জাতীয় সংহতি দিবস বা সৈনিক হত্যা দিবস

জাতীয় সংহতি দিবস বা সৈনিক হত্যা দিবস নিয়ে রচনার একটা নমুনা তৈরি করি আজ। এই রচনাটি আমাদের “আন্তর্জাতিক ও জাতীয় দিবস” সিরিজের একটি রচনা। আমাদের সকল রচনা শিক্ষার্থীদের ধারণা দেবার জন্য। মুখস্থ করার জন্য নয়। এই রচনা থেকে শিক্ষার্থীরা শুধুমাত্র ধারণা নেবেন। তারপর নিজের মতো করে নিজের নিজের ভাষায় লিখবেন।

জাতীয় সংহতি দিবস

আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস | আন্তর্জাতিক ও জাতীয় দিবস | বাংলা রচনা সম্ভার

ভূমিকা :

৭ নভেম্বর আমাদের জাতীয় জীবনের একটি ঐতিহাসিক দিন। এ দিনটি একদিকে সিপাহি জনতার বিপ্লবের দিন হিসেবে পরিচিত। অন্যদিকে এই দিন বাংলাদেশ রাষ্ট্র আবার ঘুরে পিছনের পথে চলা শুরু করারও দিন বটে। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ১৯৭৬ সাল থেকে এ দিনটিকে ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ হিসেবে সরকারিভাবে পালন করা হলেও ১৯৯৭ সাল থেকে ২০০০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত বিগত আওয়ামী লীগ সরকার এ দিনটিকে সরকারি দিবস হিসেবে মর্যাদা দেয়নি।

গত ১ অক্টোবর ২০০১ অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় ঐক্যজোট ক্ষমতাসীন হওয়ার পর দিবসটি আবার গুরুত্ব লাভ করে। জোট সরকার ৭ নভেম্বরকে ‘জাতীয় সংহতি ও বিপ্লব দিবস’ হিসেবে পালন করায় দিবসটির ঘটনাপ্রবাহ বর্তমান সময়ে নতুন করে গুরুত্ব লাভ করেছে ।

জাতীয় সংহতি দিবস | আন্তর্জাতিক ও জাতীয় দিবস | বাংলা রচনা সম্ভার

 

জাতীয় সংহতি দিবস বা সৈনিক হত্যা দিবসের ঘটনার পটভূমি :

১৫ আগস্ট ১৯৭৫ দেশ ও বিদেশি ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে সেনাবাহিনীর একদল বিদ্রোহী অফিসারেরা স্বাধীনতার স্থপতি ও বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত করে। তারা তাদের ষড়যন্ত্রের সাথে যুক্ত বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রী খন্দকার মোস্তাক আহমেদকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করে। দেশে সামরিক শাসন জারি করে। তবে দেশে সামরিক শাসন জারি হলেও সংবিধান এবং সংসদ ভেঙে দেয়া হয়নি। মোশতাক আহমেদ এম এ জি ওসমানীকে প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা এবং সেনাবাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল শফিউল্লাহকে সরিয়ে দিয়ে জিয়াউর রহমানকে সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। রাষ্ট্রপতি মোস্তাক আহমদ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েই ব্যাপক পরিবর্তন আনয়ন করেন।

একদিকে তিনি যেমন ইনডেমিনিটি আদেশ জারি করেন অন্যদিকে শেখ মুজিব প্রবর্তিত বাকশাল সরকার প্রথা বাতিল করেন। তা ছাড়া তিনি সরকারের চরিত্রে ইসলামী বিশ্বাস ও মূল্যবোধের নামে পাকিস্তানি ভাবধারা প্রতিষ্ঠা করেন। দেশের এ নতুন পরিবর্তন ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ মানতে চাননি। তিনি ভেতরে ভেতরে গোপন তৎপরতা অব্যাহত রাখেন এবং ৩ নভেম্বর ১৯৭৫ ঢাকা সেনানিবাসে এক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমানকে পদচ্যুত করে বন্দি করেন। সে সাথে নিজেকে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত করে সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর থেকে ৭ নভেম্বর পর্যন্ত আলোচিত দিনগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের উদ্দেশ্য ছিল খন্দকার মোস্তাক আহমদের সরকারকে উৎখাত করা এবং সে স্থলে পূর্বের সরকারকে পুনরায় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করা।

তারা ধরে নেয় যে, খালেদ মোশাররফের মাধ্যমে মুজিববাদীরা ক্ষমতায় ফিরে আসছে। তারা আরো বিশ্বাস করে যে, খালেদ মোশাররফের পিছনে ভারতের আশীর্বাদ আছে।’ খালেদ মোশাররফের ইচ্ছা ছিল খন্দকার মোস্তাককে ক্ষমতাচ্যুত করে কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি আওয়ামী লীগের চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমেদ, ক্যাপ্টেন (অব) মনসুর আলী এবং এএইচএম কামরুজ্জামানের নেতৃত্বে একটি সরকার গঠন করা। এজন্যই সেনাবাহিনীর পদ দখল করলেও তিনি নিজেকে সরকারপ্রধান হিসেবে ঘোষণা করেননি।

কিন্তু দুটি কারণে খালেদ মোশাররফের সে পরিকল্পনা ভেঙে যায়। ট্যাঙ্ক বাহিনীর সমর্থনে আগস্ট-অভ্যুত্থানকারীদের প্রতিরোধের প্রেক্ষিতে ৬ নভেম্বরের আগে তিনি বঙ্গভবনের দখল নিতে পারেননি। দ্বিতীয় কারণটি আরো মর্মান্তিক। সেনানিবাসে সংঘটিত অভ্যুত্থানের দিনই কারাগারের অভ্যন্তরে আওয়ামী লীগের ঐ চার নেতাকে হত্যা করা হয়।

বঙ্গভবন দখলে অত্যধিক বিলম্ব ঘটায় সকল দিক থেকে খালেদ মোশাররফ পিছিয়ে পড়েছিলেন। ঢাকার সেনানিবাস, তেজগাঁও বিমানবন্দর এবং রেডিও স্টেশন দখল করতে পারলেও শাহবাগ থেকে বঙ্গভবনসহ রাজধানীর বিস্তীর্ণ এলাকা বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। এ ধরনের নাজুক এক পরিস্থিতিতে সম্মুখযুদ্ধ কিংবা দুই পক্ষের সমঝোতা ছাড়া কোনো বিকল্প ছিল না। ফলে উভয় পক্ষই সমঝোতার পথে পা বাড়াতে বাধ্য হয় এবং সমঝোতা অনুযায়ী মুজিব হত্যাকারীদের দেশ ত্যাগ করার সুযোগ করে দেয়া হয়।

খালেদ মোশাররফ বঙ্গভবনের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেন ৬ নভেম্বর । তিনি প্রেসিডেন্ট মোস্তাককে গেপ্তার করেন এবং তার মন্ত্রিসভা বাতিল ঘোষণা করেন। কিন্তু জেলখানায় চার নেতার হত্যার প্রেক্ষিতে খালেদ মোশাররফের পরিকল্পনায় পরিবর্তন আসে। তিনি বাধ্য হয়ে বিচারপতি আবু সাদাত মুহাম্মদ সায়েমকে প্রেসিডেন্ট পদে আসীন করেন। সে দিনই সন্ধ্যায় রেডিও এবং টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া এক ভাষণে বিচারপতি সায়েম জাতীয় সংসদ ভেঙে দেন এবং নতুন নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন।

জাতীয় সংহতি দিবস | আন্তর্জাতিক ও জাতীয় দিবস | বাংলা রচনা সম্ভার

 

সিপাহি জনতার বিপ্লব ও আফটারম্যাথ :

খালেদ মোশাররফ সেনাপ্রধানের দায়িত্ব নেবার পর তার উদ্দেশ্য ও পরিকল্পনার কথা দেশবাসীর কাছে স্পষ্ট করে না বলায় একধরনের ধোঁয়াশা তৈরি হয়। জাসদ, বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা খালেদ মোশাররফকে ‘রুশ-ভারতের এজেন্ট’ হিসেবে প্রচার করে বিভ্রান্তি তৈরি করে। তার ভাই রাশেদ মোশাররফ আওয়ামী লীগের নেতা হওয়ায় এবং ৪ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রসমাজের উদ্যোগে একটি মিছিল বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে শ্রদ্ধা জানাতে গেলে সেই মিছিলে খালেদ মোশাররফের মা অংশ নেওয়ায় এটা প্রচার হয় যে ‘ভারতপন্থি আওয়ামী লীগ’ আবার ক্ষমতায় আসছে। সেনানিবাসগুলোর ভেতরে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার পক্ষ থেকে সাধারণ সিপাহীদের উস্কানি দিয়ে হাজার হাজার প্রচারপত্র বিলি করা হয়। আতিকুল আলম এবং এনায়েতুল্লাহ খানের মতো সাংবাদিকরা চরম অসত্য খবর প্রচার করে মানুষের মনে ভারতবিরোধিতা তীব্র করে তোলার রসদ জোগান।

প্রতিক্রিয়াশীল, ধর্মান্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধবিরোধী সব শক্তি ঐক্যবদ্ধ হয়ে পড়ে খালেদ মোশাররফের অবস্থানের বিরুদ্ধে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ এবং তার মিত্ররা তখন ছিল অসংগঠিত, বিচ্ছিন্ন এবং কিছুটা দিশাহারা। পরিস্থিতির সুযোগ নেয় জাসদ, গণবাহিনী, বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা। সামরিক বাহিনীর উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার আগেই খালেদ একপ্রকার বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। ব্রিগেডিয়ার থেকে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হওয়া ছাড়া আর কিছু তিনি দেশের মানুষের কাছে স্পষ্ট করতে পারেননি। অথচ ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর থেকে ৬ নভেম্বর রাত পর্যন্ত কর্নেল তাহেরের উদ্যোগে সেনানিবাসসহ বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য সভা হয়েছে। কর্নেল তাহের একটি পাল্টা অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করেছিলেন। তিনি সৈনিকদের অস্ত্র হাতে বেরিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছিলেন। বাইরে অপেক্ষা করবে জাসদ সমর্থক শ্রমিক-ছাত্ররা আর সেনানিবাস থেকে বেরিয়ে আসবে সশস্ত্র সৈনিকরা। এভাবেই সৈনিক-জনতার অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করে তা বাস্তবায়ন করেছিলেন কর্নেল তাহের।

কর্নেল তাহের কালবিলম্ব না করে তার নেতৃত্বাধীন সেনাকল্যান সংস্থার কতিপয় সৈনিকদের  ৬ নভেম্বর সন্ধ্যা রাতে যে কোনো নির্দেশের জন্য তার সৈনিকদের প্রস্তুত রাখেন। আরো সিদ্ধান্ত নেয়া হয় ৬ নভেম্বর দিবাগত রাত ১ টায় বিপ্লব শুরু হবে। বিপ্লবী পদক্ষেপ ছিল-

১. খালেদ মোশাররফের অপসারণ; জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করা ।

২. বিপ্লবী সৈনিক কমান্ড কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা করা।

৩. দলমত নির্বিশেষে সকল বন্দির মুক্তি।

৪. সর্বদলীয় জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠা (বাকশাল বাদে)।

৪. বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার বারো দফা বাস্তবায়ন ।

৫. নভেম্বর সকালে সৈনিকরা ব্যারাক থেকে বেরিয়ে আসে।

স্বতঃস্ফূর্তভাবে অস্ত্রগুদাম ভেঙে অফিসারদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে সৈনিকরা মিছিলে হাজির হয় । তারা রেডিও স্টেশন, টিভি, টেলিফোন ভবন, পোস্ট অফিস এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে নেন। রাত তিনটায় কর্ণেল তাহের অবরুদ্ধ জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করেন। সৈনিকরা সেকেন্ড ফিল্ড আর্টিলারি সদর দপ্তরে জিয়াকে কাঁধে নিয়ে আসে।

অবশ্য যে উদ্দেশ্য নিয়ে সৈনিকরা জেনারেল জিয়াউর রহমানকে উদ্ধার করে, তা বাস্তবায়িত হয়নি। বরং পরবর্তীকালে বিভিন্ন মামলাল অসংখ্য সৈনিকসহ কর্নেল তাহেরকে ফাঁসিতে ঝোলায় জিয়াউর রহমান। এ কারণে অনেকে এ দিনটিকে কালো দিবস হিসেবে আষায়িত করেছেন।

৭ নভেম্বর সরকারি ছুটি :

ঐতিহাসিক গুরুত্বের কারণেই ১৯৭৬ সাল থেকে ৭ নভেম্বর ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ হিসেবে বাংলাদেশে পালিত হয়ে আসছে এবং এ দিনে সরকারি ছুটি পালন করা হয়। কিন্তু ১৯৯৭ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আদেশ বলে ৭ নভেম্বর সরকারি ছুটির দিন বাতিল করা হয়, যদিও আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম বছর ১৯৯৬ সালের ৭ নভেম্বর সরকারি ছুটির দিন বহাল ছিল। আওয়ামী লীগ এ দিবসটিকে ‘সৈনিক হত্যা দিবস’ হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকে।

আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

উপসংহার :

৭ নভেম্বর জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবসকে ঘিরে অনেক বিতর্ক ও সমালোচনা থাকলেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। সুতরাং বাঙালি জাতির চিন্তাচেতনায় এ দিবসটির তাৎপর্য ও গুরুত্ব আরো বিশ্লেষণ ও মূল্যায়নের দাবি রাখে।

 

আরও দেখুন:

Leave a Comment