ক্রীতদাসের হাসি – শওকত ওসমান [ বই রিভিউ ]

“বুকরিভিউ [Book Review]” সিরিজের ২২তম পর্বে আলোচনা করা হয়েছে শওকত ওসমানের প্রখ্যাত উপন্যাস ক্রীতদাসের হাসি। আমাদের এই ভিডিওতে বইটির সারসংক্ষেপ, সাহিত্যিক গুরুত্ব ও সামাজিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করা হয়েছে। উপন্যাসটি নিপীড়িত মানুষের হাসির মধ্য দিয়ে প্রতিবাদের শক্তি তুলে ধরে, যেখানে শোষণ, স্বৈরতন্ত্র ও সামাজিক বৈষম্যের বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকে মানবিকতা ও বিবেক। শওকত ওসমানের গভীর জীবনবোধ ও ভাষার সৌকর্য বইটিকে চিরকালীন পাঠযোগ্য করে তুলেছে। আমাদের সিরিজে এই বইয়ের রিভিউটি পাঠকদের নতুনভাবে ভাবতে সহায়তা করবে।

 

ক্রীতদাসের হাসি

 

‘ক্রীতদাসের হাসি’ কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমান রচিত উপন্যাস। ১৯৬২ সালে রচিত উপন্যাসটি প্রথম ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত হয়। পরবর্তীকালে ২০১৫ সালে সময় প্রকাশন কর্তৃক প্রকাশিত হয়।

১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খানের সামরিক শাসন পাকিস্তানকে বর্বর স্বৈরশাসনের জাঁতাকলে আবদ্ধ করল। এ সময় সব ধরনের বাকস্বাধীনতা হরণ করা হয়েছিল। তৎকালীন পাকিস্তানের স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের শাসন ব্যবস্থাকে ব্যঙ্গ করে এ উপন্যাস রচিত হয়। এ উপন্যাসের মূল চরিত্র তাতারী। গণতান্ত্রিক চেতনাকে ভয় পায় স্বৈরাচারী শাসক। এই চেতনাকে দমন করার জন্যই আবার নেমে আসে সামরিক শাসন তবুও লেখকের প্রতিবাদ স্তব্ধ থাকেনি। রূপকের মধ্য দিয়ে তীব্র হয়ে উঠেছে এই প্রতিবাদ। প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছে শওকত ওসমানের ‘ক্রীতদাসের হাসি’র তাতারী।

 

ক্রীতদাসের হাসি - শওকত ওসমান

 

উপন্যাসের কাহিনি শুরু হয়েছে হাবসী গোলাম তাতারী আর বাদী মেহেরজানের প্রেমময় হৃদয় উৎসারিত হাস্যকলরোল মধ্য দিয়ে। রাজমহলের অদূরে স্ত্রীর সঙ্গে ক্রীতদাস ‘তাতারীর’ উদ্দাম সুখ-হাসি চঞ্চল করে তোলে সম্রাট হারুনকে। অধরা সেই হাসিকে বারবার শুনতে এবং নিজের করে নিতে ক্রীতদাস তাতারীকে নিজের ধন-সম্পদের প্রাচুর্য বলয়ে বন্দি করেন সম্রাট। দ্বন্দ্ব-বিক্ষুব্ধ বাদশাহ হারুনর রশীদ হাবশী গোলাম তাতারীর হাসি শুনে ভয়ানক ঈর্ষান্বিত হন।

পৃথিবী শুধু তার জন্য যার ক্ষমতা আছে। এখানে যে কেউ চাইলেই সুখে থাকতে পারে না, হাসতে পারে না, অধিকার নেই। হাসবে শুধু তারাই, যাদের ক্ষমতা আছে, বিত্ত-ভৈবব আছে। ইচ্ছামতো ভালো থাকার অধিকার, সুখে থাকার অধিকারও তাদের। শওকত ওসমানের ‘ক্রীতদাসের হাসি’ উপন্যাসটি আমার এই কথাগুলোর ভিত্তি প্রস্তর দাঁড় করিয়েছে। বোঝার সুবিধার্থে উপন্যাসের কিছু ঘটনা সংক্ষেপে তুলে ধরছি।

বাগদাদের অধিপতি হারুনর রশীদের মুখে আবেগ-চাঞ্চল্যের ছাপ। বড় একা লাগছে। সুসজ্জ্বিত মহল ‘কাওসুল আকদারে’ সবকিছুই আছে কিন্তু কেমন এক শূন্যতা ঘিরে আছে তার পুরো পৃথিবী জুড়ে। ভুলবশতঃ প্রিয় উজির আজম জাফর বামের্কীর কতল পরোয়ানা দিয়েছিলেন। নিজের করা ভুলে অনুশোচনায় ভুগছেন। মনের অশান্তি থেকে একটু পরিত্রান পেতে একান্ত সেনাপতি মশরুরের পরামর্শে বাগানে হাঁটতে বের হলেন। পুরানো স্মৃতি আওড়াতে লাগলেন বারবার। হঠাৎ তিনি লক্ষ্য করলেন তার মহলের অদূরেই সুখের হাসি হাসছে কেউ। অস্পষ্ট তবে মোহনীয়, যুগযুগান্তের উৎসবের বার্তাও বয়ে আসে সেই হাসির তরঙ্গে।

বাদশাহের অশান্ত মন আরো বেশী অশান্ত হয়ে উঠে। বাগদাদ অধীশ্বর হয়েও তিনি যে শান্তির গরীবানা হালে আছেন তা তো এই কথাগুলোতেই ফুটে উঠেছে- “মশরুর। শুনেছো এমন হাসি? এতরাতে কে হাসছে আমার মহলের দেওয়ালের ওদিকে? এ হাসি ঠোঁট থেকে উৎসারিত হয়না। এর উৎস সুখ-ডগমগ হৃদয়ের নিভৃত প্রদেশ। ঝর্ণা যেমন নির্জন পাহাড়ের উৎসঙ্গ-দেশ থেকে বেরিয়ে আসে উপলবিনুনী পাশে ঠেলে ঠেলে-বিজন পথ-ভ্রষ্ট তৃষ্ণার্ত পথিককে সঙ্গীতে আমন্ত্রণ দিতে-এই হাসি তেমনই বক্ষঝর্ণা-উৎসারিত। কিন্তু কে এই সুখীজন- আমার হিংসা হয়, মশরুর। আমি বাগদাদ অধীশ্বর সুখ ভিক্ষুক। সে তো আমার তুলনায় আরোও বড় ভিক্ষুক, তবু সুখের অধীশ্বর! কে, সে?

যখন জানা গেল এ হাসি তারই গোলামের তখন তিনি অবাক না হয়ে পারলেন না। গোলামেরা এমন হাসি হাসতে পারে তা তিনি কল্পনাও করতে পারেননি। জোর যার মুল্লুক তার সূত্রে হারুনর রশীদের মুল্লুক আছে ঠিকই কিন্তু হাসি নেই। গোলামের মুল্লুক নেই তবে সুখের সমৃদ্ধি আছে, হৃদয়ের কোঠরে হাসি আছে। আর কি চাই?

হাবসী গোলাম তাতারীর সাথে বাদশাহের সহধর্মিণী জুবায়দার একান্ত বাঁদী আরমেনী তরুণী মেহেরজানের গোপন বিয়ে হয়েছিল। এই বিয়ের দায়িত্ব পালন করেন স্বয়ং বাদশাহের সহধর্মিণী। মেহেরজান খুবই রুপবতী, আকর্ষণীয়া যৌবনবতী এক নারী। বেগম জুবায়দা মেহেরজানকে খুব ভালোবাসতেন, হাসি-তামাশা করতেন তার সঙ্গে। বেগম জুবায়দার উৎসাহে প্রতিরাতেই তাতারীর সাথে গোপন অভিসারে যেত মেহেরজান, সুখে-শান্তিতে কাটতে থাকে এই দুই প্রেমিকযুগলের। তাদের সুখী জীবনের বার্তাই গভীর রাতের নিঃস্তব্ধতাকে ম্লাণ করে দিয়ে হাসি হয়ে ভেসে বেড়ায় দূর থেকে দূরে।

ঘটনাক্রমে গোলামের সুখের রহস্য জানতে পারলেন বাদশাহ। পরিকল্পনামতো একরাতে হাজির হলেন তাতারীর শয়নকক্ষে, একসাথে পেয়ে গেলেন মেহেরজানকেও। অতুলনীয় রুপবতী, যৌবনা মেহেরজানকে দেখলে যেকেউ ভালোবেসে ফেলবে। বাদশাহও মুগ্ধ হলেন এই অপরুপ লাবণ্যময়ীকে দেখে। ভীত-সন্ত্রস্ত তাতারী ও মেহেরজানকে বাদশাহ অভয় জানালেন এবং তাদেরকে তখনই আজাদ ঘোষণা করলেন। শাস্তির বদলে অভাবনীয় পুরস্কারে দু’জনই অবাক হলো।

বাদশাহ জানালেন তাদের হাসিই তাদেরকে বাঁচিয়ে দিয়েছে এবং হাসিতে মুগ্ধ হয়েই এই এনাম তাদেরকে দেয়া হয়েছে। তাতারীকে একটি রাজ্যের রাজত্ব ঘোষণা করা হলো। রাতের দিপ্রহরে যে তাতারী ফকির ছিল ত্রিপ্রহরে এসে সে আমির হয়ে গেল। হাসির এত শক্তি, এত দাম! তাতারীকে তখনই তার জন্য মনোনীত রাজ্যে পাঠিয়ে দেয়া হলো, এবং বলে দেয়া হলো অতিশীঘ্রই তার হাসি শুনতে যাবেন বাদশাহ। মেহেরজানকে বেগম জুবায়দার কাছে ফিরে যেতে বলা হলো।

উপন্যাসের এই পর্যায়থেকে ঘটনা ভিন্নরুপ নিতে শুরু করে। তাতারী তার নতুন রাজ্যে বাস করা শুরু করলো কিন্তু তার সুখের পৃথিবীর দরজা ততক্ষণে বন্ধ হয়ে গেছে। তাতারীর সুখের ঠিকানা ছিল মেহেরজান। সারাদিনের ক্লান্তির পরে মেহেরজানকে কাছে পেয়ে সব কষ্ট ভুলে যেতে পারতো, মন খুলে হাসতে পারতো। কিন্তু এখন!

গোলামী জীবনে মেহেরজান ছিল, সুখের একটা ঠিকানা ছিল সেথায়। হৃদয়জুড়ে দুঃচিন্তার কালো মেঘ জড়ো হতে থাকে তাতারীর। অনিশ্চয়তার কালো ছায়া তাকে আচ্ছন্ন করে ক্রমশঃ। হাসতে ভুলে যায় তাতারী। বাদশাহ তাতারীর মনে শান্তি এনে দিতে বাগদাদের সবচেয়ে আকর্ষণীয় এবং সুন্দরী চিরযৌবনা তরুণীকে পাঠালেও তাতারী সেই রমণীকে ফিরিয়ে দেয়। তাতারীর নৈতিকতার জোর দেখে লজ্জায় পড়ে যায় সেই সুন্দরী এবং পড়ে সে অকল্পনীয়ভাবে আত্মহত্যা করে। রাজ্য-রাজত্ব, ভোগ-বিলাস কোন কিছুই চাইনা তাতারীর। কোনো কিছুতেই যে লোভ নেই চরিত্রবান হাবসী গোলাম তাতারীর। বাদশাহ অসন্তুষ্ট হয়ে যান এই যুবকের উপর। ঈর্ষান্বিত হন তাতারীর পবিত্র আত্মার জ্যোতি দেখে, তার প্রশংসা বিষিয়ে তোলে বাদশাহকে। নির্মম অত্যাচারের খরগ নেমে আসে তাতারীর ওপর।

বাদশাহের কারাগারে অত্যাচারে জর্জড়িত ক্ষত-বিক্ষত শরীর নিয়ে তাতারী বেঁচে থাকে দীর্ঘ ৩/৪ টি বছর কিন্তু তার মুখে কোনো কথা নেই। এই দীর্ঘ কারাবাসে একটি কথাও বাদশাহের সাথে বিনিময় করেনি সে। শেষদৃশ্যে মেহেরজানের উপস্থিতি ঘটে বাদশাহের বিবি পরিচয়ে। কথা ফোটে তাতারীর মুখে। অসহ্য যন্ত্রনা সয়েও এতটুকু ভালবাসা কমে যায়নি মেহেরজানের প্রতি বরং মেহেরজানই ভুলে গিয়েছিল সবকিছু।

শেষপর্যায়ে হলেও মেহেরজান চিনতে পারে তার ভালোবাসার যথাযোগ্য পুরুষ তাতারীকে। কিন্তু নিরুপায় মেহেরজান এবং তাতারী। তারা কি জানতো যে হাসির বিনিময়ে তারা মুক্তি পেয়েছিলো সেটা আসলে মুক্তি ছিলনা বরং তার চেয়ে আরও কঠিন শেকল তাদের পায়ে বেঁধে দেয়া হয়েছিল। ইতিহাসে দেখা যায় অধিকাংশ শাসকরা নিজেকে ঈশ্বরের মর্যাদা দান করে বসেন, প্রজারা তাদের হুকুমের গোলাম হয়ে থাকে সারাজীবন। উপন্যাসের ভীতরকার প্রতিটি ঘটনা পাঠকহৃদয়কে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করবে। উপন্যাসের বিভিন্ন চরিত্র পাঠকদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবে সমাজের ক্ষমতাশালীদের আধিপত্যের নোংরা আচরণগুলো।

ক্রীতদাসের হাসি শওকত ওসমানের জনপ্রিয় এবং বিখ্যাত একটি উপন্যাস প্রকাশিত হয় ১৯৬২ সালের দিকে। উপন্যাসটি রচনা সম্পর্কে লেখকের বক্তব্য থেকে জানা যায় এটি আরব্য কাহিনী- ‘আলেফ লায়লা ওয়া লায়লানে’ (সহস্র দুই রাত্রি)’-র শেষ কাহিনীর বাংলা তরজমা (অনেকেই জানেন ‘আলেফ লায়লা লায়লান’ অর্থাৎ ‘সহস্র এক রাত্রি’ কিন্তু সেই তথ্যটি যে ভুল উপন্যাসটির ভূমিকা অংশে লেখক সে সম্পর্কে একটি আলোচনা তুলে ধরেছেন)। ১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের কবলে তৎকালীন পাকিস্তানে জনগনের সবধরনের বাক স্বাধীনতা কেড়ে নেয়া হয়েছিল। সেই শাসন ব্যবস্থাকে ব্যঙ্গ করে এই উপন্যাস জনপ্রিয়তা পেয়েছিল বেশ।

গণতান্ত্রিক চেতনায় যখনই কেউ সোচ্চার হয়েছে তখনই স্বৈরশাসকরা তা কঠোর হাতে তা দমন করেছে। এবং এই প্রথা চলতে থাকে যুগ যুগ ধরে, প্রতিবাদ যে কেউ করে না, তা কিন্তু নয়। প্রতিবাদ করে, তবে তাতে লাভের লাভ হয়না কিছুই উল্টো প্রতিবাদকারীকে চরম মূল্য গুনতে হয় সবসময়ই। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্রের তাতারী গণতান্ত্রিক চেতনাকে ধারণ করেছে। আর বাদশাহ হারুনুর রশীদ স্বৈরশাসকের ভূমিকা পালন করেছে যেন। এই ঘটনা রুপকের মধ্য দিয়েই বিস্তৃত হয়েছে শওকত ওসমানের ক্রীতদাসের হাসি।

উপন্যাসের রাজনৈতিক পটভূমি বিশ্লেষণ করতে যারা অনিচ্ছুক তাদের কাছেও গোলাম তাতারীর তীব্র শ্লেষমাখা চিৎকার বাঙালীর সংগ্রামের চেতনা পাঠকের কাছে সুস্পষ্টভাবে ধরা দিবে শেষ অংশের এই কথাগুলোই- ক্ষত-বিক্ষত তাতারীকে চাবুক মারা হচ্ছে, তাতারী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে এবং বলছে- “শোন হারুনুর রশীদ, দীরহাম দৌলত দিয়ে ক্রীতদাস গোলাম কেনা চলে, বান্দী কেনা সম্ভব! কিন্তু… কিন্তু ক্রীতদাসের হাসি? না! না! না! না!

 

BanglaGOLN.com Logo 252x68 px Dark ক্রীতদাসের হাসি - শওকত ওসমান [ বই রিভিউ ]

 

ক্রীতদাসের হাসি | শওকত ওসমান :

 

 

ক্রীতদাসের হাসি – শওকত ওসমান: মানব জীবনের বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি:

হাসি, মানব জীবনের একটি অন্যতম অনুষঙ্গ। এমিলি ডিকিনসনের মতে ‘হাসি নির্মলতার চিঠি’। জীবনে সুখ-দুঃখ আপেক্ষিক বিষয়। আর এরই বহিঃপ্রকাশ ঘটে হাসি-কান্না নামক অভিব্যক্তিতে। হৃদয়ে ধারণ কিংবা অন্তরে অনুভব করা ছাড়া এই অভিব্যক্তি যে কতটা দুষ্প্রাপ্য সেটা খুব বাস্তবিক প্রেক্ষাপটে উপস্থাপিত হয়েছে কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমান (১৯১৭-১৯৯৮) রচিত ‘ক্রীতদাসের হাসি’ উপন্যাসে।

উপন্যাসটির কেন্দ্রীয় চরিত্র হাবশি গোলাম তাতরী। আব্বাসীয় খলিফা হারুণ অর রশিদের হাবসি ক্রীতদাস ও আর্মেনীয় দাসী মেহেরজানের প্রেমের স্বীকৃতি দেন খলিফার স্ত্রী জুবায়দা। খলিফার অজান্তেই রাজমহিষী তাদের দুজনের বিবাহ দেন। বিবি জুবায়দার অনুমতিক্রমেই প্রতি রাতে নির্ধারিত স্থানে তারা দেখা করত।

খলিফা হারুনুর রশিদ বাগদাদের অধিপতি। উজিরে আজম জাফর বার্মাকির হত্যার আদেশ কার্যকর হওয়ার পর তার মধ্যে মানসিক অস্থিরতা তৈরি হয়। একদিন রাতে এদিক-ওদিক ঘুরতে ঘুরতে নির্মল হাসির শব্দ শুনতে পান তিনি। মুহূর্তেই তার হৃদয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে সেই হাসির শব্দ। এই হাসির উৎস খুঁজতে গিয়েই তিনি দেখতে পান গোলাম তাতারী ও তার স্ত্রী মেহেরজানের প্রণয়দৃশ্য এবং শোনেন তাতারীর প্রাণখোলা হাসি। ক্রীতদাস পল্লীতে চরম দারিদ্রতার মধ্যে বসবাস করলেও তাদের এই হাসি থামে না।

বাদশাহ হারুন রূপবতী দাসী মেহেরজানকে রানীর মর্যাদা দিয়ে প্রাসাদে নিয়ে আসেন। তাতারীকে একটি রাজ্যের রাজত্ব দেয়া হলো। অন্য আরো সুবিধা দিয়ে বলা হলো এর বিনিময়ে খলিফা প্রাণখোলা হাসি শুনতে চান কিন্তু তাতারী আর হাসে না। তাতারীর প্রাণখোলা হাসির উৎস ছিল প্রিয় মেহেরজান। সে এখন খলিফার রানী। প্রিয়া বিরহে তাতারী প্রাণখোলা হাসি তো দূরের কথা, সামান্য হাসিও হাসতে পারে না। এতে খলিফা অপমানিত বোধ করেন।

হাসি শোনানোর জন্য তাতারীকে বারংবার সময় দেয়া হয়। বাগদাদের সবচেয়ে সুন্দরী ও আবেদনময়ী নর্তকীকে তাতারীর মহলে পাঠানো হয়। কিন্তু সে তাতারীকে উপভোগ করতে ব্যর্থ হয়। বরং তাতারীর নৈতিকতার কাছে পরাজিত হয়ে সে আত্মহত্যা করে। এ আত্মহত্যাকে হত্যা হিসেবে চালিয়ে দিয়ে তাতারীর ওপর এর দায় চাপানো হয়। তার বিচার হয়।

আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

সাহিত্যে সমাজের অনিয়ম, অনাচার ফুটে ওঠে। আর এই গুরুদায়িত্ব পালন করেন লেখক, কবি, সাহিত্যিকেরা। এখানেও খলিফার নির্দয়তায় আপত্তি তোলেন কবি নওয়াস। ফলে তাকে রাজদরবার থেকে বহিষ্কারও হতে হয়।

তাতারীকে হাসাতে ব্যর্থ হয়ে খলিফা তার ওপর নির্যাতন শুরু করেন। তাতেও কাজ হয় না। সকল প্রকার অত্যাচার নির্যাতনে সে নীরব থাকে। অতঃপর সর্বশেষ কৌশল হিসেবে মেহেরজানকে তাতারীর কাছে নিয়ে আসা হয়।

কিন্তু মেহেরজান এখন তাতারীর প্রেমিকা নেই, এখন সে খলিফার রানী। প্রথমে মেহেরজান তাতারীকে চিনতেই পারে না। পরে চিনতে পারলেও প্রাক্তন প্রেমিককে সে কোনো কথাই বলাতে পারেনি। শত চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে খলিফা হারুন দুঃখে, ক্ষোভে চরম উত্তেজিত হয়ে তাতারীকে চাবুক মারার আদেশ দেন। মেহেরজান চলে যাওয়া শুরু করলে তাতারী মুখ খোলে। মেহেরজানকে পিছু ডাক দেয় এবং খলিফাকে বলে-

শোন, হারুনর রশিদ। দিরহাম দৌলত দিয়ে ক্রীতদাস গোলাম কেনা চলে। বান্দী কেনা সম্ভব! কিন্ত ক্রীতদাসদের হাসি না।

এ উক্তিই উপন্যাসের জীবনদর্শন। এ পর্যায়ে কবি নওয়াস প্রবেশ করে মন্তব্য করেন-

আমিরুল মোমেনিন, হাসি মানুষের আত্মারই প্রতিধ্বনি।

কবি নওয়াসের কণ্ঠে অসাধারণ এ উক্তিটির মাধ্যমে উপন্যাসটির সমাপ্তি ঘটে।

‘ক্রীতদাসের হাসি’ উপন্যাসটি আরব্য রজনী আলিফ লায়লা ওয়া লায়লা-এর শেষ গল্প ‘জাহাকুল আবদ’- এর অনুবাদ। ভূমিকা অংশের পরেই পান্ডুলিপি আবিষ্কারের ঘটনার খুব চমৎকার বর্ণনা দেওয়া আছে। রচনা এবং প্রকাশকাল অনুযায়ী ধারণা করা হয় এ উপন্যাসে রূপকারের আইয়ুবি স্বৈরশাসনের স্বরূপ এবং পূর্ব বাংলার স্বাধীনতাকামী মানুষের অন্তর্সত্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। সব মিলিয়ে উপন্যাসটি যেন মানব জীবনের বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি।

 

আরও দেখুন:

Leave a Comment