নিরক্ষরতা দূরীকরণকল্পে একটি ভাষণ রচনা | ভাষণ | ভাষা ও শিক্ষা , নিরক্ষরতা দূরীকরণকল্পে একটি জনসভার আয়োজন করা হয়েছে। সেখানে কিছু বলতে হবে তার একটি ভাষণ রচনা ।
নিরক্ষরতা দূরীকরণকল্পে একটি ভাষণ রচনা | ভাষণ | ভাষা ও শিক্ষা
নিরক্ষরতা দূরীকরণ বিষয়ে আয়োজিত অনুষ্ঠানের সম্মানিত সভাপতি, মাননীয় প্রধান অতিথি, উপস্থিত সুধীবৃন্দ— আসসালামু আলাইকুম । আজ এক মহৎ সংকল্প নিয়ে আমরা এখানে সমবেত হয়েছি। নিরক্ষরতা দূরীকরণের প্রয়োজন সম্পর্কে বলতে গিয়ে প্রথমেই মনে হয়, যে মানুষের অক্ষর জ্ঞান নেই, আধুনিক জীবনের মর্মমূলে পৌঁছানোর চাবিকাঠিও তার হাতে নেই। চক্ষুষ্মান হয়েও সে দৃষ্টিহীন। এই পৃথিবীর জ্ঞানভাণ্ডারে যা লিখিত হয়ে আছে গ্রন্থে, সে তার পাঠোদ্ধারে অক্ষম। সংবাদপত্র তার কাছে অজানা হরফের অসংখ্য হিজিবিজি ছাড়া আর কিছুই নয়।
নিরক্ষর ব্যক্তি তার নিরক্ষরতার জন্যে এ-পৃথিবীর রূপ-রূস-গন্ধ, ন্যায়-অন্যায়, লাভ-লোকসান, আনন্দ-বেদনা, সুখ-দুঃখ সবকিছু থেকে হয় বঞ্চিত হয় প্রতারিত। তার জীবনটাই অভিশপ্ত ও ব্যর্থ। আজকের দিনে তাই নিরক্ষরতা একটি জাতীয় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বক্তৃতাদানের সুযোগ পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে করছি। এজন্য জনসভার আয়োজকদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। ধন্যবাদ জানাই নিরক্ষরতার গুরুত্ব অনুধাবনের জন্যে। সুধী, আজকের জনসভায় অনেক পণ্ডিত ব্যক্তি উপস্থিত রয়েছেন। তারা একেকজন দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদ।
তারা তাদের জ্ঞানগর্ব বক্তব্য দিয়ে আপনাদেরকে নিরক্ষরতার গুরুত্ব সম্পর্কে বিস্তারিত জানাবেন। আমি শুধু নিরক্ষরতার সামগ্রিক দিক সম্পর্কে সংক্ষেপে আপনাদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাই।’ সুধী, শিক্ষার স্থান মানবজীবনে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষা ছাড়া ব্যক্তি ও জাতীয় জীবনের উন্নতির কোনো বিকল্প নেই। পৃথিবীতে শিক্ষা বা জ্ঞানই একমাত্র সম্পদ যা জীবনের মতো মহামূল্যবান। জীবন ছাড়া দেহের যেমন মূল্য নেই, শিক্ষা ছাড়া তেমনি জীবনেরও কোনো মূল্য নেই। তাই সাক্ষরতার প্রার্থনা মানুষের জন্মজন্মান্তরের।
সম্মানিত সুধীবৃন্দ, আমাদের প্রথমে জানা দরকার নিরক্ষরতা কী বা নিরক্ষর কারা? সাধারণভাবে অক্ষর-জ্ঞানহীনতাই হল নিরক্ষরতা। আর যাদের অক্ষর জ্ঞানের অভাব রয়েছে তারাই নিরক্ষর। এ দেশে জনসংখ্যার প্রায় ৬৫% অশিক্ষিত। এতো বিশাল জনগোষ্ঠীকে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত রেখে অর্থনৈতিক ভিত্তি শক্তিশালী করা সম্ভব নয়। পৃথিবীর যেসব দেশ অর্থনৈতিকভাবে উন্নত, সে সব দেশের জনগণের প্রায় সবাই শিক্ষিত। শিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগিয়ে তারা উন্নতির চরম শিখরে আরোহন করেছে। অথচ বিশাল সম্ভাবনাময় জনসম্পদ থাকা সত্ত্বেও আমরা যুগ যুগ ধরে অনুন্নত।
নিরক্ষরতার অভিশাপে আমরা দিন দিন নিমজ্জিত হচ্ছি চরম হতাশায়। সুধীবৃন্দ, আমরা সকলেই জানি, ‘শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড’। মেরুদণ্ড ছাড়া যেমন কোনো মানুষ সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না, তেমনি শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতিকে জাতি হিসেবে কল্পনা করা যায় না। তাই দেশ ও জাতির সার্বিক উন্নয়নে নিরক্ষরতা দূরীকরণের প্রয়োজন অনস্বীকার্য। কেননা- ‘নিরক্ষরতা দুর্ভাগ্যের প্রসূতি।’ শিক্ষা-বিবর্জিত মানুষ জাতিকে পিছিয়ে দেয়, জাতিকে পরিণত করে ন্যুব্জ, গর্বহীন, দীপ্তিহীন জনগোষ্ঠীতে। বস্তুত শিক্ষার প্রসারই পারে সব সংস্কার, জড়তা দূর করে জাতিকে গতিশীল করতে। তাই জাতীয় জীবনে তথা একটি উন্নত দেশের জন্যে চাই শিক্ষিত জনশক্তি।
এজন্য বর্তমান বিশ্বে শিক্ষাকে উন্নয়নের পূর্বশর্ত বিবেচনা করা হয়ে থাকে। সুধী, যে ব্যক্তি শিক্ষা থেকে বঞ্চিত তার মনুষ্যজীবন ব্যর্থ। তাকে চরম দুর্ভাগ্যের মধ্য দিয়ে জীবন কাটাতে হয়। জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোয় আলোকিত নয়, বলে পদে পদে সে অন্ধকার দেখে। চোখ থাকতেও সে অন্ধের মতো বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্কহীন জীবনযাপন করে। আধুনিক বিশ্বে অক্ষরজ্ঞানহীন ব্যক্তি প্রায় অচল। উন্নত জীবনের সঙ্গে তার পরিচয় থাকে না, উন্নত জীবন সম্পর্কে কোনো ধারণাও সে করতে পারে না। উন্নত পেশা লাভেও সে বঞ্চিত থাকে। দারিদ্র্যই তাদের জীবনের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়ায়। দারিদ্র্য ও দুঃখ-কষ্ট থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার পথ সে জানে না।
এই ধরনের মানুষ শুধু ধুঁকে ধুঁকে মরে। নিরক্ষরতার অভিশাপ বয়ে বেড়ানোই এদের একমাত্র নিয়তি। শুধু ব্যক্তি জীবনেই নয়, জাতীয় জীবনেও নিরক্ষরতা দুর্ভাগ্য নিয়ে আসে। জাতি যদি নিরক্ষর হয় তবে দেশের অগ্রগতি ব্যাহত হয় এবং নানা সমস্যা সৃষ্টি হওয়ায় জাতীয় জীবন হয়ে ওঠে দুর্বিষহ। নিরক্ষর জাতি আধুনিক উন্নত জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে এবং নানা সমস্যায় জড়িয়ে পড়ে। বস্তুত ব্যক্তি ও জাতীয় জীবনের উন্নতি ও অগ্রগতির জন্য শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। অজ্ঞতার অন্ধকারে নিমজ্জিত নিরক্ষর জনগোষ্ঠী তাই জাতির জন্যে বোঝাস্বরূপ।
শিক্ষা প্রত্যেক নর-নারীর জন্যে ফরজ। শিক্ষা ব্যতীত কোনো জাতি উন্নতি লাভ করতে পারে না। যে দেশের লোক যত বেশি শিক্ষিত সে দেশ তত বেশি উন্নত। মানুষের পূর্ণ বিকাশের জন্য প্রয়োজন শিক্ষা। শিক্ষার আলো না পেলে ব্যক্তি মানুষ যেমন বিকশিত হয় না, তেমনি দেশ ও সমাজ উন্নত হতে পারে না। পৃথিবীর প্রত্যেকটি দেশ আজ নিরক্ষরতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। তুরস্ক তার অগ্নিসন্তান কামাল পাশার নেতৃত্বে মাত্র বিশ বছরে শিক্ষার মান ৮০ ভাগে উন্নীত করেছিল। ইংল্যান্ড, আমেরিকা, ফ্রান্স, জার্মানির মতো দেশগুলোর শতকরা ১০০ ভাগ শিক্ষিত।
ফলে তারা এত উন্নত। সুধী, আমাদের স্মরণ রাখতে হবে, – “জ্ঞান মানুষের মধ্যে সকলের চেয়ে বড় ঐক্য।’ যে-কোনো জাতির উন্নতির মূলে রয়েছে শিক্ষা। নিরক্ষরতার অভিশাপ জাতিকে নিয়ে যায় অন্ধকারের অতল গহ্বরে। নিরক্ষর লোকেরা নিজের উন্নতি ও জাতীয় উন্নতি কোনোটিতেই ভূমিকা রাখতে পারে না। তারা দেশ ও জাতির জন্যে বিরাট বোঝাস্বরূপ। তাই নিরক্ষর লোকদের অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন করে তোলার প্রয়োজন জরুরি হয়ে দেখা দিয়েছে। নিরক্ষরতার ভয়াবহতা বিবেচনা করে নিরক্ষরতা দূরীকরণের জন্যে ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
নিরক্ষরতা দূরীকরণে বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যেই “প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করেছে এবং এ শিক্ষায় আগ্রহ সৃষ্টির জন্য ‘শিক্ষার বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি’ চালু করেছে। এতে আশাব্যঞ্জক সাড়া পড়েছে এবং প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রী অনেক গুণ বেড়েছে। দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত মেয়েদের শিক্ষা অবৈতনিক এবং উপবৃত্তি প্রদানের ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে। নিরক্ষরতা দূরীকরণে গণশিক্ষা একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
বর্তমানে দেশের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষিত লোকদের সহায়তায় গণশিক্ষা কেন্দ্র খোলা হয়েছে। প্রত্যেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তাদের নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের একটি কক্ষ নৈশ বিদ্যালয় হিসেবে ব্যবহার করে নিরক্ষরতা দূরীকরণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতে পারে। সকল শ্রেণি এবং সকল বয়সের লোকদের শিক্ষা সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে হবে। নিরক্ষরতা দূরীকরণে সকলের স্লোগান হওয়া উচিত —
‘শিক্ষার কোনো বয়স নাই, চল সবাই শিখতে যাই। ”
ব্যক্তি ও জাতীয় জীবনে উন্নতি ও অগ্রগতির জন্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। আমাদের দেশের বিপুল সংখ্যক জনতা নিরক্ষরতার অন্ধকার থেকে মুক্ত হোক এই আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করে আমার বক্তব্য শেষ করছি। ধন্যবাদ সবাইকে। খোদাহাফেজ।
আরও দেখুন: