ডেঙ্গু জ্বর, ডেঙ্গুজ্বর ও তার প্রতিকার প্রতিবেদন রচনা। Essay on Dengue fiber

ডেঙ্গু জ্বর, ডেঙ্গুজ্বর ও তার প্রতিকার [ Essay on Dengue fiber ] অথবা, ডেঙ্গুজ্বরের প্রাদুর্ভাব ও প্রতিকার – নিয়ে একটি প্রতিবেদন রচনার নমুনা দেয়া হল।

ডেঙ্গু জ্বর রচনা । Essay on Dengue fiber
ডেঙ্গু জ্বর রচনা । Essay on Dengue fiber

ডেঙ্গু জ্বর রচনার ভূমিকা :

আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি যেমন চিকিৎসা ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন এনেছে তেমনি পৃথিবীতে নিত্যনতুন মারাত্মক রােগও দেখা দিচ্ছে। ডেঙ্গুজ্বর তেমনি একটি মারাত্মক রােগ। এ রােগে আক্রান্ত রােগীকে সময়মতাে চিকিৎসা প্রদান করতে না পারলে মারাত্মক অসুবিধা হয়। এমনকি যেকোনাে সময় প্রাণহানিও ঘটে যেতে পারে। সম্প্রতি পৃথিবীর দেশে দেশে ডেঙ্গুজ্বরের প্রাদুর্ভাবের। কথা শুনা যাচ্ছে।

ডেঙ্গুজ্বর :

মানবদেহে ডেঙ্গুভাইরাসের আক্রমণজনিত ক্ল্যাসিক্যাল বা হেমােরেজিক ধরনের তীব্র জ্বরের নামই ডেঙ্গুজ্বর। সম্প্রতি বাংলাদেশে ডেঙ্গুজ্বরের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। আর এ রােগের বাহক হচ্ছে ‘এডিস’ নামক এক ধরনের বিশেষ মশা । যদিও এদেশে ডেঙ্গুজ্বর বিষয়ে বেশি আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে তবুও ভয়ের তেমন কারণ নেই। এর প্রতিকার এবং প্রতিরােধ অনেকটা সহজ এমনকি নিশ্চিত।

 

এডিস মশার পরিচয় :

এডিস মশা দেখতে গাঢ় নীলাভ কালাে রঙের । এ মশার সারা শরীরে সাদা-কালাে ডােরা কাটা দাগ আছে, পাগুলাে একটু লম্বাটে ধরনের। এডিস এজিইপটাই এবং এডিস এলােপিটাস নামক এ দুই প্রজাতির স্ত্রী মশা ডেঙ্গুজুরের ভাইরাস। বহন করে থাকে। এডিস মশা সাধারণত দিনের বেলায় কামড়ায়। বিশেষ করে সকাল বেলার প্রথম দিকে ও বিকেল বেলার শেষ দিকে এ মশা বেশি কামড়ায়। আর এদের বংশবিস্তার একটু ব্যতিক্রমধর্মী । এরা বর্ষাকালে বংশবিস্তার করে। বর্ষা মৌসুমে যখন কিছুদিন পরপর বৃষ্টি হয় তখন এদের বংশবিস্তার ঘটে। কোথাও পরিষ্কার অথচ জমানাে পানি পেলে এরা সেখানে ডিম পাড়ে। যেমন- বাড়ির আশেপাশে পড়ে থাকা ভাঙা পাত্র, ডাবের খােসা, প্লাস্টিকের বােতল, আইসক্রিমের কৌটা, টায়ার, ফুলের টব, এসি বা ফ্রিজের নিচে জমে থাকা পানিতে এরা ডিম পাড়ে। এভাবেই এদের বংশবিস্তার ঘটে।

আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

ডেঙ্গুজ্বরের উদ্ভব ও বিস্তার :

১৭৮০ সালে ডেঙ্গুজ্বর প্রথম দেখা দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়া অঙ্গরাজ্যে । তারপর ১৯২২ সালে এটি মহামারি আকার ধারণ করে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস ও লুসিয়ানা অঙ্গরাজ্যে। ১৯২৭ সালে অস্ট্রেলিয়ায় এবং ১৯২৮ সালে গ্রিসে ডেঙ্গুজ্বরের কারণে মানুষ মারা যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে প্রথম ডেঙ্গুভাইরাস শনাক্ত করা হয়। ১৯৪৪ সালে ড. আলবার্ট মার্টিন ডেঙ্গু ভাইরাস আবিষ্কার করেন। ডেঙ্গুর মারাত্মক পর্যায় ডেঙ্গু হেমােরেজিক ফিভার। আর এ ফিভার সবচেয়ে বেশি দেখা দিয়েছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় । ১৯৭০ সালে বিশ্বের ৯০টিরও অধিক দেশে হেমােরেজিক ফিভারের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যায় । ১৯৮১ সালে এ ফিভার আবার ভেনিজুয়েলায় ছড়িয়ে পড়ে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় ৪০-৪৫ মিলিয়ন লােক ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে ।

ডেঙ্গুজ্বরের প্রকারভেদ :

ডেঙ্গুজ্বর এডিস মশাবাহিত এক ধরনের আর এন এ ফ্ল্যাবি ভাইরাসজনিত তীব্র জ্বর । এ জ্বর সাধারণত দুধরনের হয়ে থাকে। যথা— ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গুজ্বর ও হেমােরেজিক ডেঙ্গুজ্বর । ডেঙ্গু ভাইরাসের ৪টি সেরােটাইপ রয়েছে। এগুলাে হলাে : DEN-১, DEN-2, DEN-৩, ও DEN-৪। ৪টি সেরােটাইপ থেকে ডেঙ্গুজ্বর হতে পারে। তবে এগুলাের মধ্যে মারাত্মক DEN-২, DEN-৩ এ দুই সেরােটাইপের ডেঙ্গু ভাইরাসই হেমােরেজিক ডেঙ্গুজ্বরের কারণ।

ডেঙ্গুজ্বরের উপসর্গ :

ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গুজ্বরের ক্ষেত্রে যেসকল উপসর্গ দেখা যায় সেগুলাে হলাে— তীব্র জ্বর (জ্বর সাধারণত ১০৪/১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত হয়ে থাকে)। বমি, পেটব্যথা, মাথাব্যথা, কোমর ব্যথা, অস্থিসন্ধি বা জয়েন্ট ব্যথা, চোখের পেছনে ব্যথা ইত্যাদি। এক্ষেত্রে হাড় ব্যথা এতটাই প্রচণ্ড হয় যে, মনে হয় হাড় ভেঙে গেছে।

এ কারণে এই জ্বরকে ‘ব্রেক বােন ফিভার’ বলা হয়ে থাকে। অনেক সময় শরীরের ত্বকে এলার্জি র্যাশের মতাে র্যাশ দেখা দিতে পারে। এসব র্যাশ কখনাে কখনাে চুলকানির উদ্রেক করে থাকে । হেমােরেজিক বা রক্তক্ষরা ডেঙ্গুজ্বর খুবই মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে।

ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গুজুরের উপসর্গগুলােই এক্ষেত্রে আরও তীব্র হয়ে দেখা দেয় এবং সঙ্গে রক্তক্ষরণ হতে থাকে। বিশেষ করে মাড়ি বা নাক দিয়ে রক্তপাত, ত্বকের নিচের রক্তের জমাট বাধা রক্তবমি, পায়খানার সাথে কালাে রক্ত যাওয়া ইত্যাদি দেখা দিয়ে থাকে। রক্তক্ষরণের ফলে হাইপােভালিউমিক শকে রােগীর মৃত্যু পর্যন্ত হয়ে থাকে। এ অবস্থাকে বলা হয় ডেঙ্গু শক সিনড্রোম।

ডেঙ্গু জ্বর রচনা । Essay on Dengue fiber
ডেঙ্গু জ্বর রচনা । Essay on Dengue fiber

ডেঙ্গুজ্বরের কারণ :

এডিস মশার কামড়ে ডেঙ্গুজ্বর হয়। এডিস এডিইপটাই ও এডিস এলােপিটাস নামক দুই প্রজাতির স্ত্রী মশা ডেঙ্গুজ্বরের ভাইরাস বহন করে। বর্ষা মৌসুমে এ রােগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যায় । এ মৌসুমে প্রজননের জন্য তারা মানুষের রক্ত গ্রহণ করে। এর কারণ হলাে তাদের ডিম ফুটানাের জন্য মানুষের রক্ত উত্তম খাদ্য। আর রক্ত খাওয়ার সময় ডেঙ্গু ভাইরাস মশার দেহে ঢুকে যায়। এর ফলে মশাটি বিষাক্ত হয়ে ওঠে এবং কাউকে কামড়ালে সে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয় ।

বাংলাদেশে ডেঙ্গুজুর :

বাংলাদেশে ১৯৬৪ সালে প্রথম ডেঙ্গুজ্বর ধরা পড়ে। থাইল্যান্ডের একদল বিশেষজ্ঞ প্রথম বাংলাদেশে ডেঙ্গুজুর শনাক্ত করেন। এ জুরের ক্ষেত্রে কোনাে কারণ চিহ্নিত করতে না পারায় বিশেষজ্ঞরা এর নাম দিয়েছিলেন ঢাকা ফিভার বা ঢাকাইয়া। জুর’ । পরবর্তী সময়ে বিশেষজ্ঞরা এ জ্বরের বিভিন্ন কারণ, লক্ষণ চিহ্নিত করতে পেরে ১৯৬৪ সালে এর নাম দেন ডেঙ্গুজ্বর।

১৯৬৪ সালের পর ১৯৯৯ সালের জুন মাসে এবং ২০০০ সালের আগস্ট মাসে আবারও বাংলাদেশে ডেঙ্গুজ্বর দেখা দেয় তবে ২০০০ সালে। এটি মারাত্মক আকার ধারণ করে। ২০০০ সালের পর থেকে প্রতিবছরই বাংলাদেশে কম-বেশি ডেঙ্গুজ্বর হয়। তবে মানুষের। সচেতনতা ও চিকিৎসার ফলে প্রকট আকার ধারণ করতে পারেনি ।

ডেঙ্গুজ্বরের চিকিৎসা পদ্ধতি :

ডেঙ্গুজ্বরের কোনাে সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই । ক্লাসিক্যাল এবং রক্তক্ষরণ বা হেমােরেজিক ডেঙ্গুজুর উভয়। ক্ষেত্রেই চিকিৎসা উপসর্গ অনুযায়ী করতে হবে।

১. ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গুজ্বর সাধারণত ৭ দিনের মধ্যে সেরে যাবে। এক্ষেত্রে উপসর্গ অনুযায়ী চিকিৎসা করতে হয়। যেমন- ব্যথার জন্য প্যারাসিটামল, বমির জন্য স্টিমিটিল জাতীয় ওষুধ দেওয়া হয়। এছাড়া ডেঙ্গুজ্বরে প্রচুর পানি পান করতে হয় ।

২. হেমােরেজিক ডেঙ্গুজ্বর হলে রােগীকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। প্রতিদিন রােগীর রক্তের প্লেটলেট কাউন্ট এবং পিসিভি পরীক্ষা করাতে হবে । হেমােরেজিক ডেঙ্গুজ্বরে রােগীর প্লেটলেট কাউন্ট কমে যেতে পারে । প্লেটলেট কাউন্ট ১০ হাজারের নিচে নেমে গেলে রােগীকে শিরাপথে প্লেটলেট ট্রান্সফিউশন করতে হবে। আর যদি রােগীর প্রত্যক্ষ রক্তক্ষরণ হয়, তাহলে রােগীকে রক্ত দিতে হবে । ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত রােগীর ব্যথার জন্য এসপিরিন জাতীয় ওষুধ দেওয়া যাবে না। কারণ, এতে রক্তক্ষরণের প্রবণতা বেড়ে যায়।

প্রতিরােধ :

ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হলে আমাদের প্রধান করণীয় হলাে চিকিৎসকের সাহায্য নেওয়া এবং প্রতিরােধ ব্যবস্থা গ্রহণ করা । এজন্য নিন্মােক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে-

১. এডিস মশা ডেঙ্গুজ্বরের বাহক, তাই বাহক মশার দমনই হলাে ডেঙ্গুজ্বর প্রতিরােধের প্রধান উপায় ।

২. বাসগৃহে ফুলের টব, অব্যবহৃত কৌটা, ড্রাম, নারিকেলের মালা, গাড়ির টায়ার ইত্যাদিতে জমে থাকা পানিতে এডিস মশা ডিম পাড়ে। এসব পানি জমার স্থান ধ্বংস করতে হবে।

৩. ঘরে জমে থাকা পানি নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে।

৪. এডিস মশা দিনের বেলায় কামড়ায়, তাই দিনের বেলায় ঘুমানাের সময় মশারি ব্যবহার করতে হবে ।

৫. ডেঙ্গু সন্দেহ হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

ডেঙ্গু জ্বর রচনা । Essay on Dengue fiber
ডেঙ্গু জ্বর রচনা । Essay on Dengue fiber

প্রতিষেধক আবিষ্কার :

মানুষের অনেক অসাধ্যই বিজ্ঞান সাধন করে দিয়েছে। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞানের বিস্ময়কর যুগে ডেঙ্গুজ্বরের । কোনাে প্রতিষেধক না থাকা সত্যিই দুঃখজনক ব্যাপার। বিশ্ববাসীর এ দুঃখ ঘুচিয়ে দিতে গত কিছুদিন আগে আশার বাণী শুনাল ডায়রিয়া রােগের আন্তর্জাতিক গবেষণা কেন্দ্র আইসিডিডিআরবি। আইসিডিডিআরবি’র প্রােগ্রাম অন ইনফেকসাস ডিজিজ অ্যান্ড ভেকসিন সায়েন্স-এর প্রধান রবার্ট এফ ব্রেইমেন জানিয়েছেন, আগামী ১ বছরের মধ্যেই ডেঙ্গুজ্বরের প্রতিষেধক আবিষ্কার সম্ভব হবে। বলে আশা করা হচ্ছে। এ প্রতিষেধক আবিষ্কার হলে ডেঙ্গু আর সব সাধারণ রােগের মতােই বিবেচিত হবে।

উপসংহার :

ভয়াবহ ডেঙ্গুজ্বরের কালাে থাবা ছিনিয়ে নিয়েছে অনেক জীবন । চিকিৎসা বিজ্ঞানের সফলতার যুগে এমন অনাহুত। অকাল মৃত্যু কারােরই কাম্য নয়। তাই ডেঙ্গুজ্বরের কারণে আর কোনাে অমূল্য জীবন যেন হারিয়ে না যায়, সেজন্য আমাদের সবাইকে। সচতেন হতে হবে ।

আরও পরুনঃ

Leave a Comment