চলচ্চিত্রে অশ্লীলতা | সাংস্কৃতিক অবক্ষয় ও আইনের কার্যকারিতা | নীতি চরিত্র মূল্যবোধ | বাংলা রচনা সম্ভার , ভূমিকা : সাহিত্য, সংস্কৃতি ও চলচ্চিত্র শুধু বিনোদনের মাধ্যম নয়; জীবনঘনিষ্ঠ সুস্থ সাহিত্য, সংস্কৃতি ও চলচ্চিত্র আন্দোলনের মাধ্যমে যে কোনো দেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তন সম্ভব। সুস্থ বিনোদন ছাড়া সুস্থ জীবন কোনোভাবেই কল্পনা করা যায় না। কিন্তু বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে অশ্লীলতার মাত্রা দিনের পর দিন অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে বেড়ে চলেছে। অশ্লীলতার এ হাতছানি আমাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক জীবনে ফেলছে বিরূপ প্রভাব। অপসংস্কৃতির বেড়াজালে আবদ্ধ চলচ্চিত্রকে উদ্ধার করতে হবে, ফিরিয়ে আনতে হবে চলচ্চিত্রের অতীত গৌরব । নৈতিকতা, দায়িত্ববোধ, সামাজিক দায়বদ্ধতা, সুন্দর ও রুচিশীল সংস্কৃতি লালন এক্ষেত্রে পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করতে পারে।
চলচ্চিত্রে অশ্লীলতা | সাংস্কৃতিক অবক্ষয় ও আইনের কার্যকারিতা | নীতি চরিত্র মূল্যবোধ | বাংলা রচনা সম্ভার
চলচ্চিত্রে অশ্লীলতা
চলচ্চিত্র সম্পর্কে ধারণা মানুষের মুক্তবুদ্ধি, চিন্তা, বাক, মত ও ভাব প্রকাশের অন্যতম বাহন হলো গণমাধ্যম। এ গণমাধ্যমসমূহের মধ্যে রয়েছে সংবাদপত্র, রেডিও, টেলিভিশন, বই-পুস্তক, চলচ্চিত্র প্রভৃতি। বিজ্ঞানের যে সামান্য কয়টি হাতে গোণা বিস্ময়কর আবিষ্কার সর্বস্তরের মানুষের জীবনকে গভীরভাবে স্পর্শ করে একটি স্থায়ী আসন দখল করেছে এবং যার গভীর আবেদন ও জনপ্রিয়তা আবিষ্কারোত্তর দীর্ঘ যাত্রাপথে তিল পরিমাণ স্নান হয়নি, সেগুলোর মধ্যে চলচ্চিত্র বা সিনেমা অন্যতম। বস্তুত সিনেমার জনপ্রিয়তা বিশ্বব্যাপী দিনের পর দিন বৃদ্ধি পেয়েছে। চলচ্চিত্রের ব্যবহার বা প্রয়োগ আজ বহুমুখী হলেও জনসাধারণের জীবনে এখনো তা বিনোদনের এক অতুলনীয় মাত্রা হিসেবে চিহ্নিত।
ঐতিহাসিক পটভূমি : যাদুকর বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসন ১৮৯০ সালে তার গবেষণাগারে উদ্ভাবন করলেন চলন্ত বস্তুর ছবি তোলার এক যন্ত্র, যা পরবর্তীতে ইংরেজ এক বিজ্ঞানীর হাতে সংস্কারকৃত হয়ে তৈরি হলো সিনেমার মূল যন্ত্রের সরলতম রূপটি। আর এ যন্ত্র দিয়েই সাদা পর্দার ওপর ছবি প্রতিফলিত করা সম্ভব হলো।
পরম বিস্ময়ে মানুষ দেখল পৃথিবীর প্রথম চলচ্চিত্র। তবে সে চলচ্চিত্র ছিল গতিশীল জীবন্ত, বাস্তবধর্মী নির্বাক। এরপর বিশ্বব্যাপী এ চলচ্চিত্র বিকশিত হতে লাগল । আবিষ্কারের মতোই চল’চ্চিত্রের বিকাশ ঘটে আমেরিকায়। সেখান থেকে পৌঁছায় ইউরোপে। ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ড চলচ্চিত্রের আরও উন্নততর বিকাশ সাধন করে এবং অন্তহীন গবেষণার ফলে আবিষ্কৃত হলো ‘টকিবায়োস্কোপ’ বা ‘অবাক চল’চ্চিত্র’। আরো পরে ক্রমাগত এবং ক্রমবর্ধমান বিবর্তনের মাধ্যমে চলচ্চিত্র আজকের এ পূর্ণতা লাভ করেছে।
চলচ্চিত্র আবিষ্কারের পর তা নিয়ন্ত্রিত ও সুব্যবস্থাপনায় পরিচালিত করার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গড়ে ওঠে চলচ্চিত্রভিত্তিক বিভিন্ন সংস্থা। বিশ্বের প্রথম চলচ্চিত্র সংসদ ‘The Film Society’ প্রতিষ্ঠিত হয় লন্ডনে ১৯২৫ সালে। ব্রিটেনে চলচ্চিত্র সংসদ জন্মলাভের পর যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও জার্মানিসহ এ সংস্থা বিভিন্ন দেশে বিস্তার লাভ করে। উপমহাদেশে ১৯৪৫ সালের ৫ অক্টোবর প্রতিষ্ঠিত হয় চল’চ্চিত্র সংসদ ‘ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি’। বস্তুতপক্ষে বাংলাদেশে চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের সূচনা পাকিস্তান ফিল্ম সোসাইটি প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে।
এটি ১৯৬৩ সালে গঠিত হয়। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভের পর পাকিস্তান ফিল্ম সোসাইটির নামকরণ করা হয় ‘বাংলাদেশ চল’চ্চিত্র সংসদ’। আমাদের দেশে চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন বর্তমানে দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বার বার বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। ১৯৭৫ সালে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের সাথে সাথে চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের ওপর নেমে আসে নিয়ন্ত্রণের বেড়াজাল। ১৯৭৭ সালের মাঝামাঝি চলচ্চিত্র সংসদগুলোর কার্যক্রম সম্পর্কে সরকার খোঁজ-খবর নিতে শুরু করে। জাতীয় নিরাপত্তা দপ্তর এবং সামরিক নিরাপত্তা দপ্তর সংসদগুলোর কাগজপত্র পরীক্ষা করে ।
চলচ্চিত্র সংসদগুলোর বিরুদ্ধে সরকার বিদেশী সংস্থা থেকে বেআইনিভাবে আর্থিক লেনদেন এবং গোপন চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর অভিযোগ উত্থাপন করে। অপরদিকে সেন্সর নীতিমালার কড়াকড়ির জন্য বিদেশী দূতাবাসসমূহ বাংলাদেশে ছবি আনার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। শেষে চল’চ্চিত্র সংসদগুলোর ওপর আরোপিত হয় নিয়ন্ত্রণাদেশ। ১৯৮০ সালের ৯ জুলাই জাতীয় সংসদে চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি আইন পাস হয়। আইনটির শিরোনাম হচ্ছে ‘ফিল্ম রেজিস্ট্রেশন ও নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৮০’। এভাবে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র ও চলচ্চিত্র সংসদের দীর্ঘ পথচলার দ্বার উন্মোচিত হয় । বর্তমানে এ সংসদ সর্বজন পরিচিত ও স্বীকৃত একটি প্রতিষ্ঠান ।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের সাংবিধানিক স্বীকৃতি : গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে মত বা ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা ও চিন্তার স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে : ৩৯(১) চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল। ২ (ক) প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার এবং (খ) সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।
এখানে যে কোনো মাধ্যম এবং রাষ্ট্রীয় সীমানা নির্বিশেষে মত প্রকাশের অধিকারকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে । আর যে কোনো মাধ্যমের মধ্যে চল’চ্চিত্রও যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। চল’চ্চিত্র এমন একটি মাধ্যম, যা রাষ্ট্রীয় সীমানা ও সাংবিধানিক গণ্ডি অতিক্রম করে সমগ্র মানবজাতি জন্য বার্তা পৌঁছে দিতে পারে।
সাধারণ অর্থে কিন্তু হচ্ছে অভিব্যক্তির মাধ্যম এবং সে হিসেবেই ভারতীয় সংবিধানে এ মাধ্যমের পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। তৎসত্ত্বেও (সে দেশের সংবিধানের) ১৯ নম্বর ধারার ২ নম্বর সূত্রে এ অভিব্যক্তির স্বাধীনতাকে কিছু যুক্তিগ্রাহ্য আইনকানুনে সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে। এসব সাংবিধানিক নিয়মাবলীর ওপর ভিত্তি করে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশ ও ভারতে সিনেমা সংক্রান্ত আইন তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতের সংবিধানে যে যুক্তিগ্রাহ্য আইনকানুনে ভাব ও বাক প্রকাশের এবং চিন্তার স্বাধীনতা সীমিত করা হয়েছে তার প্রায় অনুরূপ চিত্র পাওয়া যায় জার্মানিতে। যে কোনো পেশা বা বৃত্তি গ্রহণের মাধ্যমে নিজের কিংবা অন্যের ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার বাংলাদেশের সংবিধানের ৪০ নম্বর অনুচ্ছেদে উল্লেখ রয়েছে। এতে বলা হয়েছে-
“আইনের দ্বারা আরোপিত বিধিনিষেধ সাপেক্ষে কোন পেশা বা বৃত্তি গ্রহণের কিংবা কারবার বা ব্যবসায় পরিচালনার জন্য আইনের দ্বারা কোন যোগ্যতা নির্ধারিত হইয়া থাকিলে অনুরূপ যোগ্যতাসম্পন্ন প্রত্যেক নাগরিকের যে কোন আইনসঙ্গত পেশা বা বৃত্তি গ্রহণের অধিকার রহিয়াছে।’
অতএব, কেউ চলচ্চিত্রকে তার পেশা বা বৃত্তি হিসেবে গ্রহণ করতে পারেন এবং এ বৃত্তির মাধ্যমে তিনি তার নিজের বা অন্যের ভাব প্রকাশ করতে পারেন। তবে সে সমাজের কোন শ্রেণীর ভাব প্রকাশ করে, সেটাই বিবেচ্য বিষয়। বিশ শতকের প্রথম দিকে চল’চ্চিত্র একটি শক্তিশালী গণমাধ্যম, স্বতন্ত্র শিল্প ও বিনোদন মাধ্যম হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার সময় থেকেই চলচ্চিত্রের অসাধারণ ও অভাবনীয় জনপ্রিয়তায় শাসকশ্রেণী হয়ে পড়ে ভীত ও বিচলিত। কারণ সাহিত্য, চিত্রকলা ও সঙ্গীতের চেয়ে চল’চ্চিত্রের সাথে দর্শকের যোগাযোগ অনেক বেশি প্রত্যক্ষ এবং দর্শকদের প্রভাবিত করার ক্ষমতাও এর প্রবল ।
বাংলাদেশে চলচ্চিত্র নিয়ন্ত্রণ আইন : বাংলাদেশে ১৯৮২ সালের ৫৮ নম্বর অধ্যাদেশটি চল’চ্চিত্র “সেন্সরশিপ অধ্যাদেশ-১৯৮২’ নামে অভিহিত। এটি মূলত পাকিস্তান আমলে প্রণীত চল’চ্চিত্র সেন্সরশিপ আইন, ১৯৬৩- এর অধিকতর সংশোধিত অধ্যাদেশ। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল মুজিবনগরে জারিকৃত আদেশ অনুযায়ী বাংলাদেশে ১৯৬৩ সালের চল’চ্চিত্র সেন্সরশিপ আইনটি মূলত চল’চ্চিত্র সেন্সরশিপ এবং সুনির্দিষ্ট কারণে চল’চ্চিত্রের ছাড়পত্র বাতিলের আইন।
এ আইনের ২(গ) ধারায় বলা হয়েছে, ছাড়পত্র প্রাপ্ত চল’চ্চিত্র অর্থ এমন একটি চলচ্চিত্র, যার ছাড়পত্র ৪ ধারার (২) উপধারার অধীনে প্রদর্শনের অনুমতি দেয়া হয়েছে। (২) উপধারায় বলা হয়েছে, কোনো চল’চ্চিত্র পরীক্ষার পর যদি কর্তৃপক্ষ মনে করে যে, সেটি প্রকাশ্যে প্রদর্শনের উপযোগী, তবে ঐ কর্তৃপক্ষ দরখাস্তকারী ব্যক্তিকে একটি ছাড়পত্র দেবে এবং সেখানে যেভাবে বর্ণিত হবে সেভাবে চলচ্চিত্রটি চিহ্নিত হবে।
বাংলাদেশে বলবৎ ১৯১৮ সালের চল’চ্চিত্র প্রদর্শন যন্ত্র আইনের ৫(২) ধারায় বলা হয়েছে, প্রতিটি অনুমতিপত্রের সাথে একটি শর্তযুক্ত থাকবে যে, অনুমতিপত্রধারী ব্যক্তি নির্ধারিত স্থানে ১৯৬৩ সালের ফিল্ম সেন্সরশিপ আইনের অধীনে গঠিত কর্তৃপক্ষ দ্বারা প্রকাশ্যে প্রদর্শনের যোগ্য বলে অনুমোদনপ্রাপ্ত কোনো চল’চ্চিত্র ছাড়া অন্য কোনো চল’চ্চিত্র প্রদর্শন করবে না এবং প্রদর্শনকালে ঐ কর্তৃপক্ষের বর্ণিত ছাড়পত্র পাওয়ার পর সেখানে কোনো পরিবর্তন বা বিকৃতি সাধন করা যাবে না।
১৯৬৩ সালের চলচ্চিত্র সেন্সরশিপ আইনের ৪ ধারার সংশোধন করে ১৯৮২ সালের চল’চ্চিত্র সেন্সরশিপ অধ্যাদেশে বলা হয়, কোনো ব্যক্তি প্রকাশ্যে প্রদর্শনের উপযোগী কোনো চল’চ্চিত্রের ছাড়পত্রের জন্য নির্ধারিত ফরমে দরখাসহ কর্তৃপক্ষের কাছে চলচ্চিত্র জমা দিতে পারবে; তবে শর্ত থাকে যে, কর্তৃপক্ষ দেশে তৈরি কাহিনীভিত্তিক কোনো চল’চ্চিত্রের মোট দৈর্ঘ্য চৌদ্দ হাজার ফুটের বেশি হলে সেটার প্রকাশ্যে প্রদর্শনের উপযোগিতা যাচাইয়ের জন্য গ্রহণ করবেন না যদি না চল’চ্চিত্র প্রযোজকের অনুরোধে সরকার কোনো বিশেষ কারণে উক্ত সীমা শিথিল করতে আগে থেকে সম্মত হয়।
একই অধ্যাদেশের ৬ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, যদি কেউ ছাড়পত্রহীন চল’চ্চিত্র অথবা কর্তৃপক্ষের প্রদত্ত চিহ্ন নেই এমন ছাড়পত্র পাওয়া চল’চ্চিত্র অথবা এ ধরনের চিহ্ন দেয়ার পর পরিবর্তন বা বিকৃত করা হয়েছে এমন চলচ্চিত্র প্রদর্শন করে অথবা এ আইনের অন্য কোনো বিধান বা এর অধীনে প্রণীত নিয়ম লঙ্ঘন করে তবে সে সর্বোচ্চ তিন বছর কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ দশ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে।
১৯৬৩ সালের চলচ্চিত্র সেন্সরশিপ আইনের মুখবন্ধে বলা হয়েছে, আইন-শৃঙ্খলার স্বার্থে অথবা স্থানীয় চল’চ্চিত্র শিল্পের স্বার্থে অথবা তার সাথে প্রসঙ্গত উত্থাপিত অথবা তার সাথে সংশ্লিষ্ট অথবা জাতীয় স্বার্থে প্রদর্শনের জন্য প্রণীত চলচ্চিত্র নির্বাচন এবং ছাড়পত্র প্রাপ্ত চলচ্চিত্রসমূহের ছাড়পত্র বাতিল করার উদ্দেশ্যেই এ আইন প্রণীত হয়েছে। আইনটি প্রণয়নের উদ্দেশ্য দুটি। প্রথমত, স্থানীয় চল’চ্চিত্র শিল্পের সংরক্ষণ এবং দ্বিতীয়ত, চলচ্চিত্র নির্বাচন বোর্ডের কাছে সরকারবিরোধী প্রতীয়মান হবে অথবা অন্য কোনো কারণে কর্তৃপক্ষ পছন্দ করবেন না এমন সব চল’চ্চিত্র প্রদর্শন বন্ধ করা।
কোনো চল’চ্চিত্র প্রদর্শনের ক্ষমতা দেয়া না দেয়ার ক্ষমতা কর্তৃপক্ষকে প্রদান করা হয়েছে এ আইনের চতুর্থ ধারায়। আর স্থানীয় এলাকার মধ্যে একটি ছাড়পত্র প্রাপ্ত চল’চ্চিত্র প্রদর্শিত হওয়া উচিত নয় বলে যদি একজন ম্যাজিস্ট্রেট মনে করেন, তাহলে তিনি উক্ত চলচ্চিত্রের প্রদর্শন স্থগিত করে দিতে পারবেন। এ ধরনের ব্যাপক ক্ষমতা তাকে দেয়া হয়েছে। জনস্বার্থে এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কারণে একটি ছাড়পত্র প্রাপ্ত ছবির ছাড়পত্র রদ করার ক্ষমতা এ আইনের সপ্তম ধারার মাধ্যমে সরকারের হাতে ন্যস্ত করা হয়েছে।
এ আইনের কারণে, কোনো চল’চ্চিত্র নির্মাতাই প্রত্যক্ষভাবে অথবা পরোক্ষভাবে সরকারের কোনো ব্যর্থতা অথবা অন্যায়ের সমালোচনা করে কোনো চল’চ্চিত্র তৈরি করতে পারবেন না। এ আইনের মাধ্যমে চল’চ্চিত্র নির্মাণের স্বাধীনতায় বাধ্যবাধকতা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। সরকারের পছন্দের সাথে খাপ খায় না এমন কোনো ছাড়পত্র নাও পেতে পারে এবং যদিও বা ছাড়পত্র পায় তারপরও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের দ্বারা তার প্রদর্শন স্থগিত হওয়ার ঝুঁকি থেকে যায় এবং পরিণামে ছবিটির ছাড়পত্র সরকারের দ্বারা প্রত্যাহৃত হতে পারে।
১৯৮৫ সালের ১৬ নভেম্বর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে একটি নোটিফিকেশন জারি করা হয়। এ নোটিফিকেশনে সাতটি শিরোনামের অধীনে সর্বমোট ৪৫টি নিষেধাজ্ঞা স্থান পেয়েছে। এ ৪৫টি নিষেধাজ্ঞায় যে কোনো একটি নির্মিত চলচ্চিত্রে ছাড়পত্র প্রদান করবে না। ‘Government Instructions for Examining and Certifying Films’ শীর্ষক এ গেজেট নোটিফিকেশনটি বহু অগণতান্ত্রিক ও কঠোর নিয়ন্ত্রণমূলক কলাকানুনে পরিপূর্ণ। মুক্তবুদ্ধি বা স্বাধীনতা কিংবা নাগরিক অধিকার ইত্যাদি কোনো কিছুরই তোয়াক্কা এখানে করা হয়নি।
আরেকটি লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হলো অধিকাংশ বিধানই এমন যার প্রয়োগ, প্রয়োগকারীর রাজনৈতিক আদর্শ, ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করে। অবশ্য সংবিধানের ৩৯ নম্বর অনুচ্ছেদের ভাষ্য নির্দেশ করে যে, সংশ্লিষ্ট কোনো প্রকার নিয়ন্ত্রণ চাপিয়ে দিতে পারে না এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা কোনোভাবে সীমিত করতে পারে না। অতএব কোনো নিয়ন্ত্রণ চাপাতে হলে কেবল এ উদ্দেশ্যেই সংসদে একটি আইন প্রণীত হতে হবে।…
চলচ্চিত্র ও সেন্সরশিপ : চলচ্চিত্রের শক্তিকে কেউই অস্বীকার করতে পারে না। কোনো দেশের রাষ্ট্রীয় সীমানা অতিক্রম করে একটি চল’চ্চিত্র অপর দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে প্রভাব বিস্তার এবং অনুকূল কিংবা প্রতিকূল জনমত গড়ে তুলতে পারে। সে হিসেবে চল’চ্চিত্র খুবই ক্ষমতাধর গণমাধ্যম। তাই এ মাধ্যমের ওপর প্রতিনিয়ত খবরদারি বা নজর রাখা দরকার- এ রকম একটি বোধ শাসক শ্রেণীর মধ্যে সবসময় কাজ করে।
চলচ্চিত্রের উপর এ খবরদারির নামই সেন্সরশিপ। সেন্সর প্রথা মানবসভ্যতার মতোই প্রাচীন। নাগরিকের আচরণ ও অভিমতের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়নি, মানব ইতিহাসে এমন সমাজব্যবস্থা প্রায় অস্তিত্বহীন। সেন্সরশিপ ব্যবস্থায় একটি দেশের সরকার কোনো কিছু প্রকাশের আগে তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখার অধিকার রাখে এবং প্রয়োজন মনে করলে তা থেকে আপত্তিকর অংশ বাদ দিতে পারে। Colombia Encyclopedia’ সেন্সরশিপ সংজ্ঞার্থ নির্ধারণ করেছে এভাবে-
‘সেন্সরশিপ হচ্ছে যে কোনো ধরনের রাজনৈতিক, সামাজিক অথবা নৈতিক আদর্শের ব্যাপারে দেয়া হুমকি, মতামত এবং বিশ্বাসের প্রতিবন্ধকতা বা নিষেধাজ্ঞা।’ সেন্সর সম্পর্কে আলেকজান্ডার বলেন, নৈতিকবিধি ও রাজনৈতিক ক্ষমতা পরিপন্থী কোনো রীতি, ধারণা, মত ও প্রত্যয় নিয়ন্ত্রণ সেন্সরের অন্তর্গত।’
বাংলাদেশের সেন্সর বোর্ড এবং এর ভূমিকা: দেশে সুস্থ চল’চ্চিত্র নির্মাণ বা তার পরিবেশ সৃষ্টির যে কোনো প্রচেষ্টা প্রতিহত করার সবচেয়ে বড় মন্ত্রণাদাতা ফিল্ম সেন্সর বোর্ড। আমাদের দেশের অধিকাংশ চিত্রনির্মাতা বস্তুনিষ্ঠ, রুচিশীল এবং সৎ চল’চ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে সেন্সর বোর্ডকে বড় বাধা বলে মনে করেন। এ কারণে সেন্সর বোর্ডের রুচি ও বিবেচনাবোধ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয় এমন ছবির সংখ্যা হাতে গোনা ।
বাংলাদেশে চলচ্চিত্র সেন্সর পুরোপুরি সরকার নিয়ন্ত্রিত এবং সরকারের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানেই এ বোর্ড পরিচালিত হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বোর্ড গঠন করা হয় যোগ্যতা বিচারে নয়, সরকারের পছন্দ ও ইচ্ছানুযায়ী। স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার মর্যাদা না থাকায় বোর্ডের কোনো স্বাধীনতা নেই। ফিল্ম সেন্সর বোর্ডে যারা নিযুক্ত হন নিজস্ব মতামত প্রকাশের কোনো সুযোগ তাদের নেই। ছবি বিচারে বোর্ডের সদস্যরা যে রায় দেন, তা প্রণীত হয় সরকারের ঘোষিত সেন্সরবিধির এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিজস্ব ব্যাখ্যার ভিত্তিতে; বিচক্ষণতা, সমাজ চেতনা এবং বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে নয়।
১৯৮২ সালে সেন্সর বোর্ড থেকে পদত্যাগ করে একজন সদস্য বোর্ডের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করে বলেছিলেন, বোর্ডের বেশিরভাগ সদস্যই ছবির যথার্থ বিচার নয় বরং বিশেষ স্বার্থানেষী মহলের নির্দেশে কোর্টরি স্বার্থ রক্ষায় উচ্চকণ্ঠ হয়। সেন্সর বোর্ডের উপেক্ষা এবং মুক্তচিন্তার এহেন অপমৃত্যু যে কোনো বিবেকবান ব্যক্তির জন্য লজ্জাকর ঘটনা বলে তিনি উল্লেখ করেন। একদিকে সরকারি আমলা এবং অন্যদিকে সরকার মনোনীত কিছু সুবিধাভোগী সদস্য এ প্রতিষ্ঠানে সংশ্লিষ্ট হয়ে একে বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র ফড়িয়াদের একচেটিয়াত্ব কায়েমে সহযোগিতা করে চলেছেন।
তাদের কাজ হলো প্রতি সপ্তাহে – মুক্তিলান্ত দেশী ও বিদেশী ছবিগুলোকে ছাড়পত্র প্রদান করা। তাদের আক্রোশযুক্ত শিল্পসম্মত এমন কোনো চল’চ্চিত্র নেই, যা সেন্সর বোর্ডের রোষানলে পড়েনি। ৬৯-এর গণঅভূত্থান নিয়ে নির্মিত জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’ থেকে শুরু করে সাম্প্রতিককালে নির্মিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘ধূসর যাত্রা’য় এর দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যায়। একদিকে এ সেন্সর বোর্ড সুস্থ চল’চ্চিত্র নির্মাণ ও তার প্রদর্শনে বাধার সৃষ্টি করছে, অন্যদিকে সুস্থ চলচ্চিত্র নির্মাণের পরিবেশ যাতে সৃষ্টি না হয়, তার ব্যবস্থা করে চলেছে।
বলতে দ্বিধা নেই যে, অলৌকিক কাহিনী, নকল গান, অশ্লীল যৌনতা, স্থূল আড়ামি এবং অকারণ ভায়োলেন্সসমৃদ্ধ জীবনবিমুখ অপসংস্কৃতির অন্যতম বাহন হচ্ছে আমাদের দেশের বর্তমান চল’চ্চিত্র। এ কুরুচিপূর্ণ অবাস্তব এবং অলৌকিক ছবির দৌরাত্ম্যে আমাদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি আজ ধ্বংসের পথে। আনন্দপিপাসু নিরীহ দর্শকদের ক্রমশ আফিমের মতো নেশা ধরিয়ে দিচ্ছে এ ছবিগুলো।
বাংলাদেশের বর্তমান সেন্সর নীতিমালা মুক্তবুদ্ধি চর্চার অন্তরায় হলেও তা এখনো প্রত্যক্ষভাবে ধরা পড়েনি। কারণ সেরকম ছবি নির্মিত হয়নি, যে ছবিকে মুক্তবুদ্ধি চর্চার নিদর্শন বলা যায়। সেন্সর বোর্ড প্রচলিত নীতিমালায় উদ্ভট, অশ্লীল, জাতীয় চেতনাবিরোধী ছবি নিষিদ্ধ করার বিধান থাকলেও সেন্সর বোর্ড অনেকাংশেই ব্যর্থ হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, অবাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে নির্মিত স্বল্পদৈর্ঘ্য ‘আগামী’ ছবিতে ‘হারামজাদা’ শব্দকে অশ্লীল বলে বাদ দেয়ার পরামর্শ দেয়া হয় অথচ টেলিভিশনে প্রদর্শিত ‘শহর থেকে দূরে’ ছবিতে অবলীলাক্রমে ‘হারামজাদী’, ‘মাগী’ প্রভৃতি শব্দ উচ্চারিত হয়। সেন্সর বোর্ডের প্রায়োগিক দিকের বার্থতাই এর মূল কারণ বলে বিবেচিত।
ভিডিও ছবি, চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন এবং সেন্সরবিধির অসারতা : বাংলাদেশে ভিডিও, চল’চ্চিত্র বর্তমানে একটি সাংস্কৃতিক রূপ নিয়েছে। এক কথায় বলা যায়, ভিডিও ক্যামেরায় চিত্রায়িত এবং ভিসিআর বা ভিসিপির মাধ্যমে পূর্ণ বা স্বল্পদৈর্ঘ্যের যে ছবি নির্মিত হয়, তাকে ভিডিও ছবি বলা হয়। স্বল্প বা পূর্ণদৈর্ঘ্যের কাহিনী চিত্রই কেবল নয়, একজন নির্মাতা ভিডিওতে বিভিন্ন বিষয়, যেমন- পরিবেশ, বিক্ষোভ, মিছিল, সভা, সন্ত্রাস, মানবাধিকার, জনসংখ্যা প্রভৃতি বিষয়ে ছবি নির্মাণ করতে পারেন। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও ভিডিওর মাধ্যমে প্রচলন ঘটে টেলিভিশনের । আকার, ওজোন এবং রঙিন ছবির ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন সাধিত হওয়ার পর ভিডিও ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করতে থাকে।
সাধারণ মানুষও এ প্রযুক্তির ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠে। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলো এ ব্যাপারে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছে। বাংলাদেশে নির্মিত চল’চ্চিত্রের ক্ষেত্রে সেন্সর ব্যবস্থা থাকলেও অবৈধভাবে চোরাপথে আমদানিকৃত ভিডিও ক্যাসেটের ক্ষেত্রে সেন্সরের কোনো ব্যবস্থা নেই। চল’চ্চিত্র প্রদর্শনের ব্যাপারে বাংলাদেশের সেন্সর বোর্ড দু মুখোনীতি প্রয়োগ করে আসছে- ভিডিওএর ব্যাপারে একরকম আর চলচ্চিত্রের ব্যাপারে অন্যরকম। এ দু মুখো টানাপোড়েনের ফলে এ দেশের সুস্থ চল’চ্চিত্রের বিকাশ প্রায় রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে।
চলচ্চিত্র সংসদ কলাকানুন প্রয়োগ হওয়ার পর চলচ্চিত্র সংসদগুলো বিদেশ থেকে সদস্যদের দেখানোর জন্য যেসব ছবি পেয়ে থাকে সেসব ছবির ওপর বোর্ড কড়া সেন্সর আরোপ করে। যেমন- সত্যজিৎ রায়ের ‘জন অরণ্য’, উপলেন্দু চক্রবর্তীর ‘চোখ’, কেতন মেহতার ‘হোলি’, ঋত্বিক ঘোটকের ‘যুক্তি তক্কো গপ্পো’র মতো ছবি সেন্সর বোর্ড এ দেশে প্রদর্শনের জন্য নিষিদ্ধ করে। অপরদিকে ভিডিও ক্লাবগুলোতে বোম্বাইয়ের তাবৎ কুরুচিপূর্ণ, মারদাঙ্গা অশ্রীল ছবি, বিদেশী ভয়ঙ্কর সব ভায়োলেন্সপূর্ণ কুংফু, ক্যারাতে ছবি কিংবা হংকং, থাইল্যান্ডের নির্মিত কুৎসিত এবং নিম্নমানের চল’চ্চিত্র, সফট এবং
হার্ডকোর মার্কিনি পর্ণোগ্রাফির ছবি ধরে থরে সাজানো থাকে এবং হলে নিয়মিত প্রদর্শিত হয়। এসব ছবির ওপর সেন্সর বোর্ডের নিয়ন্ত্রণ নেই। এসব ভিডিও প্রদর্শনীর ব্যাপারে অধ্যাবধি সরকারের পক্ষ থেকে কোনো নীতিমালা তৈরি হয়নি। মননশীল ছবি নির্মাণ না করে অনেকেই আবার ভিডিওর অপব্যবহার করছেন। কারণ ভিডিওতে নির্মিত ছবির সেন্সর হয় না। নির্মাতারা এ সুযোগে স্বেচ্ছাচারিতার আশ্রয় নেয়ার ফলে ভিডিও একটা দ্রোহমূলক কাজে পরিণত হয়েছে। সেন্সর ব্যবস্থাকে করে তুলেছে অর্থহীন ।
অশ্লীল ছবি নির্মাণের নেপথ্যে : সরকারি নিয়ন্ত্রণের অভাব, কার্যকারিতার অপ্রতুলতা, নৈতিক ও মানবিক অবক্ষয়ের কারণে অশ্লীল ছবি বাংলাদেশের জন্য হুমকিতে পরিণত হয়েছে। এর কারণ অন্বেষণে দুটি প্রধান বিষয় উদঘাটিত হয়েছে : ১. সমিতির সদস্যদের দৃঢ় হস্তক্ষেপ/পরিচালক সমিতির ব্যর্থতা, ২. সহিংস পোস্টার।
পরিচালক সমিতির ব্যর্থতা : দেশের চলচ্চিত্র পরিচালকরা এক সময় নির্মাণ করেছেন জীবন থেকে নেয়া, ক, খ, গ, ঘ, ও ধারাপাত, সূর্যদীঘল বাড়ী, বাদী থেকে বেগম, আলোর মিছিল, বেহুলা, নীল আকাশের নিচে’র মতো কালজয়ী ছবি। সেই দেশের পরিচালকদের প্রতিনিধি সংগঠন চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির অনেক সদস্যের বিরুদ্ধে এখন কুরুচিপূর্ণ, নোংরা ও অশ্লীল ছবি নির্মাণের অভিযোগ। এ অশ্লীল ছবি নির্মাতাদের বিরুদ্ধে কোনো রকম দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে পারেনি কেউ। চলচ্চিত্র বোদ্ধারা এজন্য পরিচালক সমিতির কার্যনির্বাহী পরিষদকে দায়ী করেছেন। চলচ্চিত্র বোদ্ধারা এর বিরুদ্ধে নানামুখী অবস্থান নিয়েছেন। কিন্তু ফল হয়েছে শূন্য। পরিচালক সমিতির কার্যনির্বাহীরা সার্বিক পদক্ষেপ নিতে পারলে আমাদের আজকের চলচ্চিত্র এ পর্যায়ে উপনীত হতো না ।
বাংলা ছবিতে আজ যে অশ্লীলতার বিস্তার, তা একদিনে হয়নি। প্রথমে শুরু হয় অশ্লীল সংলাপ ও সংলাপে ভাষার অমর্যাদাকর ব্যবহার। আর এজন্য কেউ কেউ দায়ী করেছেন কাজী হায়াৎকে। মন্দ ভাষা ও সংলাপ ব্যবহারের কারণে কাজী হায়াতের ‘ধর’ ছবিটি নিষিদ্ধ হয়েছিল। এছাড়া অভিযোগ আছে তার চাঁদাবাজ ছবিতে কবিতাকে তিনি যে দৃশ্যে দেখিয়েছেন, অনেকে বলেন সেটাও ছিল অশ্লীল দৃশ্য নির্মাণের প্রথম সূচনা।
অন্যদিকে শহিদুল ইসলাম খোকনের মতো কুশলী নির্মাতার বিরুদ্ধেও অভিযোগ আছে। ‘বীরপুরুষ’ ছবিতে, তিনি প্রথম বিকিনি পরা দৃশ্য দেখিয়েছেন। ‘ফায়ার’ এবং ‘নিষিদ্ধ নারী’ ছবিতে অশ্লীলতার মাত্রা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। এভাবে বাংলা চলচ্চিত্রে অশ্লীলতার অন্ধকার ছায়া অবলীলায় অন্ধকার যুগের সূচনা করে। বর্তমানে যেসব ছবি নির্মিত হচ্ছে তার অধিকাংশই সুস্থ ছবি নয়। পরিচালক সমিতির ব্যর্থতাই এর মূল কারণ বলে অভিজ্ঞ মহলের ধারণা।
অশ্রীলতা ও সহিংস পোস্টার পোস্টারের মাধ্যমে চলচ্চিত্রের স্বরূপ বোঝা যায়। অশ্লীল ও সহিংস পোষ্টার প্রদর্শনের কারণে যুবসমাজ নীতিনৈতিকতা বর্জন করে ধাবিত হয় অশ্লীল ছবির দিকে। এ অভ্যাসের ফলে এক সময় তারা নানা সামাজিক অপরাধে লিপ্ত হয়। সুস্থ চলচ্চিত্রের পোস্টারও সুস্থ থাকে, যা রুচিপূর্ণ। অপরদিকে অসুস্থ চল’চ্চিত্রে বিভিন্ন অংশের কুরুচিপূর্ণ ও সহিংস ছবি সম্বলিত পোষ্টার লাগানোর বিষয়টি Public Nuisance Act ছাড়া অপর কোনো আইন দ্বারা প্রতিরোধ করার ব্যবস্থা প্রচলিত নেই বললেই চলে।
অথচ বিষয়টি যে অতীব গুরুত্বপূর্ণ সে বিষয়ে কারও দ্বিমত নেই। কেননা, কুরুচিপূর্ণ অশ্লীল ছবি অস্থিরচিত্ত যুবক সম্প্রদায়কে নৈতিক অধঃপতনের দিকে ঠেলে দেয়। সংঘাতপূর্ণ, চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রমূলক, চলচ্চিত্র দেখে মানুষের অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যায়। আর মাত্রাতিরিক্ত চল’চ্চিত্র আকর্ষণ অর্থের ও সময়ের অপচয় ঘটায়।
চলচ্চিত্রের অশ্লীলতা দূরীকরণে গৃহীত পদক্ষেপ : বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকার, সংস্থা, ব্যক্তি বিশেষের কূপমণ্ডূকতা কিংবা সেন্সর বোর্ডের কোটারি স্বার্থ ও অদূরদর্শিতার কারণে বাংলাদেশের
চলচ্চিত্র তার কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশে সৃষ্টিশীল চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রয়াস তাই বাধার সম্মুখীন হয়েছে। ব্যক্তি বিশেষ ততক্ষণ স্বাধীন, যতক্ষণ তার অভিব্যক্তি প্রকাশের ক্ষমতা থাকে। চলচ্চিত্রের স্বাধীনতার প্রসঙ্গ তাই সামনে এসেছে বার বার। চল’চ্চিত্র বোদ্ধারা অভিমত প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশের চল’চ্চিত্র শিল্পকে এ ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষার জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপ নেয়া উচিত।
১. বিকল্প ধারার ছবি নির্মাণ;
২. ভিডিও পাইরেসি বন্ধ
৩. সেন্সরবিধির কার্যকারিতা;
৪. ভিডিও ছবি নির্মাণে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন;
৫. ছবির ভাষা ব্যবহারে পরিচালকদের সংযমী মনোভাব পোষণ;
৬. ভাবপ্রকাশে নৈতিকতা অবলম্বনে জনসচেতনতা বৃদ্ধি ইত্যাদি।
উপর্যুক্ত বিষয়গুলোর মধ্যে সেন্সরবিধির উপযোগিতা বৃদ্ধি ও বিকল্প ধারার ছবি নির্মাণ এ দুটি বিষয় চলচ্চিত্রে অশ্লীলতা দূরীকরণে সহায়ক ভূমিকা পালনে সক্ষম হবে।
সেন্সরবিধির উপযোগিতা বৃদ্ধি : চলচ্চিত্রে সমাজের প্রতিচ্ছবি প্রতিফলিত হয়। এ কারণে এ শিল্পের উপকারিতা ও অপকারিতা উভয় দিকই বিদ্যমান। কেননা এ মাধ্যমে দর্শকদেরকে গভীরভাবে প্রভাবিত করা যায়। সিনেমা ব্যবসায়ীদের অনেকেরই যেহেতু নন্দনতত্ত্ব বা জীবনের ভালোমন্দ সম্পর্কে মাথাব্যথা নেই, তাদের মুনাফার নেশারও যেহেতু লাগাম নেই, ভাই স্কুল প্রবৃত্তির সুড়সুড়ি দিয়ে এসব সিনেমা ব্যবসায়ীরা মানুষের রুচি নষ্ট করে। ফিল্মের সেন্সর ব্যবস্থা থাকা ভালো এবং তা সমাজের পক্ষে কল্যাণকর।
সেন্সরশিপের পক্ষে এরকম বাণী প্রায়ই শোনা যায়। কিছু বলার এবং আত্মপ্রকাশের স্বাধীনতা সংবিধানসম্মত। সংবিধানেই এ স্বাধীনতার সীমারেখা নির্দেশ করা হয়েছে। কিন্তু সমাজ ও দেশের ক্ষতিকর কোনো কাজ, যা মত প্রকাশের স্বাধীনতার পরিপন্থী। কিন্তু এটা উপলব্ধ সত্য যে, আজ আমাদের চল’চ্চিত্র সুদূর পরাহত। সেন্সর বিধির উপযোগিতা বৃদ্ধি পেলে এ ধরনের কুরুচিপূর্ণ ও অশ্লীল ছবি নির্মাণ বন্ধ হতে পারে।
বিকল্প ধারার ছবি নির্মাণ : বাংলাদেশের চল’চ্চিত্রের আকাশে অশনিসঙ্কেত এ শিল্পকে ধ্বংসের মুখে পতিত করেছে। এ অবস্থা নিরসনে চল’চ্চিত্রের নির্মাতা, পরিচালক, কলা-কুশলী ও অভিনেতা- অভিনেত্রী এবং বিভিন্ন চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনে নেমেছে। বিকল্প ধারার ছবি নির্মাণে তারা প্রশাসনের কাছে জোর দাবি করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। ইতোমধ্যেই বেশ কিছু বিকল্প ধারার ছবি ও স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি আমাদের দেশের দর্শকদের মুগ্ধ করেছে। শর্ট ফিল্ম নির্মাতারা আমাদের সমাজ ও মানবিক মূল্যবোধের ওপর ভিত্তি করে শর্ট ফিল্ম বা পূর্ণদৈর্ঘ্য ছায়াছবি নির্মাণ করেছেন, যা সর্ব মহলে প্রশংসা কুড়িয়েছে এবং সিনেমার দর্শকগণ তা সানন্দে গ্রহণ করেছে।
এছাড়া প্রখ্যাত লেখক, ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদ রচিত ও পরিচালিত ‘আগুনের পরশমণি’, ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’, ‘দুই দুয়ারী’, ‘চন্দ্রকথা’, অথবা মৌসুমী পরিচালিত ‘কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি অথবা তারেক মাসুদ এবং ক্যাথরিন মাসুদের ‘মাটির ময়না’, মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ‘ব্যাচেলর’ ইত্যাদি ছবি ব্যবসায়িকভাবে সফল এবং দেশ-বিদেশে সুনাম অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। অপরদিকে মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক,
সত্যজিত রায় প্রমুখ আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চলচ্চিত্রকারদের ছবি এবং আমাদের জহির রায়হান, আলমগীর কবির, কবীর আনোয়ার এবং সুভাষদত্ত ও আমজাদ হোসেন নির্মিত ছবি এখনো আমাদের চল’চ্চিত্রে আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে আছে। বিশিষ্ট চল’চ্চিত্রকার নিয়ামত উল্লাহর ‘সূর্যদীঘল বাড়ি বা ঋতিক ঘটকের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ আমাদের চল’চ্চিত্র অঙ্গনে মাইলফলক হিসেবে স্বীকৃত ।
আমাদের দেশে স্বল্পদৈর্ঘ্য চ’লচ্চিত্রের বিষয়বস্তু হয় মুক্তিযুদ্ধ, শিশুশ্রম, নারীর অধিকার বা মাদকাসক্তির সমস্যা অর্থাৎ সেসব বিষয় যা সমাজ ও রাজনীতি সচেতন। নির্মাণশৈলী এবং চল’চ্চিত্রের ভাষার সাবলীল প্রয়োগের দিকটি বিবেচনা করলে জহির রায়হান হচ্ছেন বাংলাদেশের চল’চ্চিত্র আন্দোলনের স্থপতি ও অগ্রদূত। ১৯৭১-এর মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় তার স্টপ জেনোসাইড’ হচ্ছে এ দেশের প্রথম সার্থক স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র।
মোরশেদুল ইসলাম পরিচালিত ‘আগামী’ হচ্ছে বাংলাদেশে মুক্তি পাওয়া প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি। ১৯৮৪ সালের জানুয়ারিতে ছবিটি সেন্সর সার্টিফিকেট লাভ করে ব্যাপক সাড়া পায়। বর্তমানেও বিকল্পধারার ছবি আমাদের সিনেমা দর্শকের মাঝে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। অশ্লীল ছবি দূরীকরণে ও দর্শকদের রুচিপূর্ণ ছবিতে আকর্ষণে বিকল্পধারার ছবি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
উপসংহার : সমাজ ও জাতিগঠনে সুস্থ চল’চ্চিত্রের ভূমিকা অনস্বীকার্য। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র বর্তমানে মৃত্যুপথের যাত্রী। এ অবস্থা থেকে চল’চ্চিত্রকে মুক্ত করতে হবে। এজন্য প্রয়োজন সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে চলচ্চিত্রের সাথে জড়িত ব্যক্তিবর্গের আন্তরিক প্রয়াস। এ প্রয়াসে বর্তমানে বিকল্পধারার চল’চ্চিত্র দশর্কদের মাঝে আশার প্রদীপ জ্বালিয়েছে। আশা করা হচ্ছে ভবিষ্যতে এ ধরনের আরও সুস্থ, সুন্দর, রুচিশীল চলচ্চিত্র নির্মিত হবে। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র যখন তার সীমাবদ্ধতা ছেড়ে ব্যাপক মর্যাদার অধিকারী হবে, চল’চ্চিত্র তখন হয়ে উঠবে সংস্কৃতির ধারক ও বাহক।
আরও দেখুন: