জনমত গঠনে বেতার ও টেলিভিশন | গণমাধ্যম | বাংলা রচনা সম্ভার , ভূমিকা : সাধারণ অর্থে জনমত বলতে জনসাধারণের মতামতকে বোঝায়। তবে জনমতকে অবশ্যই জাতীয় স্বার্থের অনুকূলে হতে হবে। সম্প্রদায়ের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জনগণের অভিমতের সমষ্টিই জনমত। লক্ষ্যণীয় যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেই তাদের মতামত জনমত হবে এমন কথা নয়। সংখ্যালঘুদের, এমনকি একজনের মতামতও জনমতে পরিণত হতে পারে। এর ভিত্তি হবে সার্বিক কল্যাণ, মঙ্গল ও যুক্তি সঙ্গত দাবি যদি অধিকাংশ জনগণ কোনো বিষয় সম্পর্কে মতামত প্রকাশ করে এবং তা যদি নিজেদের এবং দেশের সামগ্রিক স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর হয়, তাহলে সে মত জনমত হতে পারে না। উদাহরণসহ বলা যায়, সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ যদি চায় যে, তাদের ধূমপানের অধিকার থাকা উচিত, তাহলে তা জনমত হতে পারে না ।
জনমত গঠনে বেতার ও টেলিভিশন | গণমাধ্যম | বাংলা রচনা সম্ভার
জনমত গঠনে বেতার ও টেলিভিশন
জনমত যুক্তিপূর্ণ এবং সর্বসাধারণের কল্যাণার্থে গঠিত হবে। অধ্যাপক লাওয়েল (Lowell) বলেন, ‘জনমতের জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠতা যথেষ্ট নয় অথবা একমত হওয়ারও প্রয়োজন হয় না।’ অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠতা যথেষ্ট নয় এবং একমতের প্রয়োজন হয় না। তবে উক্ত মতকে এমন হওয়া আবশ্যক যেন সংখ্যালঘুদের জন্যও গ্রহণীয় হয় এবং তারা বিশ্বাসের সাথে মেনে নেয়। যুক্তিভিত্তিক, জ্ঞানপূর্ণ, কল্যাণকামী এবং সর্বোপরি জাতীয় মঙ্গলে গঠিত মতামতকে জনমত বলা হয়।
লর্ড ব্রাইসের মতে, ‘জনমত হচ্ছে সম্প্রদায়ের স্বার্থ ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জনগণের অভিমতের সমষ্টি। তাই দেখা যায়, জনমত অবশ্যই দেশের স্বার্থের অনুকূলে হবে। ব্যক্তি বা গোষ্ঠীগত স্বার্থে হলে তা হতে পারে না। উক্ত মতকে জনমত না বলে ব্যক্তি বা দলীয় মত বলা যায়। গণতন্ত্রে জনমতকে অত্যধিক প্রাধান্য দেয়া হয়। অনেক সময় জনগণের মতামতকে ‘ঈশ্বরের বাণী’ হিসেবে গ্রহণ করা হয়। ঈশ্বর বা খোদার বাণীকে যেমন জনমতকেও তেমনি অবজ্ঞা করা যায় না। গণতন্ত্রে জনমত হলো মূল চালিকা শক্তি ও প্রাণ বায়ু ।
জনমত গঠনের মাধ্যম : জনমত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কিন্তু তা এমনি গঠিত হয় না। গঠনের জন্য কিছু বাহন প্রয়োজন এবং সেগুলো সুন্দর হওয়া দরকার, কারণ এগুলোই জনমতের সঠিক অর্থ নিরূপণ করে। তাই বলা হয়, ‘মাধ্যম যেমন করে জনমতও তেমনিভাবে গড়ে ওঠে। এগুলোর মধ্যে কিছু আছে দৃশ্যমান উপাদান এবং কিছু অদৃশ্য কিন্তু ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য উপাদান। তবে দৃশ্যমান উপাদান; যেমন- রেডিও, টেলিভিশন, সভা-সমিতি, সেমিনার, প্রচারাভিযান প্রভৃতিই জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মূলত জনমত একটি আপেক্ষিক বিষয়, যা কেবল কূটকৌশলের মাধ্যমে অধিকতর ফলপ্রসূ করে তোলা যায়।
বেতার ও টেলিভিশন আবিষ্কার বেতারযন্ত্রের আবিষ্কার কোনো বিজ্ঞানীর একক প্রচেষ্টার ফল নয়। বেতার যন্ত্রের প্রথম পূর্ণাঙ্গ রূপ দান করেন ইতালির বিজ্ঞানী মার্কনি। ১৯০১ সালে তিনি প্রথম সংবাদ আদান-প্রদানের ঘটনাটি বেতারযন্ত্র ব্যবহারের প্রথম ঘটনা। মার্কনির বেতার উদ্ভাবনের ত্রিশ বছর আগে ইংরেজ বিজ্ঞানী ব্লাক মাক্সওয়েল গণিতের মাধ্যমে তড়িৎ চুম্বকীয় তরঙ্গের অস্তিত্ব প্রমাণ করেন। তার বিশ বছর পরে ১৮৮৭ সালে জার্মান বিজ্ঞানী হাইনরিখ হার্টজ গবেষণাগারে সে তরঙ্গ উৎপাদন করেন।
১৮৯৬ সালে বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু কোলকাতায় এই একই তরঙ্গের উদ্ভাবন করেন । তিনিই প্রথম বিজ্ঞানী যিনি দেখান যে, বিদ্যুৎ তরঙ্গ অনেক দূরে দয়াল বা কোনো কঠিন বস্তু ভেদ করে ধ্বনি সংকেত পাঠাতে পারে। কিন্তু মার্কনির উদ্ভাবনই আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতি লাভ করে। উদ্ভাবিত বেতার সংকেত প্রেরণই পরবর্তীকালে আধুনিক বেতার যন্ত্রের রূপ পরিগ্রহ করে।
১৯২২ সালে জার্মান বিজ্ঞানী কন-এর বেতারে ছবি পাঠানো থেকে টেলিভিশনের যাত্রা শুরু। ১৯২৭ সালে ইংল্যান্ডের বিজ্ঞানী জন লোগি বেয়ার্ড বেতারে চলন্ত মানুষের ছবি পাঠানোর সাফল্য অর্জন করলে টেলিভিশনের জয়যাত্রা সগৌরবে বিঘোষিত হয়। তবে ১৯৪৫ সাল থেকে টেলিভিশন বর্তমান রূপ পরিগ্রহ করেছে। সাম্প্রতিককালে ভূউপগ্রহ যোগাযোগের মাধ্যমে টেলিভিশন হয়ে উঠেছে পরম বৈচিত্র্যপূর্ণ জনপ্রিয় যোগাযোগ, বিনোদন ও শিক্ষার মাধ্যম। আমাদের দেশে টেলিভিশন এসেছে ষাটের দশকে। কিন্তু স্বল্প সময়ের মধ্যে তা যেমন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে তেমনি তার সম্প্রসারণও ঘটেছে যথেষ্ট। সাধারণ মানুষও নানাভাবে টেলিভিশন অনুষ্ঠান উপভোগের সুযোগ পাচ্ছে। তাই আমাদের জাতীয় জীবনে টেলিভিশনের ভূমিকা তাৎপর্যের অধিকারী বলে যথার্থই বিবেচনার যোগ্য ।
জনমত গঠনে টেলিভিশন : জনমত গঠনে বেতারের মতোই টেলিভিশনের ভূমিকা অনন্যসাধারণ। কোনো বিষয়ে জনমত গঠনের লক্ষ্যে টেলিভিশনে প্রচারণা চালানো হলে তা সহজেই জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। জনগণ বিচার-বিশ্লেষণ করে সে বিষয়ের প্রতি তাদের মতামত প্রদান করে। টেলিভিশনের প্রচারণা কৌশল অত্যন্ত মোহনীয়। এটা বিভিন্ন অস্পষ্ট ধারণাকে সুস্পষ্টভাবে জনগণের সামনে উপস্থাপন করে। যার ফলশ্রুতিতে জনমত হয়ে ওঠে প্রায়োগিক ও গতিশীল। টেলিভিশন জনমত গঠনে তিনটি ভূমিকা পালন করে। যথা :
১. জনগণের বিভ্রান্তি দূরীকরণ ।
২. জনগণের মতামত স্পৃহাকে অধিকতর জোরালো করে ।
৩. জনগণকে করে তোলে সচেতন ও আত্মপ্রত্যয়ী ।
জনমত গঠনে টেলিভিশনের ভূমিকা সম্পর্কে ড. শমশের আলী বলেন, ‘The extra ordinary role played by television in the formation of public opinion can hardly be overemphasized truly দুঃখের বিষয় যে বাংলাদেশ টেলিভিশন স্বাধীনভাবে কখনো কাজ করতে পারেনি। ৭১ থেকে ৯৯ সাল পর্যন্ত প্রায় সবক্ষেত্রেই টেলিভিশন নিজস্ব পরিকল্পনা প্রয়োগ করে সুষ্ঠু জনমত গঠনে সক্ষম হয়নি। তাই আক্ষেপ করে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. নূরুল আমীন বেপারী বলেন, ‘It is really irony of fate that we couldn’t ensure the suitable condition of radio and television in Bangladesh still now.’
জনমত গঠনে বেতার : বিভিন্ন বিষয়ে জনমত গঠনে বেতারের ভূমিকা অনস্বীকার্য। জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিস্তার, সভ্যতা-সংস্কৃতির বিকাশ, জাতীয় সমস্যার সমাধান, জনগণের শুভচেতনার বোধোদয়, সর্বোপরি সুস্থ সুন্দর সমাজ গঠনের পথ-নির্দেশক হিসেবে বেতার এক অন্যতম মাধ্যম। বেতারকে রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সাথে সহজলভ্য গণমাধ্যমের ‘সেতুবন্ধন’ বলা যায়। কোনো একটি বিষয় পরিকল্পিতভাবে বেতারে প্রচার করলে জনগণ সহজেই এর প্রতি সাড়া দেয়। জনমত গঠনে বেতার কয়েকটি বিষয়ে অভূতপূর্ব ভূমিকা পালন করে। যেমন—
১. জনগণের যুগোপযোগী অভিমতকে সমাজের সর্বস্তরে পৌঁছে দেয়।
২. নির্দিষ্ট বিষয়ে জনগণকে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সচেতন করে ।
৩. বেতার জনগণের মতামতকে ক্রিয়াশীল করে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় এই বেতার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ২৬ মার্চ থেকে রেডিও বাংলাদেশ বা বাংলাদেশ বেতার বলা হয় এবং তারপর থেকেই এটি ‘স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র ‘ নামে পরিচিত হয়। মুক্তযুদ্ধকালীন সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসাহ উদ্দীপনা, দেশের জনগণকে প্রতিনিয়ত আশার, জয়ের স্বপ্ন দেখিয়ে স্মরণীয় হয়ে আছে এটি। ১৯৭১ সালে দেশের উত্তাল পরিস্থিতিতে সাধারণ জনগণ যখন বেতারে কান পেতে শুনল যুদ্ধের ঘোষণা, তখন গ্রামে গ্রামে গড়ে উঠল গেরিলা বাহিনী।
বাংলাদেশে জনমত গঠনে বেতার ও টেলিভিশন : বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। এদেশের মানুষ এখনো পুরনো ধ্যান-ধারণা দ্বারা প্রভাবিত। তাই জনমত গঠন প্রক্রিয়াটি এদেশে তেমন সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। তবে বেতার ও টেলিভিশন দেশের জনমতকে একটি স্থিতিশীল পর্যায়ে উপনীত হতে সহায়তা করছে। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে, বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশন স্বাধীনভাবে কখনো কাজ করতে পারেনি। ১৯৭১ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত এ চৌত্রিশ বছরে একটিবারও বেতার ও টেলিভিশন নিজস্ব পরিকল্পনা প্রয়োগ করে সুষ্ঠু জনমত গঠনে সক্ষম হয়নি।
অনুন্নত দেশসমূহে জনমত গঠনে বেতার ও টেলিভিশন : অনুন্নত দেশসমূহে জনমত গঠনে বেতার ও টেলিভিশনের ভূমিকা অনস্বীকার্য। এসব দেশে কোনো প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনা জনগণের দ্বারপ্রান্তে সহজে পৌঁছাতে বেতার ও টেলিভিশন অন্যতম মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। এ দুটি গণমাধ্যম তৃণমূল পর্যায় থেকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর পর্যায় পর্যন্ত প্রভাব বিস্তার করে। এছাড়া উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বেতার ও টেলিভিশন জনমত গঠনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। এ দুটি মাধ্যম জনগণের প্রায়োগিক সিদ্ধান্তকে অধিকতর সর্বজনীন করে তোলে ।
উন্নত দেশসমূহে জনমত গঠনে বেতার ও টেলিভিশন : উন্নত বিশ্বে জনমত গঠনের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে বেতার ও টেলিভিশনকে প্রধান্য দেয়া হয়। কেননা, বেতার ও টেলিভিশনের মাধ্যমে অধিকতর ক্রিয়াশীল মতবাদ সৃষ্টি করা যায়।
কোনো বিষয়ে জনমত যাচাইয়ের ক্ষেত্রে বেতার ও টেলিভিশনের প্রতি জনগণ যত বেশি সাড়া দেয়, অন্যান্য গণমাধ্যমের প্রতি তেমনটি দেয় না । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৯৬ সালের নির্বাচনী অভিযানে প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন বেতার ও টেলিভিশনকে জনমত গঠনের প্রধান মাধ্যম হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘It’s great opportunity given by science that radio and television have enormously contributed us in the formation of public opinion.
গণতান্ত্রিক সরকার গঠনে বেতার ও টেলিভিশন : গণতান্ত্রিক সরকার সৃষ্টির একটি উৎকৃষ্ট মাধ্যম বেতার ও টেলিভিশন । এর মাধ্যমে রাষ্ট্রপ্রধান বা দেশের প্রখ্যাত নেতাগণ জনগণের উদ্দেশ্যে ভাষণ ও বাণী দান করে দেশ ও সমাজের কল্যাণের লক্ষ্যে গণচেতনা ও জনমত সৃষ্টি করতে পারেন। সরকারের উন্নয়নমূলক বিভিন্ন পরিকল্পনা ও কার্যবলীর প্রামাণ্য চিত্র প্রচার করে সরকার ও জনগণের মধ্যে একটি গভীর যোগসূত্র গড়ে তোলা যায় ।

উপসংহার : মানুষের মুক্তবুদ্ধি, চিন্তা, বাক, মত ও ভাব প্রকাশের অন্যতম বাহন হলো গণমাধ্যম। বেতার ও টেলিভিশন এ কালের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও শক্তিশালী গণমাধ্যম। শুধু জনমত গঠনেই নয়, বেতার ও টেলিভিশনের মাধ্যমে একটি জাতি বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞানলাভ করতে পারে। এই একটি উদাহরণকে লক্ষ করলেই বোঝা যায় সমাজজীবনকে কতখানি প্রভাবিত করতে পারে। আজ মানুষ দুটি সন্তান নেয়। আর এর পেছনে টেলিভিশনে প্রচারিত নাটক, নাটিকার ভূমিকা কতখানি তা বলার অপেক্ষা রাখে না। উন্নত ফলনের জন্য চাষ পদ্ধতি কৃষকের মাঝে প্রচার করার ফলে কৃষক অনেক সচেতন।
শুধু পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে নয়, রাজনৈতিক পরিস্থিতিও বহু বহু গুণ মিডিয়া তথা বেতার ও টেলিভিশন নির্ভর। এ দুটি গণমাধ্যম আজ বিশাল পৃথিবীকে মানুষের হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে। তাই বেতার ও টেলিভিশনকে শুধু বিনোদনের সামগ্রী হিসেবে বিবেচন না করে সরকারি প্রচেষ্টায় প করে তুলতে পারলে এগুলো সুন্দর ও চমৎকার জনমত গঠনে সহায়ক হবে।
আরও দেখুন: