কোরবানি কবিতা — কাজী নজরুল ইসলামের কাব্যগ্রন্থ ‘অগ্নিবীণা’-য় স্থান পাওয়া একটি শক্তিশালী এবং প্রতীকী কবিতা। ‘কোরবানি’ শিরোনামের এই কবিতায় নজরুল শুধুমাত্র পশু কোরবানির উদযাপন নয়, বরং তার মাধ্যমে সত্য ও ঐক্যের শক্তির উদ্ভবকে তুলে ধরেছেন। কবিতার শুরুতেই তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, “ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যগ্রহ’ শক্তির উদ্বোধন।” এ পংক্তির মধ্য দিয়ে তিনি কোরবানিকে শুধু নির্দোষ পশু হত্যার ঘটনা নয়, বরং মানবিক ঐক্য, আত্মত্যাগ ও ন্যায়ের লড়াই হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
বাংলা সাহিত্যে নজরুলের ‘কোরবানি’ কবিতাটি বিশেষ গুরুত্ব পায় কারণ এটি মুসলিম সমাজে কোরবানির ঐতিহ্য ও তাৎপর্যের প্রতি এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করে। যাঁরা কোরবানিকে অহেতুক রক্তপাত বা হত্যাযজ্ঞ হিসেবে অপপ্রচার করেন, তাদের বিরুদ্ধে কবি সরাসরি প্রতিবাদ জানিয়ে, ধর্মীয় উৎসবকে ভিন্ন অর্থে ভাবার আহ্বান জানিয়েছেন। বিশেষ করে সাম্প্রতিককালে কিছু ইসলামবিরোধী গোষ্ঠী কোরবানির বিষয়কে বিতর্কিত করে তুলতে চেয়েছে; কিন্তু নজরুলের কবিতায় এই অপপ্রচারের সঠিক এবং উচ্চতর ব্যাখ্যা পাওয়া যায়।
‘কোরবানি’ কবিতাটি কেবল ধর্মীয় উৎসবের একটি চিত্র নয়, বরং এটি মানবতার প্রতি করুণা, আত্মত্যাগের মহিমা ও সত্যের পক্ষে এক বিপ্লবী ঘোষণা। তাই নজরুলের ‘কোরবানি’ কবিতার বার্তা আজও সমকালীন সমাজের জন্য প্রাসঙ্গিক এবং তা আমাদের মানবিক মূল্যবোধ ও ধর্মীয় ঐক্যকে আরও দৃঢ় করে।
কোরবানি কবিতা – কাজী নজরুল ইসলাম
ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’, শক্তির উদ্বোধন।
দুর্বল! ভীরু! চুপ রহো, ওহো খাম্খা ক্ষুব্ধ মন!
ধ্বনি ওঠে রণি দূর বাণীর,–
আজিকার এ খুন কোর্বানির!
দুম্বা-শির রুম্-বাসীর
শহীদের শির-সেরা আজি। –রহমান কি রুদ্র নন?
বাস্! চুপ খামোশ রোদন!
আজ শোর ওঠে জোর ‘খুন দে, জান দে, শির দে বৎস’ শোন!
ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’, শক্তির উদ্বোধন।
ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’, শক্তির উদ্বোধন।
খঞ্জর মারো গর্দানেই,
পঞ্জরে আজি দরদ নেই,
মর্দানি’ই পর্দা নেই
ডর্তা নেই আজ খুন্-খারাবিতে রক্ত-লুব্ধ মন!
খুনে খেল্ব খুন্-মাতন!
দুনো উন্মাদনাতে সত্য মুক্তি আন্তে যুঝ্র রণ।
ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’, শক্তির উদ্বোধন।
ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’, শক্তির উদ্বোধন।
চড়েছে খুন আজ খুনিয়ারার
মুস্লিমে সারা দুনিয়াটার।
‘জুল্ফেকার’ খুল্বে তার
দু’ধারী ধার্ শেরে-খোদার রক্তে-পূত-বদন!
খনে আজকে রুধ্ব মন!
ওরে শক্তি-হস্তে মুক্তি, শক্তি রক্তে সুপ্ত শোন্!
ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’, শক্তির উদ্বোধন।
ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’, শক্তির উদ্বোধন।
আস্তানা সিধা রাস্তা নয়,
‘আজাদি’ মেলে না পস্তানোয়!
দস্তা নয় সে সস্তা নয়!
হত্যা নয় কি মৃত্যুও? তবে রক্ত-লুব্ধ কোন্
কাঁদে-শক্তি-দুঃস্থ শোন্–
‘এয়্ ইব্রাহিম্ আজ কোর্বানি কর শ্রেষ্ঠ পুত্রধন!’
ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’, শক্তির উদ্বোধন।
এ তো নহে লোহু তরবারের
ঘাতক জালিম জোর্বারের!
কোরবানের জোর-জানের
খুন এ যে, এতে গোর্দা ঢের রে, এ ত্যাগে ‘বুদ্ধ’ মন!
এতে মা রাখে পুত্র পণ্!
তাই জননী হাজেরা বেটারে পরাল বলির পূত বসন!
ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’, শক্তির উদ্বোধন।
ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’, শক্তির উদ্বোধন।
এই দিনই ‘মীনা’-ময়দানে
পুত্র-স্নেহের গর্দানে
ছুরি হেনে খুন ক্ষরিয়ে নে
রেখেছে আব্বা ইব্রাহিম্ সে আপনা রুদ্র পণ!
ছি ছি! কেঁপো না ক্ষুদ্র মন!
আজ জল্লাদ নয়, প্রহলাদ সম মোল্লা খুন-বদন!
ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’, শক্তির উদ্বোধন।
ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’, শক্তির উদ্বোধন।
দ্যাখ্ কেঁপেছে ‘আরশ’ আস্মানে,
মন-খুনি কি রে রাশ মানে?
ত্রাস প্রাণে?-তবে রাস্তা নে!
প্রলয়- বিষাণ কিয়ামতে তবে বাজাবে কোন্ বোধন?
সেকি সৃষ্টি-সংশোধন?
ওরে তাথিয়া তাথিয়া নাচে ভৈরব বাজে ডম্বরু শোন্!–
ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’, শক্তির উদ্বোধন।
ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’, শক্তির উদ্বোধন।
মুস্লিম-রণ-ডঙ্কা সে,
খুন্ দেখে করে শঙ্কা কে?
টঙ্কারে অসি ঝঙ্কারে
ওরে হুঙ্কারে, ভাঙি গড়া ভীম কারা লড়ব রণ-মরণ!
ঢালে বাজ্বে ঝন্-ঝনন!
ওরে সত্য মুক্তি স্বাধীনতা দেবে এই সে খুন-মোচন!
ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’, শক্তির উদ্বোধন।
ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’, শক্তির উদ্বোধন।
জোর চাই আর যাচ্না নয়
কোরবানি-দিন আজ না ওই?
বাজ্না কই? সাজ্না কই?
কাজ না আজিকে জান্ মাল দিয়ে মুক্তির উদ্ধরণ?
বল্– ‘যুঝ্ব জান্ ভি পণ!’
ঐ খুনের খুঁটিতে কল্যাণ-কেতু, লক্ষ্য ঐ তোরণ!
আজ আল্লার নামে জান কোরবানে ঈদের পূত বোধন।
ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’, শক্তির উদ্বোধন।
কোরবানী কবিতাটি লেখার প্রেক্ষাপট:
জানা যায়, সেকালে জনৈক তরীকুল আলম নামক মৌলভী কোরবানীর বিরুদ্ধে লিখেছিলেন। তার বক্তব্য ছিল কোরবানী নৃশংস। এর প্রতিবাদস্বরূপ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম অসাধারন এই কবিতাটি লিখেন। আজ যেমন কিছু মানুষ অতি দরদীর মুখোশ পড়ে কুরবানী এলেই মায়াকান্না নিয়ে হাজির হন। বুঝতে কষ্ট হয় না, এদের উপস্থিতি সকল সময়েই কম বেশি ছিল। এদের কথা গায়ে না নিলেই হল।
তবে, শুধু পশু কুরবানী নয়। মনের ভেতরের পশুত্বকে কুরবানী করে সত্যিকারের মানুষ হই আমরা। প্রকৃত ত্যাগের মহিমায় উজ্জিবিত হোক আমাদের প্রত্যেকের হৃদয়-মন। যেমনটা ঘটেছিল হযরত ইবরাহিম আলাইহিসসালাম কর্তৃক প্রানপ্রিয় পুত্র সন্তানকে স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে কোরবানী করতে উদ্যত হওয়ার অবিস্মরনীয় ঘটনায়।
কবির আত্মার শান্তি এবং মাগফিরাত কামনা করছি আজকের এই দিনে। একইসাথে কোরবানী (ধর্ম) বিদ্বেষী কথিত অচেনা সেই মৌলভী ব্যক্তিটির প্রতিও শ্রদ্ধা। কারন, তিনি কোরবানীর যৌক্তিকতা নিয়ে খোঁচাখুচি না করলে, খোদার হুকুমের তোয়াক্কা না করে অহেতুক পশু প্রেম দেখাতে গিয়ে উল্টোপাল্টা কথা না বললে নজরুলের অনবদ্য এই সৃজন থেকে আমরা বঞ্চিত হতাম। সুতরাং, এখন যারা কোরবানী নিয়ে খোঁচা মেরে ভাবেন এতেই আনন্দ, শ্রদ্ধা তাদের প্রতিও।
কোরবানী কবিতা আবৃত্তি: