Site icon Bangla Gurukul [ বাংলা গুরুকুল ] GOLN

গ্রাম সরকার ও গ্রামীণ উন্নয়ন | সরকার ও প্রশাসন | বাংলা রচনা সম্ভার

গ্রাম সরকার ও গ্রামীণ উন্নয়ন | সরকার ও প্রশাসন | বাংলা রচনা সম্ভার , ভূমিকা : গ্রাম সরকার ব্যবস্থা বাংলাদেশের স্থানীয় শাসনের ক্ষেত্রে নতুন কোনো বিষয় নয় । স্বাধীনতাপরবর্তী সরকারগুলোর প্রায় সকলেই ভিন্ন ভিন্ন নামে এ ধরনের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রয়াস চালিয়েছে। এক্ষেত্রে অবশ্য প্রথম কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। তিনি গ্রামকে সকল প্রকার উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করার যে অব্যাহত প্রচেষ্টা গ্রহণ করেন তারই ধারাবাহিকতায় বর্তমান জোট সরকার এ ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করে।

গ্রাম সরকার ও গ্রামীণ উন্নয়ন | সরকার ও প্রশাসন | বাংলা রচনা সম্ভার

গ্রাম সরকার ও গ্রামীণ উন্নয়ন

অবশ্য গ্রাম সরকার ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে ইতিমধ্যেই নানা সমালোচনা শোনা যাচ্ছে। বিশেষ করে বর্তমান বিরোধী দল আওয়ামী লীগ এ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তাদের তীক্ষ্ণ সমালোচনা অব্যাহত রেখেছে। অবশ্য গ্রামীণ জনপদের অবহেলিত জনগোষ্ঠীকে যাবতীয় উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের অংশীদার করার জন্য এ জাতীয় প্রতিষ্ঠানের যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। এ ব্যবস্থা জনগণকে অধিক মাত্রায় উন্নয়নমূলক, রাজনেতিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে উন্নয়ন ও সুশাসনের প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।

 

গ্রাম সরকার ব্যবস্থার ইতিহাস : রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ১৯৭৬ সালে গ্রাম পর্যায়ে গ্রাম পরিষদ গঠনের ঘোষণা করেন। পরবর্তীতে ১৯৮০ সালে নাম পরিবর্তন করে ‘স্বনির্ভর গ্রাম- সরকার’ গঠনের লক্ষ্যে আইন পাস করা হয়। ১৯৮০ সালের ৩০ এপ্রিল সাভারের জিরাবো গ্রামে প্রথম গ্রাম সরকার গঠিত হয়। পর্যায়ক্রমে ৬৫ হাজার গ্রামে ‘গ্রাম সরকার’ গঠন করা হয়। এই গ্রাম’ সরকার গঠনের বিষয়টি বিভিন্ন মহলে সমালোচনার মুখোমুখি হয়। তাদের যুক্তি ছিল গ্রাম’ সরকার গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে গঠিত হয়নি। তাছাড়া এর কার্যপরিধিও সুনির্দিষ্ট ছিল না। ফলে যে উদ্দেশ্যে গ্রাম- সরকার গঠন করা হয়েছিল তা ব্যর্থ হয়।

এরপর ক্ষমতার পালাবদলে জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ক্ষমতায় এসে গ্রাম- সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেন। তিনি গ্রাম- সরকার বাতিল করলেও ১৯৮৯ সালে ‘পল্লী পরিষদ’ গঠনের সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৯০ সালে জেনারেল এরশাদের পতনের পর বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার পল্লী পরিষদ ও জেলা পরিষদ বাতিল করেন। ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এসে গ্রাম পরিষদ, গ্রাম- সরকার কোনোটিই প্রতিষ্ঠায় মনোযোগী হয়নি।

১৯৯৬ সালে তৎকালীন ক্ষমতাসীন সরকার একটি শক্তিশালী ‘স্থানীয় সরকার কমিশন’ গঠন করে। বিভিন্ন দেশের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা পর্যালোচনা ও বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা বিবেচনা করে কমিশন ১৯৯৭ সালের মে মাসে ‘স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান শক্তিশালীকরণ’ শিরোনামের প্রতিবেদনে চারস্তর বিশিষ্ট স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করে, যা ৪ সেপ্টেম্বর ১৯৯৭ জাতীয় সংসদে  ‘ইউনিয়ন পরিষদ সংশোধনী বিল’ ‘গ্রাম পরিষদ সংশোধনী বিল’ নামে পাস হয়।

এ আইনে ইউনিয়ন পরিষদের সংশোধনী আইনের মাধ্যমে প্রতি ইউনিয়নে তিনটি ওয়ার্ডের পরিবর্তে ৯টি ওয়ার্ড করা হয়। ১৯টি ওয়ার্ডে ৯ জন সদস্য এবং পুরনো ৩ ওয়ার্ডে ৩৫ জন মহিলা সদস্য নির্বাচিত হবেন প্রত্যক্ষ ভোটে। আর গ্রাম পরিষদ আইন অনুযায়ী প্রতি ওয়ার্ড থেকে নির্বাচিত ইউপি সদস্য সংশ্লিষ্ট গ্রাম পরিষদের চেয়ারম্যান হবেন।

উল্লেখ্য, গ্রাম পরিষদ আইন পাস করা সত্ত্বেও আওয়ামী সরকার গ্রাম পরিষদ গঠন করেনি। অবশেষে ২০০১ সালে চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতাসীন হয়। সরকার গ্রাম-বাংলার উন্নয়ন ও স্থানীয় প্রশাসনকে আরো তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত করার লক্ষ্যে এবং গ্রাম পরিষদ আইনের বাধ্যবাধকতা ও দলীয় অঙ্গীকার পূরণের লক্ষ্যে ‘গ্রাম সরকার’ গঠনের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

১৭ আগস্ট ২০০২ স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের এক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া গ্রাম সরকার। গঠনের গুরুত্বারোপ করে বক্তব্য রাখেন। তিনি অবিলম্বে গ্রাম সরকার বিলের খসড়া মন্ত্রিসভায় পেশ করার জন্য নির্দেশ দেন। উল্লেখ্য, ১২ আগস্ট ২০০২ স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের এক বৈঠকে গ্রাম সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। অতঃপর ২০০৩ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগের ওয়াক আউটের মধ্য দিয়ে ‘গ্রাম সরকার’ বিল পাস হয়।

গ্রাম সরকারের গঠন ও কাঠামো : ইউনিয়ন পরিষদের এক একটি ওয়ার্ডই হবে গ্রাম সরকার এলাকা। গ্রাম পরিষদে ১ জন চেয়ারম্যান, ১জন উপদেষ্টা, ১০ জন পুরুষ সদস্য ও ৩ জন মহিলা সদস্য রয়েছেন। ইউনিয়ন পরিষদের জন্য নির্বাচিত সদস্য তার সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের চেয়ারম্যান বিবেচিত হন। ওয়ার্ডের জনগণের সাধারণ সভায় সদস্যগণ নির্বাচিত হন। পরিষদ গঠনের তারিখ থেকে গ্রাম পরিষদের মেয়াদ ৫ বছর। এই আইনে প্রতিটি ইউনিয়নে ওয়ার্ড প্রতি একটি করে গ্রাম সরকার গঠনের বিধান রয়েছে। সে হিসেবে দেশে গ্রাম’ সরকারের সংখ্যা ৪০,৩৯২টি। ২০০৩ সালের ২ আগস্ট থেকে সারা দেশে গ্রাম সরকার গঠন শুরু হয়। পরবর্তী ৪৫ দিনের মধ্যে পর্যায়ক্রমে ৪০,৩৯২টি গ্রাম সরকার গঠিত হয়।

প্রত্যেক ওয়ার্ডে একটি করে গ্রাম সরকার গঠিত হয়। সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের নামের পর ওয়ার্ড নম্বরের সূচকে গ্রাম সরকারের নামকরণ হয়। এটি সংবিধানের ১৫২ (১) অনুচ্ছেদে সংজ্ঞায়িত প্রশাসনিক একাংশ হিসেবে গণ্য নয়, তবে ইউনিয়ন পরিষদের সহায়ক সংগঠন। একজন গ্রাম সরকার প্রধান, একজন উপদেষ্টা ও ১৩ জন সদস্য সমন্বয়ে ১৫ সদস্য বিশিষ্ট গ্রাম’ সরকার গঠিত। সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের জন্য ইউপি সদস্য গ্রাম সরকার প্রধান এবং ইউপি’র সংরক্ষিত আসনের মহিলা নির্বাচিত সদস্য সংশ্লিষ্ট গ্রাম’ সরকারের উপদেষ্টা।

একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি, তিনজন মহিলা সদস্য (একজন মহিলা ভিডিপি সদস্যসহ), একজন কৃষক সদস্য, দু’জন ভূমিহীন কৃষক, একজন ভিডিপি পুরুষ সদস্য, একজন সমবায় সমিতির সদস্য, একজন মুক্তিযোদ্ধা, একজন শিক্ষক, একজন ব্যবসায়ী, একজন চিকিৎসক/ পেশাজীবী প্রতিনিধি নিয়ে গ্রাম সরকার গঠিত। সমঝোতার ভিত্তিতে সদস্য মনোনীত হয়। এক বা একাধিক ক্ষেত্রের প্রতিনিধি পাওয়া না গেলে উক্ত স্থলে কৃষক প্রতিনিধি নেয়া হয়।

সদস্য মনোনয়ন : গ্রাম সরকারের সদস্য মনোনীত হবেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)-এর মাধ্যমে। তিনি বা তার প্রতিনিধি ভোটারদের সভা ডেকে সমঝোতার ভিত্তিতে সদস্য মনোনীত করবেন। তবে সমঝোতা না হলে ইউএনও’র সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে।

সভা: গ্রাম সরকারের দু’মাসে অন্তত একটি সভ্য এবং ৬ মাসে একবার সাধারণ সভা হবে। ওই সভায় চলমান উন্নন্দন কার্যক্রমের অগ্রগতি ও ভবিষ্যৎ উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হবে। সম্ভার সিদ্ধান্ত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের কাছে পাঠাতে হবে।

 

কার্যাবলী : গ্রাম সরকারের সার্বিক কার্যাবলী হচ্ছে গ্রাম বাংলার সার্বিক উন্নয়নে ভূমিকা পালন। এরা মধ্যে রয়েছে- 

১. গ্রামের রাস্তাঘাট, কালভার্ট ইত্যাদি উন্নয়নের জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পরিকল্পনা প্রণয়ন, চলমান প্রকল্পের অগ্রগতি ও আর্থিক বিষয়াদি পর্যালোচনা করা; 

২. নারী নির্যাতন, সন্ত্রাস, চুরি-ডাকাতি ইত্যাদি অপরাধ সংঘটিত হওয়ার বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তোলাসহ আইন-শৃঙ্খলা নিশ্চিত করা এবং ইউনিয়ন পরিষদে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন পেশ করা;

৩. নিরক্ষরতা দূরীকরণ কর্মসূচি তদারক, প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাদ্রাসা ও মকরের লেখাপড়ার খোঁজ- খবর রাখা এবং এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন ইউনিয়ন পরিষদে পেশ করা;

৪. প্রাথমিক বিদ্যালয়গামী শিশুদের বিদ্যালয়ে পাঠাতে অভিভাবকদের উদ্বুদ্ধকরণ, পুষ্টি, টিকাদান ও পরিবার-পরিকল্পনা কর্মসূচিতে সহায়তা প্রদান করা এবং মাঠ পর্যায়ের কর্মচারীদের কাজের ওপর ইউনিয়ন পরিষদে প্রতিবেদন পেশ করা;

৫. জন্ম-মৃত্যু, বিয়ে ও বিয়ে বিচ্ছেদ সম্পর্কিত খবর সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করে ইউনিয়ন পরিষদে প্রেরণ করা; 

৬. কৃষি উন্নয়নে সার, বীজ ও কীটনাশক সরবরাহ সম্পর্কে অবহিত থাকা এবং সংকট দেখা দিলে ইউনিয়ন পরিষদকে অবহিত করা;

৭. আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষকে সহায়তা করা এবং গ্রামে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে বিসম্বাদ নিষ্পত্তির চেষ্টা করা;

৮. ভিজিএফ ও বিজিটি কার্যক্রম তদারক করা;

৯. বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ ও স্বাস্থ্যসম্মত ল্যাট্রিন বাস্তবায়নে সহায়তা দেয়া; 

১০ ক্রীড়ার উন্নয়ন, সমবায় সমিতি গঠন, ক্ষুদ্র শিল্প ও খামার প্রতিষ্ঠা, বৃক্ষরোপণ ও পরিবেশ সংরক্ষণসহ সরকার নির্ধারিত অন্যান্য কাজ করা।

 গ্রাম সরকার ইউনিয়ন পরিষদের সহায়ক সংগঠন হিসেবে কাজ করবে। তবে স্থানীয় সরকার কাঠামোর কোনো প্রশাসনিক ইউনিট হিসেবে পরিগণিত হবে না। প্রয়োজনে গ্রাম সরকার সাব-কমিটি বা বিষয়ভিত্তিক কমিটি করতে পারবে।

গ্রামবাংলার আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে গ্রাম সরকারের ভূমিকা : গ্রাম সরকার দেশের গ্রামীণ জনপদের জনগণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অতীব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারবে। বিশেষ করে স্থানীয় সরকারের সহযোগী সর্বনিম্ন স্তরের সংগঠন হিসেবে এটি গণমানুষের সংগঠনে পরিণত হতে পারে। যেমন—

১. উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের বিকেন্দ্রীকরণ : আধুনিককালে প্রশাসনিক ও উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের বিকেন্দ্রীকরণ উন্নয়ন ও সুশাসনের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করা হয়। এক্ষেত্রে গ্রাম সরকার ব্যবস্থা বেশ ফলপ্রসূ হতে পারে। কেননা বাংলাদেশে স্থানীয় শাসন তথা বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে জনগণের কাছে উন্নয়ন ও সুশাসনের ফলাফল পৌঁছে দেয়া এবং তাদেরকে সরকারি কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রভূমিতে স্থান দিতে গ্রাম সরকার ব্যবস্থা অন্যতম মাধ্যম হিসেবে কাজ করতে পারে।

২. তৃণমূল পর্যায়ে জনগণের ক্ষমতায়ন : জনগণের উন্নয়ন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য গ্রামীণ দরিদ্র ও খেটে খাওয়া মানুষের ক্ষমতায়ন অত্যন্ত জরুরি। কেননা তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধি ছাড়া তাদেরকে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের যোগ্য অংশীদার করা যাবে না। অথচ আধুনিক উন্নয়ন ভাবনায় উন্নয়নে জনগণের অংশগ্রহণকে আবশ্যকীয় বিবেচনা করা হয়। এক্ষেত্রে গ্রাম সরকার ব্যবস্থা ইতিবাচক ফল দিতে পারে।

কেননা গ্রামের মানুষকে তাদের নিজেদের ভাগ্যোন্নয়নের ব্যাপারে নিজেদের চিন্তা করা, পন্থা উদ্ভাবন করা এবং পারস্পরিক সহযোগিতার ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে এ ধরনের একটি প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা নিঃসন্দেহে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। এক্ষেত্রে চিরাচরিত পন্থায় গড়ে ওঠা গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোর বাইরে গ্রামের বিভিন্ন পেশা ও শ্রেণীর মানুষের মাঝে ক্ষমতার পুনঃবণ্টনের পথ সূচিত হতে পারে। এতে আবহমানকাল থেকে লুকিয়ে থাকা গ্রামীণ সমাজের অফুরন্ত সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত হবে বলেও আমরা আশা করতে পারি।

৩. স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে সহায়তাকরণ : অনেকেই আবার ইউনিয়ন পরিষদের উপস্থিতিতে গ্রাম সরকারের মতো একটি প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। আসলে গ্রাম’ সরকার ইউনিয়ন পরিষনের বিকল্প নয় বরং ইউনিয়ন পরিষদকে আরো বেশি কার্যকর, এর কার্যক্রমের বিস্তৃতি ও অংশগ্রহণমূলক করার ক্ষেত্রে গ্রাম- সরকার ব্যবস্থা সহায়ক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করবে। আর এটা সম্ভব এজন্য যে, গ্রাম’ সরকারের প্রধান হবেন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের মেম্বার।

সুতরাং একদিকে সকল ওয়ার্ডের মেম্বার, অন্যকথায় সকল গ্রাম -সরকারের প্রধানদের সমন্বিত কর্মকাণ্ডই ইউনিয়ন পরিষদকে কর্মমুখর ও উন্নয়নমুখী করে তুলবে। এক্ষেত্রে গ্রাম- সরকার হওয়ার সুবিধা হলো, এতে অন্তর্ভুক্ত সদস্যরা ইউনিয়ন পরিষদের কাজকর্মে অংশগ্রহণের ক্ষেত্র, স্পৃহা ও পদ্ধতি খুঁজে পাবে এবং বিদ্যমান স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর গণসম্পৃক্ততা বৃদ্ধি পাবে।

৪. সুশাসন নিশ্চিতকরণ : গ্রাম ‘সরকারের যে কাঠামো, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য এবং কার্যাবলীর কথা বলা হয়েছে। তা দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে। কেননা স্থানীয় সরকারে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি এবং প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক জটিলতার বিপক্ষে এ ব্যবস্থা জনগণকে একটি অধিকতর ব্যাপক ও অংশগ্রহণমূলক এবং জীবনবান্ধব উন্নয়ন ধারার জন্ম দিতে পারে। জনগণের ঋণ, সাহায্য আর আইন ও বিচারসংক্রান্ত সুবিধা দানের ক্ষেত্রে গ্রাম’ সরকার গুরুত্বপূর্ণ ও অধিকতর স্বচ্ছ ভূমিকা পালন করতে পারে, যা হতে পারে গ্রামীণ সমাজ পরিবর্তনের অন্যতম অনুঘটক।

৫. গ্রামীণ কর্তৃত্বের শূন্যতা পূরণ : একটি বিষয় অবশ্যই আমাদের সমাজবিজ্ঞানী ও বিশ্লেষকদের দৃষ্টি হারায়নি। আর সেটি হলো বর্তমানে আমাদের গ্রামীণ সমাজে এক ধরনের কর্তৃত্বের শুনাতা বিরাজ করছে। আগে গ্রামীণ মাতাব্বর শ্রেণীর লোকেরা তাদের সামাজিক অবস্থান ও প্রতিপত্তির ভিত্তিতে যে কর্তৃত্বের অধিকারী ছিল তা এখন আর পূর্বের মতো বহাল নেই।

সামাজিক ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব কাঠামোর এ গুণগত পরিবর্তন গ্রামীণ বিচার-সালিশ ও গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আন্তঃসম্পর্ককে নানাভাবে প্রভাবিত করছে। এক্ষেত্রে ইতিবাচক দিক হলো গ্রামীণ সমাজে বিধিবদ্ধ কর্তৃত্বের বিকাশ ঘটছে, অন্যদিকে নেতিবাচক দিক হলো বিধিবদ্ধ কর্তৃপক্ষের কার্যকর উপস্থিতির অভাবে গ্রামীণ এ সকল সমস্যার দ্রুত সমাধান সম্ভব হচ্ছে না। সুতরাং গ্রাম- সরকার একটি বিধিবদ্ধ কর্তৃপক্ষ হিসেবে এ শূন্যতা পূরণে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারবে।

৫. অংশগ্রহণমূলক দৃষ্টিভঙ্গি ও নেতৃত্বের বিকাশ: গ্রাম সরকার ব্যবস্থা গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মাঝে অংশগ্রহণমূলক দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশ ঘটাবে এবং গ্রামীণ নেতৃত্বের বিকাশেও সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। কেননা গ্রাম’ সরকারের কার্যক্রমে অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়ে জনগণের নেতৃত্বের সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে যা সার্বিকভাবে দেশের রাজনৈতিক উন্নয়ন ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিকাশে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে।

সফলতার শর্ত : গ্রাম সরকার ব্যবস্থা নিয়ে বিশেষ করে সরকারি মহলে বিশেষ উচ্ছ্বাস লক্ষ্য করা গেলেও এ নিয়ে আশঙ্কারও যথেষ্ট কারণ রয়েছে। এ বিষয়ে চূড়ান্ত মন্তব্য করার সময় এখনো আসেনি । এখন আমরা যা করতে পারি তা কেবলই আশাবাদ। এক্ষেত্রে সামনের দিনগুলোতে সরকার এবং নীতিনির্ধারকদেরকে অনেক সতর্কতার সাথে পা ফেলতে হবে। কেননা গ্রাম- সরকার ব্যবস্থাকে সফল করে দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবে গড়ে তুলতে হলে নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখা জরুরি।

প্রথমত, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাকে বৃদ্ধি করতে হবে। স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন ও বিকেন্দ্রীকরণের নামে একের পর এক কেবল নতুন নতুন প্রতিষ্ঠানের জন্ম দিলেও সাধারণ মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন হবে না । বরং এ সকল প্রতিষ্ঠানকে সরকারি নিয়ন্ত্রণমুক্ত হয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা দিতে হবে।

দ্বিতীয়ত, গ্রাম সরকারের সফলতার জন্য এ প্রতিষ্ঠানকে পরিকল্পনা প্রণয়ন ও সমন্বয় সাধনের ক্ষেত্রে সফলতার পরিচয় দিতে হবে। বিশেষ করে গ্রাম সরকারের কার্যক্রম অনেকাংশেই ইউনিয়ন পরিষদের ওপর নির্ভরশীল। তাই ইউনিয়ন পরিষদের কার্যক্রমের সাথে সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে গ্রাম’ সরকারকে যথাযথ পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।

সেক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্ত গ্রাম- সরকারগুলোর পরিকল্পনার সমন্বয় সাধন ও বাস্তবায়নে ইউনিয়ন পরিষদকে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে হবে। বিশেষ করে অর্থনৈতিক সক্ষমতা অর্জনের বিষয়কে সবিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ প্রয়োজনীয় গ্রামীণ রাজস্ব আদায় ও যথাযথ ব্যবহারের ব্যর্থতাই আমাদের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর অবদমনের অন্যতম কারণ।

আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

তৃতীয়ত, আর্থিক স্বনির্ভরতা অর্জনের পাশাপাশি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে। কেবল অনির্বাচিত ব্যক্তিদের নিয়ে গ্রাম ‘সরকার গঠনে বিভিন্ন মহল থেকে যে আপত্তি উত্থাপিত হচ্ছে তা ঘোচাতে হলে এ জাতীয় সতর্কতা অতীব জরুরি। রাজনৈতিক স্বেচ্ছাচারিতা, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির মতো মহারোগে আক্রান্ত হয়ে পড়লে এ প্রতিষ্ঠান তার অস্তিত্ব হারাবে নিশ্চিত।

সর্বোপরি গ্রাম সরকার ব্যবস্থা সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করে তাদের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারলে এটি জনগণের মাঝে গ্রহণযোগ্যতা পাবে এবং বর্তমান সরকারের সূচিত উন্নয়নের ধারা সুনিশ্চিতভাবে আরো বেশি বেগবান হবে।

 

আরও দেখুন:

Exit mobile version