আজকের আলোচনার বিষয়ঃ নদীর স্বপ্ন । যা সাহিত্য কণিকার অন্তর্গত। এটি বুদ্ধদেব বসু রচিত কবিতা।
Table of Contents
নদীর স্বপ্ন । বুদ্ধদেব বসু
কোথায় চলেছো? এদিকে এসো না!
দুটো কথা শোনো দিকি,
এই নাও – এই চকচকে, ছোটো,
নতুন রুপোর সিকি ।
ছোকানুর কাছে দুটো আনি আছে,
তোমায় দিচ্ছি তাও,
আমাদের যদি তোমার সঙ্গে
নৌকায় তুলে নাও ।
নৌকা তোমার ঘাটে বাঁধা আছে-
যাবে কি অনেক দূরে?
পায়ে পড়ি, মাঝি, সাথে নিয়ে চলো
মোরে আর ছোকানুরে।
আমারে চেনো না? আমি যে কানাই ।
ছোকানু আমার বোন
তোমার সঙ্গে বেড়াবো আমরা
মেঘনা, পদ্মা, শৌণ।
শোনো, যা এখন ঘুমিয়ে আছেন,
দিদি গেছে ইশকুলে,
এই ফাঁকে মোরে – -আর ছোকানুরে-
নৌকোয় নাও তুলে ।
কোনো ভয় নেই – বাবার বকুনি
তোমায় হবে না খেতে,
যত দোষ সব আমরা-
-না, আমি
একা নেবো মাথা পেতে।
ওটা কী? জেলের নৌকা? – তাই তো!
জাল টেনে তোলা দায়,
রুপোলি নদীর রুপোলি ইলিশ –
ইশ, চোখে ঝলসায়।
ইলিশ কিনলে? – আঃ, বেশ, বেশ,
তুমি খুব ভালো, মাঝি ।
উনুন ধরাও, ছোকানু দেখাক
রান্নার কারসাজি।
পইঠায় বসে ধোঁয়া ওঠা ভাত,
টাটকা ইলিশ ভাজা-
ছোকানু রে, তুই আকাশের রানি,
আমি পদ্মার রাজা ।
খাওয়া হলো শেষ, আবার চলছি
দুলছে ছোট্ট নাও,
হালকা নরম হাওয়ায় তোমার
লাল পাল তুলে দাও ।
ছোকানুর চোখ ঘুমে ঢুলে আসে
গান গাওয়া হলে আমায় অনেক
গল্প বলবে, মাঝি?
শুনতে শুনতে আমিও ঘুমোই
বিছানা বালিশ বিনা-
মাঝি, তুমি দেখো ছোকানুরে, ভাই,
ও বড়োই ভীতু কিনা।
আমার জন্যে কিচ্ছু ভেবো না
আমি তো বড়োই প্রায়
ঝড় এলে ডেকো আমারে ছোকানু
আমি ঠিক জেগে আছি,
যেন সুখে ঘুম যায় ।
[সংক্ষেপিত]
শব্দার্থ ও টীকা
সিকি – চার আনা মূল্যের মুদ্রা বা ২৫ পয়সার মুদ্রা।
আনি – এক টাকার ষোল ভাগের এক ভাগ মূল্যের মুদ্রা।
শোণ – একটি নদীর নাম ।
কারসাজি – কূটকৌশল । এখানে চমৎকারিত্ব অর্থে কাব্যিক ব্যবহার ।
পাল – বাতাসের সাহায্যে চালাবার জন্য নৌকায় খাটানো মোটা কাপড়ের পর্দা।
পাঠের উদ্দেশ্য
এই কবিতা পাঠ করার কারণে শিক্ষার্থীদের কল্পনাশক্তির প্রসার ঘটবে। প্রকৃতি ও দেশের প্রতি আকর্ষণ বাড়বে। ভাইবোনের মধ্যে মধুর সম্পর্ক তৈরি হবে ।
পাঠ-পরিচিতি
বুদ্ধদেব বসুর নদীর স্বপ্ন’ কবিতায় নদী এবং নৌভ্রমণ নিয়ে এক কিশোরের কল্পনা রূপায়িত হয়েছে। দুরন্ত এক কিশোর তার ছোট বোনকে নিয়ে নৌকাতে উঠে নদীর পর নদী পার হয়ে তাদের মনের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে চায়। নৌকার নানা রঙের পাল, নীল রঙের আকাশ, ঝাঁকে ঝাঁকে পাখির উড়ে চলা, রুপালি ইলিশ মাছ, নৌকায় রান্না করা, সন্ধ্যায় গান গাওয়া, গল্প করা—এত কিছু কিশোর মনে গভীর স্বপ্ন নিয়ে আসে। পাশাপাশি এ কবিতায় বোনের প্রতি ভাইয়ের দায়িত্ব ও আদর প্রকাশের চমৎকার নিদর্শন আছে ।
কবি-পরিচিতি
বুদ্ধদেব বসু বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। তিনি কবিতা, ছড়া, ছোটগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, ভ্রমণ -কাহিনি, স্মৃতিকথা, অনুবাদ, সম্পাদনা ইত্যাদির মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে প্রথম শ্রেণিতে স্নাতক (সম্মান) এবং পরের বছর প্রথম শ্রেণিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। প্রথমে সাংবাদিকতা এবং পরে অধ্যাপনাকে তিনি পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন।
ঢাকার পুরানা পল্টন থেকে তাঁর ও অজিত দত্তের যৌথ সম্পাদনায় সচিত্র মাসিক পত্রিকা ‘প্রগতি’ (১৯২৭-১৯২৯) প্রকাশিত হয়। তিনি ‘কবিতা পত্রিকা’ নামেও একটি পত্রিকা সম্পাদনা করেন । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাব্যরীতির বাইরে পৃথক কাব্যধারার প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অন্যতম প্রধান কবি বুদ্ধদেব বসুর রচনাশৈলী স্বতন্ত্র ও মনোজ্ঞ। বুদ্ধদেব বসু ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দে কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস বিক্রমপুর অর্থাৎ বর্তমানের মুন্সিগঞ্জে। ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।
কৰ্ম-অনুশীলন
তোমার ভালো লাগার স্বপ্ন নিয়ে কবিতা, গল্প বা নাটিকা রচনা কর (একক কাজ)। ‘নদীর স্বপ্ন’ কবিতাটির একটি গদ্যরূপ উপস্থাপন কর (দলগত কাজ)।
নমুনা প্রশ্ন
বহুনির্বাচনি প্রশ্ন
১. কোথায় চলেছো? এদিকে এসো না!
দুটো কথা শোনো দিকি,
চরণটিতে প্রকাশ পেয়েছে—
ক. আদেশ
খ. নির্দেশ
গ. অনুরোধ
ঘ. অনুনয়
নিচের উদ্দীপকটি পড়ে ২ ও ৩ নম্বর প্রশ্নের উত্তর দাও :
কিশোর মোরা ঊষার আলো, আমরা হাওয়া দুরন্ত,
মনটি চির বাঁধন হারা, পাখির মতো উড়ন্ত।
২. উদ্দীপকের দ্বিতীয় চরণের অর্থের সাথে নিচের কোন চরণের অর্থের মিল পাওয়া যায়?
ক. পায়ে পড়ি, মাঝি সাথে নিয়ে চলো, মোরে আর ছোকানুরে
খ. ছোকানু রে, তুই আকাশের রানি, আমি পদ্মার রাজা
গ. শুনতে শুনতে আমিও ঘুমোই – বিছানা বালিশ বিনা –
ঘ. এই ফাঁকে মোরে আর ছোকানুরে, নৌকোয় নাও তুলে
৩. উক্ত পক্তি দুটিতে যে আবেগ প্রকাশিত হয়েছে তা হচ্ছে—
i. কিশোর মনের উচ্ছ্বাস
ii. ভাই ও বোনের সত্যিকার মর্যাদা
iii. কল্পনার অবাধ প্রবাহ
নিচের কোনটি সঠিক?
ক. i
খ. ii
গ. i ও ii
ঘ. i ও iii
সৃজনশীল প্রশ্ন
8. নিশু, লিজা, শ্যামা, মিথিয়া, পিয়া বড়দের দৃষ্টি এড়িয়ে সাগরদিঘি পাড়ে মিলিত হয়েছে। বাড়ি থেকে চাল, ডাল, ডিম, মসলা- সবকিছু নিয়ে এসেছে। জমিয়ে পিকনিক হবে। রান্নার ধূম লেগেছে। রান্না শেষ হতেই নিশুর দেখাদেখি সবাই দিঘির জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। দাপাদাপি যেন শেষ হতেই চায় না। শেষে পিয়ার চেঁচামেচিতে সবাই এসে কলাপাতায় পাত পেড়ে খেতে বসল। খাবার মুখে দিয়েই এ ওর মুখের দিকে তাকাচ্ছে। নুন—নুন দেয়া হয় নি যে। আবার এক দফা হেসে নিয়ে সবাই গপাগপ খিচুড়ি খেতে বসে গেল। খুউব ক্ষুধা পেয়েছে যে!
ক. দুপুরের রোদে জল কেমন করে বয়ে চলে?
খ. নৌকা-ভ্রমণের বিনিময়ে কানাই মাঝিকে আনি বা পয়সা দিতে চেয়েছিল কেন? – ব্যাখ্যা কর ।
গ. উদ্দীপকের সাথে কবিতার কী অমিল লক্ষ্য করা যায়-আলোচনা কর।
ঘ. বিষয়বস্তু ভিন্ন হলেও উদ্দীপক ও কবিতাটি কিশোর মনের আবেগ প্রকাশের দিক থেকে অভিন্ন— বিশ্লেষণ কর।
আরও দেখুনঃ