পার্বত্য শান্তিচুক্তির প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া | বিচিত্র বিষয়াবলী | বাংলা রচনা সম্ভার

পার্বত্য শান্তিচুক্তির প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া | বিচিত্র বিষয়াবলী | বাংলা রচনা সম্ভার ,  ভূমিকা : প্রায় দুই যুগ ধরে আত্মঘাতী তৎপরতায় লিপ্ত শান্তিবাহিনীর সাথে সাবেক আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর চূড়ান্ত শান্তিচুক্তি সম্পাদন করেছে। শান্তির অন্বেষায় শান্তিবাহিনীর রাজনৈতিক সংগঠন জনসংহতি সমিতির সাথে দীর্ঘ আলোচনা ও অবশেষে শান্তিচুক্তি দেশের অভ্যন্তরীণ আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যথেষ্ট প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছে। এ ব্যাপারে ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’ পত্রিকা মন্তব্য করে, ‘এই শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ দীর্ঘদিনের একটি বিদ্রোহের অবসান ঘটিয়েছে।

পার্বত্য শান্তিচুক্তির প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া | বিচিত্র বিষয়াবলী | বাংলা রচনা সম্ভার

পার্বত্য শান্তিচুক্তির প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া

ইউনেস্কো বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ঐতিহাসিক পার্বত্য শান্তিচুক্তি সম্পাদন করে এ অঞ্চলের বিরাজিত দীর্ঘদিনের রক্তপাত ও জাতিগত সহিংসতা অবসানের স্বীকৃতিস্বরূপ শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করেছে।

পার্বত্য শান্তিচুক্তির প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া | বিচিত্র বিষয়াবলী | বাংলা রচনা সম্ভার

 

ইতিহাসের ধারাবাহিকতা : পার্বত্য চট্টগ্রামের অশান্তির ইতিহাস দীর্ঘ, মর্মান্তিক এবং রক্তাক্ত। এ এলাকায় উপজাতীয় বসতি স্থাপিত হয় কয়েক শতাব্দী পূর্বে । ১৪১৮ সালে চাকমা রাজা মুআন সিনী বার্মা থেকে বিতাড়িত হয়ে কক্সবাজারের রামু ও টেকনাফ এলাকায় আশ্রয় গ্রহণ করেন। পরে চাকমা ও মগরা (মার্মা) পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যান্য অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে। ১৬৬৬ সালে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের সময় পার্বত্য চট্টগ্রাম মুঘল শাসনাধীনে আসে। এরপর বাঙালিরা চাকমা রাজার আমন্ত্রণে সমতল ভূমি থেকে পার্বত্য এলাকায় বসবাস করতে শুরু করে।

১৯২০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামকে ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেলের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকা ঘোষণা করে বিশেষ মর্যাদা দেয়া হয়। অতঃপর ১৯৫৭ সালে র‍্যাডক্লিফ মিশন পার্বত্য চট্টগ্রামকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করে। ১৯৬০ সালে পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের পর কাপ্তাই কৃত্রিম হ্রদ সৃষ্টি হলে বিপুলসংখ্যক উপজাতীয় পরিবার তাদের ফসলি জমি ও বাস্তুভিটা হারায়। তৎকালীন পাকিস্তান সরকার উপজাতীয়দের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করলেও উপজাতীয়দের কাছে এটি একটি গভীর ক্ষত হিসেবে কাজ করে।

১৯৭১ সালের স্বাধীনতার পর পার্বত্য চট্টগ্রামে এক নতুন সংকট সৃষ্টি হয়। ১৯৭২ সালে উপজাতীয় নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা বাংলাদেশের খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির কাছে ও তৎকালীন গণপরিষদে পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য বিশেষ মর্যাদা ও স্বায়ত্তশাসনের দাবি জানিয়ে ব্যর্থ হন।

অতঃপর শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ১৯৭৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি সকল উপজাতিকে বাঙালি হওয়ার পরামর্শ দিলে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে গঠন করেন ‘শান্তি বাহিনী’ নামক জনসংহতি সমিতির সশস্ত্র শাখা। শান্তি বাহিনীর জন্ম ও বিকাশের মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িদের আত্মরক্ষার সংগ্রামের রাজনৈতিক কৌশল সশস্ত্র রূপ লাভ করে। ‘৬০, ‘৭০ ও ‘৮০-এর দশকে মানবেন্দ্র লারমা ছাড়াও পার্বত্য চট্টগ্রামে জুমু জাতীয়তাবাদের বিকাশে যারা বিশেষ ভূমিকা পালন করেন তাদের অন্যতম হলেন বিহারী খাসা, জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমা, বীরেন্দ্র কিশোর রোয়াজা প্রমুখ।

অতীত শান্তি আলোচনা : পার্বত্য সশস্ত্র সংঘাত অবসানের লক্ষ্যে জনসংহতি সমিতির সঙ্গে প্রথম আলোচনা শুরু হয় ১৯৮৫ সালে, জেনারেল এরশাদের শাসনামলে। ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত মূলত সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে জনসংহতি সমিতির এই শান্তি আলোচনা চলে। এ সময় ১৯৮৯ সালের ২ জুলাই পার্বত্য চট্টগ্রাম স্থানীয় সরকার পরিষদ আইনের অধীনে তিন পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদ গঠন করা হয়। এই পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচনের ব্যবস্থা রাখা হয় উপজাতীয়দের মধ্য থেকে। প্রতি জেলায় ৩০ জন সদস্য রাখা হয় যার, এক-তৃতীয়াংশ বাঙালি এবং দুই-তৃতীয়াংশ বিভিন্ন উপজাতীয় জনগোষ্ঠী থেকে। কিন্তু সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন শান্তিবাহিনী এই সরকারের তীব্র বিরোধিতা শুরু করলে পরিষদের হাতে যে ২২ ধরনের ক্ষমতা হস্তান্তর হওয়ার কথা ছিল তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় ।

১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতাসীন হবার পর ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত শান্তিবাহিনীর সঙ্গে ১৩ দফা বৈঠক হয়েছে। তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী কর্নেল অলি আহমেদের নেতৃত্বাধীন একটি জাতীয় কমিটি এই শান্তি আলোচনা পরিচালনা করে। এ পর্যায়ের শান্তি আলোচনায় বামপন্থী নেতা রাশেদ খান মেননও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তবে উপরোক্ত দু পর্যায়ে কোনো বৈঠকেই সমস্যার কোনো ইতিবাচক সমাধান বেরিয়ে আসেনি।

আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৯৬ সালের ২২ জুন ক্ষমতায় বসার পর আবার নতুন করে শান্তিবাহিনীর সঙ্গে আলোচনা শুরুর উদ্যোগ নেয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি স্থাপন এবং সমস্যার রাজনৈতিক সমধানের লক্ষ্যে ‘৯৬ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১১ সদস্যের একটি জাতীয় কমিটি গঠন করেন। কমিটির প্রধান হিসেবে মনোনীত হন চিফ হুইপ আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ। শান্তি আলোচনার পাশাপাশি ১৯৯৭ সালের ১ আগস্ট থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্ত্র বিরতি শুরু হয়। সরকারের সাথে আলোচনাকালে জনসংহতি সমিতি ৫ দফা দাবি পেশ করে। দাবিগুলো নিম্নরূপ :

১. বাংলাদেশের সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামকে একটি নির্বাচিত আঞ্চলিক পরিষদের কর্তৃত্বাধীন পৃথক স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের মর্যাদা প্রদান, যার নাম হবে জুম্বুল্যান্ড।

২. পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিসত্তাসমূহের জাতিগত সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান ।

৩. ১৯৪৭-এর ১৪ আগস্টের পর থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে অনুপ্রবেশকারী বহিরাগতদের প্রত্যাহার। পার্বত্য ভূমির ওপর পাহাড়ি স্বত্বের স্বীকৃতি ।

৪. বিডিআর ক্যাম্প ব্যতীত পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সামরিক ও আধাসামরিক বাহিনীর সকল ক্যাম্প ও সেনানিবাস তুলে নেয়া।

৫. ১৯৬০ সালের পর থেকে যেসব পাহাড়ি চট্টগ্রাম ছেড়ে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে, তাদের দেশে ফিরিয়ে আনা। জনসংহতি সমিতির সদস্যদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত সকল আইনি অভিযোগ প্রত্যাহার এবং তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা ।

পার্বত্য শান্তিচুক্তির প্রধান বৈশিষ্ট্য : মোট ২৬টি বৈঠক শেষে সরকার ও জনসংহতি সমিতির মধ্যে ঐতিহাসিক পার্বত্য শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, মন্ত্রীবর্গ, সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান এবং জনসংহতি সমিতির নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। চুক্তিতে সই করেন পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক জাতীয় কমিটির চেয়ারম্যান আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ ও জনসংহতি সমিতির পক্ষে জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা)। শান্তিচুক্তির প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো হলো :

১. চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটি : চুক্তিতে উভয় পক্ষ পার্বত্য চট্টগ্রামকে উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে বিবেচনা করে এই অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ এবং এ অঞ্চলের সার্বিক উন্নয়ন অর্জন করার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেছেন। চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠিত হবে। প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক মনোনীত একজন সদস্য হবেন এর আহ্বায়ক। অন্য দুজন সদস্য হবেন টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যান কল্পরঞ্জন চাকমা এমপি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি সন্তু লারমা ।

স্বাক্ষরের পর থেকেই চুক্তি বলবৎ হয়েছে। এ চুক্তিতে পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদের নাম পরিবর্তন করে পার্বত্য জেলা পরিষদ করা হয়েছে। অ-উপজাতীয় বলে তাকে চিহ্নিত করা হয়েছে, যিনি উপজাতীয় নন এবং পার্বত্য জেলায় যার বৈধ জমি আছে এবং যিনি পার্বত্য জেলার সুনির্দিষ্ট ঠিকানায় সাধারণত বসবাস করেন। চুক্তিতে ১৯৮৯ সালের রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান স্থানীয় সরকার পরিষদ আইন তিনটির বিভিন্ন ধারা পরিবর্তন, সংশোধন ও সংযোজন করার ব্যাপারে উভয় পক্ষ একমত হয়েছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

২. ভূমি প্রসঙ্গ : পার্বত্য জেলা এলাকাধীন বন্দোবস্তযোগ্য খাসজমিসহ কোনো জায়গাজমি পরিষদের পূর্ব-অনুমোদন ছাড়া ইজারা প্রদানসহ বন্দোবস্ত, ক্রয়-বিক্রয় ও হস্তান্তর করা যাবে না। তবে রক্ষিত বনাঞ্চল, কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প এলাকা, বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ এলাকা, রাষ্ট্রীয় শিল্প- কারখানা ও সরকারের নামে রেকর্ডকৃত ভূমির ক্ষেত্রে এ বিধান প্রযোজ্য হবে না। পার্বত্য জেলা পরিষদের নিয়ন্ত্রণ ও আওতাধীন কোনো প্রকার জমি, পাহাড় ও বনাঞ্চল পরিষদের সাথে আলোচনা ও এর সম্মতি ব্যতিরেকে সরকার কর্তৃক অধিগ্রহণ ও হস্তান্তর করা যাবে না।

আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

কাপ্তাই হ্রদের জলে ভাসা জমি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে জমির মূল মালিকদের বন্দোবস্ত দেয়া হবে । পরিষদ ভূমি উন্নয়ন কর আদায় করবে এবং আদায়কৃত কর পরিষদের তহবিলে থাকবে। সরকার প্রণীত কোনো আইন পরিষদের বিবেচনায় ‘কষ্টকর’ বা ‘আপত্তিকর’ হলে লিখিত আবেদন পেলে সরকার তা বিবেচনা করতে পারবে। পরিষদের বিষয়সমূহের মধ্যে বৃত্তিমূলক শিক্ষা, মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা ও মাধ্যমিক শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

৩. পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদ : তিন জেলার স্থানীয় সরকার পরিষদ আইন সংশোধন ও সংযোজন করে তিন জেলা পরিষদের সমন্বয়ে একটি আঞ্চলিক পরিষদ গঠন করা হবে। পার্বত্য জেলা পরিষদগুলোর সদস্যদের দ্বারা পরোক্ষভাবে এই পরিষদেও চেয়ারম্যান নির্বাচিত হবেন। তিনি একজন উপজাতীয় হবেন এবং তার পদমর্যাদা হবে প্রতিমন্ত্রীর সমতুল্য । পরিষদের চেয়ারম্যানসহ সদস্য থাকবেন ২২ জন। এদের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ হবেন উপজাতীয় পরিষদের গঠন হবে নিম্নরূপ : চেয়ারম্যান ১ জন, উপজাতীয় সদস্য (পুরুষ) ১২ জন, উপজাতীয় সদস্য (মহিলা) ২ জন, অ-উপজাতীয় সদস্য (পুরুষ) ৬ জন ও অ-উপজাতীয় সদস্য (মহিলা) ১ জন।

উপজাতীয় পুরুষ সদস্যদের মধ্য থেকে ৫ জন নির্বাচিত হবেন চাকমা উপজাতি থেকে, ৩ জন মার্মা উপজাতি থেকে, ২ জন ত্রিপুরা উপজাতি থেকে, ১ জন মুরং ও তংচঙ্গা উপজাতি থেকে এবং ১ জন লুসাই, বোম, পাংখো, খুমী, চাক ও লিয়াং উপজাতি থেকে। অ-উপজাতীয় পুরুষ সদস্যদের মধ্য থেকে প্রত্যেক জেলা থেকে দুজন করে নির্বাচিত হবেন। উপজাতীয় মহিলা সদস্য নিয়োগের ক্ষেত্রে চাকমা উপজাতি থেকে একজন ও অন্যান্য উপজাতি থেকে একজন নির্বাচিত হবেন। পরিষদের মহিলাদের জন্য তিনটি আসন সংরক্ষিত রাখা হবে এক-তৃতীয়াংশ অ-উপজাতীয় থেকে ।

তিন পার্বত্য জেলার চেয়ারম্যানগণ পদাধিকারবলে পরিষদের সদস্য হবেন। পরিষদের মেয়াদ হবে ৫ বছর। পরিষদে সরকারের যুগ্মসচিব সমতুল্য একজন মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা থাকবেন এবং এতে উপজাতীয় প্রার্থীকে অগ্রাধিকার দেয়া হবে। পরিষদ তিনটি পার্বত্য জেলা পরিষদের অধীনে পরিচালিত সকল উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সমন্বয় সাধন করাসহ তিনটি পার্বত্য জেলা পরিষদের আওতাধীন ও এদের ওপর অর্পিত বিষয়াদি সঠিক তত্ত্বাবধান ও সমন্বয় করবে। আঞ্চলিক পরিষদের সিদ্ধান্তই হবে চূড়ান্ত।

পৌরসভাসহ স্থানীয় পরিষদসমূহও এই পরিষদের তত্ত্বাবধানে থাকবে। এছাড়া প্রশাসন, পরিষদ আইনশৃঙ্খলা উন্নয়ন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, এনজিওদের কার্যাবলীর সমন্বয় সাধন, উপজাতীয় আইন ও সামাজিক বিচার পরিচালনা এবং ভারী শিল্পের লাইসেন্স প্রদান করবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম বোর্ড পরিষদের তত্ত্বাবধানে থাকবে। সরকার একজন উপজাতীয়কে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এর চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ করবেন। ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি অন্যান্য সংশ্লিষ্ট আইনে কোনো অসঙ্গতি থাকলে তা দূর করা হবে।

আঞ্চলিক পরিষদ গঠিত না হওয়া পর্যন্ত সরকার অন্তর্বর্তীকালীন আঞ্চলিক পরিষদ গঠন করে নিম্নোক্ত উৎস থেকে পরিষদের তহবিল গঠিত হবে : জেলা পরিষদ, পরিষদের ওপর ন্যস্ত সম্পত্তি, সরকার বা অন্যান্য কর্তৃপক্ষের ঋণ ও অনুদান, কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি কর্তৃক প্রদত্ত অনুদান, পরিষদের অর্থ বিনিয়োগ থেকে মুনাফা, পরিষদ থেকে প্রাপ্ত যে কোনো অর্থ, সরকারের নির্দেশে পরিষদের ওপর ন্যস্ত অন্যান্য আয়ের উৎস থেকে প্রাপ্ত অর্থ ।

৪. পুনর্বাসন ও সাধারণ ক্ষমা : চুক্তি মোতাবেক শরণার্থী প্রত্যাবাসন অব্যাহত থাকবে এবং একটি টাস্কফোর্সের মাধ্যমে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে। ভূমি জরিপ কাজ শুরু করার ব্যাপারে চুক্তিতে উভয় পক্ষ একমত হন। এছাড়া জায়গাজমি বিষয়ে বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠন করা হবে। উপজাতীয় শরণার্থীদের ঋণ-সুদ মওকুফ করা হবে। চাকরি ও উচ্চশিক্ষার জন্য কোটা ব্যবস্থা বহাল থাকবে। উপজাতীয় কৃষ্টি ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখা হবে।

৫. যে সকল বিষয় জেলা পরিষদের অধীনে থাকবে : পার্বত্য জেলা পরিষদের কার্য ও দায়িত্বের মধ্যে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত থাকবে ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, পুলিশ, উপজাতীয় আইন ও সামাজিক বিচার, যুবকল্যাণ, পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন, স্থানীয় পর্যটন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষন ব্যতীত ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট ও অন্যান্য স্থানীয় শাসন সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠান, স্থানীয় শিল্প-বাণিজ্যের লাইসেন্স প্রদান, কাপ্তাই হ্রদের জলসম্পদ ব্যতীত অন্যান্য নদী-নালা, খাল-বিলের সুষ্ঠু ব্যবহার ও সেচ ব্যবস্থা, জন্ম-মৃত্যু অন্যান্য পরিসংখ্যান সংরক্ষণ, মহাজনি কারবার ও জুম চাষ ।

জেলা পরিষদ যে সকল সূত্র ও ক্ষেত্র থেকে কর, টোল ও ফিস ইত্যাদি আদায় করতে পারবে সেগুলো হলো : অযান্ত্রিক যানবাহনের রেজিস্ট্রেশন ফি, পণ্য জন্য-বিক্রয়ের ওপর কর। ভূমি ও দালান-কোঠার ওপর হোল্ডিং কর, গৃহপালিত পশু বিক্রয়ের কর, সামাজিক বিচারের ফিস, সরকারি ও বেসরকারি শিল্প প্রতিষ্ঠানের ওপর হোল্ডিং কর, বনজ সম্পদের ওপর বয়্যালটির অংশবিশেষ, সিনেমা, যাত্রা, সার্কাস ইত্যাদির ওপর সম্পূরক কর, খনিজসম্পদ অন্বেষণ বা  নিষ্কর্ষণের উদ্দেশ্যে সরকার কর্তৃক প্রদত্ত অনুজ্ঞাপত্র বা পাট্টাসমূহ সূত্রে প্রাপ্ত রয়্যালটির অংশবিশেষ, ব্যবসা, লটারি ও মৎস্য ধরার ওপর কর। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হলে অ- উপজাতীয়কে সংশ্লিষ্ট সার্কেল প্রধানের সার্টিফিকেট সংগ্রহ করতে হবে।

জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের শপথ করাবেন একজন বিচারপতি। জেলা পরিষদের মেয়াদ বর্ধিত হবে তিন বছরের স্থলে পাঁচ বছর। পরিষদের সভায় চেয়ারম্যানের অনুপস্থিতিতে শুধু উপজাতীয় সদস্য সভাপতিত্ব করতে পারবেন। পরিষদের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা সচিব হবেন একজন উপসচিবের সমকক্ষ। এ পদে উপজাতীয় কর্মকর্তাদের অগ্রাধিকার দেয়া হবে। পরিষদ বিভিন্ন কর্মকর্তা ও কর্মচারীর পদ সৃষ্টি করবে। তবে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর পদে নিয়োগ করতে পারবে এবং তাদের বদলি ও অপসারণ ইত্যাদি এর ওপর ন্যস্ত হবে। কিন্তু কর্মকর্তাদের নিয়োগ করবে সরকার। তাদের বদলি, বরখাস্ত ইত্যাদিও সরকারই স্থির করবে।

চুক্তিতে জেলা পরিষদগুলোকে বাজেট প্রণয়নের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। পরিষদের কার্যকলাপের সামঞ্জস্য সাধনের নিশ্চয়তা বিধানের জন্য সরকার পরিষদকে পরামর্শ প্রদান ও অনুশাসন এবং প্রয়োজনে তথ্য ও ব্যাখ্যা চাওয়া এবং পরামর্শ বা নির্দেশ দিতে পারবে। পরিষদ বাতিলের ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান চুক্তিতে রাখা হয়েছে। পরিষদ পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর ও অধস্তন স্তরের সকল সদস্যকে নিয়োগ করবে এবং এক্ষেত্রে উপজাতীয়গণ অগ্রাধিকার পাবে।

উপরোক্ত বিশ্লেষণ থেকে যেসব উল্লেখযোগ্য দিক পরিলক্ষিত হয় সেগুলো হলো :

পার্বত্য চট্টগ্রামকে উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে বিবেচনা করা হবে। স্বাক্ষরের পর থেকেই চুক্তি বলবৎ হবে । বিডিআর ও স্থায়ী সেনানিবাস (তিন জেলা সদরে তিনটি এবং আলী কলম, রুমা ও দীঘিনালা) ব্যতীত সামরিক বাহিনী, আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর সকল অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামে সকল সরকারি, আধা-সরকারি, পরিষদীয় ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে সকল স্তরে নিয়োগে উপজাতীয়দের অগ্রাধিকার দেয়া হবে । পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের গঠন করা হবে। একজন উপজাতীয় এই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হবেন।

রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদ আইনসমূহ পরিবর্তন, সংশোধন, সংযোজন ও অবলোকন করা হবে। পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদের নতুন নাম হবে পার্বত্য জেলা পরিষদ। প্রতি জেলা পরিষদের তিনটি মহিলা আসনের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ অ-উপজাতীয়দের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। পরিষদের সাথে আলোচনা ছাড়া সরকার কোনো জমি, পাহাড় ও বনাঞ্চল অধিগ্রহণ ও হস্তান্তর করবে না। কাপ্তাই হ্রদের জলে ভাসা জমি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে জমির মূল মালিকদের বন্দোবস্ত দেয়া হবে। মাতৃভাষার মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা চালু হবে।

তিন জেলা সমন্বয়ে ২২ সদস্যবিশিষ্ট পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ গঠন করা হবে। এর মেয়াদ হবে ৫ বছর। পার্বত্য জেলা পরিষদের নির্বাচিত সদস্যদের দ্বারা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হবেন। তার পদমর্যাদা হবে একজন প্রতিমন্ত্রীর সমকক্ষ এবং তিনি হবেন উপজাতীয়। পরিষদের মুখ্য কর্মকর্তা হবেন একজন যুগ্ম সচিব পর্যায়ের ব্যক্তি। উপজাতীয় প্রার্থীকে অগ্রধিকার দেয়া হবে । আঞ্চলিক পরিষদ তিন জেলা পরিষদের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সমন্বয় সাধন এবং তত্ত্বাবধান করবে উপজাতীয় আইন ও সামাজিক বিচার আঞ্চলিক পরিষদের আওতাভুক্ত থাকবে এবং পরিষদ ভারী শিল্পের লাইসেন্স প্রদান করবে। ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি এবং অন্যান্য আইনে অসঙ্গতি থাকলে তা দূর করা হবে ।

পার্বত্য শান্তিচুক্তির আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাব : পার্বত্য শান্তিচুক্তির আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক প্রভাব সুদূরপ্রসারী। পার্বত্য চট্টগ্রামের আয়তন প্রায় সমগ্র দেশের এক-দশমাংশ। এখানে রয়েছে প্রচুর পরিমাণ প্রাকৃতিক সম্পদ। শান্তি বাহিনীর উপস্থিতির কারণে এতদিন এখানে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সম্ভব হয়নি । এখন সে অনিশ্চয়তার অবসান হয়েছে। শান্তি বাহিনীই এখন মূল কর্মকাণ্ডের নেতৃত্বে এসেছে। ঐ অঞ্চলের সকল কর্তৃত্ব ও উন্নয়নের ভার এখন তাদের নেতাদের হাতে অর্পিত সুতরাং রাজনৈতিক ও সামাজিক দিক দিয়ে যেমন ঐ অঞ্চলে অস্থিরতা দূর হয়েছে, তেমনি সামাজিক ক্ষেত্রে সহাবস্থানের ফলে শান্তির বার্তা নিয়ে এসেছে। ইতিমধ্যেই সরকার ঐ অঞ্চলকে বিশেষ মর্যাদা দিয়ে উন্নয়নের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে।

পঞ্চম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার এক মহা পরিকল্পনা বাস্তবায়নাধীন। তাছাড়া পার্বত্য অঞ্চলের প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ ও তার যথাযথ ব্যবহারের জন্য দাতাগোষ্ঠীর সাথে সংলাপ শুরু হয়েছে। পার্বত্য অঞ্চলের ভূমি উন্নয়ন, শিল্প-কারখানা স্থাপন, আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো, প্রশাসন প্রভৃতি উপজাতীয়দের হাতে অর্পণ করায় তারা নিজেরাই নিজেদের ভাগ্য উন্নয়নে সচেষ্ট হয়েছে। সরকার ভূমি কটন, পুনর্বিন্যাস, প্রশাসনিক সংস্কার, স্থানীয় সরকার গঠন ও বিশেষ মন্ত্রণালয় গঠনের মতো যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে তা ঐ অঞ্চলের আর্থ- সামাজিক উন্নয়নে উৎসাহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছে। এসব উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে পাহাড়ি ও বাঙালিদের যৌথ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা গেলে পার্বত্য চট্টগ্রাম জাতীয় উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে।

এছাড়া দেশের চাকরি, শিক্ষা প্রভৃতি ক্ষেত্রে তাদের জন্য কোটা নির্বাচন ও পার্বত্য অঞ্চলে এক্ষেত্রে তাদের বিশেষ সুবিধা দানের ফলে তারা অগ্রসর জাতিতে পরিণত হওয়ার সুযোগ পেয়েছে, যা দেশের সার্বিক উন্নয়নে সকল জনশক্তির সুষ্ঠ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেছে। দেশের সকল নাগরিক সমান মর্যাদার অধিকারী এবং জাতীয় উন্নয়নে সকলের অংশগ্রহণের ফলে দেশের আরেক ধাপ অগ্রগতির সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে । মোট কথা, পার্বত্য শান্তিচুক্তি একটি অনিবার্য রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং এর সফল বাস্তবায়নই দেশ তথা পার্বত্য অঞ্চলে শান্তির সুবাতাস ও স্থিতিশীলতা আনয়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে ।

পার্বত্য শান্তিচুক্তির প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া | বিচিত্র বিষয়াবলী | বাংলা রচনা সম্ভার

 

উপসংহার : পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ এখন অরাজকতা ও অস্থিতিশীলতা থেকে পরিত্রাণ পেতে চায়। সংঘাতের পরিবর্তে চায় সহাবস্থান, যাতে থাকবে পারস্পরিক উপলব্ধি আর সংবেদনশীলতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত । এই প্রত্যাশার ফলে যদি পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে সৌন্দর্যের রানী পার্বত্য চট্টগ্রাম দেশী-বিদেশী সকলের কাছে এক আকর্ষণীয় ক্ষেত্র হিসেবে পরিগণিত হবে। পর্যটন ক্ষেত্র হিসেবে যেমন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে, তেমনি পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূখণ্ডে থাকা প্রাকৃতিক গ্যাস ও তেল উত্তোলনের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নও নিশ্চিত হবে।

 

আরও দেখুন:

Leave a Comment