ণত্ব বিধানের নিয়মাবলি

ণত্ব বিধানের নিয়মাবলি নিয়ে আজকের আলোচনা। সাধারণভাবে তৎসম শব্দে ঋ, র, ষ -এর পর মূর্ধন্য ‘ণ’ ব্যবহৃত হবে। (তৎসম শব্দে র-ফলা, রেফ, ক্ষ-এর পর মূর্ধন্য ‘ণ’ ব্যবহৃত হয়।)

ণত্ব বিধানের নিয়মাবলি

Capture 40 ণত্ব বিধানের নিয়মাবলি

Capture 41 ণত্ব বিধানের নিয়মাবলি

দ্রষ্টব্য : মূর্ধন্য ণ ব্যবহৃত হচ্ছে। মূর্ধন্য ষ-এর পরে যুক্ত হয়ে মূর্ধন্য-ণ যুক্তব্যঞ্জন গঠন করলে তা ষ্ণ (মূর্ধন্য ষ-য়ে তৃষ্ণা বীক্ষণ রক্ষণাবেক্ষণ সংরক্ষণ ক্ষ যুক্তবর্ণটির গঠন : ক-য়ে মূর্ধন্য ষ। অর্থাৎ এর অভ্যন্তরে ষ রয়ে গেছে বলেই এই অক্ষরের পরে মূর্ধন্য ণ)-এর রূপ নেয়।

 

ণত্ব বিধানের নিয়মাবলি | ণত্ব ও ষত্ব বিধান | ভাষা ও শিক্ষা

 

যেমন ‘র’ = র, ঋ, রেফ ( ), ঋ-কার (,), র-ফলা (a ) অথবা ‘ষ’-এর পরে যদি স্বরবর্ণ, ক-বর্গের ৫টি (ক খ গ ঘ ঙ) এবং প-বর্গের ৫টি (প ফ ব ভ ম) এবং য য় হ ং এই বর্ণগুলোর ব্যবধান থাকে তবে তার পরেও মূর্ধন্য ণ হবে। যেমন :

Capture 42 ণত্ব বিধানের নিয়মাবলি

তবে ওপরের নিয়মের কিছু ব্যতিক্রমও আছে। যেমন : আয়ুষ্মান্, গরীয়ান্, চক্ষুষ্মান্, নির্গমন, পূষ, বহির্গমন, বর্ষীয়ান, রঙ্গন, শ্রীমান্ ইত্যাদি । লক্ষণীয় একই পদের মধ্যে প্রথমে ঋ র্-এর পরে যদি স্বরবর্ণ, ক-বর্গ, প-বর্গ, য-ব-হ এবং অনুস্বারের ব্যবধান থাকে তা হলেও ‘ন’ পরিবর্তিত হয়ে‘ণ’ হবে। রণ (অণ— এখানে ‘অ’ ব্যবধান) বক্ষ্যমাণ (অঅআণ)— এখানে ক + ষ্-এর পর অ ম্ আ ব্যবধান। স্পৃহণীয় (ঋঅঈঅ)— এখানে ‘ঋ’-এর পর হ্ অ ব্যবধান এই নিয়মেই অপেক্ষমাণ, ম্রিয়মাণ।

অন্য বর্ণ ব্যবধান থাকলে ‘ণ’ হবে না। অর্চনা, অর্জন, দৰ্শন, কীর্তন [এই সব শব্দে যথাক্রমে র্-এর পর চ, জ, শ ও ত ব্যবধান আছে। ] মনে রাখতে হবে এ দুটি নিয়ম এক পদেই প্রযোজ্য। যেখানে দুটি পদ নিয়ে শব্দটি সেখানে এ দুটি নিয়ম খাটবে না। তাই দুর্ণাম নয়, দুর্নাম। হরিণাম নয়, হরিনাম। ত্রিনয়ন। বীরাঙ্গণা নয়, । শিক্ষাঙ্গণ নয়, শিক্ষাঙ্গন । বীরাঙ্গনা। শি াম। ত্ৰিণয়ন নয়, ।

Capture 43 ণত্ব বিধানের নিয়মাবলি

‘তাম্রনখ’ মানে যখন তাম্রের মতো নখ যার, তখন ‘ন’, কিন্তু তাম্রনখ যদি কারও নাম হয় তাহলে ‘ণ’ হবে। ট-বর্গের ট ঠ ড ঢ— এই চারটি বর্ণের পূর্বে যদি নৃ ধ্বনি থাকে এবং ঐ ‘ন্’ সহযোগে যদি যুক্তবর্ণ তৈরি হয়, তা হলে তা সর্বদা মূর্ধন্য ণ হবে ৷ যেমন :

Capture 44 ণত্ব বিধানের নিয়মাবলি

 

উত্তর, পর, পার, চান্দ্র, নার, রাম শব্দের পরে ‘অয়ন’ শব্দ হলে দন্ত্য ন পাল্টে মূর্ধন্য ণ হয়। উদাহরণ : উত্তর + অয়ন = উত্তরায়ণ, পর + অয়ন = পরায়ণ, পার + অয়ন = পারায়ণ, চান্দ্র + অয়ন চান্দ্রায়ণ, নার + অয়ন নারায়ণ, রাম + অয়ন = রামায়ণ ইত্যাদি। ৫, ৬ ও ৭-এর বিকল্প নিয়ম : প্র, পরা, পরি, নির্ এই চারটি উপসর্গ ও অন্তর্ শব্দের পরে নদ্, নম্, নশ্, নহ্, নী, নু, নুদ্, অন্ ও হন্ ধাতুর ‘নৃ’ ণ হবে। -প্রণাম, পরিণাশ। ব্যতিক্রম : প্রনষ্ট, পরিনষ্ট। সুনীতিকুমার ণত্ব-বিধানে উদাহরণ হিসেবে ‘প্ৰণষ্ট’ লিখেছেন, কিন্তু পাণিনি ব্যাকরণে প্রনষ্ট শব্দটিকে ব্যতিক্রম হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

ন – নহ্—পরিণাহ; নী—প্রণয়; নু—প্ৰণব; নুদ—প্রণোদ, প্রণোদিত; অন্—প্ৰাণ; হন্—অন্তৰ্ণন অগ্র ও গ্রাম শব্দের পরবর্তী ‘নী’ ধাতুর ‘ন’ ‘ণ’ হয় : অগ্রণী, গ্রামণী প্র, পরা, পূর্ব, অপর— এগুলোর পর ‘অহ্ন’ শব্দ থাকলে ‘ন্’ ‘ণ’ হয়। যেমন : প্রাহ্ণ, পরাহ্ণ, পূর্বাহ্ণ, অপরাহ্ণ। মধ্যাহ্ন ও সায়াহ্ন শব্দে ণ হবে না কারণ এখানে ‘অহ্ন’ ‘মধ্য’ ও ‘সায়’ শব্দের পরে আছে। প্র, পরা, পরি, নির্— এই চারটি উপসর্গ এবং অন্তর্ শব্দের পর কৃৎ প্রত্যয়ের দন্ত্য ‘ন’ মূর্ধন্য ‘ণ হয়, যদি সেই প্রত্যয়ের আগে স্বরবর্ণ থাকে।

যেমন : যা— প্রয়াণ (প্র-√য়া+অন); আপ্‌—প্রাপণীয় (প্ৰ- √আপ্+অনীয়); মা—প্রমাণ (প্র-√মা+অন), নির্মাণ (নির্-√মা+অন)। তা ছাড়া এমন শব্দ অনেক আছে যেখানে স্বভাবতই মূর্ধন্য ণ বসে। কোনো নিয়মের সূত্রে যেগুলোকে ফেলা যায় না, সেগুলো স্বতঃসিদ্ধ; মনে রাখার জন্যে তাই এ-জাতীয়, শব্দগুলো মুখস্থ করে বা লিখে লিখে অভ্যাস করে আয়ত্তে আনতে হয়। যেমন— অণু, কল্যাণ ইত্যাদি। স্বতঃসিদ্ধ শব্দগুলোকে সহজে মনে রাখার জন্যে নিচের ছড়াটি বেশ উপকারে আসবে:

Capture 45 ণত্ব বিধানের নিয়মাবলি

ত-বর্গের ত থ দ ধ— এই চারটি বর্ণের পূর্বে যদি ধ্বনি থাকে এবং ওই ‘ন্’ সহযোগে যদি যুক্তবর্ণ তৈরি হয়, তা হলে সেই যুক্তব্যঞ্জনে সর্বদা দন্ত্য ন হবে । উদাহরণ : অন্ত, কান্ত, প্রান্ত; কথা, পন্থা; অন্দর, খন্দ, ছন্দ, বন্দি; অন্ধ, গন্ধ, পিন্ধন, বন্ধ, বন্ধন ইত্যাদি । এই ণত্ব-বিধান বিদেশি শব্দ অথবা বিদেশি নামের বানানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।

অর্থাৎ এ -সকল ক্ষেত্রে ‘মূর্ধন্য ণ’-এর স্থলে ‘দন্ত্য ন’ ব্যবহৃত হবে। উদাহরণ : গ্রিন, আলবেরুনি, ব্রেইন, ড্রেইন, ইস্টার্ন । এরকম : আয়রন, ইরান, কার্নিশ, কুর্নিশ, কেরানি, কোরান, ক্লোরিন, জার্মান, ট্রেনিং, ফার্নিচার, বার্নার, বার্নিশ, মেরুন, রানার, শিরনি, সাইরেন, হর্ন, স্যাকারিন, হ্যারিকেন, হারমোনিয়াম ইত্যাদি ।

সংস্কৃত ব্যাকরণের নিয়মে কিছু সাধিত শব্দে ণত্ব বিধি কার্যকর হয় “না। ফলে ওই ধরনের তৎসম শব্দে দন্ত্য ন বহাল থাকে। যেমন : পরান রূপবান অগ্রনায়ক ছাত্রনিবাস দুর্নিবার নির নীর প্ৰনষ্ট সর্বনাম অগ্রনেতা ত্রিনয়ন দুর্নিমিত্ত নির্গমন পরনিন্দা বহির্গমন হরিনাম অহর্নিশ ত্রিনেত্র দুর্নিরীক্ষ্য নির্নিমেষ ক্ষুন্নিবৃত্তি দুর্নাম দুর্নীতি নিষ্পন্ন পুরুষানুক্রমে শ্রীমান্ খাঁটি বাংলা শব্দে ও অতৎসম শব্দে (অর্থাৎ তদ্ভব শব্দে) সর্বদা দন্ত্য ন হবে।

 

ণত্ব বিধানের নিয়মাবলি | ণত্ব ও ষত্ব বিধান | ভাষা ও শিক্ষা

 

বাংলা ভাষার শব্দভাণ্ডারে মূল সংস্কৃত শব্দের যে রূপটি বাংলায় সরাসরি না এসে প্রাকৃত ভাষার মাধ্যমে পরিবর্তিত হয়ে ঢুকেছে তাকে বলা হয় তদ্ভব বা প্রাকৃতজ শব্দ। যেমন : সংস্কৃত ‘চন্দ্র’ শব্দটি প্রাকৃতে হয়েছে চন্দ এবং বাংলায় হয়েছে চাঁদ। চন্দ্র > চন্দ > চাঁদ। এ ধরনের শব্দের মূল সংস্কৃত বানানে মূর্ধন্য ণ বহাল থাকবে, কিন্তু তদ্ভব শব্দের বানানে মূর্ধন্য ণ-এর স্থলে দন্ত্য ন হবে। যেমন :

ক্রিয়াপদে সর্বদাই ‘ন’ হয়। যেমন: করেন, করুন, ধরুন, ধরেন, মারেন ইত্যাদি। ময়ট্ (ময়) প্রত্যয়ের ম্-যোগে ত্ স্থানে যে ‘ন্’ হয় তা মূর্ধন্য ণ হবে না। মৃন্ময় (মৃত্+ময়)। লক্ষণীয় ণত্ববিধি কেবল তৎসম শব্দেই প্রযোজ্য, অতৎসম শব্দে প্রযোজ্য নয়। সমোচ্চারিত শব্দের বানানে দন্ত্য ন এবং মূর্ধন্য ণ-এর পার্থক্যের জন্যে অর্থেরও পার্থক্য ঘটে। সুতরাং অর্থ-বিভ্রান্তি এড়াতে দন্ত্য ন এবং মূর্ধন্য ণ-এর ব্যবহার সম্পর্কে দৃষ্টি রাখতে হবে। pp অণু—ক্ষুদ্রতম অংশ অনু—পিছন আপণ—দোকান আপন—নিজ গুণ— বৈশিষ্ট্য বাণ—তীর, শর গুন—নৌকা টানার দড়ি বান—বন্যা।

 

 

 

আরও দেখুন:

Leave a Comment