নিমন্ত্রণ কবিতা — বিখ্যাত বাংলা কবি জসীম উদ্দীন এর এক অনন্য সৃষ্টি, যা তাঁর জনপ্রিয় কবিতাগুলোর মধ্যে বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। এই কবিতায় তিনি সরল ও মাধুর্যময় ভাষায় গ্রামীণ জীবনের চিত্রায়ন করেছেন, যেখানে মানুষের আন্তরিকতা, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং সাংস্কৃতিক রূপকথার মিশেলে হৃদয় স্পর্শকারী এক আবহ তৈরি হয়।
জসীম উদ্দীনের কবিতা সাধারণত গ্রামীণ বাংলার জীবনধারা, মানুষের মেলবন্ধন ও প্রকৃতির সঙ্গে গভীর সম্পর্কের প্রতিফলন হয়ে থাকে। ‘নিমন্ত্রণ’ কবিতাটিও তার ধারাবাহিকতায় স্থান পেয়েছে, যেখানে তিনি পাঠককে প্রাকৃতিক ও মানবিক বন্ধনের একটি প্রাণবন্ত আমন্ত্রণ জানান। কবিতার মাধ্যমে তিনি জীবনযাত্রার সরলতা এবং মানুষের আন্তরিক সম্পর্কের সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলেন যা আজও পাঠক হৃদয়ে গভীর অনুপ্রেরণা জাগায়।
এই কবিতার ভাষা ও ভাবের সরলতা, বর্ণনায় ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ সংস্কৃতির সুক্ষ্ম প্রকাশ এবং মানবিক বন্ধনের দৃঢ়তা এটিকে বাংলা সাহিত্যের অমর সৃষ্টি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। ‘নিমন্ত্রণ’ কেবল একটি কবিতা নয়, এটি আমাদের মানবতা ও ভালোবাসার এক মধুর উদ্বোধন।
নিমন্ত্রণ কবিতা – জসীম উদ্দীন
তুমি যাবে ভাই যাবে মোর সাথে আমদের ছোট গাঁয়
গাছের ছায়ায় লতায় পাতায় উদাসী বনের বায়;
মায়া মমতায় জড়াজড়ি করি
মোর গেহখানি রহিয়াছে ভরি,
মায়ের বুকেতে, বোনের আদরে, ভায়ের স্নেহের ছায়,
তুমি যাবে ভাই- যাবে মোর সাথে আমাদের ছোট গাঁয়।
ছোট গাঁওখানি- ছোট নদী চলে, তারি একপাশ দিয়া,
কালো জল তার মাজিয়াছে কেবা কাকের চক্ষু নিয়া।
ঘাটের কিনারে আছে বাঁধা তরী,
পারের খবর টানাটানি করি-
বিনাসূতি মালা গাঁথিছে নিতুই এপার ওপার দিয়া;
বাঁকা ফাঁদ পেতে টানিয়া আনিছে দুইটি তীরের হিয়া।
তুমি যাবে ভাই, যাবে মোর সাথে- নরম ঘাসের পাতে,
চুম্বন রাখি অম্বরখানিরে মেজে লয়ো নিরালাতে।
তেলাকুচ-লতা গলায় পরিয়া
মেঠো ফুলে নিও আঁচল ভরিয়া,
হেথায় সেথায় ভাব করো তুমি বুনো পাখিদের সাথে,
তোমার পায়ের রঙখানি তুমি দেখিবে তাদের পাতে।
তুমি যদি যাও আমাদের গাঁয়ে, তোমারে সঙ্গ করি
নদীর ওপারে চলে যাই তবে লইয়া ঘাটের তরী
মাঠের যত না রাখাল ডাকিয়া,
তব সনে দেই মিতালি করিয়া,
ঢেলা কুড়াইয়া গড়ি ইমারত সারা দিনমান ধরি
সত্যিকারের নগর ভুলিয়া নকল নগর গড়ি।
তুমি যদি যাও – দেখিবে সেখানে মটর-লতার সনে,
সীম-আর-সীম হাত বাড়ালেই মুঠি ভরে সেইখানে।
তুমি যদি যাও সে-সব কুড়ায়ে,
নাড়ার আগুনে পোড়ায়ে পোড়ায়ে,
খাব আর যত গেঁয়ো চাষিদের ডাকিয়া নিমন্ত্রণে,
হাসিয়া হাসিয়া মুঠি মুঠি তাহা বিলাইব জনে জনে।
তুমি যদি যাও- শামুক কুড়ায়ে, খুব-খুব বড় করে
এমন একটি গাঁথিব মালা যা দেখনি কাহারো করে;
কারেও দেব না, তুমি যদি চাও
মনের খুশিতে দিয়ে দেব তাও,
গলায় পরিবে ঝুমঝুম রবে পথেরে মুখর করে,
হাসিব খেলিব গাহিব নাচিব সারাটি গেরাম ভরে।
খুব ভোর করে উঠিতে হইবে, সুয্যি উঠারও আগে,
কারেও কবি না দেখিস পায়ের শব্দে কেহ না জাগে।
রেল সড়কের ছোট খাদ ভরে
ডানকিনে মাছ কিলবিল করে;
কাদার বাঁধাল গাঁথি মাঝামাঝি জল সেঁচে আগেভাগে,
সব মাছগুলো কুড়ায়ে আনিব কাহারো জানার আগে।
ভর দুপুরেতে একরাশ কাদা আর একরাশ মাছ,
কাপড়ে জাড়ায়ে ফিরিয়া আসিব আপন বাড়ির কাছ;
‘ওরে মুখ-পোড়া ওরে রে বাঁদর।’
গালি-ভরা মার অমনি আদর,
কতদিন আমি শুনি নারে ভাই, আমার মায়ের পাছ;
যাবি তুই ভাই, আমাদের গাঁয়ে যেথা ঘন কালো গাছ।
যাবি তুই ভাই, যাবি মোর সাথে আমাদের ছোট গাঁয়,
ঘন কালো বন-মায়া মমতায় বেঁধেছে বনের বায়।
গাছের ছায়ায় বনের লতায়,
মোর শিশুকাল, লুকায়েছে হায়!
আজিকে সে-সব সরায়ে সরায়ে খুঁজিয়া লইব তায়,
যাবি তুই ভাই, যাবি মোর সাথে আমাদের ছোট গাঁয়।
নিমন্ত্রণ কবিতা আবৃত্তিঃ