‘ফুটকড়াই’ কবিতাটি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শক্তিশালী আধুনিক কবি জয় গোস্বামী-এর একটি অনন্যসাধারণ সৃষ্টি। এই কবিতায় কবি তুলে ধরেছেন নিম্নবর্গের এক মেয়ের জীবন, তার লাঞ্ছনা, সংগ্রাম এবং দ্রোহের অন্তর্লীন গল্প। ‘ফুটকড়াই’ শুধু একজন নারী নয়, বরং একটি প্রতীক—একটি শ্রেণির প্রতিচ্ছবি—যাকে সমাজ বরাবরই অবহেলা করে এসেছে।
কবিতার কেন্দ্রীয় চরিত্র ‘ফুটকড়াই’ এক গরিব মেয়ের নাম, যার দিকে তাকিয়ে কবির কণ্ঠে উচ্চারিত হয়—
“ওই যে যাচ্ছে ফুটকড়াই / কার ঘর ভাঙবে ফুটকড়াই?”
এই পংক্তির মধ্য দিয়ে ফুটে ওঠে একদিকে সামাজিক বিদ্রূপ, অন্যদিকে চরম সত্য—এক দরিদ্র মেয়ের অস্তিত্ব সমাজের চোখে শুধুই সম্ভাব্য বিপর্যয়ের উৎস।
এই কবিতায় জয় গোস্বামী তাঁর স্বভাবসুলভ প্রতীকী ভাষা, ইঙ্গিতপূর্ণ শব্দচয়ন ও অনুভূতির তীব্রতায় তুলে ধরেছেন নারী জীবনের নিগৃহীত বাস্তবতা এবং শ্রেণি বৈষম্যের নির্মম চিত্র। তাঁর ভাষা কখনও কাঁটা হয়ে বিঁধে যায়, আবার কখনও গানের মতো বয়ে যায় মর্মে।
‘ফুটকড়াই’ কবিতা নারী, সমাজ ও শ্রেণির জটিল সংলাপে একটি প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর—যা আমাদের ভাবায়, ব্যথিত করে, আবার জাগিয়েও তোলে। এটি নিঃসন্দেহে বাংলা আধুনিক কবিতার ইতিহাসে এক মাইলফলক রচনা।
জয় গোস্বামীর ফুটকড়াই কবিতা
পরির পাশে পরির বোন,
দাঁড়িয়ে আছে কতক্ষণ।
জ্বর থেকে তো উঠল কাল,
রোদের তাপে মুখটি লাল।
লম্বা লাইন ইস্কুলের,
দাও দারোয়ান গেট খুলে।
পরির পাশে পরির মা-ও,
বলছে, ঠাকুর রোদ কমাও,
আবার অসুখ করবে ওর
নষ্ট হবে একবছর।
বয়স কত ? বয়ঃক্রম ?
সেসব ভাবার সময় কম।
ভর্তি হবার জন্য আজ,
টেষ্টে বসাই পরির কাজ।
পরি তো নয়, পরির বোন,
পাঁচ বছরের কম এখন।
এদিক তাকায়, ওদিক চায়;
গোরু বসছে গাছতলায়
একটা কুকুর দৌড়ে যায়,
ট্যাক্সি গাড়ি পাশ কাটায়
গাড়ি থামায় নীল পুলিশ…
কী ভাবছিস রে ? কী ভাবছিস ?
এ বি সি ডি, ওয়ান টু আর
ভুল করিস না, খবরদার !
ভুল করিস না লক্ষ্মীটি,
‘ছি’ দেবে কাকপক্ষিটি।
ভুল করিস না, ধরছি পা’য়
মা কী করে মুখ দেখায়।
না যদি পাস অ্যাডমিশন,
কোন চুলোতে যাই তখন।
পাশের বাড়ির বাপটুও,
দেখবি কেমন দেয় দুয়ো।
চায় না তো মা আর কিছুই,
নম্বর চায়-আনবি তুই।
নাম হবে তোর খুব বড়,
নামের পাশে নম্বরও
বাড়তে বাড়তে সাতশো মন,
না হবে তোর যতক্ষণ
দাঁড়িয়ে থাকবি, দাঁড়িয়ে থাক,
লাল সাদা আর নীল পোশাক।
পরির দিদি, পরির বোন
কতক্ষণ আর কতক্ষণ
ওই খুলেছে, ওই তো, চল,
রোদ পোড়া সব পরির দল
টুম্পি, টিমা, মম, টোকাই
মাথায় মাথায় পিন ঢোকাই।
ফুটকড়াই, ফুটকড়াই,
ঠিক ডাটা ঠিক ফিড করাই।
ব্যস, হয়েছে প্রোগ্রামিং,
তিড়িং বিড়িং তিড়িং বিং
বন্ধ এখন, জোর সে চল,
কোর্সে কোর্সে এগিয়ে চল
ঊর্ধ গগনে বাজে মাদল
মাথার ওপর যাঁতার কল
ফুটফুটে সব ছাত্রীদল
ছাত্রদল
চল রে চল
এই তো চাই, ফুটকড়াই।
ফুটকড়াই কবিতা আবৃত্তিঃ