ধ্বন্যাত্মক শব্দ | শব্দদ্বিত্ব | ভাষা ও শিক্ষা

ধ্বন্যাত্মক শব্দ | শব্দদ্বিত্ব | ভাষা ও শিক্ষা , বাংলা ভাষায় ধ্বনি-সমবায়ে সৃষ্ট বর্ণনাসূচক এবং দ্যোতনাসৃষ্টিকারী কতকগুলো শব্দ বিশেষ্য, বিশেষণ, ক্রিয়া ও ক্রিয়াবিশেষণরূপে ব্যবহৃত হয়। এগুলো কোনো বাক্তি, বস্তু বা প্রাণীর ক্রিয়া বা অনুভূতির স্বাভাবিক বা কাল্পনিক অনুকৃতির শব্দাত্মক রূপায়ণ। এগুলোকে ধ্বন্যাত্মক শব্দ (Onomatopoeic word) বলে।

ধ্বন্যাত্মক শব্দ | শব্দদ্বিত্ব | ভাষা ও শিক্ষা

 

ধ্বন্যাত্মক শব্দ

যে-শব্দ নৈসর্গিক ধ্বনির অনুকৃতি বা বাঞ্জনা দেয় এবং অনুভূতিগ্রাহ্য সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ভাব বা অবস্থার দ্যোতনা দেয় তাকেই ধ্বন্যাত্মক শব্দ বা অনুকার শব্দ বলে। যেমন: ভেউ ভেউ (মানুষের উচ্চ কান্নার ধ্বনি), ঘচাঘচ্ (ধান কাটার শব্দ), হু হু (বাতাস প্রবাহের শব্দ) ইত্যাদি।

ধ্বন্যাত্মক শব্দ কতগুলো ধ্বনির সমন্বয় মাত্র। এই সম্মিলিত ধ্বনি একদিকে শ্রুতিগ্রাহ্য নৈসর্গিক ধ্বনির অনুকরণে জাত ও অন্যদিকে মানবমনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অনুভূতির প্রতীক। রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর মতে ‘প্রত্যেক ধ্বনির একটা নৈসর্গিক তৎপরতা আছে- এই তৎপরতা প্রত্যেক ধ্বনির উৎপাদক বস্তুর মাতাবিক গুণে প্রতিষ্ঠিত।

কঠিন দ্রব্যের আঘাত বর্গের ধ্বনি জন্মে, কোমল প্রবোর মামাতের সহিত ত-বর্ণের ানির সম্পর্ক, ফাপা জিনিসের ভিতর হইতে বায়ু নিঃসরণে প-বর্গের ধ্বনি জন্যে, ইত্যাদি। প্রত্যেক ধ্বনি যাবত কাঠিন্য, তারা, কোমলতা, শূন্যগর্ততা প্রভৃতি এক- একটা বস্তুধর্মের সম্পর্ক রাখে ও সহকারিতা রাখে, এবং প্রত্যেক ধ্বনি তিগত হইবামাত্র ঐ ঐ ধর্ম স্মরণ করায় বা ব্যাঞ্জনা করে।

 

ধ্বন্যাত্মক শব্দ | শব্দদ্বিত্ব | ভাষা ও শিক্ষা

 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ধ্বন্যাত্মক শব্দ সম্পর্কে বলেছেন, ‘বাংলাভাষার বর্ণনাসূচক বিশেষ এক শ্রেণীর শব্দ বিশেষণ ও ক্রিয়ার বিশেষণরূপে বহুল পরিমাণে ব্যবহৃত হইয়া থাকে, তাহারা অভিধানের মধ্যে স্থান পায় নাই। অথচ সে সকল শব্দ ভাষা হইতে বাদ দিলে বাতাযার বর্ণনাশক্তি নিতান্তই পঙ্গু হইয়া পড়ে। তিনি অন্যত্র বলেছেন, যে সকল শব্দ ধ্বনিব্যঞ্জক কোনো অর্থসূচক ধাতু হইতে যাহাদের উৎপত্তি নহে, তাহাদিগকে ধ্বন্যাত্মক নাম দেওয়া গেছে, যেমন, ধা সাঁ চট্‌ খট্ ইত্যাদি।

গতির দ্রুততা সাধারণত চোখের দৃষ্টি ও অনুভূতির বিষয়, কিন্তু আমরা বলি বা করে, সাঁ করে, বোঁ করে অথবা তোঁ করে চলে গেল। যেসব পদার্থ বা বস্তু (যেমন— প্লেন, তীর, দ্রুতগামী পাখি) বাতাসে এরূপ ধ্বনি করে, সে ধ্বনি আশ্রয় করে বাংলা ভাষা মুহূর্তের মধ্যে মনের মাঝে কিংবা দৃশ্যপটে, কিংবা স্মৃতিপটে ওই দ্রুতগামী (প্লেন, তীর, দ্রুতগামী রাখি) বস্তুটির কথা স্মরণ করিয়ে দেয় কিংবা তার ছবি ফুটিয়ে তোলে। আমরা যদি বলি তীরবেগে চলে গেল, তাহলে প্রথে অর্থবোধ ও পরে কল্পনায় বিষয়টির দৃশ্যপট ভেসে উঠতে সময় লাগে। কিন্তু ‘সা’ শব্দের অর্থ নেই বলেই কল্পনাকে সে এত দ্রুত বস্তুটির সম্পর্কে ধারণা দিতে পারে।

নৈসর্গিক ধ্বনিকে মানুষ যেভাবে শোনে তার ভাষায় বর্ণ ও ধ্বনির মাধ্যমে সে সেভাবে ব্যক্ত করে। সে অভিবারির ফলস্বরূপ ভাষায় বর্ণ বা ধ্বনিগুলো নৈসর্গিক ধানির অনুকৃতি বা ব্যঞ্জনারূপে ও অন্যদিকে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অনুভূতির প্রতীক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। যেমন বাংলায়, বৃষ্টি পড়ার শব্দ ঝমঝম (জোরে পতন), ঝিরঝির (ধীরে পতন), টপটপ (ফোঁটা ফোঁটা আকারে জল পড়া), টিপটিপ (ছোট ছোট ফোঁটা আকারে জল পড়া), করার (জেলের পতন যেখানে প্রতিটি জলকনা দৃশ্যমান), তরতর (মোটা আকারে জলের পতন), তিরতির (সরু আকারে জলের পতন), কুলকুল (নদীর জল বওয়া), কড়কড় (বাজ পড়ার শব্দ), মড়মড় (গাছের ডাল ভাঙার শব্দ) ইত্যাদি।

অন্যদিকে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অনুভূতির প্রতীক হিসেবে ‘কনকনে’ ও ‘গনগনে’ শব্দের মধ্যে দেখি ‘কনকনে’ শব্দে স্পর্শেন্দ্রিয়গ্রাহ্য বেদনার সূক্ষ্ম অনুভূতি (কনকনে ঠাণ্ডা, কনকনে হাওয়া, কনকনে ব্যথা) আর গনগনে শব্দে দর্শনেন্দ্রিয়ের জ্বালা (গনগনে আগুন) যা অনুভূতিতে একই ভাবগত তাৎপর্য বহন করে।

বাংলা ভাষায় এই ধ্বন্যাত্মক শব্দগুলোর নিজস্ব কোনো অর্থ না থাকলেও বাক্যে ব্যবহৃত হলে এগুলো বেশ তাৎপর্যপূর্ণ অর্থ প্রকাশ করে থাকে। ভাষায় ধ্বন্যাত্মক শব্দ ব্যবহারে যত সহজে গুড় ও গভীর অনুভূতি সূক্ষ্মভাবে প্রকাশ করা যায় অন্য কোনো শব্দ ব্যবহারে সে-সুখ তাবের উত্তরণ সম্ভব নয়। সে কারণেই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন “এই যে ধ্বনিবৈচিত্রা’ এত সহজে এত বর্ণনাবৈচিত্র্যের অবতারণা করিতে পারে যে, তাহা অর্থবদ্ধ শব্দদ্বারা প্রকাশ করা দুঃসাধ্য।

অনেক সময় কোনো বিশেষ তাবকে বা অভিব্যক্তিকে প্রকাশ করার জন্য একমাত্র ধ্বন্যাত্মক শব্দের ওপরই। নির্ভর করতে হয়। শারীরিক অনুভূতি, হাসি ও কথার বর্ণনা, রং-বৈচিত্র্য, নিঃশব্দতা, শূন্যতা প্রভৃতি বোঝাতে এদের প্রয়োগ হয়। অর্থাৎ যে সব অনুভূতি শ্রুতিগ্রাহ্য নয় সে সব অনুভূতিকে ধ্বনিরূপে বর্ণনা করার জন্য ধ্বন্যাত্মক শব্দের প্রয়োগ হয়। এটি বাংলা ভাষার বিশেষ বৈশিষ্ট্য। প্রসঙ্গত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘বাংলা ভাষার একটি অদ্ভুত বিশেষত্ব আছে, যে-সকল অনুভূতি শ্রুতিগ্রাহ্য নহে, আমরা তাহাকেও ধ্বনিরূপে বর্ণনা করিয়া থাকি। বাংলাভাষার সকল প্রকার ইন্দ্রিয়বোধই অধিকাংশ সানে মুভিগম্য ধ্বনির আকারে ব্যক্ত হইয়া থাকে।’

“ধ্বনির সঙ্গে যে-সব ভাবের দূরসম্পর্কও নেই, তাও বাংলায় ধ্বনির মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। যেমন : কনকনে শীত। কনকন ধ্বনির সঙ্গে শীতের কোনো সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায় না। শীতে শরীরে যে বেদনা বোধ হয় আমাদের কল্পনার কোনো অদ্ভুত বিশেষত্ববশত আমরা তাকে কনকন ধ্বনির সঙ্গে তুলনা করি, অর্থাৎ আমরা মনে করি, সেই বেদনা যদি শ্রুতিগম্য হতো তবে তা ‘কনকন’ শব্দে প্রকাশ পেত। বস্তুত সব ধরনের শূন্যতা, স্তব্ধতা, এমনকী নিঃশব্দতাকেও আমরা ধ্বনির মাধ্যমে প্রকাশ করি।

 

আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

আমাদের ভাষায় শূন্য ঘর বা না করে, মধ্যাহ্ন রৌদ্রের সুস্থতা বা বা করে, শূন্য মাঠ ধূ ধূ করে, বৃহৎ জলাশয় এই থই করে, পোড়োবাড়ি বা খা করে, শূন্য হৃদয় হু হু করে, কোথাও কেউ না থাকলে তো তো করতে থাকে— এসব নিঃশব্দতার ধ্বনি অন্যভাষীদের কাছে কীরূপ জানি না, আমাদের কাছে নিরতিশয় স্পষ্ট ভাববহ।’

যে সকল ধ্বনি ভাষায় ব্যবহৃত হয় তার পরিবর্তন ঘটে সময়ের ব্যবধানে। শব্দের অর্থেরও পরিবর্তন ঘটে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রয়োজনে। কিন্তু ধ্বন্যাত্মক শব্দে যে ধ্বনি ব্যবহৃত হয় তা সহজে পরিবর্তিত হবার নয়। ধ্বন্যাত্মক শব্দে ভাষার জাতীয় চরিত্র এমন লষ্টরূপে বিদ্যমান থাকে যা সহজে বদলায় না।

রবীন্দ্রনাথ তাই বলেছেন, “ধ্বন্যাত্মক শব্দ পরিবর্তিত হইবে কেন। বাঙালি বিধি করিয়া হাসিবে না, প্যান প্যান করিয়া কাদিবে না, ঘ্যান ঘ্যান করিয়া চাহিবে না। মধ্যযুগের বাংলায় আমরা যে ধরনের ধ্বন্যাত্মক শব্দের ব্যবহার দেখি আজও সে-ধ্বন্যাত্মক শব্দের ব্যবহার একই অর্থে ঘটে দু-একটা ব্যতিক্রম ছাড়া। তাই ধ্বন্যাত্মক শব্দগুলো বাংলা ভাষার এক শ্রেষ্ঠ সম্পদ

ধ্বন্যাত্মক শব্দ বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাই প্রতি ধ্বনিরই একটা নিজস্ব অর্থগত তাৎপর্য আছে। যেমন কচকচ চটচট, তলতল ধরার মড়মড় প্রকৃতি শব্দে ক ও চ ধ্বনি, চা ও ধ্বনি, ন র ধ্বনি এবং ম শু ড় ধ্বনি বিশেষ বিশেষ অর্থ প্রকাশ করছে। শব্দের আদিতে কচকচ শব্দে ক বানিতে আকস্মিকতা ও তাৎক্ষণিক অর্থ, ‘চটচট শব্দে ট ধ্বনির কাঠিন্য, কঠোরতা, “তলতল’ শব্দে ন ধ্বনির চাঞ্চল্য ধরধর’ শব্দের ধ্বনির কম্পনভাব ও মড়মড় শব্দে ড় ধ্বনির বারংবার আঘাতে সরণ বা স্থানান্তরণের ভাব পরিলক্ষিত হয়। রামেন্দ্রসুন্দরের মতে চ বর্ণের ধ্বনির লক্ষণই তারল্য।

ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘ও. ডি. বি. এল.’ (ODBL) গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডে বাংলা ধাতু প্রসঙ্গে ধ্বন্যাত্মক শব্দ সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করেন। তিনি বাংলা ধ্বন্যাত্মক ক্রিয়াপদগুলোকে দুটি ভাগে ভাগ করেন। যথা, (১) মৌলিক ধ্বন্যাত্মক খাতু যেমন, চিল্লা, ছুঁয়া, টুপা, টুসা, ফোঁসা, হাঁকা, ইচো ইত্যাদি। (২) ধ্বন্যাত্মক ধাতুর দ্বিত্বীকরণ যেমন,  কড়মড়া, চড়চড়া, টনটনা, ধুকপুকা, বিড়বিড়া, সড়সড় হড়হড়া ইত্যাদি। পরবর্তীকালে সুনীতিকুমার তাঁর ‘কাশ বাঙ্গালা ব্যাকরণ’ গ্রন্থে ‘দ্বিরুক্ত শব্দের প্রয়োগ’ প্রসঙ্গে আলোচনার সময় বলেন- ‘অনুকার ধ্বনিতে শব্দ-বৈত বাঙ্গালায় খুবই সাধারণ।

টক্‌টর, কচমচ, বকছ, গগণ, বিলবিল, কচর-মচর।’ তিনি আরও বলেন, ‘কতকগুলি ধ্বন্যাত্মক শব্দ আবার ধ্বনির ভাব বাতীত অন্য ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ভাবের প্রকাশক হইয়া থাকে, যথা- বাধায় চট (কট্‌কট) করে, জ্বালায় কর কর করে, হাত নিশ্ পিশ্ করে, লাল টুকটুক করেছে, টকটকে লাল, চ্যাডেবে লা ইত্যাদি। তাঁর মতে কিছু ধ্বন্যাত্মক শব্দ আছে যার মধ্যে বিশেষ গুণের বর্ণনা থাকে যে গুণ বহুক্ষণ ধরে বস্তুতে বিরাজ করে।

রবীন্দ্রনাথ, রামেন্দ্রসুন্দর ও সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়-এর পর আরও অনেকেই ধ্বন্যাত্মক শব্দ নিয়ে আলোচনা করেছেন। রবীন্দ্রনাথই তাঁর ‘শূন্যাত্মক শব্দ’ ও ‘ভাষার ইঙ্গিত’ নিবন্ধ দুটিতে ধ্বন্যাত্মক শব্দের স্বরূপ ব্যাখ্যা করেছেন। অতি নিপুণ হাতে। বলা বাহুল্য, এই প্রথম অন্যাত্মক শব্দের মারিন্য মোচন হল কবিরই হাতে। আস্তাকুঁড় থেকে একেবারে অট্টালিকায় উত্তরণ ঘটল।

নৈসর্গিক শব্দানুকৃতি ও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সুখানুভূতির প্রতীক হিসেবে ধ্বন্যাত্মক শব্দ না ছিল এক সময় অখ্যাত, অবজ্ঞাত, অভিধানকারের কাছে অসম্মানিত তা রবীন্দ্র-সমকালীন ও পরবর্তী যুগে অভিধানের মণিকোঠায় স্থান করে নিয়েছে অনায়াসেই, সে কবিরই মাধুর্য-তরা সৃষ্টির গুণে। তাই কবির কণ্ঠে শুনতে পাই। ধ্বন্যাত্মক শব্দ সব সময় বাস্তব ধ্বনির অনুকরণমাত্র নয়, অনেক সময় ধ্বনির কল্পনা মাত্র। ইহা ইঙ্গিত, ইহা বোবার ভাষা।

Capture293 ধ্বন্যাত্মক শব্দ | শব্দদ্বিত্ব | ভাষা ও শিক্ষা

 

 

 

ধ্বন্যাত্মক শব্দ | শব্দদ্বিত্ব | ভাষা ও শিক্ষা

 

আরও দেখুন:

Leave a Comment