Site icon Bangla Gurukul [ বাংলা গুরুকুল ] GOLN

কেউ কথা রাখেনি কবিতা, বিশ্লেষণ ও আবৃত্তি – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় [ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর কবিতা ]

‘কেউ কথা রাখেনি’ কবিতাটি বাংলা আধুনিক কবিতার এক অনবদ্য সৃষ্টি, যার রচয়িতা কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। এই কবিতায় কবি নিঃসঙ্গতা, প্রতারণা ও জীবনের প্রতিশ্রুতি না রাখার বেদনা গভীরভাবে তুলে ধরেছেন। কবিতার প্রথম পঙ্‌ক্তি—
“কেউ কথা রাখেনি, তেত্রিশ বছর কাটলো কেউ কথা রাখেনি”—
শুধু একটি কবিতা নয়, এটি কবির দীর্ঘজীবনের নির্যাস, প্রত্যাশা ও হতাশার অনুপম দলিল।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এই কবিতায় ব্যক্ত করেছেন তার জীবনের নানা পর্যায়ে প্রিয়জনদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের তীব্র যন্ত্রণা। এই কবিতা আত্মজৈবনিক হলেও, এতে মিশে আছে এক সাধারণ মানুষের অসংখ্য ক্ষত-বিক্ষত অনুভূতি, যা পাঠকের হৃদয়কে ছুঁয়ে যায়। কবিতার ভাষা সরল, কিন্তু আবেগ প্রবল; প্রতিটি পঙ্‌ক্তির ভাঁজে লুকিয়ে আছে ব্যর্থ স্বপ্ন, ভাঙা আশা এবং নিঃসঙ্গ জীবনের আর্তনাদ।

‘কেউ কথা রাখেনি’ কবিতাটি প্রেম, সম্পর্ক, বন্ধন, বিশ্বাস ও বিচ্ছেদ—এই সমস্ত মানবিক অনুভবের গভীর ও নিঃসঙ্কোচ প্রকাশ, যা একাধারে সময়ের দলিল এবং চিরন্তন মানুষের বেদনার প্রতিচ্ছবি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের এই কবিতা শুধু তাঁর ব্যক্তিগত জীবন নয়, বরং সমস্ত ‘অপেক্ষমান হৃদয়’-এর প্রতিনিধি হয়ে ওঠে।

 

কেউ কথা রাখেনি কবিতা – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

 

কেউ কথা রাখেনি, তেত্রিশ বছর কাটলো কেউ কথা রাখেনি
ছেলেবেলায় এক বোষ্টুমি তার আগমনী গান হঠাৎ থামিয়ে বলেছিলো
শুক্লা দ্বাদশীর দিন অন্তরাটুকু শুনিয়ে যাবে
তারপর কত চন্দ্রভুক অমবস্যা এসে চলে গেল, কিন্তু সেই বোষ্টুমি আর এলো না
পঁচিশ বছর প্রতীক্ষায় আছি ।

মামাবাড়ির মাঝি নাদের আলী বলেছিল, বড় হও দাদাঠাকুর
তোমাকে আমি তিন প্রহরের বিল দেখাতে নিয়ে যাবো
সেখানে পদ্মফুলের মাথায় সাপ আর ভ্রমর খেলা করে !
নাদের আলি, আমি আর কত বড় হবো ? আমার মাথা এই ঘরের ছাদ
ফুঁরে আকাশ স্পর্শ করলে তারপর তুমি আমায় তিন প্রহরের বিল দেখাবে ?

একটাও রয়্যাল গুলি কিনতে পারিনি কখনো
লাঠি-লজেন্স দেখিয়ে দেখিয়ে চুষেছে লস্কর বাড়ির ছেলেরা
ভিখারীর মতন চৌধুরীদের গেটে দাঁড়িয়ে দেখেছি ভেতরে রাস উৎসব
অবিরল রঙ্গের ধারার মধ্যে সুবর্ণ কঙ্কণ পড়া ফর্সা রমণীরা কতরকম আমোদে হেসেছে
আমার দিকে তারা ফিরেও চায়নি !
বাবা আমার কাঁধ ছুঁয়ে বলেছিলেন, দেখিস, একদিন আমরাও…
বাবা এখন অন্ধ, আমাদের দেখা হয়নি কিছুই
সেই রয়্যাল গুলি, সেই লাঠি-লজেন্স, সেই রাস উৎসব
আমায় কেউ ফিরিয়ে দেবে না !

বুকের মধ্যে সুগন্ধি রুমাল রেখে বরুণা বলেছিল,
যেদিন আমায় সত্যিকারের ভালবাসবে
সেদিন আমার বুকেও এরকম আতরের গন্ধ হবে !
ভালবাসার জন্য আমি হাতের মুঠোয় প্রাণ নিয়েছি
দুরন্ত ষাঁড়ের চোখে বেঁধেছি লাল কাপড়
বিশ্ব সংসার তন্ন তন্ন করে খুঁজে এনেছি ১০৮ নীলপদ্ম
তবু কথা রাখেনি বরুণা, এখন তার বুকে শুধুই মাংসের গন্ধ
এখনো সে যে কোন নারী !
কেউ কথা রাখেনি, তেত্রিশ বছর কাটলো, কেউ কথা রাখেনা !

আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

কেউ কথা রাখেনি কবিতা আবৃত্তি ঃ

 

কেউ কথা রাখেনি কবিতার বিশ্লেষণ:

‘কেউ কথা রাখেনি’ কবিতায় কবি তার জীবনের বিভিন্ন পর্বে আপন জানা মানুষদের কথা না রাখার বেদনা ও যাতনা মর্মস্পর্শী ভাষায় তুলে ধরেছেন। এভাবে তিনি পার করেছেন তেত্রিশটি বছর।

কবিতায় তিনি কয়েকটি ঘটনা বলেছেন। একটি ঘটনা- মামাবাড়ির মাঝি নাদের আলি বলেছিল, তুমি বড় হও দাদাঠাকুর, তোমাকে তিন প্রহরের বিল দেখাতে নিয়ে যাব। কবির প্রশ্ন- নাদের আলি আমি আর কত বড় হব? আমার মাথা ঘরের ছাদ ফুঁড়ে আকাশ স্পর্শ করলে তবে কি তিন প্রহরের বিল দেখাতে নিয়ে যাবে?

আমাদের প্রতিজনের জীবনে এরকম অনেক না পাওয়া রয়েছে। রয়েছে নানা না পাওয়ার গল্প। সেই গল্পগুলোকে বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেখলে আমরা একটি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি পাই। ঘটনাগুলোকে মনে হয় দুর থেকে দেখার অবকাশ হয়।

“কেউ কথা রাখেনি, তেত্রিশ বছর কাটলো, কেউ কথা রাখেনি” এ যেন ধ্রুব সত্য। তেত্রিশ কেন তিনশো বছর পরেও রাখা-না রাখার এই শব্দবন্ধে যেন নিজেকেই প্রতিফলিত করতে পারবে পাঠক। আসমুদ্র হিমাচল জুড়ে সর্বত্র আঁকিবুকি কেটে বেড়াচ্ছে ইতিহাস। কিন্তু বাঙালি বড্ড ইতিহাস বিমুখ। স্মৃতির কোনও এক নির্জন কোণে কিংবা বিস্মৃতির জীর্ণ এক পাতায় বাঙালি স্থান দেয় ইতিহাসকে। ইতিহাস ধরে রাখা তো দূরের কথা ইতিহাসটা খুলেও কেউ পড়ে না। এই আক্ষেপ বাঘা বাঘা ব্যক্তিত্বের। অভিযোগ জমা পড়েছে তাঁর কাছেও। তাই তিনি ইতিহাস আর বর্তমানের মেলবন্ধনে গড়ে তুলেছেন একের পর এক সৃষ্টি। তিনি নীললোহিত।

“একটাও রয়্যাল গুলি কিনতে পারিনি কখনও! লাঠি লজেন্স দেখিয়ে দেখিয়ে চুষেছে লস্কর বাড়ির ছেলেরা।” সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জীবনই তাঁর সৃষ্টির রশদ। তখন টাউন স্কুলে পড়ছেন তিনি, লস্করবাবু হেডমাস্টার। কোনও ক্রমে আলু সেদ্ধ খেয়ে দিন কাটছে। তখন একথালা ভাতা অমৃত। আর হেডমাস্টারের ছেলে গল্প করে বলত ভোগবিলাসের কথা, আর লাঠি লজেন্স চুষতো। তাই হয়তো বন্দি জেগে আছো কাব্যগ্রন্থের ‘কেউ কথা রাখেনি’ কবিতায় এই লাইন।

কবি বলেছিলেন, তার বয়স যখন তেত্রিশ পেরিয়ে গেছে তখন এমন অনুভূতি তাকে তাড়িত করেছে। তাই তিনি লিখলেন ‘কেউ কথা রাখেনি’। কবিতার কিছু অংশে কল্পনার সংমিশ্রণ থাকলেও পুরো কবিতাটিই বাস্তবতার আলোকে লেখা। কবিতায় বোষ্টমীর প্রসঙ্গ কাল্পনিক হলেও অবাস্তব নয়। কবি ১৯৩৪ সালের ৭ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার আমগ্রামের মামাবাড়িতে। তখন পৈতৃক নিবাস কালকিনির মাইজপাড়ায়। সম্ভবত ১০-১১ বছর বয়সে অর্থাৎ দেশভাগের আগেই পরিবারের সঙ্গে চলে যান কলকাতা। তবু তিনি ভুলতে পারেননি শৈশবের স্মৃতি।

কবি বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার পর ‘পঁচিশ বছর প্রতীক্ষায়’ থেকেছেন। সে সময় মনে হয়েছে তার মামাবাড়ির মাঝি নাদের আলী তাকে বলেছিল, ‘বড় হও দাদাঠাকুর তোমাকে আমি/তিন প্রহরের বিল দেখাতে নিয়ে যাব’। তিন প্রহরের বিলে সাপ আর ভ্রমরের প্রসঙ্গ এলে কবি মুচকি হেসে বললেন, তখন আমি ছোট ছিলাম। মামারা যখন নৌকা নিয়ে বিলে যেত তখন আমিও বায়না ধরতাম। কিন্তু মামারা নিতেন না। ছোট্ট সুনীলকে ভয় দেখানোর জন্য বলতেন, সে বিলে যেতে-আসতে তিন প্রহর লেগে যায়। আর সেখানে ভয়ঙ্কর সাপ রয়েছে। সেই বোধ থেকেই বিলের নাম দেন তিন প্রহরের বিল। এবং সাপ আর ভ্রমরের খেলাটা বাচ্চাদের ভয় দেখানোর জন্য বলা।

এ সময় আ জ ম কামাল অভিযোগ করে বললেন, কবি কবিতায় আপনি মুসলমানদের ছোট করেছেন। একটি মাত্র চরিত্র তাও আবার মাঝি। কবি তখনো হাসলেন। বললেন, তখন মুসলমানরা এখনকার মতো এত সচেতন ছিল না। আমি তাদের ছোট করিনি বরং তাদের পশ্চাৎপদতাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি। তখনো মুসলমানরা শিক্ষাদীক্ষায় অনেক পিছিয়ে ছিল। মামাবাড়ির আশপাশের মুসলমানরা হিন্দু জমিদারদের বাড়ির কামলা খাটত বা নৌকা বেয়ে জীবিকা নির্বাহ করত।

কবিরা আর্থিকভাবে অতটা সচ্ছল ছিলেন না। মার্বেল খেলার জন্য একটা রয়্যাল গুলিও তিনি কিনতে পারেননি। তখন মাইজপাড়ার লস্কররা খুবই বিত্তবান ছিল। লস্করবাড়ির ছেলেদের লাঠিলজেন্স খেতে দেখে কবি বাবার কাছে বায়না ধরতেন। বাবা বলতেন, পরে কিনে দেব। কবি অপেক্ষায় থেকেছেন। বাবা স্কুলমাস্টার। বেতন কম। তাই তার মা কবিকে বলতেন, জীবনে অন্য কিছু করবে তবু মাস্টারি করবে না। তাই কবি কখনো মাস্টারি করতে যাননি।

রাস উৎসব প্রসঙ্গে কবি বললেন, তিনি ছেলেবেলায় খুব ডানপিটে স্বভাবের ছিলেন। তাদের গাঙ্গুলিবাড়িতে যখন রাস উৎসব হতো তখন ভেতর বাড়িতে মহিলারা নাচ-গান করত। কবি তার ব্যাঘাত ঘটাবেন বলে তাকে সেখানে ঢুকতে দেওয়া হতো না। নিজেকে অসহায় কল্পনা করে কবি এমন অভিব্যক্তি করেছেন। কবি তখন ভাবতেন, একদিন আমিও সব পাব। রয়্যাল গুলি, লাঠিলজেন্স আর রাস উৎসব সবই তিনি পেয়েছেন। কিন্তু তার বাবা এসব কিছুই দেখে যেতে পারেননি। আজ সুনীলের সব আছে কিন্তু তার স্কুলমাস্টার বাবা নেই। এই শূন্যতা তাকে বার বার গ্রাস করেছে।

কবিকে যখন বরুণা প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করা হলো, কবি তখন মুচকি হেসে প্রসঙ্গটি এড়িয়ে গেলেন। তখন কবির সঙ্গে তার স্ত্রী স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন। কবি শুধু এটুকু বললেন, এটা কল্পনা। বরুণা বলে কেউ ছিল না। তবে পরে আমরা জেনেছি, কবির এক বন্ধুর বোনের প্রতি কবির দুর্বলতা বা ভালোবাসা জন্মেছিল। কবি তার কোনো এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, সে সময়ে একমাত্র বন্ধুর সুবাদে কেবল বন্ধুর বোনের সঙ্গেই কথা বলার বা ভাববিনিময়ের সুযোগ ছিল। হয়তো বরুণা তার কল্পনার নারী।

 

কেউ কথা রাখেনি কবিতা আবৃত্তিঃ

এই কবিতাটি বহুজন আবৃত্তি করেছেন। ইউটিউবে ঘুরে সার্চ করলে বড় তালিকা পাবেন। আমরা একটি তুলে দিলাম।

 

Exit mobile version