নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি সম্পর্কে পত্রিকায় প্রকাশের জন্য প্রতিবেদন | প্রতিবেদন | ভাষা ও শিক্ষা
Table of Contents
নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি সম্পর্কে পত্রিকায় প্রকাশের জন্য প্রতিবেদন
প্রতিবেদনের প্রকৃতি: বিশেষ প্রতিবেদন / সংবাদ প্রতিবেদন
প্রতিবেদনের শিরোনাম: নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি : মধ্যবিত্তদের নাভিশ্বাস, দরিদ্র মানুষ দিশেহারা
সরেজমিনে তদন্তের স্থান: ‘ক’, ‘খ’, ‘গ’ বাজার পরিদর্শন
প্রতিবেদন তৈরির সময়: …
তারিখ :…
সংযুক্তি : ৩ কপি ছবি (‘ক’, ‘খ’, ‘গ’ বাজারে মজুদ মালের চিত্র)।
নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি : ক্রেতারা অসহায়, মধ্যবিত্তদের নাভিশ্বাস, দরিদ্র মানুষ দিশেহারা
নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্যবৃদ্ধি আজ আর কোনো ‘বিশেষ সংবাদ’ নয়। প্রতিবছর বা প্রতিমাসে তো বটেই, প্রতি দিনই জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি পায়। ফলে জনজীবন হচ্ছে দুঃখ ও ভোগান্তির শিকার। ধানের ভরা মৌসুমেও দাম বাড়ছে চালের। শুধু চাল নয় ডাল, আটা, ভোজ্যতেল, শুকনা মরিচ, পিঁয়াজ ও চিনিসহ প্রতিটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামই এখন বাড়তির দিকে।
হঠাৎ করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধিতে বিপাকে পড়েছে মধ্যবিত্তসহ স্বল্প আয়ের মানুষ। একই সঙ্গে বিশ্ব ব্যাংক ও আইএমএফের পরামর্শে গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ ও পরিবহনের মতো সেবা সার্ভিসের মূল্য দফায় দফায় বেড়ে যাওয়ায় দেশের ক্রেতা-ভোক্তা সাধারণ আরও বেশি অসহায় হয়ে পড়েছে। দারিদ্র্য সীমার নিচে অবস্থানরত মানুষের জন্য তা এক অভিশাপ হিসেবে বিবেচ্য। কারণ দ্রব্যমূল্য যেভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে সেভাবে তাদের উপার্জন বৃদ্ধি পায় নি। একদিকে দারিদ্র্যের অভিশাপ অন্যদিকে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি তাদের জীবনকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। সরেজমিনে বিভিন্ন বাজার পরিদর্শনকালে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সত্যতা যেমন মিলেছে তেমনি দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির নানা কারণ জানা যায়।
০১. নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ঊর্ধ্বগতি ও বর্তমান বাজার পরিস্থিতি
গত ২০০৫ থেকে ২০১৩ সালের দ্রব্যমূল্যের তুলনামূলক চিত্র পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ২০০৫ সালে মোটা চাল স্বর্ণা/ইরি চালের দাম ছিল ১৫-২০ টাকা; যা ২০১২ সালে বিক্রি হচ্ছে ৩৫-৪০ টাকায়। নাজিরশাইল/মিনিকেট, পাইজাম/লতা চালের দাম ছিল ২৫-৩০ টাকা; যা ২০১২ সালে ক্রমপর্যায়ে ৫৫-৬৫ টাকায় দাঁড়িয়েছে। অন্যান্য পণ্য যেমন মসুর ডাল ৪৮ থেকে ১০০-১১২ টাকা, সয়াবিন তেল ৫৪ থেকে ১১০ টাকা, আটা ১৬ থেকে ৩৫ টাকা, লবণ ১২ থেকে ১৭ টাকা, শুকনা মরিচ ১০০ টাকা থেকে ১৫০ টাকা, ২৮ টাকার চিনি ৫৫-৬০ টাকা, গরুর মাংস ১১০ টাকা থেকে ২৫০ টাকা। বর্তমানে মরিচ ও পিঁয়াজের দাম বেড়েছে অস্বাভাবিকভাবে। বিশেষ করে মরিচ, পিঁয়াজ ও আলুর অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির ঝাঁজে ক্রেতাদের রীতিমতো নাকাল হওয়ার মতো অবস্থা।
০২. দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সম্পর্কে টিসিবির মতামত
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)’র হিসাবে গত এক বছরে মসুর ডাল ১৯.৫৭%, মুগ ডাল ২৯.৩৩%, চিনি ৫৯.০৯%, পিঁয়াজ ৪৬%, শুকনা মরিচ ৩৫% ও আলু ৭৪.০৭% হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া গত এক মাসের ব্যবধানে চাল, চিনি, আটা এই তিনটি পণ্যের দাম বেড়েছে যথাক্রমে ১০.৮৭%, ৩.৮০% এবং ১৪.৬৩%।
০৩. নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধির নানা চিত্র
৩.১. অনুসন্ধানে জানা গেছে, ভরা মৌসুমে এখন চালের দাম বাড়ার কোনো কারণ নেই। স্থানীয় পাইকারী ও খুচরা চাল ব্যবসায়ীরা, হঠাৎ করে চালের দাম বাড়ার পেছনে এক শ্রেণির চাল মিল মালিকদের অতি মুনাফা লাভের প্রবণতাকে দায়ী করেছেন।
৩.২. শহরের বিভিন্ন ব্যবসায়কেন্দ্র ঘুরে তথ্যানুসন্ধান করে দেখা গেছে, কোনো ব্যবসায়ী বাজারে পণ্যের অভাব আছে বলে জানায় নি। খুচরা বিক্রেতারা নিজেদের দায়িত্ব সম্পর্কে সাফাই গেয়ে জানায় যে তারা পাইকারী বাজার থেকে উচ্চমূল্যে পণ্য ক্রয় করেছে। কম দাম হাঁকা তাদের পক্ষে অসম্ভব। পাইকারী বাজারের ব্যবসায়ীদেরও ওই একই সুর। আসলে বাজারের পরিস্থিতি এরূপ দাঁড়িয়েছে যে, মজুতদারেরাই নিজেদের লাভের জন্য জিনিসপত্রের দাম চড়িয়ে দিয়েছে এবং তাদের দেখাদেখি সকল ব্যবসায়ীরা বেশি মুনাফার পথ বেছে নিয়েছে।
৩.৩. মূল ঘটনা এই যে, বাজারের ওপর কারো কোনো সঠিক নিয়ন্ত্রণ নেই। বরং, ব্যবসায়ীরা বাজেট, খরা, বন্যা, হরতাল, ধর্মঘট, পূজাপার্বণ, ঈদ উৎসব, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্যের বৃদ্ধির অছিলায় নিত্যব্যবহার্য পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। এ যেন রেওয়াজে পরিণত হয়েছে।
৩.৪. কিছু পণ্যের ক্ষেত্রে সরকার আমদানি শুল্ক কমানোসহ অন্যান্য সুবিধা দিলেও ব্যবসায়ীরা পণ্যের দাম কমায় নি। বস্তুত, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্য বৃদ্ধির কারণ ও সূত্র নানাবিধ। তবে উৎপাদন অব্যবস্থাই যে এর মূল কারণ এতে কোনো সন্দেহ নেই। ক্রেতারা বলছেন, পণ্যমূল্য বৃদ্ধির সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে চাহিদার তুলনায় জোগানের অভাব। চাহিদা যেখানে বিশাল সমুদ্রের ন্যায়, সেখানে কূপ খনন করে পানি সরবরাহে চলে না। ফলে সীমাবদ্ধ জিনিসের জন্যে অগণিত ক্রেতার ভিড় এবং পরিণামে মূল্যবৃদ্ধি ও জিনিস সংগ্রহের জন্যে তীব্র প্রতিযোগিতা।
৩.৫. আবার প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। বন্যা, ঝড়, জলোচ্ছ্বাস প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে অনেক সময় দেশের এক অঞ্চলের সঙ্গে অন্য অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ফলে সরবরাহের স্বল্পতাহেতুও পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পায়।
৩.৬. আমাদের দেশের বহু অসাধু ব্যবসায়ী কৃত্রিম অভাব সৃষ্টিতে তৎপর। তারা অনেক সময় বিপুল পরিমাণে পণ্যদ্রব্য গুদামজাত করে রাখে। তারপর দেশে পণ্যের জন্যে যখন হাহাকার শুরু হয়, তখন অসাধু ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট গঠন করে মজুতপণ্য বাড়তি দামে বাজারে ছাড়ে। এতে ফটকাবাজদের মুনাফার অঙ্ক রাতারাতি ফুলে-ফেঁপে ওঠে, আর তাতে সাধারণ জনগণের নাভিশ্বাস ওঠে। স্থানীয় দোকানের ক্রেতা ইদ্রিস আলী এই বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে— ‘জিনিসপত্রের দাম যেই হারে বাড়তাছে, দুই দিন পরে আমাগো না খাইয়া মইরতে অইবো।
৩,৭, কেউ কেউ বলেছেন, টিসিবি সক্রিয় না থাকায় বাজারে সরকারি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে না। টিসিবি ছাড়াও নব্বই দশকের আগে পর্যন্ত দেশে বাজার দর সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ ও দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একটি সেল কার্যকর ছিল। পরে মুক্তবাজার অর্থনীতির জন্য এটি বিলুপ্ত করা হয়। এখন মুক্তবাজার অর্থনীতির কারণে চলছে টাকা বানিয়ে নেয়ার প্রতিযোগিতা ।
৩,৮. বাজারের ঊর্ধ্বগতি সম্পর্কে বাণিজ্য সচিবের কাছে মতামত চাওয়া হলে তিনি বলেন- আন্তর্জাতিক বাজারে নির্দিষ্ট কয়েকটি পণ্যের দাম কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে এ কথা সত্য, কিন্তু এ অজুহাতে আমাদের দেশের অসাধু ব্যবসায়ীরা সব পণ্যের মূল্য লাগামহীনভাবে বৃদ্ধি করেছে, এটা দুঃখজনক। সরকার বর্তমানে পণ্যের দ্রব্যমূল্য মনিটরিং করার জন্য টিসিবিকে দায়িত্ব দিয়েছে।
পাশাপাশি এখন থেকে প্রতি সপ্তাহে স্পর্শকাতর পণ্যের খুচরা ও পাইকারি মূল্যের তালিকা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বর্তমান আইন অনুযায়ী দোকানে দোকানে পণ্যের মূল্য তালিকা টানানো বাধ্যতামূলক। কিন্তু এসব আইন বাজারে কোনো প্রভাব ফেলছে না।
০৪. দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ ও বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি আমাদের সামাজিক, জাতীয় ও অর্থনৈতিক জীবনে এক দুষ্ট রাহু। তাই যথাশীঘ্র এই রাহু থেকে মুক্তির জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। এ উদ্দেশ্যে-
৪.১. বাজারে চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পণ্যের জোগান নিশ্চিত করতে হবে।
৪.২. কৃষি উন্নয়ন ও কৃষি ফলন নিশ্চিত করতে হবে। আধুনিক চাষাবাদ ও অধিক উৎপাদনশীল ফসল ফলাতে হবে।
৪.৩. কল-কারখানার উৎপাদন নিয়মিত করার উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানি প্রক্রিয়ায় যাতে বিঘ্ন না ঘটে সেজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। পণ্যের ঘাটতি দেখা দিলে সরকারি ভাণ্ডার থেকে পণ্যের যোগান দিয়ে বাজার দাম স্থিতিশীল রাখতে হবে।
৪.৪. দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখার জন্য মজুতদারি, সিন্ডিকেট ও কালোবাজারি দূর করতে হবে। মুদ্রাস্ফীতি যথাসম্ভব কমিয়ে আনতে হবে।
৪.৫. অসাধু ও ফটকা ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে।
৪.৬. সর্বোপরি সামগ্রিক বাজার ব্যবস্থাপনার ওপর সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে এবং কেউ যেন হঠকারী সিদ্ধান্ত দিয়ে দ্রব্যের মূল্যকে প্রভাবিত করতে না পারে সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। তবে শুধু সরকারের একার
পক্ষে এর সমাধান করা কঠিনতর ব্যাপার। সরকারের পাশাপাশি সচেতন জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং অসাধু মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের নৈতিকতাবিরোধী কার্যক্রম পরিহারই এই সমস্যার আশু সমাধান দিতে পারে। আশা করি সরকার ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এসব দিক বিবেচনা করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম স্থিতিশীল রাখার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
আরও দেখুন: