পরিবেশ দূষণ ও প্রতিকার সম্পর্কে টেলিভিশন ভাষণ

পরিবেশ দূষণ ও প্রতিকার সম্পর্কে টেলিভিশন ভাষণের একটা নমুনা তৈরি করে দেয়া হল। আপনি এখান থেকে ধারণা নিয়ে নিজের মতো করে ভাষণটি রচনা করবেন।

পরিবেশ দূষণ ও প্রতিকার সম্পর্কে টেলিভিশন ভাষণ

প্রিয় দেশবাসী— সকলের প্রতি আমার আন্তরিক সালাম ও শুভেচ্ছা।

আজ সময়োপযোগী একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দু-চার কথা বলার জন্য আপনাদের সামনে উপস্থিত হয়েছি। দূষণমুক্ত পরিবেশ আপনার, আমার সকলের দাবি। পরিবেশ মানবসভ্যতার এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। মানুষের চালচলন, আচার- ব্যবহার, শিক্ষা-সংস্কৃতি ইত্যাদিতে পরিবেশের ব্যাপক প্রভাব পড়ে। পরিবেশের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে মানব, উদ্ভিদ ও প্রাণী-জীবনের বিকাশ ঘটে। তাই পরিবেশ ও জীবনের মধ্যে রয়েছে এক নিবিড় যোগসূত্র। দেশের প্রতিটি মানুষের তথা- বিশ্বের সব মানুষের আকুতি দূষণমুক্ত বাতাস, প্রদীপ্ত সূর্যের আলো, প্রাণবন্ত নির্মল পরিবেশ, প্রাণধারণের অবলম্বন, একটি নিরাপদ কলুষমুক্ত সুন্দর পৃথিবী। তাই আবারও কবিকণ্ঠে সুর মিলিয়ে ছন্দোবদ্ধ আকুল প্রার্থনা—

‘অন্ন চাই, প্রাণ চাই, আলো চাই, চাই মুক্ত বায়ু / চাই বল, চাই স্বাস্থ্য, আনন্দ-উজ্জ্বল পরমায়ু। ‘

সুধী, নানা কারণে পরিবেশদূষণ সমস্যা প্রকট হওয়ায় মানবসভ্যতা আজ চরম হুমকির সম্মুখীন। আর পৃথিবীকে এসব সমস্যায় ফেলবার সকল কৃতিত্ব (?) আমাদের। নিজেদের অবিবেচনামূলক কর্মকাণ্ড দ্বারা আমরা নিজেরাই যেন নিজেদের সর্বনাশ করার খেলায় মেতে আছি। আমাদের কে থামাবে? উপস্থিত সুধীবৃন্দ, আপনারা আমার সঙ্গে একমত হবেন যে, এই বিশাল জগৎ সংসারে মানুষই একমাত্র জীব যারা প্রকৃতির নিয়ম-নীতি ভেঙে নিজের আরাম-আয়েশের জন্য পৃথিবীতে সৃষ্টির উপায় উপকরণের যথেচ্ছ ব্যবহার করে। আর এই যথেচ্ছ ব্যবহারের কারণে পৃথিবী আজ চরম বিপর্যয়ের মুখোমুখি।

পরিবেশ দূষণ ও তার প্রতিকার [ Environmental pollution and remedies ]

 

মানুষের বসবাসের জন্য পৃথিবীর আদিম পরিবেশ বা প্রাকৃতিক পরিবেশ স্বাভাবিক রাখা প্রয়োজন, প্রয়োজন দূষণমুক্ত রাখা। সুধী, জীবন ও পরিবেশ এক ও অভিন্ন বিষয়। জীবন বাঁচাতে হলে পরিবেশকেও বাঁচাতে হবে। পরিবেশ নিয়ে তাই বিশ্বব্যাপী কথা হচ্ছে, আলোচনা চলছে, চুক্তি হচ্ছে। প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী ৫ জুন পরিবেশ দিবস হিসেবে পালিত হয়। অন্যান্য দেশের সঙ্গে এ-বছরও ৫ জুন আমাদের দেশে বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালিত হচ্ছে। সুস্থ, সুন্দর ও স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে বাঁচার জন্য আমরা ৭ এপ্রিল বিশ্ব স্বাস্থ্যদিবসও পালন করি। প্রসঙ্গটি এ কারণে আনা যে, সুস্বাস্থ্যের জন্য দূষণমুক্ত পরিবেশ অনিবার্য শর্ত।

বিশেষজ্ঞদের মতে আমরা প্রতিনিয়ত যে সব স্বল্প দীর্ঘমেয়াদী রোগ ও শারীরিক অসুস্থতা ভোগ করি তার সবকটির মূলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দায়ী পরিবেশ দূষণই। সুধী, এই পরিবেশদূষণ যে রাতারাতি শুরু হয়েছে- তা নয়। সভ্যতার আদিলগ্ন থেকেই পরিবেশদূষণের সূত্রপাত ঘটে। আগুন আবিষ্কার ও তার ব্যবহারের শুরু থেকেই প্রাণপ্রদায়ী অক্সিজেনের ধ্বংস শুরু হয়। সেই অক্সিজেন ধ্বংসের সঙ্গে সঙ্গে ধোঁয়া এবং ভস্মকণায় কলুষিত হয় পরিবেশ। বিশ্বের অন্য বহু দেশের মতো বাংলাদেশেও পরিবেশের বারোটা বাজাবার কাজ চলে আসছে দীর্ঘকাল ধরে। কোনো কোনো দিক দিয়ে তো বাংলাদেশ অন্য সকল দেশকে পেছনে ফেলে দিয়েছে।

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা বিশ্বের অন্যতম দূষিত নগরী। পরিবেশ দূষণের নানাবিধ কারণ রয়েছে। তন্মধ্যে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, বনজ সম্পদের বিনাশ, বায়ুদূষণ, পানিদূষণ, শব্দদূষণ এবং গ্রিন হাউস প্রতিক্রিয়ার বিরূপ প্রভাব উল্লেখযোগ্য। উল্লিখিত বিষয়গুলোর মাধ্যমে কীভাবে পরিবেশ দূষণ ঘটে- তা এখন জানা দরকার। বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি দেশের মোট আয়তনের শতকরা ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা উচিত। কিন্তু নির্বিচারে বৃক্ষ কর্তনের ফলে আমাদের দেশে রয়েছে মোট আয়তনের শতকরা ১৬ ভাগ মাত্র। বনভূমির এই পরিমাণ; একটি উন্নয়নশীল দেশের প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। সুধিবৃন্দ, নির্বিচারে বন উজাড় করার ফলে বিলুপ্তি ঘটছে বহু প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণিকুলের। বিপন্ন আজ জীববৈচিত্র্য। ফলে দূষণযুক্ত এক অসহনীয় পরিবেশের মধ্য দিয়ে আমরা প্রাত্যহিক জীবনযাপন করছি।

বায়ু দূষণ, শব্দ দূষণ, শিল্প দূষণের ভয়াবহতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাড়ছে আর্সেনিকের মৃত্যুছোবল। ঢাক-ঢোল পিটিয়ে পলিথিন বিরোধী অভিযান চালিয়ে পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ করা হয়েছিল বটে কিন্তু নিষিদ্ধ পলিথিন আবার ভিন্ন রঙে, ভিন্ন আকারে বাজারে দেখা যায়। বিকট শব্দ সৃষ্টিকারী হাইড্রোলিক হর্নের ব্যবহারও নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলেও তা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করা সম্ভব হয় নি। এখনও রাস্তার মোড়ে মোড়ে বিকট শব্দে মাইক বাজে; গভীর রাতে মাইকের শব্দ, গানবাজনার শব্দ (মধ্যরাতে অথবা সারারাত এমনভাবে লাউড স্পিকার লাগিয়ে গানবাজনা করা হয় যেন আশেপাশে কেউ আর না ঘুমুতে পারে!), অথচ গভীর রাতে মাইকের শব্দে শিশু ও রোগীরা নিদ্রাহীন অবস্থায় বিছানায় ছটফট করে, পড়ার টেবিলে পরীক্ষার্থীদের মনোযোগ বার বার বিনষ্ট হয়।

আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

আজকাল যানবাহনের কালো ধোঁয়ার অত্যাচার রাজধানীর সীমানা ডিঙিয়ে মফস্বল হয়ে বহু গ্রামেও হানা দিতে শুরু করেছে। শত শত অপরিকল্পিত ইটের ভাটার ধোঁয়ায় প্রতিদিন পরিবেশ হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্ত; পাহাড় ও টিলা কেটে পরিবেশের বারোটা বাজানোর কাজেও আমাদের উৎসাহের কমতি নেই। সম্মানিত সুধীবৃন্দ,শহরের যেখানে সেখানে দেখা যায় আবর্জনার স্তূপ। আমরাও নির্বিচারে যত্রতত্র আবর্জনা ফেলি দিই। দুর্গন্ধময় হয়ে ওঠে পরিবেশ। নাকে রোমাল চাপা দিয়ে পাশ কেটে চলি স্বার্থপরের মতো, বিবেক সাড়া দেয় না। যেন এই পৃথিবী আমার নয়। অথচ একটু সতর্ক হলে, একটু সচেতন হলেই আমাদের পরিবেশকে আমরা সুস্থ-সুন্দর রাখতে পারি। পয়ঃপ্রণালির অব্যবস্থাপনার কথা তো বলাই বাহুল্য। এ-অব্যবস্থাপনায় লুক্কায়িত আছে যুগ যুগের অনিয়ম। কী সেই অনিয়ম? প্রশাসনের কাছে জানতে চাইলে তার কোনো উত্তর মেলে না।

রূপকথার কাহিনির মতো সে গুপ্তরহস্য। পরিবেশের কথা, জনগণের দুর্ভোগের কথা না ভেবেই বছরের পর বছর শহরের কোনো না কোনো স্থানে চলছে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি। এ যেন গুপ্ত রহস্যের সন্ধান চলছে অথচ সন্ধান মেলছে না। চলছে নির্মাণ-বিনির্মাণের কাজ – জাদুর কাঠির মতো সে কাজ কেবল বেড়েই চলছে, কমে না! বছরের পর বছর এ-কর্ম জনগণের মন-প্রাণকে বিষিয়ে দিয়েছে। অবশ্য এখন অনেকটা নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে সবাই নিরবে-নিঃশব্দে অসহায় পথ চলে, কোনো কথা বলে না। পরিবেশের বিরুদ্ধে যত ধরনের অনিয়ম তার সবই যেন এখন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুধী, পরিবেশ-প্রকৃতিকে আমরা ভেবে নিয়েছি খোদার নেয়ামত, প্রকৃতির দান।

তাই নির্দয়ভাবে পরিবেশের উপর চালাচ্ছি অত্যাচার অনাচার। সর্বংসহা ধরিত্রীর বুক চিরে বৃষ্টি ঝড়ে— পরিবেশ শান্ত হয় না, — অনাদর, অবহেলা পেয়ে প্রচণ্ড সূর্যদাহে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরু। সর্বংসহা ধরিত্রীর নিরাপদ কোমল-আশ্রয় থেকে ক্রমেই ছিটকে পড়ছে মানুষ। মানুষ এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে পরিবেশের বিরূপ প্রভাব কতটা ভয়াবহ। সিডর ও আইলার মতো মহা প্রলয় আমাদেরকে তা-ই জানিয়ে দিয়ে গেছে, সাবধান করে দিয়েছে। ইতোমধ্যেই বিশ্ব পরিবেশে দেখা দিয়েছে গ্রিনহাউস প্রতিক্রিয়া। গ্রিনহাউস প্রতিক্রিয়ার ফলে যে ব্যাপক ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে তাতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের উপকূলবর্তী ও নিম্নাঞ্চল বা সাগরের দ্বীপাঞ্চলগুলোর তলিয়ে যাবার আশঙ্কা রয়েছে।

এরইমধ্যে পরিবেশ বিপর্যয়ের ফলে পৃথিবী থেকে চিরতরে বিদায় নিতে হয়েছে ৭৬ রকমের প্রাণী ও কয়েক হাজার রকমের গাছপালা। বহু এলাকা পরিণত হয়েছে মরুভূমিতে। সুধীবৃন্দ, বস্তুত পরিবেশ রক্ষা নিয়ে যত মাতামাতি, বাস্তবচিত্র তার বিপরীত। আপনারা জানেন যে, বাংলাদেশের পৌর এলাকাগুলোতে প্রতিদিন প্রায় ১৭ হাজার মেট্রিক টন বর্জ্য উৎপন্ন হয়। এর মধ্যে শতকরা ৫০ ভাগ বর্জ্য অপসারণ করা সম্ভব হয় না। এসব অপসারিত বর্জ্য পচে-গলে জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দেখা দেয়। তরল বর্জ্য বৃষ্টির পানির সঙ্গে মিশে গিয়ে নদ-নদী, খাল-বিল দূষিত করে। শিল্পাঞ্চলে এই দূষণ আরও বেশি।

পরিবেশ দূষণ ও তার প্রতিকার [ Environmental pollution and remedies ]

 

উন্নত দেশগুলোতে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ করে তাকে সম্পদে রূপান্তরিত করা হয়। শ্রেণিকরণের মাধ্যমে বিষাক্ত বর্জ্য ধ্বংস করে ব্যবহার উপযোগী বর্জ্যকে জৈবসারে রূপান্তরিত করা হয়। এছাড়া বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন বর্তমান বিশ্বে একটি স্বাভাবিক বিষয়। আবর্জনা থেকে যেমন সার হয় তেমনি বায়োগ্যাস উৎপাদনও সম্ভব। সুপ্রিয় সুধিসমাজ, পরিবেশদূষণের হাত থেকে বাঁচার জন্যে যা করতে হবে তা হচ্ছে, বৃক্ষনিধন নয় বরং বৃক্ষ রোপণ করে এ পৃথিবীকে সবুজের সমারোহে ভরে দিতে হবে। একই সঙ্গে কয়লা, গ্যাস ব্যবহার করতে হবে পরিমিত পরিমাণে।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি ও পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ বন্ধ করতে হবে। স্তূপীকৃত আবর্জনা নগরজীবনের জন্য যে মারাত্মক বিঘ্ন সৃষ্টি করছে তা রোধ করার জন্য বর্জ্য-আবর্জনার আধুনিক ব্যবহারের প্রতি মনোযোগী ও উদ্যোগী হতে হবে। বর্জ্যোর আধুনিক ব্যবহারের উদ্যোগ গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখার ব্যাপারে সর্বস্তরে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। তাই আসুন পরিবেশ রক্ষার মহান মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে সকলে এক সঙ্গে কাজ করি। আমাদের পরিবেশ রক্ষা করে পৃথিবীকে সুস্থ ও সবল রাখি। পরিশেষে যারা অক্লান্ত পরিশ্রম করে আজকের এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আমাকে কিছু বলার সুযোগ করে দিয়েছেন এবং এতক্ষণ যারা অসীম ধৈর্য নিয়ে আমার বক্তব্য শুনেছেন- আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ।

আরও দেখুন:

Leave a Comment