দুর্নীতি ও তার প্রতিকার বিষয়ে একটি প্রতিবেদন রচনা | প্রতিবেদন | ভাষা ও শিক্ষা , দুর্নীতি, উন্নয়নের অন্তরায় ও উত্তরণের পথ দুর্নীতি বাংলাদেশের সবচেয়ে ক্ষতিকর সামাজিক ব্যাধিগুলোর অন্যতম। প্রকৃত গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান অন্তরায় দুর্নীতি। দুর্নীতি শব্দটি আমাদের প্রাত্যহিকতার সঙ্গে জড়িত হয়ে গেছে। রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে সামাজিক জীবনে প্রতিদিনই আমরা কোন না কোন দুর্নীতির খবর জানছি, শুনছি এবং পড়ছি। আমাদের দেশের এমন কোনো পর্যায় নেই যেখানে দুর্নীতি বিস্তার লাভ করে নি। সরকার থেকে শুরু করে আমাদের পারিবারিক জীবন এমন কি ব্যক্তি জীবনে পর্যন্ত দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়েছে মারাত্মকভাবে।
Table of Contents
দুর্নীতি ও তার প্রতিকার বিষয়ে একটি প্রতিবেদন রচনা | প্রতিবেদন | ভাষা ও শিক্ষা
বিভিন্ন উৎসে প্রাপ্ত হিসাবে দেখা যায়, দুর্নীতি ও অপচয়ের কারণে কয়েকটি খাতে বছরে ক্ষতি হচ্ছে ৪০ হাজার কোটি টাকার বেশি (সূত্র : দৈনিক ইত্তেফাক, ১৯ জুলাই, ২০০৫)। এজিবির অডিট প্রতিবেদনে দেখা যায়, বিগত ৩৫ বছরে বাংলাদেশে ৫০-৬০ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে। বিদ্যুৎ ও অন্যান্য সেবা খাতে দুর্নীতির দরুন বছরে প্রায় ৮-১০ হাজার কোটি টাকা জাতীয় আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
০১. দুর্নীতি কেন হয় বা দুর্নীতির কারণ
দুর্নীতি সংঘটনে বেশ কিছু কারণ প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। ব্যক্তিগত কারণের পাশাপাশি পদ্ধতিগত কিছু কারণও দুর্নীতির বিস্তার ঘটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে সাধারণভাবে নিম্নোক্ত বিষয়গুলোকে দুর্নীতির মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। যেমন
১.১. জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর অকার্যকারিতা : গণতন্ত্র ও জাতীয় সততা ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো, যেমন : জাতীয় সংসদ, বিচার ব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, গণমাধ্যম, সুশীল সমাজ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত না হলে দেশে দুর্নীতির মাত্রা বৃদ্ধি পায়।
১.২. রাজনৈতিক প্রভাব : বাংলাদেশের বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে প্রশাসনে ব্যাপক রাজনৈতিক প্রভাব লক্ষণীয়। রাজনৈতিক প্রক্রিয়া দুর্নীতিগ্রস্ত ত এবং জনপ্রশাসনে এর যথেচ্ছ প্রভাব থাকার কারণে আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতি স্বাভাবিকভাবেই বৃদ্ধি পায়।
১.৩. স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব : সমাজ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তরে দুর্নীতি বিস্তারের একটি অন্যতম কারণ হল প্রশাসনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব।
১.৪. দায়িত্বে অবহেলা : নির্দিষ্ট দায়িত্বে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিদের দায়িত্ব পালনে অবহেলাও দুর্নীতির অন্যতম কারণ।
১.৫. তথ্যে অধিকারের অভাব : বিভিন্ন সেবা সংক্রান্ত এবং রাষ্ট্রীয় তথ্যে সাধারণ জনগণের অধিকার না থাকার কারণে দুর্নীত করার সুযোগ বেড়ে যায়।
১.৬. আর্থ-সামাজিক কারণ- ক. ক্রমবর্ধমান ভোগবাদী প্রবণতা ও নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় এবং খ. আয়-ব্যয়ের অসামঞ্জস্য, অর্থঅৎ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে সাধারণ জনগণ, বিশেষ করে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পক্ষে তাদের স্বাভাবিক আয়ে জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। ফলে দুর্নীতি সংঘটিত হয়।

০২. দুর্নীতির প্রভাব
রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা নিজের স্বার্থে ব্যবহার, সরকারি ক্রয়ে অতিরিক্ত মূল্য দেখিয়ে অর্থ আত্মসাৎ, ঘুষ বা কমিশনের বিনিময়ে বিদেশি কোম্পানিগুলোকে ব্যবসায় করার সুযোগ দেওয়া, সিন্ডিকেটের মাধ্যমে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বাড়িয়ে অর্থ উপার্জন, বরাদ্দকৃত অর্থের পূর্ণ ব্যবহার না করে আত্মসাৎ, বিভিন্ন সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান, যেমন : পাসপোর্ট, পুলিশ, বিদ্যুৎ, গ্যাস, টেলিফোন ও অন্যান্য খাতে ঘুষের লেনদেন, অতিরিক্ত মুনাফা আদায়, সরকারি বরাদ্দ ও অনুদানের অর্থ ও দ্রব্য আত্মসাৎ, খাদ্য ও অন্যান্য উপকরণে ভেজাল দ্রব্য মেশানো এবং বিভিন্ন সরকারি কাজে দালালদের দৌরাত্মসহ সর্বক্ষেত্রে দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে।
০৩. দুর্নীতি কীভাবে রোধ করা যায় বা এর প্রতিকার
বিশ্বের সব দেশেই কম-বেশি দুর্নীতি আছে। দুর্নীতিকে সমাজ থেকে পুরোপুরি নির্মূল করা না গেলেও সহনীয় পর্যায়ে রাখা সম্ভব। উন্নয়নশীল দেশে রাষ্ট্রের একার পক্ষে দুর্নীতি রোধ করা সম্ভব নয়। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দুর্নীতি রোধ করা সম্ভব। দুর্নীতি রোধ করতে নিচের কার্যক্রমগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
৩. ১. রাজনৈতিক সদিচ্ছা : দুর্নীতি রোধের মাধ্যমে দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতি অর্জন করতে হলে প্রয়োজন দৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকার। ৩.২. কার্যকর সংসদ : সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন কার্যকর সংসদ। সংসদে সরকারি হিসাব সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি দুর্নীতি রোধ ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। ৩.৩. স্বাধীন বিচার বিভাগ ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দুর্নীতি রোধ করা যায়।
৩.৪. সক্রিয় দুর্নীতি দমন কমিশন : দুর্নীতি প্রতিরোধে দলনিরপেক্ষ; স্বাধীন ও সক্রিয় দুর্নীতি দমন কমিশন প্রয়োজন ।
৩.৫. সুষম বেতন কাঠামো ও পর্যাপ্ত পারিশ্রমিক নির্ধারণ করলে অনেকাংশে দুর্নীতি রোধ করা সম্ভব।
৩.৬. দুর্নীতিবিরোধী সামাজিক আন্দোলন সৃষ্টি করা প্রয়োজন।
৩.৭. গণমাধ্যমের কার্যকর ভূমিকা : দুর্নীতি রোধ, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সুশাসন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে স্বাধীন গণমাধ্যম সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। দুর্নীতি একটি সামাজিক ব্যাধি। তাই দুর্নীতি প্রতিকারের জন্য প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের পাশাপাশি সাধারণ জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ। দুর্নীতি প্রতিরোধে নাগরিক সমাজ, বিশেষ করে যুব সমাজকে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলন, ১৯৬২-র শিক্ষা আন্দোলন, ৬ দফা, ১১ দফা হয়ে ১৯৬৯ এর গণঅভুত্থান-
সকল পর্যায়েই বঞ্চিত, নিপীড়িত জাতিকে মুক্তির আলো দেখিয়েছে এ দেশের যুব সমাজ। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের এই দেশ বিশ্বের ইতিহাসে সৃষ্টি করেছে এক অনন্য দৃষ্টান্ত। এ দেশের যুব সমাজ বারবার প্রমাণ করেছে আমরা হারি নি, আমরা পেরেছি, আমরা পারবো। দেশের প্রতি তরুণদের অকৃত্রিম ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধই এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে দুর্নীতিবিরোধী এই সামাজিক আন্দোলনকে।
আরও দেখুন:
- হরতাল সম্পর্কে সংবাদপত্রে প্রকাশের জন্য প্রতিবেদন রচনা | প্রতিবেদন | ভাষা ও শিক্ষা
- বৃক্ষরোপণ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন রচনা | প্রতিবেদন | ভাষা ও শিক্ষা
- ক্যাবল টিভির সুফল ও কুফল সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন রচনা | প্রতিবেদন | ভাষা ও শিক্ষা
- বন্যা দুর্গত এলাকার বিপর্যস্ত জনজীবনের বিবরণ দিয়ে একটি প্রতিবেদন | প্রতিবেদন | ভাষা ও শিক্ষা