কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত এর জন্ম হয় যশােহর জেলার সাগরদাঁড়ি গ্রামে ২৫ শে জানুয়ারি ১৮২৪ সালে । মাইকেল মধুসূদনের বাবা রাজনারায়ণ দত্ত একজন অবস্থাপন্ন উকিল ছিলেন । মধুসূদনের মা জাহ্নবীদেবী ছিলেন শিক্ষিতা মহিলা । প্রায় সাত বছর বয়স পর্যন্ত মধুসূদন মায়ের কাছেই লেখাপড়া করেন । মাইকেল মধুসূদন দত্ত সাত বছর বয়সে কলকাতায় আসেন । এখানে এসে প্রথম দুবছর তিনি খিদিরপুর স্কুলে পড়েন । ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি হিন্দু কলেজে ভর্তি হন । মধুসূদন খুব মেধাবী ছাত্র ছিলেন । স্কুলের পরীক্ষায় প্রতি বছর তিনি বৃত্তি পেতেন । কলেজে পড়ার সময় একটা প্রবন্ধ প্রতিযােগিতায় মধুসূদন স্বর্ণপদক পেয়েছিলেন । সেই সময় থেকেই মধুসূদন ইংরেজিতে কবিতা লিখতেন । ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে ৯ ফেব্রুয়ারি ঊনিশ বছর বয়সে মধুসূদন খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন । তখন তার নাম হয় মাইকেল মধুসূদন দত্ত ।
খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণের ফলে স্বজনরা মাইকেল মধুসূদন দত্তকে দূরে ঠেলে দেয়। আর তাই নিজের পাঠ্যপুস্তক বিক্রি করে সেই অর্থ দিয়ে ভাগ্যের সন্ধানে মধুসূদন মাদ্রাজ গেলে সেখানে মধুসূদনের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঘটনা ঘটে। মাদ্রাজে বসবাসের সময় থেকেই মাইকেল মধুসূদন দত্ত সাংবাদিক ও কবি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। মাদ্রাজে অবস্থানকালে মাইকেল মধুসূদন দত্ত ‘Timothy Penpoem’ ছদ্মনামে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘The Captive Ladie’ (১৮৪৮) এবং দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘Visions of the Past’ লেখেন। তখন তাঁর কবিতা জ্ঞানান্বেষণ, Bengal Spectator, Literary Gleamer, Calcutta Library Gazette, Literary Blossom, Comet প্রভৃতি পত্রিকায় প্রকাশিত হতো। তাঁর বন্ধুবান্ধবরা ওই সময় তাঁকে বাংলায় সাহিত্যচর্চা করতে অনুরোধ জানান এবং তিনি নিজেও ভেতর থেকে এরূপ একটি তাগিদ অনুভব করেন। এই তাগিদ থেকেই তিনি বাংলা ভাষায় সাহিত্য রচনা শুরু করেন
Table of Contents
কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা:
অন্নপূর্ণার ঝাঁপি – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
মোহিনী-রূপসী-বেশে ঝাঁপি কাঁখে করি
পশিছেন, ভবানন্দ, দেখ তব ঘরে
অন্নদা! বহিছে শূন্যে সঙ্গীত-লহরী,
অদৃশ্যে অপ্সরাচয় নাচিছে অম্বরে।–
দেবীর প্রসাদে তোমা রাজপদে বরি,
রাজাসন, রাজছত্র, দিবেন সত্বরে
রাজলক্ষ্মী; ধন-স্রোতে তব ভাগ্যতরি
ভাসিবে অনেক দিন, জননীর বরে।
কিন্তু চিরস্থায়ী অর্থ নহে এ সংসারে;
চঞ্চলা ধনদা রমা, ধনও চঞ্চল;
তবু কি সংশয় তব, জিজ্ঞাসি তোমারে?
তব বংশ-যশঃ-ঝাঁপি–অন্নদামঙ্গল–
যতনে রাখিবে বঙ্গে মনের ভাণ্ডারে,
রাখে যথা সুধামৃতে চন্দ্রের মণ্ডলে।
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 2 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-5-177x300.jpg)
অর্থ – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
ভেবো না জনম তার এ ভবে কুক্ষণে,
কমলিনী-রূপে যার ভাগ্য-সরোবরে
না শোভেন মা কমলা সুবর্ণ কিরণে ;–
কিন্তু যে, কম্পনা-রূপ খনির ভিতরে
কুড়ায়ে রতন-ব্ৰজ, সাজায় ভূষণে
স্বভাষা, অঙ্গের শোভা বাড়ায়ে আদরে!
কি লাভ সঞ্চয়ি, কহ, রজত কাঞ্চনে,
ধনপ্রিয় ?বাঁধা রমা চির কার ঘরে ?
তার ধন-অধিকারী হেন জন নহে,
যে জন নিৰ্ব্বংশ হলে বিস্মৃতি-আঁধারে
ডুবে নাম, শিলা যথা তল-শূন্য দলে।
তার ধন-অধিকারী নারে মরিবারে–
রসনা-যন্ত্রের তার যত দিন বহে
ভাবের সঙ্গীত-ধ্বনি, বাঁচে সে সংসারে।।
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 3 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-4-212x300.jpg)
অশ্ব ও কুরঙ্গ – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
১
অশ্ব, নবদূর্ব্বাময় দেশে,
বিহরে একেলা অধিপতি।
নিত্য নিশা অবশেষে
শিশিরে সরস দূর্ব্বা অতি।
বড়ই সুন্দর স্থল,
অদূরে নির্ঝরে জল,
তরু, লতা, ফল, ফুল,
বন-বীণা অলিকুল;
মধ্যাহ্নে আসেন ছায়া,
পরম শীতল কায়া,
পবন ব্যজন ধরে,
পত্র যত নৃত্য করে,
মহানন্দে অশ্বের বসতি॥
২
কিছু দিনে উজ্জ্বলনয়ন,
কুরঙ্গ সহসা আসি দিল দরশন।
বিস্ময়ে চৌদিকে চায়,
যা দেখে বাগানে তায়,
কতক্ষণে হেরি অশ্বে কহে মনে মনে;—
“হেন রাজ্যে এক প্রজা এ দুখ না সহে!
তোমার প্রসাদ চাই,
শুন হে বন-গোঁসাই,
অাপদে, বিপদে দেব, পদে দিও ঠাঁই॥”
৩
এক পার্শ্ব করি অধিকার,
আরম্ভিল কুরঙ্গ বিহার;
খাইল অনেক ঘাস,
কে গণিতে পারে গ্রাস?
অাহার করণান্তরে
করিল পান নির্ঝরে;
পরে মৃগ তরুতলে
নিদ্রা গেল কুতূহলে—
গৃহে গৃহস্বামী যথা বলী স্বত্ববলে॥
৪
বাক্যহীন ক্রোধে অশ্ব, নিরখি এ লীলা,
ভোজবাজি কিম্বা স্বপ্ন! নয়ন মুদিলা;
উন্মীলি ক্ষণেক পরে কুরঙ্গে দেখিলা,
রঙ্গে শুয়ে তরুতলে;
দ্বিগুণ অাগুন হৃদে জ্বলে;
তীক্ষ্ণ ক্ষুর আঘাতনে ধরণী ফাটিল,
ভীম হ্রেষা গগনে উঠিল।
প্রতিধ্বনি চৌদিকে জাগিল॥
৫
নিদ্রাভঙ্গে মৃগবর
কহিলা, “ওরে বর্ব্বর!
কে তুই, কত বা বল?
সৎ পড়সীর মত
না থাকিবি, হবি হত।”
কুরঙ্গের উজ্জ্বল নয়ন
ভাতিল সরোষে যেন দুইটি তপন।।
৬
হয়ের হৃদয়ে হৈল ভয়,
ভাবে এ সামান্য পশু নয়,
শিরে শৃঙ্গ শাখাময়!
প্রতি শৃঙ্গ শূলের আকার
বুঝি বা শূলের তুল্য ধার,
কে আমারে দিবে পরিচয়?
৭
মাঠের নিকটে এক মৃগয়ী থাকিত,
অশ্ব তারে বিশেষ চিনিত।
ধরিতে এ অশ্ববরে,
নানা ফাঁস নিরন্তরে।
মৃগয়ী পাতিত।
কিন্তু সৌভাগ্যের বলে, তুরঙ্গম মায়া-ছলে
কভু না পড়িত॥
৮
কহিল তুরঙ্গ;—“পশু উচ্চশৃঙ্গধারী—
মোর রাজ্য এবে অধিকারী;
না চাহিল অনুমতি,
কর্কশভাষী সে অতি;
হও হে সহায় মোর,
মারি দুই জনে চোর॥”
৯
মৃগয়ী করিয়া প্রতারণা,
কহিলা,“হা! এ কি বিড়ম্বনা!
জানি সে পশুরে আমি,
বনে পশুকুলে স্বামী,
শার্দ্দূলে, সিংহেরে নাশে,
দগ্ধে বন বিষশ্বাসে;
একমাত্র কেবল উপায়;—
মুখস ও মুখে পর,
পৃষ্ঠে চর্ম্মাসন ধর,
আমি সে আসনে বসি,
করে ধনুর্ব্বাণ অসি,
তা হলে বিজয় লভা যায়॥”
১০
হায়! ক্রোধে অন্ধ অশ্ব, কুছলে ভুলিল;
লাফে পৃষ্ঠে দুষ্ট সাদী অমনি চড়িল।
লোহার কণ্টকে গড়া অস্ত্র, বাঁধা পাদুকায়,
তাহার আঘাতে প্রাণ যায়।
মুখস নাশিল গতি, ভয়ে হয় ক্ষিপ্তমতি,
চলে সাদী যে দিকে চালায়॥
১১
কোথা অরি, কোথা বন,
সে সুখের নিকেতন?
দিনান্তে হইলা বন্দী আঁধার-শালায়।
পরের অনিষ্ট হেতু ব্যগ্র যে দুর্ম্মতি,
এই পুরস্কার তার কহেন ভারতী;
ছায়া সম জয় যায় ধর্ম্মের সংহতি॥
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 4 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-3-297x300.jpg)
আত্মবিলাপ – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
আশার ছলনে ভুলি কী ফল লভিনু,হায়,
তাই ভাবী মনে?
জীবন-প্রবাহ বহি কাল-সিন্ধু পানে যায়,
ফিরাব কেমনে?
দিন দিন আয়ুহীন হীনবল দিন দিন ,—
তবু এ আশার নেশা ছুটিল না? এ কি দায়!
রে প্রমত্ত মন মম! কবে পোহাইবে রাতি?
জাগিবি রে কবে?
জীবন-উদ্যানে তোর যৌবন-কুসুম-ভাতি
কত দিন রবে?
নীর বিন্ধু, দূর্বাদলে,নিত্য কিরে ঝলঝলে?
কে না জানে অম্বুবিম্ব অম্বুমুখে সদ্যঃপাতি?
নিশার স্বপন-সুখে সুখী যে কী সুখ তার?
জাগে সে কাঁদিতে!
ক্ষণপ্রভা প্রভা -দানে বাড়ায় মাত্ত আঁধার
পথিকে ধাঁদিতে!
মরীচিকা মরুদেশে,নাশে প্রাণ তৃষাক্লেশে—
এ তিনের ছল সম ছল রে এ কু-আশার।
প্রেমের নিগড় গড়ি পরিলি চরণে সাদে
কী ফল লভিলি?
জ্বলন্ত-পাবক-শিখা-লোভে তুই কাল ফাঁদে
উড়িয়া পড়িলি
পতঙ্গ যে রঙ্গে ধায়,ধাইলি,অবোধ,হায়
না দেখলি না শুনিলি,এবে রে পরাণ কাঁদে
বাকি কি রাখিলি তুই বৃথা অর্থ-অন্বেষণে,
সে সাধ সাধিতে?
ক্ষত মাত্ত হাত তোর মৃণাল-কণ্টকগণে
কমল তুলিতে
নারিলি হরিতে মণি, দঃশিল কেবল ফণী
এ বিষম বিষজ্বালা ভুলিবি, মন,কেমনে!
যশোলাভ লোভে আয়ু কত যে ব্যয়িলি হায়,
কব তা কাহারে?
সুগন্ধ কুসুম-গন্ধে অন্ধ কীট যথা ধায়,
কাটিতে তাহারে?
মাৎসর্য-বিষদশন, কামড়ে রে অনুক্ষণ!
এই কি লভিলি লাভ,অনাহারে,অনিদ্রায়?
মুকুতা-ফলের লোভে,ডুবে রে অতল জলে
যতনে ধীবর,
শতমুক্তাধিক আয়ু কালসিন্ধু জলতলে
ফেলিস,পামড়!
ফিরি দিবি হারাধন,কে তোরে,অবোধ মন,
হায় রে,ভুলিবি কত আশার কুহক-ছলে!
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 5 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-2-282x300.jpg)
আমরা – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
আকাশ-পরশী গিরি দমি গুণ-বলে,
নিৰ্ম্মিল মন্দির যারা সুন্দর ভারতে ;
তাদের সন্তান কি হে আমরা সকলে ?—
আমরা,—দুর্ব্বল, ক্ষীণ, কুখ্যাত জগতে,
পরাধীন, হা বিধাতঃ, আবদ্ধ শৃঙ্খলে?—
কি হেতু নিবিল জ্যোতিঃ মণি, মরকতে,
ফুটিল ধুতুরা ফুল মানসের জলে
নির্গন্ধে ? কে কবে মোরে ? জানিব কি মতে
বামন দানব-কুলে, সিংহের ঔরসে
শৃগাল কি পাপে মোরা কে কবে আমারে?
রে কাল, পূরিবি কি রে পুনঃ নব রসে
রস-শূন্য দেহ তুই ? অমৃত-আসারে
চেতাইবি মৃত-কল্পে ? পুনঃ কি হরষে,
শুক্লকে ভারত-শশী ভাতিবে সংসারে ?
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 6 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-1-208x300.jpg)
আশা – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
বাহ্য-জ্ঞান শূন্য করি,নিদ্রা মায়াবিনী
কত শত রঙ্গ করে নিশা-আগমনে!—
কিন্তু কি শকতি তোর এ মর-ভবনে
লো আশা!—নিদ্রার কেলি আইলে যামিনী,
ভাল মন্দ ভুলে লোক যখন শয়নে,
দুখ,সুখ,সত্য,মিথ্যা!তুই কুহকিনী,
তোর লীলা-খেলা দেখি দিবার মিলনে,—
জাগে যে স্বপন তারে দেখাস্,রঙ্গিণি!
কাঙ্গালী যে,ধন-ভোগ তার তোর বলে;
মগন যে,ভাগ্য-দোষে বিপদ-সাগরে,
(ভুলি ভূত,বর্ত্তমান ভুলি তোর ছলে)
কালে তীর-লাভ হবে,সেও মনে করে!
ভবিষ্যৎ-অন্ধকারে তোর দীপ জ্বলে,—
এ কুহক পাইলি লো কোন্ দেব-বরে?
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 7 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-7-300x300.jpg)
আশ্বিন মাস – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
সু-শ্যামাঙ্গ বঙ্গ এবে মহাব্রতে রত।
এসেছেন ফিরে উমা, বৎসরের পরে,
মহিষমৰ্দ্দিনীরূপে ভকতের ঘরে;
বামে কমকায়া রমা, দক্ষিণে আয়ত-
লোচনা বচনেশ্বরী, স্বর্ণবীণা করে;
শিখীপৃষ্ঠে শিখীধ্বজ, যাঁর শরে হত
তারক—অসুরশ্রেষ্ঠ; গণ-দল যত,
তার পতি গণদেব, রাঙা কলেবরে
করি-শিরঃ; —আদিব্রহ্ম বেদের বচনে ।
এক পদ্মে শতদল৷ শত রূপবতী—
নক্ষত্রমণ্ডলী যেন একত্রে গগনে!—
কি আনন্দ! পূৰ্ব্ব কথা কেন কয়ে, স্মৃতি,
আনিছ হে বারি-ধারা আজি এ নয়নে?—
ফলিবে কি মনে পুনঃ সে পূর্ব্ব ভকতি?
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 8 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-6-300x293.jpg)
ইতালি – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
ইতালি, বিখ্যাত দেশ, কাব্যের কানন,
বহুবিধ পিক যথা গায় মধুস্বরে,
সঙ্গীত‐সুধার রস করি বরিষণ,
বাসন্ত আমোদে আমোদ মন পূরি নিরন্তরে;—
সে দেশে জনম পূর্বে করিলা গ্রহণ
ফ্রাঞ্চিস্কো পেতরাকা কবি; বাক্দেবীর বরে
বড়ই যশস্বী সাধু, কবি‐কুল‐ধন,
রসনা অমৃতে সিক্ত, স্বর্ণ বীণা করে।
কাব্যের খনিতে পেয়ে এই ক্ষুদ্র মণি,
স্বমন্দিরে প্রদানিলা বাণীর চরণে
কবীন্দ্র: প্রসন্নভাবে গ্রহিলা জননী
(মনোনীত বর দিয়া) এ উপকরণে।
ভারতে ভারতী‐পদ উপযুক্ত গণি,
উপহাররূপে আজি অরপি রতনে॥
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 2 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-5-177x300.jpg)
ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
স্রোতঃ-পথে বহি যথা ভীষণ ঘোষণে
ক্ষণ কাল, অল্পায়ুঃ পয়োরাশি চলে
বরিষায় জলাশয়ে ; দৈব-বিড়ম্বনে
ঘটিল কি সেই দশা সুবঙ্গ-মণ্ডলে
তোমার, কোবিদ বৈদ্য ? এই ভাবি মনে,—
নাহি কি হে কেহ তব বান্ধবের দলে,
তব চিতা-ভস্মরাশি কুড়ায়ে যতনে,
স্নেহ-শিল্পে গড়ি মঠ, রাখে তার তলে ?
আছিলে রাখাল-রাজ কাব্য-ব্রজধামে
জীবে তুমি ; নানা খেলা খেলিলা হরষে ;
যমুনা হয়েছ পার ; তেঁই গোপগ্রামে
সবে কি ভুলিল তোমা ? স্মরণ-নিকষে,
মন্দ-স্বর্ণ-রেখা-সম এবে তব নামে
নাহি কি হে জ্যোতিঃ, ভাল স্বর্ণের পরশে?
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 6 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-1-208x300.jpg)
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
বিদ্যার সাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে।
করুণার সিন্ধু তুমি, সেই জানে মনে,
দীন যে, দীনের বন্ধু !– উজ্জল জগতে
হেমাদ্রির হেম-কান্তি অম্লান কিরণে।
কিন্তু ভাগ্য-বলে পেয়ে সে মহা পর্বতে,
যে জন আশ্রয় লয় সুবর্ণ চরণে,
সেই জানে কত গুণ ধরে কত মতে
গিরীশ। কি সেবা তার সে সুখ সদনে !
দানে বারি নদীরূপ বিমলা কিঙ্করী।
যোগায় অমৃত ফল পরম আদরে
দীর্ঘ-শিরঃ তরু-দল, দাসরূপ ধরি।
পরিমলে ফুল-কুল দশ দিশ ভরে,
দিবসে শীতল শ্বাসী ছায়া, বনেশ্বরী,
নিশায় সুশান্ত নিদ্রা, ক্লান্তি দূর করে।
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 8 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-6-300x293.jpg)
ঈশ্বরী পাটনী – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
সেই ঘাটে খেয়া দেয় ঈশ্বরী পাটনী।’
– অন্নদামঙ্গল।
কে তোর তরিতে বসি, ঈশ্বরী পাটনি?
ছলিতে তোরে রে যদি কামিনী কমলে,
কোথা করী, বাম করে ধরি যারে বলে,
উগরি, গ্রাসিল পুনঃ পূর্ব্বে সুবদনী?
রূপের খনিতে আর আছে কি রে মণি
এর সম? চেয়ে দেখ, পদ-ছায়া-ছলে,
কনক কমল ফুল্ল এ নদীর জলে-
কোন দেবতারে পূজি, পেলি এ রমণী?
কাঠের সেঁউতি তোর, পদ-পরশনে
হইতেছে স্বর্ণময়! এ নব যুবতী-
নহে রে সামান্যা নারী, এই লাগে মনে,
বলে বেয়ে নদী-পারে যা রে শীঘ্রগতি।
মেগে নিস, পার করে, বর-রূপ ধরে
দেখায়ে ভকতি, শোন, এ মোর যুকতি!
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 7 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-7-300x300.jpg)
উদ্যানে পুষ্করিণী – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
বড় রম্য স্থলে বাস তোর, লো সরসি!
দগধা বসুধা যবে চৌদিকে প্রখরে
তপনের, পত্রময়ী শাখা ছত্র ধরে
শীতলিতে দেহ তোর ; মৃদু শ্বাসে পশি,
সুগন্ধ পাখার রূপে, বায়ু বায়ু করে।
বাড়াতে বিরাম তোর আদরে, রূপসি,
শত শত পাতা মিলি মিষ্টে মরমরে;
স্বর্ণ-কান্তি ফুল ফুটি, তোর তটে বসি,
যোগায় সৌরভ-ভোগ, কিঙ্করী যেমতি
পাট-মহিষীর খাটে, শয়ন-সদনে।
নিশায় বাসর রঙ্গ তোর, রসবতি,
লয়ে চাঁদে,—কত হাসি প্রেম-আলিঙ্গনে!
বৈতালিক-পদে তোর পিক-কুল-পাত;
ভ্রমর গায়ক ; নাচে খঞ্জন, ললনে ।
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 2 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-5-177x300.jpg)
উপক্রম – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
যথাবিধি বন্দি কবি, আনন্দে আসরে,
কহে, জোড় করি কর, গৌড় সুভাজনে;—
সেই আমি, ডুবি পূর্বে ভারত‐সাগরে,
তুলিল যে তিলোত্তমা‐মুকুতা যৌবনে;—
কবি‐গুরু বাল্মীকির প্রসাদে তৎপরে,
গম্ভীরে বাজায়ে বীণা, গাইল, কেমনে,
নাশিলা সুমিত্রা‐পুত্র, লঙ্কার সমরে,
দেব‐দৈত্য‐নরাতঙ্ক— রক্ষেন্দ্র‐নন্দনে;
কল্পনা দূতীর সাথে ভ্রমি ব্রজ‐ধামে
শুনিল যে গোপিনীর হাহাকার ধ্বনি,
(বিরহে বিহ্বলা বালা হারা হয়ে শ্যামে;)—
বিরহ‐লেখন পরে লিখিল লেখনী
যার, বীর জায়া‐পক্ষে বীর পতি‐গ্রামে,
সেই আমি, শুন, যত গৌড়‐চূড়ামণি!—
ইতালি, বিখ্যাত দেশ, কাব্যের কানন,
বহুবিধ পিক যথা গায় মধুস্বরে,
সঙ্গীত-সুধার রস করি বরিষণ,
বাসন্ত আমোদে আমোদ মন পূরি নিরন্তরে;—
সে দেশে জনম পূর্বে করিলা গ্রহণ
ফ্রাঞ্চিস্কো পেতরাকা কবি; বাক্দেবীর বরে
বড়ই যশস্বী সাধু, কবি-কুল-ধন,
রসনা অমৃতে সিক্ত, স্বর্ণ বীণা করে।
কাব্যের খনিতে পেয়ে এই ক্ষুদ্র মণি,
স্বমন্দিরে প্রদানিলা বাণীর চরণে
কবীন্দ্র: প্রসন্নভাবে গ্রহিলা জননী
(মনোনীত বর দিয়া) এ উপকরণে।
ভারতে ভারতী-পদ উপযুক্ত গণি,
উপহাররূপে আজি অরপি রতনে॥
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 3 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-4-212x300.jpg)
উপসংহার – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
রাগিণী বসন্ত,তাল ধীমা তেতালা
শুন হে সভাজন!
আমি অভাজন,
দীন ক্ষীণ জ্ঞানগুণে,
ভয় হয় দেখে শুনে,
পাছে কপাল বিগুণে,
হারাই পূর্ব্ব মূলধন!
যদি অনুরাগ পাই,
আনন্দের সীমা নাই,
এ কাষেতে একষাই,
দিব দরশন!
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 5 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-2-282x300.jpg)
ঊষা – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
১
কনক উদয়াচলে তুমি দেখা দিলে,
হে সুর-সুন্দরি!
কুমুদ-মুদয়ে আঁখি, কিন্তু সুখে গায় পাখী,
গুঞ্জরি নিকুঞ্জে ভ্ৰমে ভ্রমর ভ্রমরী;
বরসরোজিনী ধনী, তুমি হে তার স্বজনী,
নিত্য তার প্রাণনাথে আন সাথে করি!
2
তুমি দেখাইলে পথ যায় চক্রবাকী
যথা প্রাণপতি!
ব্ৰজাঙ্গনে দয়া করি, লয়ে চল যথা হরি,
পথ দেখাইয়া তারে দেহ শীঘ্ৰগতি!
কাঁদিয়া কাঁদিয়া আঁধা, আজি গো শ্যামের রাধা,
ঘুচাও আঁধার তার, হৈমবতি সতি!
৩
হায়, ঊষা, নিশাকালে আশার স্বপনে
ছিলাম ভুলিয়া,
ভেবেছিনু তুমি, ধনি, নাশিবে ব্রজ রজনী,
ব্রজের সরোজরবি ব্রজে প্রকাশিয়া!
ভেবেছিনু কুঞ্জবনে পাইব পরাণধনে
হেরিব কদম্বমূলে রাধা-বিনোদিয়া!
৪
মুকুতা-কুণ্ডলে তুমি সাজাও, ললনে,
কুসুমকামিনী;
অান মন্দ সমীরণে বিহারিতে তার সনে
রাধা-বিনোদনে কেন আন না, রঙ্গিণি?
রাধার ভূষণ যিনি, কোথায় আজি গো তিনি
সাজাও আনিয়া তাঁরে রাধা বিরহিণী!
৫
ভালে তব জ্বলে, দেবি, আভাময় মণি—
বিমল কিরণ;
ফণিনী নিজ কুন্তলে পরে মণি কুতূহলে
কিন্তু মণি-কুলরাজা ব্রজের রতন!
মধু কহে,ব্রজাঙ্গনে, এই লাগে মোর মনে
ভূতলে অতুল মণি শ্রীমধুসূদন!
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 6 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-1-208x300.jpg)
কপোতাক্ষ নদ – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
সতত, হে নদ তুমি পড় মোর মনে
সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে।
সতত যেমনি লোক নিশার স্বপনে
শোনে মায়া যন্ত্র ধ্বনি তব কলকলে
জুড়াই এ কান আমি ভ্রান্তির ছলনে।
বহু দেশ দেখিয়াছি বহু নদ দলে
কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মেটে কার জলে
দুগ্ধস্রোতরূপি তুমি মাতৃভূমি স্তনে।
আর কি হে হবে দেখা যত দিন যাবে
প্রজারূপে রাজরূপ সাগরেরে দিতে
বারি রূপ কর তুমি এ মিনতি গাবে
বঙ্গজ জনের কানে সখে-সখারিতে।
নাম তার এ প্রবাসে মজি প্রেমভাবে
লইছে যে নাম তব বঙ্গের সঙ্গীতে।
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 7 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-7-300x300.jpg)
কবি-মাতৃভাষা – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
নিজাগারে ছিল মোর অমূল্য রতন
অগণ্য; তা সবে আমি অবহেলা করি,
অর্থলোভে দেশে দেশে করিনু ভ্রমণ,
বন্দরে বন্দরে যথা বাণিজ্যের তরী।
কাটাইনু কত কাল সুখ পরিহরি,
এই ব্রতে, যথা তপোবনে তপোধন,
অশন, শয়ন ত্যজে, ইষ্টদেবে স্মরি,
তাঁহার সেবায় সদা সঁপি কায় মন।
বঙ্গকূল-লক্ষ্মী মোরে নিশার স্বপনে
কহিলা – “হে বৎস, দেখি তোমার ভকতি,
সুপ্রসন্ন তব প্রতি দেবী সরস্বতী।
নিজ গৃহে ধন তব, তবে কি কারণে
ভিখারী তুমি হে আজি, কহ ধন-পতি?
কেন নিরানন্দ তুমি আনন্দ সদনে?
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 8 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-6-300x293.jpg)
কবিগুরু দান্তে – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
নিশান্তে সুবর্ণ-কান্তি নক্ষত্র যেমতি
(তপনের অনুচর ) সুচারু কিরণে
খেদায় তিমির-পুঞ্জে ; হে কবি, তেমতি
প্রভা তব বিনাশিল মানস-ভুবনে
অজ্ঞান!জনম তব পরম সুক্ষণে।
নব কবি-কুল-পিতা তুমি, মহামতি,
ব্রহ্মাণ্ডের এ সুখণ্ডে । তোমার সেবনে
পরিহরি নিদ্রা পুনঃ জাগিলা ভারতী।
দেবীর প্রসাদে তুমি পশিলা সাহসে
সে বিষম দ্বার দিয়া আঁধার নরকে,
যে বিষম দ্বার দিয়া, ত্যজি আশা,পশে
পাপ প্রাণ, তুমি, সাধু, পশিলা পুলকে।
যশের আকাশ হতে কভু কি হে খসে।
এ নক্ষত্ৰ?কোন্ কীট কাটে এ কোরকে?
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 2 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-5-177x300.jpg)
কমলে কামিনী – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
কমলে কামিনী আমি হেরিনু স্বপনে
কালিদহে। বসি বামা শতদল-দলে
(নিশীথে চন্দ্রিমা যথা সরসীর জলে
মনোহরা।) বাম করে সাপটি হেলনে
গজেশে, গ্রাসিছে তারে উগরি সঘনে
গুঞ্জরিছে অলিপুঞ্জ অন্ধ পরিমলে,
বহিছে দহের বারি মৃদু কলকলে!—
কার না ভোলে রে মনঃ, এহেন ছলনে!
কবিতা-পঙ্কজ-রবি, শ্রীকবিকঙ্কণ,
ধন্য তুমি বঙ্গভূমে! যশঃ-সুধাদানে
অমর করিলা তোমা অমরকারিণী
বাগ্দেবী! ভোগিলা দুখ জীবনে, ব্রাহ্মণ,
এবে কে না পূজে তোমা, মজি তব গানে?—
বঙ্গ-হৃদ-হ্রদে চণ্ডী কমলে কামিনী॥
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 3 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-4-212x300.jpg)
করুণ-রস – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
সুন্দর নদের তীরে হেরিনু সুন্দরী
বামারে মলিন-মুখী,শরদের শশী
রাহুর তরাসে যেন!সে বিরলে বসি,
মৃদে কাঁদে সুবদনা;ঝরঝরে ঝরি,
গলে অশ্রু-বিন্দু,যেন মুক্তা-ফল খসি!
সে নদের স্রোতঃ অশ্রু পরশন করি,
ভাসে,ফুল্ল কমলের স্বর্ণকান্তি ধরি,
মধুলোভী মধুকরে মধুরসে রসি
গন্ধামোদী গন্ধবহে সুগন্ধ প্রদানী।
না পারি বুঝিতে মায়া,চাহিনু চঞ্চলে
চৌদিকে;বিজন দেশ;হৈল দেব-বাণী;—
”কবিতা-রসের স্রোতঃ এ নদের ছলে;
করুণা বামার নাম—রস-কুলে রাণী;
সেই ধন্য,বশ সতী যার তপোবলে!”
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 7 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-7-300x300.jpg)
কল্পনা – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
লও দাসে সঙ্গে রঙ্গে, হেমাঙ্গি কল্পনে,
বাগদেবীর প্রিয়সখি, এই ভিক্ষা করি ;
হায়, গতিহীন আমি দৈব-বিড়ম্বনে,—
নিকুঞ্জ-বিহারী পাখী পিঞ্জর-ভিতরি!
চল যাই মনানন্দে গোকুল-কাননে,
সরস বসন্তে যথা রাধাকান্ত হরি
নাচিছেন, গোপীচয়ে নাচায়ে ; সঘনে
পূরি বেণুরবে দেশ! কিম্বা, শুভঙ্করি,
চল লো, আতঙ্কে যথা লঙ্কায় অকালে
পূজেন উমায় রাম, রঘুরাজ-পতি,
কিম্বা সে ভীষণ ক্ষেত্রে, যথা শরজালে
নাশিছেন ক্ষত্ৰকুলে পার্থ মহামতি।
কি স্বরগে, কি মরতে, অতল পাতালে,
নাহি স্থল যথা, দেবি, নহে তব গতি ।
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 8 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-6-300x293.jpg)
কাক ও শৃগালী – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
একটি সন্দেশ চুরি করি,
উড়িয়া বসিলা বৃক্ষোপরি,
কাক, হৃষ্ট-মনে;
সুখাদ্যের বাস পেয়ে,
আইল শৃগালী ধেয়ে,
দেখি কাকে কহে দুষ্টা মধুর বচনে;—
“অপরূপ রূপ তব, মরি!
তুমি কি গো ব্রজের শ্রীহরি,—
গোপিনীর মনোবাঞ্ছা?—কহ গুণমণি!
হে নব নীরদ-কান্তি,
ঘুচাও দাসীর ভ্রান্তি,
যুড়াও এ কান দুটি করি বেণু-ধ্বনি!
পুণ্যবতী গোপ-বধূ অতি।
তেঁই তারে দিলা বিধি,
তব সম রূপ-নিধি,—
মোহ হে মদনে তুমি; কি ছার যুবতী?
গাও গীত, গাও, সখে করি এ মিনতি!
কুড়াইয়া কুসুম-রতনে,
গাঁথি মালা সুচারু গাঁথনে,
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 3 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-4-212x300.jpg)
কাশীরাম দাস – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
চন্দ্রচূড় জটাজালে আছিলা যেমতি
জাহ্নবী, ভারত-রস ঋষি দ্বৈপায়ন,
ঢালি সংস্কৃত-হ্রদে রাখিলা তেমতি; —
তৃষ্ণায় আকুল বঙ্গ করিত রোদন।
কঠোরে গঙ্গায় পূজি ভগীরথ ব্রতী,
(সুধন্য তাপস ভবে, নর-কুল-ধন! )
সগর-বংশের যথা সাধিলা মুকতি,
পবিত্ৰিলা আনি মায়ে, এ তিন ভুবন;
সেই রূপে ভাষা-পথ খননি স্ববলে,
ভারত-রসের স্রোতঃ আনিয়াছ তুমি
জুড়াতে গৌড়ের তৃষা সে বিমল জলে।
নারিবে শোধিতে ধার কভু গৌড়ভূমি।
মহাভারতের কথা অমৃত-সমান।
হে কাশি, কবীশদলে তুমি পুণ্যবান্॥
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 4 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-3-297x300.jpg)
কুক্কুট ও মণি – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
খুঁটিতে খুঁটিতে ক্ষুদ কুক্কুট পাইল
একটি রতন;—
বণিকে সে ব্যগ্রে জিজ্ঞাসিল;—
“ঠোঁটের বলে না টুটে, এ বস্তু কেমন?”
বণিক্ কহিল,-“ভাই,
এ হেন অমূল্য রত্ন, বুঝি, দুটি নাই।”
হাসিল কুক্কুট শুনি;—”তণ্ডুলের কণা
বহুমূল্যতর ভাবি;—কি আছে তুলনা?”
“নহে দোষ তোর, মূঢ়, দৈব এ ছলনা,
জ্ঞান-শূন্য করিল গোঁসাই!”
এই কয়ে বণিক ফিরিল।
মূর্খ যে, বিদ্যার মূল্য কভু কি সে জানে?
নর-কুলে পশু বলি লোকে তারে মানে;—
এই উপদেশ কবি দিলা এই ভানে।
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 5 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-2-282x300.jpg)
কুরুক্ষেত্রে – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
যথা দাবানল বেড়ে অনল-প্রাচীরে
সিংহ-বৎসে । সপ্ত রথী বেড়িলা তেমতি
কুমারে । অনল-কণা-রূপে শর, শিরে
পড়ে পুঞ্জে পুঞ্জে পুড়ি, অনিবার-গতি!
সে কাল অনল-তেজে, সে বনে যেমতি
রোষে, ভয়ে সিংহ-শিশু গরজে অস্থিরে,
গরজিলা মহাবাহু চারি দিকে ফিরে
রোষে, ভয়ে। ধরি ঘন ধূমের মূরতি,
উড়িল চৌদিকে ধুলা, পদ-আস্ফালনে
অশ্বের । নিশ্বাস ছাড়ি আর্জ্জুনি বিষাদে,
ছাড়িলা জীবন-আশা তরুণ যৌবনে।
আঁধারি চৌদিক যথা রাহু গ্রাসে চাঁদে
গ্রাসিলা বীরেশে যম । অস্তের শয়নে
নিদ্রা গেলা অভিমন্যু অন্যায় বিবাদে।
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 26 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-1-208x300.jpg)
কুসুম – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
১
কেনে এত ফুল তুলিলি, স্বজনি—
ভরিয়া ডালা?
মেঘাবৃত হলে, পরে কি রজনী
তারার মালা?
অার কি যতনে, কুসুম রতনে
ব্রজের বালা?
২
আর কি পরিবে কভু ফুলহার
ব্ৰজকামিনী?
কেনে লো হরিলি ভূষণ লতার—
বনশোভিনী?
অলি বঁধু তার; কে আছে রাধার—
হতভাগিনী?
৩
হায় লো দোলাবি, সখি,কার গলে
মালা গাঁথিয়া?
আর কি নাচে লো তমালের তলে
বনমালিয়া?
প্রেমের পিঞ্জর, ভাঙি পিকবর,
গেছে উড়িয়া!
৪
আর কি বাজে লো মনোহর বাঁশী
নিকুঞ্জবনে?
ব্রজ সুধানিধি শোভে কি লো হাসি,
ব্রজগগনে?
ব্রজ কুমুদিনী, এবে বিলাপিনী
ব্রজভবনে!
৫
হায় রে যমুনে কেনে না ডুবিল
তোমার জলে
অদয় অক্রূর, যবে সে আইল
ব্রজমণ্ডলে?
ক্রূর দূত হেন, বধিলে না কেন
বলে কি ছলে?
৬
হরিল অধম মম প্রাণ হরি
ব্রজরতন!
ব্রজবনমধু নিল ব্রজ অরি,
দলি ব্রজবন?
কবি মধু ভণে, পাবে, ব্রজাঙ্গনে,
মধুসূদন!
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 7 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-7-300x300.jpg)
কুসুমের কীট – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
কি পাপে, কহ তা মোরে, লো বন-সুন্দরি,
কোমল হৃদয়ে তব পশিল,—কি পাপে—
এ বিষম যমদূত ? কাঁদে মনে করি
পরাণ যাতনা তব ; কত যে কি তাপে
পোড়ায় দুরন্ত তোমা, বিষদন্তে হরি
বিরাম দিবস নিশি ! মৃদে কি বিলাপে
এ তোমার দুখ দেখি সখী মধুকরী,
উড়ি পড়ি তব গলে যবে লো সে কাঁপে ?
বিষাদে মলয় কি লো, কহ, সুবদনে,
নিশ্বাসে তোমার ক্লেশে, যবে লো সে আসে
যাচিতে তোমার কাছে পরিমল-ধনে ?
কানন-চন্দ্রিমা তুমি কেন রাহু-গ্রাসে?
মনস্তাপ-রূপে রিপু, হায়, পাপ-মনে,
এইরূপে, রূপবতি, নিত্য সুখ নাশে !
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 2 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-5-177x300.jpg)
কৃত্তিবাস – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
জনক জননী তব দিলা শুভ ক্ষণে
কৃত্তিবাস নাম তোমা!— কীর্ত্তির বসতি
সতত তোমার নামে সুবঙ্গ-ভবনে,
কোকিলের কণ্ঠে যথা স্বর, কবিপতি,
নয়নরঞ্জন-রূপ কুসুম-যৌবনে,
রশ্মি মাণিকের দেহে। আপনি ভারতী,
বুঝি কয়ে দিলা নাম নিশার স্বপনে,
পূর্ব্ব-জনমের তব স্মরি হে ভকতি!
পবন-নন্দন হনু, লঙ্ঘি ভীমবলে
সাগর, ঢালিলা যথা রাঘবের কানে
সীতার বারতা-রূপ সঙ্গীত-লহরী;–
তেমতি, যশস্বি, তুমি সুবঙ্গ-মণ্ডলে
গাও গো রামের নাম সুমধুর তানে,
কবি-পিতা বাল্মীকিকে তপে তুষ্ট করি!
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 3 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-4-212x300.jpg)
কৃষ্ণচূড়া – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
(১)
এই যে কুসুম শিরোপরে, পরেছি যতনে,
মম শ্যাম-চূড়া-রূপ ধরে এ ফুল রতনে!
বসুধা নিজ কুন্তলে পরেছিল কুতূহলে
এ উজ্জ্বল মণি,
রাগে তারে গালি দিয়া, লয়েছি আমি কাড়িয়া-
মোর কৃষ্ণ-চূড়া কেনে পরিবে ধরণী?
(২)
এই যে কম মুকুতাফল, এ ফুলের দলে,-
হে সখি, এ মোর আঁখিজল, শিশিরের ছলে!
লয়ে কৃষ্ণচূড়ামণি, কাঁদিনু আমি, স্বজনি,
বসি একাকিনী,
তিতিনু নয়ন-জলে; সেই জল এই দলে
গলে পড়ে শোভিতেছে, দেখ্ লো কামিনি!
(৩)
পাইয়া এ কুসুম রতন-শোন্ লো যুবতি,
প্রাণহরি করিনু স্মরণ -স্বপনে যেমতি!
দেখিনু রূপের রাশি মধুর অধরে বাঁশী,
কদমের তলে,
পীত ধড়া স্বর্ণরেখা, নিকষে যেন লো লেখা,
কুঞ্জশোভা বরগুঞ্জমালা দোলে গলে!
(৪)
মাধবের রূপের মাধুরী, অতুল ভুবনে-
কার মনঃ নাহি করে চুরি, কহ লো ললনে?
যে ধন রাধায় দিয়া, রাধার মনঃ কিনিয়া
লয়েছিলা হরি,
সে ধন কি শ্যামরায়, কেড়ে নিলা পুনরায়?
মধু কহে, তাও কভু হয় কি, সুন্দরি?
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 4 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-3-297x300.jpg)
কেউটিয়া সাপ – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
বিষাগার শিরঃ হেরি মণ্ডিত কমলে
তোর, যম-দূত, জন্মে বিস্ময় এ মনে!
কোথায় পাইলি তুই,—কোন্ পুণ্যবলে—
সাজাতে কুচূড়া তোর, হেন সুভূষণে ?
বড়ই অহিত-কারী তুই এ ভবনে।
জীব-বংশ-ধ্বংস-রূপে সংসার-মণ্ডলে
সৃষ্টি তোর। ছটফটি, কে না জানে, জ্বলে
শরীর, বিষাগ্নি যবে জ্বালাস্ দংশনে?—
কিন্তু তোর অপেক্ষা রে, দেখাইতে পারি,
তীক্ষ্ণতর বিষধর অরি নর-কুলে!
তোর সম বাহ-রূপে অতি মনোহারী,—
তোর সম শিরঃ-শোভা রূপ-পদ্ম-ফুলে।
কে সে ? কবে কবি, শোন্! সে রে সেই নারী,
যৌবনের মদে যে রে ধৰ্ম্ম-পথ ভুলে!
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 6 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-1-208x300.jpg)
গদা-যুদ্ধ – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
দুই মত্ত হস্তী যথা ঊর্দ্ধশুণ্ড করি,
রকত-বরণ আঁখি,গরজে সঘনে,—
ঘুরায়ে ভীষণ গদা শূন্যে,কাল রণে,
গরজিলা দুর্য্যোধন,গরজিলা অরি
ভীমসেন।ধূলা-রাশি,চরণ-তাড়নে
উড়িল;অধীরে ধরা থর থর থরি
কাঁপিলা;—টলিল গিরি সে ঘন কম্পনে;
উথলিল দ্বৈপায়নে জলের লহরী,
ঝড়ে যেন!যথা মেঘ,বজ্রানলে ভরা,
বজ্রানলে ভরা মেঘে আঘাতিলে বলে,
উজলি চৌদিক তেজে বাহিরায় ত্বরা
বিজলী;গদায় গদা লাগি রণ-স্থলে,
উগরিল অগ্নি-কণা দরশন-হরা!
আতঙ্কে বিহঙ্গ-দল পড়িল ভূতলে।।
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 7 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-7-300x300.jpg)
গোগৃহ-রণে – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
হুহুঙ্কারি টঙ্কারিলা ধনুঃ ধনুর্দ্ধারী
ধনঞ্জয়,মৃত্যুঞ্জয় প্রলয়ে যেমতি!
চৌদিকে ঘেরিল বীরে রথ সারি সারি,
স্থির বিজলীর তেজঃ,বিজলীর গতি!—
শর-জালে শূর-ব্রজে সহজে সংহারি
শূরেন্দ্র,শোভিলা পূনঃ যথা দিনপতি
প্রখর কিরণে মেঘে খ-মুখে নিবারি,
শোভেন অম্লানে নভে।উত্তরের প্রতি
কহিলা আনন্দে বলী;—”চালাও স্যন্দনে
বিরাট-নন্দন,দ্রুতে,যথা সৈন-দলে
লুকাইছে দুর্য্যোধন হেরি মোরে রণে,
তেজস্বী মৈনাক যথা সাগরের জলে
বজ্রাগ্নির কাল তেজে ভয় পেয়ে মনে।—
দণ্ডিব প্রচণ্ডে দুষ্টে গাণ্ডীবের বলে।”
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 33 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-6-300x293.jpg)
গোধূলি – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
(১)
কোথা রে রাখাল-চূড়ামণি?
গোকুলের গাভীকুল, দেখ,সখি,শোকাকুল,
না শুনে সে মুরলীর ধ্বনি!
ধীরে ধীরে গোষ্ঠে সবে পশিছে নীরব,—
আইল গোধূলি, কোথা রহিল মাধব!
(২)
আইল লো তিমির যামিনী;
তরুডালে চক্রবাকী বসিয়া কাঁদে একাকী–
কাঁদে যথা রাধা বিরহিণী!
কিন্তু নিশা অবসানে হাসিবে সুন্দরী;
আর কি পোহাবে কভু মোর বিভাবরী?
(৩)
ওই দেখ উদিছে গগনে—
জগত-জন-রঞ্জন— সুধাংশু রজনীধন,
প্রমদা কুমুদী হাসে প্রফুল্লিত মনে;
কলঙ্কী শশাঙ্ক, সখি, তোষে লো নয়ন–
ব্রজ-নিষ্কলঙ্ক-শশী চুরি করে মন।
(৪)
হে শিশির, নিশার আসার!
তিতিও না ফুলদলে ব্রজে আজি তব জলে,
বৃথা ব্যয় উচিত গো হয় না তোমার;
রাধার নয়ন-বারি ঝরি অবিরল,
ভিজাইবে আজি ব্রজে—যত ফুলদল!
(৫)
চন্দনে চর্চ্চিয়া কলেবর,
পরি নানা ফুলসাজ, লাজের মাথায় বাজ;
মজায় কামিনী এবে রসিক নাগর;
তুমি বিনা, এ বিরহ, বিকট মূরতি,
কারে আজি ব্রজাঙ্গনা দিবে প্রেমারতি?
(৬)
হে মন্দ মলয় সমীরণ,
সৌরভ ব্যাপারী তুমি, ত্যজ আজি ব্রজভূমি–
অগ্নি যথা জ্বলে তথা কি করে চন্দন?
যাও হে, মোদিত কবলয় পরিমলে,
জুড়াও সুরতক্লান্ত সীমন্তিনী দলে!
(৭)
যাও চলি, বায়ু-কুলপতি,
কোকিলার পঞ্চস্বর বহ তুমি নিরন্তর–
ব্রজে আজি কাঁদে যত ব্রজের যুবতী!
মধু ভণে, ব্রজাঙ্গনে, করো না রোদন,
পাবে বঁধু—অঙ্গীকারে শ্রীমধুসূদন!
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 2 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-5-177x300.jpg)
ছায়া পথ – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
কহ মোরে, শশিপ্রিয়ে, কহ, কৃপা করি,
কার হেতু নিত্য তুমি সাজাও গগনে,
এ পথ,—উজ্জ্বল কোটি মণির কিরণে ?
এ সুপথ দিয়া কি গো ইন্দ্রাণী সুন্দরী
আনন্দে ভেটিতে যান নন্দন-সদনে
মহেন্দ্রে, সঙ্গেতে শত বরাঙ্গী অপ্সরী,
মলিনি ক্ষণেক কাল চারু তারা-গণে—
সৌন্দর্য্যে ?—এ কথা দাসে কহ, বিভাবরি !
রাণী তুমি ; নীচ আমি ; তেঁই ভয় করে,
অনুচিত বিবেচনা পার করিবারে
আলাপ আমার সাথে ; পবন-কিঙ্করে,—
ফুল-কুল সহ কথা কহ দিয়া যারে,
দেও কয়ে ; কহিবে সে কানে, মৃদুস্বরে,
যা কিছু ইচ্ছহ, দেবি, কহিতে আমারে !
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 5 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-2-282x300.jpg)
জয়দেব – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
চল যাই, জয়দেব, গোকুল-ভবনে
তব সঙ্গে, যথা রঙ্গে তমালের তলে
শিখীপুচ্ছ-চূড়া শিরে, পীতধড়া গলে
নাচে শ্যাম, বামে রাধা— সৌদামিনী ঘনে!
না পাই যাদবে যদি, তুমি কুতূহলে
পূরিও নিকুঞ্জরাজী বেণুর স্বননে।
ভুলিবে গোকুল-কুল এ তোমার ছলে,—
নাচিবে শিখিনী সুখে, গাবে পিকগণে,—
বহিবে সমীর ধীরে সুস্বর-লহরী,—
মৃদুতর কলকলে কালিন্দী আপনি
চলিবে। আনন্দে শুনি সে মধুর ধ্বনি,
ধৈরজ ধরি কি রবে ব্রজের সুন্দরী?
মাধবের রব, কবি, ও তব বদনে,
কে আছে ভারতে ভক্ত নাহি ভাবে মনে?
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 4 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-3-297x300.jpg)
জলধর – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
১
চেয়ে দেখ,প্রিয়সখি,কি শোভা গগনে!
সুগন্ধ-বহ-বাহন, সৌদামিনী সহ ঘন
ভ্ৰমিতেছে মন্দগতি প্রেমানন্দ মনে!
ইন্দ্র-চাপ রূপ ধরি, মেঘরাজ ধ্বজোপরি,
শোভিতেছে কামকেতু—খচিত রতনে!
২
লাজে বুঝি গ্রহরাজ মুদিছে নয়ন!
মদন উৎসবে এবে, মাতি ঘনপতি সেবে
রতিপতি সহ রতি ভুবনমোহন!
চপলা চঞ্চলা হয়ে, হাসি প্রাণনাথে লয়ে
তুষিছে তাহায় দিয়ে ঘন আলিঙ্গন!
৩
নাচিছে শিখিনী সুখে কেকা রব করি,
হেরি ব্রজ কুঞ্জবনে, রাধা রাধাপ্রাণধনে,
নাচিত যেমতি যত গোকুল সুন্দরী!
উড়িতেছে চাতকিনী শূন্যপথে বিহারিণী
জয়ধ্বনি করি ধনী—জলদ-কিঙ্করী!
৪
হায় রে কোথায় আজি শ্যাম জলধর।
তব প্রিয় সৌদামিনী, কাঁদে নাথ একাকিনী
রাধারে ভুলিলে কি হে রাধামনোহর?
রত্নচূড়া শিরে পরি, এস বিশ্ব আলো করি,
কনক উদয়াচলে যথা দিনকর।
৫
তব অপরূপ রূপ হেরি, গুণমণি,
অভিমানে ঘনেশ্বর যাবে কাঁদি দেশান্তর,
আখণ্ডল-ধনু লাজে পালাবে অমনি;
দিনমণি পুনঃ আসি উদিবে আকাশে হাসি;
রাধিকার সুখে সুখী হইবে ধরণী;
৬
নাচে গোকুল নারী, যথা কমলিনী
নাচে মলয়-হিল্লোলে সরসী-রূপসী-কোলে,
রুণু রুণু মধু বোলে বাজায়ে কিঙ্কিণী!
বসাইও ফুলাসনে এ দাসীরে তব সনে
তুমি নব জলধর এ তব অধীনী!
৭
অরে আশা আর কি রে হবি ফলবতী?
আর কি পাইব তারে সদা প্রাণ চাহে যারে
পতি-হারা রতি কি লো পাবে রতি-পতি?
মধু কহে হে কামিনী, আশা মহামায়াবিনী!
মরীচিকা কার তৃষা কবে তোষে সতি?
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 6 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-1-208x300.jpg)
সায়ংকালের তারা – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
কার সাথে তুলনিবে,লো সুর-সুন্দরি,
ও রূপের ছটা কবি এ ভব-মণ্ডলে?
আছে কি লো হেন খনি,যার গর্ভে ফলে
রতন তোমার মত,কহ,সহচরি
গোধূলির?কি ফণিনী,যার সু-কবরী
সাজায় সে তোমা সম মণির উজ্জ্বলে?—
ক্ষণমাত্র দেখি তোমা নক্ষত্র-মণ্ডলে
কি হেতু?ভাল কি তোমা বাসে না শর্ব্বরী?
হেরি অপরূপ রূপ বুঝি ক্ষুণ্ণ মনে
মানিনী রজনী রাণী,তেঁই অনাদরে
না দেয় শোভিতে তোমা সখীদল-সনে,
যবে কেলি করে তারা সুহাস-অম্বরে?
কিন্তু কি অভাব তব,ওলো বরাঙ্গনে,—
ক্ষণমাত্র দেখী মুখ,চির আঁখি স্মরে!
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 7 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-7-300x300.jpg)
দুঃশাসন – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
মেঘ-রূপ চাপ ছাড়ি, বজ্রাগ্নি যেমনে
পড়ে পাহাড়ের শৃঙ্গে ভীষণ নির্ঘোষে ;
হেরি ক্ষেত্রে ক্ষত্র-গ্লানি দুষ্ট দুঃশাসনে,
রৌদ্ররূপী ভীমসেন ধাইলা সরোষে ;
পদাঘাতে বসুমতী কাঁপিলা সঘনে ;
বাজিল ঊরুতে অসি গুরু অসি-কোষে
যথা সিংহ সিংহনাদে ধরি মৃগে বনে
কামড়ে প্রগাঢ়ে ঘাড় লহু-ধারা শোষে ;
বিদরি হৃদয় তার ভৈরব-আরবে,
পান করি রক্ত-স্রোতঃ গৰ্জ্জিলা পাবনি ।
“মানাগ্নি নিবানু আমি আজি এ আহবে
বর্ব্বর!–পাঞ্চালী সতী, পাণ্ডব-রমণী,
তার কেশপাশ পর্শি, আকর্ষিলি যবে,
কুরু-কুলে রাজলক্ষ্মী ত্যজিলা তখনি।”
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 8 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-6-300x293.jpg)
দে- দোল – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
ওই যে শুনিছ ধ্বনি ও নিকুঞ্জ-বনে,
ভেবো না গুঞ্জরে অলি চুম্বি ফুলাধরে ;
ভেবো না গাইছে পিক কল কুহরণে,
তুষিতে প্রত্যূষে আজি ঋতু-রাজেশ্বরে !
দেখ, মীলি,ভক্ত জন, ভক্তির নয়নে,
অধোগামী দেব-গ্রাম উজ্জ্বল-অম্বরে,—
আসিছেন সবে হেথা–এই দোলাসনে–
পূজিতে রাখালরাজ—রাধা-মনোহরে !
স্বর্গীয় বাজনা ওই ! পিককুল কবে,
কবে বা মধুপ, করে হেন মধু-ধ্বনি ?
কিন্নরের বীনা-তান অপ্সরার রবে !
আনন্দে কুসুম-সাজ ধরেন ধরণী,—
নন্দন-কানন-জাত পরিমল ভবে
বিতরেন বায়ু-ইন্দ্র পবন আপনি !
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 2 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-5-177x300.jpg)
দ্বেষ – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
শত ধিক্ সে মনেরে, কাতর যে মনঃ
পরের সুখেতে সদা এ ভব-ভবনে !
মোর মতে নর-কুলে কলঙ্ক সে জন
পোড়ে আঁখি যার যেন বিষ-বরিষণে,
বিকশে কুসুম যদি, গায় পিক-গণে
বাসন্ত আমোদে পূরি ভাগ্যের কানন
পরের! কি গুণ দেখে, কব তা কেমনে,
প্রসাদ তোমার, রম, কর বিতরণ
তুমি ? কিন্তু এ প্রসাদ, নমি যোড় করে
মাগি রাঙা পায়ে, দেবি; দ্বেষের অনলে
( সে মহানরক ভবে!) সুখী দেখি পরে,
দাসের পরাণ যেন কভু নাহি জ্বলে,
যদিও না পাত তুমি তার ক্ষুদ্র ঘরে
রত্ন-সিংহাসন, মা গো, কুভাগ্যের বলে!
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 3 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-4-212x300.jpg)
নদী-তীরে প্রাচীন দ্বাদশ শিব-মন্দির – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
এ মন্দির-বৃন্দ হেথা কে নির্ম্মিল কবে?
কোন্ জন?কোন্ কালে?জিজ্ঞাসিব কারে?
কহ মোরে কহ তুমি কল কল রবে,
ভুলে যদি,কল্লোলিনি,না থাক লো তারে।
এ দেউল-বর্গ গাঁথি উৎসর্গিল যবে
সে জন,ভাবিল কি সে,মাতি অহঙ্কারে,
থাকিবে এ কীর্ত্তি তার চিরদিন ভবে,
দীপরূপে আলো করি বিস্মৃতি-আঁধারে?
বৃথা ভাব,প্রবাহিণি,দেখ ভাবি মনে।
কি আছে লো চিরস্থায়ী এ ভবমণ্ডলে?
গুঁড়া হয়ে উড়ি যায় কালের ফীড়নে
পাথর;হুতাশে তার কি ধাতু না গলে?—
কোথা সে?কোথা বা নাম?ধন?লো ললনে?
হায়,গত,যথা বিম্ব তব চল জলে!
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 4 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-3-297x300.jpg)
নন্দন-কানন – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
লও দাসে, হে ভারতি, নন্দন-কাননে,
যথা ফোটে পারিজাত ; যথায় উৰ্ব্বশী,—
কামের আকাশে বামা চির-পূর্ণ-শশী,—
নাচে করতালি দিয়া বীণার স্বননে ;
যথা রম্ভা, তিলোত্তমা, অলকা রূপসী
মোহে মনঃ সুমধুর স্বর বরিষণে ,—
মন্দাকিনী বাহিনীর স্বর্ণ তীরে বসি,
মিশায়ে সু-কণ্ঠ-রব বীচির বচনে !
যথায় শিশিরের বিন্দু ফুল্ল ফুল-দলে
সদা সদ্যঃ ; যথা অলি সতত গুঞ্জরে ;
বহে যথা সমীরণ বহি পরিমলে ;
বসি যথা শাখা-মুখে কোকিল কুহরে ;
লও দাসে ; আঁখি দিয়া দেখি তব বলে
ভাব-পটে কল্পনা যা সদা চিত্র করে।
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 5 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-2-282x300.jpg)
নিকুঞ্জবনে – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
(১)
যমুনা পুলিনে আমি ভ্রমি একাকিনী,
হে নিকুঞ্জবন,
না পাইয়া ব্রজেশ্বরে, আইনু হেথা সত্বরে,
হে সখে, দেখাও মোরে ব্রজের রঞ্জন!
সুধাংশু সুধার হেতু, বাঁধিয়ে আশার সেতু,
কুমুদীর মনঃ যতা উঠে গো গগনে,
হেরিতে মুরলীধর— রূপে যিনি শশধর—
আসিয়াছি আমি দাসী তোমার সদনে—
তুমি হে অম্বর, কুঞ্জবর, তব চাঁদ নন্দের নন্দন!
(২)
তুমি জান কত ভাল বাসি শ্যামধনে
আমি অভাগিনী;
তুমি জান, সুভাজন, হে কুঞ্জকুল রাজন,
এ দাসীরে কত ভাল বাসিতেন তিনি!
তোমার কুসুমালয়ে যবে গো অতিথি হয়ে,
বাজায়ে বাঁশরী ব্রজ মোহিত মোহন,
তুমি জান কোন ধনী শুনি সে মধুর ধ্বনি,
অমনি আসি সেবিত ও রাঙা চরণ,
যথা শুনি জলদ-নিনাদ ধায় রড়ে প্রমদা শিখিনী।
(৩)
সে কালে—জ্বলে রে মনঃ স্মরিলে সে কথা,
মঞ্জু কুঞ্জবন,—
ছায়া তব সহচরী সোহাগে বসাতো ধরি
মাধবে অধীনী সহ পাতি ফুলাসন;
মুঞ্জরিত তরুবলী, গুঞ্জরিত যত অলি,
কুসুম-কামিনী তুলি ঘোমটা অমনি,
মলয়ে সৌরভধন বিতরিত অনুক্ষণ,
দাতা যথা রাজেন্দ্রনন্দিনী—গন্ধামোদে মোদিয়া কানন!
(৪)
পঞ্চস্বরে কত যে গাইত পিকবর
মদন-কীর্ত্তন,—
হেরি মম শ্যাম-ধন ভাবি তারে নবঘন,
কত যে নাচিত সুখে শিখিনী, কানন,—
ভুলিতে কি পারি তাহা, দেখেছি শুনেছি যাহা?
রয়েছে সে সব লেখা রাধিকার মনে।
নলিনী ভুলিবে যবে রবি-দেবে, রাধা তবে
ভুলিবে, হে মঞ্জু কুঞ্জ, ব্রজের রঞ্জনে।
হায় রে, কে জানে যদি ভুলি যবে আসি গ্রাসিবে শমন।
(৫)
কহ, সখে, জান যদি কোথা গুণমণি—
রাধিকারমণ?
কাম-বঁধু যথা মধু তুমি হে শ্যামের বঁধু
একাকী আজি গো তুমি কিসের কারণ,—
হে বসন্ত, কোথা আজি তোমার মদন?
তব পদে বিলাপিনী কাঁদি আমি অভাগিনী,
কোথা মম শ্যামমণি—কহ কুঞ্জবর!
তোমার হৃদয় দয়া, পদ্মে যথা পদ্মালয়া,
বধো না রাধার প্রাণ না দিয়া উত্তর!
মধু কহে, শুন ব্রজাঙ্গনে, মধুপুরে শ্রীমধুসূদন!
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 6 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-1-208x300.jpg)
নিশা – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
বসন্তে কুসুম-কুল যথা বনস্থলে,
চেয়ে দেখ, তারাচয় ফুটিছে গগনে,
মৃগাক্ষি !— সুহাস-মুখে সরসীর জলে,
চন্দ্রিমা করিছে কেলি প্রেমানন্দ-মনে।
কত যে কি কহিতেছে মধুর স্বননে
পবন— বনের কবি, ফুল্ল ফুল-দলে,
বুঝিতে কি পার, প্রিয়ে ? নারিবে কেমনে,
প্ৰেম-ফুলেশ্বরী তুমি প্রমদা-মণ্ডলে?
এ হৃদয়, দেখ, এবে ওই সরোবরে,—
চন্দ্রিমার রূপে এতে তোমার মূরতি !
কাল বলি অবহেলা, প্রেয়সি, যে করে
নিশায়, আমার মতে সে বড় দুৰ্ম্মতি।
হেন সুবাসিত শ্বাস, হাস স্নিগ্ধ করে
যার, সে কি কভু মন্দ, ওলো রসবতি?
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 7 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-7-300x300.jpg)
নিশাকালে নদী-তীরে বট-বৃক্ষ-তলে শিব-মন্দির – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
রাজসূয়-যজ্ঞে যথা রাজাদল চলে
রতন-মুকুট শিরে ; আসিছে সঘনে
অগন্য জোনাকীব্রজ, এই তরুতলে
পূজিতে রজনী-যোগে বৃষভ-বাহনে।
ধূপরূপ পরিমল অদূর কাননে
পেয়ে, বহিতেছে তাহে হেথা কুতূহলে
মলয় ; কৌমুদী, দেখ, রজত-চরণে
বীচি-রব-রূপ পরি নূপুর, চঞ্চলে
নাচিছে; আচাৰ্য্য-রূপে এই তরু-পতি
উচ্চারিছে বীজমন্ত্র। নীরবে অম্বরে,
তারাদলে তারানাথ করেন প্রণতি
(বোধ হয়) আরাধিয়া দেবেশ শঙ্করে !
তুমিও, লো কল্লোলিনি, মহাব্ৰতে ব্ৰতী,—
সাজায়েছ, দিব্য সাজে, বর-কলেবরে !
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 8 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-6-300x293.jpg)
নূতন বৎসর – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
ভূত-রূপ সিন্ধু-জলে গড়ায়ে পড়িল
বৎসর, কালের ঢেউ, ঢেউর গমনে।
নিত্যগামী রথচক্র নীরবে ঘুরিল
আবার আয়ুর পথে। হৃদয়-কাননে,
কত শত আশা-লতা শুখায়ে মরিল,
হায় রে, কব তা কারে, কব তা কেমনে!
কি সাহসে আবার বা রোপিব যতনে ।
সে বীজ, যে বীজ ভূতে বিফল হইল!
বাড়িতে লাগিল বেলা ; ডুবিবে সত্বরে
তিমিরে জীবন-রবি। আসিছে রজনী,
নাহি যার মুখে কথা বায়ু-রূপ স্বরে ;
নাহি যার কেশ-পাশে তারা-রূপ মণি ;
চির-রুদ্ধ দ্বার যার নাহি মুক্ত করে
ঊষা,—তপনের দূতী, অরুণ-রমণী!
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 2 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-5-177x300.jpg)
পরেশনাথ গিরি – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
হেরি দূরে উর্দ্ধশিরঃ তোমার গগনে,
অচল, চিত্রিত পটে জীমূত যেমতি।
ব্যোমকেশ তুমি কি হে, (এই ভাবি মনে)
মজি তপে, ধরেছ ও পাষাণ-মূরতি?
এ হেন ভীষণ কায়া কার বিশ্বজনে?
তবে যদি নহ তুমি দেব উমাপতি,
কহ, কোন্ রাজবীর তপোব্রতে ব্ৰতী—
খচিত শিলার বর্ম্ম কুসুম-রতনে
তোমার? যে হর-শিরে শশিকলা হাসে,
সে হর কিরীটরূপে তব পুণ্য শিরে,
চিরবাসী, যেন বাঁধা চিরপ্রেমপাশে!
হেরিলে তোমায় মনে পড়ে ফাল্গুনিরে
সেবিলা বীরেশ যবে পাশুপত আশে
ইন্দ্ৰকীল নীলচূড়ে দেব ধূর্জ্জটিরে।
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 3 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-4-212x300.jpg)
পুরুরবা – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
যথা ঘোর বনে ব্যাধ বধি অজাগরে,
চিরি শিরঃ তার, লভে অমূল রতনে ;
বিমুখি কেশীরে আজি, হে রাজা, সমরে,
লভিলা ভুবন-লোভ তুমি কাম-ধনে !
হে সুভগ, যাত্রা তব বড় শুভ ক্ষণে !—
ঐ যে দেখিছ এবে, গিরির উপরে,
আচ্ছন্ন, হে মহীপতি, মূৰ্চ্ছা-রূপ ঘনে
চাঁদেরে, কে ও, তা জান ? জিজ্ঞাস সত্বরে,
পরিচয় দেবে সখী, সমুখে যে বসি ।
মানসে কমল, বলি, দেখেছ নয়নে ;
দেখেছ পূর্ণিমা-রাত্রে শরদের শশী ;
বধিয়াছ দীর্ঘ-শৃঙ্গী কুরঙ্গে কাননে;—
সে সকলে ধিক্ মান ! ওই হে উৰ্ব্বশী !
সোণার পুতলি যেন, পড়ি অচেতনে।
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 4 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-3-297x300.jpg)
পুরুলিয়া – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
পাষাণময় যে দেশ, সে দেশে পড়িলে
বীজকুল, শস্য তথা কখন কি ফলে?
কিন্তু কত মনানন্দ তুমি মোরে দিলে,
হে পুরুল্যে!দেখাইয়া ভকত-মণ্ডলে!
শ্ৰীভ্রষ্ট সরস সম, হায়, তুমি ছিলে,
অজ্ঞান-তিমিরাচ্ছন্ন এ দূর জঙ্গলে;
অজ্ঞান-তিমিরাচ্ছন্ন এ দূর জঙ্গলে;
এবে রাশি রাশি পদ্ম ফোটে তব জলে,
পরিমল-ধনে ধনী করিয়া অনিলে!
প্রভুর কি অনুগ্রহ! দেখ ভাবি মনে,
(কত ভাগ্যবান্ তুমি কব তা কাহারে?)
রাজাসন দিলা তিনি ভূপতিত জনে!
উজলিলা মুখ তব বঙ্গের সংসারে;
বাড়ুক সৌভাগ্য তব এ প্রার্থনা করি,
ভাসুক সত্যতা-স্রোতে নিত্য তব তরি।
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 5 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-2-282x300.jpg)
পৃথিবী – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
১
হে বসুধে, জগৎজননি!
দয়াময়ী তুমি, সতি, বিদিত ভুবনে!
যবে দশানন অরি,
বিসৰ্জ্জিলা হুতাশনে জানকী সুন্দরী,
তুমি গো রাখিলা বরাননে।
তুমি, ধনি, দ্বিধা হয়ে, বৈদেহীরে কোলে লয়ে,
জুড়ালে তাহার জ্বালা বাসুকি-রমণি!
২
হে বসুধে, রাধা বিরহিণী!
তার প্রতি আজি তুমি বাম কি কারণে?
শ্যামের বিরহানলে, সুভগে, অভাগা জ্বলে,
তারে যে কর না তুমি মনে?
পুড়িছে অবলা বালা, কে সম্বরে তার জ্বালা,
হায়, এ কি রীতি তব, হে ঋতু কামিনি!
৩
শমীর হৃদয়ে অগ্নি জ্বলে—
কিন্তু সে কি বিরহ-অনল, বসুন্ধরে?
তা হলে বন-শোভিনী
জীবন যৌবন তাপে হারাত তাপিনী—
বিরহ দুরূহ দুহে হরে!
পুড়ি আমি অভাগিনী, চেয়ে দেখ না মেদিনি,
পুড়ে যথা বনস্থলী ঘোর দাবানলে!
৪
আপনি তো জান গো ধরণি
তুমিও তো ভালবাস ঋতুকুলপতি!
তার শুভ আগমনে
হাসিয়া সাজহ তুমি নানা আভরণে—
কামে পেলে সাজে যথা রতি!
অলকে ঝলকে কত ফুল-রত্ন শত শত!
তাহার বিরহ দুঃখ ভেবে দেখ, ধনি!
৫
লোকে বলে রাধা কলঙ্কিনী!
তুমি তারে ঘৃণা কেনে কর, সীমন্তিনি?
অনন্ত, জলধি নিধি—
এই দুই বরে তোমা দিয়াছেন বিধি,
তবু তুমি মধুবিলাসিনী!
শ্যাম মম প্রাণ স্বামী— শ্যামে হারায়েছি আমি,
আমার দুঃখে কি তুমি হও না দুঃখিনী?
৬
হে মহি, এ অবোধ পরাণ
কেমনে করিব স্থির কহ গো আমারে?
বসন্তরাজ বিহনে
কেমনে বাঁচ গো তুমি—কি ভাবিয়া মনে—
শেখাও সে সব রাধিকারে!
মধু কহে, হে সুন্দরি, থাক হে ধৈরয ধরি,
কালে মধু বমুধারে করে মধুদান!
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 6 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-1-208x300.jpg)
প্রতিধ্বনি – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
১
কে তুমি, শ্যামেরে ডাক রাধা যথা ডাকে—
হাহাকার রবে?
কে তুমি, কোন্ যুবতী, ডাক এ বিরলে, সতি,
অনাথা রাধিকা যথা ডাকে গো মাধবে?
অভয় হৃদয়ে তুমি কহ আসি মোরে—
কে না বাঁধা এ জগতে শ্যাম-প্রেম-ডোরে।
২
কুমুদিনী কায়, মনঃ সঁপে শশধরে—
ভুবনমোহন!
চকোরি শশীর পাশে, আসে সদা সুধা আশে,
নিশি হাসি বিহারয়ে লয়ে সে রতন;
এ সকল দেখিয়া কি কোপে কুমুদিনী?
স্বজনী উভয় তার—চকোরী, যামিনী!
৩
বুঝিলাম এতক্ষণে কে তুমি ডাকিছ—
আকাশ-নন্দিনি—!
পৰ্ব্বত গহন বনে, বাস তব, বরাননে,
সদা রঙ্গরসে তুমি রত, হে রঙ্গিণি!
নিরাকারা ভারতি, কে না জানে তোমারে?
এসেছ কি কাঁদিতে গো লইয়া রাধারে?
৪
জানি আমি, হে স্বজনি, ভাল বাস তুমি,
মোর শ্যামধনে!
শুনি মুরারির বাঁশী, গাইতে তুমি গো আসি,
শিখিয়া শ্যামের গীত, মঞ্জু কুঞ্জবনে!
রাধা রাধা বলি যবে ডাকিতেন হরি—
রাধা রাধা বলি তুমি ডাকিতে, সুন্দরি!
৫
যে ব্রজে শুনিতে আগে সঙ্গীতের ধ্বনি,
আকাশসম্ভবে,
ভূতলে, নন্দবন, আছিল যে বৃন্দাবন,
সে ব্রজ পূরিছে আজি হাহাকার রবে!
কত যে কাঁদে রাধিকা কি কব, স্বজনি,
চক্রবাকী সে—এ তার বিরহ রজনী!
৬
এস, সখি, তুমি আমি ডাকি দুই জনে
রাধা-বিনোদন;
যদি এ দাসীর রব, কুরব ভেবে মাধব
না শুনেন, শুনিবেন তোমার বচন!
কত শত বিহঙ্গিনী ডাকে ঋতুবরে—
কোকিলা ডাকিলে তিনি আসেন সত্বরে!
৭
না উত্তরি মোরে, রামা, যাহা আমি বলি,
তাই তুমি বল?
জানি পরিহাসে রত, রঙ্গিণি, তুমি সতত,
কিন্তু আজি উচিত কি তোমার এ ছল?
মধু কহে, এই রীতি ধরে প্রতিধ্বনি,—
কাঁদ, কাঁদে ; হাস, হাসে, মাধব-রমণি!
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 7 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-7-300x300.jpg)
প্রস্তাবনা – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
রাগিণী খাম্বাজ,তাল মধ্যমান
মরি হায়,কোথা সে সুখের সময়,
সে সময় দেশময় নাট্যরস সবিশেষ ছিল রসময়!
শুন গো ভারতভূতি,
কত নিদ্রা যাবে তুমি,
আর নিদ্রা উচিত না হয়।
উঠ ত্যজ ঘুম ঘোর,
হইল,হইল ভোর,
দিনকর প্রাচীতে উদয়।
কোথায় বাল্মীকি,ব্যাস,
কোথা তব কালিদাস,
কোথা ভবভূতি মহোদয়।
অলীক কুনাট্য রঙ্গে,
মজে লোক রাঢ়ে বঙ্গে,
নিরখিয়া প্রাণে নাহি সয়।
সুধারস অনাদরে,
বিষবারি পান করে,
তাহে হয় তনু মনঃ ক্ষয়।
মধু বলে জাগ মা গো,
বিভু স্থানে এই মাগ,
সুরসে প্রবৃত্ত হউক তব তনয় নিচয়।।
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 2 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-5-177x300.jpg)
প্রাণ – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
কি সুরাজ্যে, প্রাণ, তব রাজ-সিংহাসন !
বাহু-রূপে দুই রথী, দুর্জয় সমরে,
বিধির বিধানে পুরী তব রক্ষা করে ;—
পঞ্চ অনুচর তোমা সেবে অনুক্ষণ ।
সুহাসে ঘ্ৰাণেরে গন্ধ দেয় ফুলবন ;
যতনে শ্রবণ আনে সুমধুর স্বরে ;
সুন্দর যা কিছু আছে, দেখায় দর্শন
ভূতলে, সুনীল নভে, সৰ্ব্ব চরাচরে !
স্পর্শ, স্বাদ, সদা ভোগ যোগায়, সুমতি !
পদরূপে দুই বাজী তব রাজ-দ্বারে ;
জ্ঞান-দেব মন্ত্রী তব—ভবে বৃহস্পতি ;—
সরস্বতী অবতার রসনা সংসারে !
স্বর্ণস্রোতোরূপে লহু, অবিরল-গতি,
বহি অঙ্গে, রঙ্গে ধনী করে হে তোমারে !
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 3 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-4-212x300.jpg)
বউ কথা কও – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
কি দুখে,হে পাখি,তুমি শাখার উপরে
বসি,বউ কথা কও,কও এ কাননে?—-
মানিনী ভামিনী কি হে,ভামের গুমরে,
পাখা-রূপ ঘোমটায় ঢেকেছে বদনে?
তেঁই সাধ তারে তুমি মিনতি-বচনে?
তেঁই হে এ কথাগুলি কহিছ কাতরে?
বড়ই কৌতুক,পাখি,জনমে এ মনে—
নর-নারী-রঙ্গ কি হে বিহঙ্গিনী করে?
সত্য যদি,তবে শুন,দিতেছি যুকতি;
(শিখাইব শিখেছি যা ঠেকি এ কু-দায়ে)
পবনের বেগে যাও যথায় যুবতী;
”ক্ষম,প্রিয়ে” এই বলি পড় গিয়া পায়ে!—
কভু দাস,কভু প্রভু,শুন,ক্ষুণ্ণ-মতি,
প্রেম-রাজ্যে রাজাসন থাকে এ উপায়ে।।
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 4 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-3-297x300.jpg)
বঙ্গভাষা – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন;
তা সবে, (অবোধ আমি!) অবহেলা করি,
পর-ধন-লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ
পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি।
কাটাইনু বহু দিন সুখ পরিহরি।
অনিদ্রায়, নিরাহারে সঁপি কায়, মনঃ
মজিনু বিফল তপে অবরেণ্যে বরি; –
কেলিনু শৈবালে; ভুলি কমল-কানন!
স্বপ্নে তব কুললক্ষ্মী কয়ে দিলা পরে –
“ওরে বাছা, মাতৃকোষে রতনের রাজি,
এ ভিখারী-দশা তবে কেন তোর আজি?
যা ফিরি, অজ্ঞান তুই, যা রে ফিরি ঘরে!”
পালিলাম আজ্ঞা সুখে; পাইলাম কালে
মাতৃ-ভাষা-রূপে খনি, পূর্ণ মণিজালে।
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 5 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-2-282x300.jpg)
বঙ্গভূমির প্রতি – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
রেখো মা দাসেরে মনে, এ মিনতি করি পদে
সাধিতে মনের সাধ,
ঘটে যদি পরমাদ,
মধুহীন করো না গো তব মনঃকোকনদে।
প্রবাসে দৈবের বশে,
জীব-তারা যদি খসে
এ দেহ-আকাশ হতে, – খেদ নাহি তাহে।
জন্মিলে মরিতে হবে,
অমর কে কোথা কবে,
চিরস্থির কবে নীর, হায় রে, জীবন-নদে?
কিন্তু যদি রাখ মনে,
নাহি, মা, ডরি শমনে;
মক্ষিকাও গলে না গো, পড়িলে অমৃত-হ্রদে!
সেই ধন্য নরকুলে,
লোকে যারে নাহি ভুলে,
মনের মন্দিরে সদা সেবে সর্ব্বজন; –
কিন্তু কোন্ গুণ আছে,
যাচিব যে তব কাছে,
হেন অমরতা আমি, কহ, গো, শ্যামা জন্মদে!
তবে যদি দয়া কর,
ভুল দোষ, গুণ ধর,
অমর করিয়া বর দেহ দাসে, সুবরদে! –
ফুটি যেন স্মৃতি-জলে,
মানসে, মা, যথা ফলে
মধুময় তামরস কি বসন্ত, কি শরদে!
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 6 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-1-208x300.jpg)
বটবৃক্ষ – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
দেব-অবতার ভাবি বন্দে যে তোমারে,
নাহি চাহে মনঃ মোর তাহে নিন্দা করি,
তরুরাজ ! প্রত্যক্ষতঃ ভারত-সংসারে,
বিধির করুণা তুমি তরু-রূপ ধরি !
জীবকুল-হিতৈষিণী, ছায়া সু-সুন্দরী,
তোমার দুহিতা, সাধু ! যবে বসুধারে
দগধে আগ্নেয় তাপে, দয়া পরিহরি,
মিহির, আকুল জীব বাঁচে পূজি তাঁরে।
শত-পত্রময় মঞ্চে, তোমার সদনে,
খেচর—অতিথি-ব্রজ, বিরাজে সতত,
পদ্মরাগ ফলপুঞ্জে ভুঞ্জি হৃষ্ট-মনে ;—
মৃদু-ভাষে মিষ্টালাপ কর তুমি কত,
মিষ্টালাপি, দেহ-দাহ শীতলি যতনে !
দেব নহ; কিন্তু গুণে দেবতার মত।
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 7 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-7-300x300.jpg)
বর্ষাকাল – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
গভীর গর্জ্জন সদা করে জলধর,
উথলিল নদনদী ধরণী উপর ।
রমণী রমণ লয়ে, সুখে কেলি করে,
দানবাদি দেব, যক্ষ সুখিত অন্তরে।
সমীরণ ঘন ঘন ঝন ঝন রব,
বরুণ প্রবল দেখি প্রবল প্রভাব ।
স্বাধীন হইয়া পাছে পরাধীন হয়,
কলহ করয়ে কোন মতে শান্ত নয়।।
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 8 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-6-300x293.jpg)
বংশী-ধ্বনি – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
১
নাচিছে কদম্বমূলে,
বাজায়ে মুরলী,রে,
রাধিকারমণ!
চল,সখি,ত্বরা করি,
দেখিগে প্রাণের হরি,
ব্রজের রতন!
চাতকী আমি স্বজনি,
শুনি জলধর-ধ্বনি
কেমনে ধৈরজ ধরি থাকি লো এখন?
যাক্ মান,যাক্ কুল,
মন-তরী পাবে কূল;
চল,ভাসি প্রেমনীরে,ভেবে ও চরণ!
২
মানস সরসে,সখি,
ভাসিছে মরাল রে,
কমল কাননে!
কমলিনী কোন্ ছলে,
থাকিবে ডুবিয়া জলে,
বঞ্চিয়া রমণে?
যে যাহারে ভাল বাসে,
যে যাইবে তার পাশে—
মদন রাজার বিধি লঙ্ঘিব কেমনে?
যদি অবহেলা করি,
রুষিবে শম্বর-অরি;
কে সম্বরে স্মর-শরে এ তিন ভুবনে!
৩
ওই শুন,পুনঃ বাজে
মজাইয়া মন,রে,
মুরারির বাঁশী!
সুমন্দ মলয় আনে
ও নিনাদ মোর কাণে—
আমি শ্যাম-দাসী।
জলদ গরজে যবে,
ময়ূরী নাচে সে রবে;—
আমি কেন না কাটিব শরমের ফাঁসি?
সৌদামিনী ঘন সনে,
ভ্রমে সদানন্দ মনে;—
রাধিকা কেন ত্যজিবে রাধিকাবিলাসী।
৪
ফুটিছে কুসুমকুল
মুঞ্জু কুঞ্জবনে,রে,
যথা গুণমণি!
হেরি মোর শ্যামচাঁদ,
পীরিতের ফুল ফাঁদ,
পাতে লো ধরণী!
কি লজ্জা!হা ধিক্ তারে,
ছয় ঋতু বরে যারে,
আমার প্রাণের ধন লোভে সে রমণী?
চল,সখি,শীঘ্র যাই,
পাছে মাধবে হারাই,—
মণিহারা ফণিনী কি বাঁচে লো স্বজনি?
৫
সাগর উদ্দেশে নদী
ভ্রমে দেশে দেশে,রে,
অবিরাম গতি—
গগনে উদিলে শশী,
হাসি যেন পড়ে খসি,
নিশি রূপবতী;
আমার প্রেম-সাগর,
দুয়ারে মোর নাগর,
তাবে ছেড়ে রব আমি?ধিক্ এ কুমতি!
আমার সুধাংশু নিধি—
দিয়াছে আমায় বিধি—
বিরহ আঁধারে আমি?ধিক্ এ যুকতি!
৬
নাচিছে কদম্বমূলে,
বাজায়ে মুরলী,রে,
রাধিকারমণ!
চল,সখি,ত্বরা করি,
দেখিগে প্রাণের হরি,
গোকুল রতন!
মধু কহে ব্রজাঙ্গনে,
স্মরি ও রাঙা চরণে,
যাও যথা ডাকে তোমা শ্রীমধুসূদন!
যৌবন মধুর কাল,
আশু বিনাশিবে কাল,
কালে পিও প্রেমমধু করিয়া যতন।
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 2 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-5-177x300.jpg)
বংশীধ্বনি – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
১
কে ও বাজাইছে বাঁশী, স্বজনি,
মৃদু মৃদু স্বরে নিকুঞ্জবনে?
নিবার উহারে ; শুনি ও ধ্বনি
দ্বিগুণ আগুন জ্বলে লো মনে?–
এ আগুনে কেনে অাহুতি দান?
অমনি নারে কি জ্বালাতে প্রাণ?
২
বসন্ত অন্তে কি কোকিলা গায়
পল্লব—বসনা শাখা-সদনে?
নীরবে নিবিড় নীড়ে সে যায়—
বাঁশীধ্বনি আজি নিকুঞ্জবনে?
হায়, ও কি আর গীত গাইছে?
না হেরি শ্যামে ও বাঁশী কাঁদিছে?
৩
শুনিয়াছি, সই, ইন্দ্র রুষিয়া
গিরিকুল-পাখা কাটিলা যবে,
সাগরে অনেক নগ পশিয়া
রহিল ডুবিয়া—জলধিভবে।
সে শৈল সকল শির উচ্চ করি
নাশে এবে সিন্ধুগামিনী তরী।
৪
কি জানি কেমনে প্রেমসাগরে
বিচ্ছেদ-পাহাড় পশিল আসি?
কার প্রেমতরী নাশ না করে—
ব্যাধ যেন পাখী পাতিয়া ফাঁসি—
কার প্রেমতরী মগনে না জলে
বিচ্ছেদ-পাহাড়—-বলে কি ছলে!
৫
হায় লো সখি, কি হবে স্মরিলে
গত সুখ? তারে পাব কি আর?
বাসি ফুলে কি লো সৌরভ মিলে?
ভুলিলে ভাল যা—-স্মরণ তার?
মধুরাজে ভেবে নিদাঘ-জ্বালা,
কহে মধু, সহ, ব্রজের বালা!
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 3 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-4-212x300.jpg)
বসন্তে-১ – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
(১)
ফুটিল বকুলকুল কেন লো গোকুলে আজি,
কহ তা, স্বজনি?
আইলা কি ঋতুরাজ? ধরিলা কি ফুলসাজ,
বিলাসে ধরণী?
মুছিয়া নয়ন-জল, চল লো সকলে চল,
শুনিব তমাল তলে বেণুর সুরব;—
আইল বসন্ত যদি, আসিবে মাধব!
(২)
যে কালে ফুটে লো ফুল, কোকিল কুহরে, সই,
কুসুমকাননে,
মুঞ্জরয়ে তরুবলী, গুঞ্জরয়ে সুখে অলি,
প্রেমানন্দ মনে,
সে কালে কি বিনোদিয়া, প্রেমে জলাঞ্জলি দিয়া,
ভুলিতে পারেন, সখি, গোকুলভবন?
চল লো নিকুঞ্জবনে পাইব সে ধন!
(৩)
স্বন, স্বন, স্বনে শুন, বহিছে পবন, সই,
গহন কাননে,
হেরি শ্যামে পাই প্ৰীত, গাইছে মঙ্গল গীত,
বিহঙ্গমগণে!
কুবলয় পরিমল, নহে এ ; স্বজনি, চল,—
ও সুগন্ধ দেহগন্ধ বহিছে পবন।
হায় লো, শ্যামের বপুঃ সৌরভসদন!
(৪)
উচ্চ বীচি রবে, শুন, ডাকিছে যমুনা ওই
রাধায়, স্বজনি;
কল কল কল কলে, সুতরঙ্গ দল চলে,
যথা গুণমণি।
সুধাকর-কররাশি সম লো শ্যামের হাসি,
শোভিছে তরল জলে; চল, ত্বরা করি—
ভুলি গে বিরহ-জ্বালা হেরি প্রাণহরি!
(৫)
ভ্রমর গুঞ্জরে যথা ; গায় পিকবর, সই,
সুমধুর বোলে;
মরমরে পাতাদল; মৃদুরবে বহে জল
মলয় হিল্লোলে;—
কুসুম-যুবতী হাসে, মোদি দশ দিশ বাসে,—
কি সুখ লভিব, সখি, দেখ ভাবি মনে,
পাই যদি হেন স্থলে গোকুলরতনে?
(৬)
কেন এ বিলম্ব আজি, কহ ওলো সহচরি,
করি এ মিনতি?
কেন অধোমুখে কাঁদ, আবরি বদনচাঁদ,
কহ, রূপবতি?
সদা মোর সুখে সুখী, তুমি ওলো বিধুমুখি,
আজি লো এ রীতি তব কিসের কারণে?
কে বিলম্বে হেন কালে? চল কুঞ্জবনে!
(৭)
কাঁদিব লো সহচরি, ধরি সে কমলপদ,
চল, ত্বরা করি,
দেখিব কি মিষ্ট হাসে, শুনিব কি মিষ্ট ভাষে,
তোষেন শ্রীহরি
দুঃখিনী দাসীরে; চল, হইমু লো হতবল,
ধীরে ধীরে ধরি মোরে, চল লো স্বজনি ;–
সুধে—মধু শূন্য কুঞ্জে কি কাজ, রমণি?
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 4 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-3-297x300.jpg)
বসন্তে ২ – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
১
সখি রে,—
বন অতি রমিত হইল ফুল ফুটনে!
পিককুল কলকল, চঞ্চল অলিদল,
উছলে সুরবে জল,
চল লো বনে!
চল লো, জুড়াব আঁখি দেখি ব্ৰজরমণে!
২
সখি রে,—
উদয় অচলে ঊষা, দেখ, আসি হাসিছে!
এ বিরহ বিভাবরী কাটানু ধৈরজ ধরি
এবে লো রব কি করি?
প্রাণ কাঁদিছে!
চল লো নিকুঞ্জে যথা কুঞ্জমণি নাচিছে!
৩
সখি রে,—
পূজে ঋতুরাজে আজি ফুলজালে ধরণী!
ধূপরূপে পরিমল, আমোদিছে বনস্থল,
বিহঙ্গমকুলকল,
মঙ্গল ধ্বনি!
চল লো, নিকুঞ্জ পূজি শ্যামরাজে, স্বজনি!
৪
সখি রে,—
পাদ্যরূপে অশ্রুধারা দিয়া ধোব চরণে!
দুই কর কোকনদে, পূজিব রাজীব পদে;
শ্বাসে ধূপ, লো প্রমদে,
ভাবিয়া মনে!
কঙ্কণ কিঙ্কিণী ধ্বনি বাজিবে লো সঘনে।
৫
সখি রে,—
এ যৌবন ধন, দিব উপহার রমণে!
ভালে যে সিন্দূরবিন্দু, হইবে চন্দনবিন্দু;—
দেখিব লো দশ ইন্দু
সুনখগণে!
চিরপ্রেম বর মাগি লব, ওলো ললনে!
৬
সখি রে,—
বন অতি রমিত হইল ফুল ফুটনে!
পিককুল কলকল, চঞ্চল অলিদল
উছলে সুরবে জল,
চল লো বনে!
চল লো, জুড়াব আঁখি দেখি—মধুসূদনে!
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 5 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-2-282x300.jpg)
বসন্তের একটি পাখীর প্রতি – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
নহ তুমি পিক, পাখি, বিখ্যাত ভারতে,
মাধবের বাৰ্ত্তাবহ ; যার কুহরণে
ফোটে কোটি ফুল-পুঞ্জ মঞ্জু কুঞ্জবনে !—
তবুও সঙ্গীত-রঙ্গ করিছ যে মতে
গায়ক, পুলক তাহে জনমে এ মনে !
মধুময় মধুকাল সৰ্ব্বত্র জগতে ,—
কে কোথা মলিন কবে মধুর মিলনে,
বসুমতী সতী যবে রত প্রেমব্রতে?—
দুরন্ত কৃতান্ত-সম হেমন্ত এ দেশে
নিৰ্দ্দয় ; ধরার কষ্টে দুষ্ট তুষ্ট অতি !
না দেয় শোভিতে কভু ফুলরত্মে কেশে,
পরায় ধবল বাস বৈধব্যে যেমতি !—
ডাক তুমি ঋতুরাজে, মনোহর বেশে
সাজাতে ধরায় আসি, ডাক শীঘ্ৰগতি !
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 6 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-1-208x300.jpg)
বাল্মীকি – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
স্বপনে ভ্রমিনু আমি গহন কাননে
একাকী ৷ দেখিনু দূরে যুব এক জন,
দাঁড়ায়ে তাহার কাছে প্রাচীন ব্রাহ্মণ—
দ্রোণ যেন ভয়-শূন্য কুরুক্ষেত্র-রণে ৷
”চাহিস্ বধিতে মোরে কিসের কারণে?”
জিজ্ঞাসিলা দ্বিজবর মধুর বচনে ৷
”বধি তোমা হরি আমি লব তব ধন,”
উত্তরিলা যুব জন ভীম গরজনে ৷—
পরিবরতিল স্বপ্ন ৷ শুনিনু সত্বরে
সুধাময় গীত-ধ্বনি,আপনি ভারতী,
মোহিতে ব্রহ্মার মনঃ,স্বর্ণ বীণা করে,
আরম্ভিলা গীত যেন—মনোহর অতি!
সে দুরন্ত যুব জন,সে বৃদ্ধের বরে,
হইল,ভারত,তব কবি-কুল-পতি!
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 7 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-7-300x300.jpg)
বিজয়া-দশমী – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
”যেয়ো না,রজনি,আজি লয়ে তারাদলে!
গেলে তুমি,দয়াময়ি,এ পরাণ যাবে!-
উদিলে নির্দ্দয় রবি উদয়-অচলে,
নয়নের মণি মোর নয়ন হারাবে!
বার মাস তিতি,সত্যি,নিত্য অশ্রুজলে,
পেয়েছি উমায় আমি!কি সান্ত্বনা-ভাবে-
তিনটি দিনেতে,কহ,লো তারা-কুন্তলে,
এ দীর্ঘ বিরহ-জ্বালা এ মন জুড়াবে?
তিন দিন স্বর্ণদীপ জ্বলিতেছে ঘরে
দূর করি অন্ধকার;শুনিতেছি বাণী-
মিষ্টতম এ সৃষ্টিতে এ কর্ণ-কুহরে!
দ্বিগুণ আঁধার ঘর হবে,আমি জানি,
নিবাও এ দীপ যদি!”- কহিলা কাতরে
নবমীর নিশা-শেষে গিরীশের রাণী।
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 8 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-6-300x293.jpg)
বীর-রস – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
ভৈরব-আকৃতি শূরে দেখিনু নয়নে
গিরি-শিরে ; বায়ু-রথে, পূর্ণ ইরম্মদে,
প্রলয়ের মেঘ যেন! ভীম শরাসনে
ধরি বাম করে বীর, মত্ত বীর-মদে,
টঙ্কারিছে মুহুর্মুহুঃ,হুঙ্কারি ভীষণে,
ব্যোমকেশ-সম কায়;ধরাতল পদে,
রতন-মণ্ডিত শিরঃ ঠেকিছে গগনে,
বিজলী-ঝলসা-রূপে উজলি জলদে।
চাঁদের পরিধি,যেন রাহুর গরাসে
ঢালখান;ঊরু-দেশে অসি তীক্ষ্ণ অতি,
চৌদিকে,বিবিধ অস্ত্র।সুধিনু তরাসে,—
”কে এ মহাজন,কহ গিরি মহামতি?”
আইল শব্দ বহি স্তব্ধ আকাশে—
”বীর-রস এ বীবেন্দ্র,রস-কুল-পতি!”
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 3 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-4-212x300.jpg)
ভারত-ভূমি – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
কে না লোভে, ফণিনীর কুন্তলে যে মণি
ভূপতিত তারারূপে, নিশাকালে ঝলে ?
কিন্তু কৃতান্তের দূত বিষদন্তে গণি,
কে করে সাহস তারে কেড়ে নিতে বলে ?
হায় লো ভারত-ভূমি! বৃথা স্বর্ণ-জলে
ধুইলা বরাঙ্গ তোর, কুরঙ্গ-নয়নি,
বিধাতা ? রতন সিঁথি গড়ায়ে কৌশলে,
সাজাইলা পোড়া ভাল তোর লো, যতনি!
নহিস্ লো বিষময়ী যেমতি সাপিনী;
রক্ষিতে অক্ষম মান প্রকৃত যে পতি ;
পুড়ি কামানলে, তোরে করে লো অধীনী
(হা ধিক্!) যবে যে ইচ্ছে, যে কামী দুৰ্ম্মতি!
কার শাপে তোর তরে, ওলো অভাগিনি,
চন্দন হইল বিষ;সুধা তিত অতি ?
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 4 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-3-297x300.jpg)
ভূত কাল – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
কোন্ মূল্য দিয়া পুনঃ কিনি ভূত কালে,
—-কোন্ মূল্য —-এ মন্ত্রণা কারে লয়ে করি?
কোন্ ধন, কোন্ মুদ্রা, কোন্ মণি-জালে
এ দুর্ল্লভ দ্রব্য-লাভ ? কোন্ দেবে স্মরি,
কোন্ যোগে,কোন্ তপে,কোন্ ধর্ম্ম করি?
আছে কি এমন জন ব্রাহ্মণে,চণ্ডালে,
এ দীক্ষা-শিক্ষার্থে যারে গুরু-পদে বরি,
এ তত্ত্ব-স্বরূপ পদ্ম পাই যে মৃণালে?—
পশে যে প্রবাহ বহি অকূল সাগরে,
ফিরি কি সে আসে পুনঃ পর্ব্বত-সদনে?
যে বারির ধারা ধরা সতৃষ্ণায় ধরে,
উঠে কি সে পুনঃ কভু বারিদাতা ঘনে?—
বর্ত্তমানে তোরে,কাল,যে জন আদরে
তার তুই!গেলে তোরে পায় কোন্ জনে?
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 5 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-2-282x300.jpg)
মধুকর – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
শুনি গুন গুন ধ্বনি তোর এ কাননে,
মধুকর,এ পরাণ কাঁদে রে বিষাদে!
ফুল-কুল-বধূ-দলে সাধিস্ যতনে
অনুক্ষণ,মাগি ভিক্ষা অতি মৃদু নাদে,
তুমকী বাজায়ে যথা রাজার তোরণে
ভিখারী,কি হেতু তুই?ক মোরে,কি সাদে
মোমের ভাণ্ডারে মধু রাখিস্ গোপনে,
ইন্দ্র যথা চন্দ্রলোকে,দানব-বিবাদে
সুধামৃত?এ আয়াসে কি সুফল ফলে?
কৃপণের ভাগ্য তোর!কৃপণ যেমতি
অনাহারে,অনিদ্রায়,সঞ্চয়ে বিকলে
বৃথা অর্থ;বিধি-বশে তোর সে দুর্গতি!
গৃহ-চ্যুত করি তোরে,লুটি লয় বলে
পর জন পরে তোর শ্রমের সঙ্গতি!
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 6 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-1-208x300.jpg)
ময়ূর ও গৌরী – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
ময়ুর কহিল কাঁদি গেীরীর চরণে,
কৈলাস-ভবনে;—
“অবধান কর দেবি,
আমি ভৃত্য নিত্য সেবি
প্রিয়োত্তম সুতে তব এ পৃষ্ঠ-আসনে।
রথী যথা দ্রুত রথে,
চলেন পবন-পথে
দাসের এ পিঠে চড়ি সেনানী সুমতি;
তবু, মা গো, আমি দুখী অতি!
করি যদি কেকাধ্বনি,
ঘৃণায় হাসে অমনি
খেচর, ভূচর জন্তু;—মরি, মা, শরমে!
ডালে মূঢ় পিক যবে
গায় গীত, তার রবে
মাতিয়া জগৎ-জন বাখানে অধমে!
বিবিধ কুসুম কেশে,
সাজি মনোহর বেশে,
বরেন বসুধা দেবী যবে ঋতুবরে
কোকিল মঙ্গল-ধ্বনি করে।
অহরহ কুহুধ্বনি বাজে বনস্থলে;
নীরবে থাকি, মা, আমি; রাগে হিয়া জ্বলে!
ঘুচাও কলঙ্ক শুভঙ্করি,
পুত্রের কিঙ্কর আমি এ মিনতি করি,
পা দুখানি ধরি।”
উত্তর করিলা গৌরী সুমধুর স্বরে;—
“পুত্রের বাহন তুমি খ্যাত চরাচরে,
এ আক্ষেপ কর কি কারণে?
হে বিহঙ্গ, অঙ্গ-কান্তি ভাবি দেখ মনে!
চন্দ্রককলাপে দেখ নিজ পুচ্ছ-দেশে;
রাখাল রাজার সম চূড়াখানি কেশে!
আখণ্ডল-ধনুর বরণে
মণ্ডিলা সু-পুচ্ছ ধাতা তোমার সৃজনে!
সদা জ্বলে তব গলে
স্বর্ণহার ঝল ঝলে,
যাও, বাছা, নাচ গিয়া ঘনের গর্জ্জনে,
হরষে সু-পুচ্ছ খুলি
শিরে স্বর্ণ-চূড়া তুলি;
করগে কেলি ব্রজ-কুঞ্জ-বনে।
করতালি ব্রজাঙ্গনা
দেবে রঙ্গে বরাঙ্গনা—
তোষ গিয়া ময়ূরীরে,প্রেম-আলিঙ্গনে!
শুন বাছা, মোর কথা শুন,
দিয়াছেন কোন কোন গুণ,
দেব সনাতন প্রতি-জনে;
সু-কলে কোকিল গায়,
বাজ বজ্র-গতি ধায়,
অপরূপ রূপ তব, খেদ কি কারণে?”—
নিজ অবস্থায় সদা স্থির যার মন,
তার হতে সুখীতর অন্য কোন্ জন?
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 7 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-7-300x300.jpg)
ময়ূরী – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
১
তরুশাখা উপরে, শিখিনি,
কেনে লো বসিয়া তুই বিরস বদনে?
না হেরিয়া শ্যামচাঁদে, তোরও কি পরাণ কাঁদে,
তুইও কি দুঃখিনী!
আহা!কে না ভালবাসে রাধিকারমণে?
কার না জুড়ায় আঁখি শশী, বিহঙ্গিনি?
২
আয়,পাখি,আমরা দুজনে
গলা ধরাধরি করি ভাবি লো নীরবে;
নবীন নীরদে প্রাণ; তুই করেছিস্ দান—
সে কি তোর হবে?
আর কি পাইবে রাধা রাধিকারঞ্জনে?
তুই ভাব্ ঘনে ধনি,আমি শ্ৰীমাধবে!
৩
কি শোভা ধরয়ে জলধর,
গভীর গরজি যবে উড়ে সে গগনে!
স্বর্ণবর্ণ শক্র-ধনু— রতনে খচিত তনু—
চূড়া শিরোপর;
বিজলী কনক দাম পরিয়া যতনে,
মুকুলিত লতা যথা পরে তরুবর!
৪
কিন্তু ভেবে দেখ্ লো কামিনি,
মম শ্যাম-রূপ অনুপম ত্রিভুবনে!
হায়,ও রূপ-মাধুরী, কার মন নাহি চুরি,
করে,রে শিখিনি!
যার অাঁখি দেখিয়াছে রাধিকামোহনে,
সেই জানে কেনে রাধা কুলকলঙ্কিনী!
৫
তরুশাখা উপরে, শিখিনি,
কেনে লো বসিয়া তুই বিরসবদনে?
না হেরিয়া শ্যামচাঁদে, তোর কি পরাণ কাঁদে
তুই কি দুঃখিনী?
আহা!কে না ভালবাসে শ্রীমধুসূদনে?
মধু কহে, যা কহিলে,সত্য বিনোদিনি!
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 2 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-5-177x300.jpg)
মলয় মারুত – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
(১)
শুনেছি মলয় গিরি তোমার আলয়—
মলয় পবন!
বিহঙ্গিনীগণ তথা গায়ে বিদ্যাধরী যথা,
সঙ্গীত সুধায় পূরে নন্দনকানন; কুসুমকুলকামিনী, কোমলা কমলা জিনি,
সেবে তোমা, রতি যথা সেবেন মদন!
(২)
হায়, কেনে ব্রজে আজি ভ্ৰমিছ হে তুমি—
মন্দ সমীরণ?
যাও সরসীর কোলে, দোলাও মৃদু হিল্লোলে
সুপ্রফুল্ল নলিনীরে—প্রেমানন্দ মন!
ব্ৰজ-প্রভাকর যিনি ব্ৰজ আজি ত্যজি তিনি,
বিরাজেন অস্তাচলে—নন্দের নন্দন!
(৩)
সৌরভ রতন দানে তুষিবে তোমারে
আদরে নলিনী;
তব তুল্য উপহার কি আজি আছে রাধার?
নয়ন আসারে, দেব, ভাসে সে দুঃখিনী!
যাও যথা পিকবধূ— বরিষে সঙ্গীত-মধু,—
এ নিকুঞ্জে কাঁদে আজি রাধা বিরহিণী।
(৪)
তবে যদি, সুভগ, এ অভাগীর দুঃখে
দুঃখী তুমি মনে,
যাও আশু, আশুগতি, যথা ব্ৰজকুলপতি—
যাও যথা পাবে, দেব, ব্রজের রতনে!
রাখার রোদনধ্বনি বহ যথা শ্যামমণি—
কহ তাঁরে মরে রাধা শ্যামের বিহনে!
(৫)
যাও চলি, মহাবলি, যথা বনমালী–
রাধিকা-বাসন;
তুঙ্গ শৃঙ্গ দুষ্টমতি, রোধে যদি তব গতি,
মোর অনুরোধে তারে ভেঙো, প্রভঞ্জন!
তরুরাজ যুদ্ধ আশে, তোমারে যদি সম্ভাষে–
ব্রজাঘাতে যেও তায় করিয়া দলন!
(৬)
দেখি তোমা পীরিতের ফাঁদ পাতে যদি
নদী রূপবতী;
মজো না বিভ্রমে তার, তুমি হে দূত রাধার,
হেরো না, হেরো না দেব কুসুম যুবতী!
কিনিতে তোমার মন, দিবে সে সৌরভধন,
অবহেলি সে ছলনা, যেয়ো আশুগতি!
(৭)
শিশিরের নীরে ভাবি অশ্রুবারিধারা,
ভুলো না, পবন!
কোকিলা শাখা উপরে, ডাকে যদি পঞ্চস্বরে,
মোর কিরে—শীঘ্র করে ছেড়ো সে কানন!
স্মরি রাধিকার দুঃখ, হইও সুখে বিমুখ—
মহৎ যে পরদুঃখে দুঃখী সে সুজন!
(৮)
উতরিবে যবে যথা রাধিকারমণ,
মোর দূত হয়ে,
কহিও গোকুল কাঁদে হারাইয়া শ্যামচাঁদে—
রাধার রোদনধ্বনি দিও তাঁরে লয়ে;
আর কথা আমি নারী শরমে কহিতে নারি,—
মধু কহে, ব্রজাঙ্গনে, আমি দিব কয়ে।
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 3 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-4-212x300.jpg)
মহাভারত – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
কল্পনা-বাহনে সুখে করি আরোহণ,
উতরিনু, যথা বসি বদরীর তলে,
করে বীণা, গাইছেন গীত কুতূহলে
সত্যবতী-সুত কবি,—ঋষিকুল-ধন !
শুনিলু গম্ভীর ধ্বনি ; উম্মীলি নয়ন
দেখিনু কৌরবেশ্বরে, মত্ত বাহুবলে ;
দেখিনু পবন-পুত্রে, ঝড় যথা চলে
হুঙ্কারে !আইলা কর্ণ—সূর্যের নন্দন—
তেজস্বী। উজ্জ্বলি যথা ছোটে অনম্বরে
নক্ষত্র, আইলা ক্ষেত্রে পার্থ মহামতি,
আলো করি দশ দিশ, ধরি বাম করে
গাণ্ডীব—প্রচণ্ড-দণ্ড-দাতা রিপু প্রতি।
তরাসে আকুল হৈনু এ কাল সমরে
দ্বাপরে গোগৃহ-রণে উত্তর যেমতি।
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 4 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-3-297x300.jpg)
মিত্রাক্ষর – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
বড়ই নিষ্ঠুর আমি ভাবি তারে মনে,
লো ভাষা, পীড়িতে তোমা গড়িল যে আগে
মিত্রাক্ষররূপ বেড়ি ! কত ব্যথা লাগে
পর’ যবে এ নিগড় কোমল চরণে–
স্মরিলে হৃদয় মোর জ্বলি উঠে রাগে
ছিল না কি ভাবধন, কহ, লো ললনে,
মনের ভাণ্ডারে তার, যে মিথ্যা সোহাগে
ভুলাতে তোমারে দিল এ তুচ্ছ ভূষণে ?
কি কাজ রঞ্জনে রাঙি কমলের দলে ?
নিজরূপে শশিকলা উজ্জ্বল আকাশে !
কি কাজ পবিত্রি’ মন্ত্রে জাহ্নবীর জলে ?
কি কাজ সুগন্ধ ঢালি পারিজাত-বাসে ?
প্রকৃত কবিতা রূপী কবিতার বলে,–
চীন-নারী-সম পদ কেন লৌহ ফাঁসে ?
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 2 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-5-177x300.jpg)
মেঘ ও চাতক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
উড়িল আকাশে মেঘ গরজি ভৈরবে;—
ভানু পলাইল ত্রাসে;
তা দেখি তড়িৎ হাসে;
বহিল নিশ্বাস ঝড়ে;
ভাঙ্গে তবু মড়-মড়ে;
গিরি-শিরে চূড়া নড়ে,
যেন ভূ-কম্পনে;
অধীরা সভয়ে ধরা সাধিলা বাসবে।
আইল চাতক-দল,
মাগি কোলাহলে জল—
“তৃষায় আকুল মোরা, ওহে ঘনপতি!
এ জ্বালা জুড়াও, প্রভু, করি এ মিনতি।”
বড় মানুষের ঘরে ব্রতে, কি পরবে,
ভিখারী-মণ্ডল যথা অাসে ঘোর রবে;—
কেহ আসে, কেহ যায়;
কেহ ফিরে পুনরায়
আবার বিদায় চায়;
ত্রস্ত লোভে সবে;—
সেরূপে চাতক-দল,
উড়ি করে কোলাহল;—
“তৃষায় আকুল মোরা, ওহে ঘনপতি!
এ জ্বালা জুড়াও জলে, করি এ মিনতি।”
রোষে উত্তরিলা ঘনবর;—
“অপরে নির্ভর যার, অতি সে পামর!
বায়ু-রূপ দ্রুত রথে চড়ি,
সাগরের নীল পায়ে পড়ি,
আনিয়াছি বারি;—
ধরার এ ধার ধারি।
এই বারি পান করি,
মেদিনী সুন্দরী
বৃক্ষ-লতা-শস্যচয়ে
স্তন-দুগ্ধ বিতরয়ে
শিশু যথা বল পায়,
সে রসে তাহারা খায়,
অপরূপ রূপ-সুধা বাড়ে নিরন্তর;
তাহারা বাঁচায়, দেখ, পশু-পক্ষী-নর।
নিজে তিনি হীন-গতি;
জল গিয়া আনিবারে নাহিক শকতি;
তেঁই তাঁর হেতু বারি-ধারা।—
তোমরা কাহারা?
তোমাদের দিলে জল,
কভু কি ফলিবে ফল?
পাখা দিয়াছেন বিধি;
যাও, যথা জলনিধি;
যাও, যথা জলাশয়;—
নদ-নদী-তড়াগাদি, জল যথা রয়।
কি গ্রীষ্ম, কি শীত কালে,
জল যেখানে পালে,
সেখানে চলিয়া যাও, দিনু এ যুকতি।”
চাতকের কোলাহল অতি।
ক্রোধে তড়িতেরে ঘন কহিলা,—
“অগ্নি-বাণে তাড়াও এ দলে।”—
তড়িৎ প্রভুর আজ্ঞা মানিলা।
পলায় চাতক, পাখা জ্বলে।
যা চাহ, লভ সদা নিজ-পরিশ্রমে;
এই উপদেশ কবি দিলা এই ক্রমে।
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 5 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-2-282x300.jpg)
মেঘদূত – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
কামী যক্ষ দগ্ধ,মেঘ,বিরহ-দহনে,
দূত-পদে বরি পূর্ব্বে,তোমায় সাধিল
বহিতে বারতা তার অলকা-ভবনে,
যেখানে বিরহে প্রিয়া ক্ষুণ্ণ মনে ছিল।
কত যে মিনতি কথা কাতরে কহিল
তব,পদতলে সে,তা পড়ে কি হে মনে?
জানি আমি,তুষ্ট হয়ে তার সে সাধনে
প্রদানিলা তুমি তারে যা কিছু যাচিল;
তেঁই গো প্রবাসে আজি এই ভিক্ষা করি;—
দাসের বারতা লয়ে যাও শীঘ্রগতি
বিরাজে,হে মেঘরাজ,যথা সে যুবতী,
অধীর এ হিয়া হায়,যার রূপ স্মরি!
কুসুমের কানে স্বনে মলয় যেমতি
মৃদু নাদে,কয়ো তারে,এ বিরহে মরি!
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 6 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-1-208x300.jpg)
মেঘনাদ ও বিভীষণ – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
এতক্ষণে” –অরিন্দম কহিলা বিষাদে
“জানিনা কেমনে আসি লক্ষণ পশিল
রক্ষঃপুরে ! হায়, তাত, উচিত কি তব
একাজ, নিকষা সতী তোমার জননী,
সহোদর রক্ষশ্রেষ্ঠ ? –শূলী-শম্ভূনিভ
কুম্ভকর্ণ ? ভ্রাতৃপুত্র বাসব বিজয়ী ?
নিজগৃহপথ, তাত, দেখাও তস্করে ?
চণ্ডালে বসাও আনি রাজার আলয়ে ?
কিন্তু নাহি গঞ্জি তোমা, গুরুজন তুমি
পিতৃতুল্য | ছাড় দ্বার, যাব অস্ত্রাগারে,
পাঠাইব রামানুজে শমন-ভবনে,
লঙ্কার কলঙ্ক আজি ভঞ্জিব আহবে |”
উত্তরিলা বিভীষণ;–“বৃথা এ সাধনা,
ধীমান্ ! রাঘবদাস আমি ; কি প্রকারে
তাঁহার বিপক্ষ কাজ করিব, রক্ষিতে
অনুরোধ ?” উত্তরিলা কাতরে রাবণি ;–
“হে পিতৃব্য, তব বাক্যে ইচ্ছি মরিবারে !
রাঘবের দাস তুমি ? কেমনে ও মুখে
আনিলে ও কথা, তাত, কহ তা দাসেরে !
স্থপিলা বিধুরে বিধি স্থানুর ললাটে ;
পড়ি কি ভূতলে শশী যান গড়াগড়ি
ধুলায় ? হে রক্ষোরথি, ভুলিলে কেমনে
কে তুমি ? জনম তব কোন্ মহাকুলে ?
কেবা সে অধম রাম ? স্বচ্ছ সরোবরে
করে ফেলি রাজ হংস পঙ্কজ কাননে ;
যায় কি সে কভু, পঙ্কিল সলিলে,
শৈবালদলের ধাম ? মৃগেন্দ্র কেশরী
কবে, হে বীর-কেশরী, সম্ভাষে শৃগালে
মিত্রভাবে ? অজ্ঞ দাস, বিজ্ঞতম তুমি,
অবিদিত নহে কিছু তোমার চরণে |
ক্ষুদ্রমতি নর, শূর, লক্ষণ ; নহিলে
অস্ত্রহীন যোধে কি সে সম্বোধে সংগ্রামে ?
কহ, মহারথি, একি মহারথিপ্রথা ?
নাহি শিশু লঙ্কাপুরে, শুনি না হাসিবে
এ কথা ! ছাড়হ পথ ; আসিব ফিরিয়া
এখনি ! দেখিব আজি, কোন্ দেববলে,
বিমুখে সমরে মোরে সৌমিত্রি কুমতি !
দেব-দৈত্য-নর-রণে, স্বচক্ষে দেখেছ,
রক্ষঃশ্রেষ্ঠ, পরাক্রম দাসের ! কি দেখি
ডরিবে এ দাস হেন দুর্বল মানবে ?
নিকুম্ভিলা-যজ্ঞাগারে প্রগল্ ভে পশিল
দম্ভী ; আজ্ঞা কর দাসে, শাস্তি নরাধমে |
তব জন্মপুরে, তাত, পদার্পণ করে
বনবাসী ! হে বিধাতঃ, নন্দন-কাননে
ভ্রমে দুরাচার দৈত্য ? প্রফুল্ল কমলে
কীটবাস ? কহ, তাত, সহিব কেমনে
হেন অপমান আমি,–ভ্রাতৃ পুত্র তব ?
তুমিও, হে রক্ষোমণি, সহিছ কেমনে ?”
মহামন্ত্রবলে যথা নম্রশিরঃ ফণী,
মলিনবদন লাজে, উত্তরিলা রথী
রাবণ-অনুজ, লক্ষি রাবণ-আত্মজে ;–
“নহি দোষী আমি, বত্স; বৃথা ভর্ত্স মোরে
তুমি ! নিজ কর্ম দোষে হায় মজাইলা
এ কনক-লঙ্কা রাজা, মজিলা আপনি !
বিরত সতত পাপে দেবকুল ; এবে
পাপপূর্ণ লঙ্কা পুরী ; প্রলয়ে যেমতি
বসুধা, ডুবিছে লঙ্কা এ কাল-সলিলে !
রাঘবের পদাশ্রয়ে রক্ষার্থে আশ্রয়ী
তেঁই আমি ! পরদোষে কে চাহে মজিতে ?”
রুষিলা বাসবত্রাস ! গম্ভীরে যেমতি
নিশীথে অম্বরে মন্দ্রে জীমূতেন্দ্র কোপি,
কহিলা বীরেন্দ্র বলী ;–“ধর্মপথগামী,
হে রাক্ষসরাজানুজ, বিখ্যাত জগতে
তুমি ;–কোন্ ধর্মমতে, কহ দাসে, শুনি,
জ্ঞাতিত্ব, ভ্রাতৃত্ব, জাতি,–এ সকলে দিলা
জলাঞ্জলি ? শাস্ত্রে বলে, গুণবান্ যদি
পরজন, গুণহীন স্বজন, তথাপি
নির্গুণ স্বজন শ্রেয়ঃ, পরঃ পরঃ সদা !
এ শিক্ষা হে রক্ষোবর, কোথায় শিখিলে ?
কিন্তু বৃথা গঞ্জি তোমা ! হেন সহবাসে,
হে পিতৃব্য, বর্বরত কেন না শিখিবে ?
গতি যার নীচ সহ, নীচ সে দুর্মতি |”
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 7 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-7-300x300.jpg)
ষষ্ঠ সর্গ — মেঘনাদবধ কাব্য – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
কুশাসনে ইন্দ্রজিৎ পূজে ইষ্টদেবে
নিভৃতে; কৌশিক বস্ত্র,কৌশিক উত্তরি,
চন্দনের ফোঁটা ভালে, ফুলমালা গলে।
পুড়ে ধূপ দানে ধূপ; জ্বলিছে চৌদিকে
পুত ঘৃতরসে দীপ; পুস্প রাশি রাশি,
গন্ডারের শৃঙ্গে গড়া কোষা কোষী, ভরা
হে জাহ্নবি, তব জলে, কলুষনাশিনী
তুমি; পাশে হেম-ঘন্টা, উপহার নানা
হেমপাত্রে ; রুদ্ধ দ্বার ;— বসেছে একাকী
যমদূত, ভীমবাহু লক্ষণ পশিলা
মায়াবলে দেবালয়ে। ঝনঝনিল অসি
পিধানে,ধ্বনিল বাজি তুণীর-ফলকে,
কাঁপিল মন্দির ঘন বীরপদভরে।
চমকি মুদিত আঁখি মিলিলা রাবণি।
দেখিলা সম্মুখে বলী দেবকৃতি রথী—
তেজস্বী মধ্যাহ্নে যথা দেব অংশুমালী ;
সাষ্টাঙ্গে প্রণমি শূর, কৃতাঞ্জলিপুটে,
কহিলা “হে বিভাবসু, শুভক্ষণে আজি
পূজিল তোমারে দাস, তেঁই, প্রভু, তুমি
পবিত্রিলা লঙ্কাপুরী ও পদ-অর্পণে;
কিন্তু কি কারণে,কহ, তেজস্বি, আইলা
রক্ষঃকুলরিপু নর লক্ষণের রূপে
প্রসাদিতে এ অধীনে ? এ কি লীলা তব,
প্রভাময় ?” পুনঃ বলী নমিলা ভূতলে।
উত্তরিলা বীরদর্পে রৌদ্র দাশরথি ;—
“নহি বিভাবসু আমি, দেখ নিরখিয়া,
রাবণি; লক্ষণ নাম, জন্ম রঘুকুলে;
সংহারিত, বীরসিংহ, তোমায় সংগ্রামে
আগমন হেথা মম ; দেহ রণ মোরে
অবিলম্বে।” যথা পথে সহসা হেরিলে
ঊর্দ্ধফণা ফণীশ্বরে, ত্রাসে হীনগতি
পথিক, চাহিলা বলী লক্ষণের পানে
সভয় হইল আজি ভয়শূ্ন্য হিয়া;
প্রচন্ড উত্তাপে পিন্ড হায় রে গলিল;
গ্রাসিল মিহিরে রাহু, সহসা আঁধারি
তেজপুঞ্জ ;অম্বুনাথে নিদাঘ শুষিল;
পশিল কৌশলে কলি নলের শরীরে;
বিস্ময়ে কহিলা শূর, “সত্য যদি তুমি
রামানুজ,কহ,রথি,কি ছলে পশিলা
রক্ষোরাজপুরে আজি ? রক্ষঃ শত শত,
যক্ষপতিত্রাস বলে, ভীম-অস্ত্রপাণি,
রক্ষিছে নগরদ্বার;শৃঙ্গধরসম
এ পুর-প্রাচীর উচ্চ ;—প্রাচীর উপরে
ভ্রমিছে অযুত যোধ চক্রাবলীরূপে;—
কোন্ মায়াবলে,বলী ? ভুলালে এ সবে
মানবকুলসম্ভব,দেবকুলদ্ভবে
কে আছে রথী এ বিশ্বে,বিমুখয়ে রণে
একাকী এ রক্ষোবৃন্দে ? এ প্রপন্চে তবে
কেন বন্চাইছ দাসে,কহ তা দাসেরে,
সর্ব্বভুক্? কি কৌতুক এ তব, কৌতুকি?
নহে নিরাকার দেব,সৌমিত্রি; কেমনে
এ মন্দিরে পশিবে সে এখনও দেখ
রুদ্ধ দ্বার;বর,প্রভু,দেহ এ কিংকরে,
নিঃশঙ্কা করিব লঙ্কা বধিয়া রাঘবে
আজি,খেদাইব দূরে কিষ্কিন্ধা-অধিপে,
বাঁধি আনি রাজপদে দিব বিভীষণে
রাজদ্রোহী|ওই শুন,নাদিছে চৌদিকে
শৃঙ্গ শৃঙ্গনাদিগ্রাম; বিলম্বিলে আমি,
ভগ্নোদ্যম রক্ষঃ-চমূ,বিদাও আমারে;
উত্তরিলা দেবাকৃতি সৌমিত্রি কেশরী,-
“কৃতান্ত আমি রে তোর,দুরন্ত রাবণি;
মাটি কাটি দংশে সর্প আয়ুহীনজনে;
মদে মত্ত সদা তুই;দেব-বলে বলী,
তবু অবহেলা,মূঢ়,করিস সতত
দেবকুলে; এতদিনে মজিলি দুর্ম্মতি;
দেবাদেশে রণে আমি আহ্বানি রে তোরে;”
এতেক কহিলা বলী উলঙ্গিলা অসি
ভৈরবে;ঝলসি আঁখি কালানল-তেজে,
ভাতিল কৃপাণবর,শত্রুকর যথা
ইরম্মদময় বজ্র;কহিলা রাবণি,–
“সত্য যদি রামানুজ তুমি,ভীমবাহু
লক্ষণ;সংগ্রাম-সাধ অবশ্য মিটাব
মহাহবে আমি তব,বিরত কি কভু
রণরঙ্গে ইন্দ্রজিৎ? আতিথেয় সেবা,
তিষ্ঠি লহ শূরশ্রেষ্ঠ,প্রথমে এ ধামে—
রক্ষোরিপু তুমি,তবু অতিথি হে এবে।
সাজি বীরসাজে আমি। নিরস্ত্র যে অরি,
নহে রথিকুলপ্রথা আঘাতিতে তারে।
এ বিধি, হে বীরবর,অবিদিত নহে,
ক্ষত্র তুমি,তব কাছে;-কি আর কহিব?”
জলদ-প্রতিম স্বনে কহিলা সৌমিত্রি,–
“আনায়-মাঝারে বাঘে পাইলে কি কভু
ছাড়ে রে কিরাত তারে? বধিব এখনি,
অবোধ,তেমতি তোরে? জন্ম রক্ষঃকুলে
তোর,ক্ষত্রধর্ম্ম, পাপি,কি হেতুী পালিব
তোর সঙ্গে? মারি অরি পারি যে কৌশলে;”
কহিলা বাসবজেতা,( অভিমন্যু যথা
হেরি সপ্ত শূরে শূর তপ্তলৌহাকৃতি
রোষে;)–ক্ষত্রকুলগ্লানি,শত ধিক তোরে,
লক্ষণ; নির্লজ্জ তুই। ক্ষত্রিয়-সমাজে
রোধিবে শ্রবণপথ ঘৃণায়,শুনিলে
নাম তোর রথিবৃন্দ; তস্কর যেমতি,
পশিলি এ গৃহে তুই; তস্কর-সদৃশ
শাস্তিয়া নিরস্ত তোরে করিব এখনি;
পশে যদি কাকোদর গরুড়ের নীড়ে,
ফিরি কি সে যায় কভু আপন বিবরে,
পামর? কে তোরে হেথা আনিল দুর্ম্মতি?
চক্ষের নিমেষে কোষা তুলি ভীমবাহু
নিক্ষেপিলা ঘোর নাদে লক্ষণের শিরে।
পড়িলা ভূতলে বলী ভীম প্রহরণে,
পড়ে তরুরাজ যথা প্রভঞ্জনবলে
মড়মড়ে; দেব-অস্ত্র বাজিল ঝনঝনি,
কাঁপিল দেউল যেন ঘোর ভূকম্পনে;
বহিল রুধির-ধারা;ধরিলা সত্বরে
দেব-অসি ইন্দ্রজিৎ;–নারিলা তুলিতে
তাহায়;কার্ম্মুক ধরি কর্ষিলা; রহিল
সৌমিত্রির হাতে ধনুঃ;সাপটিলা কোপে
ফলক;বিফল বল সে কাজ-সাধনে;
যথা শুন্ডধর টানে শুন্ডে জড়াইয়া
শৃঙ্গধর-শৃঙ্গে বৃথা,টানিলা তূণীরে
শূরেন্দ্র;মায়ার মায়া কে বুঝে জগতে;
চাহিলা দুয়ার-পানে অভিমানে মানী।
সচকিতে বীরবর দেখিলা সম্মুখে
ভীমতম শূল হস্তে, ধূমকেতুসম
খুল্লতাত বিভীষণে—বিভীষণ রণে;
“এতক্ষণে”–অরিন্দম কহিলা বিষাদে
“জানিনু কেমনে আসি লক্ষণ পশিল
রক্ষঃপুরে; হায়,তাত,উচিত কি তব
এ কাজ,নিকষা সতী তোমার জননী,
সহোদর রক্ষঃশ্রেষ্ঠ? শূলীশম্ভুনিভ
কুম্ভকর্ণ? ভ্রাতৃপুত্র বাসববিজয়ী
নিজগৃহপথ,তাত, দেখাও তস্করে?
চন্ডালে বসাও আনি রাজার আলয়ে?
কিন্তু নাহি গঞ্জি তোমা,গুরুজন তুমি
পিতৃতুল্য। ছাড় দ্বার যাব অস্ত্রাগারে,
পাঠাইব রামানুজে শমন-ভবনে,
লঙ্কার কলঙ্ক আজি ভঞ্জিব আহবে?
উত্তরিলা বিভীষণ, “বৃথা এ সাধনা,
ধীমান; রাঘবদাস আমি; কি প্রকারে
তাঁহার বিপক্ষ কাজ করিব,রক্ষিতে এ
অনুরোধ?” উত্তরিলা কাতরে রাবণি;–
“হে পিতৃব্য,তব বাক্যে ইচ্ছি মরিবারে;
রাঘবের দাস তুমি? কেমনে ও মুখে
আনিলে এ কথা তাত,কহ তা দাসেরে;
স্থাপিলা বিধুরে বিধি স্থানুর ললাটে;
পড়ি কি ভূতলে শশী যান গড়াগড়ি
ধুলায়? হে রক্ষোরথি,ভুলিলে কেমনে
কে তুমি? জনম তব কোন মহাকুলে?
কে বা সে অধম রাম? স্বচ্ছ সরোবরে
করে কেলি রাজহংস পঙ্কজ কাননে;
যায় কি সে কভু প্রভু,পঙ্কিল সলিলে,
শৈবালদলের ধাম? মৃগেন্দ্র কেশরী,
কবে,হে বীরকেশরী,সম্ভাষে শৃগালে
মিত্রভাবে? অজ্ঞ দাস বিজ্ঞতম তুমি,
অবিদিত নহে কিছু তোমার চরণে।
ক্ষুদ্রমতি নর,শূর,লক্ষণ,নহিলে
অস্ত্রহীন যোধে কি সে সম্বোধে সংগ্রামে?
কহ,মহারথী,একি মহারথী-প্রথা?
নাহি শিশু লঙ্কাপুরে শুনি না হাসিবে
এ কথা; ছাড়হ পথ;আসিব ফিরিয়া
এখনি; দেখিব আজি কোন্ দেববলে,
বিমুখে সমরে মোরে সৌমিত্রি কুমতি;
দেব-দৈত্য-নর-রণে,স্বচক্ষে দেখেছ,
রক্ষঃশ্রেষ্ঠ,পরাক্রম দাসের; কি দেখি
ডরিবে এ দাস হেন দুর্ব্বল মানবে?
নিকুম্ভিলা-যজ্ঞাগারে প্রগলভে পশিল
দম্ভী; আজ্ঞা কর দাসে,শাস্তি নরাধমে।
তব জন্মপুরে ,তাত,পদার্পণ করে
বনবাসী; হে বিধাতঃ, নন্দন-কাননে
ভ্রমে দুরাচার-দৈত্য? প্রফুল্ল কমলে
কীট-বাস? কহ তাত,সহিব কেমনে
হেন অপমান আমি,—ভ্রাতৃ-পুত্র তব?
তুমিও,হে রক্ষোমণি,সহিছ কেমনে?
মহামন্ত্র-বলে যথা নম্রশির; ফনী
মলিন বদন লাজে,উত্তরিলা রথী
রাবণ-অনুজ,লক্ষি রাবণ-আত্মজে—
“নহি দোষী আমি,বৎস;বৃথা ভর্ৎস মোরে
তুমি; নিজ-কর্মদোষে,হায়,মজাইলা
এ কনক-লঙ্কা রাজা মজিলা আপনি।
বিরত সতত পাপে দেবকুল; এবে
পাপপূর্ণ লঙ্কাপুরী; প্রলয়ে যেমতি
বসুধা,ডুবিছে লঙ্কা এ কাল সলিলে;
রাঘবের পদাশ্রয়ে রক্ষার্থে আশ্রয়ী
তেঁই আমি;পরদোষে কে চাহে মজিতে?
রুষিলা বাসবত্রাস;গম্ভীরে যেমতি
নিশীথে অম্বরে মন্দ্রে জীমূতেন্দ্র কোপি,
কহিলা বীরেন্দ্র বলী,–“ধর্মপথগামী,
হে রাক্ষসরাজানুজ,বিখ্যাত জগতে
তুমি;কোন্ ধর্ম্ম-মতে,কহ দাসে,শুনি,
জ্ঞাতিত্ব,ভ্রাতৃত্ব,জাতি,–এ সকলে দিলা
জলাঞ্জলি?শাস্ত্রে বলে,গুণবান্ যদি
পরজন,গুণহীন স্বজন, তথাপি
নির্গুণ স্বজন শ্রেয়,পরঃ পরঃ সদা;
এ শিক্ষাড ,হে রক্ষোবর,কোথায় শিখিলে?
কিন্তু বৃথা গঞ্জি তোমা; হেন সহবাসে,
হে পিতৃব্য,বর্ব্বরতা কেন না শিখিবে?
গতি যার নীচ সহ,নীচ সে দুর্ম্মতি।”
হেথায় চেতন পাই মায়ার যতনে
সৌমিত্রি,হুঙ্কারে ধনুঃ টঙ্কারিলা বলী।
সন্ধানি বিন্ধিলা শূর খরতর শরে
অরিন্দম ইন্দ্রজিতে,তারকা যথা
মহেস্বাস শরজালে বিঁধেন তারকে;
হায় রে রুধির-ধারা (ভূধর শরীরে
বহে বরিষার কালে জলস্রোতঃ যথা,)
বহিব,তিতিয়া বস্ত্র,তিতিয়া মেদিনী।
অধীল ব্যাথায় রথী,সাপটি সত্বরে
শঙ্খ,ঘন্টা,উপহার-পাত্র ছিল যত
যজ্ঞাগারে একে একে নিক্ষেপিলা,কোপে;
যথা অভিমন্যু রথী, নিরস্ত্র সমরে
সপ্তরথী-অস্ত্রবলে,কভু বা হানিলা
রথচূড়া,রথচক্র;কভু ভগ্ন অসি,
ছিন্ন চর্ম্ম,ভিন্ন বর্ম্ম,যা পাইলা হাতে;
কিন্ত মায়াময়ী মায়া,বাহু-প্রসরণে,
ফেলাইলা দূরে সবে,জননী যেমতি
খেদান মশকবৃন্দে সুপ্ত সুত হতে
করপদ্ম-সঞ্চালনে;সরোষে রাবণি
ধাইলা লক্ষণ-পানে গর্জি ভীমনাদে,
প্রহারকে হেরি যথা সম্মুখে কেশরী;
মায়ার মায়ায় বলী হেরিলা চৌদিকে
ভীষণ মহিষারূঢ় ভীম দন্ডধরে;
শূল-হস্তে শূলপাণি; শঙ্খ,চক্র,গদা
চতুর্ভুজে চতুর্ভুজ;হেরিলা সভয়ে
দেবকুল রথীবৃন্দে সুদিব্য বিমানে।
বিষাদে নিশ্বাস ছাড়ি দাঁড়াইলা বলী–
নিষ্ফল,হায় রে মরি,কালাধর যথা
রাহুগ্রাসে; কিম্বা সিংহ আনায়-মাঝারে;
ত্যজি ধনুঃ নিষ্কোষিলা অসি মহাতেজাঃ
রামানুজ;ঝলসিলা ফলক-আলোকে
নয়ন;হায় রে অন্ধ অরিন্দম বলী
ইন্দ্রজিৎ,খড়্গাঘাতে পড়িলা ভূতলে
শোণিতাদ্র। থরথরি কাঁপিলা বসুধা,
গর্জিলা উথলি সিন্ধু;ভৈরব-আরাবে
সহসা পূরিল বিশ্ব;ত্রিদিবে পাতালে,
মর্ত্ত্যে,মরামর জীব প্রমাদ গণিলা
আতঙ্কে;যথায় বসি হৈম-সিংহাসনে
সভায় কর্ব্বুরপতি,সহসা পড়িল
কনক-মুকুট খসি,রথচূড়া যথা
রিপুরথী কাটি যবে পড়ে রথতলে।
সশঙ্ক লঙ্কেশ শূর স্মরিলা শঙ্করে;
প্রমীলার বামেতর নয়ন নাচিল;
আত্মবিস্মৃতিতে,হায়,অকস্মাৎ সতী
মুছিলা সিন্দুর বিন্দু সুন্দর ললাটে;
মূর্ছিলা রাক্ষসেন্দ্রাণী মন্দোদরী দেবী
আচম্বিতে;মাতৃকোলে নিদ্রায়য় কাঁদিল
শিশুকুল আর্ত্তনাদে,কাঁদিল যেমতি
ব্রজে ব্রজকুলশিশু,যবে শ্যামমণি,
আঁধারি সে ব্রজপুর,গেলা মধুপুরে;
অন্যায় সমরে পড়ি,অসুরারি-রিপু,
রাক্ষসকুল-ভরসা, পরুষ বচনে
কহিলা লক্ষণ শূরে,-“বীরকুল গ্লানি,
সুমিত্রা নন্দন তুই;শত ধিক্ তোরে;
রাবণনন্দনন আমি না ডরি শমনে।
কিন্ত তোর অস্ত্রাঘাতে মরিনু যে আজি,
পামর, এ চিরদুঃখ রহিলল যে মনে;
দৈত্যকুলদল ইন্দ্রে দমিনু সংগ্রামে
মরিতে কি তোর হাতে? কি পাপে বিধাতা
দিবেন এ তাপ দাসে, বুঝিব কেমনে?
আর কি কহিব তোরে? এ বারতা যবে
পাইবেন রক্ষোনাথ, কে রক্ষিবে তোরে,
নরাধম? জলধির অতল সলিলে
ডুবিস যদিও তুই,পশিবে সে দেশে
রাজরোষ-বাড়বাগ্নিরাশিসম তেজে;
দাবাগ্নিসদৃশ তোরে দগ্ধিবে কাননে
সে রোষ, কাননে যদি পশিস্,কুমতি;
নারিবে রজনী, মূঢ়, আবরিতে তোরে।
দানব,মানব,দেব,কার সাধ্য হেন
ত্রাণিবে,সৌমিত্রি,তোরে রাবণ রুষিলে?
কে বা এ কলঙ্ক তোর ভঞ্জিবে জগতে,
কলঙ্কি?” এতেক কহি বিষাদে সুমতি
মাতৃপিতৃপাদপদ্ম শ্মরিলা অন্তিমে।
অধীর হইলা ধীর ভাবি প্রমীলারে
চিরানন্দ; লোহ সহ মিশি অশ্রুধারা
অনর্গল বহি,হায়,আদ্রিল মহীরে।
লঙ্কার পঙ্কজ রবি গেলা অস্তাচলে।
নির্বাণ পাবক যথা, কিম্বা তিষাম্পতি
শান্তরশ্মি,মহাবল রহিলা ভূতলে
পঞ্চম সর্গ — মেঘনাদবধ কাব্য – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
কুসুম-শয়নে যথা সুবর্ণ-মন্দিরে
বিরাজে বীরেন্দ্র বলী ইন্দ্রজিত,তথা
পশিল কূজন-ধ্বনি সে সুখ-সদনে।
জাগিলা বীর-কুন্জর কুন্জবন-গীতে।
প্রমীলার করপদ্ম করপদ্মে ধরি
রথীন্দ্র, মধুর স্বরে, হায় রে, যেমতি
নলিনীর কানে অলি কহে গুন্জরিয়া
প্রেমের রহস্য কথা, কহিলা (আদরে
চুম্বি নিমীলিত আঁখি )—“ডাকিছে কূজনে,
হৈমবতী ঊষা তুমি,রূপসি, তোমারে
পাখী-কুল; মিল, প্রিয়ে, কমল লোচন
উঠ, চিরানন্দ মোর; সূর্য্যকান্তমণি-
সম এ পরাণ,কান্তে, তুমি রবিচ্ছবি;—-
তেজোহীন আমি তুমি মুদিলে নয়ন;
ভাগ্য-বৃক্ষে ফলোত্তম তুমি হে জগতে
আমার; নয়ন-তারা; মহার্হ রতন;
উঠি দেখ,শশিমুখি,কেমনে ফুটিছে,
চুরি করি কান্তি তব মন্জু কুন্জবনে
কুসুম ;” চমকি রামা উঠিলা সত্বরে;—
গোপিনী কামিনী যথা বেনুর সুরবে;
আবরিলা অবয়ব সুচারু-হাসিনী
শরমে। কহিলা পুনঃ কুমার আদরে;—
“পোহাইল এতক্ষনে তিমির-শর্বরী;
তা না হলে ফুটিতে কি তুমি, কমলিনি,
জুড়াতে এ চক্ষুর্দ্বয়? চল, প্রিয়ে, এবে
বিদায় হইব নমি জননীর পদে;
পরে যথাবিধি পূজি দেব বৈশ্বানরে,
ভীষণ-অশনি-সম শর-বরিষণে
রামের সংগ্রাম-সাধ মিটাব সংগ্রামে।”
সাজিলা রাবণ-বধূ, রাবণ-নন্দন,
অতুল জগতে দোঁহে; বামাকুলোত্তমা
প্রমীলা, পুরুষোত্তম মেঘনাদ বলী ;
শয়ন-মন্দির হতে বাহিরিলা দোঁহে—
প্রভাতের তারা যথা অরুনের সাথে;
বাজিল রাক্ষস-বাদ্য ; নমিল রক্ষক ;
জয় মেঘনাদ উঠিল গগনে ;
রতন-শিবিকাসনে বসিলা হরষে
দম্পতী। বহিলা যান যানবাহ- দলে
মন্দোদরী মহিষীর সুবর্ন-মন্দিরে।
প্রবেশিলা অরিন্দম, ইন্দু-নিভাননা
প্রমীলা সুন্দরী সহ,সে স্বর্ণ-মন্দিরে।
ত্রিজটা নামে রাক্ষসী আইল ধাইয়া।
কহিল বীর-কেশরী; “শুন লো ত্রিজটে,
নিকুম্ভিলা-যজ্ঞ সাঙ্গ করি আমি আজি
যুঝিব রামের সঙ্গে পিতার আদেশে,
নাশিব রাক্ষস-রিপু; তেঁই ইচ্ছা করি
পূজিতে জননী পদ। যাও বার্তা লয়ে ;
কহ,পুত্র, পুত্রবধু দাঁড়ায়ে দুয়ারে
তোমার,হে লঙ্কেশ্বরী ;” সাষ্টাঙ্গে প্রণমি,
কহিলা শূরে ত্রিজটা, ( বিকটা রাক্ষসী)—
“শিবের মন্দিরে এবে রাণী মন্দোদরী,
যুবরাজ; তোমার মঙ্গল-হেতু তিনি
অনিদ্রায়, অনাহারে পূজেন উমেশে ;
তব সম পুত্র, শূর,কার এ জগতে ?
কার বা এ হেন মাতা ?”—এতেক কহিয়া
সৌদামিনী-গতি দূতী ধাইল সত্বরে।
বাহিরিলা লঙ্কেশ্বরী শিবালয় হতে
প্রণমে দম্পতী পদে। হরষে দুজনে
কোলে করি, শিরঃ চুম্বি, কাঁদিলা মহিষী।
কহিলা বীরেন্দ্র; ” দেবি আশীষ দাসেরে।
নিকুম্ভিলা-যজ্ঞ সাঙ্গ করি যথাবিধি,
পশিব সমরে আজি, নাশিব রাঘবে;
শিশু ভাই বীরবাহু; বধিয়াছে তারে
পামর। দেখিব মোরে নিবারে কি বলে ?
দেহ পদ-ধূলি, মাতঃ ;তোমার প্রসাদে
নির্ব্বিঘ্ন করিব আজি তীক্ষ্ন শর-জালে
লঙ্কা; বাঁধি দিব আনি তাত বিভীষণে
রাজদ্রোহী ; খেদাইব সুগ্রীব অঙ্গদে
সাগর অতল জলে;” উত্তরিলা রাণী,
মুছিয়া নয়ন-জল রতন-আঁচলে;—
“কেমনে বিদায় তোরে করি রে বাছনি ;
আঁধারি হৃদয়াকাশ,তুই পূর্ণ শশী
আমার। দুরন্ত রণে সীতাকান্ত বলী;
দুরন্ত লক্ষণ শূর; কাল-সর্প-সম
দয়া-শূন্য বিভীষণ; মত্ত লোভ-মদে,
স্ববন্ধু-বান্ধবে মূঢ় নাশে অনায়াসে,
ক্ষুধায় কাতর ব্যাঘ্র গ্রাসয়ে যেমতি
স্বশিশু; কুক্ষনে,বাছা, নিকষা শাশুড়ী
ধরেছিলা গর্ভে দুষ্টে, কহিনু রে তোরে;
এ কনক-লঙ্কা মোর মজালে দুর্ম্মতি;”
হাসিয়া মায়ের পদে উত্তরিলা রথী;—
কেন, মা ডরাও তুমি রাঘবে লক্ষণে,
রক্ষোবৈরী ? দুইবার পিতার আদেশে
তুমুল সংগ্রামে আমি বিমুখিনু দোঁহে
অগ্নিময় শর-জালে ; ও পদ-প্রসাদে
চির-জয়ী দেব-দৈত্য-নরের সমরে
এ দাস ; জানেন তাত বিভীষণ, দেবি,
তব পুত্র-পরাক্রম ; দম্ভোলি-নিক্ষেপী
সহস্রাক্ষ সহ যত দেব-কুল-রথী ;
পাতালে নাগেন্দ্র, মর্ত্তে নগেন্দ্র ; কি হেতু
সভয় হইলা আজি,কহ, মা, আমারে ?
কি ছার সে রাম, তারে ডরাও আপনি ?
মুছিয়া নয়ন-জল রতন-আঁচলে,
উত্তরিলা লঙ্কেশ্বরী; ” যাইবি রে যদি;—
রাক্ষস-কুল-রক্ষণ বিরূপাক্ষ তোরে
রক্ষুন এ কাল-রণে ; এই ভিক্ষা করি
তার পদ যুগে আমি। কি আর কহিব ?
নয়নের তারা হারা করি রে থুইলি
আমায় এ ঘরে তুই;” কাঁদিয়া মহিষী
কহিলা,চাহিয়া তবে প্রমীলার পানে ;—
“থাক,মা,আমার সঙ্গে তুমি; জুড়াইব,
ও বিধুবদন হেরি এ পোড়া পরাণ ;
বহুলে তারার করে উজ্জ্বল ধরণী।”
বন্দি জননীর পদ বিদায় হইলা
ভীমবাহু কাঁদি রাণী, পুত্র-বধূ সহ,
প্রবেশিলা পুনঃ গৃহে। শিবিকা ত্যজিয়া,
পদ-ব্রজে যুবরাজ চলিলা কাননে—
ধীরে ধীরে রথীবর চলিলা একাকী,
কুসুম-বিব্রিত পথে যজ্ঞশালা মুখে।
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 8 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-6-300x293.jpg)
মেঘনাদবধ কাব্য (চতুর্থ সর্গ) – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
নমি আমি,কবি-গুরু তব পদাম্বুজে,
বাল্মীকি;হে ভারতের শিরঃচূড়ামণি,
তব অনুগামী দাস,রাজেন্দ্র-সঙ্গমে
দিন যথা যায় দূর তীর্থ দরশনে;
তব পদ-চিহ্ন ধ্যান করি দিবানিশি,
পশিয়াছে কত যাত্রী যশের মন্দিরে,
দমনিয়া ভব-দম দুরন্ত শমনে—
অমর; শ্রীভর্ত্তৃহরি; সূরী ভবভূতি
শ্রীকন্ঠ;ভারতে খ্যাত বরপুত্র যিনি
ভারতীর, কালিদাস–সুমধুর-ভাষী;
মুরারী-মূরলীধ্বনি-সদৃশ মুরারি
মনোহর;কীর্ত্তিবাস,কীর্ত্তিবাস কবি,
এ বঙ্গের অলঙকার;–হে পিতঃ, কেমনে,
কবিতা-রসের সরে রাজহংস-কুলে
মিলি করি কেলি আমি, না শিখালে তুমি?
গাঁথিব নূতন মালা ,তুলি সযতনে
তব কাব্যদানে ফুল; ইচ্ছা সাজাইতে
বিবিধ ভূষনে ভাষা; কিন্তু কোথা পাব
(দীন আমি;) রত্নরাজী,তুমি নাহি দিলে,
রত্নাকর? কৃপা,প্রভু কর আকিন্চনে।
একাকিনি শোকাকুলা, অশোক-কাননে
কাঁদেন রাঘব-বান্ছা আঁধার কুটিরে
নীরবে;দুরন্ত চেড়ী,সতীরে ছাড়িয়া,
ফেরে দূরে মত্ত সবে উৎসব-কৌতুকে–
হীন-প্রাণা হরিণীরে রাখিয়া বাঘিনী
নির্ভয় হৃদয়ে যথা ফেরে দূর বনে
মলিন-বদনা দেবী,হায় রে যেমতি
খনির তিমির গর্ভে (না পারে পশিতে
সৌর-কর-রাশি যথা) সূর্য্যকান্ত-মণি;
কিম্বা বিম্বাধরা রমা অম্বুরাশি-তলে;
স্বনিছে পবন, দূরে রহিয়া রহিয়া
উছ্বাসে বিলাপী যথা; লড়িছে বিষাদে
মর্মরিয়া পাতাকুল; বসেছে অরবে
শাখে পাখী; রাশি রাশি কুসুম পড়েছে
তরুমূলে; যেন তরু, তাপি মনস্তাপে,
ফেলিয়াছে খুলি সাজ; দূরে প্রবাহিণী,
উচ্চ বিচী-রবে কাঁদি, চলিছে সাগরে,
কহিতে বারীশে যেন এ দুঃখ-কাহিনী;
না পশে সুধাংশু-অংশু সে ঘোর বিপিনে
ফোটে কি কমল কভু সমল সলিলে?
তবুও উজ্বল বন ও অপূর্ব্ব রূপে;
একাকিনী বসি দেবী, প্রভা আভাময়ী,
তমোময় ধামে যেন; হেন কালে তথা
সরমা সুন্দরী আসি বসিলা কাঁদিয়া
সতীর চরণ-তলে,সরমা সুন্দরী–
রক্ষঃকুল-রাজলক্ষী রক্ষোবধূ-বেশে;
কতক্ষনে চক্ষু-জল মুছি সুলোচনা
কহিলা মধুর স্বরে; ”দুরন্ত চেড়ীরা,
তোমারে ছাড়িয়া, দেবি ফিরিছে নগরে,
মহোৎসবে রত সবে আজি নিশা-কালে;
এই কথা শুনি আমি আইনু পূজিতে
পা-দুখানি। আনিয়াছি কৌটায় ভরিয়া
সিন্দুর; করিলে আজ্ঞা,সুন্দর ললাটে
দিব ফোঁটা। এয়ো তুমি, তোমার কি সাজে
এ বেশ? নিষ্ঠুর,হায়, দুষ্ট লঙ্কাপতি;
কে ছেঁড়ে পদ্মের পর্ণ? কেমনে হরিল
ও বরাঙ্গ-অলঙ্কার, বুঝিতে না পারি?
কৌটা খুলি,রক্ষো বধূ যত্নে দিলা ফোঁটা।
সীমন্তে ; সিন্দুর বিন্দু শোভিল ললাটে,
গোধূলি-ললাটে, আহা; তারা-রত্ন-যথা;
দিয়া ফোঁটা, পদ-ধূলি লইলা সরমা ।
”ক্ষম লক্ষি, ছুইনু ও দেব-আকাঙ্খিত
তনু;কিন্তু চির-দাসী দাসী ও চরণে;”
এতেক কহিয়া পুনঃ বসিলা যুবতী
পদতলে;আহা মরি সুবর্ণ-দেউটি
তুলসীর মূলে যেন জ্বলিল, উজলি
দশ দিশ; মৃদু-স্বরে কহিলা মৈথিলী;—
”বৃথা গন্জ দশাননে তুমি, বিধুমুখী;
আপনি খুলিয়া আমি ফেলাইনু দূরে
আভরণ,যবে পাপী আমারে ধরিল
বনাশ্রমে। ছড়াইনু পথে সে সকলে,
চিহ্ন হেতু। সেই হেতু আনিয়াছে হেথা–
এ কনক-লঙ্কাপুরে—-ধীর রঘুনাথে;
মণি,মুক্তা, রতন, কি আছে লো জগতে,
যাহে নাহি অবহেলি লভিতে সে ধনে?
যথা গোমুখীর মুখ হইতে সুস্বনে
ঝরে পূত বারি-ধারা, কহিলা জানকী,
মধুর ভাষিণী সতী, আদরে সম্ভাষি
সরমারে,—“হিতৈষিণী সীতার পরমা
তুমি,সখি; পূর্ব্ব-কথা শুনিবারে যদি
ইচ্ছা তব,কহি আমি, শুন মনঃ দিয়া।—
ছিনু মোরা, সুলোচনে, গোদাবরী-তীরে,
কপোত কপোতী যথা উচ্চ বৃক্ষ-চূড়ে
বাঁধি নীড়,থাকে সুখে;ছিনু ঘোর বনে,
নাম পঞ্চবটী,মর্ত্ত্যে সুর-বন-সম।
সদা করিতেন সেবা লক্ষণ সুমতি।
দন্ডক ভান্ডার যার, ভাবি দেখ মনে,
কিসের অভাব তার? যোগাতেন আনি
নিত্য ফল-মূল বীর সৌমিত্রি; মৃগয়া
করিতেন কভু প্রভু; কিন্তু জীব নাশে
সতত বিরত,সখি রাঘবেন্দ্র বলী,—
দয়ার সাগর নাথ ,বিদিত জগতে;
“ভুলিনু পূর্ব্বের সুখ। রাজার নন্দিনী
রঘু-কুল-বধু আমি; কিন্তু এ কাননে,
পাইনু, সরমা সই,পরম পিরীতি ;
কুটীরের চারিদিকে কত যে ফুটিত
ফুলকুল নিত্য নিত্য,কহিব কেমনে?
পঞ্চবটী-বন-চর মধু নিরবধি;
জাগাত প্রভাতে মোরে কহরি সুস্বরে
পিকরাজ;কোন রাণী,কহ; শশিুমুখি,
হেন চিত্ত-বিনোদন বৈতালিক-গীতে
খোলে আঁখি? শিখী সহ । শিখীনি সুখিনী
নাচিত দুয়ারে মোর; নর্ত্তক,নর্ত্তকী,
এ দোঁহার সম, রামা,আছে কি জগতে?
অতিথি আসিত নিত্য করভ,করভী,
মৃগ- শিশু, বিহঙ্গম,স্বর্ণ-অঙ্গ কেহ,
কেহ, শুভ্র,কেহ কাল,কেহ বা চিত্রিত,
যথা বাসবের ধনুঃ ঘন-বন-শিরে;
অহিংসক জীব যত। সেবিতাম সবে,
মহাদরে; পালিতাম পরম যতনে,
মরুভূমে স্রতোস্বতী তৃষাতুরে যথা,
আপনি সুজলবতী বারিদ-প্রসাদে।
সরসী আরসি মোর; তুলি কুবলয়ে,
(অতুল রতন-সম) পরিতাম কেশে;
সাজিতাম ফুল-সাজে; হাসিতেন প্রভু,
বনদেবী বলি মোরে সম্ভাষি কৌতুকে;
হায়, সখি, আর কি লো পাব প্রাণনাথে?
আর কি এ পোড়া আঁখি এ ছার জনমে
দেখিবে সে পা-দুখানি—আশার সরসে
রাজীব; নয়ন মণি? হে দারুণ বিধি,
কি পাপে পাপী এ দাসী তোমার সমীপে?
এতেক কহিয়া দেবী কাঁদিলা নীরবে।
কাঁদিলা সরমা সতী তিতি অশ্রু-নীরে।
কতক্ষনে চক্ষু-জল মুছি রক্ষোবধূ
সরমা, কহিলা সতী সীতার চরণে;—
”স্মরিলে পূর্ব্বের কথা ব্যাথা মনে যদি
পাও, দেবী, থাক তবে ; কি কাজ স্মরিয়া?—
হেরি তব অশ্রু-বারি ইচ্ছি মরিবারে;”
উত্তরিলা প্রিয়ম্বদা ( কাদম্বা যেমতি
মধু-স্বরা);–“এ অভাগী,হায়, লো সুভগে,
যদি না কাঁদিবে, তবে কে আর কাঁদিবে
এ জগতে? কহি, শুন পূর্ব্বের কাহিনী।
বরিষার কালে,সখি,প্লাবন-পীড়নে
কাতর,প্রবাহ,ঢালে,তীর অতিক্রমি,
বারি-রাশি দুই পাশে; তেমতি যে মনঃ
দুঃখিত,দুঃখের কথা কহে সে অপরে।
তেঁই আমি কহি,তুমি শুন,লো সরমে;
কে আছে সীতার আর এ অবরু-পুরে?
”পঞ্চবটী-বনে মোরা গোদাবরী-তটে
ছিনু সুখে। হায়, সখি,কেমনে বর্ণিব
সে কান্তার-কান্তি আমি? সতত স্বপনে
শুনিতাম মন-বীণা বন-দেবী-করে;
সরসীর তীরে বসি, দেখিতাম কভু
সৌর-কর-রাশি-বেশে সুরবালা-কেলি
পদ্মবনে; কভু সাধ্ধী ঋষিবংশ-বধূ
সুহাসিনী আসিতেন দাসীর কুটীরে,
সুধাংশুর অংশু যেন অন্ধকার ধামে;
অজিন (রন্জিত, আহা, কত শত রঙে;)
পাতি বসিতাম কভু দীর্ঘ তরুমূলে,
সখী-ভাবে সম্ভাষিয়া ছায়ায়,কভু বা
কুরঙ্গিনী-সঙ্গে রঙ্গে নাচিতাম বনে,
গাইতাম গীত শুনি কোকিলের ধ্বনি;
নব-লতিকার,সতি দিতাম বিবাহ
তরু-সহ; চুম্বিতাম মন্জরিত যবে
দম্পতী, মন্জরীবৃন্দে আনন্দে সম্ভাষি
নাতিনী বলিয়া সবে; গুন্জরিলে অলি,
নাতিনী-জামাই বলি বরিতাম তারে;
কভু বা প্রভুরর সহ ভ্রমিতাম সুখে
নদী-তটে; দেখিতাম তরল সলিলে
নূতন গগন যেন,নব তারাবলী,
নব নিশাকান্ত-কান্তি ; কভু বা উঠিয়া
পর্ব্বত-উপরে ,সখি বসিতাম আমি
নাথের চরণ-তলে, ব্রততী যেমতি
বিশাল রসাল-মূলে; কত যে আদরে
তুষিতেন প্রভু মোরে, বরষি বচন-
সুধা, হায়, কব কারে ? কব বা কেমনে?
শুনেছি কৈলাস-পুরে কৈলাস-নিবাসী
ব্যোমকেশ,স্বর্ণাসনে বসি গৌরী-সনে,
আগম,পুরাণ, বেদ, পঞ্চতন্ত্র-কথা
পঞ্চমুখে পঞ্চমুখ কহেন উমারে;
শুনিতাম সেইরূপে আমিও,রূপি,
নানাকথা ; এখনও, এ বিজন বনে,
ভাবি আমি শুনি যেন সে মধুর বাণী;—
সাঙ্গ কি দাসীর পক্ষে, হে নিষ্ঠুর বিধি,
সে সঙ্গীত ?”—নীরবিলা আয়ত-লোচনা
বিষাদে। কহিলা তবে সরমা সুন্দরী;—
“শুনিলে তোমার কথা, রাঘব-রমণি,
ঘৃণা জন্মে রাজ-ভোগে ; ইচ্ছা করে,ত্যজি
রাজ্য-সুখ, যাই চলি হেন বনবাসে;
কিন্তু ভেবে দেখি যদি,ভয় হয় মনে।
রবিকর যবে, দেবি, পশে বনস্থলে
তমোময়,নিজগুনে আলো করে বনে
সে কিরণ; নিশি যবে যায় কোন দেশে,
মলিন-বদন সবে তার সমাগমে;
যথা পদার্পণ তুমি কর, মধুমতি,
কেন না হইবে সুখী সর্ব্ব জন তথা,
জগৎ-আনন্দ তুমি, ভুবন-মোহিনী;
কহ, দেবি, কি কৌশলে হরিল তোমারে
রক্ষঃপতি? শুনিয়াছে বীণা-ধ্বনি দাসী,
পিকবর-রব নব পল্লব-মাঝারে
সরষ মধুর মাসে ; কিন্তু নাহি শুনি
হেন মধুমাখা কথা কভু এ জগতে;”
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 2 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-5-177x300.jpg)
তৃতীয় সর্গ — মেঘনাদবধ কাব্য – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
সম্মুখ সমরে পড়ি, বীর-চূড়ামণি
বীরবাহু, চলি যবে গেলা যমপুরে
অকালে, কহ, হে দেবি অমৃতভাষিণি,
কোন্ বীরবরে বরি সেনাপতি-পদে,
পাঠাইলা রণে পুনঃ রক্ষঃকুলনিধি
রাঘবারি? কি কৌশলে, রাক্ষসভরসা
ইন্দ্রজিৎ মেঘনাদে — অজেয় জগতে —
ঊর্মিলাবিলাসী নাশি, ইন্দ্রে নিঃশঙ্কিলা?
বন্দি চরণারবিন্দ, অতি মন্দমতি
(পূর্বপাঠ: বন্দি ও চরণ-অরবিন্দ, মন্দমতি)
আমি, ডাকি আবার তোমায়, শ্বেতভুজে
ভারতি! যেমতি, মাতঃ, বসিলা আসিয়া,
বাল্মীকির রসনায় (পদ্মাসনে যেন)
যবে খরতর শরে, গহন কাননে,
ক্রৌঞ্চবধূ সহ ক্রৌঞ্চে নিষাদ বিঁধিলা,
(পূর্বপাঠ: ক্রৌঞ্চসহ ক্রৌঞ্চবধূ বিঁধিলা নিষাদ,)
তেমতি দাসেরে, আসি, দয়া কর, সতি।
কে জানে মহিমা তব এ ভবমণ্ডলে?
নরাধম আছিল যে নর নরকুলে
(পূর্বপাঠ: দস্যুবৃত্তি প্রবৃত্ত পাষণ্ড নরাধম)
চৌর্যে রত, হইল সে তোমার প্রসাদে,
(পূর্বপাঠ: আছিল যে নর, এবে, তোমার প্রসাদে,)
মৃ্ত্যুঞ্জয়, যথা মৃত্যুঞ্জয় উমাপতি!
হে বরদে, তব বরে চোর রত্নাকর
কাব্যরত্নাকর কবি! তোমার পরশে,
সুচন্দন-বৃক্ষশোভা বিষবৃক্ষ ধরে!
(পূর্বপাঠ: বিষবৃক্ষ চন্দনবৃক্ষের শোভা ধরে!)
হায়, মা, এহেন পুণ্য আছে কি এ দাসে?
(পূর্বপাঠ: হায়, মা, এ হেন পুণ্য কি আছে আমার?)
কিন্তু যে গো গুণহীন সন্তানের মাঝে
(পূর্বপাঠ: কিন্তু গুণহীন যে সন্তানগণ মাঝে)
মূঢ়মতি, জননীর স্নেহ তার প্রতি
সমধিক্! ঊর তবে, ঊর, দয়াময়ি
বিশ্বরমে! গাইব, মা, বীররসে ভাসি,
মহাগীত; ঊরি, দাসে দেহ পদছায়া।
— তুমিও আইস, দেবি তুমি মধুকরী
কল্পনা! কবির চিত্ত-ফুলবন-মধু
লয়ে, রচ মধুচক্র, গৌড়জন যাহে
আনন্দে করিবে পান সুধা নিরবধি।
কনক-আসনে বসে দশানন বলী —
হেমকূট-হৈমশিরে শৃঙ্গবর যথা
তেজঃপুঞ্জ। শত শত পাত্রমিত্র আদি
সভাসদ্, নতভাবে বসে চারি দিকে।
ভূতলে অতুল সভা — স্ফটিকে গঠিত;
তাহে শোভে রত্নরাজি, মানস-সরসে
সরস কমলকুল বিকশিত যথা।
শ্বেত, রক্ত, নীল, পীত স্তম্ভ সারি সারি
ধরে উচ্চ স্বর্ণছাদ, ফণীন্দ্র যেমতি,
বিস্তারি অযুত ফণা, ধরেন আদরে
ধরারে। ঝুলিছে ঝলি ঝালরে মুকুতা,
পদ্মরাগ, মরকত, হীরা; যথা ঝোলে
(খচিত মুকুলে ফুলে) পল্লবের মালা
ব্রতালয়ে। ক্ষণপ্রভা সম মুহুঃ হাসে
(পূর্বপাঠ: স্বয়ম্বর গেহে। ক্ষণপ্রভা সম হাসে)
রতনসম্ভবা বিভা — ঝলসি নয়নে!
সুচারু চামর চারুলোচনা কিঙ্করী
(পূর্বপাঠ: ঢুলায় চামর চারুলোচনা কিঙ্করী।)
ঢুলায়; মৃণালভুজ আনন্দে আন্দোলি
(পূর্বপাঠ: ধরে ছত্র ছত্রধর, হর কোপানলে)
চন্দ্রাননা। ধরে ছত্র ছত্রধর; আহা
(পূর্বপাঠ: না পুড়ে মদন যেন দাঁড়ান সেখানে!)
হরকোপানলে কাম যেন রে না পুড়ি
(পূর্বপাঠ: এই পংক্তি নেই।)
দাঁড়ান সে সভাতলে ছত্রধর-রূপে!—
(পূর্বপাঠ: এই পংক্তি নেই।)
ফেরে দ্বারে দৌবারিক, ভীষণ মুরতি,
পাণ্ডব-শিবির দ্বারে রুদ্রেশ্বর যথা
শূলপাণি! মন্দে মন্দে বহে গন্ধবহ,
অনন্ত বসন্ত-বায়ু, রঙ্গে সঙ্গে আনি
(পূর্বপাঠ: পরিমলময় বায়ু, রঙ্গে সঙ্গে আনি)
কাকলী লহরী, মরি! মনোহর, যথা
(পূর্বপাঠ: কাকলী লহরী, আহা, মনোহর যথা)
বাঁশরীস্বরলহরী গোকুল বিপিনে!
কি ছার ইহার কাছে, হে দানবপতি
ময়, মণিময় সভা, ইন্দ্রপ্রস্থে যাহা
স্বহস্তে গড়িলা তুমি তুষিতে পৌরবে?
এহেন সভায় বসে রক্ষঃকুলপতি,
বাক্যহীন পুত্রশোকে! ঝর ঝর ঝরে
(পূর্বপাঠ: পুত্রশোকে বাক্যহীন! ঝর ঝর ঝরে)
অবিরল অশ্রুধারা — তিতিয়া বসন;
যথা তরু, তীক্ষ্ণ শর সরস শরীরে
(পূর্বপাঠ: যথা তরু, সরস শরীরে তীক্ষ্ণশর)
বাজিলে, কাঁদে নীরবে। কর জোড় করি,
দাঁড়ায় সম্মুখে ভগ্নদূত, ধূসরিত
ধূলায়, শোণিতে আর্দ্র সর্ব কলেবর।
বীরবাহু সহ যত যোধ শত শত
ভাসিল রণসাগরে, তা সবার মাঝে
একমাত্র বাঁচে বীর; যে কাল তরঙ্গ
গ্রাসিল সকলে, রক্ষা করিল রাক্ষসে—
নাম মকরাক্ষ, বলে যক্ষপতি সম।
এ দূতের মুখে শুনি সুতের নিধন,
হায়, শোকাকুল আজি রাজকুলমণি
নৈকষেয়! সভাজন দুঃখী রাজ-দুঃখে।
আঁধার জগৎ, মরি, ঘন আবরিলে
দিননাথে! কত ক্ষণে চেতন পাইয়া,
বিষাদে নিশ্বাস ছাড়ি, কহিলা রাবণ;—
“নিশার স্বপনসম তোর এ বারতা,
রে দূত! অমরবৃন্দ যার ভুজবলে
কাতর, সে ধনুর্ধরে রাঘব ভিখারী
বধিল সম্মুখ রণে? ফুলদল দিয়া,
কাটিলা কি বিধাতা শাল্মলী তরুবরে?
হা পুত্র, হা বীরবাহু, বীর-চূড়ামণি!
কি পাপে হারানু আমি তোমা হেন ধনে?
কি পাপ দেখিয়া মোর, রে দারুণ বিধি,
হরিলি এ ধন তুই? হায় রে, কেমনে
সহি এ যাতনা আমি? কে আর রাখিবে
এ বিপুল কুল-মান এ কাল সমরে!
বনের মাঝারে যথা শাখাদলে আগে
একে একে কাঠুরিয়া কাটি, অবশেষে
নাশে বৃক্ষে, হে বিধাতঃ, এ দুরন্ত রিপু
তেমতি দুর্বল, দেখ, করিছে আমারে
নিরন্তর! হব আমি নির্মূল সমূলে
(পূর্বপাঠ: নিরন্তর! সমূলে নির্মূল হব আমি)
এর শরে! তা না হলে, মরিত কি কভু
শূলী শম্ভুসম ভাই কুম্ভকর্ণ মম,
অকালে আমার দোষে? আর যোধ যত—
রাক্ষস-কুল-রক্ষণ? হায়, সূর্পণখা,
কি কুক্ষণে দেখেছিলি, তুইরে অভাগী,
কাল পঞ্চবটীবনে কালকূটে ভরা
এ ভুজগে? কি কুক্ষণে (তোর দুঃখে দুঃখী)
পাবক-শিখা-রূপিণী জানকীরে আমি
আনিনু এ হৈম গেহে? হায় ইচ্ছা করে,
ছাড়িয়া কনকলঙ্কা, নিবিড় কাননে
পশি, এ মনের জ্বালা জুড়াই বিরলে!
কুসুমদাম-সজ্জিত, দীপাবলী-তেজে
উজ্জ্বলিত নাট্যশালা সম রে আছিল
এ মোর সুন্দরী পুরী! কিন্তু একে একে
শুখাইছে ফুল এবে, নিবিছে দেউটি;
নীরব রবাব, বীণা, মুরজ, মুরলী;
তবে কেন আর আমি থাকি রে এখানে?
কার রে বাসনা বাস করিতে আঁধারে?”
এইরূপে বিলাপিলা আক্ষেপে রাক্ষস–
কুলপতি রাবণ; হায় রে মরি, যথা
হস্তিনায় অন্ধরাজ, সঞ্জয়ের মুখে
শুনি, ভীমবাহু ভীমসেনের প্রহারে
(পূর্বপাঠ: শুনি, গদাধর ভীমসেন-গদাঘাতে)
হত যত প্রিয়পুত্র কুরুক্ষেত্র-রণে!
তবে মন্ত্রী সারণ (সচিবশ্রেষ্ঠ বুধঃ)
কৃতাঞ্জলিপুটে উঠি কহিতে লাগিলা
নতভাবে; — “হে রাজন্, ভুবন বিখ্যাত,
রাক্ষসকুলশেখর, ক্ষম এ দাসেরে!
হেন সাধ্য কার আছে বুঝায় তোমারে
(পূর্বপাঠ: তোমারে বুঝায় হেন সাধ্য কার আছে)
এ জগতে? ভাবি, প্রভু, দেখ কিন্তু মনে;—
(পূর্বপাঠ: এ জগতে? ভাবি, প্রভু, দেখ মনে মনে,—)
অভ্রভেদী চূড়া যদি যায় গুঁড়া হয়ে
বজ্রাঘাতে, কভু নহে ভূধর অধীর
সে পীড়নে। বিশেষতঃ এ ভবমণ্ডল
মায়াময়, বৃথা এর দুঃখ সুখ যত।
মোহের ছলনে ভুলে অজ্ঞান যে জন।”
উত্তর করিলা তবে লঙ্কা-অধিপতি;—
“যা কহিলে সত্য, ওহে অমাত্য-প্রধান
সারণ! জানি হে আমি, এ ভব-মণ্ডল
মায়াময়, বৃথা এর দুঃখ সুখ যত।
কিন্তু জেনে শুনে তবু কাঁদে এ পরাণ
অবোধ। হৃদয়-বৃন্তে ফুটে যে কুসুম,
তাহারে ছিঁড়িলে কাল, বিকল হৃদয়
ডোবে শোক-সাগরে, মৃণাল যথা জলে,
যবে কুবলয়ধন লয় কেহ হরি।”
এতেক কহিয়া রাজা, দূত পানে চাহি,
আদেশিলা,— “কহ, দূত, কেমনে পড়িল
সমরে অমর-ত্রাস বীরবাহু বলী?”
প্রণমি রাজেন্দ্রপদে, করযুগ জুড়ি,
আরম্ভিলা ভগ্নদূত;— “হায়, লঙ্কাপতি,
কেমনে কহিব আমি অপূর্ব কাহিনী?
কেমনে বর্ণিব বীরবাহুর বীরতা?—
মদকল করী যথা পশে নলবনে,
পশিলা বীরকুঞ্জর অরিদল মাঝে
ধনুর্ধর। এখনও কাঁপে হিয়া মম
থরথরি, স্মরিলে সে ভৈরব হুঙ্কারে!
শুনেছি, রাক্ষসপতি, মেঘের গর্জনে;
সিংহনাদে; জলধির কল্লোলে; দেখেছি
দ্রুত ইরম্মদে, দেব, ছুটিতে পবন–
পথে; কিন্তু কভু নাহি শুনি ত্রিভুবনে,
এহেন ঘোর ঘর্ঘর কোদণ্ড-টঙ্কারে!
কভু নাহি দেখি শর হেন ভয়ঙ্কর!—
পশিলা বীরেন্দ্রবৃন্দ বীরবাহু সহ
রণে, যূথনাথ সহ গজযূথ যথা।
ঘন ঘনাকারে ধূলা উঠিল আকাশে,—
মেঘদল আসি যেন আবরিলা রুষি
গগনে; বিদ্যুৎঝলা-সম চকমকি
উড়িল কলম্বকুল অম্বর প্রদেশে
শনশনে!— ধন্য শিক্ষা বীর বীরবাহু!
কত যে মরিল অরি, কে পারে গণিতে?
এইরূপে শত্রুমাঝে যুঝিলা স্বদলে
পুত্র তব, হে রাজন্! কত ক্ষণ পরে,
প্রবেশিলা, যুদ্ধে আসি নরেন্দ্র রাঘব।
কনক-মুকুট শিরে, করে ভীম ধনুঃ,
বাসবের চাপ যথা বিবিধ রতনে
খচিত,”— এতেক কহি, নীরবে কাঁদিল
ভগ্নদূত, কাঁদে যথা বিলাপী, স্মরিয়া
পূর্বদুঃখ! সভাজন কাঁদিলা নীরবে।
অশ্রুময়-আঁখি পুনঃ কহিলা রাবণ,
মন্দোদরীমনোহর;— “কহ, রে সন্দেশ–
বহ, কহ, শুনি আমি, কেমনে নাশিলা
দশাননাত্মজ শূরে দশরথাত্মজ?”
“কেমনে, হে মহীপতি,” পুনঃ আরম্ভিল
ভগ্নদূত, “কেমনে, হে রক্ষঃকুলনিধি,
কহিব সে কথা আমি, শুনিবে বা তুমি?
অগ্নিময় চক্ষুঃ যথা হর্যক্ষ, সরোষে
কড়মড়ি ভীম দন্ত, পড়ে লম্ফ দিয়া
বৃষস্কন্ধে, রামচন্দ্র আক্রমিলা রণে
কুমারে! চৌদিকে এবে সমর-তরঙ্গ
উথলিল, সিন্ধু যথা দ্বন্দ্বি বায়ু সহ
নির্ঘোষে! ভাতিল অসি অগ্নিশিখাসম
ধূমপুঞ্জসম চর্মাবলীর মাঝারে
অযুত! নাদিল কম্বু অম্বুরাশি-রবে!—
আর কি কহিব, দেব? পূর্বজন্মদোষে,
একাকী বাঁচিনু আমি! হায় রে বিধাতঃ,
কি পাপে এ তাপ আজি দিলি তুই মোরে?
কেন না শুইনু আমি শরশয্যোপরি,
হৈমলঙ্কা-অলঙ্কার বীরবাহু সহ
রণভূমে? কিন্তু নহি নিজ দোষে দোষী।
ক্ষত বক্ষঃস্থল মম, দেখ, নৃপমণি,
রিপু-প্রহরণে; পৃষ্ঠে নাহি অস্ত্রলেখা।”
এতেক কহিয়া স্তব্ধ হইল রাক্ষস
মনস্তাপে। লঙ্কাপতি হরষে বিষাদে
কহিলা; “সাবাসি, দূত! তোর কথা শুনি,
কোন্ বীর-হিয়া নাহি চাহে রে পশিতে
সংগ্রামে? ডমরুধ্বনি শুনি কাল ফণী
কভু কি অলসভাবে নিবাসে বিবরে?
ধন্য লঙ্কা, বীরপুত্রধারী! চল, সবে,—
চল যাই, দেখি, ওহে সভাসদ-জন,
কেমনে পড়েছে রণে বীর-চূড়ামণি
বীরবাহু; চল, দেখি জুড়াই নয়নে।”
উঠিলা রাক্ষসপতি প্রাসাদ-শিখরে,
কনক-উদয়াচলে দিনমণি যেন
অংশুমালী। চারিদিকে শোভিল কাঞ্চন-
সৌধ-কিরীটিনী লঙ্কা— মনোহরা পুরী!
হেমহর্ম্য সারি সারি পুষ্পবন মাঝে;
কমল-আলয় সরঃ; উৎস রজঃ-ছটা;
তরুরাজি; ফুলকুল— চক্ষু-বিনোদন,
যুবতীযৌবন যথা; হীরাচূড়াশিরঃ
দেবগৃহ; নানা রাগে রঞ্জিত বিপণি,
বিবিধ রতনপূর্ণ; এ জগৎ যেন
আনিয়া বিবিধ ধন, পূজার বিধানে,
রেখেছে, রে চারুলঙ্কে, তোর পদতলে,
জগত-বাসনা তুই, সুখের সদন।
দেখিলা রাক্ষসেশ্বর উন্নত প্রাচীর—
অটল অচল যথা; তাহার উপরে,
বীরমদে মত্ত, ফেরে অস্ত্রীদল, যথা
শৃঙ্গধরোপরি সিংহ। চারি সিংহদ্বার
(রুদ্ধ এবে) হেরিলা বৈদেহীহর; তথা
জাগে রথ, রথী, গজ, অশ্ব, পদাতিক
অগণ্য। দেখিলা রাজা নগর বাহিরে,
রিপুবৃন্দ, বালিবৃন্দ সিন্ধুতীরে যথা,
নক্ষত্র-মণ্ডল কিম্বা আকাশ-মণ্ডলে।
থানা দিয়া পূর্ব দ্বারে, দুর্বার সংগ্রামে,
বসিয়াছে বীর নীল; দক্ষিণ দুয়ারে
অঙ্গদ, করভসম নব বলে বলী;
কিংবা বিষধর, যবে বিচিত্র কঞ্চুক-
ভূষিত, হিমান্তে অহি ভ্রমে, ঊর্ধ্ব ফণা—
ত্রিশূলসদৃশ জিহ্বা লুলি অবলেপে!
উত্তর দুয়ারে রাজা সুগ্রীব আপনি
বীরসিংহ। দাশরথি পশ্চিম দুয়ারে—
হায় রে বিষণ্ণ এবে জানকী-বিহনে,
কৌমুদী-বিহনে যথা কুমুদরঞ্জন
শশাঙ্ক! লক্ষ্মণ সঙ্ঘে, বায়ুপুত্র হনু,
মিত্রবর বিভীষণ। এত প্রসরণে,
বেড়িয়াছে বৈরিদল স্বর্ণ-লঙ্কাপুরী,
গহন কাননে যথা ব্যাধ-দল মিলি,
বেড়ে জালে সাবধানে কেশরিকামিনী,—
নয়ন–রমণী রূপে, পরাক্রমে ভীমা
ভীমাসমা! অদূরে হেরিলা রক্ষঃপতি
রণক্ষেত্র। শিবাকুল, গৃধিনী, শকুনি,
কুক্কুর, পিশাচদল ফেরে কোলাহলে।
কেহ উড়ে; কেহ বসে; কেহ বা বিবাদে;
পাকসাট মারি কেহ খেদাইছে দূরে
সমলোভী জীবে; কেহ, গরজি উল্লাসে,
নাশে ক্ষুধা-অগ্নি; কেহ শোষে রক্তস্রোতে!
পড়েছে কুঞ্জরপুঞ্জ ভীষণ-আকৃতি;
ঝড়গতি ঘোড়া, হায়, গতিহীন এবে!
চূর্ণ রথ অগণ্য, নিষাদী, সাদী, শূলী,
রথী, পদাতিক পড়ি যায় গড়াগড়ি
একত্রে! শোভিছে বর্ম, চর্ম, অসি, ধনুঃ,
ভিন্দিপাল, তূণ, শর, মুদ্গর, পরশু,
স্থানে স্থানে; মণিময় কিরীট, শীর্ষক,
আর বীর-আভরণ, মহাতেজস্কর।
পড়িয়াছে যন্ত্রীদল যন্ত্রদল মাঝে।
হৈমধ্বজ দণ্ড হাতে, যম-দণ্ডাঘাতে,
পড়িয়াছে ধ্বজবহ। হায় রে, যেমতি
স্বর্ণ-চূড় শস্য ক্ষত কৃষিদলবলে,
পড়ে ক্ষেত্রে, পড়িয়াছে রাক্ষসনিকর,
রবিকুলরবি শূর রাঘবের শরে!
পড়িয়াছে বীরবাহু— বীর-চূড়ামণি,
চাপি রিপুচয় বলী, পড়েছিল যথা
হিড়িম্বার স্নেহনীড়ে পালিত গরুড়
ঘটোৎকচ, যবে কর্ণ, কালপৃষ্ঠধারী,
এড়িলা একাঘ্নী বাণ রক্ষিতে কৌরবে।
মহাশোকে শোকাকুল কহিলা রাবণ;—
“যে শয্যায় আজি তুমি শুয়েছ, কুমার
প্রিয়তম, বীরকুলসাধ এ শয়নে
সদা! রিপুদলবলে দলিয়া সমরে,
জন্মভূমি-রক্ষাহেতু কে ডরে মরিতে?
যে ডরে, ভীরু সে মূঢ়; শত ধিক্ তারে!
তবু, বৎস, যে হৃদয়, মুগ্ধ মোহমদে
কোমল সে ফুলসম। এ বজ্র-আঘাতে,
কত যে কাতর সে, তা জানেন সে জন,
অন্তর্যামী যিনি; আমি কহিতে অক্ষম।
হে বিধি, এ ভবভূমি তব লীলাস্থলী;—
পরের যাতনা কিন্তু দেখি কি হে তুমি
হও সুখী? পিতা সদা পুত্রদুঃখে দুঃখী—
তুমি হে জগত-পিতা, এ কি রীতি তব?
হা পুত্র! হা বীরবাহু! বীরেন্দ্র-কেশরী!
কেমনে ধরিব প্রাণ তোমার বিহনে?”
এইরূপে আক্ষেপিয়া রাক্ষস-ঈশ্বর
রাবণ, ফিরায়ে আঁখি, দেখিলেন দূরে
সাগর-মকরালয়। মেঘশ্রেণী যেন
অচল, ভাসিছে জলে শিলাকুল, বাঁধা
দৃঢ় বাঁধে; দুই পাশে তরঙ্গ-নিচয়,
ফেনাময়, ফণাময় যথা ফণিবর,
উথলিছে নিরন্তর গম্ভীর নির্ঘোষে।
অপূর্ব-বন্ধন সেতু; রাজপথ-সম
প্রশস্ত; বহিছে জনস্রোতঃ কলরবে,
স্রোতঃ-পথে জল যথা বরিষার কালে।
অভিমানে মহামানী বীরকুলর্ষভ
রাবণ, কহিলা বলী সিন্ধু পানে চাহি;—
“কি সুন্দর মালা আজি পরিয়াছ গলে,
প্রচেতঃ! হা ধিক্, ওহে জলদলপতি!
এই কি সাজে তোমারে, অলঙ্ঘ্য, অজেয়
তুমি? হায়, এই কি হে তোমার ভূষণ,
রত্নাকর? কোন্ গুণে, কহ, দেব, শুনি,
কোন গুণে দাশরথি কিনেছে তোমারে?
প্রভঞ্জনবৈরী তুমি; প্রভঞ্জন-সম
ভীম পরাক্রমে! কহ, এ নিগড় তবে
পর তুমি কোন্ পাপে? অধম ভালুকে
শৃঙ্খলিয়া যাদুকর, খেলে তারে লয়ে;
কেশরীর রাজপদ কার সাধ্য বাঁধে
বীতংসে? এই যে লঙ্কা, হৈমবতী পুরী,
শোভে তব বক্ষস্থলে, হে নীলাম্বুস্বামি,
কৌস্তুভ-রতন যথা মাধবের বুকে,
কেন হে নির্দয় এবে তুমি এর প্রতি?
উঠ, বলি; বীরবলে এ জাঙাল ভাঙি,
দূর কর অপবাদ; জুড়াও এ জ্বালা,
ডুবায়ে অতল জলে এ প্রবল রিপু।
রেখো না গো তব ভালে এ কলঙ্ক-রেখা,
হে বারীন্দ্র, তব পদে এ মম মিনতি।”
এতেক কহিয়া রাজরাজেন্দ্র রাবণ,
আসিয়া বসিলা পুনঃ কনক-আসনে
সভাতলে; শোকে মগ্ন বসিলা নীরবে
মহামতি; পাত্র, মিত্র, সভাসদ-আদি
বসিলা চৌদিকে, আহা, নীরব বিষাদে!
হেন কালে চারিদিকে সহসা ভাসিল
রোদন-নিনাদ মৃদু; তা সহ মিশিয়া
ভাসিল নূপুরধ্বনি, কিঙ্কিণীর বোল
ঘোর রোলে। হেমাঙ্গী সঙ্গিনীদল-সাথে
প্রবেশিলা সভাতলে চিত্রাঙ্গদা দেবী।
আলু থালু, হায়, এবে কবরীবন্ধন!
আভরণহীন দেহ, হিমানীতে যথা
কুসুমরতন-হীন বনসুশোভিনী
লতা! অশ্রুময় আঁখি, নিশার শিশির-
পূর্ণ পদ্মপর্ণ যেন! বীরবাহু-শোকে
বিবশা রাজমহিষী, বিহঙ্গিনী যথা,
যবে গ্রাসে কাল ফণী কুলায়ে পশিয়া
শাবকে। শোকের ঝড় বহিল সভাতে!
সুর-সুন্দরীর রূপে শোভিল চৌদিকে
বামাকুল; মুক্তকেশ মেঘমালা, ঘন
নিশ্বাস প্রলয়-বায়ু; অশ্রুবারি-ধারা
আসার; জীমূত-মন্দ্র হাহাকার রব!
চমকিলা লঙ্কাপতি কনক-আসনে।
ফেলিল চামর দূরে তিতি নেত্রনীরে
কিঙ্করী; কাঁদিল ফেলি ছত্র ছত্রধর;
ক্ষোভে, রোষে, দৌবারিক নিষ্কোষিলা অসি
ভীমরূপী; পাত্র, মিত্র, সভাসদ যত,
অধীর, কাঁদিলা সবে ঘোর কোলাহলে।
কত ক্ষণে মৃদুস্বরে কহিলা মহিষী
চিত্রাঙ্গদা, চাহি সতী রাবণের পানে;—
“একটি রতন মোরে দিয়েছিলে বিধি
কৃপাময়; দীন আমি থুয়েছিনু তারে
রক্ষাহেতু তব কাছে, রক্ষঃকুল-মণি,
তরুর কোটরে রাখে শাবকে যেমতি
পাখী। কহ, কোথা তুমি রেখেছ তাহারে,
লঙ্কানাথ? কোথা মম অমূল্য রতন?
দরিদ্র-ধন-রক্ষণ রাজধর্ম; তুমি
রাজকুলেশ্বর; কহ, কেমনে রেখেছ,
কাঙ্গালিনী আমি, রাজা, আমার সে ধনে?”
উত্তর করিলা তবে দশানন বলী;—
“এ বৃথা গঞ্জনা, প্রিয়ে, কেন দেহ মোরে!
গ্রহদোষে দোষী জনে কে নিন্দে, সুন্দরি?
হায়, বিধিবশে, দেবি, সহি এ যাতনা
আমি! বীরপুত্রধাত্রী এ কনকপুরী,
দেখ, বীরশূন্য এবে; নিদাঘে যেমতি
ফুলশূন্য বনস্থলী, জলশূন্য নদী!
বরজে সজারু পশি বারুইর যথা
ছিন্ন ভিন্ন করে তারে, দশরথাত্মজ
মজাইছে লঙ্কা মোর! আপনি জলধি
পরেন শৃঙ্খল পায়ে তার অনুরোধে!
এক পুত্রশোকে তুমি আকুলা, ললনে,
শত পুত্রশোকে বুক আমার ফাটিছে
দিবা নিশি! হায়, দেবি, যথা বনে বায়ু
প্রবল, শিমুলশিম্বী ফুটাইলে বলে,
উড়ি যায় তূলারাশি, এ বিপুল-কুল-
শেখর রাক্ষস যত পড়িছে তেমতি
এ কাল সমরে। বিধি প্রসারিছে বাহু
বিনাশিতে লঙ্কা মম, কহিনু তোমারে।”
নীরবিলা রক্ষোনাথ; শোকে অধোমুখে
বিধুমুখী চিত্রাঙ্গদা, গন্ধর্বনন্দিনী,
কাঁদিলা, — বিহ্বলা, আহা, স্মরি পুত্রবরে।
কহিতে লাগিলা পুনঃ দাশরথি-অরি;—
“এ বিলাপ কভু, দেবি, সাজে কি তোমারে?
দেশবৈরী নাশি রণে পুত্রবর তব
গেছে চলি স্বর্গপুরে; বীরমাতা তুমি;
বীরকর্মে হত পুত্র-হেতু কি উচিত
ক্রন্দন? এ বংশ মম উজ্জ্বল হে আজি
তব পুত্রপরাক্রমে; তবে কেন তুমি
কাঁদ, ইন্দুনিভাননে, তিত অশ্রুনীরে?”
উত্তর করিলা তবে চারুনেত্রা দেবী
চিত্রাঙ্গদা;— “দেশবৈরী নাশে যে সমরে,
শুভক্ষণে জন্ম তার; ধন্য বলে মানি
হেন বীরপ্রসূনের প্রসূ ভাগ্যবতী।
কিন্তু ভেবে দেখ, নাথ, কোথা লঙ্কা তব;
কোথা সে অযোধ্যাপুরী? কিসের কারণে,
কোন্ লোভে, কহ, রাজা, এসেছে এ দেশে
রাঘব? এ স্বর্ণ-লঙ্কা দেবেন্দ্রবাঞ্ছিত,
অতুল ভবমণ্ডলে; ইহার চৌদিকে
রজত-প্রাচীর-সম শোভেন জলধি।
শুনেছি সরযূতীরে বসতি তাহার—
ক্ষুদ্র নর। তব হৈমসিংহাসন-আশে
যুঝিছে কি দাশরথি? বামন হইয়া
কে চাহে ধরিতে চাঁদে? তবে দেশরিপু
কেন তারে বল, বলি? কাকোদর সদা
নম্রশিরঃ; কিন্তু তারে প্রহারয়ে যদি
কেহ ঊর্ধ্ব-ফণা ফণী দংশে প্রহারকে।
কে, কহ, এ কাল-অগ্নি জ্বালিয়াছে আজি
লঙ্কাপুরে? হায়, নাথ, নিজ কর্ম-ফলে,
মজালে রাক্ষসকুলে, মজিলা আপনি!”
এতেক কহিয়া বীরবাহুর জননী,
চিত্রাঙ্গদা, কাঁদি সঙ্গে সঙ্গীদলে লয়ে,
প্রবেশিলা অন্তঃপুরে। শোকে, অভিমানে,
ত্যজি সুকনকাসন, উঠিলা গর্জিয়া
রাঘবারি। “এত দিনে” (কহিলা ভূপতি)
“বীরশূন্য লঙ্কা মম! এ কাল সমরে,
আর পাঠাইব কারে? কে আর রাখিবে
রাক্ষসকুলের মান? যাইব আপনি।
সাজ হে বীরেন্দ্রবৃন্দ, লঙ্কার ভূষণ!
দেখিব কি গুণ ধরে রঘুকুলমণি!
অরাবণ, অরাম বা হবে ভব আজি!”
এতেক কহিলা যদি নিকষানন্দন
শূরসিংহ, সভাতলে বাজিল দুন্দুভি
গম্ভীর জীমূতমন্দ্রে। সে ভৈরব রবে,
সাজিল কর্বূরবৃন্দ বীরমদে মাতি,
দেব-দৈত্য-নর-ত্রাস, বাহিরিল বেগে
বারী হতে (বারিস্রোতঃ-সম পরাক্রমে
দুর্বার) বারণযূথ; মন্দুরা ত্যজিয়া
বাজীরাজি, বক্রগ্রীব, চিবাইয়া রোষে
মুখস্। আইল রড়ে রথ স্বর্ণচূড়,
বিভায় পূরিয়া পুরী। পদাদিক-ব্রজ,
কনক শিরস্ক শিরে, ভাস্বর পিধানে
অসিবর, পৃষ্ঠে চর্ম অভেদ্য সমরে,
হস্তে শূল, শালবৃক্ষ অভ্রভেদী যথা,
আয়সী-আবৃত দেহ, আইল কাতারে।
আইল নিষাদী যথা মেঘবরাসনে
বজ্রপাণি; সাদী যথা অশ্বিনী-কুমার,
ধরি ভীমাকার ভিন্দিপাল, বিশ্বনাশী
পরশু,— উঠিল আভা আকাশমণ্ডলে,
যথা বনস্থলে যবে পশে দাবানল।
রক্ষঃকুলধ্বজ ধরি, ধ্বজধর বলী
মেলিলা কেতনবর, রতনে খচিত,
বিস্তারিয়া পাখা যেন উড়িলা গরুড়
অম্বরে। গম্ভীর রোলে বাজিল চৌদিকে
রণবাদ্য হয়ব্যূহ হেষিল উল্লাসে,
গরজিল গজ, শঙ্খ নাদিল ভৈরবে;
কোদণ্ড-টঙ্কার সহ অসির ঝন্ ঝনি
রোধিল শ্রবণ-পথ মহা কোলাহলে!
টলিল কনকলঙ্কা বীরপদভরে;—
গর্জিলা বারীশ রোষে! যথা জলতলে
কনক-পঙ্কজ-বনে, প্রবাল-আসনে,
বারুণী রূপসী বসি, মুক্তাফল দিয়া
কবরী বাঁধিতেছিলা, পশিল সে স্থলে
আরাব; চমকি সতী চাহিলা চৌদিকে।
কহিলেন বিধুমুখী সখীরে সম্ভাষি
মধুস্বরে;— “কি কারণে, কহ, লো স্বজনি,
সহসা জলেশ পাশী অস্থির হইলা?
দেখ, থর থর করি কাঁপে মুক্তাময়ী
গৃহচূড়া। পুনঃ বুঝি দুষ্ট বায়ুকুল
যুঝিতে তরঙ্গচয়-সঙ্গে দিলা দেখা।
ধিক্ দেব প্রভঞ্জনে! কেমনে ভুলিলা
আপন প্রতিজ্ঞা, সখি, এত অল্প দিনে
বায়ুপতি? দেবেন্দ্রর সভায় তাঁহারে
সাধিনু সেদিন আমি বাঁধিতে শৃঙ্খলে
বায়ু-বৃন্দে; কারাগারে রোধিতে সবারে।
হাসিয়া কহিলা দেব;— অনুমতি দেহ,
জলেশ্বরি, তরঙ্গিণী বিমলসলিলা
আছে যত ভবতলে কিঙ্করী তোমারি
তা সবার সহ আমি বিহারি সতত,—
তা হলে পালিব আজ্ঞা;— তখনি, স্বজনি,
সায় তাহে দিনু আমি। তবে কেন আজি,
আইলা পবন মোরে দিতে এ যাতনা?”
উত্তর করিলা সখী কল কল রবে;—
“বৃথা গঞ্জ প্রভঞ্জনে, বারীন্দ্রমহিষি,
তুমি। এ তো ঝড় নহে; কিন্তু ঝড়াকারে
সাজিছে রাবণ রাজা স্বর্ণলঙ্কাধামে,
লাঘবিতে রাঘবের বীরগর্ব রণে।”
কহিলা বারুণী পুনঃ;— “সত্য, লো স্বজনি,
বৈদেহীর হেতু রাম রাবণে বিগ্রহ।
রক্ষঃকুল-রাজলক্ষ্মী মম প্রিয়তমা
সখী। যাও শীঘ্র তুমি তাঁহার সদনে,
শুনিতে লালসা মোর রণের বারতা।
এই স্বর্ণকমলটি দিও কমলারে।
কহিও, যেখানে তাঁর রাঙা পা দুখানি
রাখিতেন শশিমুখী বসি পদ্মাসনে,
সেখানে ফোটে এ ফুল, যে অবধি তিনি,
আঁধারি জলধি-গৃহ, গিয়াছেন গৃহে।”
উঠিলা মুরলা সখী, বারুণী-আদেশে,
জলতল ত্যজি, যথা উঠয়ে চটুলা
সফরী, দেখাতে ধনী রজঃ-কান্তি-ছটা-
বিভ্রম বিভাবসুরে। উতরিলা দূতী
যথায় কমলালয়ে, কমল-আসনে,
বসেন কমলময়ী কেশব-বাসনা
লঙ্কাপুরে। ক্ষণকাল দাঁড়ায়ে দুয়ারে,
জুড়াইলা আঁখি সখী, দেখিয়া সম্মুখে,
যে রূপমাধুরী মোহে মদনমোহনে।
বহিছে বাসন্তানিল— চির অনুচর—
দেবীর কমলপদপরিমল-আশে
সুস্বনে। কুসুমরাশি শোভিছে চৌদিকে,
ধনদের হৈমাগারে রত্নরাজী যথা।
শত স্বর্ণ-ধূপদানে পুড়িছে অগুরু,
গন্ধরস, গন্ধামোদে আমোদি দেউলে।
স্বর্ণপাত্রে সারি সারি উপহার নানা,
বিবিধ উপকরণ। স্বর্ণদীপাবলী
দীপিছে, সুরভি তৈলে পূর্ণ-হীনতেজাঃ,
খদ্যোতিকাদ্যোতি যথা পূর্ণ-শশী-তেজে!
ফিরায়ে বদন, ইন্দু-বদনা ইন্দিরা
বসেন বিষাদে দেবী, বসেন যেমতি—
বিজয়া-দশমী যবে বিরহের সাথে
প্রভাতয়ে গৌড়গৃহে— উমা চন্দ্রাননা
করতলে বিন্যাসিয়া কপোল, কমলা
তেজস্বিনী, বসি দেবী কমল-আসনে;—
পশে কি গো শোক হেন কুসুম-হৃদয়ে?
প্রবেশিলা মন্দগতি মন্দিরে সুন্দরী
মুরলা; প্রবেশি দূতী, রমার চরণে
প্রণমিলা, নতভাবে। আশীষি ইন্দিরা—
রক্ষঃ-কুল-রাজলক্ষ্মী— কহিতে লাগিলা;—
“কি কারণে হেথা আজি, কহ লো মুরলে;
গতি তব? কোথা দেবী জলদলেশ্বরী,
প্রিয়তমা সখী মম? সদা আমি ভাবি
তাঁর কথা। ছিনু যবে তাঁহার আলয়ে,
কত যে করিলা কৃপা মোর প্রতি সতী
বারুণী, কভু কি আমি পারি তা ভুলিতে?
রমার আশার বাস হরির উরসে;—
হেন হরি হারা হয়ে বাঁচিল যে রমা,
সে কেবল বারুণীর স্নেহৌষধগুণে।
ভাল তো আছেন, কহ, প্রিয়সখী মম
বারীন্দ্রাণী?” উত্তরিলা মুরলা রূপসী;—
“নিরাপদে জলতলে বসেন বারুণী।
বৈদেহীর হেতু রাম রাবণে বিগ্রহ;
শুনিতে লালসা তাঁর রণের বারতা।
এই যে পদ্মটি, সতি, ফুটেছিল সুখে।
যেখানে রাখিতে তুমি রাঙা পা দুখানি;
তেঁই পাশি-প্রণয়িনী প্রেরিয়াছে এরে।”
বিষাদে নিশ্বাস ছাড়ি কহিলা কমলা,
বৈকুণ্ঠধামের জ্যোৎস্না;— “হায় লো স্বজনি,
দিন দিন হীন-বীর্য রাবণ দুর্মতি,
যাদঃ-পতি-রোধঃ যথা চলোর্মি-আঘাতে!
শুনি চমকিবে তুমি। কুম্ভকর্ণ বলী
ভীমাকৃতি, অকম্পন, রণে ধীর, যথা
ভূধর, পড়েছে সহ অতিকায় রথী।
আর যত রক্ষঃ আমি বর্ণিতে অক্ষম।
মরিয়াছে বীরবাহু— বীর-চূড়ামণি,
ঐ যে ক্রন্দন-ধ্বনি শুনিছ, মুরলে,
অন্তঃপুরে, চিত্রাঙ্গদা কাঁদে পুত্রশোকে
বিকলা। চঞ্চলা আমি ছাড়িতে এ পুরী।
বিদরে হৃদয় মম শুনি দিবা নিশি
প্রমদা-কুল-রোদন! প্রতি গৃহে কাঁদে
পুত্রহীনা মাতা, দূতি, পতিহীনা সতী!”
শুধিলা মুরলা;— “কহ, শুনি, মহাদেবি,
কোন্ বীর আজি পুনঃ সাজিছে যুঝিতে
বীরদর্পে?” উত্তরিলা মাধব-রমণী;—
“না জানি কে সাজে আজি। চল লো মুরলে,
বাহিরিয়া দেখি মোরা কে যায় সমরে।”
এতেক কহিয়া রমা মুরলার সহ,
রক্ষঃকুল-বালা-রূপে, বাহিরিলা দোঁহে
দুকূল-বসনা। রুণু রুণু মধুবোলে
বাজিল কিঙ্কিণী; করে শোভিল কঙ্কণ,
নয়নরঞ্জন কাঞ্চী কৃশ কটিদেশে।
দেউল দুয়ারে দোঁহে দাঁড়ায়ে দেখিলা,
কাতারে কাতারে সেনা চলে রাজপথে,
সাগরতরঙ্গ যথা পবন-তাড়নে
দ্রুতগামী। ধায় রথ, ঘুরয়ে ঘর্ঘরে
চক্রনেমি। দৌড়ে ঘোড়া ঘোর ঝড়াকারে।
অধীরিয়া বসুধারে পদভরে, চলে
দন্তী, আস্ফালিয়া শুণ্ড, দণ্ডধর যথা
কাল-দণ্ড। বাজে বাদ্য গম্ভীর নিক্কণে।
রতনে খচিত কেতু উড়ে শত শত
তেজস্কর। দুই পাশে, হৈম-নিকেতন-
বাতায়নে দাঁড়াইয়া ভুবনমোহিনী
লঙ্কাবধূ বরিষয়ে কুসুম-আসার,
করিয়া মঙ্গলধ্বনি। কহিলা মুরলা,
চাহি ইন্দিরার ইন্দুবদনের পানে;—
“ত্রিদিব-বিভব, দেবি, দেখি ভবতলে
আজি! মনে হয় যেন, বাসব আপনি,
স্বরীশ্বর, সুর-বল-দল সঙ্গে করি,
প্রবেশিলা লঙ্কাপুরে। কহ, কৃপাময়ি,
কৃপা করি কহ, শুনি, কোন্ কোন্ রথী
রণ-হেতু সাজে এবে মত্ত বীরমদে?”
কহিলা, কমলা সতী কমলনয়না;—
“হায়, সখী, বীরশূন্য স্বর্ণলঙ্কাপুরী!
মহারথীকুল-ইন্দ্র আছিল যাহারা,
দেব-দৈত্য-নর-ত্রাস, ক্ষয় এ দুর্জয়
রণে! শুভ ক্ষণে ধনুঃ ধরে রঘুমণি!
ওই যে দেখিছ রথী স্বর্ণ-চূড়-রথে,
ভীমমূর্তি, বিরূপাক্ষ রক্ষঃ-দল-পতি,
প্রক্ষ্বেড়নধারী বীর, দুর্বার সমরে।
গজপৃষ্ঠে দেখ ওই কালনেমি, বলে
রিপুকুল-কাল বলী, ভিন্দিপালপাণি!
অশ্বারোহী দেখ ঐ তালবৃক্ষাকৃতি
তালজঙ্ঘা, হাতে গদা, গদাধর যথা
মুরারি! সমরমদে মত্ত, ঐ দেখ
প্রমত্ত, ভীষণ রক্ষঃ, বক্ষঃ শিলাসম
কঠিন! অন্যান্য যত কত আর কব?
শত শত হেন যোধ হত এ সমরে,
যথা যবে প্রবেশয়ে গহন বিপিনে
বৈশ্বানর, তুঙ্গতর মহীরূহব্যূহ
পুড়ি ভস্মরাশি সবে ঘোর দাবানলে।”
শুধিলা মুরলা দূতী: “কহ, দেবীশ্বরি,
কি কারণে নাহি হেরি মেঘনাদ রথী
ইন্দ্রজিতে — রক্ষঃ-কুল-হর্যক্ষ বিগ্রহে?
হত কি সে বলী, সতি, এ কাল সমরে?”
উত্তর করিলা রমা সুচারুহাসিনী;—
“প্রমোদ-উদ্যানে বুঝি ভ্রমিছে আমোদে,
যুবরাজ, নাহি জানি হত আজি রণে
বীরবাহু; যাও তুমি বারুণীর পাশে,
মুরলে। কহিও তাঁরে এ কনক-পুরী
ত্যজিয়া, বৈকুণ্ঠধামে ত্বরা যাব আমি।
নিজদোষে মজে রাজা লঙ্কা-অধিপতি।
হায়, বরিষার কালে বিমল-সলিলা
সরসী, সমলা যথা কর্দম-উদ্গমে,
পাপে পূর্ণ স্বর্ণলঙ্কা! কেমনে এখানে
আর বাস করি আমি? যাও চলি, সখি,
প্রবাল-আসনে যথা বসেন বারুণী
মুক্তাময় নিকেতনে। যাই আমি যথা
ইন্দ্রজিৎ আনি তারে স্বর্ণ-লঙ্কা-ধামে।
প্রাক্তনের ফল ত্বরা ফলিবে এ পুরে।”
প্রণমি দেবীর পদে, বিদায় হইয়া,
উঠিলা পবন-পথে মুরলা রূপসী
দূতী, যথা শিখণ্ডিনী, আখণ্ডল-ধনুঃ-
বিবিধ-রতন-কান্তি আভায় রঞ্জিয়া
নয়ন, উড়য়ে ধনী মঞ্জু কুঞ্জবনে!
উতরি জলধি-কূলে, পশিলা সুন্দরী
নীল-অম্বু-রাশি। হেথা কেশব-বাসনা
পদ্মাক্ষী, চলিলা রক্ষঃ-কুল-লক্ষ্মী, দূরে
যথায় বাসবত্রাস বসে বীরমণি
মেঘনাদ। শূন্যমার্গে চলিলা ইন্দিরা।
কত ক্ষণে উতরিলা হৃষীকেশ-প্রিয়া,
সুকেশিনী, যথা বসে চির-রণজয়ী
ইন্দ্রজিৎ। বৈজয়ন্তধাম-সম পুরী,—
অলিন্দে সুন্দর হৈমময় স্তম্ভাবলী
হীরাচূড়; চারি দিকে রম্য বনরাজী
নন্দনকানন যথা। কুহরিছে ডালে
কোকিল; ভ্রমরদল ভ্রমিছে গুঞ্জরি;
বিকশিছে ফুলকুল; মর্মরিছে পাতা;
বহিছে বাসন্তানিল; ঝরিছে ঝর্ঝরে
নির্ঝর। প্রবেশি দেবী সুবর্ণ-প্রাসাদে,
দেখিলা সুবর্ণ-দ্বারে ফিরিছে নির্ভয়ে
ভীমরূপী বামাবৃন্দ, শরাসন করে।
দুলিছে নিষঙ্গ-সঙ্গে বেণী পৃষ্ঠদেশে।
বিজলীর ঝলা সম, বেণীর মাঝারে,
রত্নরাজি, তূণে শর মণিময় ফণী!
উচ্চ কুচ-যুগোপরি সুবর্ণ-কবচ,
রবি-কর-জাল যথা প্রফুল্ল কমলে।
তূণে মহাখর শর; কিন্তু খরতর
আয়ত-লোচনে শর। নবীন যৌবন-
মদে মত্ত, ফেরে সবে মাতঙ্গিনী যথা
মধুকালে। বাজে কাঞ্চী, মধুর শিঞ্জিতে,
বিশাল নিতম্ববিম্বে; নূপুর চরণে।
বাজে বীণা, সপ্তস্বরা, মুরজ, মুরলী;
সঙ্গীত-তরঙ্গ, মিশি সে রবের সহ,
উথলিছে চারি দিকে, চিত্ত বিনোদিয়া।
বিহারিছে বীরবর, সঙ্গে বরাঙ্গনা
প্রমদা, রজনীনাথ, বিহারেন যথা
দক্ষ-বালা-দলে লয়ে; কিম্বা, রে যমুনে,
ভানুসুতে, বিহারেন রাখাল যেমতি
নাচিয়া কদম্বমূলে, মুরলী অধরে,
গোপ-বধূ-সঙ্গে রঙ্গে তোর চারু কূলে!
মেঘনাদধাত্রী নামে প্রভাষা রাক্ষসী।
তার রূপ ধরি রমা, মাধব-রমণী,
দিলা দেখা, মুষ্টে যষ্টি, বিশদ-বসনা।
কনক-আসন ত্যজি, বীরেন্দ্রকেশরী
ইন্দ্রজিৎ, প্রণমিয়া ধাত্রীর চরণে,
কহিলা,— “কি হেতু, মাতঃ, গতি তব আজি
এ ভবনে? কহ দাসে লঙ্কার কুশল।”
শিরঃ চুম্বি, ছদ্মবেশী অম্বুরাশি-সুতা
উত্তরিলা;— “হায়! পুত্র, কি আর কহিব
কনক-লঙ্কার দশা! ঘোরতর রণে,
হত প্রিয় ভাই তব বীরবাহু বলী!
তার শোকে মহাশোকী রাক্ষসাধিপতি,
সসৈন্যে সাজেন আজি যুঝিতে আপনি।”
জিজ্ঞাসিলা মহাবাহু বিস্ময় মানিয়া;—
“কি কহিলা, ভগবতি? কে বধিল কবে
প্রিয়ানুজে? নিশা-রণে সংহারিনু আমি
রঘুবরে; খণ্ড খণ্ড করিয়া কাটিনু
বরষি প্রচণ্ড শর বৈরিদলে; তবে
এ বারতা, এ অদ্ভুত বারতা, জননি,
কোথায় পাইলে তুমি, শীঘ্র কহ দাসে।”
রত্নাকর রত্নোত্তমা ইন্দিরা সুন্দরী
উত্তরিলা;— “হায়! পুত্র, মায়াবী মানব
সীতাপতি; তব শরে মরিয়া বাঁচিল।
যাও তুমি ত্বরা করি; রক্ষ রক্ষঃকুল-
মান, এ কালসমরে, রক্ষঃ-চূড়ামণি!”
ছিঁড়িলা কুসুমদাম রোষে মহাবলী
মেঘনাদ; ফেলাইলা কনক-বলয়
দূরে; পদ-তলে পড়ি শোভিল কুণ্ডল,
যথা অশোকের ফুল অশোকের তলে
আভাময়! “ধিক্ মোরে” কহিলা গম্ভীরে
কুমার, “হা ধিক্ মোরে! বৈরিদল বেড়ে
স্বর্ণলঙ্কা, হেথা আমি বামাদল মাঝে?
এই কি সাজে আমারে, দশাননাত্মজ
আমি ইন্দ্রজিৎ, আন রথ ত্বরা করি;
ঘুচাব এ অপবাদ, বধি রিপুকুলে।”
সাজিলা রথীন্দ্রর্ষভ বীর-আভরণে
হৈমবতীসুত যথা নাশিতে তারকে
মহাসুর; কিম্বা যথা বৃহন্নলারূপী
কিরীটি, বিরাটপুত্র সহ, উদ্ধারিতে
গোধন, সাজিলা শূর, শমীবৃক্ষমূলে।
মেঘবর্ণ রথ; চক্র বিজলীর ছটা;
ধ্বজ ইন্দ্রচাপরূপী; তুরঙ্গম বেগে
আশুগতি। রথে চড়ে বীর-চূড়ামণি
বীরদর্পে, হেন কালে প্রমীলা সুন্দরী,
ধরি পতি-কর-যুগ (হায় রে, যেমতি
হেমলতা আলিঙ্গয়ে তরু-কুলেশ্বরে)
কহিলা কাঁদিয়া ধনী; “কোথা প্রাণসখে,
রাখি এ দাসীরে, কহ, চলিলা আপনি?
কেমনে ধরিবে প্রাণ তোমার বিরহে
এ অভাগী? হায়, নাথ, গহন কাননে,
ব্রততী বাঁধিলে সাধে করি-পদ, যদি
তার রঙ্গরসে মনঃ না দিয়া, মাতঙ্গ
যায় চলি, তবু তারে রাখে পদাশ্রমে
যূথনাথ। তবে কেন তুমি, গুণনিধি,
ত্যজ কিঙ্করীরে আজি?” হাসি উত্তরিলা
মেঘনাদ, “ইন্দ্রজিতে জিতি তুমি, সতি,
বেঁধেছ যে দৃঢ় বাঁধে, কে পারে খুলিতে
সে বাঁধে? ত্বরায় আমি আসিব ফিরিয়া
কল্যাণি, সমরে নাশি তোমার কল্যাণে
রাঘবে। বিদায় এবে দেহ, বিধুমুখি।”
উঠিলা পবন-পথে, ঘোরতর রবে,
রথবর, হৈমপাখা বিস্তারিয়া যেন
উড়িলা মৈনাক-শৈল, অম্বর উজলি!
শিঞ্জিনী আকর্ষি রোষে, টঙ্কারিলা ধনুঃ
বীরেন্দ্র, পক্ষীন্দ্র যথা নাদে মেঘ মাঝে
ভৈরবে। কাঁপিলা লঙ্কা, কাঁপিলা জলধি!
সাজিছে রাবণরাজা, বীরমদে মাতি;—
বাজিছে রণ-বাজনা; গরজিছে গজ;
হেষে অশ্ব; হুঙ্কারিছে পদাতিক, রথী;
উড়িছে কৌশিক-ধ্বজ; উঠিছে আকাশে
কাঞ্চন-কঞ্চুক-বিভা। হেন কালে তথা
দ্রুতগতি উতরিলা মেঘনাদ রথী।
নাদিলা কর্বূরদল হেরি বীরবরে
মহাগর্বে। নমি পুত্র পিতার চরণে,
করজোড়ে কহিলা;— “হে রক্ষঃ-কুল-পতি,
শুনেছি, মরিয়া নাকি বাঁচিয়াছে পুনঃ
রাঘব? এ মায়া, পিতঃ, বুঝিতে না পারি!
কিন্তু অনুমতি দেহ; সমূলে নির্মূল
করিব পামরে আজি! ঘোর শরানলে
করি ভস্ম, বায়ু-অস্ত্রে উড়াইব তারে;
নতুবা বাঁধিয়া আনি দিব রাজপদে।”
আলিঙ্গি কুমারে, চুম্বি শিরঃ, মৃদুস্বরে
উত্তর করিলা তবে স্বর্ণ-লঙ্কাপতি;
“রাক্ষস-কুল-শেখর তুমি, বৎস; তুমি
রাক্ষস-কুল-ভরসা। এ কাল সমরে,
নাহি চাহে প্রাণ মম পাঠাইতে তোমা
বারংবার। হায়, বিধি বাম মম প্রতি।
কে কবে শুনেছে পুত্র, ভাসে শিলা জলে,
কে কবে শুনেছে, লোক মরি পুনঃ বাঁচে?”
উত্তরিলা বীরদর্পে অসুরারি-রিপু;—
“কি ছার সে নর, তারে ডরাও আপনি,
রাজেন্দ্র? থাকিতে দাস, যদি যাও রণে
তুমি, এ কলঙ্ক, পিতঃ, ঘুষিবে জগতে।
হাসিবে মেঘবাহন; রুষিবেন দেব
অগ্নি। দুই বার আমি হারানু রাঘবে;
আর এক বার পিতঃ, দেহ আজ্ঞা মোরে;
দেখিব এবার বীর বাঁচে কি ঔষধে!”
কহিলা রাক্ষসপতি;— “কুম্ভকর্ণ বলী
ভাই মম,— তায় আমি জাগানু অকালে
ভয়ে; হায়, দেহ তার, দেখ, সিন্ধু-তীরে
ভূপতিত, গিরিশৃঙ্গ কিম্বা তরু যথা
বজ্রাঘাতে! তবে যদি একান্ত সমরে
ইচ্ছা তব, বৎস, আগে পূজ ইষ্টদেবে,—
নিকুম্ভিলা যজ্ঞ সাঙ্গ কর, বীরমণি!
সেনাপতি-পদে আমি বরিণু তোমারে।
দেখ, অস্তাচলগামী দিননাথ এবে;
প্রভাতে যুঝিও, বৎস, রাঘবের সাথে।”
এতেক কহিয়া রাজা, যথাবিধি লয়ে
গঙ্গোদক, অভিষেক করিলা কুমারে।
অমনি বন্দিল বন্দী, করি বীণাধ্বনি
আনন্দে; “নয়নে তব, হে রাক্ষস-পুরি,
অশ্রুবিন্দু; মুক্তকেশি শোকাবেশে তুমি;
ভূতলে পড়িয়া, হায়, রতন-মুকুট,
আর রাজ-আভরণ, হে রাজসুন্দরি,
তোমার! উঠ গো শোক পরিহার, সতি।
রক্ষঃ-কুল-রবি ওই উদয়-অচলে।
প্রভাত হইল তব দুঃখ-বিভাবরী!
উঠ রাণি, দেখ, ওই ভীম বাম করে
কোদণ্ড, টঙ্কারে যার বৈজয়ন্ত-ধামে
পাণ্ডুবর্ণ আখণ্ডল! দেখ তূণ, যাহে
পশুপতি-ত্রাস অস্ত্র পাশুপত-সম!
গুণি-গণ-শ্রেষ্ঠ গুণী, বীরেন্দ্র-কেশরী,
কামিনীরঞ্জন রূপে, দেখ মেঘনাদে!
ধন্য রাণী মন্দোদরী! ধন্য রক্ষঃ-পতি
নৈকষেয়! ধন্য লঙ্কা, বীরধাত্রী তুমি!
আকাশ-দুহিতা ওগো শুন প্রতিধ্বনি,
কহ সবে মুক্তকণ্ঠে, সাজে অরিন্দম
ইন্দ্রজিৎ। ভয়াকুল কাঁপুক শিবিরে
রঘুপতি, বিভীষণ, রক্ষঃ-কুল-কালি,
দণ্ডক-অরণ্যচর ক্ষুদ্র প্রাণী যত।”
বাজিল রাক্ষস-বাদ্য, নাদিল রাক্ষস;—
পুরিল কনক-লঙ্কা জয় জয় রবে।
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 3 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-4-212x300.jpg)
দ্বিতীয় সর্গ — মেঘনাদবধ কাব্য – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
অস্তে গেল দিনমণি; আইলা গোধূলি,—
একটি রতন ভালে। ফুটিলা কুমুদী;
মুদিলা সরসে আঁখি বিরসবদনা
নলিনী; কূজনি পাখী পশিল কুলায়ে;
গোষ্ঠ-গৃহে গাভী-বৃন্দ ধায় হাম্বা রবে।
আইলা সুচারু-তারা শশী সহ হাসি,
শর্বরী; সুগন্ধবহ বহিল চৌদিকে,
সুস্বনে সবার কাছে কহিয়া বিলাসী,
কোন্ কোন্ ফুল চুষি কি ধন পাইলা।
আইলেন নিদ্রা দেবী; ক্লান্ত শিশুকুল
জননীর ক্রোড়-নীড়ে লভয়ে যেমতি
বিরাম, ভূচর সহ জলচর-আদি
দেবীর চরণাশ্রমে বিশ্রাম লভিলা।
উতরিলা শশিপ্রিয়া ত্রিদশ-আলয়ে।
বসিলেন দেবপতি দেবসভা মাঝে,
হৈমাসনে; বামে দেবী পুলোম-নন্দিনী
চারুনেত্রা। রজ-ছত্র, মণিময় আভা,
শোভিল দেবেন্দ্র-শিরে। রতনে খচিত
চামর যতনে ধরি, ঢুলায় চামরী।
আইলা সুসমীরণ, নন্দন-কানন-
গন্ধমধু বহি রঙ্গে। বাজিল চৌদিকে
ত্রিদিব-বাদিত্র। ছয় রাগ, মূর্তিমতী
ছত্রিশ রাগিণী সহ, আসি আরম্ভিলা
সঙ্গীত। ঊর্বশী, রম্ভা সুচারুহাসিনী,
চিত্রলেখা, সুকেশিনী মিশ্রকেশী, আসি
নাচিলা, শিঞ্জিতে রঞ্জি দেব-কুল-মনঃ!
যোগায় গন্ধর্ব স্বর্ণ-পাত্রে সুধারসে!
কেহ বা দেব-ওদন; কুঙ্কুম, কস্তুরী,
কেশর বহিছে কেহ; চন্দন কেহ বা;
সুগন্ধ মন্দার-দাম গাঁথি আনে কেহ।
বৈজয়ন্ত-ধামে সুখে ভাসেন বাসব
ত্রিদিব-নিবাসী সহ; হেন কালে তথা,
রূপের আভায় আলো করি সুর-পুরী
রক্ষঃ-কুল-রাজলক্ষ্মী আসি উতরিলা।
সসম্ভ্রমে প্রণমিলা রমার চরণে
শচীকান্ত। আশীষিয়া হৈমাসনে বসি,
পদ্মাক্ষী পুণ্ডরীকাক্ষ-বক্ষোনিবাসিনী
কহিলা; “হে সুরপতি, কেন যে আইনু
তোমার সভায় আজি, শুন মন দিয়া।”
উত্তর করিলা ইন্দ্র; “হে বারীন্দ্র-সুতে,
বিশ্বরমে, এ বিশ্বে ও রাঙা পা দুখানি
বিশ্বের আকাঙ্খা মা গো! যার প্রতি তুমি,
কৃপা করি, কৃপা-দৃষ্টি কর, কৃপাময়ি,
সফল জনম তারি! কোন্ পুণ্য-ফলে,
লভিল এ সুখ দাস, কহ, মা দাসেরে?”
কহিলেন পুনঃ রমা, “বহুকালাবধি
আছি আমি, সুরনিধি, স্বর্ণ-লঙ্কাধামে।
পূজে মোরে রক্ষোরাজ! হায়, এত দিনে
বাম তার প্রতি বিধি! নিজ কর্ম-দোষে,
মজিছে সবংশে পাপী; তবুও তাহারে
না পারি ছাড়িতে, দেব। বন্দী যে, দেবেন্দ্র,
কারাগার-দ্বার নাহি খুলিলে কি কভু
পারে সে বাহির হতে? যত দিন বাঁচে
রাবণ, থাকিব আমি বাঁধা তার ঘরে।
মেঘনাদ নামে পুত্র, হে বৃত্রবিজয়ি,
রাবণের, বিলক্ষণ জান তুমি তারে।
একমাত্র বীর সেই আছে লঙ্কাধামে
এবে; আর বীর যত, হত এ সমরে।
বিক্রম-কেশরী শূর আক্রমিবে কালি
রামচন্দ্রে; পুনঃ তারে সেনাপতি-পদে
বরিয়াছে দশানন। দেব-কুল-প্রিয়
রাঘব; কেমনে তারে রাখিবে, তা দেখ।
নিকুম্ভিলা যজ্ঞ সাঙ্গ করি, আরম্ভিলে
যুদ্ধ দম্ভী মেঘনাদ, বিষম সঙ্কটে
ঠেকিবে বৈদেহীনাথ, কহিনু তোমারে।
অজেয় জগতে মন্দোদরীর নন্দন,
দেবেন্দ্র! বিহঙ্গকুলে বৈনতেয় যথা
বল-জ্যেষ্ঠ, রক্ষঃ-কুল-শ্রেষ্ঠ শূরমণি!”
এতেক কহিয়া রমা কেশব-বাসনা
নীরবিলা; আহা মরি, নীরবে যেমতি
বীণা, চিত্ত বিনোদিয়া সুমধুর নাদে!
ছয় রাগ, ছত্রিশ রাগিণী আদি যত,
শুনি কমলার বাণী, ভুলিলা সকলে
স্বকর্ম; বসন্তকালে পাখীকুল যথা,
মুঞ্জরিত কুঞ্জে, শুনি পিকবর-ধ্বনি!
কহিলেন স্বরীশ্বর; “এ ঘোর বিপদে,
বিশ্বনাথ বিনা, মাতঃ, কে আর রাখিবে
রাঘবে? দুর্বার রণে রাবণ-নন্দন।
পন্নগ-অশনে নাগ নাহি ডরে যত,
ততোধিক ডরি তারে আমি! এ দম্ভোলি,
বৃত্রাসুর-শিরঃ চূর্ণ যাহে, বিমুখয়ে
অস্ত্র-বলে মহাবলী; তেঁই এ জগতে
ইন্দ্রজিৎ নাম তার। সর্বশুচি-বরে
সর্বজয়ী বীরবর। দেহ আজ্ঞা দাসে,
যাই আমি শীঘ্রগতি কৈলাস-সদনে।”
কহিলা উপেন্দ্র-প্রিয়া বারীন্দ্রনন্দিনী;—
“যাও তবে সুরনাথ, যাও ত্বরা করি।
চন্দ্র-শেখরের পদে, কৈলাস-শিখরে,
নিবেদন কর, দেব, এ সব বারতা।
কহিও সতত কাঁদে বসুন্ধরা সতী,
না পারি সহিতে ভার; কহিও, অনন্ত,
ক্লান্ত এবে। না হইলে নির্মূল সমূলে
রক্ষঃপতি, ভবতল রসাতলে যাবে!
বড় ভাল বিরূপাক্ষ বাসেন লক্ষ্মীরে।
কহিও, বৈকুণ্ঠপুরী বহু দিন ছাড়ি
আছয়ে সে লঙ্কাপুরে! কত যে বিরলে
ভাবয়ে সে অবিরল, এক বার তিনি,
কি দোষ দেখিয়া, তারে না ভাবেন মনে?
কোন্ পিতা দুহিতারে পতি-গৃহ হতে
রাখে দূরে — জিজ্ঞাসিও, বিজ্ঞ জটাধরে!
ত্র্যম্বকে না পাও যদি, অম্বিকার পদে
কহিও এ সব কথা।” — এতেক কহিয়া,
বিদায় হইয়া চলি গেলা শশিমুখী
হরিপ্রিয়া। অনম্বর-পথে সুকেশিনী,
কেশব-বাসনা দেবী গেলা অধোদেশে।
সোনার প্রতিমা, যথা! বিমল সলিলে
ডুবে তলে জলরাশি উজলি স্বতেজে!
আনিলা মাতলি রথ, চাহি শচী পানে
কহিলেন শচীকান্ত মধুর বচনে
একান্তে; “চলহ, দেবি, মোর সঙ্গে তুমি।
পরিমল-সুধা সহ পবন বহিলে,
দ্বিগুণ আদর তার! মৃণালের রুচি
বিকচ কমল-গুণে, শুন লো ললনে।”
শুনি প্রণয়ীর বাণী, হাসি নিতম্বিনী,
ধরিয়া পতির কর, আরোহিলা রথে।
স্বর্গ-হৈম-দ্বারে রথ উতরিল ত্বরা।
আপনি খুলিল দ্বার মধুর নিনাদে
অমনি! বাহিরি বেগে, শোভিল আকাশে।
দেবযান, সচকিতে জগত জাগিলা,
ভাবি রবিদেব বুঝি উদয়-অচলে
উদিলা! ডাকিলা ফিঙা, আর পাখী যত
পূরিল নিকুঞ্জ-পুঞ্জ প্রভাতী সঙ্গীতে!
বাসরে কুসুম-শয্যা ত্যজি লজ্জাশীলা
কুলবধূ, গৃহ কার্য উঠিলা সাধিতে!
মানস-সকাশে শোভে কৈলাস শিখরী
আভাময়, তার শিরে ভবের ভবন।
শিখী-পুচ্ছ-চূড়া যেন মাধবের শিরে।
সুশ্যামাঙ্গ শৃঙ্গধর, স্বর্ণ-ফুল-শ্রেণী
শোভে তাহে, আহা মরি পীত ধড়া যেন।
নির্ঝর-ঝরিত-বারি-রাশি স্থানে স্থানে-
বিশদ চন্দনে যেন চর্চিত সে বপু!
ত্যজি রথ, পদব্রজে, সহ স্বরীশ্বরী,
প্রবেশিলা স্বরীশ্বর আনন্দ-ভবনে।
রাজরাজেশ্বরী-রূপে বসেন ঈশ্বরী
স্বর্ণাসনে, ঢুলাইছে চামর বিজয়া,
ধরে রাজছত্র জয়া। হায় রে, কেমনে,
ভবভবনের কবি বর্ণিবে বিভব?
দেখ, হে ভাবুক জন, ভাবি মনে মনে!
পূজিলা শক্তির পদ মহাভক্তি ভাবে
মহেন্দ্র ইন্দ্রাণী সহ। আশীষি অম্বিকা
জিজ্ঞাসিলা;— “কহ, দেব, কুশল বারতা,—
কি কারণে হেথা আজি তোমা দুই জনে?”
কর-জোড়ে আরম্ভিলা দম্ভোলি-নিক্ষেপী;—
“কি না তুমি জান, মাতঃ, অখিল জগতে?
দেবদ্রোহী লঙ্কাপতি, আকুল বিগ্রহে,
বরিয়াছে পুনঃ পুত্র মেঘনাদে আজি
সেনাপতি-পদে? কালি প্রভাতে কুমার
পরন্তপ প্রবেশিবে রণে, ইষ্টদেবে
পূজি, মনোনীত বর লভি তার কাছে।
অবিদিত নহে মাতঃ, তার পরাক্রম।
রক্ষঃ-কুল-রাজলক্ষ্মী, বৈজয়ন্ত-ধামে
আসি, এ সংবাদ দাসে দিলা, ভগবতী।
কহিলেন হরিপ্রিয়া, কাঁদে বসুন্ধরা,
এ অসহ ভার সতী না পারি সহিতে;
ক্লান্ত বিশ্বধর শেষ; তিনিও আপনি
চঞ্চলা সতত এবে ছাড়িতে কনক-
লঙ্কাপুরী। তব পদে এ সংবাদ দেবী
আদেশিলা নিবেদিতে দাসেরে, অন্নদে!
দেব-কুল-প্রিয় বীর রঘু-কুল-মণি।
কিন্তু দেবকুলে হেন আছে কোন্ রথী
যুঝিবে যে রণ-ভূমে রাবণির সাথে?
বিশ্বনাশী কুলিশে, মা, নিস্তেজে সমরে
রাক্ষস, জগতে খ্যাত ইন্দ্রজিৎ নামে!
কি উপায়ে, কাত্যায়নি, রক্ষিবে রাঘবে,
দেখ ভাবি। তুমি কৃপা না করিলে, কালি
অরাম করিবে ভব দুরন্ত রাবণি।”
উত্তরিলা কাত্যায়নী;— “শৈব-কুলোত্তম
নৈকষেয়, মহা স্নেহ করেন ত্রিশূলী
তার প্রতি, তার মন্দ, হে সুরেন্দ্র, কভু
সম্ভবে কি মোর হতে? তবে মগ্ন এবে
তাপসেন্দ্র, তেঁই, দেব, লঙ্কার এ গতি।”
কৃতাঞ্জলি-পুটে পুনঃ বাসব কহিলা;—
“পরম-অধর্মাচরী নিশাচর-পতি—
দেব-দ্রোহী! আপনি, যে নগেন্দ্র-নন্দিনি,
দেখ বিবেচনা করি। দরিদ্রের ধন
হরে যে দুর্মতি, তব কৃপা তার প্রতি
কভু কি উচিত, মাতঃ? সুশীল রাঘব,
পিতৃ-সত্য-রক্ষা-হেতু, সুখ-ভোগ ত্যজি
পশিল ভিখারী-বেশে নিবিড় কাননে।
একটি রতনমাত্র তাহার আছিল
অমূল; যতন কত করিত সে তারে,
কি আর কহিবে দাস? সে রতন, পাতি
মায়াজাল, হরে দুষ্ট, হায়, মা, স্মরিলে
কোপানলে দহে মনঃ! ত্রিশূলীর বরে
বলী রক্ষঃ, তৃণ-জ্ঞান করে দেব-গণে!
পর-ধন, পর-দার লোভে সদা লোভী
পামর। তবে যে কেন (বুঝিতে না পারি)
হেন মূঢ়ে দয়া কর, দয়াময়ি?”
নীরবিলা স্বরীশ্বর; কহিতে লাগিলা
বিণাবাণী স্বরীশ্বরী; কহিতে লাগিলা
“বৈদেহীর দুঃখে দেবি, কার না বিদরে
হৃদয়? অশোক-বনে বসি দিবা নিশি
(কুঞ্জবন-সখী পাখী পিঞ্জরে যেমতি)
কাঁদেন রূপসী শোকে! কি মনোবেদনা
সহেন বিধুবদনা পতির বিহনে,
ও রাঙা চরণে, মাতঃ, অবিদিত নহে।
আপনি না দিলে দণ্ড, কে দণ্ডিবে, দেবি,
এ পাষণ্ড রক্ষোনাথে? নাশি মেঘনাদে,
দেহ বৈদেহীরে পুনঃ বৈদেহীরঞ্জনে;
দাসীর কলঙ্ক ভঞ্জ, শশাঙ্কধারিণি!
মরি, মা, শরমে আমি, শুনি লোকমুখে,
ত্রিদিব-ঈশ্বরে রক্ষঃ পরাভবে রণে।”
হাসিয়া কহিলা উমা; “রাবণের প্রতি
দ্বেষ তব, জিষ্ণু! তুমি, হে মঞ্জুনাশিনী
শচি, তুমি ব্যগ্র ইন্দ্রজিতের নিধনে।
দুই জন অনুরোধ করিছ আমারে
নাশিতে কনক-লঙ্কা। মোর সাধ্য নহে
সাধিতে এ কার্য। বিরূপাক্ষের রক্ষিত
রক্ষঃকুল; তিনি বিনা তব এ বাসনা,
বাসব, কে পারে, কহ, পূর্ণিতে জগতে?
যোগে মগ্ন, দেবরাজ, বৃষধ্বজ আজি।
যোগাসন নামে শৃঙ্গ, মহাভয়ঙ্কর,
ঘন ঘনাবৃত, তথা বসেন বিরলে
যোগীন্দ্র। কেমনে যাবে তাঁহার সমীপে?
পক্ষীন্দ্র গরুড় সেথা উড়িতে অক্ষম!”
কহিলা বিনত-ভাবে অদিতিনন্দন;—
“তোমা বিনা কার শক্তি, হে মুক্তি-দায়িনি
জগদম্বে, যায় যে সে যথা ত্রিপুরারি
ভৈরব? বিনাশি, দেবি, রক্ষঃকুল, রাখ
ত্রিভুবন; বৃদ্ধি কর ধর্মের মহিমা,
হ্রাসো বসুধার ভার, বসুন্ধরাধর
বাসুকিরে কর স্থির; বাঁচাও রাঘবে।”
এইরূপে দৈত্য-রিপু স্তুতিলা সতীরে।
হেন কালে গন্ধামোদে সহসা পূরিল
পুরী; শঙ্খঘণ্টাধ্বনি বাজিল চৌদিকে
মঙ্গল নিক্কণ সহ, মৃদু যথা যবে
দূর কুঞ্জবনে গাহে পিককুল মিলি!
টলিল কনকাসন! বিজয়া সখীরে
সম্ভাষিয়া মধুস্বরে, ভবেশ-ভাবিনী
শুধিলা, “লো বিধুমুখি, কহ শীঘ্র করি,
কে কোথা, কি হেতু মোরে পূজিছে অকালে?”
মন্ত্র পড়ি, খড়ি পাতি, গণিয়া গণনে,
নিবেদিলা হাসি সখী; “হে নগনন্দিনি,
দাশরথি রথী তোমা পূজে লঙ্কাপুরে।
বারি-সংঘটিত-ঘটে, সুসিন্দূরে আঁকি
ও সুন্দর পদযুগ, পূজে রঘুপতি,
নীলোৎপলাঞ্জলি দিয়া, দেখিনু গণনে।
অভয়-প্রদান তারে কর গো, অভয়ে।
পরম ভকত তব কৌশল্যা-নন্দন
রঘুশ্রেষ্ঠ; তার তারে বিপদে, তারিণি!”
কাঞ্চন-আসন ত্যজি, রাজরাজেশ্বরী
উঠিয়া, কহিল পুনঃ বিজয়ারে সতী;—
“দেব-দম্পতিরে তুমি সেব যথা বিধি,
বিজয়ে। যাইব আমি যথা যোগাসনে
(বিকটশিখর।) এবে বসেন ধূর্জটি।”
এতেক কহিয়া দুর্গা দ্বিরদ-গামিনী
প্রবেশিলা হৈম গেহে। দেবেন্দ্র বাসবে
ত্রিদিব-মহিষী সহ, সম্ভাষি আদরে,
স্বর্ণাসনে বসাইলা বিজয়া সুন্দরী।
পাইলা প্রসাদ দোঁহে পরম-আহ্লাদে।
শচীর গলায় জয়া হাসি দোলাইলা
তারাকারা ফুলমালা, কবরী-বন্ধনে
বসাইলা চিররুচি, চির-বিকচিত
কুসুম-রতন-রাজী, বাজিল চৌদিকে
যন্ত্রদল, বামাদল গাইল নাচিয়া
মোহিল কৈলাসপুরী, ত্রিলোক মোহিল!
স্বপনে শুনিয়া শিশু সে মধুর ধ্বনি,
হাসিল মায়ের কোলে, মুদিত নয়ন!
নিদ্রাহীন বিরহিণী চমকি উঠিলা,
ভাবি প্রিয়-পদ-শব্দ শুনিলা ললনা
দুয়ারে। কোকিলকুল নীরবিল বনে।
উঠিলেন যোগীব্রজ, ভাবি ইষ্টদেব,
বর মাগ বলি, আসি দরশন দিলা!
প্রবেশি সুবর্ণ-গেহে, ভবেশ-ভাবিনী
ভাবিলা, “কি ভাবে আজি ভেটিব ভবেশে?”
ক্ষণ কাল চিন্তি সতী চিন্তিলা রতিরে।
যথায় মন্মথ-সাথে, মন্মথ-মোহিনী
বরাননা, কুঞ্জবনে বিহারিতেছিলা,
তথায় উমার ইচ্ছা, পরিমলময়-
বায়ু তরঙ্গিণী-রূপে বহিল নিমিষে।
নাচিল রতির হিয়া বীণা-তার যথা
অঙ্গুলির পরশনে। গেলা কামবধূ,
দ্রুতগতি বায়ুপথে, কৈলাস-শিখরে।
সরসে নিশান্তে যথা ফুটি, সরোজিনী
নমে ত্বিষাম্পতি-দূতী ঊষার চরণে,
নমিলা মদন-প্রিয়া হরপ্রিয়া-পদে।
আশিষি রতিরে, হাসি কহিলা অম্বিকা,—
“যোগাসনে তপে মগ্ন যোগীন্দর, কেমনে,
কোন্ রঙ্গে, ভগ্ন করি তাঁহার সমাধি,
কহ মোরে, বিধুমুখি?” উত্তরিলা নমি
সুকেশিনী,— “ধর, দেবি, মোহিনী মূরতি।
দেহ আজ্ঞা, সাজাই ও বর বপুঃ, আনি
নানা আভরণ, হেরি যে সবে, পিনাকী
ভুলিবেন, ভুলে যথা ঋতুপতি, হেরি
মধুকালে বনস্থলী কুসুম-কুন্তলা!
এতেক কহিয়া রতি, সুবাসিল তেলে
মাজি চুল, বিনানিলা মনোহর বেণী।
যোগাইলা আনি ধনী বিবিধ ভূষণে,
হীরক, মুকুতা, মণি-খচিত, আনিলা
চন্দন, কেশর সহ কুঙ্কুম, কস্তুরী;
রত্ন-সঙ্কলিত-আভা কৌষেয় বসনে।
লাক্ষারসে পা’দুখানি চিত্রিলা হরষে
চারুনেত্রা। ধরি মূর্তি ভুবনমোহিনী,
সাজিলা নগেন্দ্র-বালা, রসানে মার্জিত
হেম-কান্তি-সম কান্তি দ্বিগুণ শোভিল।
হেরিলা দর্পণে দেবী ও চন্দ্র-আননে,
প্রফুল্ল নলিনী যথা বিমল সলিলে
নিজ-বিকচিত-রুচি। হাসিয়া কহিলা,
চাহি স্মর-হর-প্রিয়া স্মর-প্রিয়া পানে;—
“ডাক তব প্রাণনাথে।” অমনি ডাকিলা
(পিককুলেশ্বরী যথা ডাকে ঋতুবরে!)
মদনে মদন-বাঞ্ছা। আইলা ধাইয়া
ফুল-ধনুঃ, আসে যথা প্রবাসে প্রবাসী,
স্বদেশ-সঙ্গীত-ধ্বনি শুনি রে উল্লাসে!
কহিলা শৈলেশসুতা; “চল মোর সাথে,
হে মন্মথ, যাব আমি যথা যোগীপতি
যোগে মগ্ন এবে; বাছা, চল ত্বরা করি।”
অভয়ার পদতলে মায়ার নন্দন,
মদন আনন্দময়, উত্তরিলা ভয়ে,—
“হেন আজ্ঞা কেন, দেবি, কর এ দাসেরে?
স্মরিলে পূর্বের কথা, মরি, মা, তরাসে!
মূঢ় দক্ষ-দোষে যবে দেহ ছাড়ি, সতি
হিমাদ্রির গৃহে জন্ম গ্রহিলা আপনি,
তোমার বিরহ-শোকে বিশ্ব-ভার ত্যজি
বিশ্বনাথ, আরম্ভিলা ধ্যান, দেবপতি
ইন্দ্র আদেশিলা দাসে সে ধ্যান ভাঙিতে,
কুলগ্নে গেনু, মা, যথা মগ্ন বামদেব
তপে; ধরি ফুল-ধনুঃ, হানিনু কুক্ষণে
ফুল-শর। যথা সিংহ সহসা আক্রমে
গজরাজে, পূরি বন ভীষণ গর্জনে,
গ্রাসিলা দাসেরে আসি রোষে বিভাবসু,
বাস যাঁর, ভবেশ্বরি, ভবেশ্বর-ভালে।
হায়, মা, কত যে জ্বালা সহিনু, কেমনে
নিবেদি ও রাঙা পায়ে? হাহাকার রবে,
ডাকিনু বাসবে, চন্দ্রে, পবনে, তপনে;
কেহ না আইল; ভস্ম হইনু সত্বরে!—
ভয়ে ভগ্নোদ্যম আমি ভাবিয়া ভবেশে;—
ক্ষম দাসে, ক্ষেমঙ্করি! এ মিনতি পদে!”
আশ্বাসি মদনে, হাসি কহিলা শঙ্করী;—
“চল রঙ্গে মোর সঙ্গে নির্ভয় হৃদয়ে,
অনঙ্গ। আমার বরে চিরজয়ী তুমি!
যে অগ্নি কুলগ্নে তোমা পাইয়া স্বতেজে
জ্বালাইল, পূজা তব করিবে সে আজি,
ঔষধের গুণ ধরি, প্রাণ-নাশ-কারী
বিষ যথা রক্ষে প্রাণ বিদ্যার কৌশলে!”
প্রণমিয়া কাম তবে উমার চরণে,
কহিলা, “অভয় দান কর যারে তুমি,
অভয়ে, কি ভয় তার এ তিন ভুবনে?
কিন্তু নিবেদন করি ও কমল-পদে;—
কেমনে মন্দির হতে, নগেন্দ্র-নন্দিনি,
বাহিরিবা, কহ দাসে, এ মোহিনী-বেশে?
মুহূর্তে মাতিবে, মাতঃ, জগৎ, হেরিলে
ও রূপ-মাধুরী, সত্য কহিনু তোমারে।
হিতে বিপরীত, দেবি, সত্বরে ঘটিবে।
সুরাসুর-বৃন্দ যবে মথি জলনাথে,
লভিলা অমৃত, দুষ্ট দিতিসুত যত
বিবাদিল দেব সহ সুধামধু-হেতু।
মোহিনী মূরতি ধরি আইলা শ্রীপতি।
ছদ্মবেশী হৃষীকেশে ত্রিভুবন হেরি,
হারাইলা জ্ঞান সবে এ দাসের শরে!
অধর-অমৃত আশে ভুলিল অমৃত
দেব-দৈত্য, নাগদল নম্রশিরঃ লাজে,
হেরি পৃষ্ঠদেশে বেণী, মন্দর আপনি
অচল হইল হেরি উচ্চ কুচ-যুগে!
স্মরিলে সে কথা, সতি, হাসি আসে মুখে।
মলম্বা অম্বরে তাম্র এত শোভা যদি
ধরে, দেবি, ভাবি দেখ বিশুদ্ধ কাঞ্চন-
কান্তি কত মনোহর!” অমনি অম্বিকা,
সুবর্ণ বরণ ঘন মায়ায় সৃজিয়া,
মায়াময়ী, আবরিলা চারু অবয়বে।
হায় রে, নলিনী যেন দিবা-অবসানে
ঢাকিল বদনশশী! কিম্বা অগ্নিশিখা,
ভস্মরাশি মাঝে পশি, হাসি লুকাইলা!
কিম্বা সুধা-ধন যেন, চক্র-প্রসরণে,
বেড়িলেন দেব শত্রু সুধাংশু-মণ্ডলে!
দ্বিরদ-রদ-নির্মিত গৃহদ্বার দিয়া
বাহিরিলা সুহাসিনী, মেঘাবৃতা যেন
ঊষা! সাথে মন্মথ, হাতে ফুল-ধনুঃ,
পৃষ্ঠে তূণ, খরতর ফুল-শরে ভরা-
কণ্টকময় মৃণালে ফুটিল নলিনী।
কৈলাস-শিখরি-শিরে ভীষণ শিখর
ভৃগুমান্, যোগাসন নামেতে বিখ্যাত
ভুবনে; তথায় দেবী ভুবন-মোহিনী
উতরিলা গজগতি। অমনি চৌদিকে
গভীর গহ্বরে বদ্ধ, ভৈরব নিনাদী
জলদল নীরবিলা জল-কান্ত যথা
শান্ত শান্তিসমাগমে, পলাইল দূরে
মেঘদল, তমঃ যথা ঊষার হসনে!
দেখিলা সম্মুখে দেবী কপর্দী তপসী,
বিভূতি-ভূষিত দেহ, মুদিত নয়ন,
তপের সাগরে মগ্ন, বাহ্য-জ্ঞান-হত।
কহিলা মদনে হাসি সুচারুহাসিনী;—
“কি কাজ বিলম্বে আর, হে শম্বর-অরি?
হান তব ফুল-শর।” দেবীর আদেশে
হাঁটু পাড়ি মীনধ্বজ, শিঞ্জিনী টঙ্কারি,
সম্মোহন-শরে শূর বিঁধিলা উমেশে!
শিহরিলা শূলপাণি! লড়িল মস্তকে
জটাজূট তরুরাজী যথা গিরিশিরে।
ঘোর মড় মড় রবে লড়ে ভূকম্পনে।
অধীর হইলা প্রভু! গরজিলা ভালে
চিত্রভানু, ধকধকি উজ্জ্বল জ্বলনে!
ভয়াকুল ফুল-ধনুঃ পশিলা অমনি
ভবানীর বক্ষঃ-স্থলে, পশয়ে যেমতি
কেশরী-কিশোর ত্রাসে, কেশরিণী-কোলে,
গম্ভীর নির্ঘোষে ঘোষে ঘনদল যবে,
বিজলী ঝলসে আঁখি কালানল তেজে!
উন্মীলি নয়ন এবে উঠিলা ধূর্জটি।
মায়া-ঘন-আবরণ ত্যজিলা গিরিজা।
মোহিত মোহিনীরূপে, কহিলা হরষে
পশুপতি, “কেন হেথা একাকিনী দেখি,
এ বিজন স্থলে, তোমা, গণেন্দ্রজননি?
কোথায় মৃগেন্দ্র তব কিঙ্কর, শঙ্করি?
কোথায় বিজয়া, জয়া?” হাসি উত্তরিলা
সুচারুহাসিনী উমা, “এ দাসীরে, ভুলি,
হে যোগীন্দ্র, বহু দিন আছ এ বিরলে;
তেঁই আসিয়াছি, নাথ, দরশন-আশে
পা দুখানি। যে রমণী পতি পরায়ণা,
সহচরী সহ সে কি যায় পতি-পাশে?
একাকী প্রত্যূষে, প্রভু, যায় চক্রবাকী
যথা প্রাণকান্ত তার!” আদরে ঈশান,
ঈষৎ হাসিয়া দেব, অজিন-আসনে
বসাইলা ঈশানীরে। অমনি চৌদিকে
প্রফুল্লিল ফুলকুল; মকরন্দ-লোভে
মাতি শিলীমুখবৃন্দ আইল ধাইয়া;
বহিল মলয়-বায়ু, গাইল কোকিল;
নিশার শিশিরে ধৌত কুসুম-আসার
আচ্ছাদিল শৃঙ্গবরে। উমার উরসে
(কি আর আছে রে বাসা সাজে মনসিজে
ইহা হতে!) কুসুমেষু, বসি কুতূহলে,
হানিলা, কুসুম-ধনুঃ টঙ্কারি কৌতুকে
শর-জাল;— প্রেমামোদে মাতিলা ত্রিশূলী!
লজ্জা-বেশে রাহু আসি গ্রাসিল চাঁদেরে,
হাসি ভস্মে লুকাইলা দেব বিভাবসু!
মোহন মূরতি ধরি, মোহি মোহিনীরে
কহিলা হাসিয়া দেব; “জানি আমি, দেবি,
তোমার মনের কথা,— বাসব কি হেতু
শচী সহ আসিয়াছে কৈলাস-সদনে,
কেন বা অকালে তোমা পূজে রঘুমণি?
পরম ভকত মম নিকষানন্দন;
কিন্তু নিজ কর্ম-ফলে মজে দুষ্টমতি।
বিদরে হৃদয় মম স্মরিলে সে কথা,
মহেশ্বরি! হায়, দেবি, দেবে কি মানবে,
কোথা হেন সাধ্য রোধে প্রাক্তনের গতি?
পাঠাও কামেরে, উমা, দেবেন্দ্র সমীপে।
সত্বরে যাইতে তারে আদেশ, মহেশি,
মায়াদেবি-নিকেতনে। মায়ার প্রসাদে,
বধিবে লক্ষ্মণ শূর মেঘনাদ শূরে।”
চলি গেলা মীনধ্বজ, নীড় ছাড়ি উড়ে
বিহঙ্গম-রাজ যথা, মুহূর্মুহূ চাহি
সে সুখ-সদন পানে! ঘন রাশি রাশি
স্বর্ণবর্ণ, সুবাসিত বাস শ্বাসি ঘন,
বরষি প্রসূনাসার—কমল, কুমুদী,
মালতী, সেঁউতি, জাতি, পারিজাত-আদি
মন্দ-সমীরণ-প্রিয়া—ঘিরিল চৌদিকে
দেবদেব মহাদেবে মহাদেবী সহ।
দ্বিরদ-রদ-নির্মিত হৈমময় দ্বারে
দাঁড়াইলা বিধুমুখী মদন-মোহিনী,
অশ্রুময় আঁখি, আহা! পতির বিহনে!
হেন কালে মধু-সখা উতরিল তথা।
অমনি পসারি বাহু, উল্লাসে মন্মথ
আলিঙ্গন-পাশে বাঁধি, তুষিলা ললনে
প্রেমালাপে। শুখাইল অশ্রুবিন্দু, যথা
শিশির-নীরের বিন্দু শতদল-দলে,
দরশন দিলে ভানু উদয়-শিখরে।
পাই প্রাণ-ধনে ধনী, মুখে মুখ দিয়া,
(সরস বসন্তকালে সারী শুক যথা)
কহিলেন প্রিয়-ভাষে; “বাঁচালে দাসীরে
আশু আসি তার পাশে, হে রতি-রঞ্জন!
কত যে ভাবিতেছিনু, কহিব কাহারে?
বামদেব নামে, নাথ, সদা, কাঁপি আমি,
স্মরি পূর্ব-কথা যত! দুরন্ত হিংসক
শূলপাণি! যেও না গো আর তাঁর কাছে,
মোর কিরে প্রাণেশ্বর!” সুমধুর হাসে
উত্তরিলা পঞ্চশর; “ছায়ার আশ্রমে,
কে কবে ভাস্কর-করে ডরায়, সুন্দরি!
চল এবে যাই যথা দেবকুল-পতি।”
সুবর্ণ-আসনে যথা বসেন বাসব,
উতরি মন্মথ তথা, নিবেদিলা নমি
বারতা। আরোহি রথে দেবরাজ রথী
চলি গেলা দ্রুতগতি মায়ার সদনে।
অগ্নিময় তেজঃ বাজী ধাইল অম্বরে,
অকম্প চামর শিরে; গম্ভীর নির্ঘোষে
ঘোষিল রথের চক্র, চূর্ণি মেঘদলে।
কত ক্ষণে সহস্রাক্ষ উতরিলা বলী
যথা বিরাজেন মায়া। ত্যজি রথ-বরে,
সুরকুল-রথীবর পশিলা দেউলে।
কত যে দেখিলা দেব কে পারে বর্ণিতে?
সৌর-খরতর-কর-জাল-সঙ্কলিত
আভাময় স্বর্ণাসনে বসি কুহকিনী
শক্তীশ্বরী। কর-জোড়ে বাসব প্রণমি
কহিলা; “আশীষ দাসে, বিশ্ব-বিমোহিনি!”
আশীষি শুধিলা দেবী;— “কহ, কি কারণে,
গতি হেথা আজি তব, অদিতি-নন্দন?”
উত্তরিলা দেবপতি;— “শিবের আদেশে,
মহামায়া, আসিয়াছি তোমার সদনে।
কহ দাসে, কি কৌশলে সৌমিত্রি জিনিবে
দশানন-পুত্রে কালি? তোমার প্রসাদে
(কহিলেন বিরূপাক্ষ) ঘোরতর রণে
নাশিবে লক্ষ্মণ শূর মেঘনাদ শূরে।”
ক্ষণ কাল চিন্তি দেবী কহিলা বাসবে,—
“দুরন্ত তারকাসুর, সুর-কুল-পতি,
কাড়ি নিল স্বর্গ যবে তোমায় বিমুখি
সমরে, কৃত্তিকা-কুল-বল্লভ সেনানী,
পার্বতীর গর্ভে জন্ম লভিলা তৎকালে।
বধিতে দানব-রাজে সাজাইলা বীরে
আপনি বৃষভ-ধ্বজ, সৃজি রুদ্র-তেজে
অস্ত্রে। এই দেখ, দেব, ফলক, মণ্ডিত
সুবর্ণে, ওই যে অসি, নিবাসে উহাতে
আপনি কৃতান্ত, ওই দেখ, সুনাসীর,
ভয়ঙ্কর তূণীরে, অক্ষয়, পূর্ণ শরে,
বিষাকর ফণী-পূর্ণ নাগ-লোক যথা!
ওই দেখ ধনুঃ, দেব!” কহিলা হাসিয়া,
হেরি সে ধনুর কান্তি, শচীকান্ত বলী,
“কি ছার ইহার কাছে দাসের এ ধনুঃ
রত্নময়! দিবাকর-পরিধি যেমতি,
জ্বলিছে ফলক-বর ধাঁধিয়া নয়নে।
অগ্নিশিখাসম অসি মহাতেজস্কর!
হেন তূণ আর, মাতঃ, আছে কি জগতে?”
“শুন দেব।” (কহিলেন পুনঃ মায়াদেবী)
“ওইসব অস্ত্রবলে, নাশিলা তারকে
ষড়ানন। ওই সব অস্ত্রবলে, বলি,
মেঘনাদ-মৃত্যু, সত্য কহিনু তোমারে।
কিন্তু হেন বীর নাহি এ তিন ভুবনে,
দেব কি মানব, ন্যায়যুদ্ধে যে বধিবে
রাবণিরে। প্রের তুমি অস্ত্র রামানুজে,
আপনি যাইব আমি কালি লঙ্কাপুরে,
রক্ষিব লক্ষ্মণে, দেব, রাক্ষস-সংগ্রামে।
যাও চলি সুর-দেশে, সুরদল-নিধি।
ফুল-কুল সখী ঊষা যখন খুলিবে
পূর্বাশার হেমদ্বারে পদ্মকর দিয়া
কালি, তব চির-ত্রাস, বীরেন্দ্রকেশরী
ইন্দ্রজিৎ—ত্রাস-হীন করিবে তোমারে—
লঙ্কার পঙ্কজ-রবি যাবে অস্তাচলে!”
মহানন্দে দেব-ইন্দ্র বন্দিয়া দেবীরে,
অস্ত্র লয়ে গেলা চলি ত্রিদশ-আলয়ে।
বসি দেব-সভাতলে কনক-আসনে
বাসব, কহিলা শূর চিত্ররথ শূরে,—
“যতনে লইয়া অস্ত্র, যাও মহাবলি
স্বর্ণ-লঙ্কা-ধামে তুমি। সৌমিত্রি কেশরী
মায়ার প্রসাদে কালি বধিবে সমরে
মেঘনাদে। কেমনে, তা দিবেন কহিয়া
মহাদেবী মায়া তারে! কহিও রাঘবে,
হে গন্ধর্ব-কুল-পতি, ত্রিদিব-নিবাসী
মঙ্গল-আকাঙ্ক্ষী তার; পার্বতী আপনি আজি।
অভয় প্রদান তারে করিও সুমতি!
মরিলে রাবণি রণে, অবশ্য মরিবে
রাবণ, লভিবে পুনঃ বৈদেহী সতীরে
বৈদেহী-মনোরঞ্জন রঘুকুল-মণি।
মোর রথে, রথীবর, আরোহণ করি
যাও চলি। পাছে তোমা হেরি লঙ্কা-পুরে
বাধায় বিবাদ রক্ষঃ; মেঘদলে আমি
আদেশিব আবরিতে গগনে, ডাকিয়া
প্রভঞ্জনে, দিব আজ্ঞা ক্ষণ ছাড়ি দিতে
বায়ুকুলে, বাহিরিয়া নাচিলে চপলা,
দম্ভোলি-গম্ভীর-নাদে পূরিব জগতে।”
প্রণমি দেবেন্দ্র-পদে, সাবধানে লয়ে
অস্ত্রে, চলি গেলা মর্ত্যে চিত্ররথ রথী।
তবে দেব-কুল-নাথ ডাকি প্রভঞ্জনে
কহিলা, “প্রলয়-ঝড় উঠাও সত্বরে
লঙ্কাপুরে, বায়ুপতি, শীঘ্র দেহ ছাড়ি
কারাবদ্ধ বায়ুদলে; লহ মেঘদলে;
দ্বন্দ্ব ক্ষণ-কাল বৈরী বারি-নাথ সনে,
নির্ঘোষে!” উল্লাসে দেব চলিলা অমনি,
ভাঙিলে শৃঙ্খল লম্ফী কেশরী যেমতি,
যথায় তিমিরাগারে রুদ্ধ বায়ু যত
গিরি-গর্ভে। কত দূরে শুনিলা পবন
ঘোর কোলাহলে; গিরি (দেখিলা) লড়িছে
অন্তরিত পরাক্রমে, অসমর্থ যেন
রোধিতে প্রবল বায়ু আপনার বলে।
শিলাময় দ্বার দেব খুলিলা পরশে।
হুহুঙ্কারি বায়ুকুল বাহিরিল বেগে
যথা অম্বুরাশি, যবে ভাঙে আচম্বিতে
জাঙাল! কাঁপিল মহী; গর্জিল জলধি!
তুঙ্গ-শৃঙ্গধরাকারে তরঙ্গ-আবলী
কল্লোলিল, বায়ু-সঙ্গে রণরঙ্গে মাতি!
ধাইল চৌদিকে মন্দ্রে জীমূত; হাসিল
ক্ষণপ্রভা; কড়মড়ে নাদিল দম্ভোলি।
পলাইল তারানাথ তারাদলে লয়ে।
ছাইল লঙ্কায় মেঘ, পাবক উগরি
রাশি রাশি; বনে বৃক্ষ পড়িল উপড়ি
মড়মড়ে; মহাঝড়ি বহিল আকাশে।
বর্ষিল আসার যেন সৃষ্টি ডুবাইতে
প্রলয়ে। বৃষ্টিল শিলা তড়তড়তড়ে।
পশিল আতঙ্কে রক্ষঃ যে যাহার ঘরে।
যথায় শিবির মাঝে বিরাজেন বলী
রাঘবেন্দ্র, আচম্বিতে উতরিলা রথী
চিত্ররথ, দিবাকর যেন অংশুমালী,
রাজ-আভরণ দেহে! শোভে কটিদেশে
সারসন, রাশি-চক্র-সম তেজোরাশি,
ঝোলে তাহে অসিবর—ঝল ঝল ঝলে!
কেমনে বর্ণিবে কবি দেব-তূণ, ধনুঃ,
চর্ম, বর্ম, শূল, সৌর-কিরীটের আভা
স্বর্ণময়ী? দৈববিভা ধাঁধিল নয়নে
স্বর্গীয় সৌরভে দেশ পূরিল সহসা।
সসম্ভ্রমে প্রণমিয়া, দেবদূত-পদে
রঘুবর, জিজ্ঞাসিলা, “হে ত্রিদিববাসি,
ত্রিদিব ব্যতীত, আহা, কোন্ দেশ সাজে
এহেন মহিমা, রূপে?—কেন হেথা আজি,
নন্দনকানন ত্যজি, কহ এ দাসেরে?
নাহি স্বর্ণাসন, দেব, কি দিব বসিতে?
তবে যদি কৃপা, প্রভু, থাকে দাস প্রতি,
পাদ্য, অর্ঘ্য লয়ে বসো এই কুশাসনে।
ভিখারী রাঘব হায়।” আশীষিয়া রথী
কুশাসনে বসি তবে কহিলা সুস্বরে,—
“চিত্ররথ নাম মম, শুন দাশরথি;
চির-অনুচর আমি সেবি অহরহঃ
দেবেন্দ্রে, গন্ধর্বকুল আমার অধীনে।
আইনু এ পুরে আমি ইন্দ্রের আদেশে।
তোমার মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী দেবকুল সহ
দেবেশ। এই যে অস্ত্র দেখিছ নৃমণি,
দিয়াছেন পাঠাইয়া তোমার অনুজে
দেবরাজ। আবির্ভাবি মায়া মহাদেবী
প্রভাতে, দিবেন কহি, কি কৌশলে কালি
নাশিবে লক্ষ্মণ শূর মেঘনাদ শূরে।
দেবকুল-প্রিয় তুমি, রঘুকুল-মণি।
সুপ্রসন্ন তব প্রতি আপনি অভয়া!”
কহিলা রঘুনন্দন; “আনন্দ-সাগরে
ভাসিনু, গন্ধর্বশ্রেষ্ঠ, এ শুভ সংবাদে!
অজ্ঞ নর আমি; হায়, কেমনে দেখাব
কৃতজ্ঞতা? এই কথা জিজ্ঞাসি তোমারে।”
হাসিয়া কহিলা দূত; “শুন, রঘুমণি,
দেব প্রতি কৃতজ্ঞতা, দরিদ্র-পালন,
ইন্দ্রিয়-দমন, ধর্মপথে সদা গতি,
নিত্য সত্য-দেবী-সেবা; চন্দন, কুসুম,
নৈবেদ্য, কৌষিক বস্ত্র আদি বলি যত,
অবহেলা করে দেব, দাতা যে যদ্যপি
অসৎ! এ সার কথা কহিনু তোমারে!”
প্রণমিলা রামচন্দ্র; আশীষিয়া রথী
চিত্ররথ, দেবরথে গেলা দেবপুরে।
থামিল তুমুল ঝড়, শান্তিলা জলধি;
হেরিয়া শশাঙ্কে পুনঃ তারাদল সহ,
হাসিল কনকলঙ্কা। তরল সলিলে
পশি, কৌমুদিনী পুনঃ অবগাহে দেহ
রজোময়; কুমুদিনী হাসিল কৌতুকে।
আইল ধাইয়া পুনঃ রণ-ক্ষেত্রে, শিবা
শবাহারী; পালে পালে গৃধিনী, শকুনী,
পিশাচ। রাক্ষসদল বাহিরিল পুনঃ
ভীম-প্রহরণ-ধারী——মত্ত বীরমদে।
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 4 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-3-297x300.jpg)
যশঃ – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
লিখিনু কি নাম মোর বিফল যতনে
বালিতে,রে কাল,তোর সাগরের তীরে ?
ফেন-চূড় জল-রাশি আসি কি রে ফিরে,
মুছিতে তুচ্ছেতে ত্বরা এ মোর লিখনে ?
অথবা খোদিনু তারে যশোগিরি-শিরে,
গুণ-রূপ যন্ত্রে কাটি অক্ষর সুক্ষণে
নারিবে উঠাতে যাহে,ধুয়ে নিজ নীরে,
বিস্মৃতি,বা মলিনিতে মলের মিলনে?—
শূন্য-জল জল-পথে জলে লোক স্মরে;
দেব-শূন্য দেবালয়ে অদৃশ্যে নিবাসে
দেবতা;ভস্মের রাশি ঢাকে বৈশ্বানরে।
সেই রূপে,ধড় যবে পড়ে কাল-গ্রাসে,
যশোরূপাশ্রমে প্রাণ মর্ত্ত্যে বাস করে;—
কুযশে নরকে যেন সুযশে—আকাশে।
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 5 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-2-282x300.jpg)
যশের মন্দির – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
সুবর্ণ‐দেউল আমি দেখিনু স্বপনে
অতি‐তুঙ্গ শৃঙ্গ শিরে! সে শৃঙ্গের তলে,
বড় অপ্রশস্ত সিঁড়ি গড়া মায়া‐বলে,
বহুবিধ রোধে রুদ্ধ উর্দ্ধগামী জনে!
তবুও উঠিতে তথা— সে দুর্গম স্থলে—
করিছে কঠোর চেষ্টা কষ্ট সহি মনে
বহু প্রাণী। বহু প্রাণী কাঁদিছে বিকেলে,
না পারি লভিতে যত্নে সে রত্ন‐ভবনে।
ব্যথিল হৃদয় মোর দেখি তা সবারে।—
শিয়রে দাঁড়ায়ে পরে কহিলা ভারতী,
মৃদু হাসি; “ওরে বাছা, না দিলে শকতি
আমি, ও দেউলে কার সাধ্য উঠিবারে?
যশের মন্দির ওই; ওথা যার গতি,
অশক্ত আপনি যম ছুঁইতে রে তারে!”
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 6 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-1-208x300.jpg)
রসাল ও স্বর্ণলতিকা – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
রসাল কহিল উচ্চে স্বর্ণলতিকারে;-
শুন মোর কথা, ধনি, নিন্দ বিধাতারে।
নিদারুণ তিনি অতি;
নাহি দয়া তব প্রতি;
তেঁই ক্ষুদ্র-কায়া করি সৃজিলা তোমারে।
মলয় বহিলে, হায়,
নতশিরা তুমি তায়,
মধুকর- ভরে তুমি পড় লো ঢলিয়া;
হিমাদ্রি সদৃশ আমি,
বন-বৃক্ষ-কুল-স্বামী,
মেঘলোকে উঠ শির আকাশ ভেদিয়া!
দূরে রাখি গাভী-দলে,
রাখাল আমার তলে
বিরাম লভয়ে অনুক্ষণ,-
শুন, ধনি, রাজ-কাজ দরিদ্র পালন!
আমার প্রসাদ ভুঞ্জে পথ-গামী জন।
কেহ অন্ন রাঁধি খায়
কেহ পড়ি নিদ্রা যায
এ রাজ চরণে।
মধু-মাখা ফল মোর বিখ্যাত ভূবনে!
তুমি কি তা জান না ললনে?
দেখ মোর ডাল-রাশি,
কত পাখি বাঁধে আসি
বাসা এ আগারে!
ধন্য মোর জনম সংসারে!
কিন্তু তব দুঃখ দেখি নিত্য আমি দুঃখী
নিন্দ বিধাতায় তুমি, নিন্দ, বিধুমুখী!
নীরবিলা তরুরাজ; উড়িল গগনে
যমদূতাকৃতি মেঘ গম্ভীর স্বননে;
মহাঘাতে মড়মড়ি
রসাল ভূতলে পড়ি
হায়, বায়ুবলে
হারাইল আয়ু-সহ দর্প বনস্থলে!
ঊর্ধ্বশির যদি তুমি কুল মান ধনে;
করিও না ঘৃণা তবু নিচ-শির জনে।
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 7 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-7-300x300.jpg)
রামায়ণ – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
সাধিনু নিদ্রায় বৃথা সুন্দর সিংহলে।—
স্মৃতি, পিতা বাল্মীকির বৃদ্ধ-রূপ ধরি,
বসিলা শিয়রে মোর ; হাতে বীণা করি,
গাইলা সে মহাগীত, যাহে হিয়া জ্বলে,
যাহে আজু আঁখি হতে অশ্রু-বিন্দু গলে !
কে সে মূঢ় ভূভারতে, বৈদেহি সুন্দরি,
নাদি আর্দ্রে মনঃ যার তব কথা স্মরি,
নিত্য-কান্তি কমলিনী তুমি ভক্তি-জলে!
দিব্য চক্ষুঃ দিলা গুরু;দেখিনু সুক্ষণে
শিলা জলে;কুম্ভকর্ণ পশিল সমরে,
চলিল অচল যেন ভীষণ ঘোষণে,
কাঁপায় ধরায় ঘন ভীম-পদ-ভরে।
বিনাশিলা রামানুজ মেঘনাদে রণে;
বিনাশিলা রঘুরাজ রক্ষোরাজেশ্বরে।
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 8 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-6-300x293.jpg)
রাশি-চক্র – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
রাজপথে,শোভে যথা, রম্য-উপবনে,
বিরাম-অ্যালয়বৃন্দ ; গড়িলা তেমতি
দ্বাদশ মন্দির বিধি, বিবিধ রতনে,
তব নিত্য পথে শূন্যে, রবি, দিনপতি।
মাস কাল প্রতি গৃহে তোমার বসতি,
গ্রহেন্দ্র ; প্রবেশ তব কখন সুক্ষণে,—
কখন বা প্রতিকুল জীব-কুল প্রতি!
অাসে এ বিরামালয়ে সেবিতে চরণে
গ্রহব্রজ ; প্রজাব্রজ, রাজাসন-তলে
পূজে রাজপদ যথা ; তুমি তেজাকর,
হৈমময় তেজ-পুঞ্জ প্রসাদের ছলে,
প্রদান প্রসন্ন ভাবে সবার উপর।
কাহার মিলনে তুমি হাস কুতূহলে,
কাহার মিলনে বাম,—শুনি পরস্পর।
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 2 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-5-177x300.jpg)
রৌদ্র-রস – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
শুনিনু গম্ভীর ধ্বনি গিরির গহ্বরে,
ক্ষুধাৰ্ত্ত কেশরী যেন নাদিছে ভীষণে;
প্রলয়ের মেঘ যেন গর্জ্জিছে গগনে ;
সচূড়ে পাহাড় কাঁপে থর থর থরে,
কাঁপে চারি দিকে বন যেন ভূকম্পনে ;
উথলে অদূরে সিন্ধু যেন ক্রোধ-ভরে,
যবে প্রভঞ্জন আসে নির্ঘোষ ঘোষণে।
জিজ্ঞাসিনু ভারতীরে জ্ঞানার্থে সত্বরে!
কহিলা মা;—”রৌদ্র নামে রস,রৌদ্র অতি,
রাখি আমি,ওরে বাছা,বাঁধি এই স্থলে,
(কৃপা করি বিধি মোরে দিলা এ শকতি)
বাড়বাগ্নি মগ্ন যথা সাগরের জল।
বড়ই কর্কশ-ভাষী,নিষ্ঠুর,দুর্ম্মতি,
সতত বিবাদে মত্ত,পুড়ি রোষানলে।”
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 4 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-3-297x300.jpg)
শকুন্তলা – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
মেনকা অপ্সরারূপী, ব্যাসের ভারতী
প্রসবি, ত্যজিলা ব্যস্তে, ভারত-কাননে,
শকুন্তলা সুন্দরীরে, তুমি, মহামতি,
কণ্বরূপে পেয়ে তারে পালিলা যতনে,
কালিদাস ! ধন্য কবি, কবি-কুল-পতি !
তব কাব্যাশ্রমে হেরি এ নারী-রতনে
কে না ভাল বাসে তারে, দুষ্মন্ত যেমতি
প্রেমে অন্ধ?কে না পড়ে মদন-বন্ধনে?
নন্দনের পিক-ধ্বনি সুমধুর গলে;
পারিজাত-কুসুমের পরিমল শ্বাসে;
মানস-কমল-রুচি বদন-কমলে;
অধরে অমৃত-সুধা;সৌদামিনী হাসে;
কিন্তু ও মৃগাক্ষি হতে যবে গলি,ঝলে
অশ্রুধারা,ধৈর্য্য ধরে কে মর্ত্ত্যে,আকাশে?
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 5 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-2-282x300.jpg)
শিশুপাল – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
নর-পাল-কুলে তব জনম সুক্ষণে
শিশুপাল ! কহি শুন, রিপুরূপ ধরি,
ওই যে গরুড়-ধ্বজে গরজেন ঘনে
বীরেশ, এ ভব-দহে মুকতির তরি!
টঙ্কারি কার্ম্মুক, পশ হুহুঙ্কারে রণে ;
এ ছার সংসার-মায়া অম্তিমে পাসরি ;
নিন্দাছলে বন্দ, ভক্ত, রাজীব-চরণে ।
জানি, ইষ্টদেব তব, নহেন হে অরি
বাসুদেব ; জানি আমি বাগ্দেবীর বরে ।
লৌহদন্ত হল, শুন, বৈষ্ণব সুমতি,
ছিঁড়ি ক্ষেত্রে-দেহ যথা ফলবান করে
সে ক্ষেত্রে ; তোমায় ক্ষণ যাতিনি তেমতি
আজি, তীক্ষ্ণ শর-জালে বধি এ সমরে,
পাঠাবেন সুবৈকুণ্ঠে সে বৈকুণ্ঠ-পতি ।
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 5 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-2-282x300.jpg)
শৃঙ্গার-রস – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
শুনিনু নিদ্রায় আমি,নিকুঞ্জ-কাননে,
মনোহর বীণা-ধ্বনি;- দেখিনু সে স্থলে
রূপস পুরুষ এক কুসুম-আসনে,
ফুলের ঠৌপর শিরে,ফুল-মালা গলে।
হাত ধরাধরি করি নাচে কুতূহলে
চৌদিকে রমণী-চয়,কামাগ্নি-নয়নে,-
উজলি কানন-রাজি বরাঙ্গ-ভূষণে,
ব্রজে যথা ব্রজাঙ্গনা রাস-রঙ্গ-ছলে।
সে কামাগ্নি-কণা লয়ে সে যুবক,হাসি
জ্বালাইছে হিয়াবৃন্দে;ফুল-ধনুঃ ধরি
হানিতেছে চারি দিকে বাণ রাশি রাশি
কি দেব কি নর উভে জর জর করি!
”কামদেব অবতার রস-কুলে আসি,
শৃঙ্গার রসের নাম।”জাগিনু শিহরি।
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 8 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-6-300x293.jpg)
শ্মশান – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
বড় ভাল বাসি আমি ভ্রমিতে এ স্থলে,-
তত্ত্ব-ধীক্ষা-দায়ী স্থল জ্ঞানের নয়নে ৷
নীরবে আসীন হেথা দেখি ভস্মাসনে
মৃত্যু- তেজোহীন আঁখি,হাড়-মালা গলে,
বিকট অধরে হাসি,যেন ঠাট-ছলে!
অর্থের গৌরব বৃথা হেথা- এ সদনে-
রূপের প্রফুল্ল ফুল শুষ্ক হুতাশনে,
বিদ্যা,বুদ্ধি,বল,মান,বিফল সকলে।
কি সুন্দর অট্টালিকা,কি কুটীর-বাসী,
কি রাজা,কি প্রজা,হেথা উভয়ের গতি।
জীবনের স্রোতঃ পড়ে এ সাগরে আসি।
গহন কাননে বায়ু উড়ায় যেমতি
পত্র-পুঞ্জে,আয়ু-কুঞ্জে,কাল,জীব-রাশি
উড়ায়ে,এ নদ-পাড়ে তাড়ায় তেমতি।
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 3 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-4-212x300.jpg)
শ্যামা-পক্ষী – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
আঁধার পিঞ্জরে তুই,রে কুঞ্জ-বিহারি
বিহঙ্গ, কি রঙ্গে গীত গাইস্ সুস্বরে ?
ক মোরে, পূর্ব্বের সুখ কেমনে বিস্মরে
মনঃ তোর ? বুঝা রে, যা বুঝিতে না পারি!
সঙ্গীত-তরঙ্গ-সঙ্গে মিশি কি রে ঝরে
অদৃশ্যে ও কারাগারে নয়নের বারি?
রোদন-নিনাদ কি রে লোকে মনে করে
মধুমাখা গীত-ধ্বনি, অজ্ঞানে বিচারি?
কে ভাবে, হৃদয়ে তোর কি ভাব উথলে?—
কবির কুভাগ্য তোর, আমি ভাবি মনে।
দুখের আঁধারে মজি গাইস্ বিরলে
তুই,পাখি, মজায়ে রে মধু-বরিষণে!
কে জানে যাতনা কত তোর ভব-তলে ?
মোহে গন্ধে গন্ধরস সহি হুতাশনে!
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 5 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-2-282x300.jpg)
শ্রীপঞ্চমী – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
নহে দিন দূরে, দেবি যবে ভূভারতে
বিসর্জ্জিব ভূভারত, বিস্মৃতির জলে,
ও তব ধবল মূর্ত্তি সুদল কমলে ;—
কিন্তু চিরস্থায়ী পূজা তোমার জগতে !
মনোরূপ-পদ্ম যিনি রোপিলা কৌশলে
এ মানব-দেহ-সরে, তাঁর ইচ্ছামতে
সে কুসুমে বাস তব, যথা মরকতে
কিম্বা পদ্মরাগে জ্যোতিঃ নিত্য ঝলঝলে !
কবির হৃদয়-বনে যে ফুল ফুটিবে,
সে ফুল-অঞ্জলি লোক ও রাঙা চরণে
পরম-ভকতি-ভাবে চিরকাল দিবে
দশ দিশে, যত দিন এ মর ভবনে
মনঃ-পদ্ম ফোটে, পূজা, তুমি, মা, পাইবে !—
কি কাজ মাটির দেহে তবে, সনাতনে ?
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 6 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-1-208x300.jpg)
সখি – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
(১)
কি কহিলি কহ, সই, শুনি লো আবার—
মধুর বচন!
সহসা হইনু কালা; জুড়া এ প্রাণের জ্বালা,
আর কি এ পোড়া প্রাণ পাবে সে রতন?
হ্যাদে তোর পায় ধরি, কহ না লো সত্য করি,
আসিবে কি ব্রজে পুনঃ রাধিকারমণ?
(২)
কহ, সখি, ফুটিবে কি এ মরুভূমিতে
কুসুমকানন ?
জলহীনা স্রোতস্বতী, হবে কি লো জলবতী,
পয়ঃ সহ পয়োদে কি বহিবে পবন?
হ্যাদে তোর পায় ধরি, কহ না লো সত্য করি,
আসিবে কি ব্রজে পুনঃ রাধিকারঞ্জন?
(৩)
হায় লো সয়েছি কত, শ্যামের বিহনে—
কতই যাতন।
যে জন অন্তরযামী সেই জানে আর আমি,
কত যে কেঁদেছি তার কে করে বর্ণন?
হ্যাদে তোর পায় ধরি, কহ না লো সত্য করি,
আসিবে কি ব্রজে পুনঃ রাধিকামোহন।
(৪)
কোথা রে গোকুল-ইন্দু,—বৃন্দাবন-সর—
কুমুদ-বাসন।
বিষাদ নিশ্বাস বায়, ব্রজ, নাথ, উড়ে যায়,
কে রাখিবে, তব রাজ, ব্রজের রাজন!
হ্যাদে তোর পায় ধরি, কহ না লো সত্য করি,
আসিবে কি ব্রজে পুনঃ রাধিকাভূষণ!
(৫)
শিখিনী ধরি, স্বজনি, গ্রাসে মহাফণী—
বিষের সদন!
বিরহ বিষের তাপে শিখিনী আপনি কাঁপে,
কুলবালা এ জ্বালায় ধরে কি জীবন!
হ্যাদে তোর পায় ধরি, কহ না লো সত্য করি,
আসিবে কি ব্রজে পুনঃ রাধিকারতন!
(৬)
এই দেখ্, ফুলমালা গাঁথিয়াছি আমি—
মধুর বচন।
দোলাইব শ্যামগলে, বাঁধিব বঁধুরে ছলে—
প্ৰেম-ফুল-ডোরে তাঁরে করিব বন্ধন!
হ্যাদে তোর পায় ধরি, কহ না লো সত্য করি,
আসিবে কি ব্রজে পুনঃ রাধাবিনোদন।
(৭)
কি কহিলি কহ, সই, শুনি লো আবার—
মধুর বচন।
সহসা হইনু কালা, জুড়া এ প্রাণের জ্বালা
আর কি এ পোড়া প্রাণ পাবে সে রতন!
মধু—যার মধুধ্বনি— কহে কেন কাঁদ, ধনি,
ভুলিতে কি পারে তোমা শ্ৰীমধুসূদন?
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 7 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-7-300x300.jpg)
সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
সুরপুরে সশরীরে, শূর-কুল-পতি
অর্জ্জুন, স্বকাজ যথা সাধি পুণ্য-বলে
ফিরিলা কানন-বাসে ;- তুমি হে তেমতি,
যাও সুখে ফিরি এবে ভারত-মণ্ডলে,
মনোদ্যানে আশা-লতা তব ফলবতী !—
ধন্য ভাগ্য, হে সুভগ, তব ভব-তলে !
শুভ ক্ষণে গর্ভে তোমা ধরিলা সে সতী,
তিতিবেন যিনি, বৎস, নয়নের জলে
( স্নেহাসার!) যবে রঙ্গে বায়ু-রূপ ধরি
জনরব, দূর বঙ্গে বহিবে সত্বরে
এ তোমার কীৰ্ত্তি-বাৰ্ত্তা!—যাও দ্রুতে, তরি,
নীলমণি-ময় পথ অপথ সাগরে!
অদৃশ্যে রক্ষার্থে সঙ্গে যাবেন সুন্দরী
বঙ্গ-লক্ষ্মী! যাও, কবি আশীৰ্ব্বাদ করে!–
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 8 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-6-300x293.jpg)
সমাধি-লিপি – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
দাঁড়াও, পথিক-বর, জন্ম যদি তব
বঙ্গে! তিষ্ঠ ক্ষণকাল! এ সমাধিস্থলে
(জননীর কোলে শিশু লভয়ে যেমতি
বিরাম) মহীর পদে মহানিদ্রাবৃত
দত্তকুলোদ্ভব কবি শ্রীমধুসূদন!
যশোরে সাগরদাঁড়ী কবতক্ষ-তীরে
জন্মভূমি, জন্মদাতা দত্ত মহামতি
রাজনারায়ণ নামে, জননী জাহ্নবী!
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 97 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-5-177x300.jpg)
সমাপ্তে – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
বিসর্জ্জিব আজি, মা গো, বিস্মৃতির জলে
( হৃদয়-মণ্ডপ, হায়, অন্ধকার করি!)
ও প্রতিমা!নিবাইল,দেখ,হোমানলে
মনঃ-কুণ্ডে অশ্রু-ধারা মনোদুঃখে ঝরি!
শুখাইল দুরদৃষ্ট সে ফুল্ল কমলে,
যার গন্ধামোদে অন্ধ এ মনঃ,বিস্মরি
সংসারে ধর্ম্ম,কর্ম্ম!ডুবিল সে তরি,
কাব্য-নদে খেলাইনু যাহে পদ-বলে
অল্প দিন!নারিনু,মা,চিনিতে তোমারে
শৈশব,অবোধ আমি!ডাকিলা যৌবনে;
(যদিও অধম পুত্র,মা কি ভুলে তারে?)
এবে- ইন্দ্রপ্রস্থ ছাড়ি যাই দূর বনে!
এই বর,হে রবদে,মাগি শেষ বারে,-
জ্যোতির্ম্ময় কর বঙ্গ- ভারত-রতনে!
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 4 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-3-297x300.jpg)
সরস্বতী – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
তপনের তাপে তাপি পথিক যেমতি
পড়ে গিয়া দড়ে রড়ে ছায়ার চরণে ;
তৃষাতুর জন যথা হেরি জলবতী
নদীরে, তাহার পানে ধায় ব্যগ্ৰ মনে
পিপাসা-নাশের আশে ; এ দাস তেমতি,
জ্বলে যবে প্রাণ তার দুঃখের জ্বলনে,
ধরে রাঙা পা দুখানি, দেবি সরস্বতি!—
মার কোল-সম, মা গো, এ তিন ভুবনে
আছে কি আশ্রম আর ? নয়নের জলে
ভাসে শিশু যবে, কে সাম্ভনে তারে ?
কে মোচে আঁখির জল অমনি আঁচলে ?
কে তার মনের খেদ নিবারিতে পারে,
মধুমাখা কথা কয়ে, স্নেহের কৌশলে ?—
এই ভাবি, কৃপাময়ি, ভাবি গো তোমারে!
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 6 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-1-208x300.jpg)
সংস্কৃত – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
কাণ্ডারী-বিহীন তরি যথা সিন্ধু-জলে
সহি বহু দিন ঝড়, তরঙ্গ-পীড়নে,
লভে কূল কালে, মন্দ পবন-চালনে;
সে সুদশা আজি তব সুভাগ্যের বলে,
সংস্কৃত, দেব-ভাষা মানব-মণ্ডলে,
সাগর-কল্লোল-ধ্বনি, নদের বদনে,
বজ্রনাদ, কম্পবান্ বীণা-তার-গণে!
রাজাশ্রম আজি তব ! উদয়-অচলে,
কনক-উদয়াচলে, আবার, সুন্দরি,
বিক্রম-অাদিত্যে তুমি হের লো হরষে,
নব আদিত্যের রূপে ! পুৰ্ব্বে-রূপ ধরি,
ফোট পুনঃ পুর্ব্বরূপে, পুনঃ পূৰ্ব্ব-রসে
এত দিনে প্রভাতিল দুখ-বিভাবরী ;
ফোট মনানন্দে হাসি মনের সরসে ।
![কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা 7 মাইকেল মধুসূদন দত্ত [ Michael Madhusudan Dutta ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Michael-Madhusudan-Dutta-মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত-7-300x300.jpg)

আরও পড়ুন: