রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত কাহিনীকবিতা ‘দুই বিঘা জমি’ তাঁর চিত্রা কাব্যগ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত একটি অনন্য সাহিত্যকর্ম। কবিতাটি বাংলার গ্রামীণ সমাজে বিদ্যমান শ্রেণীবৈষম্য এবং দুর্বলের উপর সবলের নিপীড়নের এক মর্মস্পর্শী চিত্র তুলে ধরে।
এই কবিতায় কবি একজন দরিদ্র কৃষকের করুণ কাহিনী তুলে ধরেছেন, যার মাত্র দুই বিঘা জমি এক প্রভাবশালী জমিদারের লালসার শিকার হয়। জমি জোর করে দখল নেওয়া এবং সেই কৃষকের অসহায় অবস্থার চিত্র কবি অত্যন্ত সংবেদনশীলভাবে, কবিতার ছন্দ ও কাহিনির মাধুর্যে ফুটিয়ে তুলেছেন।
‘দুই বিঘা জমি’ শুধু একটি কবিতা নয়, এটি এক ধরনের সামাজিক প্রতিবাদও, যা দুর্বল মানুষের প্রতি সহানুভূতি ও ন্যায়বোধ জাগিয়ে তোলে। এই কবিতার প্রভাব এতটাই গভীর ছিল যে, এর ভিত্তিতে নির্মিত হয় বিখ্যাত হিন্দি চলচ্চিত্র ‘দো বিঘা জমিন’, যা ভারতের সামাজিক বাস্তবতা নিয়ে তৈরি চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে অন্যতম।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই কবিতার মাধ্যমে সমাজের অন্যায় ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী সাহিত্যিক প্রতিবাদ গড়ে তুলেছেন। এই কবিতাটি সাহিত্য কণিকার অন্তর্গত। এটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত কবিতা।’দুই বিঘা জমি’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘চিত্রা’ কাব্যগ্রন্থ থেকে সংকলিত।
Table of Contents
দুই বিঘা জমি – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত কবিতা
শুধু বিঘে-দুই ছিল মোর ভুঁই, আর সবই গেছে ঋণে।
বাবু বলিলেন, ‘বুঝেছ উপেন? এ জমি লইব কিনে।’
কহিলাম আমি, ‘তুমি ভূস্বামী, ভূমির অন্ত নাই –
চেয়ে দেখো মোর আছে বড়জোর মরিবার মতো ঠাঁই।
শুনি রাজা কহে, ‘বাপু, জানো তো হে, করেছি বাগানখানা,
পেলে দুই বিঘে প্রস্থে ও দিঘে সমান হইবে টানা –
ওটা দিতে হবে।’ কহিলাম তবে বক্ষে জুড়িয়া পাণি
সজল চক্ষে, ‘করুন রক্ষে গরিবের ভিটেখানি।
সপ্তপুরুষ যেথায় মানুষ সে মাটি সোনার বাড়া,
দৈন্যের দায়ে বেচিব সে মায়ে এমনি লক্ষ্মীছাড়া!’
আঁখি করি লাল রাজা ক্ষণকাল রহিল মৌনভাবে,
কহিলেন শেষে ক্রুর হাসি হেসে, ‘আচ্ছা, সে দেখা যাবে।’
পরে মাস-দেড়ে ভিটে মাটি ছেড়ে বাহির হইনু পথে –
করিল ডিক্রি, সকলই বিক্রি মিথ্যা দেনার খতে।
এ জগতে হায় সেই বেশি চায় আছে যার ভূরি ভূরি,
রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি।
মনে ভাবিলাম, মোরে ভগবান রাখিবে না মোহগর্তে,
তাই লিখি দিল বিশ্বনিখিল দু বিঘার পরিবর্তে।
সন্ন্যাসীবেশে ফিরি দেশে দেশে হইয়া সাধুর শিষ্য –
কত হেরিলাম মনোহর ধাম, কত মনোরম দৃশ্য।
ভূধরে সাগরে বিজনে নগরে যখন যেখানে ভ্রমি
তবু নিশিদিনে ভুলিতে পারি নে সেই দুই বিঘা জমি।
হাটে মাঠে বাটে এইমত কাটে বছর পনেরো-ষোলো,
একদিন শেষে ফিরিবারে দেশে বড়োই বাসনা হল।।
নমোনমো নম, সুন্দরী মম জননী বঙ্গভূমি!
গঙ্গার তীর, স্নিগ্ধ সমীর জীবন জুড়ালে তুমি।
অবারিত মাঠ, গগনললাট চুমে তব পদধুলি –
ছায়াসুনিবিড় শান্তির নীড় ছোটো ছোটো গ্রামগুলি।
পল্লবঘন আম্রকানন, রাখালের খেলাগেহ –
স্তব্ধ অতল দিঘি কালোজল নিশীথশীতলস্নেহ।
বুক-ভরা-মধু বঙ্গের বধু জল লয়ে যায় ঘরে
মা বলিতে প্রাণ করে আনচান, চোখে আসে জল ভরে।
দুই দিন পরে দ্বিতীয় প্রহরে প্রবেশিনু নিজগ্রামে –
কুমোরের বাড়ি দক্ষিণে ছাড়ি, রথতলা করি বামে,
রাখি হাটখোলা নন্দীর গোলা, মন্দির করি পাছে
তৃষাতুর শেষে পঁহুছিনু এসে আমার বাড়ির কাছে।।
ধিক্ ধিক্ ওরে, শত ধিক্ তোরে নিলাজ কুলটা ভূমি,
যখনি যাহার তখনি তাহার – এই কি জননী তুমি!
সে কি মনে হবে একদিন যবে ছিলে দরিদ্রমাতা
আঁচল ভরিয়া রাখিতে ধরিয়া ফলফুল শাক-পাতা!
আজ কোন্ রীতে কারে ভুলাইতে ধরেছ বিলাসবেশ –
পাঁচরঙা পাতা অঞ্চলে গাঁথা, পুষ্পে খচিত কেশ!
আমি তোর লাগি ফিরেছি বিবাগি গৃহহারা সুখহীন,
তুই হেথা বসি ওরে রাক্ষসী, হাসিয়া কাটাস দিন!
ধনীর আদরে গরব না ধরে! এতই হয়েছ ভিন্ন –
কোনোখানে লেশ নাহি অবশেষ সে দিনের কোনো চিহ্ন!
কল্যাণময়ী ছিলে তুমি অয়ী, ক্ষুধাহরা সুধারাশি।
যত হাসো আজ, যত করো সাজ, ছিলে দেবী – হলে দাসী।।
বিদীর্ণহিয়া ফিরিয়া ফিরিয়া চারি দিকে চেয়ে দেখি –
প্রাচীরের কাছে এখনো যে আছে সেই আমগাছ একি!
বসি তার তলে নয়নের জলে শান্ত হইল ব্যথা,
একে একে মনে উদিল স্মরণে বালককালের কথা।
সেই মনে পড়ে, জ্যৈষ্ঠের ঝড়ে রাত্রে নাহিকো ঘুম,
অতি ভোরে উঠি তাড়াতাড়ি ছুটি আম কুড়াবার ধুম।
সেই সুমধুর স্তব্ধ দুপুর, পাঠশালা-পলায়ন –
ভাবিলাম হায়, আর কি কোথায় ফিরে পাব সে জীবন।
সহসা বাতাস ফেলি গেল শ্বাস শাখা দুলাইয়া গাছে,
দুটি পাকা ফল লভিল ভূতল আমার কোলের কাছে।
ভাবিলাম মনে, বুঝি এতখনে আমারে চিনিল মাতা।
স্নেহের সে দানে বহু সম্মানে বারেক ঠেকানু মাথা।।
হেনকালে হায় যমদূতপ্রায় কোথা হতে এল মালী।
ঝুঁটিবাঁধা উড়ে সপ্তম সুরে পাড়িতে লাগিল গালি।
কহিলাম তবে, ‘আমি তো নীরবে দিয়েছি আমার সব –
দুটি ফল তার করি অধিকার, এত তারি কলরব।’
চিনিল না মোরে, নিয়ে গেল ধরে কাঁধে তুলি লাঠিগাছ;
বাবু ছিপ হাতে পারিষদ-সাথে ধরিতেছিলেন মাছ –
শুনে বিবরণ ক্রোধে তিনি কন, ‘মারিয়া করিব খুন।’
বাবু যত বলে পারিষদ-দলে বলে তার শতগুণ।
আমি কহিলাম, ‘শুধু দুটি আম ভিখ মাগি মহাশয়!’
বাবু কহে হেসে, ‘বেটা সাধুবেশে পাকা চোর অতিশয়!’
আমি শুনে হাসি, আঁখিজলে ভাসি, এই ছিল মোরে ঘটে –
তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ, আমি আজ চোর বটে।।
দুই বিঘা জমি কাহিনী (সংক্ষিপ্ত)ঃ
ভিটেমাটির এই দুই বিঘা জমি। কিন্তু উপেনের কপাল খারাপ। তার এলাকার জমিদার বাবুর ভূমির শেষ নেই। তবুও জমিদার বাবুর নজর পড়ে উপেনের দুই বিঘা জমির উপর। বাবু উপেনের জমি কিনতে চান। শুনে উপেন বলে, রাজা এই দেশের মালিক আপনি, জায়গার অভাব নেই কিন্তু আমার এই জায়গাটি ছাড়া মরার মতো ঠাঁই নেই; উপেন দুই হাত জোড় করে বাবুর কাছে ভিটেটা কেড়ে না নেওয়ার অনুরোধ করে। এতে বাবু রেগে চোখ গরম করে চুপ করে থাকেন। নাছোড়বান্দা বাবু দেড় মাস পরেই মিথ্যে ঋণের দায়ে উপেনের প্রতি ডিক্রি জারি করেন। উপেন নিজের ভিটে ছেড়ে পথে পথে ঘুরে বেড়ায়।
এভাবে ১৫/১৬ বছর কেটে যায়। অনেক তীর্থস্থান, শহর, গ্রাম সে বিচরণ করে, তবুও উপেন তার দুই বিঘা জমির কথা ভুলতে পারে না। তাই মাতৃভূমির টানে উপেন একদিন নিজ গ্রামে ফিরে আসে। গ্রামে এসে নিজ বাড়ির সামনে এসে উপস্থিত হয়ে দেখে বাড়িতে আগের কোন চিহ্ন নেই। উপেনের মন বিষণ্ন হয়ে পড়ে, তার বসতভিটা নিজ ঐতিহ্য ভুলে অন্য রূপ ধারণ করেছে। নিজের বাড়িতে এসে উপেন স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ে। তার চোখ জলে ভরে যায়। অবশেষে তার ছেলেবেলার সেই আমগাছটির দিকে চোখ পড়ে উপেনের। স্মৃতিময় আমগাছটি দেখে তার মনের ব্যথা দূর হয়ে যায়। আমগাছটির নিচে বসে সে ভাবতে থাকে ছেলেবেলার কথাগুলো।
তখন হঠাৎ তার কোলের কাছে দুটি আম ঝরে পড়ে। ক্ষুধার্ত উপেন ভাবে আমগাছটি তাকে চিনতে পেরে দুটি আম উপহার দিয়েছে। কিন্তু আম দুটি হাতে নিতেই বাগানের মালি লাঠি হাতে এসে উপেনকে গালিগালাজ করে, উপনকে ধরে রাজার কাছে নিয়ে যায়। বাবু তখন মাছ ধরছিলেন। মালির কাছে সব শুনে বাবু রেগে উপেনকে বকা দেন, মারতে চান। উপেন কাতর হূদয়ে বাবুর কাছে আম দুটো ভিক্ষা চায়। কিন্তু বাবু উপেনকে সাধুবেশী চোর বলে উল্লেখ করেন। এতে উপেন হতভম্ব হয়ে যায়। চোর উপাধি শুনে উপেনের চোখ দিয়ে ভাগ্যের নিষ্ঠুরতা ও পরিহাসের কথা মনে পড়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে থাকে।
দুই বিঘা জমি কবিতা আবৃত্তিঃ
শব্দার্থ ও টীকা
বিঘে – বিঘা শব্দের চলিত রূপ। জমির পরিমাপ বিশেষ। কুড়ি কাঠা বা ১৪৪০০ বর্গফুট বা ১৩৩৪ বর্গমিটার পরিমাণ জমি।
ভূস্বামী – অনেক জমির মালিক, জমিদার।
দিঘে — দৈর্ঘ্যে, লম্বা দিকের মাপে।
পাণি – হাত।
বক্ষে জুড়িয়া পাণি – বুকে জোড় হাত রেখে অনুনয় করে ।
সপ্ত পুরুষ – পূর্ববর্তী সাত বংশধর বা প্রজন্ম ।
লক্ষ্মীছাড়া — লক্ষ্মী ছেড়েছে এমন, দুর্ভাগা, ভাগ্যহীন।
ক্রুর — নিষ্ঠুর, নির্দয়।
ডিক্রি – আদালতের হুকুম বা নির্দেশনামা ।
খত – ঋণপত্র, ঋণের দলিল ।
ভূরি ভূরি – প্রচুর।
কাঙাল – নিঃস্ব, দরিদ্র।
মোহত – মোহের ক্ষুদ্র গহ্বর।
বিশ্বনিখিল – গোটা দুনিয়া, সমগ্র পৃথিবী।
হেরিলাম – দেখলাম ।
ধাম — তীর্থস্থান ।
ভূধর— পর্বত, পাহাড়।
নমো নমো নম – নমস্কার, বন্দনাজ্ঞাপক অভিব্যক্তি বিশেষ ।
সমীর – বাতাস, বায়ু।
ললাট – কপাল ।
খেলাগেহ – খেলাঘর।
নিশীথ — গভীর রাত |
নিশীথ শীতল স্নেহ – হৃদয়জুড়ানো গভীর মমতা ।
প্রহর – তিন ঘণ্টা কাল, দিনরাত্রির আট ভাগের এক ভাগ ।
গোলা – শস্য রাখার মরাই বা আড়ত ।
তৃষাতুর – পিপাসা বা তৃষ্ণায় কাতর ।
পঁহুছিনু — পৌঁছে গেলাম ।
লভিল – লাভ করল, পেল ।
উড়ে – ভারতের উড়িষ্যা বা ওড়িয়া প্রদেশের লোক।
কলরব – কোলাহল, হট্টগোল, হৈচৈ।
পারিষদ – মোসাহেব, পার্শ্বচর।
ঘটে – মাথার মগজে, এখানে ভাগ্যে অর্থে ব্যবহৃত।
পাঠের উদ্দেশ্য
এ কবিতা পাঠ করে শিক্ষার্থীরা শোষক শ্রেণির নিষ্ঠুর শোষণ ও গরিবদের দুর্দশা সম্পর্কে জানতে পারবে। গরিবদের প্রতি তারা সহানুভূতিশীল হবে।
পাঠ-পরিচিতি
‘দুই বিঘা জমি’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘চিত্রা’ কাব্যগ্রন্থ থেকে সংকলিত। দরিদ্র কৃষক উপেন অভাব-অনটনে বন্ধক দিয়ে তাঁর প্রায় সব জমি হারিয়েছে। বাকি ছিল মাত্র দুই বিঘা জমি। কিন্তু জমিদার তাঁর বাগান বাড়ানোর জন্য সে জমি কিনে নিতে চায়। কিন্তু সাত পুরুষের স্মৃতি বিজড়িত সে জমি উপেন বিক্রি করতে না চাইলে জমিদারের ক্রোধের শিকার হয় সে । মিথ্যে মামলা দিয়ে জমিদার সে জমি দখল করে নেয়। ভিটেছাড়া হয়ে উপেন বাধ্য হয় পথে বেরুতে। সাধু হয়ে সে গ্রাম-গ্রামান্তরে ঘোরে। কিন্তু পৈতৃক ভিটের স্মৃতি সে ভুলতে পারে না ।
একদিন চির-পরিচিত গ্রামে সে ফিরে আসে। গ্রামের অন্য সবকিছু ঠিকঠাক থাকলেও তার ভিটে আজ নিশ্চিহ্ন। কিন্তু হঠাৎ সে লক্ষ করে তার ছোট বেলার স্মৃতি-বিজড়িত সেই আম গাছটি এখনও আছে। সেই আম গাছের ছায়াতলে বসে ক্লান্ত-শ্রান্ত উপেন পরম শান্তি অনুভব করে। তার মনে পড়ে, ঝড়ের দিনে কত না আম সে কুড়িয়েছে এখানে। হঠাৎ বাতাসের ঝাপটায় দুটি পাকা আম পড়ে তার কোলের কাছে। আম দুটিকে সে জননীর স্নেহের দান মনে করে গ্রহণ করে। কিন্তু তখনই ছুটে আসে মালি।
উপেনকে সে আম-চোর বলে গালাগালি করতে থাকে। উপেনকে জমিদারের নিকট হাজির করা হয়। উপেন জমিদারের কাছে আমটি ভিক্ষা হিসেবে চাইলে জমিদার তাকে সাধুবেশী চোর বলে মিথ্যা অপবাদ দেয় ।
এই কবিতার মাধ্যমে কবি দেখাতে চেয়েছেন, সমাজে এক শ্রেণির লুটেরা বিত্তবান প্রবল প্রতাপ নিয়ে বাস করে। তারা সাধারণ মানুষের সম্পদ লুট করে সম্পদশালী হয়। তারা অর্থ, শক্তি ও দাপটের জোরে অন্যায়কে ন্যায়, ন্যায়কে অন্যায় বলে প্রতিষ্ঠা করে। ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতাটিতে কবি এদের স্বরূপ তুলে ধরেছেন।
কবি-পরিচিতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্বকবি, বিশ্বনন্দিত কবি। কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে তাঁর জন্ম ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দের ৭ই মে, ১২৬৮ বঙ্গাব্দের ২৫শে বৈশাখ। ছেলেবেলায় বিদ্যালয়ের বাঁধাধরা পড়াশোনায় তাঁর মন বসেনি। পড়াশোনার জন্য তাঁকে ওরিয়েন্টাল সেমিনারি, নর্মাল স্কুল, বেঙ্গল একাডেমি—এসব শিক্ষা- প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করা হয়েছিল। কিন্তু পাঠ শেষ করার আগেই তিনি সেসব ছেড়ে দেন। ছোটবেলা থেকেই তাঁর কবি-প্রতিভার উন্মেষ ঘটে।
সাহিত্যের সকল শাখায় অসামান্য দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন তিনি। কবিতা, সংগীত, ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনি, রম্যরচনা ইত্যাদি সাহিত্যের প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাঁর পদচারণা ছিল স্বচ্ছন্দ, উজ্জ্বল। তিনি একাধারে কবি, দার্শনিক, গীতিকার, সুরকার, শিক্ষাবিদ, চিত্রশিল্পী, নাট্য-প্রযোজক ও অভিনেতা।
১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে ইংরেজিতে অনূদিত ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যের জন্য তিনি এশীয়দের মধ্যে প্রথম সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। আমাদের জাতীয় সংগীত — আমার সোনার বাংলা’ তাঁরই লেখা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দের ৭ই আগস্ট (২২শে শ্রাবণ, ১৩৪৮ বঙ্গাব্দ) কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন ।
কর্ম-অনুশীলন
ক. কবিতাটি তোমার নিজস্ব ভাষায় গল্পে, নাটিকায় বা বর্ণনাধর্মী গদ্যে রূপায়িত কর।
খ. তোমার জানা কোনো কৃষকের অত্যাচারিত জীবনের একটি কাহিনী লিপিবন্ধ কর (একক কাজ)।
গ. কবিতাটির নাট্যরূপ দাও এবং শ্রেণির সকল শিক্ষার্থীর সহযোগিতায় অভিনয়ের মাধ্যমে উপস্থাপন কর।
নমুনা প্রশ্ন
বহুনির্বাচনি প্রশ্ন
১. ‘দুই বিঘা জমি’ কোন ধরনের কবিতা ?
ক. কাহিনী-কবিতা
খ. গীতিকবিতা
গ. চতুর্দশপদী কবিতা
ঘ. স্বদেশপ্রেমের কবিতা
২. ‘সেই মনে পড়ে জ্যৈষ্ঠের ঝড়ে রাত্রে নাহিকো ঘুম’—পঙ্ক্তিটিতে যে ভাব প্রকাশ পেয়েছে তা হলো—
i. স্মৃতিকাতরতা
ii. স্পর্শকাতরতা
iii. অনুদারতা
নিচের কোনটি সঠিক ?
ক. i
খ. i ও ii
গ. i ও iii
ঘ. ii ও iii
৩. বাবু সাহেবের সম্পত্তি-আকাঙ্ক্ষা ফুটে উঠেছে যে চরণে, তা হচ্ছে—
i. বাবু কহিলেন, বুঝেছ উপেন, এ জমি লইব কিনে
ii. পেলে দুই বিঘে, প্রস্থে ও দিঘে সমান হইবে টানা
iii. এ জগতে হায়, সেই বেশি চায় আছে যার ভূরি ভূরি
নিচের কোনটি সঠিক ?
ক. i ও ii
খ. ii ও iii
গ. i ও iii
ঘ. ii ও iii
নিচের উদ্দীপকটি পড়ে ৪ ও ৫ নম্বর প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও :
রাজিব সাহেব এক যুগ আগে আমেরিকায় গিয়ে প্রচুর বিত্ত-বৈভবের মালিক হয়েছেন। কিন্তু তারপরও তার মনে সুখ নেই। সেখানকার পরিবেশ, প্রকৃতি, মানুষজন কোনো কিছুই তাকে আকৃষ্ট করে না। সারাক্ষণ মনটা পড়ে থাকে আঁকা-বাঁকা মেঠো পথের ধারের কুঁড়েঘরে, যেখানে কেটেছে তার শৈশব, কৈশোরের সোনালি সময়।
8. উদ্দীপকে রাজিব সাহেবের মানসিকতায় ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতার কোন অনুভূতি প্রকাশ পেয়েছে ?
ক. স্বদেশপ্রীতি
খ. প্ৰকৃতিপ্রীতি
গ. স্বাজাত্যপ্রীতি
ঘ. মর্ত্যপ্রীতি
৫. উক্ত অনুভূতি নিচের কোন চরণে ফুটে উঠেছে ?
ক. চেয়ে দেখো মোর আছে বড়-জোর মরিবার মতো ঠাঁই ।
খ. কত হেরিলাম মনোহর ধাম, কত মনোরম দৃশ্য।
গ. কল্যাণময়ী ছিলে তুমি অয়ি ক্ষুধাহরা সুধারাশি।
ঘ. তবু নিশিদিনে ভুলিতে পারিনে, সেই দুই বিঘা জমি ।
সৃজনশীল প্রশ্ন
গাজীপুর চৌরাস্তার কাছে মতিন মিয়ার ছোট্ট এক চায়ের দোকান। আর দোকানের পাশেই ‘ক’ হাউজিং সোসাইটির বিশালাকার অ্যাপার্টমেন্ট গড়ে উঠেছে। একদিন সকালে মতিন দেখে, তার দোকান অ্যাপার্টমেন্টের সীমানা প্রাচীরের মধ্যে আটকে গেছে। সে বুঝে গেল আর কিছুই করার নেই। উপায়ান্তর না দেখে সে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে ঘুরে ফ্লাক্সে করে চা বিক্রি করে সংসার চালায় আর উদাস দৃষ্টিতে গগনচুম্বি অট্টালিকাগুলোর দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
ক. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কত খ্রিষ্টাব্দে নোবেল পুরস্কার পান?
খ. ‘রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি’—বলতে কী বোঝানো হয়েছে?
গ. ‘ক’ হাউজিং সোসাইটির কার্যক্রমে ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতার বাবু সাহেব চরিত্রের যে দিকটি ফুটে উঠেছে তার বর্ণনা দাও ।
ঘ. উদ্দীপকের মতিন ‘দুই বিঘা জমির’ শোষিত উপেনের সার্থক প্রতিনিধি কি না— এ বিষয়ে তোমার মতামত যুক্তি সহকারে উপস্থাপন কর।