পড়ার অভ্যাস গঠন বিষয়ক প্রধান অতিথির ভাষণ | ভাষণ | ভাষা ও শিক্ষা

পড়ার অভ্যাস গঠন বিষয়ক প্রধান অতিথির ভাষণ ভাষণ রচনার একটি নমুনা তৈরি করে দেয়া হল। আগ্রহীরা এখন থেকে ধারণা নিয়ে নিজের ভাষায় নিজস্ব ভাষণ তৈরি করবেন। এই পাঠটি আমাদের “ভাষা ও শিক্ষা” বিষয়ের “ভাষণ” বিভাগের একটি পাঠ।

BanglaGOLN.com Logo 252x68 px White পড়ার অভ্যাস গঠন বিষয়ক প্রধান অতিথির ভাষণ | ভাষণ | ভাষা ও শিক্ষা

পড়ার অভ্যাস গঠন বিষয়ক প্রধান অতিথির ভাষণ

 

BanglaGOLN.com Logo 252x68 px Dark পড়ার অভ্যাস গঠন বিষয়ক প্রধান অতিথির ভাষণ | ভাষণ | ভাষা ও শিক্ষা

 

সম্মানিত সভাপতি, উপস্থিত শিক্ষকমণ্ডলী, সুধীবৃন্দ এবং শিক্ষার্থী বন্ধুগণ, আসসালামুআলাইকুম।

পড়ার অভ্যাস গঠনের মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যে সভার আলোচ্য বিষয়, সেখানে আমাকে প্রধান অতিথির পদে বসিয়ে যে সম্মান দিলেন সেজন্য আমি ধন্য ও কৃতজ্ঞ। সুধীবৃন্দ, আজকের সভার আলোচ্য বিষয় হল ‘পড়ার অভ্যাস গঠন’। বিষয়টি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণার জন্য, এ বিষয়ে দু চারটি অপ্রিয় সত্য কথা না বললেই নয়— কেননা আমরা কিন্তু সবাই কমবেশি বই পড়ি। তো, সে পড়া কখনো পরীক্ষায় পাশের জন্য, কখনো চাকরির জন্য, কখনো নিজের আনন্দ ও সময় কাটানোর জন্যও হয়ে থাকে। কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হল এখানে যত রকমের পড়ার কথা বলা হল তাতে করে বই পড়া যে ‘পড়ার অভ্যাসে রূপান্তরিত হবে না, এটি স্পষ্ট।

 

পড়ার অভ্যাস গঠন বিষয়ক প্রধান অতিথির ভাষণ

 

আর যেখানে আমরা কম-বেশি লেখাপড়া করছিই, সেখানে আবার পড়ার অভ্যাসেরই বা প্রয়োজন কেন? এখানেই বিষয়টির তাৎপর্য নিহিত। বস্তুত, পড়াটাকে আমরা নিতান্তই অতিরিক্ত বিষয় হিসেবে বিবেচনা করছি। সময় সুযোগ পেলে পড়ি, না হলে পড়ি না। ফলে আমাদের মাঝে পড়ার অভ্যাস গড়ে উঠছে না। যা দুঃখজনক। সুধী, আমরা একটি কথা সবাই জানি, ‘সুশিক্ষিত লোক মাত্রই স্বশিক্ষিত’। আমাদের সমাজে এমন অনেকেই রয়েছেন যাঁদের উচ্চতর ডিগ্রি আছে, কিন্তু দেশ ও জাতির কল্যাণে তারা কিছুই করতে পারেন নি। তাদের প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চতর ডিগ্রি থাকলেও তাঁরা স্বশিক্ষায় সুশিক্ষিত না হওয়ায় তাদের মধ্যে কখনোই মুক্তচিন্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে নি, যা দিয়ে তাঁরা দেশ ও দশের উপকার করতে পারেন। আর এই স্বশিক্ষায় সুশিক্ষিত হওয়ার জন্যই চাই বই পড়া। বেশি বেশি বই পড়া।

বই পড়ে তা অভ্যাসে রূপান্তরিত করা। কেননা শিক্ষা সম্পূর্ণভাবেই অর্জনসাপেক্ষ। সেখানে পাঠ্য বই পড়ার মাধ্যমে প্রকৃত জ্ঞানী কিংবা সুশিক্ষা বা স্বশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া যায় না। মোদ্দাকথা হলো, আমরা পড়ার উপকারিতা বুঝতে পারি, কিন্তু পড়ার অভ্যাস গঠন করতে পারছি না। তাহলে এ বোঝার সার্থকতা কোথায় ? জগতে যত বড় সাহিত্যিক, লেখক, কবি বৈজ্ঞানিক তাঁদের সবাই ছিলেন পড়ুয়া। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে কি রকম পড়ুয়া ছিলেন তা ভাবাও যায় না। ১৯২১ সালে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সারা দুনিয়া থেকে যে অসংখ্য বই আসতো তার প্রায় প্রতিটি বই তিনি নিজে পড়ে শ্রেণিবিভাগ করতেন।

যেনতেন পড়া নয়, রীতিমতো পেন্সিল দিয়ে আন্ডারলাইন করে পড়তেন। শরৎচন্দ্র ও নজরুল ভালো পড়ুয়া ছিলেন। ফরাসী ও রুশ সাহিত্যে উপর প্রচুর পড়াশোনা করেছেন। কাজী নজরুল ইসলাম ফার্সি সাহিত্যের উপর ভালো দখল ছিল। সৈয়দ মুজতবা আলীর কোরআন, বাইবেল, গীতা সবই পড়া ছিল। ড. শহীদুল্লাহর মতো বিনয়ী, বহুভাষাবিদ উপমহাদেশে কমই জন্মেছে। প্রচুর বই পড়তেন তিনি। একজন বিখ্যাত চোখের ডাক্তারের (এম. এম. মুনীরুল হক) কথা মনে পড়ে গেল, তিনি বলেন— ‘ক্যান্সারে আক্রান্তের পর বুঝেছি বই কতো আপনজন।

 

পড়ার অভ্যাস গঠন বিষয়ক প্রধান অতিথির ভাষণ

 

কোথাও যাই না, শুধু যাই বইয়ের দোকানে। অর্থের অভাবে কিনতে না পারলে ছুঁয়ে দেখি। উল্টে-পাল্টে দেখি বইকে আদর করে আনন্দ পাই। রোগ যন্ত্রণায় বেশিক্ষণ পড়তে পারি না। রাতে বালিশের পাশে বই না থাকলে কেমন একা একা লাগে। নিঃশব্দে একান্ত আপন হয়ে বই-ই কাছে থাকে। বই ছাড়া বেঁচে থাকার কথা ভাবতেই পারি না।’ সুধীবৃন্দ, মানুষের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার অনুভূতি নিজের বুকে নিয়ে অনাগত পাঠকের জন্য চির অপেক্ষমান হয়ে আছে বই। প্রাজ্ঞ ব্যক্তিদের জ্ঞানভাণ্ডার আজ মহাসমুদ্র হয়ে স্বল্পায়ু মানুষের জ্ঞান-পিপাসা মেটানোর অপেক্ষায় আছে বইয়ের রূপ ধারণ করে। জ্ঞানের মহাসমুদ্রের কল্লোল শোনা যায় বইয়ের পাতায়।

মানুষ তার আত্মার আত্মীয়ের তথা বিশ্ব মানবের সাহচর্য ও সঙ্গ লাভ করে গ্রন্থের মাধ্যমে। অনাদিকাল থেকেই- গ্রন্থ পাঠে মানুষ অনাবিল শান্তি লাভ করে আসছে। তাই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি’– বই পড়ার মাধ্যমেই আমরা মানব-চরিত্রের বৈচিত্র্য উপলব্ধি করতে পারি। বীরত্বের মহিমা, ত্যাগের উপমা, সত্যের জীবনদর্শন, ধর্মের শাহাদত, স্বার্থসিদ্ধির হীনম্মন্যতা, বিভিন্ন দেশের সামাজিক আচার-আচরণ, ঐতিহাসিক কাহিনী, ভৌগোলিক বৃত্তান্ত, বিজ্ঞানের বিস্ময়কর আবিষ্কার ইত্যাদি আমরা পড়ার অভ্যাস বা বই পড়ার মধ্য দিয়ে জানতে পারি। সম্মানিত সুধীসমাজ, শুধুমাত্র যে উচ্চশিক্ষিত, শিক্ষিত লোকেরা পড়বে আর অন্যরা পড়বে না তা কিন্তু নয়।

সবার মাঝেই পড়ার অভ্যাস গঠন করতে হবে। প্রত্যেকেই যার যার ক্ষমতানুযায়ী বই পড়বে। বিভিন্ন জ্ঞানী, গুণী, দার্শনিকের বই পড়ে নিজেদের জীবন গড়ার ক্ষেত্রে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি লাভে সমর্থ হবে মানুষ। এটাই প্রত্যাশা। নিজের দেশের ঐতিহ্য, মানুষের ঐতিহ্য, মানবিকতাবোধ, জীবনের সার্থকতা, ভোগ ত্যাগের সার্থকতা নিরূপণ এসব বিষয়ে পড়ার মাধ্যমে বাস্তব উপলব্ধি লাভ করা যায় বলে পড়ার অভ্যাস গঠনটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা পড়ার অভ্যাস বা বই পড়ার মধ্য দিয়েই বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারি। মানুষের জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্পকলা ও সাহিত্য সাধনার নীরব সাক্ষী বিশ্বের অজস্র গ্রন্থ।

বিচিত্র জাতি, দেশ ও সমাজের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্য আমাদের সকলের মধ্যে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। আর্নল্ড টয়েনবি এবং দাইসাকু ইকেদা তাঁদের লেখা সৃজনমূলক জীবনের দিকে বইতে বলেছেন, সুস্থ সমাজ গঠনে, পরিশীলিত ও রুচিবোধ সম্পন্ন মানুষ তৈরিতে সৃজনশীল পাঠ একান্ত জরুরি। পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি সৃজনশীল বই পাঠে আমাদের শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করা চাই। সৃজনশীল পাঠের মাধ্যমেই একজন মানুষ আলোর পথের সন্ধান পেতে পারে। নিজেকে গড়ে তুলতে পারে একজন আলোকিত মানুষ হিসেবে। দূর অতীত হতে সুসভ্য ও সুষম সমাজ গঠনের জন্য যুগে যুগে পৃথিবীতে আদর্শবাদী মানুষের জন্ম হয়েছে।

 

পড়ার অভ্যাস গঠন বিষয়ক প্রধান অতিথির ভাষণ

 

তাদের সে সকল আদর্শের বাণী, যা সমাজকে স্থিতিশীল, সুসংগঠিত, ধৈর্যশীল, প্রকৃতি-প্রেমিক, পরিবেশ-বান্ধব ইত্যাদি করতে পারে, পরিবেশ অবাধ্যতা থেকে বিরত রাখে, তার সবকিছুই গ্রন্থরূপে বিধৃত হয়েছে মানব কল্যাণের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শনের জন্যেই। সে কারণে মানুষ যখন পরিশীলিত জ্ঞানার্জনের লক্ষ্যে সৃষ্টি রহস্য অনুধাবনের উদ্দেশ্যে নিজের মধ্যে মেধা ও মননকে শানিত করে, তখন সে অভিভূত হয় প্রকৃতির সৌন্দর্য উন্মোচনে। ‘জীবে প্রেম করে যেইজন, সেইজন সেবিছে ঈশ্বর’— এই উপলব্ধি একজন মানুষ যখন নিজস্ব চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আবিষ্কার করে, অন্যজন তা আস্বাদন করে পাঠের মাধ্যমে।

জীব থেকে জীবে, পরিবেশ থেকে পরিবেশে, মানুষ থেকে সমাজে, ঘটনাপ্রবাহ, নবচেতনা, জ্ঞানের উপকরণ হয়ে, গ্রন্থের মাধ্যমে বিস্তৃত হয়ে মানুষকে পরস্পরের কাছাকাছি এনেছে। সমাজকে সুসংগঠিত ও বিন্যস্ত করার ক্ষেত্রে গ্রন্থের যে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রয়েছে, পাঠাভ্যাস মানুষের মধ্যে তা সুদৃঢ় করতে পারে। সুধীবৃন্দ, আমি আর বক্তব্য দীর্ঘায়িত করে আপনাদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটাতে চাই না। আসুন আমরা সবাই মিলে পড়ার অভ্যস গঠন করে সুন্দর দেশ ও জাতি গঠন করি— এ আশা ব্যক্ত করেই আমার বক্তব্য শেষ করছি। ধন্যবাদ সবাইকে।

আরও দেখুন:

Leave a Comment