চাচা কাহিনী – সৈয়দ মুজতবা আলী [বুক রিভিউ]

“বুকরিভিউ [Book Review]” সিরিজের উনিশতম পর্বে আমরা আলোচনায় এনেছি বাংলা সাহিত্যের অনন্য রম্যরচয়িতা সৈয়দ মুজতবা আলী-এর জনপ্রিয় গ্রন্থ “চাচা কাহিনী”। আমাদের এই ধারাবাহিক সিরিজে আমরা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাববিস্তারকারী বই পাঠ ও বিশ্লেষণ করে থাকি, যার মূল উদ্দেশ্য পাঠকদের বইপাঠে আগ্রহী করে তোলা এবং সাহিত্যচর্চাকে আরও প্রসারিত করা।

“চাচা কাহিনী” মূলত একটি অনন্য রম্যগ্রন্থ, যেখানে মুজতবা আলীর চিরচেনা রসবোধ, বুদ্ধিদীপ্ত ভাষা ও সামাজিক পর্যবেক্ষণ উঠে এসেছে অত্যন্ত ব্যঙ্গাত্মক অথচ মানবিক ভঙ্গিতে। গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র “চাচা” একাধারে প্রহসনের প্রতীক, আবার কখনও বাস্তব সমাজের অন্তরালের এক গভীর দর্শনও তুলে ধরেন। সৈয়দ মুজতবা আলীর স্বভাবসিদ্ধ হাস্যরস, রিফাইনড ভাষাশৈলী এবং সূক্ষ্ম রাজনৈতিক ও সামাজিক ইঙ্গিত এই বইকে করে তুলেছে বাংলা রম্যসাহিত্যের এক অনন্য দলিল।

এই পর্বে বইটির পাঠ থেকে শুরু করে বিষয়বস্তু, লেখনশৈলী, চরিত্রচিত্রণ এবং এর সাহিত্যিক ও সামাজিক প্রাসঙ্গিকতা—সবকিছুই তুলে ধরা হয়েছে। পাশাপাশি আমরা বিশ্লেষণ করেছি মুজতবা আলীর কৌতুকের অন্তরালের তীক্ষ্ণ সমাজবোধ ও চিন্তাশক্তি।

আগের একটি পর্বে আমরা আলোচনা করেছিলাম আরেক বিশিষ্ট লেখক আবুল মনসুর আহমদ-এর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর নিয়ে। রাজনৈতিক স্মৃতিচারণায় সমৃদ্ধ এ বইটিও ছিল আমাদের “বুকরিভিউ” সিরিজের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যেখানে লেখক নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে উপস্থাপন করেছেন উপমহাদেশের রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতি ও অন্তরালের সত্য।

আমাদের এই ধারাবাহিক পাঠ ও পর্যালোচনার উদ্দেশ্য শুধু বই রিভিউ করা নয়, বরং একটি সুস্থ পাঠসংস্কৃতি গড়ে তোলা এবং নবীন পাঠকদের সাহিত্যভুবনের সাথে সংযুক্ত করা।

বই পড়ুন, ভাবুন, আলোচনা করুন—এটাই আমাদের আহ্বান।

চাচা কাহিনী

 

‘চাচা কাহিনী’ সৈয়দ মুজতবা আলীর বিখ্যাত গল্প গ্রন্থগুলির মধ্যে প্রধানতম। প্রায় প্রতিটি গল্পই বিদেশের পটভূমিকা রচিত। বিদেশে বিশেষ করে বার্লিন প্রবাসী বাঙালী তরুণ বয়স্ক ছাত্রদের নিয়েই রচিত। অনেক গল্প। স্বয়ং লেখক যৌবনে বার্লিন প্রবাসী ছাত্র ছিলেন। সে সময়কার নানা কাহিনী গল্পাকারে পরিবেশন করেচেন চাচা কাহিনীতে। সৈয়দ মুজতবা আলীর কলমে খাঁটি দেশী যাদু সেরা বিদেশী পলিশে সারাক্ষণ ঝকঝক করছে। চাচা কাহিনীর মতো এমন বিশুদ্ধ উপাদেয় আন্তর্জাতিক রসিকতা বাংলা ভাষায় অন্তত আগে কখনও পড়া যায়নি।

 

চাচা কাহিনী চাচা কাহিনী - সৈয়দ মুজতবা আলী [বুক রিভিউ]

 

ফ্ল্যাপে লেখা

কিছু কথা চাচা কাহিনী’ সৈয়দ মুজতবা আলীর বিখ্যাত গল্প গ্রন্থগুলির মধ্যে প্রধানতম। প্রায় প্রতিটি গল্পই বিদেশের পটভূমিকা রচিত। বিদেশে বিশেষ করে বার্লিন প্রবাসী বাঙালী তরুণ বয়স্ক ছাত্রদের নিয়েই রচিত। অনেক গল্প। স্বয়ং লেখক যৌবনে বার্লিন প্রবাসী ছাত্র ছিলেন। সে সময়কার নানা কাহিনী গল্পাকারে পরিবেশন করেচেন চাচা কাহিনীতে। সৈয়দ মুজতবা আলীর কলমে খাঁটি দেশী যাদু সেরা বিদেশী পলিশে সারাক্ষণ ঝকঝক করছে। চাচা কাহিনীর মতো এমন বিশুদ্ধ উপাদেয় আন্তর্জাতিক রসিকতা বাংলা ভাষায় অন্তত আগে কখনও পড়া যায়নি।

চাচা কাহিনী বইটি বেশ কয়েকটা গল্পের সমাহার। এখানে মুজতবা আলীকে নির্দিষ্ট কোন চরিত্র থেকে বরং গল্প কথক হিসেবেই দেখা যায়। গল্পগুলো বরং জার্মানীর বার্লিন শহরের এক শক্তিমান চরিত্র চাচা-কে কেন্দ্র করেই এগিয়েছে।

স্বয়ংবরা গল্পে চাচা স্মৃতিচারণ করেন তাঁর তারুণ্যে দেখা এক ভারতীয় কীর্তিমানের। হিম্মত সিং তাঁর নাম। কীভাবে তাঁর সাথে প্রথম পরিচয়? পড়ুন আলী সাহেবের ভাষ্যেই-

‘সাইনবোর্ডে ‘গেট্রেঙ্কে’ (পানীয়) শব্দ দেখে আমি বিয়ারখানায় ঢুকে দুধ চেয়ে বসেছি। কি করে জানবো বল পানীয়গুলো রূঢ়ার্থে বিয়ার ব্রান্ডি বোঝায়। ওয়েট্রসগুলো পাঁজরে হাত দিয়ে দু ভাঁজ হয়ে এমনি খিলখিল করে হাসছিল যে, শব্দ শুনে হিম্মৎ সিং রাস্তা থেকে তাড়িখানার ভেতরে তাকালেন। আমার চেহারা দেখে তাঁর দয়ার উদয় হয়েছিল- তোদের মতো পাষগুগুলোরও হ’ত। গটগট করে ঘরে ঢুকলেন। আমার পাশে বসে ওয়েট্রেসকে বলেন, ‘এক লিটার বিয়ার, বিটে (প্লীজ)। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “বিয়ার নহী পিতে? আমি মাথা নাড়িয়ে বললুম, ‘না।‘

ওয়াইন?

ফের মাথা নাড়ালাম।

কিসি কিসমকী শরাব ?

আমি বললুম যে আমি দুধের অর্ডার দিয়েছি।

দাড়ি-গোঁপের ভেতর যেন সামান্য একটু হাসির আভাস দেখতে পেলুম। বললেন, অব সমঝ়া। তারপর আমাকে বসে থাকতে আদেশ দিয়ে রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে গেলেন। ফিরে এলেন এক গেলাস দুধ হাতে নিয়ে। সমস্ত বিয়ার-খানার লোক যে অবাক হয়ে তার কাণ্ড-কারখানা লক্ষ্য করছে সেদিকে কণামাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই। তারপর, সেই যে বসলেন গেঁট হয়ে, আর আরম্ভ করলেন জালা জালা বিয়ার-পান। সে-পান দেখলে গোলাম মৌলা আর কক্ষনো রায়ের পানকে ভয় করবে না। শিখের বাচ্চা, রক্তে তার তিনপুরুষ ধরে আগুন-মার্কা ধেনো, আর মোলায়েমের মধ্যে নির্জলা হুইস্কি। বিয়ার তার কি করতে পারে?

লিটার আষ্টেক খেয়ে উঠে দাঁড়ালেন। পয়সা দিয়ে বেরোবার সময়ও কোনোদিকে একবারের তরে তাকালেন না। আমি কিন্তু বুঝলুম, বিয়ার-খানার হাসি ততক্ষণে শুকিয়ে গিয়েছে। সবাই গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে হিন্মৎ সিংয়ের দিকে তাকাচ্ছে, আর ফিসফিস্ প্রশংসা ধ্বনি বেরুচ্ছে। বাইরে এসে শুধু বললেন, ‘অব ইনলোগোকো পতা চল গিয়া কি হিন্দুস্থানী শরাব ভী পি সক্তা।‘

ভারতীয় রান্নার সাথে ইউরোপিয়ো রান্নার যে মূল তফাতটা মশলায়, সেটা আবার উঠে এসেছে ‘কর্নেল’ গল্পে। অনেক ইউরোপিয়োই আসতেন তাদের আপন আপন দেশের রান্না যে ভারতীয় রান্নার চেয়ে শ্রেষ্ঠ সেটা প্রমাণ করতে। কিন্তু ভারতীয় রান্না এমন উচ্চ শ্রেণির স্বত্তা যে তার সাথে শুধু ভগবানের তুলনা করা যেতে পারে (আলী সাহেবের ভাষায়)। প্রমাণও করা যায় না, আবার অপ্রমাণ করাও অসম্ভব।

 

সূচীপত্র

  • “স্বয়ংবরা কর্ণেল
  • “মা-জননী
  • “তীর্থহীনা
  • “বেল তলাতে দু-বার
  • “কাফে-দে-জেনি
  • *বিধবা-বিবাহ
  • * রাক্ষসী পাদটীকা পুনশ্চ
  • * বেঁচে থাকো সর্দি কাশি

 

আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

 

কর্ণেল:

কুরফুর্স্টেনডাম বার্লিন শহরের বুকের উপরকার যজ্ঞোপবীত বললে কিছুমাত্র বাড়িয়ে বলা হয় না। ওরকম নৈকষ্য-কুলীন রাস্তা বার্লিনে কেন, ইয়োরোপেই কম পাওয়া যায়। চাচার মেহেরবানিতে হিন্দুস্থান হৌস’ যখন গুলজার, তখন কিন্তু বার্লিনের বড় দুরবস্থা। ১৯১৪-১৮-এর শ্মশান-ফেরতা বার্লিন ১৯২৯-এও পৈতে উল্টো কাঁধে পরছে, এবং তাই গরীব ভারতীয়দের পক্ষেও সম্ভবপর হয়েছিল কুরফুর্স্টেনডামমের গা ঘেঁষে উলান্ডস্ট্রাসের উপর আপন রেস্তোরাঁ ‘হিন্দুস্থান হৌস’ পত্তন করার।

বহু জর্মন-অজর্মন ‘হিন্দুস্থান হৌসে’ আসত। জর্মনরা আসত নূতনত্বের সন্ধানে কলকাতার লোক যে রকম ‘চাইনীজ’ বা ‘আমজদিয়ায়’ খেতে যায়। ভারতীয়েরা নিয়ে আসত জর্মন-অজর্মন বান্ধবীদের—মাছ-ভাত বা ডাল-রুটির স্বাদ বালাবার জন্য, আর বুলগেরিয়ান, রুমানিয়ান, হাঙ্গেরিয়ানরা আসত জর্মনদের সঙ্গে নিয়ে, তাদের কাছে সপ্রমাণ করার জন্য যে তাদের আপন আপন দেশের রান্না ভারতীয় রান্নার চেয়ে ভালো। কিন্তু ভারতীয় রান্না এমনি উচ্চশ্রেণীর সত্তা যে তার সঙ্গে শুধু ভগবানের তুলনা করা যেতে পারে। ভগবানের অস্তিত্ব যে রকম প্রমাণ করা যায় না, অপ্রমাণও করা যায় না, ভারতীয় রান্নাও জর্মনদের কাছে ঠিক তেমনিতর প্রমাণ বা বাতিল কিছুই করা যায় না। কারণ ভারতীয় রান্নার বর্ণনাতে আছে:

তিন্তিড়ী পলা লঙ্কা সঙ্গে সযতনে
উচ্ছে আর ইক্ষুগুড় করি বিড়ম্বিত
অপূর্ব ব্যঞ্জন, মরি, রান্ধিয়া সুমতি
প্র-পঞ্চ-ফোড়ন দিলা মহা আড়ম্বরে।

এবং সে গ্রাম্ভারী রান্না কেন, মামুলী রান্নায় সামান্যতম মশলা দিলেও জর্মনরা সেখাদ্য গলাধঃকরণ করতে পারে না। আর মশলা না দিলে আমাদের ঝোল হয়ে যায় আইরিশ স্ট, ডাল হয় লেন্টিল সুপ, তরকারি হয় বয়ে ভেজ, মাছভাজা হয় ফ্রাইড় ফিশ। আমাদের চতুর্বর্ণ তখন শুধু বর্ণ নয়, রস-গন্ধ-স্বাদ সব কিছু হারিয়ে একই বিস্বাদের আসনে বসেন বলে চণ্ডালের মতো হয়ে যান। কাজেই আমাদের রান্না জর্মনদের কাছে এখনো ভগবানেরই ন্যায় সিদ্ধাসিদ্ধ কিছু নন। দাবাখেলায় এই অবস্থাকেই বলে চালমাত।

তবে হাঁ, আমাদের ছানার সন্দেশ ছিল কান্টের কাটেগরিশে ইম্পেরাটিফের মতো অলঙ্ঘ্য ধর্ম। তার সামনে জর্মন-অজর্মন সকলেই মাথা নিচু করতেন। ছানা-তত্ত্বে অবাঙালির অবদান অনায়াসে অবহেলা করা যেতে পারে।

‘হিন্দুস্থান হৌসে’র সবচেয়ে বড় আড়কাঠি ছিলেন চাচা। হিন্ডেনবুর্গের গোঁপের পরেই বার্লিনের সবচেয়ে পরিচিত বস্তু ছিল চাচার বেশ—তার সঙ্গে ভূষা’ শব্দ জুড়লে চাচার প্রতি অন্যায় করা হবে। সে বেশ ছিল সম্পূর্ণ বাহুল্যবর্জিত।

কারখানার চোঙার মতো গোলগাল পাতলুন, গলা-বন্ধ হাঁটু-জোকা কোট আর ভারিভারি এক জোড়া মিলিটারি বুট। লোকে সন্দেহ করত, তার কোটের তলায় কামিজ কুর্তা নাকি নেই। তবে এ কথা ঠিক কোট, পাতলুন, বুট ছাড়া অন্য কোনো তৃতীয় আবরণ বা আভরণ তার শ্যামাঙ্গে কেউ কখনো বিরাজ করতে দেখেনি। বার্লিনের মতো পাথর-ফাটা শীতেও তিনি কখনো হ্যাট, টুপি, ওভারকোট বা দস্তানা পরেননি। খুব সম্ভব শীতের প্রকোপেই তার মাথার ঘন বাবরী চুল পাতলা হয়ে আসছিল, কিন্তু চাচা সে সম্বন্ধে সম্পূর্ণ উদাসীন।

সেই অপরূপ পাতলুন, গণ্ডারের চামড়ার মতো পুরু গলাবন্ধ কোট, আর একমাথা বাবরী নিয়ে চাচা হঠাৎ থমকে দাঁড়াতেন কুরফুর্স্টেনডামের ফুটপাতে। পেছনের দিকে মাথা ঠেলে, উপরের দিকে তাকিয়ে থাকতেন উড়ন্ত মেঘের পানে। কেন, কে জানে? হয়তো বিদেশের অচেনা-অজানা দালান-কোঠা রাস্তাঘাটের মাঝখানে একমাত্র আকাশ আর মেঘই তাকে দেশের কথা স্মরণ করিয়ে দিত। দেশ ছেড়েছেন বহুকাল হল, কবে ফিরবেন জিজ্ঞাসা করলে হাঁ-না কিছু কবুল না করে কলকাতার উড়িষ্যাবাসীদের মতো শুধু বলতেন ‘ললাটঙ্ক লিখন!’

বার্লিনের লোক শহরের মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে মেঘের দিকে তাকিয়ে কাব্যি করে না। দু’মিনিট যেতে না যেতেই চাচার চতুর্দিকে ভিড় জমে যেত। তাঁর অদ্ভুত বেশ, বাবরী চুল, ঘনশ্যাম দেহরুচি আর বেপরোয়া ভাব লক্ষ্য না করে থাকবার যো ছিল না।

ফিসফিস শুনেই চাচার ঘুম ভাঙত। ভিড়ের দিকে তাকিয়ে ‘বাও’ করে একটু মৃদু হাসির মেহেরবানি দেখাতেন। ভিড় তখন ফাঁক হয়ে রাস্তা করে দিত। চাচা আবার ‘বাও’ করে হিন্দুস্থান হৌস রওয়ানা দিতেন। কেউ ‘গুটেন মর্গেন’ (সুপ্রভাত) ধরনের কিছু বললে বা পরিচয় করবার চেষ্টা দেখালে চাচা গলাবন্ধ কোটের ভিতর হাত চালিয়ে তার একখানা ভিজিটিং কার্ড বের করে এগিয়ে ধরে ফের ‘বাও করতেন—যেন অষ্টাদশ শতাব্দীর ফরাসী নবাব কাউকে ডুয়েলে আহ্বান করছেন। সেকার্ডে চাচার ঠিকানা থাকত ‘হিন্দুস্থান হৌসে’র। জর্মনরা চালাক। বুঝত, চাচা রাস্তার মাঝখানে নীরব কাব্য করেন বলে কথা বলতে চান না। কাজেই তারা চাচার আড্ডায় এসে উপস্থিত হতো।

মেঘ দেখবার জন্য অন্য জায়গা এবং অন্য কায়দা থাকতে পারে, কিন্তু হিন্দুস্থান হৌসে’র রান্নার খুশবাই ছড়াবার জন্য এর চেয়ে ভালো গ্যোবে আর কী হতে পারে?

শ্রীধর মুখুয্যে বলছিল, সংস্কৃতের নতুন ছোকরা প্রফেসর এসেছে য়ুনিভার্সিটিতে। পড়াচ্ছে গীতা। আজ সকালে প্রথম অধ্যায় পড়াবার সময় বলল, কুলক্ষয়-ফুলক্ষয় সব আবোল-তাবোল কথা। বর্ণসঙ্কর না হলে কোনো জাতের উন্নতি হয় না। তার থেকে আবার প্রমাণ করার চেষ্টা করল যে গীতার প্রথম অধ্যায়টা গুপ্তযুগে লেখা। বর্ণসঙ্করের জুজু নাকি বৌদ্ধযুগের পূর্বে ছিল না।’

চাচা বললেন, কী করে বর্ণসঙ্কর হয়, আর তার ফল কী, সেটা প্রথম অধ্যায়ে বেশ ধাপে ধাপে বাৎলানো হয়েছে, না রে? বলতো, ধাপগুলো কী?

শ্রীধর খাবি খাচ্ছে দেখে আড্ডার পয়লা নম্বরের আড্ডাবাজ পুলিন সরকার বলল, কুলক্ষয় থেকে কুলধনষ্ট, কুলধনষ্ট থেকে অধর্ম, অধর্ম থেকে স্ত্রীলোকদের ভিতর নষ্টামি, নষ্টামি থেকে বর্ণসঙ্কর, বর্ণসঙ্কর হলে পিতৃপুরুষের পিণ্ডলোপ–

মুখুয্যে বাধা দিয়ে বলল, ‘হাঁ, হাঁ, প্রফেসর বলছিল, ‘পিণ্ডির পরোয়া করে কোন সুস্থবৃদ্ধির লোক’?

বিয়ারের ভিতর থেকে সূয্যি রায়ের গলা বুদ্বুদের মতো বেরলো, ‘ছোকরা প্রফেসর ঠিক বলেছে। বর্ণসঙ্কর ভালো জিনিস। মুখুয্যে বামুনের ছেলে, এদিকে গীতার পয়লা পাঠ মুখস্থ নেই। সরকার কায়েতের ছেলে, পুরো চেনটা বাৎলে দিলে। মুখুয্যের উচিত সরকারের মেয়েকে বিয়ে করে কুলধর্ম বাঁচাননা।

চাচা বললেন, ঠিক বলেছ, রায়। তাহলে তুমি এক কাজ কর। তোমার বিয়ারে একটু জল মিশিয়ে ওটাকে বর্ণসঙ্কর করে ফেলল।

রায় রীতিমতো শকড হয়ে বললেন, ‘পানশাস্ত্রে এর চেয়ে বড় নাস্তিকতা আর কিছুই হতে পারে না। বিয়ারে জল!

চাচা মুখুয্যের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তোদের নয়া প্রফেসরটা নিশ্চয়ই ইহুদি। ওরা যেমন প্রাণপণ চেষ্টা করে আপন জাতটাকে খাঁটি রাখবার জন্য, ঠিক তেমনি আর পাঁচজনকে উপদেশ দেয় বর্ণসঙ্কর ডেকে আনবার জন্য। ওদিকে খাঁটি জর্মন এ সম্বন্ধে উচ্চবাচ্য করে না একদম, কিন্তু কাজের বেলায় না খেয়ে মরবে তবু বর্ণসঙ্কর হতে দেবে না।’

সরকার জিজ্ঞেস করল, ‘এদেশেও নির-উপবাস আছে কি? চাচা বললেন, আলবাৎ! শোন। আমি এ-বিষয়ে ওকবহাল। ‘পয়লা বিশ্বযুদ্ধের পর হেথায় অবস্থা হয়েছিল জর্মনির সর্বনাশ, বিদেশীর পৌষ মাস। ইনফ্লেশনের গ্যাসে ভর্তি জর্মন কারেন্সির বেলুন তখন বেহেশতে গিয়ে পৌঁচেছে—বেহেশতটা অবশ্যি বিদেশীদের জন্য, জর্মনরা কেউ পাঁচ হাজার, কেউ দশ হাজারে বেলুন থেকে পড়ে গিয়ে প্রাণ দিচ্ছে। আত্মহত্যার খবর তখন আর কোনো কাগজ ছাপাত না, নারী-হৃদয় ইকনমিক্সের কমডিটি, এক বার’ চকলেট দিয়ে একসার ব্লন্ড কেনা যেত, পাঁচটাকায় ফার’ কোট, পাঁচশ’ টাকায় কুরফুর্স্টেনডামমে বাড়ি, এক টাকায় গ্যেটের কমপ্লীট ওয়ার্কস।

আড্ডার সবাই সেই সর্বনাশী পৌষ মাসের কথা ভেবে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল।

চাচা বললেন, ‘সেই ঝড়ে তখনো যে সব বাড়ি দড় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পেরেছিল তাদের প্রত্যেকের ভিতরে ছিল বিদেশী পেয়িং-গেস্ট। যেসব জর্মন পরিবারে বিদেশীরা পেয়িং-গেস্ট হয়ে বসবাস করছিল তাদের প্রায় সকলেই খেয়েপরে জান বাঁচাতে পেরেছিল, কারণ যত নির্লজ্জ, কঞ্জুস, সুবিধাবাদী, পৌষ-মাসীই হও না কেন, তামাম মাসের ঘরভাড়া, খাইখর্চার জন্য অন্তত পঞ্চাশটি টাকা তো দিতে হয়। বিদেশী টাকার তখন এমনি গরমী যে সেই পঞ্চাশ টাকায় তোমাকে নিয়ে একটা পরিবারের কায়ক্লেশে দিনগুজরান হয়ে যেত।

গোঁসাই গুনগুন করে গান ধরলেন, ‘দেখা হইল না রে শ্যাম, তোমার সেই নতুন বয়সের কালে।

চাচা বললেন, কিন্তু একটা দেশের দুর্দিনে এক সের ধান দিয়ে পাঁচ সের চাল নিতে আমার বাধত। তাই যখন আমার বুড়ো ল্যান্ডলেডি একদিন হঠাৎ হার্টফেল করে মারা গেল তখন আমাকে লুফে নেবার জন্য পাড়ায় কাড়াকাড়ি পড়ে গেল। এমন সময় আমার বাড়িতে একদিন এসে হাজির ফ্রলাইন ক্লারা ফন্ ব্ৰাখেল।

আচ্ছা একগলায় শুধাল, হকি-টিমের কাপ্তান?

চাচা বললেন, আমার জান-বাঁচানেওয়ালী। বললেন, ‘ক্লাইনার ইডিয়োট (হাবাগঙ্গারাম), তুমি যদি অন্য কোথাও না গিয়ে আমার এক বন্ধুর বাড়িতে ওঠো তা হলে আমি বড় খুশি হই। প্রাশান ওবের্স্টের (কর্নেলের) বাড়ি, একটু সাবধানে চলতে হবে। এককালে খুব বড়লোক ছিলেন, এখন ‘উজর টেগলিষে ব্রো গি উত্স হয়টে (Give us this day our daily bread)। অথচ এমন দম্ভী যে পেয়িং-গেস্টের কথা তোলাতে আমাকে কোর্ট-মার্শাল করতে চান। শেষটায় যখন বললুম যে তুমি প্রাশান কারো কাছ থেকে উচ্চাঙ্গের জর্মন শেখার জন্য সুদূর ভারতবর্ষ থেকে বার্লিন এসেছ, তখন ভদ্রলোক মোলায়েম হন। এখন বুঝতে পারছ, কেন তোমাকে সাবধানে পা ফেলতে বললুম। তুমি ভাবটা দেখাবে যেন তার বাড়িতে উঠতে পেরে কৃতার্থম্মন্য হায়েছ। তুমি যে কোনো উপকার করছ সেটা যেন ধরতে না পারেন। তার বউ সম্বন্ধে কোনো দুর্ভাবনা কোরো না। তিনি সব বোঝেন, জানেন।’

চাচা বললেন, ‘প্রাশান অফিসারদের আমি চিরকাল এড়িয়ে গিয়েছি। দূর থেকে ব্যাটাদের ধোপদুরস্ত ইস্ত্রি করা স্টিফ ইউনিফর্ম আর স্টিফ ভাবসাব দেখে আমার সব সময় মনে হয়েছে এরা যেন হাসপাতালের এপ্রন-পরা সার্জেনদের দল। সার্জেনরা কাটে নির্বিকার চিত্তে রোগীর পেট, এরা কাটে পরমানন্দে ফ্রান্সের গলা।।

চাচা বললেন, কিন্তু ফন্ ব্রাথেলের প্রতি আমার যে শ্রদ্ধা ছিল তার দৌলতে আমি অনেক কিছুই করতে প্রস্তুত ছিলুম। এবং মনে মনে ভাবলুম বেশির ভাগ ভারতীয়ই বসবাস করে মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের সঙ্গে, দেখাই যাক না খানদানীরা থাকে কী কায়দায়।

ফন্ ব্ৰাখেল আমাকে নিয়ে যাননি। খবর দিয়ে আমি একাই একদিন সুটকেস নিয়ে কর্নেল ডুটেহফারের বাড়ি পৌঁছলুম।

ট্যাক্সিওলা যে বাড়ির সামনে দাঁড়াল তার চেহারা আগে দেখা থাকলে ফন্ ব্রাথেলের প্রস্তাবে আমি রাজি হতুম কি না সন্দেহ। বাড়ি তো নয়, সে এক রাজপ্রাসাদ। এ বাড়িতে তো অন্তত শ’খানেক লোকের থাকার কথা। কিন্তু তাকিয়ে দেখি দোতলার মাত্র দুতিনখানা ঘরের জানলা খোলা, বাদবাকি যেন সিল মেরে আঁটা। সামনে প্রকাণ্ড লন। পেরিয়ে গিয়ে দরজার ঘন্টা বাজালুম। মিনিটতিনেক পরে যখন ভাবছি আবার ঘন্টা বাজাবো কি না তখন দরজা আস্তে আস্তে খুলে গেল।

গহরজান যখন পানের পিক গিলতেন তখন নাকি গলার চামড়ার ভিতর দিয়ে তার লাল রঙ দেখা যেত। যে-রমণীকে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলুম তার চামড়া, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ মুখচ্ছবি দেখে মনে হল তিনি যেন সকালবেলাকার শিশির দিয়ে গড়া। জর্মনিতে পান পাওয়া যায় না, কিন্তু আমার মনে হল ইনি পান খেলে নিশ্চয়ই পিকের রঙ এঁর গলার চামড়ায় ছোপ লাগাবে। চুল যেন রেশমের সুতো, ঠোঁট দুখানি যেন প্রজাপতির পাখা, ভুরু যেন উড়ে-যাওয়া পাখি, সসুদ্ধ মিলিয়ে মনে সন্দেহ হয় ইনি দাঁড়িয়ে আছেন না হাওয়ায় ভাসছেন। প্রথম দিনেই যে এ-সবকিছু লক্ষ্য করেছিলুম তা নয়। কিন্তু আজ যখন পিছনপানে তাকাই তখন তার ঐ চেহারাই মনে পড়ে।

ইংরিজিতে বোধহয় একেই বলে ডায়াফনাস। আস্বচ্ছ’ বললে ঠিক মানে ধরা পড়ে।

কতক্ষণ ধরে হাবার মতো তাকিয়েছিলুম জানিনে, হঠাৎ শুনলুম ‘গুটেন মর্গেন (সুপ্রভাত), আপনার আগমন শুভ হোক। আমি ফ্রাউ (মিসেস) ডুটেহফার।

ভাগ্যিস ভারি মালপত্র ট্রান্সপোর্ট কোম্পানির হাতে আগেই সমঝে দেওয়া হয়ে গিয়েছিল। তা না হলে মাল নিয়ে আমি বিপদে পড়তুম। এ রকম অবস্থায় চাকর-দাসী কেউ না কেউ আসে। কিন্তু কেউ যখন এল না তখন বুঝতে পারলুম ডুটেনহফারদের দুরবস্থা কতটা চরমে পৌঁচেছে।

প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড ডজনখানেক হল পেরলুম—কোথাও একরত্তি ফার্নিচর নেই, দোজানলায় পর্দা পর্যন্ত নেই। দেয়ালের সারি সারি হুক দেখে বুঝলুম, এককালে নিশ্চয় বিস্তর ছবি ঝোলানো ছিল, মেঝের অবস্থা দেখে বুঝলুম এ-মেঝের উপর কখনো কোনো জুতোর চাট পড়েনি—জন্মের প্রথম দিন থেকে এর সর্বাঙ্গ গালচেতে ঢাকা ছিল। কঙ্কাল থেকে পূর্ণাবয়ব মানুষের যতখানি ধারণা করা যায়, দেয়ালের হুকের সার, ছাতের শেকলের গোছা, দরজা-জানলার গায়ে লাগানো পরদা-ঝোলানোর ডাণ্ডা থেকে আমি নাচের ঘর, মজলিসখানা, বাজিঘরের ততখানি আন্দাজ করলুম।।

শূন্য শোন ভয়ঙ্কর, কিন্তু কঙ্কালের ব্যঞ্জনা বীভৎস। এ-বাড়িতে থাকব কী করে? চুলোয় যাক প্রাশান জর্মন শেখা।

আন্দাজে বুঝলুম যে আমার জন্য যে-ঘর বরাদ্দ করা হয়েছে সেটা বাড়ির প্রায় ঠিক মাঝখানে। ফ্রাউ ডুটেহফার আমাকে সে-ঘরের মাঝখানে দাঁড় করিয়ে দিয়ে চলে

গেলেন।

বজরার মতো খাট, কিন্তু ঘরখানাও বিলের মতো। নৌকোয় চড়া অভ্যাস না হওয়া পর্যন্ত বিলের মাঝখানে নৌকোয় ঘুমুতে যে-রকম অসহায় অসহায়, কঁকা ফাঁকা ঠেকে, সে-খাটে শুয়ে আমারো সেই অবস্থা হয়েছিল।

দুপুরে খাবার ঘরে গিয়ে দেখি বেকুয়েট টেবিলে তিনজনের জায়গা। টেবিলের এক মাথায় কর্তা, অন্য মাথায় গিন্নী, মাঝখানে আমি। একে অন্যকে কোনো জিনিস হাত বাড়িয়ে দেবার উপায় নেই বলে তিনজনের সামনেই আপন আপন নিমক-দান। মাস্টার্ড, সস মাথায় থাকুন, গোলমরিচেরও সন্ধান নেই। বুঝলুম পাঁড় প্রাশানের বাড়ি বটে। আড়ম্বরহীনতায় এদের রান্নার সামনে আমাদের বালবিধবার হবিষ্যান্নও লজ্জায় ঘোমটা টানে। কিন্তু ওসব কথা থাক, এরকম ধারা মশলার বিরুদ্ধে জেহাদ আমি অন্য জায়গায়ও দেখেছি।

ভেবেছিলুম বাড়ির কর্তাকে দেখতে পাব শুয়োরের মতো হোঁকা, টমাটোর মতো লাল, অসুরের মতো চেহারা, দুষমনের মতো এই-মারি-কি-তেই-মারি—অর্থাৎ সবসুদ্ধ জড়িয়ে-মড়িয়ে প্রাশান বিভীষিকা। কিন্তু যা দেখলুম তার সঙ্গে তুলনা হয় তেমন কিছু ইয়োরোপে নেই।

এ যেন নর্মদা-পারের সন্ন্যাসী বিলিতি কাপড় পরে পদ্মাসনে না বসে চেয়ারে বসেছেন। দেহের উত্তমার্ধ কিন্তু যোগাসনে—শিরদাঁড়া খাড়া, চেয়ারে হেলান দেননি।

শীর্ণ দীর্ঘ দেহ, শুষ্ক মুখ, আর সেই শুকনো মুখ আরো পাংশু করে দিয়েছে দুখানি বেগুনি ঠোঁট। কপাল থেকে নাক নেমে এসেছ সোজা, চশমার ব্রিজের জায়গায় এতটুকু খাঁজ খায়নি, আর গালের হাড় বেরিয়ে এসে চোখের কোটর দুটোকে করে দিয়েছে গভীর গুহার মতো। কিন্তু কী চোখ! আমার মনে হল উঁচু পাহাড় থেকে তাকিয়ে দেখছি নীচে, চতুর্দিকে পাথরে ঘেরা নীল সরোবর। কী গভীর, কী তরল! সে-চোখে যেন এতটুকু লুকোনো জিনিস নেই। যত বড় অবিশ্বাস্য কথাই এ লোকটা বলুক না কেন, এর চোখের দিকে তাকিয়ে সে কথা অবিশ্বাস করার জো নেই।

খেতে খেতে সমস্তক্ষণ আড়-নয়নে সেই ধ্যানমগ্ন চোখের দিকে, সেই বিষণ্ণ ঠোঁটের দিকে আর চিন্তাপীড়িত ললাটের দিকে বার বার তাকিয়ে দেখছি। তখন চোখে পড়ল তার খাবার ধরন। চোয়াল নড়ছে না, ঠোঁট নড়ছে না, খাবার গেলার সময় গলায় সামান্যতম কম্পনের চিহ্ন নেই।

পরনে প্রাশান অফিসারদের যুনিফর্ম তো নয়ই, মাথার চুলও কদম-ছাঁট নয়। ব্যাব্রাশ করা চকচকে প্ল্যাটিনামব্লন্ড চুল।

কিন্তু সবচেয়ে রহস্যময় মনে হল এঁর বয়স। চল্লিশ, পঞ্চাশ, সত্তর হতেও বাধা নেই। বয়সের আন্দাজ করতে গিয়েই বুঝলুম নর্মদা-পারের সন্ন্যাসীর সঙ্গে এঁর আসল মিল কোনখানে।

এত অল্প খেয়ে মানুষ বাঁচে কী করে, তাও আবার শীতের দেশে? সুপ খেলেন না, পুডিং খেলেন না, খাবার মধ্যে খেলেন এক টুকরো মাংসশ্যামবাজারের মামুলি মটনকটলেটের সাইজ—দুটো সেদ্ধ আলু, তিনখানা বাঁধাকপির পাতা আর এক স্লাইস রুটি। সঙ্গে ওয়াইন, বিয়ার, জল পর্যন্ত না!

আহারে যত না বিরাগ তার চেয়েও তার বেশি বিরাগ দেখলুম বাক্যালাপে। নতুন বাড়িতে উঠলে প্রথম লাঞ্চের সময় যে-সব গতানুগতিক সম্বর্ধনা, হাসিঠাট্টা, গ্যাস সম্বন্ধে সতর্কতা, সিঁড়ির পিচ্ছিলতা সম্বন্ধে খবরদারি সে-সব তো কিছুই হল না—আমি আশাও করিনি—আবহাওয়া সম্বন্ধে মন্তব্য, ভারতবর্ষ সম্বন্ধে ভদ্রতা-দুরস্ত কৌতূহল, এ সব কোনো মন্তব্য বা প্রশ্নের দিক দিয়ে হের ওবের্স্ট কর্নেল মহাশয়) গেলেন না। আমিও চুপ করে ছিলুম, কারণ আমি বয়সে সকলের ছোট।

খাওয়ার শেষের দিকে যখন আমি প্রায় মনস্থির করে ফেলেছি যে, ডুটেন্হফারদের জিভে হয় ফোস্কা নয় বাত, তখন হের ওবের্স্ট হঠাৎ পরিষ্কার ইংরিজিতে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘শেক্সপীয়ারের কোন নাট্য আপনার সবচেয়ে ভালো লাগে?

আমার পড়া ছিল কুল্লে একখানাই। নির্ভয়ে বললুম, হ্যামলেট।

‘গ্যেটে পড়েছেন?

আমি বললুম, অতি অল্প।

‘একসঙ্গে গ্যেটে পড়ব?’

আমি আনন্দের সঙ্গে, অজস্র ধন্যবাদ দিয়ে সম্মতি জানালুম। মনে মনে বললুম, ‘দেখাই যাক না প্রাশান রাজপুত কী রকম কালিদাস পড়ায়। হের ওবের্স্টের চেহারাটি যদিও ভাবুকের মতো, তবু কুলোপানা চক্কর হলেই তো আর দাঁতে কালবিষ থাকে না।

ফ্রাউ ডুটেন্হফার বললেন, ‘ভদ্রলোক জর্মন বলতে পারেন।

তাই নাকি?’ বলে সেই যে ইংরিজি বলা বন্ধ করলেন তারপর আমি আর কখনন তাকে ইংরিজি বলতে শুনিনি।

লাঞ্চ শেষ হতেই হের ওবের্স্ট উঠে দাঁড়ালেন। জুতোর হিলে হিলে ক্লিক করার সঙ্গে সঙ্গে প্রথমে স্ত্রীকে, তারপর আমাকে বাও’ করে আপন ঘরের দিকে চলে গেলেন। বাপের বয়সী লোক, বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ এরকম ‘বাও’ করে বসবে কী করে জানব বললা! আমি হন্তদন্ত হয়ে উঠে বার বার ‘বাও’ করে তার খেসারতি দেবার চেষ্টা করলুম, কিন্তু মনে মনে মাদামের সামনে বড় লজ্জা পেলুম। পাছে তিনিও আবার কোনো একটা নতুন এটিকেট চালান সেই ভয়ে—যদিও আমার কোনো তাড়া ছিল না। আমি দু’মিনিট যেতে না যেতেই উঠে দাঁড়ালুম, মাদামকে কোমরে দু’ভাজ হয়ে ‘বাও’ করে নিজের ঘরের দিকে রওয়ানা হলুম-হিলে হিলে ক্লিকটা আর করলুম না, জুতোর হিল রবরের ছিল বলে।

চারটের সময় কফি খেতে এসে দেখি হের ওবের্স্ট নেই। মাদাম বললেন, তিনি অপরাহে আর কিছু খান না। মনে মনে বললুম, বাব্বা, ইনি পওহারী বাবার কাছে পৌঁছে যাবার তালে আছেন!

ডিনারে ওবের্স্ট খেলেন তিন খানা সেনউইজ আর এক কাপ চা—তাও আর পাঁচজন জর্মনের মতো—বিনদুধে।

চাচা থামলেন। তারপর গুনগুন করে অনুষ্টুপ ধরলেন

‘এবমুক্তো হৃষিকেশো গুড়াকেশেন ভারত।’

তারপর বললেন, আমি গুড়াকেশ নই, নিদ্রা আমি জয় করিনি। নিদ্রাই আমাকে জয় করেছেন, অর্থাৎ আমি ইনসমনিয়ায় কাতর। কাজেই সংযমী না হয়েও যা নিশা সর্বভূতানাং তার বেশির ভাগ আমি জেগে কাটাই। রাত তিনটের সময় শুতে যাবার আগে জানলার কাছে গিয়ে দেখি কর্তার পড়ার ঘরে তখনো আলো জ্বলছে।

দেরিতে উঠি। ব্রেকফাস্ট খেতে গিয়ে দেখি কর্তার খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছে। লজ্জা পেলুম, কিন্তু সেটা পুষিয়ে নিলুম লোহার নালে নালে এমনি বমশেল ক্লিক করে যে, মাদাম আঁৎকে উঠলেন। মনে মনে বললুম, হিন্দুস্থানীকি তমিজ ভী দেখ লিজিয়ে!

ওবের্স্টকে জিজ্ঞেস করলুম, ‘আপনি কি অনিদ্রায় ভোগেন?’ বললেন, ‘না তো।’ আমি কেন প্রশ্নটা শুধালুম সে সম্বন্ধে কোনো কৌতূহল না দেখিয়ে শুধু স্মরণ করিয়ে দিলেন যে দশটায় গ্যেটে-পাঠ।

পূর্ণ এক বৎসর তিনি আমায় গ্যেটে পড়িয়েছিলেন, দুটি শর্ত প্রথম দিনই আমার কাছ থেকে আদায় করে নিয়ে। তিনি কোনো পারিতোষিক নেবেন না, আর আমার পড়া তৈরি হোক আর না হোক, ক্লাস কামাই দিতে পারব না।

মিলিটারি কায়দায় লেখাপড়া শেখা কাকে বলে জানো? বুঝিয়ে বলছি। আমরা দেশকালপাত্রে বিশ্বাস করি। গুরুর যদি শরীর অসুস্থ থাকে, ছাত্রের যদি পিতৃশ্রাদ্ধ উপস্থিত হয়, পালা-পরবে যদি কোথাও যেতে হয়, পাঠ্যপুস্তকের যদি অনটন হয়, শিক্ষক অথবা ছাত্রের যদি পড়া তৈরি না থাকে, গুবীর যদি ঘৃতলবণতৈলতলবস্ত্রইন্ধন সংক্রান্ত কোনো বিশেষ প্রয়োজন হয় এবং তখনকার গম-বরাদ্দের (রেশনিঙের) দিনে তার নিত্য নিত্য প্রয়োজন হত—তাহলে অনধ্যায়। কিন্তু প্রাশান মিলিটারি-মার্গ অঘটনঘটনপটিয়সী দৈবদুর্বিপাকে বিশ্বাস করে না। আমি বুকে কফ নিয়ে এক ঘন্টা কেশেছি, ক্লাস কামাই যায়নি, হিন্ডেনবুর্গ হের ওবের্স্টকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন, ক্লাস কামাই যায়নি। একটি বৎসর একটানা গ্যেটে, আবার গ্যেটে এবং পুনরপি গ্যেটে। তার অর্ধেক পরিশ্রমে পাণিনি কণ্ঠস্থ হয়, সিকি মেহন্নতে ফিরদৌসীকে ঘায়েল করা যায়।

অথচ পড়ানোর কায়দাটা ন’ সিকে ভটচার্যি। গ্যেটের খেই ধরে বাইমার, বাইমার থেকে রিঙে, ট্যুরিঙে থেকে পূর্ণ জনির ইতিহাস। গ্যেটের সঙ্গে বেটোফেনের দেখা হয়েছিল কার্লসবাডে—সেই খেই ধরে বেটোফেনের সঙ্গীত, বাগনারে তার পরিণতি, আমেরিকায় তার বিনাশ। গ্যেটে শেষ বয়সে সরকারি গেইমরাট খেতাব পেয়েছিলেন, সেই খেই ধরে জর্মনির তাবৎ খেতাব, তাবৎ মিলিটারি মেডেল, গণতন্ত্রে খেতাব তুলে দেওয়াটা ভালো না মন্দ সে সব বিচার, এককথায় জর্মন দৃষ্টিবিন্দু থেকে তামাম ইয়োরাপের সংস্কৃতি-সভ্যতার সর্বাঙ্গসুন্দর ইতিহাস। পূর্ণ এক বৎসর ধরে গ্যেটের গোষ্পদে ইয়োরাপের শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে গড়েওঠা ইতিহাস-ঐতিহ্য বিম্বিত হল।

আর এ সব কিছু ছাড়িয়ে যেত তার আবৃত্তি করার অদ্ভুত ইন্দ্রজাল। সে ইন্দ্রজালের মোহ বোধহয় আমার এখনো কাটেনি। আমি এখনো বিশ্বাস করি, মন্ত্র যদি ঠিক ঠিক উচ্চারণ করা যায়—যে-শ্রদ্ধা, যে-অনুভূতি, যে-সংজ্ঞা নিয়ে ডুটেনহার গ্যেটে আবৃত্তি করতেন—তাহলে ঈশিত ফললাভ হবেই হবে।

পূর্ণ এক বৎসর রোজ দু’ঘন্টা করে এই গুণীর সাহচর্য পেলুম, কিন্তু আশ্চর্য, তার নিজের জীবন অথবা তার পরিবার সম্বন্ধে তিনি কখনো একটি কথাও বলেননি। কেন তিনি মিলিটারি ছাড়লেন, লুডেন্ডর্যের আহ্বানে জর্মনিতে নূতন দল গড়াতে কেন তিনি সাড়া দিলেন না (কাগজে এ সম্বন্ধে জল্পনা কল্পনা হত), পেন্সন কেন তিনি ত্যাগ করলেন, না করে পারিবারিক তৈলাকন তৈজসপত্র বাঁচাননা কি অধিকতর কাম্য হত না,—এ-সব কথা বাদ দাও, একদিনের তরে ঠাট্টাচ্ছলেও তাকে বলতে শুনিনি, প্রথম যৌবনে তিনি সোয়া দু’বার না আড়াইবার প্রেমে পড়েছিলেন অথবা ছাত্রাবস্থায় মাতাল হয়ে ল্যাম্পপোস্টকে জড়িয়ে ধরে ‘ভাই, এ্যাদ্দিন কোথায় ছিলি’ বলে কান্নাকাটি করেছিলেন কি না।

পূর্ণ এক বৎসর ধরে এই লোকটির সাহচর্য পেয়েছি, তার সংযম দেখে মুগ্ধ হয়েছি মদ না, সিগরেট না, কফি না। বার্লিনের মেরুমুক্ত হিমে মুক্ত বাতায়ন নিরিন্ধন গৃহে ত্রিযামা-যামিনী বিদ্যাচর্চা, আত্মসম্মান রক্ষার্থে পিতৃপিতামহসঞ্চিত আশৈশব শ্রদ্ধাবিজড়িত প্রিয়বস্তু অকাতরে বিসর্জন, আহারে বিরাগ, ভাষণে অরুচি, দন্তহীন, দৈন্যে নীলকণ্ঠ, গুড়াকে—সব কিছু নিয়ে এঁর ব্যক্তি আমাকে এমনি অভিভূত করে ফেলেছিল যে আমি নিজের অজানায় তাকে অনুকরণ করতে আরম্ভ করেছিলুম। ডুটেন্ফারের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে আমি যে দস্তানা, অভারকোট, টাই, কলার ছাড়লুম, আজো তা গ্রহণ করার প্রয়োজন বোধ করিনে। কিন্তু কিসে আর কিসে তুলনা করছি!

চাচা বললেন, শুধু একটা জিনিসে হের ওবের্স্টের চিত্তগতি আমি ধরতে পেরেছিলুম। আমাদের আলাপের দ্বিতীয় দিনে জিনিয়স সম্বন্ধে আলোচনা করতে গিয়ে জাতিভেদের কথা ওঠে। আমি মুসলমান, তার উপর ছেলেবেলায় দু হাত তফাতে দাঁড়িয়ে বামুন পণ্ডিতকে শ্লেট দেখিয়েছি, কৈশোরে হিন্দুহস্টেলে বেড়াতে গিয়ে ঢুকতে পাইনি, জাতিভেদ সম্বন্ধে আমার অত্যধিক উৎফুল্ল হওয়ার কথা নয়। তারই প্রকাশ দিতে হের ওবের্স্ট জাতিভেদের ইতিহাস; তার বিশ্লেষণ, বর্তমান পরিস্থিতি, ভিন্ন ভিন্ন দেশে তার ভিন্ন ভিন্ন রূপ সম্বন্ধে এমনি তথ্য এবং তত্তে ঠাসা কতকগুলো কথা বললেন যে আমার উম্মার চোদ্দ আনা তখনি উবে গেল। দেখলুম, শুধু যে তিনি মনুসংহিতার জর্মন অনুবাদ ভালো করে পড়েছেন তা নয়, গৃহ্য ও শ্ৰেীতসূত্রের তাবৎ আচার অনুষ্ঠান পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে অধ্যয়ন করেছেন—অবশ্য সংস্কৃতে নয়, হিলেব্রান্টের জর্মন অনুবাদে। এসব আচারঅনুষ্ঠানের উদ্দেশ্য কী, বৈজ্ঞানিক পরশপাথর দিয়ে বিচার করলে তার কতটা গ্রহণীয় কতটা বর্জনীয়, বিজ্ঞান যেখানে নীরব সেখানে কিংকর্তব্য এসব তো বললেনই, এবং যে সব সমস্যায় তিনি স্বয়ং কিংকর্তব্যবিমূঢ় সে-সবগুলোও বিশেষ উৎসাহে আমার সামনে উপস্থিত করলেন।

অথচ কী বিনয়ের সঙ্গে দিনের পর দিন এই কথাটি বোঝাতে চেষ্টা করেছেন প্রাশান কৌলীন্য যেন দম্ভপ্রসূত না হয়। প্রাশান কৌলীন্য জগতে সর্বশ্রেষ্ঠ আসন দাবী করে না, তার দাবী শুধু এইটুকু যে তার বিশেষত্ব আছে। সে-বিশেষত্বটুকুও যদি পৃথিবী স্বীকার না করে, তাতেও আপত্তি নেই, কিন্তু অন্ততপক্ষে পার্থক্যটুকু যেন স্বীকার করে নেয়। হের ওবের্স্ট তাতেই সন্তুষ্ট। তিনি সেইটুকুই বাঁচিয়ে রাখতে চান। তার দৃঢ় বিশ্বাস, সে-পার্থক্যের জন্য উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ রয়েছে।

এবং সেই পার্থক্যটুকু বাঁচিয়ে রাখবার জন্য দেখতে হবে রক্তসংমিশ্রণ যেন না হয়।

নীটশের সুপারম্যান?

না, না। শুধু বড় হওয়ার জন্য বড় হওয়া নয়, শুধু সুপার হওয়ার জন্য সুপার হওয়া নয়। প্রাশান আদর্শ হবে ত্যাগের ভিতর দিয়ে, আত্মজয়ের ভিতর দিয়ে ইয়োরোপীয় সভ্যতা-সংস্কৃতির সর্বশ্রেষ্ঠ সেবক হওয়ার।

এবং যদি দরকার হয়, তার জন্য সংগ্রাম পর্যন্ত করা। সেবা করার জন্য যদি দরকার হয় তবে যে-সব অজ্ঞ, মূর্খ, অন্ধ তার অন্তরায় হয় তাদের বিনাশ করা।

আমার কাছে বড় আশ্চর্য ঠেকল। সেবার জন্য সংগ্রাম, বাঁচবার জন্য বিনাশ?

হের ওবের্স্ট বলতেন, শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে কেন যুদ্ধ করতে বলেছিলেন? সেইটে বার বার পড়তে হয়, বুঝতে হয়। ভুললে চলবে না, জীবনের সমস্ত চিন্তাধারা কর্মপদ্ধতি লোকসেবায় যেন নিয়োজিত হয়।

আমি প্রথম দিনের আলোচনার পরই বুঝতে পেরেছিলুম হের ওবের্স্টের সঙ্গে তর্ক করা আমার ক্ষমতার বহু, বহু ঊর্ধ্বে কিন্তু এই ‘সেবার জন্য সংগ্রাম’ বাক্যটা আমার কাছে বড়ই আত্মঘাতী, পরস্পরবিরোধী বলে মনে হল। রক্তসংমিশ্রণ ঠেকাবার জন্য প্রাণবিসর্জন, এও যেন আমার কাছে বড্ড বেশি বাড়াবাড়ি মনে হল। আমার কোন কোন জায়গায় বাধছে হের ওবের্স্টের কাছে সেগুলোও অজানা ছিল না।

লক্ষ্য করলুম, এঁর চরিত্রের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে স্বল্পভাষণে। কিন্তু স্বল্প হলে কী হয়, শব্দের বাছাই, কল্পনার ব্যঞ্জনা, যুক্তির ধাপ এমনি নিরেট ঠাসবুনুনিতে বক্তব্যগুলোকে ভরে রাখত যে সেখানে সূচ্যগ্র ঢোকাবার মতো ক্ষমতা আমার ছিল না। এবং আরো লক্ষ্য করলুম যে একমাত্র রক্তসংমিশ্রণের ব্যাপারেই তিনি যেন ঈষৎ উত্তেজিত হয়ে ওঠেন।

বিষয়টি যে তাঁর জীবনের কত বিরাট অংশ দখল করে বসে আছে সেটা বুঝতে পারলুম একদিন রাত প্রায় দুটোর সময় যখন তিনি আমার ঘরে এসে বললেন, এত রাতে এলুম, কিছু মনে করবেন না। আমাদের আলোচনার সময় একটি কথা আমি বলতে ভুলে গিয়েছিলুম, সেটি হচ্ছে, সুখদুঃখ, জয়পরাজয়, লাভক্ষতি যিনি সমদৃষ্টিতে দেখতে পারেন, একমাত্র তারই অধিকার সেবার ভার গ্রহণ করার, সেবার জন্য সংগ্রাম করার।

কোনো উত্তরের অপেক্ষা না করে হিল-ক্লিকের সঙ্গে বাও’ করে বেরিয়ে গেলেন।

এত রাত্রে এসে এইটুকু বলার এমন কী ভয়ঙ্কর প্রয়োজন ছিল?

হের ওবের্স্টের সঙ্গে বেড়াতে গিয়েছি, বাড়ির সনে পাইচারি করেছি, পৎসদাম পেরিয়ে ছোট ছোট গ্রামে গিয়ে চাষাদের বাড়িতে খেয়েছি, পুরোনো বইয়ের দোকানে প্রাচীন মাসিক ঘাঁটাঘাঁটি করেছি, অধিকাংশ সময় তিনি চুপ, আমিও চুপ। তাকে কথা বলাতে হলে প্রাশান ঐতিহ্যের প্রস্তাবনা করাই ছিল প্রশস্ততম পন্থা। একদিন শুধালুম, ফ্রান্সের সঙ্গে আপনাদের বনে না কেন?

হের ওবের্স্ট বললেন, না বনাই ভালো। এ রকম ধ্বংসমুখ দেশ পৃথিবীতে আর দুটো নেই। প্যারিসের উন্মত্ত উজ্জ্বল বিলাস দেখেছেন? কোনো সুস্থ জাতির পক্ষে এরকম নির্লজ্জ কাণ্ডজ্ঞানহীনতা সম্ভব?

আমি বললুম, ‘বার্লিনেও কাবারে’ আছে।

হের ওবের্স্ট বললেন, বার্লিন জর্মনি নয়, প্রাশার প্রতীক নয়, কিন্তু প্যারিস ফ্রান্স এবং ফ্রান্স প্যারিস।

আমি চুপ করে ভাবতে লাগলুম। হঠাৎ আমার মনে একটা প্রশ্ন জাগল। যে-সমস্যা মানুষের মনকে অহরহ আন্দোলিত করে, শেষ পর্যন্ত সে-সমস্যা নিজের জীবনে, নিজের পরিবারের জীবনে কতটা প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে তাই নিয়ে মানুষ ইচ্ছা-অনিচ্ছায় একদিন না একদিন আলোচনা করে। হের ওবের্স্টকে কখনো আলোচনার সে দিকটা মাড়াতে দেখিনি।

ফ্রাউ ডুটেন্হফারকে আমি অধিকাংশ সময় ভারতবর্ষ সম্বন্ধে গল্পকাহিনী বলতুম। হের ওবের্স্টের তুলনায় যদিও তার সঙ্গে দেখা হত কম, তবু তার সঙ্গে হৃদ্যতা হয়েছিল বেশি। একদিন তাকে জিজ্ঞাসা করলুম, ‘হের ওবের্স্টের সঙ্গে নানা আলোচনা হয়, কিন্তু আমার মাঝে মাঝে ভয় হয়, না জেনে হয়তো আমি এমন বিষয়ের কথা পাড়ব যাতে তার আঘাত লাগতে পারে। আমার বিশ্বাস তিনি অনেক কষ্ট পেয়েছেন—তাই এ-প্রশ্ন শুধালুম।’

ফ্রাউ ডুটেহকার অনেকক্ষণ চুপ করে রইলেন। মুখের ভাব থেকে মনে হল তিনি মনে মনে বলি কি বলি না’ করছেন। শেষটায় ক্ষীণ কণ্ঠে বললেন, ‘আমাদের পরিবারের কথা কখনো পাড়বেন না। আমাদের যোল বছরের ছেলেটি ফ্রান্সের লড়াইয়ে মারা গেছে, আমাদের মেয়ে—

কথার মাঝখানে ফ্রাউ ডুটেনহফার হঠাৎ দু’হাত দিয়ে মুখ ঢেকে নিঃশব্দে ফুলে ফুলে কেঁদে উঠলেন। এই বেকুব গোমূখামির জন্য আমি মনে মনে নিজেকে খুব জুতো-পেটা করলুম। অতটা বুদ্ধি কিন্তু তখনো ছিল যে এ সব অবস্থায় সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করলে বিপদ বাড়িয়ে ভোলা হয় মাত্র। পা টিপে টিপে ঘর থেকে বেরিয়ে এলুম। প্রাশানরা হয়তো তখনো হিল ক্লিক করে।

বড় ছেলে মরে যাওয়াতে বয়স্ক চাষাকে একদম ভেঙে পড়তে দেখেছি। তার তখন দুঃখ সে মরে গেলে তার খেত-খামার দেখবে কে। সভ্যতা কুলটুরের পয়লা কাতারের শহরে তারি পুনরাবৃত্তি দেখলুম ভুটেনহার পরিবারে। এত ঐতিহ্য, এত সাধনা, এত ভবিষ্যতের স্বপ্ন সব এসে শেষ হবে এই ডুটেহফারে?

তাই কি এত কৃচ্ছসাধন, রক্তসংমিশ্রণের বিরুদ্ধে এত তীব্র হুঙ্কার? যে বর্ষায় সফল বৃষ্টি হয় না সেই বর্ষাতেই কি দামিনীর ধমক, বিদ্যুতের চমক বেশি?

তাই হের ওবের্স্টের পড়াশুনোরও শেষ নেই। সভ্য অসভ্য বর্বর বিদগ্ধ দুনিয়ার তাবৎ জাতির নৃতত্ত্ব, সমাজগঠন, ধর্মনীতি পড়েই যাচ্ছেন, পড়েই যাচ্ছেন। শীতের রাতে আগুন না জ্বালিয়ে ঘরের ভিতর ঘন্টার পর ঘন্টা পাইচারি, বসন্তে বেখেয়ালে বৃষ্টিতে জবজব হয়ে বাড়ি ফেরা, গ্রীষ্মের সুদীর্ঘ দিবস বিদেশী মুসলমানকে প্রাশান ধর্মের মূল তত্ত্বে ওকিবহাল করার অন্তহীন প্রয়াস, হেমন্তের পাতা-ঝরার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে না জানি কোন নিষ্ফল বৃক্ষের কথা ভেবে ভেবে চিত্তের লুকানো কোণে দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ।

কিন্তু আমার সামনে তিনি কখনো দীর্ঘনিশ্বাস ফেলেননি। এসব আমার নিছক কল্পনাই হবে।

এক বৎসর ঘুরে এল। আমি ততদিনে পুরো পাক্কা প্রাশান হয়ে গিয়েছি। চেয়ারে হেলান না দিয়ে বসি, সুপে গোলমরিচের গন্ধ পেলে ঝাড়া পনেরো মিনিট হাঁচি, একটানা বারো ঘন্টা কাজ করতে পারি, তিন দিন না ঘুমুলেও চলে—যদিও কৃচ্ছ্বসাধনের ফলে আমার নিদ্রাকৃচ্ছুতা তখন অনেকটা সেরে গিয়েছে—কাঠের পুতুলের মতো খটখট করে হাঁটা রপ্ত হয়ে গিয়েছে, আর আমার জর্মন উচ্চারণ শুনে কে বলবে আমি ভাত-খেকো, নেটিব, কালা-আদমী। সঙ্গে সঙ্গে এ-বিশ্বাসও খানিকটে হল যে হের ওবের্স্টের হৃদয় বলে যদি কোনো রক্তমাংসে গড়া বস্তু থাকে, তবে তার খানিকটে আমি জয় করতে পেরেছি।

এমন সময় এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে আমার জীবনের প্রাশান-পর্বকে তার কুরুক্ষেত্রে পৌঁছিয়ে দিল।

কলেজ থেকে ফিরেছি। দোরের গোড়ায় দেখি একটি যুবতী পেরেমবুলেটরের হ্যান্ডেলে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অঝোরে কাঁদছেন। চেহারাটি ভারি সুন্দর, হুবহু হের ওবের্স্টের মতো। তিনিও সামনে দাঁড়িয়ে। মুখে কথা নেই। আমিও দাঁড়ালুম, প্রাশান এটিকেট যদিও সে-অবস্থায় কাউকে সেখানে দাঁড়াতে কড়া বারণ করে। তবুও যদি কেউ দাঁড়ায় তবে সেই প্রাশান এটিকেটেরই অলঙ্ঘ্য আদেশ, হের ওবের্স্ট তাকে মহিলাটির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবেন। তিনি এটিকেট লঙ্ঘন করলেন—সেই প্রথম আর সেই শেষ।

আমি তখন আর প্রাশান না। আমার মুখোস খসে পড়েছে। আমি ফের কালা-আদমী হয়ে গিয়েছি। আমি নড়ব না।

মেয়েটি কী বললেন বুঝতে পারলাম না।

হের ওবের্স্ট বললেন, ‘তোমাকে আমি একবার বলেছি, আমার সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপনা করার চেষ্টা করবে না। তাই আর এক বার, শেষবারের মতো বলছি, তুমি যদি আবার এরকম চেষ্টা করো, তবে আমাকে বাধ্য হয়ে তোমার সন্ধানের বাইরে যেতে হবে।

আমি আর সেখানে দাঁড়ালুম না। ছুটে গেলুম ফ্রাউ ডুটেনহফারের কাছে। বললুম, আপনার মেয়ে দোরের গোড়ায় দাঁড়িয়ে। আপনার স্বামী তাকে তাড়িয়ে দিচ্ছেন।

তিনি পাথরের মতো বসে রইলেন। আমি তাকে হাত ধরে তুলে সদর দরজার দিকে নিয়ে চললুম। করিডরে শুনি দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ। দেখি, হের ওকে ফিরে আসছেন। আমি তখন ফ্রাই ডুটেহফারের হাত ছেড়ে দিয়ে ছুটলুম মেয়েটির সন্ধানে। তাকে পেলুম বাড়ির সামনের রাস্তায়। তখনো কাঁদছেন। তাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে এলুম, তার ঠিকানা টুকে নিয়ে এলুম।

বাড়ি ফিরে নিজের ঘরে ঢুকে দেখি টেবিলের উপর আমার নামে একখানা চিঠি। ঋজু, শক্ত, প্রাশান হাতে হের ওবের্স্টের লেখা। আমার বুক কেঁপে উঠল। খুলে পড়লুম–

আপনার কর্তব্যবুদ্ধি আপনাকে যে-আদেশ দিয়েছিল আপনি তাই পালন করেছেন। আমি তাতে আনন্দিত হয়েছি। কিন্তু এর পর আপনার সঙ্গে আমার আর কোনো যোগসূত্র থাকতে পারে না।

আপনার বাড়ি পেতে কোনো কষ্ট হবে না জেনেই বৃথা সময় নষ্ট না করে আপনাকে আমার বক্তব্য জানালাম।

হের ওবের্স্টকে ততদিনে এতটা চিনতে পেরেছিলাম যে, তার হৃদয় থাক আর নাই থাক, তাঁর প্রতিজ্ঞার নড়চড় হয় না। পরদিন সকালবেলা ডুটেন্হকারদের বাড়ি ছাড়লুম। হের ওবের্স্টের সঙ্গে দেখা করবার চেষ্টা করিনি। ফ্রাই কপালে চুমো খেয়ে আমাকে আশীর্বাদ করেছিলেন।

আচ্ছা এতক্ষণ চুপ করে শুনে যাচ্ছিল। কে যেন জিজ্ঞেস করল—সকলের হয়ে কিন্তু মেয়েটির দোষ কী ছিল?

চাচা বললেন, ‘হের ওবের্স্টের গোর দিতে যাই তার প্রায় বৎসরখানেক পরে। সেখানে শুনলুম, তার মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপককে বিয়ে করেছিলেন, এবং তিনি জাতে ফরাসী।

মুখুয্যের দিকে চেয়ে বললেন, ‘তোর অধ্যাপক কী বলছিল রে? বর্ণসঙ্কর-ফঙ্কর আবোল-তাবোল কথা! বর্ণসঙ্করের প্রতি দরদ দেখিয়েছিলুম বলে হের ওবের্স্ট তার জীবনের শেষ সঙ্গীকে অকাতরে অপাঙক্তেয় করলেন।

এবং নিজে? অর্ধ-অনশনে তার মৃত্যু হয়। আমাকে না তাড়ালে হয়তো তিনি আরো বহুদিন বাঁচতেন। তিনি আর কোনো পেয়িং-গেস্ট নিতে রাজি হননি। একে নিরস্তু উপবাসে মৃত বলা চলে না সত্যি, কিন্তু, এরও একটি পদবী থাকা উচিত। কী বলো গোঁসাই?’

আড্ডার চ্যাংড়া সদস্য গোলাম মৌলা বলল, ‘শেষ ট্রেন মিস করেছি।’

চাচা বললেন, ‘চ, প্রাশান কায়দায় পাঁচ মাইল ডবল-মার্চ করা দেখিয়ে দিই।’

 

 

 

 

মা-জননী

 

যুদ্ধের পূর্বে লন্ডনে অগুনতি ভারতীয় নানা ধান্দায় ঘোরাঘুরি করত। তাদের জন্য হোটেল, বোর্ডিং হৌস তো ছিলই, ডাল-রুটি, মাছ-ভাত খাওয়ার জন্য রেস্তোরাঁও ছিল প্রয়োজনের চেয়ে অধিক।

 

বাদবাকি সমস্ত কন্টিনেন্টে ছিল মাত্র দুটি ভারতীয় প্রতিষ্ঠান। প্যারিসের রু দ্য সমোরারের ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন’ ও বার্লিনের ‘হিন্দুস্থান হৌস’।

 

লন্ডন ভারতীয় ছাত্রদের সম্বন্ধে উদাসীন কিন্তু বার্লিন ভারতীয়দের খাতির করত। তাই অর্থাভাব সত্ত্বেও ‘হিন্দুস্থান হৌস’ কায়ক্লেশে যুদ্ধ লাগা পর্যন্ত টিকে থাকতে পেরেছিল। একদিক থেকে দেখতে গেলে হিন্দুস্থান হৌস’ নাৎসি আন্দোলনের চেয়েও প্রাচীন, কারণ ১৯২৯-এ হৌসের যখন পত্তন হয় তখনো হিটলার বার্লিনে কল্কে পাননি।

 

সেই ‘হিন্দুস্থান হৌসে’র এক কোণে বাঙালিদের একটা আড্ডা বসত। সে-আড্ডার ভাষাবিদ সূয্যি রায়, লেডি-কিলার পুলিন সরকার, বেটোফেনজ্ঞ মদনমোহন গোস্বামী বার্লিন সমাজের অশোক-স্তম্ভ কুতুবমিনার হয়ে বিরাজ করতেন। আড্ডার চক্রবর্তী ছিলেন চাচা। হিন্দুস্থান হৌসের ভিতরে বাহিরে তার প্রতিপত্তি কতটা তা নিয়ে আমরা কখনো আলোচনা করার প্রয়োজন বোধ করিনি, কারণ চাচা ছিলেন বয়সে সকলের চেয়ে বড়, দানে-খয়রাতে হাতিম-তাই, আর সলা-পরামর্শে সাক্ষাৎ বৃহস্পতি।

 

 

এঁদের সকলকেই লুফে নেবার জন্য বার্লিনের বিস্তর ড্রইংরুম খোলা থাকা সত্ত্বেও এরা সুবিধে পেলেই হিন্দুস্থান হৌসে’ এসে আড্ডা জমাতেন। এ-স্বভাবটাকে বাঙালির দোষ এবং গুণ দুইই বলা যেতে পারে।

 

আড্ডা জমেছে। সূয্যি রায় চুকচুক করে বিয়ার খাচ্ছেন। লেডি-কিলার পুলিন সরকার চেস্টনাট ব্রাউন আর নেট চুলের তফাৎটা ঠিক কোন জায়গায় তাই নিয়ে একখানা থিসিস ছাড়ছে, চাচা গলাবন্ধ কোটের ভিতরে হাত ঢুকিয়ে চোখ বন্ধ করে আপন ভাবনা ভেবে যাচ্ছেন, এমন সময় আড্ডার সবচেয়ে চ্যাংড়া সদস্য, রায়ের প্রতেজে’ বা ‘দেশের ছেলে’, গ্রাম-সম্পর্কে ভাগ্নে গোলাম মৌলা এসে তার মামার পাশে বসল। তার চোখেমুখে অদ্ভুত বিহুলতা লাস্ট ট্রেন মিস করলে কয়েক মিনিটের তরে মানুষ যে-ভাব নিয়ে বোকার মতো প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকে অনেকটা সেই রকম।

 

রায় শুধালেন, কী রে, কী হয়েছে? প্রেমে পড়েছিস?’

 

গোলাম মৌলা বড় লাজুক ছেলে। বয়স সতের হয় কি না হয়, বাপ কট্টর খেলাফতি, ছেলেকে কী দেশে কী বিলেতে ইংরেজের আওতায় আসতে দেবেন না বলে সেই অল্পবয়সেই বার্লিন পাঠিয়েছেন। সুয্যিমামা না থাকলে সে বহুকাল আগেই বার্লিন ছেড়ে পালাত। কথা কয় কম, আর বড়দের ফাইফরমাস করে দেয় অনুরোধ বা আদেশ করার আগেই।

 

 

বলল, আমার ল্যান্ডলেডি আর তার মেয়েতে কী ঝগড়াটাই না লেগেছে যদি দেখতেন! মা নাচে যাচ্ছে, কিছুতেই মেয়েকে নিয়ে যাবে না। মেয়ে বলছে যাবেই।

 

রায় জিজ্ঞেস করলেন, মায়ের বয়স কত রে?

 

চল্লিশ হয়নি বোধ হয়।

 

‘মেয়ের?’

 

‘আঠারো হবে।

 

রায় বললেন, তাই বল! এতে তোর এত বেকুব বনার কী আছে রে? মা-মেয়ে যদি একসঙ্গে নাচে যায় তবে মায়ের বয়স ভাড়াতে অসুবিধা হবে না?

 

মৌলা বলল, কী ঘেন্না! মেয়েটাও দেমাক করে বলছিল, সে থাকলে নাকি মায়ের দিকে কেউ ফিরেও তাকায় না। আমি ভাবলুম, রাগের মাথায় বলছে, কিন্তু কী ঘেন্না। মায়ে-মেয়ে এই নিয়ে লড়াই! মৌলার বিহ্বলতা কেটে গিয়েছে, আর তার জায়গায় দেখা দিয়েছে তেতো-তেতো ভাব।

 

 

আজ্ঞা তর্কাতর্কির বিষয় পেয়ে যেন রথের নারকোলের উপর লাফিয়ে পড়ল। একদল বলে বাচ্চার জন্য মায়ের ভালোবাসা অনুন্নত সমাজেই পাওয়া যায় বেশি, অন্য দল বলে ভারতের একান্ন-পরিবার সভ্যতার পরাকাষ্ঠা, আর একান্ন-পরিবার খাড়া আছে মা-জননীদের দয়ামায়ার উপর। লেডি কিলার সরকারকে জনরা বলত Schuerzenjaeger অর্থাৎ এপ্রন-শিকারী’, কাজেই সে যে মা-মেয়ে সকলের পক্ষ নিয়ে লড়বে তাতে আর আশ্চর্য কী, আর গোঁসাই বিশ্বাস করেন যে, আমাদের মা যশোদার কাছে মা-মেরির মাদারূপ নিতান্ত পানসে।

 

রায় তর্কে যোগ দেননি। কথা কাটাকাটি কমলে পরে বললেন, ‘অত ব্যস্ত হচ্ছ কেন? হবে হবে, কলকাতা-বোম্বাই সর্বত্রই আস্তে আস্তে মায়ে-মেয়ে রেষারেষি আরম্ভ হবে।

 

তখন চাচা চোখ মেললেন। বললেন, ‘সে কি হে রায়সায়েব! তুমিও একথা বললে? তার চেয়ে কথাটা পাল্টে দিয়ে বলল না কেন, জর্মনিতেও একদিন আর এলড়াই থাকবে না। এখনকার অবস্থা তো আর স্বাভাবিক নয়। বেশির ভাগ ল্যান্ডলেডিই বিধবা, আর যাদের বয়স ষোলর উপরে, তারাই বা বর জোটাবে কোত্থেকে? আরো বহুদিন ধরে চলবে কুরুক্ষেত্রের শত বিধবার রোদন। ১৪-১৮টা কুরুক্ষেত্রের চেয়ে কম কোন হিসেবে?’

 

 

গোঁসাই বললেন, কিন্তু—

 

চাচা বললেন, তবে শোনন।

 

কর্নেল ডুটেন্‌হফারের বাড়ি ছাড়ার বৎসরখানেক পরে হঠাৎ আমাকে টাকাপয়সা বাবদে বিপদগ্রস্ত হতে হয়। তখনকার দিনে বার্লিনে পয়সা কামানো আজকের চেয়েও অনেক বেশি শক্ত ছিল। মনে মনে যখন ভাবছি ধন্নাটা কোন চাকরী নিয়ে শুরু করব, অর্থাৎ ওরিয়েন্টাল ইনস্টিটুটে অনুবাদকের, খবরের কাগজে কলামনিস্টের, না ইংরিজি ভাষার প্রাইভেট ট্যুটরের, এমন সময়ে ফ্রলাইন ক্লারা ফন্ ব্রাভেলের সঙ্গে দেখা। আমি একটা অত্যন্ত নচ্ছার রেস্তোরাঁ থেকে বেরুচ্ছি, তিনি তার মেসেডেজ হাঁকিয়ে যাচ্ছেন। গাড়িতে তুলে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ক্লাইনার ইডিয়োট, ক্যুনিস্ট হয়ে গিয়েছ নাকি, এরকম প্রলেতারিয়া রেস্তোরাঁয় লবাব-পুত্তুর কী ভেবে?

 

‘তোমরা জানো, আমাকে ক্লাইনার ইডিয়োট’ অর্থাৎ হাবাগঙ্গারাম’ বলার অধিকার ক্লারার আছে।

 

আড্ডা ঘাড় নাড়িয়ে যা জানাতে চাইল তার অনুবাদ এককথায়—বিলক্ষণ।

 

 

চাচা বললেন, ততদিনে আমার জান শেখা হয়ে গিয়েছে। উত্তর দিলুম ডাকসাইটে কবিতায়–

 

কাইনেন্‌ ট্র্যোপ্‌ফ্‌ষেন্‌ ইন্‌ বেষার মেয়ার,

উন্‌ট্‌ ডেয়ার বয়টেল্‌ শ্লাপ্‌ উন্‌ট্‌ লেয়ার।।

 

গেলাসেতে নেই এক ফোঁটা মাল আর।

ট্যাঁক ফাঁকা মাঠ, বেবাক পরিষ্কার।।

 

ক্লারা বললেন, ‘পয়সা যদি কামাতে চাও তবে তার বন্দোবস্ত আমি করে দিতে পারি আমার পরিচিত এক ‘হঠাৎ-নবাবের’ ছেলের যক্ষ্মা হয়েছে। একজন সঙ্গীর দরকার। খাওয়া-থাকা তো পাবেই, মাইনেও দেবে ভালো। ওরা থাকে রাইনল্যান্ডে। বার্লিনের তুলনায় গরমে সাহারা।

 

আমি রাজি হলুম। দু’দিন বাদ টেলিফোনে চাকরি হয়ে গেল। হানোফার হয়ে কলন পৌঁছলুম।

 

মৌলা শুধাল, যেখান থেকে ‘ও দ্য কলন’ আসে?

 

 

হ্যাঁ, কিন্তু দাম এখানে যা, কলনেও তা। তারপর কলনে গাড়ি বদল করে বন্ন্‌, বন্ন্‌ থেকে গোডেসবের্গ। রাইন নদীর পারে। স্টেশনের চেহারাটা দেখেই জানটা তর হয়ে গেল। ভারি ঘরোয়া ঘরোয়া ভাব। ছোট্ট শহরখানির সঙ্গে জড়িয়ে মুড়িয়ে এক হয়ে আছে। গাছপালায় ভর্তি-বার্লিনের তুলনায় সোঁদরবন।

 

‘হঠাৎ-নবাব’ই বটে। না হলে জর্মনির আপন খাসা মের্ৎসেডেজ থাকতে রোল্‌স কিনবে কেন? ড্রাইভার ব্যাটাও উর্দি পরেছে মানওয়ারি জাহাজের এ্যাডমিরালের।

 

কিন্তু কর্তা-গিন্নীকে দেখে বড় ভালো লাগল। ‘হঠাৎ-নবাব’ হোক আর যাই হোক, আমাকে এগিয়ে নেবার জন্য দেখি দেউড়ির কাছে লনে বসে আছেন। খাতির-যত্নটা যা করলেন, আমি যেন কাইজারের বড় ব্যাটা। দু’জনাই ইয়া লাশকর্তা বিয়ার খেয়ে খেয়ে, গিন্নী হুইপট ক্রীম গিলে গিলে। কর্তার মাথায় বিপর্যয় টাক আর গিন্নীর পা দুখানা ফাইলেরিয়ায় ফুলে গিয়ে আগাগোড়া কোলবালিশের মতো একাকার। দু’জনেই কথায় কথায় মুচকি হাসেন—ছোট্ট মুখ দুখানা তখন চতুর্দিকে গাদা গাদা মাংসের সঙ্গে যেন হাতাহাতি করে কোনো গতিকে আত্মপ্রকাশ করে, এবং সে এতই কম যে তার ভিতর দিয়ে দাঁতের দর্শন মেলে না।।

 

জিরিয়েজুরিয়ে নেওয়ার পর আমি বললুম, এইবার চলুন, আপনাদের ছেলের সঙ্গে আলাপ হয়ে যাক। তখন কর্তা গিন্নীকে ঠেলেন, গিন্নী কর্তাকে। বুঝতে পারলুম ছেলের অসুখে তারা এতই বিহুল হয়ে গিয়েছেন যে সামান্যতম কর্তব্যের সামনে দু’জনেই ঘাবড়ে যান—পাছে কোনো ভুল হয়ে যায়, পাছে তাতে করে ছেলের রোগ বেড়ে যায়।

 

 

যদি জানা না থাকত যে যক্ষ্মায় ভুগছে তাহলে আমি কার্লকে ওলিম্পিকের জন্য তৈরি হতে উপদেশ দিতুম। কী সুন্দর সুগঠিত দেহ—যেন গ্রীক ভাস্কর শাস্তু মিলিয়ে মেপেজুপে প্রত্যেকটি অঙ্গ নির্মাণ করেছেন, কোনো জায়গায় এতটুকু খুঁত ধরা পড়ে না। আর সানবাথ নিয়ে নিয়ে গায়ের রঙটি আমাদের দেশের হেমন্তের পাকাধানের রঙ ধরেছে, চোখ দুটি আমাদেরই শরতের আকাশের মতো গভীর আসমানি।

 

ঘরে আরেকটি প্রাণী উপস্থিত ছিল, নিতান্ত সাদামাটা চেহারা, কিন্তু স্বাস্থ্যবতী রোগীর নার্স। গিন্নী আলাপ করিয়ে দিয়ে বললেন, আমাদেরই শহর স্টুটগার্টের মেয়ে, সঙ্গে নিয়ে এসেছি। কার্লের সেবার ভাবনা আমাদের এতটুকুও ভাবতে হয় না। আপনি নিজেই দেখতে পাবেন।

 

একে নিয়েই আমার অভিজ্ঞতা।

 

লেডি কিলার সরকার বলল, ‘কিন্তু বললেন যে নিতান্ত সাদামাটা?’

 

রায় বললেন, ‘চোপ!

 

 

চাচা কোনো কথায় কান না দিয়ে বললেন, অভিজ্ঞতাটা এমনি মর্মন্তুদ যে সেটা আমি চটপট বলে ফেলি। এ জিনিস ফেনিয়ে বলার নয়।

 

মেয়েটির নাম সিবিলা। প্রথম দর্শনে নার্সদের কায়দামাফিক গম্ভীর সরকারি চেহারা নিয়ে টেম্পারেচারের চার্টের দিকে এমনিভাবে তাকিয়েছিল, যেন চার্টখানা হঠাৎ ডানা মেলে উড়ে যাবার চেষ্টা করলে সে সেটাকে খপ করে ধরে ফেলবে। কিন্তু দুদিনের মধ্যেই টের পেলুম, সে কার্লকে যত না নিখুঁত সেবা দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে তার চেয়ে ঢের বেশি প্রাণরস যোগাচ্ছে হাসিখুশী, গালগল্প দিয়ে। সাদামাটা চেহারা কিন্তু সেটা যতক্ষণ সে অন্যের প্রতি উদাসীন ততক্ষণই-একবার কথা বলতে আরম্ভ করলে চোখমুখ যেন নাচতে থাকে, ড্যাবডেবে পুকুরে ঢিল ছুঁড়লে যে-রকম ধারা হয়। কারো কথা শোেনার সময়ও এমনভাবে তাকায়, মনে হয় যেন চোখ দিয়ে কথা গিলছে। তার উপর গানের ফোয়ারা তার ছিল অন্তহীন—গ্যেটে, হাইনে, ম্যারিকে, কের্টের কথা, বেটোফেন, ব্রামস, শুমান, মেন্ডেলজোনের সুর দিয়ে গড়া যে-সব গান সে কখনো কার্সের জন্য চেঁচিয়ে, কখনো আপন মনে গুনগুনিয়ে গেয়েছে, তার অর্ধেক ভাণ্ডারও আমি অন্য কোনো এমেচারের গলায় শুনিনি।

 

কিন্তু কয়েকদিনের ভিতরেই লক্ষ্য করলুম, কথা বলার মাঝখানে সিবিলা আচমকা কেমনধারা আনমনা হয়ে যায়, খানার টেবিলে হঠাৎ ছুরিকাটা রেখে দিয়ে দেয়ালের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে, আর প্রায়ই দেখি অবসর সময়ে রাইনের পারে একা একা বসে ভাবছে। দু-একবার নিতান্ত পাশ ঘেঁষে চলে গিয়েছি—সিবিলা কিন্তু দেখতে পায়নি। ভাবলুম নিশ্চয় প্রেমে পড়েছে। কিন্তু কখন, আর কার সঙ্গে?

 

 

এমন সময় একদিন গিন্নী আমায় খাঁটি খবরটা দিলেন। ভদ্রমহিলা নিতান্ত বিপদগ্রস্ত হয়েই আমাকে সব কিছু বললেন, কারণ তার স্বামী কার্লের অসুখের ব্যাপারে এমনি কাহিল হয়ে পড়েছিলেন যে গিন্নী খবরটা তার কাছে ভাঙতে সাহস পাচ্ছিলেন না।

 

সিবিলা অন্তঃসত্ত্বা এবং অবিবাহিতা। পাঁচমাস। আর বেশিদিন চলবে না। পাড়ায় কেলেঙ্কারি রটে যাবে।

 

আমার মস্তকে বজ্রাঘাত হয়নি। আমি গিন্নীকে বললুম, সিবিলা চলে গেলেই পারে।

 

গিন্নী বললেন, যাবে কোথায়, খাবে কী? এ-অবস্থায় চাকরী তো অসম্ভব, মাঝখান থেকে নার্সের সার্টিফিকেটটি যাবে।

 

আমি বললুম, তা হলে কর্তাকে না জানিয়ে উপায় নেই।

 

গিন্নীর আন্দাজ ভুল। কর্তা খবরটা শুনে দু’হাত দিয়ে মাথার চুল ছেঁড়েননি, রেগেমেগে চেল্লাচেল্লিও করেননি। প্রথম ডেকে পাঠালেন আমাকে। বললেন, সিবিলার সঙ্গে খোলাখুলি কথাবার্তা না বলে উপায় নেই। কিন্তু আমি মনিব, সে কর্মচারী এবং ব্যাপারটা সঙ্গিন। আপনার মতো কেউ যদি মধ্যস্থ থাকে, তবে বড় উপকার হয়। অথচ জিনিসটা আপনার কাছে অত্যন্ত অরুচিকর হবে বলে আপনাকে অনুরোধ করতে সাহস পাচ্ছি না।

 

 

আমি রাজি হলুম।

 

সিবিলা টেবিলের উপর মাথা রেখে অঝোরে কাঁদল। কর্তা-গিন্নী দু’জনই খাঁটি লোক, সিবিলাকে এ বিপদ থেকে কী করে উদ্ধার করা যায় তার উপায় অনুসন্ধান করলেন অনেক, কিন্তু বিশেষ কিছু ফল হল না। তার কারণটাও আমি বুঝতে পারলুম। একদিকে বিচক্ষণ সংসারী লোক পরিস্থিতিটা ঠাণ্ডা মাথায় কাবুতে আনার চেষ্টা করছেন, অন্যদিকে গ্যেটে-হাইনের স্নেহ-প্রেমের কবিতায় ভরা, অনুভূতির ভাপে-ঠাসা জালে-পড়া সবৎসা সচকিত হরিণী। ইনি বলছেন, ‘পা ছুঁড়ে ছুঁড়ে জাল ছেঁড়ো। ও বলছে, ‘ছোঁড়াছুঁড়ি করলে বাচ্চা হয়তো জখম হবে। ইনি জিজ্ঞেস করছেন, বাচ্চার বাপ কে?’ ও মাথা ঝাঁকুনি দিয়ে বোঝাচ্ছে, ‘তাতে কোনো লাভ নেই। সে বিবাহিত ও অত্যন্ত গরীব।’

 

বুঝলুম, সিবিলার মনস্থির, সে মা হবেই।

 

কেঁদে কেঁদে টেবিলের একটা দিক ভিজিয়ে ফেলেছে।

 

চাচা স্পর্শকাতর বাঙালি, কাজেই তার গলায় বেদনার আভাস পেয়ে আড্ডার কেউই আশ্চর্য হল না।

 

 

চাচা বললেন, দেশে আমার বোন অন্তঃসত্ত্বা হয়ে বাড়ি ফিরেছে। মা খুশি, বাবা খুশি। দুদিন আগে নির্মমভাবে যে-বোনের চুল ছিঁড়েছি তার জন্যে তখন কাঁচা পেয়ারার সন্ধানে সারা দুপুর পাড়া চুষি। তার শরীরের বিশেষ যত্ন নেওয়ার কথা উঠলেই সে মিষ্টি হাসে—কী রকম লজ্জা, খুশি আর গর্বে মেশাননা। ছোট বোনরা কাঁথা সেলাই করে, আর বাবার বন্ধু বুড়ো কবরেজ মশায় দু’বেলা গলা খাঁকারি দিয়ে বাড়িতে ঢোকেন।

 

আর এ-মেয়েও তো মা হবে।

 

থাক সেসব কথা। শেষটায় স্থির হল যে কিছুই স্থির করবার উপায় নেই। উপস্থিত সিবিলা কাজ করে যাক, যখন নিতান্তই অচল হয়ে পড়বে তখন তাকে নার্সিংহোমে পাঠানো হবে। আমি পরে কর্তাকে বললুম, কিন্তু বাচ্চাটার কী গতি হবে সে কথাটা তো কিছু ভাবলেন না। কর্তা বললেন, এখন ভেবে কোনো লাভ নেই। বিপদ-আপদ কাটুক, তখন বাচ্চার প্রতি সিবিলার কী মনোভাব সেইটে দেখে ব্যবস্থা করা যাবে।

 

প্রায় শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সিবিলা কাজ করেছিল। কিন্তু শেষের দিকে তার গান গাওয়া প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আমার বোন এমনিতে গান গাইত না। সে শেষের দিকে গুনগুন করতে আরম্ভ করেছিল।

 

বাচ্চা হল। আহা, যেন একমুঠো জুই ফুল!

 

কিন্তু তখন আরম্ভ হল আসল বিপদ। বাচ্চাকে অনাথ আশ্রমে দিতে সিবিলা কিছুতেই রাজি হয় না। বলে, কোনো পরিবারে যেন সে আশ্রয় পায়। কিন্তু এরকম পরিবার পাওয়া যায় কোথায়? অনুসন্ধান করলে যে পাওয়া একেবারে অসম্ভব তা নয়, কিন্তু জর্মনির সে দুর্দিনে, ইনফ্রেশনের গরমিতে মানুষের বাৎসল্যরস শুকিয়ে গিয়েছে—আর তার চেয়েও বড় কথা, অতটা সময় আমাদের হাতে কই?

 

রোজ হয় ফোন, নয় চিঠি। নার্সিংহোম বলে সিবিলাকে নিয়ে যাও। এখানে বেড় দখল করে সে শুধু আসন্নপ্রসবাদের ঠেকিয়ে রেখেছে।

 

এদিকে কর্তা খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন, পয়সা দিয়ে এজেন্সির লোককে লাগানো, আপন বন্ধুবান্ধবদের কাছে অনুসন্ধান কিছুই বাদ দেননি। আমাকে পর্যন্ত দুতিনবার কলন, ডুসেলডর্ষ হয়ে আসতে হল। নার্সিংহোমের তাড়া খেয়ে কর্তার ভূঁড়ি গিরে আষ্টেক কমে গেল। কী মুশকিল!

 

সব কিছু জানতে পেরে তখন সিবিলাই এক আজব প্যাঁচ খেলে আমাদের দম ফেলার ফুর্সৎ করে দিল। নার্স তো বটে, এমনি এক বিদঘুটে ব্যানোর খাসা ভান করলে যে পাঠশালার মিটমিটে শয়তান আর হলিউডের ভ্যাম্পে মিললেও ফল এর চেয়ে ভালো ওতরাতো না। কুট হামসুন বলেছেন, ‘প্রেমে পড়লে বোকা বুদ্ধিমান হয়ে ওঠে, বুদ্ধিমান বোকা হয়ে যায়। সিবিলার মতো ভিতরে-বাইরে সাদামাটা মেয়ে বাচ্চার মঙ্গলের জন্য ফন্দিবাজ হয়ে উঠলো।

 

এমন সময় কর্তাকারবারে যাকে বলে ভালো পার্টির খবর পেলেন। অগাধ পয়সা, সমাজে উঁচু, শিক্ষিত পরিবার। কিন্তু আমাদের এজেন্ট বলল ‘পার্টি’—অর্থাৎ ভদ্রলোক এবং তার স্ত্রী-কড়া শর্ত দিয়েছেন যে সিবিলা এবং আমাদের অন্য কেউ ঘুণাক্ষরে জানতে পাবে না, এবং কথা দিতে হবে যে জানবার চেষ্টা করবে না, যে কারা সিবিলার বাচ্চাকে গ্রহণ করলেন। এ শর্ত কিছু নতুন নয়, কারণ কল্পনা করা কিছু অসঙ্গত নয় যে সিবিলা যদি একদিন হঠাৎ তার বাচ্চাকে ফেরত চেয়ে বসে তখন নানা বিপত্তি সৃষ্টি হতে পারে। আর কিছু না হোক বাচ্চাটা যদি জানতে পেরে যায় তার আসল মা কে, তাহলেই তো উৎকট সঙ্কট।

 

কর্তার মতো ব্যবসায়ের পাঁজে পোড়-খাওয়া ঝামাও এ-প্রস্তাব নিয়ে নার্সিংহোমে যাননি। সব কিছু চিঠিতে লিখে জানিয়েছিলেন। দুদিন পরে উত্তর এল, সিবিলা রাজি।

 

মনস্থির করতে সিবিলার দুদিন লেগেছিল। সে আটচল্লিশ ঘন্টা তার কী করে কেটেছিল, জানি না। বাড়িতে আমরা তিনজন নিঃশব্দে লাঞ্চ-ডিনার খেয়েছি, একে অন্যে চোখাচোখি হলেই একসঙ্গে সিবিলার দ্বিতীয় প্রসব-বেদনার কথা ভেবেছি। আইন মানুষকে এক পাপের জন্য সাজা দেয় একবার, সমাজ কতবার, কত বৎসর ধরে দেয় তার সন্ধান কোনো কেতাবে লেখা নেই, কোনো বৃহস্পতিও জানেন না।

 

ট্রাঙ্ক-কলে ট্রাঙ্ক-কলে সব বন্দোবস্ত পাকাঁপাকি করা হল। কর্তা সিবিলাকে নিয়ে স্টেশনে যাবেন। পার্টি’র ওয়েট-নার্স (ধাই) বাচ্চার জন্য ওয়েটিংরুমে অপেক্ষা করবে। সিবিলা স্টুটগার্টের ট্রেন ধরলে পর কর্তা বাচ্চাটিকে সেই ধাইয়ের হাতে সঁপে দেবেন। ‘পার্টি’ কড়াক্কড় জানিয়েছেন, সিবিলা যেন ওয়েট-নার্সকেও না দেখতে পায়।

 

যে দিন সিবিলাকে নিয়ে স্টেশনে যাবার কথা, সেদিন দুপুরবেলা কার্লের গলা দিয়ে একঝলক রক্ত উঠল। ছ’মাস ধরে টেম্পারেচর, স্যটাম কাবুতে এসে গিয়েছিল, এ-পি বন্ধ ছিল, তারপর হঠাৎ সাদা দাঁতের উপর কঁচা রক্তের নিষ্ঠুর ঝিলিমিলি। আমরা তিনজনাই সামনে ছিলাম। কর্তারই কী একটা রসিকতায় হাসতে গিয়ে ব্যাপারটা ঘটল। ছেলের মন ভালো রাখবার জন্য ভদ্রলোক অনেক ভেবেচিন্তে রসিকতাখানা তৈরি করেছিলেন। অবস্থাটা বোঝো! আমি তাকে হাত ধরে নিজের ঘরে শুইয়ে দিয়ে ডাক্তারকে ফোন করতে ছুটলুম।

 

আমাকে কর্তা-গিন্নী এতদিন ধরে যে আদর-আপ্যায়ন করেছেন তার প্রতিদানে যদি সে-সন্ধ্যায় কর্তার বদলে আমি সিবিলাকে নিয়ে স্টেশনে না যেতুম তাহলে নিছক নিমকহারামি হত। হার্ট নিয়ে কর্তা আচ্ছন্নের মত পড়ে আছেন। আমি নার্সিংহোম যাচ্ছি শুনে আমার হাতে সিবিলার ছ’মাসের জমানো মাইনে দিলেন। গিন্নী নিজের থেকে আরো কিছু, আর আপন হাতে বোনা বাচ্চার জন্য একজোড়া মোজা দিলেন।

 

গোডেসবের্গ ছোট শহর। কিন্তু নার্সিংহোম থেকে স্টেশন যেতে হলে দুটি বড় রাস্তার উপর দিয়ে যেতে হয়। আমি স্টিয়ারিঙে, সিবিলা বাচ্চাকে নিয়ে পিছনে। ইচ্ছে করেই ড্রাইভারকে সঙ্গে নিইনি, এবং ট্রেনটাও বাছা হয়েছে রাত্রের, যাতে করে খামকা বেশি জানাজানি হয়। তার মাইনে তাকে দিয়েছি। মোজার মোড়ক যখন সে খুলল তখন আমি সে দিকে তাকাইনি।

 

আস্তে আস্তে গাড়ি চালাচ্ছি ঝাঁকুনিতে কাঁচা বাচ্চার অনিষ্ট হয় কি না হয় তা তো জানিনে। থেকে থেকে সিবিলা আমার কাঁধের কাছে মুখ এনে জিজ্ঞেস করছে, আপনি ঠিক জানেন যাঁদের বাড়িতে আমার বুবি যাচ্ছে তারা ভালো লোক? আমি আমার সাধ্যমতো তাকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করছি আর ভাবছি কর্তা এলেই ভালো হত। তিনি সমস্ত জিনিসটা নিশ্চয়ই আরো গুছিয়ে করতে পারতেন।

 

সিবিলা একই প্রশ্ন বারে বারে শুধায়, তারা লোক ভালো তো? আমি ভাবছি যদি শুধায় তারা ভালো আমি কী করে জানলুম, তা হলেই তো গেছি। আমার কেন কর্তারও তো সে সম্বন্ধে কোনো প্রত্যক্ষ জ্ঞান নেই। কিন্তু যখন সিবিলা সে প্রশ্ন একবারও শুধালো না তখন বুঝতে পারলুম, তার কাছে অজানার অন্ধকার আধা-আলোর দ্বন্দ্বের চেয়ে অনেক বেশি কাম্য হয়ে উঠেছে। জেরা করলে যদি ধরা পড়ে যায়—যদি ধরা পড়ে যায় যে আমার উত্তরে রয়েছে শুধু ফাঁকি? তখন? তখন সে মুখ ফেরাবে কোন দিকে, কোথায় তার সানা?

 

সিবিলা বলল, গাড়ি থামান একটু দয়া করে। ঐ তো খেলনার দোকান। আমার বুবির তো কোনো খেলনা নেই। তাইতো, কা, আমি দুজনেই এদিকে একদম খেয়াল করিনি। কিন্তু একমাসের শিশু কি খেলনা বোঝে?

 

একগাদা খেলনা নিয়ে সিবিলা গাড়িতে ঢুকল।

 

দশ পা যেতে না যেতেই সিবিলা বলল, ঐ তো জামা-কাপড়ের দোকান। বুবির তো ভাললা জামা নেই। গাড়ি থামান। থামালুম। এবার বাচ্চাকে সঙ্গে নিয়ে সে দোকানে ঢুকলো, জিনিস বয়ে আনতে অসুবিধে হতে পারে ভেবে আমিও সঙ্গে গেলুম।

 

দোকানি যেটা দেখায় সেটাই কেনে। কোনো বাছবিচার না, দাম জিজ্ঞেস করা না। দোকানি পর্যন্ত কেনার বহর দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছে। আমি ভয়ে ভয়ে বললুম, ‘বুবির এখন বাড়ন্ত বয়স, জামাগুলো দুদিনেই ছোট হয়ে যাবে না?

 

বলে করলুম পাপ। সিবিলা বলল, ঠিকতো’—আর কিনতে আরম্ভ করল সব সাইজের জামা, পাতলুন, মোজা, টুপি। আমি হতাশ হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে থেকে শেষটায় বললুম, ফ্রলাইন সিবিলা, ট্রেনের বেশি দেরি নেই। সিবিলা বলল, চলুন।

 

আরো দশ পা। সিবিলা হকুম করল, থামান।

 

এবারে কী কিনল ভগবানই জানেন।

 

সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। দোকানপাট একটা একটা করে বন্ধ হতে আরম্ভ করেছে। সিবিলা বলে, থামান’, সঙ্গে সঙ্গে চলন্ত গাড়ি থেকে নেবে পড়ে, আর ছুটে গিয়ে দোকানিকে দরজা বন্ধ করতে বারণ করে। যে-দোকান দেখে বন্ধ হচ্ছে, ছুটে যায় সে-দোকানেরই দিকে। ছুটোছুটিতে চুল এলোথেলো হয়ে গিয়েছে, পাগলিনীর মতো এদিক-ওদিক তাকায়-সে একাই লড়বে সব দোকানির সঙ্গে। কেন? একদিনের তরে তারা দোকানগুলো দুমিনিট বেশি ভোলা রাখতে পারে না? আমি বার বার অনুনয় করছি, ফ্রলাইন সিবিলা, বিট্টে বিট্টে, প্লীজ প্লীজ, জায়েজী ফেরনুনটি, একি করছেন? গাড়ি ধরব কী করে? সিবিলা কোনো কথায় কান দেয় না। আমার মাথায় কুবুদ্ধি চাপল, ভাবলুম একটু জোরজার করি। বললুম, এত সব জিনিসের কী প্রয়োজন?

 

চকিতের জন্য সিবিলা বাঘিনীর ন্যায় রুখে দাঁড়াল। হুঙ্কার দিয়ে কী? বলেই থেমে গেল। তারপর হঠাৎ ঝরঝর করে চোখের জল বেরিয়ে এল।

 

চাচা বললেন, আমি ভগবানে বিশ্বাস করি। খোদর কাছে মনে মনে প্রার্থনা করলুম সিবিলার পরীক্ষা সহজ করে দেবার জন্য।

 

তারপর আমি আর বাধা দিইনি। যায় যাক দুনিয়ার বেবাক ট্রেন মিস্ হয়ে। বিশ্বসংসার যদি তার জন্য আটকা পড়ে যায় তবে পড়ুক। আমি বাধা দেব না।

 

বোধ হয় টাকা ফুরিয়ে গিয়েছে। সিবিলা আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনাদের কাছে আমার আর কোনো পাওনা আছে? আমি বললুম, না, কিন্তু আপনার যদি প্রয়োজন হয় তবে আমি দিতে পারি। বলল, ‘পাঁচটা মার্ক দিন, একখানা আ-বে-সের বই কিনব।

 

এক মাসের শিশু বই পড়বে।

 

গাড়ির পিছনটা জিনিসে ভর্তি হয়ে গিয়েছে। সিবিলা বাচ্চাকে নিয়ে আমার পাশে বসল। তার হাতের বেলুন উড়ে এসে আমার স্টিয়ারিঙে বাধা দিচ্ছে। সিবিলার সেদিকে হৃক্ষেপ নেই।

 

স্টেশনে যখন পৌঁছলুম, তখন গাড়ি আসতে কয়েক মিনিট বাকি। গোডেসবের্গ ছোট স্টেশন, ডাকগাড়ি দু’মিনিটের বেশি দাঁড়ায় না। আমি বাচ্চাটাকে নেবার জন্য হাত বাড়ালুম কোনো কথা না বলে। সিবিলা বলল, ‘প্ল্যাটফর্মে চলুন, গাড়ি ছাড়লে পর—’। আমি কোন কথা না বলে এগিয়ে চললুম।

 

পোর্টারই দেখিয়ে দিল কোন জায়গায় দাঁড়ালে সেকেন্ড ক্লাস ঠিক সামনে পড়বে। আমি সিবিলাকে আরো পঞ্চাশটি মার্ক দিলুম।

 

সিবিলা সিগনেলের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। দূরের অন্ধকারের মাঝখানে তার দৃষ্টি ডুবে গিয়েছে। তার কোলে বুবি। ভগবানের জুই একরাতেই শুকিয়ে যায়, সিবিলার জুই যেন অক্ষয় জীবনের আত্মবিশ্বাস নিয়ে ঘুমুচ্ছে।

 

সিবিলা আমার হাতে বাচ্চাকে তুলে দিল। একমুহূর্তের তরে সব কিছু ভুলে গিয়ে বলল, আপনি তো বেশ বাচ্চা কোলে নিতে জানেন! আমাদের পুরুষরা তো পারে না।

 

আমি আরাম বোধ করলুম। গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে। পোটার সিবিলার সুটকেস তুলে দিয়েছে।

 

হঠাৎ সিবিলা সেই পাথরের প্ল্যাটফর্মে হাঁটুগেড়ে আমার দু হাঁটু জড়িয়ে হা-হা করে কেদে উঠল। সে কান্নায় জল নেই, বাষ্প নেই। বিকৃত কণ্ঠে বলল

 

আমায় কথা দিন, ঈশ্বরের শপথ, কথা দিন আপনি বুবির খবর নেবেন সে ভালো আছে কি না। মা মেরির শপথনা, না, মা মেরির না—আপনার মায়ের শপথ, কথা দিন।

 

আমি আমার মায়ের নামে শপথ করলুম। পাটি যা বলে বলুক, যা করে করুক।

 

পোর্টার হয়তো ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছিল। সিবিলাকে আস্তে আস্তে ছাড়িয়ে নিয়ে গাড়িতে তুলে দিল।

 

গাড়ির গায়ে চলার পূর্বের কাপন লেগেছে। এমন সময় আমার আর সিবিলার কামরার মাঝখান দিয়ে একটি মহিলা ধীরে-সুস্থে ছোট্ট একটি ছেলের হাত ধরে ধরে চলে গেলেন। সিবিলা দোরে দাঁড়িয়েছিল, তাদের লক্ষ্য করল কি না বলতে পারিনে, হঠাৎ দরজা খুলে প্ল্যাটফর্মে নেমে পড়ল।

 

আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বাচ্চা কেড়ে নিয়ে গাড়িতে উঠল।

 

আমি বাধা দিলাম না।

 

আরও দেখুন:

Leave a Comment