চলিত ভাষা বা চলিত রীতি | বাংলা ভাষা | ভাষা ও শিক্ষা

চলিত ভাষা বা চলিত রীতি | বাংলা ভাষা | ভাষা ও শিক্ষা , চলিত ভাষা : উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের প্রথমেই ‘চলিত ভাষা ‘র প্রচলন শুরু হয় বাংলা সাহিত্যে। সংস্কৃতবহুল ‘সাধু ভাষা’র বহুল প্রচলনের ফলে বাংলা গদ্য নিছক পণ্ডিতি গদ্যে রূপান্তরিত হয়ে পড়ে এবং তার ফলে এর গতিশক্তি শিথিল ও মশর হতে থাকে। তাই সে যুগের কোনো কোনো গদ্যশিল্পী প্রচলিত নিছক পণ্ডিতি গদ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে আপামর জনসাধারণের কথা ভাষার ঢঙে বাংলা গদ্য রচনায় ব্রতী হন। ফলে বাংলা গদ্যে “নতুন রীতির মাত্রা” সংযোজিত হল এবং গদ্যরূপে ‘কথ্য রীতি’র (standard colloquial style) প্রাণমূর্তির আবির্ভাব ঘটল।

চলিত ভাষা বা চলিত রীতি | বাংলা ভাষা | ভাষা ও শিক্ষা

ঊনবিংশ শতাব্দীতে চলিত ভাষার সাহিত্যিক রূপের প্রথম প্রকাশ ঘটে টেকচাদ ঠাকুরের ‘আলালের ঘরের দুলাল’ উপন্যাসে। বঙ্কিমচন্দ্রের ভাষায় তিনিই ‘প্রথমে এই বিষবৃক্ষের (সাধু ভাষা) মূলে কুঠারাঘাত করেন। এর কিছুদিন পরেই প্রকাশিত হয় কালীপ্রসন্ন সিংহের ‘হুতোম প্যাঁচার নক্সা ২৩ আলালি ও ইতোমি ভাষা ছিল খাস কলকাত্তাই কথ্য ভাষা। সেজন্য এ ভাষা সর্বগ্রাহ্য সর্বমান্য ভাষারূপে প্রতিষ্ঠা লাভে ব্যর্থ হয়।

যাই হোক ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিক থেকে নাটক, উপন্যাস ও গল্পের সংলাপে চলিত ভাষার প্রয়োগ হতে থাকে। বর্ণনা অংশের ভাষা থাকে সাধু। রবীন্দ্রনাথ তাঁর চিঠিপত্র ও ডায়েরি পর্যায়ের রচনায় (রোপ-প্রবাসীর পত্র : ১৮৮১) চলিত ভাষাকে বাহন করেন।

প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত ‘সবুজপত্র’-এর প্রকাশ চলিত ভাষাকে সাহিত্য-ভাষা রূপে গ্রহণের সপক্ষে যে-আন্দোলনের সূত্রপাত করে, রবীন্দ্রনাথ তার পুরোভাগে এসে দাঁড়ান। প্রমথ চৌধুরী লিখলেন, ‘শুধু মুখের কথাই জীবন্ত। যতদূর পারা যায়, যে ভাষায় কথা কই সেই ভাষায় লিখতে পারলেই দেখা যা পায়।’ স্বাভাবিকভাবে সাধু ভাষা ও চলিত ভাষার মধ্যে কোনটি সাহিত্যের বাহন হবে এ নিয়ে বিতর্কের ঝড় ওঠে। উভয় ভাষারূপের সমর্থকেরা যে যার মতাদর্শকে আঁকড়ে থাকেন।

যত সময় যেতে থাকে, চলিত ভাষার পারা ওতই ভারী হতে থাকে। ‘কালি-কলম’ ও ‘কল্লোল’ গোষ্ঠীর লেখকদের সঙ্গে অনুদাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ, তারাশঙ্কর প্রমুখ খ্যাতিমান লেখকেরা চলিত ভাষাকে সাহিত্যের উপযোগী শক্ত ভিতের ওপর প্রতিষ্ঠিত করেন। পরবর্তী কালে চলিত ভাষা ধীরে ধীরে সাধু ভাষার জায়গা দখল করে নেয় এবং সাহিত্যের প্রধান প্রকাশমাধ্যমে পরিণত হয়ে সাহিত্যে এক বিশিষ্ট আসন লাভ করে।

এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, মৌখিক বা কথ্য ভাষা আর চলিত ভাষা এক নয়। বাংলা কথা বা মৌখিক ভাষা অঞ্চলভেদে বিভিন্ন উপভাষাগুলোর মধ্যে শব্দ ও শব্দোচ্চারণগত এতই পার্থক্য যে, এক উপভাষা অঞ্চলের করা অপর উপভাষা অঞ্চলের মানুষের সহজবোধ্য নয়। সেজন্যে যে-কোনো উপভাষা অঞ্চলের কথ্য ভাষা সকলের গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। সকলের গ্রহনীয় ভাষারূপে সেই ভাষাই গণা, যা সকল রকম উপভাষার ওপরে সকলের ব্যবহারযোগা ও সকলের মান্য। শিক্ষিত জনসমাজে ব্যবহৃত এরকম মার্জিত কথ্য ভাষার মানা ও স্বীকৃত রূপকে বলা হয় প্রমিত চলিত (standard colloquial) ভাষা। এটিই শিষ্ট (অর্থাৎ আঞ্চলিক নয়) ভাষা।

চলিত ভাষা বা চলিত রীতি | বাংলা ভাষা | ভাষা ও শিক্ষা

 

একসময় কলকাতা ছিল ভারতের রাজধানী। এখন তা পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী, সেইসঙ্গে ভারতের অন্যতম শিল্প- বাণিজ্যকেন্দ্র, শিক্ষা-সংস্কৃতি ও সাহিত্যচর্চার পীঠস্থান। বৃহত্তর কলকাতা ও তার পাশাপাশি অঞ্চলকে ঘিরে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অনুশীলন ও বাঙালি সংস্কৃতির ধারা অব্যাহত আছে প্রায় দু শতাব্দী কাল ধরে। সাভাবিকভাবে ওই অঞ্চলে লোকব্যবহৃত দক্ষিণ রাঢ়ি উপভাষা আর সমস্ত ভাষার ওপরে সকলের ব্যবহারযোগ্য সর্বমান্য চলিত ভাষারূপ নিয়ে সাহিত্যের বাহন হয়েছে। কাজেই কলকাতা ও ভাগীরথী তীরবর্তী স্থানসমূহের ভদ্র শিক্ষিত বাঙালি সম্প্রদায়ের মার্জিত কথা ভাষা চলিত ভাষার আদর্শ রূপে গৃহীত।

বস্তুত কলকাতা অঞ্চলের ‘কথ্য ভাষা’ যখন দেশের বেশির ভাগ শিক্ষিত সম্প্রদায়ের ভাষা প্রয়োগের সাধারণ মাধ্যমে পরিণত হল, তখন তাতে সাহিত্য রচনার আর কোন বাধা থাকল না। এ কথা ভাষার মাধ্যমে যে ভাষা সৃষ্টি হল, তা-ই পরিণামে ‘প্রমিত’ (standard colloquial) ভাষা নামে অভিহিত হয় ও প্রতিষ্ঠা পায়।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর পরিণত বয়সের রচনায় এ চলিত ভাষা কেই অভিনন্দন জানিয়েছেন। এ ভাষা সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত হয়ে তিনি বলেছেন, এর চলিত ভাষার। নিজের একটি কলধ্বনি আছে। আমার শেষ বয়সে কাব্য-রচনায় আমি বাংলার এই ‘চলিত ভাষা’র সুরটাকে কাজে লাগাইবার চেষ্টা করিয়াছি। কেননা দেখিয়াছি ‘চলিত ভাষা টাই স্রোতের জলের মত চলে।”

চলিত কথ্য ভাষা বা চলিত কথা রীতির সংজ্ঞার্থ দিতে গিয়ে প্রখ্যাত ভাষাতত্ত্ববিদ ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, “দক্ষিণ-পশ্চিম বঙ্গে ভাগীরথী নদীর তীরবর্তী স্থানের ভদ্র ও শিক্ষিত সমাজের ব্যবহৃত মৌখিক ভাষা, সমগ্র বাঙ্গালাদেশের শিক্ষিত সমাজ কর্তৃক শ্রেষ্ঠ মৌখিক ভাষা বলিয়া গৃহীত হইয়াছে। এই মৌখিক ভাষাকে বিশেষভাবে ‘চলিত ভাষা’ বলা হয়।” তবে চলিত ভাষার এই মৌখিক বা কথ্য রূপ আমরা মুখের কথায় যেভাবে বলি, লেখার সময়ে হুবহু ঠিক সেভাবে লিখি না। তখন লেখার যে-রূপটি ব্যবহৃত হয় সেটাকেই আমরা প্রমিত (standard) চলিত ভাষা বলে থাকি।

সামগ্রিকভাবে বলতে গেলে— দেশের সর্ব এলাকার মানুষের বোধগম্য মানসমৃদ্ধ যে ভাষারীতিতে সমাসবদ্দ গুরুগম্ভীর ও সংস্কৃতানুসারী শব্দসমূহ বর্জন করে মানুষের মুখের ভাষার মার্জিত রূপকে সহজ, সরল ও চটুলভাবে প্রকাশ করা হয় এবং যে-ভাষায় ক্রিয়া, সর্বনাম এবং নঞর্থক অব্যয় (যোজক) পদের সংক্ষিপ্ত রূপ ব্যবহৃত হয়. তেমন ভাষারীতিকে চলিত ভাষারীতি বলে।

যেমন : যাকে তাকে যা তা শোনাতে যাওয়া তোমার উচিত হয় নি। এখানে ‘যাকে”, ‘তাকে’, ‘যা’, ‘তা’ যথাক্রমে ‘যাহাকে’, ‘তাহাকে ‘—সর্বনাম পদ, ‘যাহা’ ‘তাহা’—অব্যয় পদ (যোজক) এবং ‘শোনাতে’ ও ‘নি’ যথাক্রমে “শুনাইতে ‘ক্লিয়া ও ‘নাই’ নঞর্থক অব্যয় (যোজক) পদের সংক্ষিপ্ত রূপ ব্যবহৃত হয়েছে।

 

আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

সাহিত্যিক চলিত ভাষার নিদর্শন

[ক] ‘রৌদ্রে ধূ ধূ ক’রছে ধূসর মাটি, দূরে কোথাও মরীচিকা দেখা দিল। কোথাও মেষপালক নিয়ে চলেছে ভেড়ার পাল, কোথাও চ’রছে উট, কোথাও বা ঘোড়া। হু হু করে বাতাস বইছে, মাঝে মাঝে ঘুর খেতে খেতে ছুটেছে ধূলির আবর্ত। অনেক দূর পেরিয়ে এদের ক্যাম্পে এসে পৌঁছলুম। একটা বড় খোলা তাবুর মধ্যে দলের লোক বাসে গেছে…. কফি সিদ্ধ হচ্ছে, খাচ্ছে ঢেলে ঢেলে। আমরা গিয়ে বসলুম একটা মস্ত মাটির ঘরে। [রবীন্দ্রনাথ]

[খ] কেউ হয়তো প্রথমেই জিজ্ঞাসা করতে পারেন, বাংলা ভাষা কাকে বলে। বাঙালির মুখে এ প্রশ্ন শোভা পায় না। এ প্রশ্নের সহজ উত্তর কি এই নয় যে, যে ভাষা আমরা সকলে জানি শুনি বুঝি, যে ভাষায় আমরা ভাবনা-চিন্তা সুখ- দুঃখ বিনা আয়াসে বিনা ক্লেশে বহুকাল হ’তে প্রকাশ করে আসছি এবং সম্ভবত আরও বহুকাল পর্যন্ত প্রকাশ করব। সেই ভাষাই বাংলা ভাষা।’  [প্রমথ চৌধুরী]

সাহিত্যিক চলিত ভাষার এই নিদর্শনে দেখা যাচ্ছে, অসংস্কৃত শব্দের পাশাপাশি বহু সংস্কৃত শব্দও ব্যবহার করা হয়েছে। এতেও বিশেষভাবে লক্ষণীয় হচ্ছে অসমাপিকা ক্রিয়া এবং সর্বনাম পদের রূপ, যেমন :

[ক] করছে, চলছে, ক’রে বইছে, খেতে পৌঁছলুম, হ’চ্ছে ইত্যাদি;

[থ] করিতে, কাকে, নয়, হাতে, আসছি, করব ইত্যাদি।

এগুলো একান্তভাবে চলিত ভাষার বিশিষ্ট রূপ, সাধু ভাষায় এগুলোর রূপ ভিন্ন।

 

চলিত ভাষা বা চলিত রীতি | বাংলা ভাষা | ভাষা ও শিক্ষা

 

আরও দেখুন:

Leave a Comment