খাদ্যে ভেজাল ও বর্তমান অভিযান | সামাজিক সমস্যা ও বিষয়াবলী | বাংলা রচনা সম্ভার , ভূমিকা : মানুষের প্রধান মৌলিক চাহিদা হচ্ছে খাদ্য। বেঁচে থাকার জন্য যেমন খাদ্য দরকার তেমনি সুস্থ, সুন্দর, স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার জন্য ভেজালবিহীন খাদ্য অপরিহার্য। কারণ, ভেজাল খাদ্য মানুষের বিভিন্ন কঠিন রোগের জন্ম দেয়। দিনের পর দিন ভেজাল খাদ্য খেয়ে আমরা জটিল ও মারাত্মক সব রোগে আক্রান্ত হচ্ছি।
খাদ্যে ভেজাল ও বর্তমান অভিযান | সামাজিক সমস্যা ও বিষয়াবলী | বাংলা রচনা সম্ভার
খাদ্যে ভেজাল ও বর্তমান অভিযান
আমাদের আয়ু, কর্মশক্তি, দৈহিক ও মানসিক স্পৃহা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। আর ক্রেতা অধিকার সম্পর্কে আমাদের অজ্ঞতা, ভেজালবিরোধী আইন ও এর সুষ্ঠু প্রয়োগের অভাব এবং নৈতিকার অবক্ষয়ের কারণে খাদ্যে ভেজালের পরিমাণ দিন দিন বেড়েই চলছে। আমরা প্রতিদিন যা খাচ্ছি তার সিংহভাগই ভেজালে পরিপূর্ণ।
ভেজাল খাদ্য এবং ভেজালের কারণ: মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর এবং আইনত নিষিদ্ধ দ্রব্য খাদ্যদ্রব্যে ব্যবহার, মেয়াদোত্তীর্ণ দ্রব্য খাদ্যদ্রব্যে ব্যবহার করলে সে খাদ্যকে ভেজাল খাদ্য বলে থাকি । তাছাড়া কোনো খাদ্যদ্রব্যে যেসব উপাদান যে পরিমাণে থাকার কথা তা না থাকলে সে খাদ্যকেও আমরা ভেজাল বলি ।
ভেজাল খাদ্য বিরোধী আন্দোলনের অপর্যাপ্ততা, আইনের সঠিক প্রয়োগ, নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় এবং ক্রেতার অধিকার সম্পর্কে আমাদের অজ্ঞতা-ই মূলত ভেজাল খাদ্যের কারণ। আমাদের দেশে এখন টাকাই মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। কে, কিভাবে টাকা রোজগার করছে তা এখন কোনো বিষয় নয় । ফলে নৈতিকতা বিবর্জিত হয়ে আমরা কাজ করছি। তাছাড়া ভেজাল খাদ্য বিরোধী আইনের অপর্যাপ্ততা এবং এ আইনের প্রয়োগ না থাকায় খাদ্যে ভেজাল দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। দেরিতে হলেও নতুন আইন প্রণয়ন এবং তার প্রয়োগে বিষয়টি আলোচিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
ভেজালের পদ্ধতি: আমাদের দৈনন্দিন খাবারে কোন জিনিসটিতে ভেজাল নেই তা বের করা কঠিন অপরিহার্য ওয়াসার পানিতে আবর্জনা থাকে, মিনারেল ওয়াটার নামে সুন্দর সুন্দর বোতলজাত পানি কোনোরকম প্রক্রিয়া ছাড়াই বাজারে অবাধে বিক্রি হয়। তাছাড়া খাদ্যদ্রব্যকে আকর্ষণীয় করতে এবং বেশি লাভ করতে বিচিত্র সব পদ্ধতির আশ্রয় নেয়া হয়। নিচে কিছু খাদ্যদ্রব্য নিয়ে আলোচনা করা হলো :
শাকসবজি ও ফলমূল : আমরা প্রতিদিন যেসব শাকসবজি ও ফলমূল কিনে খাচ্ছি সেগুলো সতেজ রাখতে ও পাকাতে বিক্রেতারা ক্যালসিয়াম কার্বাইডসহ বিভিন্ন বিষাক্ত কেমিক্যাল ব্যবহার করছে। এসব কেমিক্যাল মিশ্রিত খাদ্যগ্রহণ করলে কিডনি ও লিভার নষ্ট হতে পারে, চোখের দৃষ্টিশক্তি হ্রাস ছাড়াও ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন খাদ্য বিশেষজ্ঞরা।
ভোজ্যতেল: মহাখালী জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের খাদ্য পরীক্ষাগার ও সিটি কর্পোরেশনের পরীক্ষাগারে পরীক্ষা করে দেখা গেছে, বাজারজাতকারীর পাওয়া ঘি ৯৩ ভাগ ভেজাল ও খাবারের অনুপযোগী; বাটার অয়েল ৯২ ভাগ ভেজাল, ডালডা ১০০ ভাগ ভেজাল, সয়াবিন ও সরিষার তেল ৯২ ভাগ ভেজাল এবং খাবারের অনুপযোগী। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব ভোজ্যতেল খেলে কিডনি, লিভারের ক্যান্সার হওয়া ও গর্ভস্থ শিশু প্রতিবন্ধী হওয়ার আশঙ্কা খুবই বেশি। নানা ধরনের পেটের রোগে আক্রান্ত হওয়ার পর যদি সেসব রোগ শরীরে থাকে, তবে কিডনি ও লিভার অকেজো হয়ে যাবে এবং আরো নানা জটিল ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা প্রবল ।
মাছ ও শুটকি : মাছের বাজারেও ভেজালের করাল গ্রাস অব্যাহত আছে। ছোট-বড় বিভিন্ন মাছকে সতেজ রাখতে ও সেগুলো সতেজ দেখানোর জন্য বিক্রেতারা ফরমালিন ব্যবহার করে, যা মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এছাড়া শুঁটকি মাছের সাথে অসাধু ব্যবসায়ীরা বিষাক্ত কীটনাশক ও ডিডিটি ব্যবহার করে, যা মানবদেহে ক্যান্সার, হৃদরোগসহ বিভিন্ন জটিল রোগ সৃষ্টি করে ।
আটা-ময়দা ও ডিম : পাউরুটি, বিস্কুট, নুডলসের আটা-ময়দা ৯৫ ভাগ ভেজাল, নিম্নমানের ও খাবার অনুপযোগী। ইদানীং ফার্মের সাদা ডিম লাল করার জন্য বিষাক্ত লাল রং ব্যবহৃত হচ্ছে। উপরোক্ত খাদ্য ও সাদা ডিমে কলকারখানার বিষাক্ত ডাই ও রং ব্যবহার করা হয় যা মানুষের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। বিশেষজ্ঞদের মতে এসব বিষাক্ত রং মিশ্রিত খাদ্যের জন্য দেশে ডায়াবেটিস ছাড়াও কিডনি ও লিভারসহ অন্যান্য অঙ্গে ক্যান্সার ও মারাত্মক রোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ডাল: বাজারের ডালের ৯৬ ভাগই ভেজাল, নিম্নমানের ও খাওয়ার অযোগ্য। এসবে বিষাক্ত রং ও ফাঙ্গাস থাকে। আমদানিকৃত নিম্নমানের মসুর ডালকে দেশি করার জন্য ‘নিউরোটক্সিন’ নামে যে কেমিক্যাল ব্যবহৃত হয় তা দেহে প্রবেশের পর স্নায়ুতন্ত্র ধ্বংস করে ফেলে। আর ‘মাইকোটক্সিন’ নামে যে কেমিক্যাল ব্যবহৃত হয় তা ক্যান্সারসহ জটিল রোগ সৃষ্টিতে সাহায্য করে। এছাড়া রং মেশানো ছোলা, মাষকলাইসহ অন্য ডালও বিভিন্ন মরণব্যাধি তৈরি করতে পারে।
গুঁড়া মশলা : বাজারের ৯৬ ভাগ গুঁড়া মশলা ভেজাল ও খাবারের অনুপযোগী । মরিচ, হলুদ, ধনে গুঁড়োর সাথে ব্যাপক হারে ব্যবহৃত হচ্ছে ইটের গুঁড়ো, বিষাক্ত সব রং। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এ ধরনের ভেজাল মশলা দিয়ে তৈরি খাবার খেলে কিডনি ও লিভার নষ্ট, ক্যান্সার ও হৃদরোগসহ যে কোনো ধরনের জটিল রোগ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। শিশু ও গর্ভবতী মায়ের জন্য এগুলো সবচেয়ে বিপজ্জনক বলে জানা গেছে।
আয়োডিন লবণ: বংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থার (বিসিক) হিসাব অনুযায়ী দেশে ২৭২টি কোম্পানি আয়োডিনযুক্ত লবণ উৎপাদন করছে । তবে এর মধ্যে গ্লোব, কনফিডেন্স, এসিআই, রূপায়ণ ও সুন্দরবন (খুলনা) সল্ট –এই ৫টি প্রতিষ্ঠান মূলত নিজস্ব কারখানায় আয়োডিনযুক্ত লবণ তৈরি করছে। পরীক্ষায় জানা গেছে, বাজারের লবণ কোম্পানিগুলোর ৯৫ ভাগের লবণেই আয়োডিন নেই। এর ফলে আয়োডিনের অভাবে গলগণ্ড, মানসিক প্রতিবন্ধিত্ব ও নানা জটিল রোগ সৃষ্টি হচ্ছে।
মিনারেল ওয়াটার, জুস ও জেলিঃ বিশেষজ্ঞদের পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে বাজারের মিনারেল ওয়াটার নামে প্রচলিত পানির ৯৬ ভাগই পানের অযোগ্য। এছাড়া বাজারজাতকৃত ৯৭ ভাগ জুসের মধ্যে ফলের রস বলতে কিছু নেই। বাজারের বেশির ভাগ জুস, সস ও জেলিতে যে বিষাক্ত রং মেশানো হয়, সেসব রং মিশ্রিত জুস, সস, জেলি খেলে কিডনি, লিভারের ক্যান্সার, পেটের পীড়াসহ যে কোনো জটিল রোগ হওয়ার সম্ভাবনা খুবই বেশি।
আইসক্রিম: বাজারজাতকারী আইসক্রিম কোম্পানির মধ্যে ৯৫ ভাগ কোম্পানির আইসক্রিম খাওয়ার অযোগ্য। যা খেলে কিডনি, লিভার ও পেটের পীড়া, ডায়রিয়া ও ক্যান্সারসহ জটিল সব রোগ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
মিষ্টির দোকান ও রেস্তোরা : রাস্তার পাশের জিলাপি দোকানের জিলাপিতে মবিল ও এক ধরনের রং মেশানো হয় এবং মিষ্টির দোকানগুলোতে মিষ্টি তৈরিতে বিষাক্ত দুধ, রং ও টিস্যু পেপার মেশানো হয়। এছাড়া রাস্তার পাশের ছোট ছোট দোকানগুলোর প্রায় সবগুলোতেই পিয়াজু, সিঙ্গাড়া, পরোটা, পুরিসহ তেলে ভাজা খাদ্যগুলো বহুবার ব্যবহৃত তেলে ভাজা হয়। এসব খাবার বিষে পরিণত হয়। এগুলো খেলে লিভার অকেজোসহ যে কোনো জটিল রোগ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে ।
চাইনিজ রেস্টুরেন্ট : বিশেষজ্ঞদের মতে ৯৬ ভাগ চাইনিজ রেস্টুরেন্টে খাবারের মান খুব খারাপ। এসব রেস্টুরেন্টে পঁচা মাংস, বিষাক্ত রং ও কেমিক্যাল ব্যবহৃত হয়। এগুলো খেলে সরাসরি কিডনি ও লিভার নষ্ট হতে পারে। এছাড়া ক্যান্সার, পেটের পীড়া, টাইফয়েড, ভাইরাল হেপাটাইটিস ও অন্যান্য জটিল রোগ হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল ।
ক্রেতা অধিকার ও বাংলাদেশ : পণ্য ক্রয়ের ক্ষেত্রে ক্রেতার বিশেষ কিছু অধিকার আছে। ক্রেতাদের সকল অধিকার আজ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। জাতিসংঘের নির্দেশ মোতাবেক সকল উন্নত দেশে ক্রেতাদের স্বার্থ সংরক্ষণের লক্ষ্যে ‘কনজুমারস ল’ নামেই বিবিধ আইন প্রণীত হয়েছে। তবে অনেক অনুন্নত দেশেই ক্রেতাদের অধিকার সংরক্ষণের আইনগত ব্যবস্থা এখনও প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
এসব দেশে ক্রেতা অধিকার সংরক্ষণের জন্য কঠোর আইন প্রণয়নের দাবিতে ক্রমান্বয়ে আন্দোলন গড়ে উঠছে। ক্রেতাদের অধিকার শুধু ন্যায্য মূল্যে সঠিক ও ভালো মানের পণ্য ক্রয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং বাস, ট্রেন অথবা বিমানে নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দ্যে ভ্রমণ করাও যে কোনো যাত্রীর মৌলিক অধিকার । অর্থের বিনিময়ে যে কোনো সময় ডাক্তারের নির্ভুল ও সঠিক প্রয়োজনীয় সেবা লাভও প্রতিটি রোগীর অধিকার । প্রকৃতপক্ষে প্রত্যেক ব্যক্তিই একজন ক্রেতা ।
১৯৮০ সালের এপ্রিল মাসে হল্যান্ডের হেগ নগরে অনুষ্ঠিত হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া, বেলজিয়াম প্রভৃতি দেশের ক্রেতা সংগঠনের উদ্যোক্তাদের এক সম্মেলন। এ সম্মেলনেই গঠিত হয় আন্তর্জাতিক ক্রেতা সংগঠন ‘ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন অব কনজুমারস ইউনিয়ন’ (আইওমিইউ)।

ক্রেতাদের অধিকার সর্বপ্রথম আমেরিকায় প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে জাতিসংঘ ধারায় ৭টি অধিকার স্বীকৃতি লাভ করে । জাতিসংঘ স্বীকৃত ৭টি অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আজ বিশ্বব্যাপী গড়ে উঠেছে ক্রেতা অধিকার আন্দোলন। জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত অধিকাংশ দেশেই আইনের মাধ্যমে এ অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ সাতটি অধিকার হলো-
১. নিরাপত্তার অধিকার : নিরাপত্তার অধিকার ক্রেতার একটি মৌলিক অধিকার। কোনো ক্ষতিকারক পণ্যের প্রতিক্রিয়া থেকে নিজেদের রক্ষা করার অধিকার প্রত্যেক ক্রেতারই রয়েছে। মানব স্বাস্থ্যের এবং জীবনের প্রতি হুমকি সৃষ্টি করে এমন কোনো পণ্য বিপণন করা যাবে না।
২. জানার অধিকার : বাজারে বিক্রীত পণ্যের গায়ে ব্যবহৃত উপাদানগুলো সম্পর্কে পর্যাপ্ত এবং সঠিক তথ্য থাকা, পণ্যের উৎপাদন তারিখ এবং ব্যবহার উপযোগী থাকার তারিখ পণ্যে উল্লেখ থাকতে হবে। এসব জানার অধিকার ক্রেতার আছে। এতে ক্রেতা বিভ্রান্ত এবং প্রতারিত হবে না।
৩. অভিযোগ ও প্রতিনিধিত্বের অধিকার: ক্রেতা তার স্বার্থ পরিপন্থি কোনো প্রবা সম্পর্কে উপর্যুক্ত কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করার অধিকার আছে। তাছাড়া যেসব সরকারি প্রতিষ্ঠান ক্রেতাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কাজ করে সেখানে ক্রেতাদের সঠিক প্রতিনিধিত্ব থাকবে। এতে ক্রেতার স্বার্থ সংরক্ষিত হবে।
৪. ন্যায্যমূল্যে পছন্দসই পণ্য কেনার অধিকার : প্রত্যেক ক্রেতারই অধিকার আছে ন্যায্যমূল্যে পছন্দানুসারে প্রয়োজনীয় পণ্য কেনার । এজন্য পণ্যের বৈচিত্র্যপূর্ণ প্রবাহ এবং পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজার থাকবে।
৫. ক্ষতিপূরণ পাওয়ার অধিকার : কোনো দ্রব্য ব্যবহারের ফলে ক্রেতা যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ পাওয়ার অধিকার ক্রেতার রয়েছে।
৬. ক্রেতার শিক্ষালাভের অধিকার : কোনো পণ্য কিভাবে ব্যবহার করতে হবে তা সম্পর্কে ক্রেতাকে সঠিক ধারণা দিতে হবে। এটা ক্রেতার অধিকার।
৭. স্বাস্থ্যকর পরিবেশের অধিকার : কোনো পণ্য ব্যবহারে ক্রেতার স্বাস্থ্যহানী যেন না হয় তার অধিকার ক্রেতার রয়েছে । পণ্যের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া থাকলে তা অবশ্যই ক্রেতাকে অবহিত করতে হবে।
বাংলাদেশে ক্রেতাদের যে অধিকার রয়েছে এ সম্পর্কেই ক্রেতাদের কোনো ধারণা নেই। তাছাড়া কোনো পণ্য সম্পর্কে অভিযোগ করেও অধিকাংশ সময় কোনো সুফল পাওয়া যায় না। কোনো পণ্য ব্যবহারের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত ক্রেতা যদি আইনের আশ্রয় নিতে যায় তবে সে তো ক্ষতিপূরণ পায়ই না বরং সে আরো ক্ষতির সম্মুখীন হয় ।
তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ক্রেতার অধিকারের ব্যাপারে সুফল আসছে। এর জন্য কাজ করছে কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)’ সম্প্রতি কনডেন্সড মিল্ক এবং জুসগুলোর বিরুদ্ধে তাদের অভিযোগ BST-এর কাছে করেছিল এবং ক্রেতাদের সচেতন করেছিল। কিন্তু খুব একটা লাভ হয়নি। কারণ আমাদের প্রশাসন কোম্পানিগুলোকে নিজেদের বলে মনে করে ।
সারা দেশের দিকে তাকালে আমরা ভয়াবহ চিত্র দেখতে পাই। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে শিয়ালের মাংস খাওয়ানো থেকে শুরু করে বিভিন্ন হোটেলগুলোতে মরা মুরগি অবাধে খাওয়ানো চলছে। এছাড়া রয়েছে বিভ্রান্তিকর ও প্রতারণামূলক বিজ্ঞাপনের ছড়াছড়ি। যেমন- নানাবিধ প্রচারণার আড়ালে গুড়ো দুধকে কখনো খাঁটি গরুর দুধ, আবার কখনো মায়ের দুধের সাথে তুলনা করা হচ্ছে। যদিও বলার অপেক্ষা রাখে না যে মায়ের দুধের সাথে কোনো দুধের তুলনা করা যায় না।
তাছাড়া বিভিন্ন কোনো কোম্পানিগুলো নানা উপায়ে উচ্চহারে কলচার্জ নিচ্ছে। চিকিৎসা নিতে গিয়ে আমরা হচ্ছি প্রতারিত। ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে এক্সপার্ট এবং যন্ত্রপাতি ছাড়াই কঠিন রোগ নির্ণয় চলছে। অনেক চিকিৎসক ১০০% গ্যারান্টিসহ এইডস, ক্যান্সার, বহুমূত্রের মতো দুরারোগ্য রোগের নিরাময়ের বিজ্ঞাপন দিচ্ছে। আবার দেশের অধিকাংশ জায়গাতেই মেট্রিক পদ্ধতিতে পণ্য বিক্রয় হয় না। কখনো ইট, পাথর, কাঠের টুকরা ইত্যাদি রা ওজনের মাধ্যমে পণ্য বিক্রি চলছে।
এতে ক্রেতারা প্রতারিত হচ্ছে। এ সবকিছু অবাধে চলছে ক্রেতাদের অজ্ঞতা, সংঘবদ্ধ হওয়ার অভাব, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দুর্নীতির ফলে। তাই ক্রেতাদের সচেতন হতে হবে অধিকার সম্পর্কে এবং অধিকার আদায়ে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। যদিও ১৯৭৮ সালে দেশের শিক্ষক, চিকিৎসক, সুশীল সমাজের কিছু মানুষ মিলে কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) নামে ক্রেতাদের অধিকার আদায়ের সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু উন্নত দেশগুলোর ক্রেতারা যেসব সুবিধা ভোগ করতে পারে, ক্ষতিপূরণ পেতে পারে তা আমাদের দেশের ক্রেতাদের কাছে স্বপ্ন।
ভেজাল রোধে আইন : ‘পূর্ব পাকিস্তান বিশুদ্ধ খাদ্য সামগ্রী অধ্যাদেশ নামে ১৯৫৯ সালের ৪ অক্টোবর তৎকালীন প্রাদেশিক গভর্নর একটি অধ্যাদেশ জারি করেন। খাদ্যদ্রব্যের বিপণনে ভেজাল নিরোধ এবং মনুষ্যভোগ্য খাদ্যসামগ্রীর উৎপাদন ও বিক্রয়ের উন্নতকরণ এবং নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে প্রণীত এ আইন বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ‘বাংলাদেশ বিশুদ্ধ খাদ্যসামগ্রী অধ্যাদেশ নামে বলবৎ থাকে।
এ আইনে কতিপয় খাদ্যসামগ্রীর উৎপাদন বিক্রয়, বিশ্লেষণ, পরিদর্শন ও বাজেয়াপ্তকরণ সম্পর্কিত বিধান রয়েছে। এ আইনে আইন লংঘনকারীকে প্রথমবার অপরাধের জন্য ১০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১০০০ টাকা পর্যন্ত জরিমানা এবং ৬ সপ্তাহ থেকে ১ বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ড; দ্বিতীয়বার অপরাধের জন্য ন্যূনপক্ষে ১০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৪০০০ টাকা পর্যন্ত জরিমানা এবং ও মাস থেকে ১ বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।
সম্প্রতি বাংলাদেশে ‘বিশুদ্ধ খাদ্য বিল ২০০৫’ নামে একটি আইন করা হয়েছে। এ আইনে সর্বোচ্চ লক্ষ টাকা জরিমানা এবং সর্বোচ্চ ৩ বছর সশ্রম কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
বিএসটিআই : বিভিন্ন ধরনের পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স প্রদান, মান নিয়ন্ত্রণ এবং ভেজাল খাদ্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে থাকে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই)। শিল্প, খাদ্য ও রাসায়নিক পণ্যের মান নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণ বিএসটিআই-এর প্রধান কাজ।
তাছাড়া দেশব্যাপী সরকার নির্ধারিত ওজন পরিমাপের বিষয়টিও তারা প্রয়োগ করে। ৬টি বিভাগীয় শহরে ৬টি আঞ্চলিক কার্যালয় এবং ঢাকাস্থ সদর দপ্তর দ্বারা বিএসটিআই কার্য পরিচালনা করে। বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস ইনস্টিটিউশন (বিডিএসআই) ও সেন্ট্রাল টেস্টিং ল্যাবরেটরিজ (সিটিএল) একত্রিত হয়ে ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিএসটিআই পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ, অনুমোদন এবং ভেজালরোধে কাজ করে যাচ্ছে।
খাদ্যে ভেজাল রোধে বর্তমান অভিযান : সরকার ভেজাল খাদ্য নিয়ন্ত্রণে যে ভ্রাম্যমাণ আদালতের ব্যবস্থা করেছে তা সব মহলে দারুণ প্রশংসিত হয়েছে। এ ধরনের সরকারি তৎপরতা আরো আগে থেকেই প্রয়োজন ছিল। মোবাইল কোর্ট বর্তমানে সে প্রয়োজনীয়তা পূরণ করার চেষ্টা করছে।
১১ জুলাই ২০০৫ বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো ভেজাল ও অস্বাস্থ্যকর খাবার তৈরির জন্য হোটেল মালিককে সাজা প্রদান ও জরিমানা করা হয়। এদিন রাজধানীর খ্রিস্টার হোটেল ‘সুন্দরবন’-এর রান্না কক্ষে অভিযান চালিয়ে মালিককে ৯৭ হাজার ৪০০ টাকা জরিমানা এবং অনাদায়ে দু’বছর এক মাস কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। এভাবে বনফুল মিষ্টি দোকান, পোলার আইসক্রিম, সেভয় আইসক্রিম, অ্যাংকর ট্রেডিং কোং, কোয়ালিটি আইসক্রিমসহ অনেক নামী-দামি কোম্পানির পণ্যে ভেজাল ধরে জরিমানা এবং কারাদণ্ড প্রদান করে।
আমাদের দেশে সাধারণত ঈদের সময় এ সব তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়। ঈদের পর আবার যে যার মতো করে অবাধে ব্যবসায় চালিয়ে যায়। এবার ভেজাল বিরোধী অভিযানে এ সম্পর্কিত আইনের দুর্বলতা ধরা পড়ার পর নতুন আইন করতে হয়েছে। আশা করা যায়, এবার সরকারের সদিচ্ছা এবং আইন প্রয়োগকারীদের সততা অটুট থাকলে ভেজালের পরিমাণ কমবে।
পরিশেষ : বাংলাদেশ অনেক কষ্ট, ত্যাগ এবং আবেগের নাম। একটি সুখী, সৃমদ্ধশালী জাতি হিসেবে দাঁড়াতে হলে দেশের মানুষকে কর্মঠ এবং সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হতে হবে। আর খাবার অপরিহার্য বিধায় তো খাঁটি হওয়া জরুরি। তাছাড়া ভেজাল, ওজনে কম দেয়ার প্রবণতা যদি আমাদের অটুট থাকে এবং ক্রেতা অধিকার যদি পূরণ না করা হয় তাহলে রপ্তানির ক্ষেত্রে আমাদের সমস্যায় পড়তে হবে। আমাদের নিজেদের স্বার্থেই নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
ক্রেতাদের যদি তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করা যায় এবং সংঘবদ্ধ করা যায় তাহলে উৎপাদনকারীরা বাধ্য হবে মান নিয়ন্ত্রণে। এজন্য ‘বাংলাদেশ কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন,’ ‘ক্রেতা স্বার্থ সংরক্ষণ সমিতি’ ও ‘সবার জন্য স্বা- এর মতো প্রতিষ্ঠান কাজ করে যাচ্ছে। ক্রেতাদের মধ্যে জাগরণ সৃষ্টি করতে না পারলে ক্রেতার অধিকার প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। তাছাড়া সরকারি সদিচ্ছা এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকেও নিষ্ঠার সাথে কর্তব্য পালন করতে হবে। কারণ, তারাও ক্রেতা।
আরও দেখুন: