কবি জয় গোস্বামীর কবিতা নিয়ে আজকের আয়োজন। জয় গোস্বামীর জন্ম ১০ নভেম্বর ১০, ১৯৫৪ সালে পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত কলকাতা শহরে। ছোটবেলায় তাঁর পরিবার রানাঘাটে চলে আসে। তখন থেকেই তাঁর স্থায়ী নিবাস হয়ে উঠে সেখানে। তাঁর পিতা মধু গোস্বামী ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবী রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন । তাঁর মা শিক্ষকতা করে তাঁকে লালন পালন করেন। জয় গোস্বামীর প্রথাগত লেখা পড়ার পরিসমাপ্তি ঘটে একাদশ শ্রেণীতে থাকার সময়। তিনি বাংলা ভাষার একজন প্রখ্যাত আধুনিক কবি। পশ্চিমবঙ্গবাসী ভারতীয় এই কবি উত্তর-জীবনানন্দ পর্বের অন্যতম জনপ্রিয় বাঙালিকবি হিসাবে পরিচিত ।
![কবি জয় গোস্বামীর কবিতা 1 কবি জয় গোস্বামীর কবিতা - জয় গোস্বামী [ Joy Goswami ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/04/জয়-গোস্বামী-Joy-Goswami-56-294x300.jpg)
জয় গোস্বামী প্রথম কবিতা লিখেছিলেন ১৩-১৪ বছর বয়সে। নিয়মিত কবিতা লিখা শুরু করেন ১৬-১৭ বছর বয়সে। তার প্রথম কবিতার বই ‘ক্রিসমাস ও শীতের সনেটগুচ্ছ’ যা প্রকাশিত হয় ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে। সাময়িকী ও সাহিত্য পত্রিকায় তিনি কবিতা লিখতেন। এভাবে অনেক দিন কাটার পর দেশ পত্রিকায় তাঁর কবিতা ছাপা হয়। কিছুদিন পরে তাঁর প্রথম কাব্য সংকলন ক্রিসমাস ও শীতের সনেটগুচ্ছ প্রকাশিত হয়। ১৯৮৯ সালে তিনি ঘুমিয়েছ, ঝাউপাতা কাব্যগ্রন্থের জন্য আনন্দ পুরস্কার লাভ করেন। ২০০০ সালের আগস্ট মাসে তিনি পাগলী তোমার সঙ্গে কাব্য সংকলনের জন্য সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন।
Table of Contents
কবি জয় গোস্বামীর কবিতা:
![কবি জয় গোস্বামীর কবিতা 2 জয় গোস্বামী [ Joy Goswami ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/04/জয়-গোস্বামী-Joy-Goswami-57-300x169.jpg)
যে-লেখা পড়ে তোমাদের শুকনো চোখে জল আসবে
সেই লেখা আমার হাত থেকে বেরিয়ে
উড়ে ওই ডালে গিয়ে বসল।
এখন থেকে তাকে পড়তে শুরু করবে পাখিরা।
শুনে-শুনে মুখস্থ হয়ে যাবে গাছেদেরও।
কিন্তু গাছেরা তো কথা বলতে পারে না! কী হবে?
কী আবার হবে!
আমি আর বকুন, দিনে রাতে, কত গাছের গুঁড়িতে
কান রেখে শুনেছি
গাছ, মনে-মনে কবিতা বলছে…
১২ মে ৮৪ রাত্রির সমস্ত শ্মশানবন্ধুকে – জয় গোস্বামী
ধায় রাত্রি ধায় রাত্রি আয় ধাত্রী ভান্ড খুলি তোর
লিখেছি সাতকান্ড আমি খন্ড করে ফ্যাল আমাকে খন্ড হাড় খন্ড ঊরু
দ্বিখন্ডিত বস্তিদেশ, অন্ডকাটা শিখন্ডিত মুন্ডুঅলা দেহ
জগত্ভূমে নৃত্য করে হাত পা ছুঁড়ে নৃত্য করে
অগ্নিভূঁড়ি ফাটিয়ে শেষকৃত্য করে তোর
করে না, কেউ করায় তাকে, ওঠে রে ধূম লক্ষপাকে
যজ্ঞভূমে কাটা আঙুল লকলকিয়ে বৃক্ষ আঁচড়ায়
হা লকলক হো লকলক ভুঁয়ে গড়ায় জ্যান্ত চোখ
কী আনন্দে স্কন্ধ ছিঁড়ে শরীরহারা কামানো এক মাথা
যায় রে যায় শূন্যপথে কাটা গলায় অগ্নি পড়ে
শেষ কামড়ে কামড়ে ধরে বক্ষহারা ভান্ড তোর লৌহলালা খায়
ধায় রাত্রি ধায় রাত্রি মাতৃধারা যায় রে গঙ্গায় ……..
—- ‘হ্যাঁ জানি। খেয়াল আছে। দেব না। দিচ্ছি না। ভয় নেই’
দাম্ভিক মেয়েটি ঠিক ওই সময় কত অসহায়
আমাকে বিশ্বাস করেছিল।
নিজের আনন্দ রাখতে মারের সাবধান রইল না।
—- ‘যদি কিছু হয়ে যায়’
—- ‘ও কিছু হবে না।’ —- ‘ঠিক তো?’—- ‘না কিছু হবে না।’
শিকড় উপড়ে তুলতে দেরি হয়েছিল।
ভাঙা গর্ভ থেকে টেনে বার করা অসমাপ্ত ফল
নার্সিংহোমের নীচে নর্দমার পাশে
ব্যান্ডেজ প্লাস্টারভাঙা তুলো রক্ত পলিথিনে
মিশে রইল জঞ্জালের মতো…
আমার সাহস থাকলে ওর আজকে দশ বছর হত!
![কবি জয় গোস্বামীর কবিতা 5 জয় গোস্বামী [ Joy Goswami ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/04/জয়-গোস্বামী-Joy-Goswami-54-300x246.jpg)
অতীতের দিকে উঠে চলে – জয় গোস্বামী
অতীতের দিকে উঠে চলে
যুদ্ধ শব, হাজার হাজার
শিখরের উপরে তুষার
তাদের পিছনে আলো জ্বেলে
বসে আছে ছোট ছোট বাড়ি
স্বামীপুত্র হারানো সংসার
![কবি জয় গোস্বামীর কবিতা 6 জয় গোস্বামী [ Joy Goswami ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/04/জয়-গোস্বামী-Joy-Goswami-52-300x169.jpg)
অন্ধ চলেছেন – জয় গোস্বামী
অন্ধ চলেছেন। খঞ্জ, চলেছেন। লাঠি
পুরনো বন্ধুর মতো চলেছে তাঁদের সঙ্গে।
হাত কাটা। ন্যাড়া মাথা। ঘেয়ো।
অষ্টাবক্র। ব্যান্ডেজ জড়ানো
চাকাঅলা কাঠের বাক্সের মধ্যে বসা–
সকলকে নিয়ে এই ধীরগতি মিছিলও চলেছে
অতিকায় মেঘের চাঙড় ফেটে ফেটে
গনগনে অস্তরশ্মি বেরোচ্ছে তখন
ঢাল বেয়ে ঢাল বেয়ে সকলেই ওই
চুল্লির ভিতরে নেমে যেতে
ব্যান্ডেজ, কাপড়, কাঠ, চাকা, ক্ষয়গ্রস্ত হাড়, আর
খণ্ড খণ্ড না-মেটা বাসনা
কতরকমের সব রঙিন পালক হয়ে ছিটকে ছিটকে উঠেছে আকাশে
আমলকীতলার মাঠে, এখনো একেকদিন, সেইসব রঙ ভেসে আসে
![কবি জয় গোস্বামীর কবিতা 7 জয় গোস্বামী [ Joy Goswami ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/04/জয়-গোস্বামী-Joy-Goswami-51-222x300.jpg)
অন্ধকার আকাশবাতি – জয় গোস্বামী
অন্ধকার আকাশবাতি
এই সড়কে নয়ন
ফাটল, খাদ, গর্ত–সব
ধসে পড়ার সুযোগ
পার ক’রে আর মাটির ওপর
ফুটে বেরোনো দাঁত
ব্যর্থ ক’রে, নিশিজাগর,
জলের নীচে শয়ন!
জলে তৈরী সড়ক, তাতে
আকাশবাতি ফেলে
রাস্তা দ্যাখে অন্ধ–পাশে
এক সন্ধ্যাকাশ
দুই সঙ্গী হাঁটে, তাদের
গমনপথ থেকে
কাঁটা, কামড়, গরল আদি
গুপ্তকীট নাশ!
![কবি জয় গোস্বামীর কবিতা 8 জয় গোস্বামী [ Joy Goswami ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/04/জয়-গোস্বামী-Joy-Goswami-50-300x300.jpg)
অভিসার – জয় গোস্বামী
প্রেম হবে বলে আজ এখানে এসেছি গাছে নতুন দোয়েল পাখি ডাকে
পুরনো দোয়েল শ্যামা নয়নে নয়ন রেখে কটুবাক্য বলে দিতে চায়
জলে দিতে চায় ওরা আমাকে হৃদয় আমি একলা শ্যামল মেয়ে হায়
পথ ভুলে এ-কোথায় এসে পড়লাম আজ শান্তিপুর ডুবু ডুবু নদে ভেসে যায়
ওলো ও তরুণগাছ সঙ্গ দেবে বলে শুধু পাতাভরা ডালখানি এনে
মাথায় বুলিয়ে কেন দিলে কেন দিলে আমি কোনো জন্ম দেখলাম না এমন পুষ্কর
গা ধুতে পারলাম না আমি জল ভরতেও নয় একী গো তোমার বিবেচনা
কী ঘরে ঘরের কাজ করি আমি কী প্রকারে মন রাখি পাঠে আজ
আমার যে গা ভরতি সোনা
খুলে খুলে পড়ে গেল বনমাঝে দস্যুদল আছোলা চালিয়ে দিলো বাঁশ–
পুলিশে উদ্ধার করল অজ্ঞান উপায়ে বলো হে প্রিয় পুলিশ
আমি তো সমস্ত ছেড়ে চলেই এসেছি আমি পা পিছলে পড়েছি
তোমার প্রণয়ে জল হাড়গোড় ভেঙেছি ওরে যত আছ হাড়গোড়
ভাঙা সব এসো পাছে পাছে
আসন গ্রহণ করো, প্রেম হবে প্রেম হবে, হরিনাম খাবলা খাবলা
হবে বলে নদীয়াসমাজে
ডাকো রে সকলে মিলি, খোঁড়া অন্ধ কানা ডাকো, যে আছ ক্ষুধার্ত পাখি
সব শালা ডাকো গাছে গাছে…
![কবি জয় গোস্বামীর কবিতা 9 জয় গোস্বামী [ Joy Goswami ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/04/জয়-গোস্বামী-Joy-Goswami-49-300x300.jpg)
আইনশৃঙ্খলা – জয় গোস্বামী
কপালে স্টিকার আঁটা : সুকুমার গিরি ।
বুকে মস্ত ছ্যাঁদা নিয়ে চিত হয়ে আছে
তমলুক হাস্পাতালে ।
ঢাক্তার বুঝেছেন
এ লোকটাকে বেডে তুলতে গেলেই
এক্ষুনি মরে যাবে ।
ঠিক । গেল তাই । কিন্তু, ছেলে তার
বুঝছে না এখনো ।
বলছে, ‘বাবু, পায়ে পড়ি,
বাবাকে বাঁচান’ ।
ডাক্তার কি করবে আর!
ওর ছেলে জানেও না
লিডারের কয়েকটি কথায়
নির্দেশিত আমাদের শোয়া বসা
হাঁটা চলা মরা আর বাঁচা—
আমাদের কাজ শুধু মর্গা আর হাসপাতালে
পুলিশের গুলি খাওয়া মৃতদেহ হয়ে
‘আইনশৃঙ্খলা’ রক্ষা করা।
![কবি জয় গোস্বামীর কবিতা 10 জয় গোস্বামী [ Joy Goswami ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/04/জয়-গোস্বামী-Joy-Goswami-47-300x300.jpg)
আজ কী নিশ্চিত কী বিদ্যুৎ কী হরিণ এই দৌড় – জয় গোস্বামী
আজ কী নিশ্চিত কী বিদ্যুৎ কী হরিণ এই দৌড়
কী প্রান্তর, কী উড়ে যাওয়া ধুলো এই হাত
কী ময়ূর এই নৃত্য
কী কূপ কী বন্ধ কী জিভ-বেরিয়ে-পড়া এই ঈর্ষা
কী অবধারিত কবর সব গর্ত
আর পশ্চাদ্বাবনরত পিশাচদের কী হঠাৎ তলিয়ে যাওয়া
আজ কী সম্রাজ্ঞী এই ছন্দ
শয়তানও যাকে কেনবার কথা কল্পনা করে না
![কবি জয় গোস্বামীর কবিতা 11 জয় গোস্বামী [ Joy Goswami ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/04/জয়-গোস্বামী-Joy-Goswami-46-197x300.jpg)
আজ যদি আমাকে জিগ্যেস করো – জয় গোস্বামী
আজ যদি আমাকে জিগ্যেস করো : ‘এই জীবন নিয়ে
তুমি কি করেছো এতদিন ?’— তাহলে আমি বলবো
একদিন বমি করেছিলাম, একদিন ঢোঁক
গিলেছিলাম, একদিন আমি ছোঁয়া মাত্র জল
রুপান্তরিত হয়েছিল দুধে, একদিন আমাকে দেখেই
এক অপ্সরার মাথা ঘুরে গিয়েছিল একদিন
আমাকে না বলেই আমার দুটো হাত
কদিনের জন্য উড়ে গেছিল হাওয়ায়
একদিন মদ হিসেবে ঢুকেছিলাম এক
জবরদস্ত মাতালের পেটে, একদিন সম্পূর্ণ
অন্যভাবে বেরিয়ে এসেছিলাম এক
রূপসীর শোকাশ্রুরুপে, আর তৎক্ষণাৎ
আহা উহু আহা উহু করতে করতে আমাকে
শুষে নিয়েছিল বহুমূল্য মসলিন
একদিন গায়ে হাত তুলেছিলাম
একদিন পা তুলেছিলাম
একদিন জিভ ভেঙিয়েছিলাম
একদিন সাবান মেখেছিলাম
একদিন সাবান মাখিয়েছিলাম যদি
বিশ্বাস না হয় তো জিগ্যেস করুন আমার মৃত্যুকে
একদিন কা কা করে ডেকে বেরিয়েছিলাম সারাবেলা
একদিন তাড়া করেছিলাম স্বয়ং কাকতাড়ুয়াকেই
একদিন শুয়োর পুষেছিলাম, হ্যাঁ হ্যাঁ একদিন ছাগল
একদিন দোদোমা ফাটিয়েছিলাম, একদিন চকলেট
একদিন বাঁশি বাজিয়েছিলাম, হ্যাঁ হ্যাঁ একদিন রাধাকেও
একদিন আমার মুখ আমি আচ্ছা ক’রে গুঁজে দিয়েছিলাম
একজনের কোলে আর আমার বাকি শরীরটা তখন
কিনে নিয়েছিল অন্য কেউ কে তা আমি এখনো জানি না যদি
বিশ্বাস না হয় তো জিগ্যেস করো গিয়ে তোমার…
একদিন আমার শরীর ছিল তরুণ পাতায় ভরা
আর আমার আঙুল ছিল লম্বা সাদা বকফুল
আমার চুল ছিল একঝাঁক ধূসর রঙের মেঘ
হাওয়া এলেই যেখানে খুশি উড়ে যাবে, কেবল সেইজন্য—
একদিন মাঠের পর মাঠে আমি ছিলাম বিছিয়ে রাখা ঘাস
তুমি এসে শরীর ঢেলে দেবে, কেবল সেইজন্য—
আর সমস্ত নিষেধের বাইরে ছিল
আমার দুটো চোখ
এ নদী থেকে ও নদী থেকে সেই সে নদীতে
কেবলই ভেসে বেড়াতো তারা
সেই রকমই কোনো নদীর উপর, রোগা একটা সাঁকোর মতো
একদিন আমি পেতে রেখেছিলাম আমার সাষ্টাঙ্গ শরীর
যাতে এপার থেকে ওপারে চলে যেতে পারে লোক
কোনো বাধা-নিষেধ ছাড়াই
যাতে ওপার থেকে এপারে চলে আসতে পারে লোক
কোনো বাধা-নিষেধ ছাড়াই
সেই সাঁকোর উপর দিয়ে একদিন এপার থেকে
ওপারে চলে গিয়েছিল আসগর আলি মণ্ডলরা বাবুল ইসলামরা
সেই সাঁকোর উপর দিয়ে একদিন ওপার থেকে
এপারে চলে এসেছিল তোমার নতুন শাড়ি-পরা মা,
টেপ-জামা-পরা আমার সান্তুমাসী
একদিন সংবিধান লিখতে লিখতে একটু
তন্দ্রা এসে গিয়েছিল আমার দুপুরের ভাত-ঘুম মতো এসেছিল একটু
আর সেই ফাঁকে কারা সব এসে ইচ্ছে মতো
কাটাকুটি করে গিয়েছে দেহি পদপল্লব মুদারম্
একদিন একদম ন্যাংটো হয়ে
ছুটতে ছুটতে চৌরাস্তার মোড়ে এসে আমি পেশ করেছিলাম
বাজেট
একদিন হাঁ করেছিলাম একদিন হাঁ বন্ধ করেছিলাম
কিন্তু আমার হা-এর মধ্যে কোনো খাবার ছিল না
কিন্তু আমার না-এর মধ্যে কোনো খাবার ছিল না
একদিন দুই গাল বেয়ে ঝরঝর ক’রে রক্তগড়ানো অবস্থায়
জলে কাদায় ধানক্ষেত পাটক্ষেতের মধ্যে
হাতড়ে হাতড়ে আমি খুঁজে ফিরেছিলাম আমার উপড়ে নেওয়া চোখ
একদিন পিঠে ছরা-গাঁথা অবস্থায়
রক্ত কাশতে কাশতে আমি আছড়ে এসে পরেছিলাম দাওয়ায়
আর দলবেঁধে, লণ্ঠন উঁচু করে, আমায় দেখতে এসেছিল গ্রামের লোক
একদিন দাউদাউ ক’রে জ্বলতে থাকা ঝোপঝাড় মধ্য থেকে
সারা গায়ে আগুন নিয়ে আমি ছুটে বেরিয়েছিলাম আর
লাফ দিয়েছিলাম পচা পুকুরে
পরদিন কাগজে সেই খবর দেখে আঁতকে উঠেছিলাম
উত্তেজিত হয়েছিলাম। অশ্রুপাত করেছিলাম, লোক জড়ো করেছিলাম,
মাথা ঘামিয়েছিলাম আর সমবেত সেই মাথার ঘাম
ধরে রেখেছিলাম দিস্তে দিস্তে দলিলে—যাতে
পরবর্তী কেউ এসে গবেষণা শুরু করতে পারে যে
এই দলিলগুলোয় আগুন দিলে ক’জনকে পুড়িয়ে মারা যায়
মারো মারো মারো
স্ত্রীলোক ও পুরুষলোকের জন্যে আয়ত্ত করো দু ধরনের প্রযুক্তি
মারো মারো মারো
যতক্ষণ না মুখ দিয়ে বমি করে দিচ্ছে হৃৎপিণ্ড
মারো মারো মারো
যতক্ষণ না পেট থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে পেটের বাচ্চা
মারো মারো মারো মারো মারো-ও-ও-ও
এইখানে এমন এক আর্তনাদ ব্যবহার করা দরকার
যা কানে লাগলে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে মাথার খুলি
এইখানে এমন এক সঙ্গম ব্যাবহার করা দরকার
যার ফলে অর্ধেক শরীর চিরকালের মতো পুঁতে যাবে ভূগর্ভে আর
দ্রুত কয়লা হয়ে যাবে
এইখানে এমন এক থুতু নিক্ষেপ করা দরকার
যে-থুতু মুখ থেকে বেরোনো মাত্রই বিদীর্ণ হবে অতিকায় নক্ষত্ররুপে
এইখানে এমন এক গান ব্যাবহার করা দরকার যা গাইবার সময়
নায়ক-নায়িকা শূনে উঠে গিয়ে ভাসতে থাকবে আর তাদের
হাত পা মুণ্ডু ও জননেন্দিয়গুলি আলাদা আলাদা হয়ে আসবে
ও প্রতিটি প্রতিটির জন্যে কাঁদবে প্রতিটি প্রতিটিকে আদর করবে ও
একে অপরের নিয়ে কী করবে ভেবে পাবে না, শেষে
পূর্বের অখণ্ড চেহারায় ফিরে যাবে
এইখানে এমন এক চুম্বন-চেষ্টা প্রয়োগ করা দরকার, যার ফলে
‘মারো’ থেকে ‘ও’ অক্ষর
‘বাচাও’ থেকে ‘ও’ অক্ষর
তীব্র এক অভিকর্ষজ টানে ছিঁড়ে বেরিয়ে এসে
পরস্পরের দিকে ছুটে যাবে এবং এক হয়ে যেতে চাইবে
আর আবহমানকালের জন্যে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া দুই প্রেমিক-প্রেমিকার মুখ
আকাশের দিকে উত্তোলিত তাদের গোল হয়ে থাকা হাঁ
একটি অনন্ত ‘ও’ ধ্বনিতে স্তব্ধ হয়ে থাকবে
আজ যদি আমায় জিগ্যেস করো শত শত লাইন ধ’রে তুমি
মিথ্যে লিখে গিয়েছো কেন ?
যদি জিগ্যেস করো একজন কবির কাজ কী হওয়া উচিত
কেন তুমি এখনো শেখোনি ?—তাহলে
আমি শুধু বলবো একটি কণা,
বলবো, বালির একটি কণা থেকে আমি জন্মেছিলাম, জন্মেছিলাম
লবণের একটি দানা থেকে—আর অজানা অচেনা এক বৃষ্টিবিন্দু
কত উঁচু সেই গাছের পাতা থেকেও ঠিক দেখতে পেয়েছিল আমাকে
আর ঝরেও পড়েছিল আমার পাশে—এর বেশি আমি আর
কিচ্ছু জানি না……
আজ যদি আমাকে জিগ্যেস করো কোন্ ব্যূহ কোন্ অন্ধকুপ
রাষ্টের কোন্ কোন্ গোপন প্রণালীর ভেতর তুমি ঘুরে
বেরিয়েছো তুমি বেড়াতে গিয়েছো কোন্ অস্ত্রাগারে তুমি চা খেয়েছো এক কাপ
তুমি মাথা দিয়ে ঢুঁসিয়েছো কোন্ হোর্ডিং কোন্ বিজ্ঞাপন কোন্ ফ্লাইওভার
তোমার পায়ের কাছে এসে মুখ রেখেছে কোন্ হরিণ
তোমার কাছে গলা মুচড়ে দেওয়ার আবেদন এনেছে কোন্
মরাল
তাহলে আমি বলবো
মেঘের উপর দিয়ে মেঘের উপর দিয়ে মেঘের উপর
আমি কেবল উড়েই বেড়াইনি
হাজার হাজার বৃষ্টির ফোঁটায় ফোঁটায় আমি
লাফিয়ে লাফিয়ে নেচে বেরিয়েছি মাঠে আর জনপদে
আজ যদি আমায় জিগ্যেস করো :
তুমি একই বৃন্তে ক’টি কুসুম
তুমি শাণ্ডিল্য না ভরদ্বাজ
তুমি দুর্লভ না কৈবর্ত
তুমি ব্যাটারি না হাত-বাক্স
তুমি পেঁপে গাছ না আতা গাছ
তুমি চটি পায়ে না জুতো পায়ে
তুমি চণ্ডাল না মোছরমান
তুমি মরা শিলা না জ্যান্ত শিলা
তা হলে আমি বলবো সেই রাত্রির কথা, যে-রাত্রে
শান্ত ঘাসের মাঠ ফুঁড়ে নিঃশব্দে নিঃশব্দে
চতুর্দিকে মাটি পাথর ছিটকোতে ছিটকোতে তীব্রগতিতে আমি উড়তে দেখেছিলাম
এক কুতুন মিনার, ঘূর্ণ্যমান কুতুব মিনার
কয়েক পলকে শূনে মিলিয়ে যাবার আগে
আকাশের গায়ে তার ধাবমান আগুনের পুচ্ছ থেকে আমি সেদিন
দুদিকে দু’হাত ভাসিয়ে দিয়ে ঝাঁপ দিয়েছিলাম ফেনায় তোলপাড় এই
সময় গর্ভে……
আজ আমি দূরত্বের শেষ সমুদ্রে আর জলের নিচে লোহার চাকা পাক খায়
আজ আমি সমুদ্রের সেই সূচনায় আর জলের নিচে লোহার চাকা পাক খায়
যা-কিছু শরীর অশরীর তা-ই আজ আমার মধ্যে জেগে উঠছে প্রবল প্রাণ
আজ আমি দুই পাখনায় কাটতে কাটতে চলেছি সময়
অতীত আর ভবিষ্যৎ দুই দিকে কাটতে কাটতে চলেছি সময় এক অতিকায় মাছ
আমার ল্যাজের ঝাপটায় ঝাপটায় গড়ে উঠছে জলস্তম্ভ ভেঙে পরছে জলস্তম্ভ
আমার নাক দিয়ে ছুঁড়ে দেওয়া ফোয়ারায় উচ্ছ্রিত হয়ে উঠছে জ্বলন্ত মেঘপুঞ্জ
আমার নাসার উপরকার খড়্গে বাঁধা রয়েছে একটি রশি
যার অপরপ্রান্ত উঠে গেছে অনেক অনেক উপরে
এই পৃথিবী ও সৌরলোকের আকর্ষণসীমার বাইরে
যেখানে প্রতি মুহূর্তে ফুলে ফুলে উঠছে অন্ধকার ঈথার
সেইখানে, একটি সৌরদ্বীপ থেকে আরেক সৌরদ্বীপের মধ্যপথে
দুলতে দুলতে, ভাসতে ভাসতে চলেছে একটি আগ্নেয় নৌকা……
এর বেশি আর কিছুই আমি বলতে পারবো না
![কবি জয় গোস্বামীর কবিতা 12 জয় গোস্বামী [ Joy Goswami ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/04/জয়-গোস্বামী-Joy-Goswami-45-300x300.jpg)
আমরা তো অল্পে খুশি – জয় গোস্বামী
আমরা তো অল্পে খুশি,
কী হবে দুঃখ করে?
আমাদের দিন চলে যায়
সাধারণ ভাতকাপড়ে।
চলে যায় দিন আমাদের
অসুখে ধারদেনাতে
রাত্তিরে দুভায়ে মিলে
টান দিই গঞ্জিকাতে।
সবদিন হয়না বাজার,
হলে হয় মাত্রাছাড়া –
বাড়িতে ফেরার পথে
কিনে আনি গোলাপচারা।
কিন্তু পুঁতব কোথায়?
ফুল কি হবেই তাতে?
সে অনেক পরের কথা
টান দিই গঞ্জিকাতে।
আমরা তো অল্পে খুশি,
কী হবে দু : খ করে?
আমাদের দিন চলে যায়
সাধারণ ভাতকাপড়ে।
মাঝে মাঝে চলেও না দিন
বাড়ি ফিরি দুপুররাতে ;
খেতে বসে রাগ চড়ে যায়
নুন নেই ঠান্ডা ভাতে।
রাগ চড়ে মাথায় আমার
আমি তার মাথায় চড়ি,
বাপব্যাটা দুভায়ে মিলে
সারা পাড়া মাথায় করি।
করি তো কার তাতে কী?
আমরা তো সামান্য লোক।
আমাদের ভাতের পাতে
লবণের ব্যবস্থা হোক।
![কবি জয় গোস্বামীর কবিতা 13 জয় গোস্বামী [ Joy Goswami ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/04/জয়-গোস্বামী-Joy-Goswami-44-300x201.jpg)
গাছেদের নাম গাছ
ধুলোদের নাম ধুলো
নদীদের নাম বলতে পারবে গ্রামবাসীরা
কিন্তু ঘরের নাম ঘর দাওয়ার নাম দাওয়া
দাওয়ার ধারে মেয়েটির নাম কী?
তা জানতে হলে তোমাকে নৌকো বাইতে হবে
গুন টানতে হবে
কাঠ কাটতে যেতে হবে বনে
ডাকাতের হাতে পড়তে হবে
বেড়া ডিঙিয়ে পৌঁছতে হবে দাওয়ায়
দাওয়া ডিঙিয়ে ঘরে
ঘরের মধ্যে সে যখন আঁকড়ে নেবে তোমায়
তার ঘূর্ণির মধ্যে তলিয়ে যাওয়া সেই সময়টায়
গাছের উপর আছড়ে পড়বে গাছ
ধূলোর ভেতর থেকে পাকিয়ে উঠবে ধুলিস্তম্ভ
গ্রামের উপর আছড়ে পরবে নদী
তোমার মনে থাকবে না তোমার নাম ছিল পথিক…
আমলকীতলার গন্ধে সার বিষণ্ণতা – জয় গোস্বামী
আমলকীতলার গন্ধে সার বিষণ্ণতা
বেতাল যে-গাছে থাকে সে-গাছের পাতাও নড়ে না
আমলকীতলার গন্ধে শোকপোড়া আলো
বেতাল আকাশপথে জোনাকি কুড়িয়ে হেরে ভূত
মরা মুখ উঠে এল রাতের জানলার বিপরীতে
আমলকীতলার বায়ু, হে ধায়, ঊনপঞ্চাশ দিকে
ধাক্কায় ফেলেছে তাকে জানলা থেকে খাড়া নর্দমায়
মাঝখানে পৃথিবী ঘোরে, সূর্য দাঁতে কামড়ে ঘোরে বায়ু
আমার একাকী মুখে জ্যোতিশ্চক্র বিদ্যুৎ ছেটায়
দ্বিখণ্ডিত করে দিয়ে উদয়অস্তের মধ্যভাগ
রক্ত ও আনন্দমাখা কবি হন পুনর্জাগরিত
পাড়ার লোকের তাতে বিস্ময় কাটে না, গালে হাত
আলোচনা করে তারা: আরে, আরে–কই
এ তো তেমনই বজ্জাত আছে–রোদবৃষ্টি খেয়ে ফেলছে
গাছপালা উড়িয়ে নিচ্ছে আগের মতোই!
![কবি জয় গোস্বামীর কবিতা 15 জয় গোস্বামী [ Joy Goswami ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/04/জয়-গোস্বামী-Joy-Goswami-42-300x172.jpg)
আমলকীতলার নীচে মায়ের হাতের সাদা শাঁখা – জয় গোস্বামী
আমলকীতলার নীচে মায়ের হাতের সাদা শাঁখা
ভেঙে পড়ে আছে–পাশে নতুন ইস্কুল বাড়ি ওঠে
ঘাট থেকে বাড়ি ফিরছে শ্রাদ্ধের একান্নবর্তী দল
পুরাতন স্বামীহারা বেড়া থেকে উঁকি দিয়ে দ্যাখে
নতুন বিধবামূর্তি কার?
গিরগিটি দৌড়য়, সামনে পুরনো বাড়ির হাড়গোড়
মরা গাছ, তারও গায়ে বিষাক্ত পিঁপড়ের সারি নামে
ওখানে শ্মশানে বসল দশ বছর আগে
পথে প’ড়ে বাবলাফুল, ধামা ও কম্বল
আমলকীতলার নীচে আঁকমগ্ন নতুন পড়ুয়া
ঘাসের ওপরে
মায়ের হাতের ভাঙা শাঁখা–
তাতে শুভ্র রোদ্দুর পড়েছে
![কবি জয় গোস্বামীর কবিতা 16 জয় গোস্বামী [ Joy Goswami ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/04/জয়-গোস্বামী-Joy-Goswami-41-300x300.jpg)
আমাকে প্রত্যেকবার কেটে – জয় গোস্বামী
আমাকে প্রত্যেকবার কেটে
পশুরক্ত পাওয়া যাবে–পর্বতচূড়ায়
পা থেকে আমার ধড় উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখলেই
পাখিরা চিৎকার করবে–লাল হবে আকাশ
সমুদ্রের জলে
আমার মহিষমুণ্ড, বেঁকে যাওয়া শিঙ
দেখা দেবে সূর্যের বদলে!

আমার বিদ্যুৎমাত্র আশা – জয় গোস্বামী
আমার বিদ্যুৎমাত্র আশা
তার দিকে, রাত্রি হলে, ধীরে ধীরে মুখ ঘুরিয়েছে
মেঘের পিছনে রাখা পুরোনো কামান
কালো, গোল গলা দিয়ে উঠে আসে অগ্নিরঙ থুতু–
বহুজনে পোড়ানো সম্মান
কে আমার লেখা শোনে? এও রক্তমাখা ভগবান!

আমার মায়ের নাম বাঁকাশশী – জয় গোস্বামী
আমার মায়ের নাম বাঁকাশশী, আমার শ্যামের নাম ছায়া
আমার তরঙ্গ মানে খোলা বাড়ি–ছাদ থেকে যার
নীচে পড়ে হানাহানি খেলা–
আমার সম্পূর্ণ ভুল চারত আকাশ খুঁড়লে বালি
আমার বাবার মুখে পান, গায়ে চাদরে উল্কারা সরে যায়
মা, নীচে, সমুদ্রে খসে পড়ে।

আমার স্বপ্নের পর স্বপ্ন হল আরো বেলা যেতে – জয় গোস্বামী
আমার স্বপ্নের পর স্বপ্ন হল আরো বেলা যেতে
আমাকে ধ্বংসের পর ধ্বংসক্ষেত্রে বর্ণনার শেষে
শান্তি নেমে চলে গেল, মৃতদেহ টপকে টপকে, দূর তেপান্তরে…
তার, গা থেকে স্ফুলিঙ্গ হয়ে তখনও ঝলক দিচ্ছে
রক্ত আর উল্লাসের ছিটে।
দিগন্তে মেঘের কুণ্ড। থেমে থাকা ঝড়…
আমাকে দৃশ্যের পর দৃশ্যের ওপিঠে
এইমতো এঁকে রাখছেন
এক মুণ্ডহীন চিত্রকর!

আমি তো আকাশসত্য গোপন রাখিনি – জয় গোস্বামী
আমি তো আকাশসত্য গোপন রাখিনি
খুলে দ্যাখো পাখির কঙ্কাল।
নীচের প্রান্তরে উড়ত পাখি ও পাখিনী
অনেক উপরে ঢালু বাটির মতন শূন্য ধ’রে
আমি তার ছায়াচিত্র তুলে রাখতাম।
এ দৃশ্য যে দেখেছিল তার মধ্যে থেকে আজ আর
আলো অব্দি বেরোতে পারে না।
সেখানে দিবস রাত্রি নেই, শুধু জমে থাকা
থলথলে অন্ধকার সময় একতাল।
তার চারিদিকে আজ শেষ হয়ে যাওয়া
জ্যোতিষ্ককোটর ভরা ছাই।
আমি দীর্ঘাকার প্রভা নিয়ে
তার বৃত্তপথ থেকে, ধীরে ধীরে, দূরতম শূন্যে সরে যাই…

আর কারো ময়ূর যাবে না – জয় গোস্বামী
আর কারো ময়ূর যাবে না
আমার সম্পূর্ণ খাতা–সাপ
এবার যে ‘দ’ আকার বাজ পড়ে, তাতে
সাপগুলো দগ্ধে পুড়ে ঝলসে এঁকেবেঁকে
জীবন পেয়েছে
ওদের আমি খালে বিলে পাহাড়ে জঙ্গলে
ছেড়ে দিই, ওদেরকে দেখে ময়ুরেরা
ধড়ফড় দৌড়য় আর দেহ থেকে শত শত চোখ
খসে পড়ে
রাত্রিবেলা আমার খাতায়
মাথা তোলে হানাবাড়ি, চাঁদ
দেখি তার ছাদে ও পাঁচিলে
ঝটপট লাফিয়ে উঠছে ওইসব ঝাঁঝরা ময়ূর

ঈশ্বর আর প্রেমিকের সংলাপ – জয় গোস্বামী
– ‘সে যদি তোমাকে অগ্নিতে ফেলে মারে?’
বিনা চেষ্টায় মরে যাব একেবারে
— ‘সে যদি তোমাকে মেঘে দেয় উত্থান?’
বৃষ্টিতে, আমি বৃষ্টিতে খানখান
— ‘সে যদি তোমাকে পিষে করে ধুলোবালি?’
পথ থেকে পথে উড়ে উড়ে যাব খালি
— ‘উড়বে?– আচ্ছা, ছিঁড়ে দেয় যদি পাখা?’
পড়তে পড়তে ধরে নেব ওর শাখা
— ‘যদি শাখা থেকে নীচে ফেলে দেয় তোকে?’
কী আর করব? জড়িয়ে ধরব ওকেই
বলো কী বলব, আদালত, কিছু বলবে কি এরপরও?
— ‘যাও, আজীবন অশান্তি ভোগ করো!’

এই শেষ পায়রা – জয় গোস্বামী
এই শেষ পায়রা। এই শেষ
শান্তির পতাকা। ঘাড়ে পোঁতা। কিন্তু তার
ছুঁচালো লোহার দণ্ড ঘাড়ে ঢুকে থামে না–এগোয়।
খোঁজে শিরদাঁড়া–ইলেকট্রোড।
পায়। ছোঁয়। গর্ত করে
আর দিন চলে যায় শতলক্ষ বছরের পার
তারপর যারা আসে, তারা দেখে বসে আছে
একটু মনুষ্যমূর্তি, কাঁধে পাখি–
দুজনই অঙ্গার!

এবার লক্ষ্মীশ্রী মুছে গেছে
লেগেছে কি তীব্র রূপটান
এইবার পথে বেরোলেই
সকলের চক্ষু টানটান
বাড়ি ফিরে সেই এক সংসার
সেই এক সাধারণ স্বামী
আজ শান্ত, কাল উদাসীন
বই নিয়ে আছে তো আছেই
অভিযোগ করাই বোকামী
অবশ্য মানুষটা ভালোই
নেশা নেই, ঠিক সময়ে ফেরে
অসুখ হলে উতলাও হয়
ছুটি নেয়, সেবা যত্ন করে
আমি ছাড়া অন্যকে জানে না
তাতেই কি সব হয়, বলুন ?
সব কিসে হয় মা জননী ?
বলো সে-কারণগুলি খুঁজি
এই বাড়ি ছাড়া অন্য বাড়ি
গেলে সব পেয়ে যেতে বুঝি ?
সারাদিন সেই এক সংসার
সেই এক জানালা আর ছাদ
কাজের লোকের তদারকি
ন’টাও ও বেরিয়ে গেলেই
সমস্যা ও স্মৃতিকথা-সহ
সেই একই শ্বশুর শাশুড়ি
সে কবে কলেজবেলা ছিল
ছিল কত সাইকেল-যুবক
তাদের ফিরিয়ে দেওয়া ছিল
সুন্দর ফিরিয়ে-দেওয়াগুলি
আজ মনে পড়ে কি পড়ে না
আজ বুঝি কুড়িতেই বুড়ি !
কুড়ি নয় তিনের কোঠায় ।
এইবার ঝরে যাবে ধার—
দিন, বুঝি দিন চলে গেল
চোখ থেকে মুগ্ধতা পাবার ।
কদিন, কয়েকদিন পরে
কেউ যদি না তাকায় আর ?
আজ আরও ছোট হোক চুল
খাটো হোক অঙ্গের বসন
আরো যত্নে মাজা হোক ত্বক
আরো তীব্র বাঁকা হোক ভুরু
এইবার পথে বেরোলেই
কী জিনিস বেরিয়েছে, গুরু !
এইতো লক্ষ্মীশ্রী মুছে গেছে
আজ থেকে জেল্লা মার-মার
আজ থেকে স্বাধীনতা জারি
কাল ছিলে বধুমাতা, আজ
নারীমাংস, নারীমাংস, নারী…
পথে পথে সহস্র পুরুষ
মনে মনে নোংরা করবে তোকে
তাই নিয়ে অবুঝের মতো
গর্ব হবে তোর, হতভাগী
আমি কবি, দুর্বল মানুষ
কী ভাবে বাঁচাব তোকে, ভাবি…

যখন, অসাবধানে, সামান্যই উঠে গেছে শাড়ি—
বাইরে নেমেছে বৃষ্টি। লন্ঠন নামানো আছে টেবিলের নীচে, অন্ধকারে
মাঝে মাঝে ভেসে উঠেছে লুকোনো পায়ের ফর্সা আভা…
অন্যায় চোখের নয়। না তাকিয়ে তার কোনো উপায় ছিল না।
সত্যিই ছিল না? কেন?—হুহু করে বৃষ্টিছাট ঢুকে আসে ঘরে
সত্যিই ছিল না? কেন?—কাঁটাতারে ঝাঁপায় ফুলগাছ
সত্যিই ছিল না? কেন?—অনধিকারীর সামনে থেকে
সমস্ত লুকিয়ে নেয় নকশা-কাটা লেসের ঝালর…
এখন থেমেছে বৃষ্টি। এখন এ-ঘর থেকে উঠে গেছে সেও।
শুধু, ফিরে আসছে হাওয়া। শুধু, এক অক্ষমের চোখের মতন
মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছে টেবিলের তলার লন্ঠন।

একটি শেষমুহূর্তের নারীসিন্ধুতট – জয় গোস্বামী
একটি শেষমুহূর্তের নারীসিন্ধুতট
অন্যটিতে আরম্ভের ডানা ছড়ানো ঈগল
ছোঁ মেরে ওঠে আবার, তার নখে সরীসৃপ
পায়ের গোছে শিকল
একটি শুভ আরম্ভের মাঙ্গলিক ঘট
ঘটের নীচে সাপের চোখ, মণি
বুড়ো আঙুল কেটে দেওয়ার পরেও বাকি থাকে
কলম, তর্জনী
মাটির কান, মাটির নীচে রক্ত চলাচল–
ভূর্গভের হৃদয় নড়ে–ওষ্ঠ? নড়ে তা-ও!
দুঃখ তার কণ্ঠা ক্ষুর দিয়ে
ফাঁক করেছে–খাও

যেভাবে বৃষ্টির জল তোড়ে বয়ে যায়
ঢালুদিকে
সেইভাবে, আমার জীবন
আজ অধোগামী।
সালোয়ার একটু উঁচু ক’রে
তুমি সেই জল ভেঙে ভেঙে রাস্তা পার হয়ে গেলে—
এত যত্নে, সাবধানে, যেন বা জলের গায়ে
আঘাত না লাগে!
পড়ন্ত জীবন শুধু মনে রাখবে অপরূপ চলে যাওয়াটিকে।

ওই কালস্রোত – জয় গোস্বামী
ওই কালস্রোত। আমি
সিমেন্ট বাঁধানো পাড় থেকে
হাত ডোবাই।
আমার আঙুল গলে যায়। কব্জি, বাহু
গলে যায়। ঘাড়ের উপরে মুণ্ডু নিয়ে
আমি হাত-পা-কাটে জগন্নাথ
নদী-নালা আঁকা এক ঘুরন্ত বলের পিঠে
বসে থাকি।
শূন্যে পাক খাই।

ওই যে বাড়ির তীরে কবর ওঠানো তার – জয় গোস্বামী
ওই যে বাড়ির তীরে কবর ওঠানো তার
ছায়াচরে ঘুমে শুরু হই
আমার অতীতকাল জলে ডাক দিলো: ‘ওরে
লগ্নে লগ্নে ফেরী ছেড়ে যায়’
গৃহমুণ্ডে যে-বায়স নুড়িমুখে বসে তার
‘কা’ ধ্বনিতে সকাল অজ্ঞান
খেলনা দুর্গের সামনে যতবার হাবাখেলা
উত্থাপন করি, বাজে টাকা
যতই পালাতে যাই, ছাদ ভেঙে মাথায় পড়ে
ততবার হতভাগ্য যশ
সখার আঙুল শুষে পদ্মিনী খেলেন, ফলে
তুমিও ঝিনুকে ঢুকে খুন
মা বাবার সঙ্গে বসে বশবর্তী এ কবিতা
সকাতরে পড়া অসম্ভব
ওই যে উঠোন থেকে গৃহরক্ত বয়ে আসে
সবার দরজায় কাদা, পা পিছলে আসুন
রাস্তায় পলায়মান ভবিষ্যৎকাল, আর
হাত পায়ে বেড়ি আর পিছনে কুকুর
কালপুরুষের কাঁধে উড়ে বসে কাক, সেও
তারা ফেলে ফেলে ভরছে ব্রহ্মাণ্ড কলস
ওই যে ছায়ার তীরে শোয়ানো কবর, তার
বাড়ি-তীরে বালি ঝুরঝুর
পূর্বের আকাশ, মত্ত, পাশে এসে দাঁড়ালেন
ও আমার ভয় ভেঙে চুর

ওরা ভস্মমুখ – জয় গোস্বামী
ওরা ভস্মমুখ। ওরা নির্বাপিত। ওরা
ধূম্রনাসা কাঠ
অনেক পাঁকের নীচে আধপোড়া কাঠ হয়ে ওরা
পালিয়ে ঘুরেছে কতক্ষণ।
এক একটি ক্ষণের সঙ্গে এক এক শতক পার হল
এখন আমার কাজ ওদের বিছানাগুলি খোঁড়া
ওদের সযত্নে শুইয়ে গায়ে চাপা দেওয়া
চাদর কম্বল নয়–মাটি
ওরা মা বাবার মতো। ওদের অস্থি-র খোঁজ পেতে
শত শত গোর গর্ত বাঙ্কার ফক্স-হোল খুঁড়ে খুঁড়ে
তাই এত ক্রোধ কান্না শোক ভস্ম ঘাঁটি।

কখনো চোখের জল – জয় গোস্বামী
কখনো চোখের জল ফেলতে নেই ভাতের থালায়
তাহলে সে-জল গিয়ে শ্রীভগবানের হাতে পড়ে
হাতে ফোস্কা পড়ে যায়, তিনিও তো খেতে বসেছেন
তাঁর সেদিন খাওয়া হয় না। তিন দিন হাতেব্যথা থাকে।
শ্রমভাগ্যে যা এসেছে দুমুঠো চারমুঠো তাতে খুশি থাকতে হয়
খুশি যদি না-ও থাকি তবুও ভাতের সামনে বসে
অন্তত ভাতের সামনে বসে আর অভিযোগ করতেনেই তাঁকে
এ কথাটা কতবার, কতভাবে বলেছি, তোমাকে?
তুমি তা শোনোনি আর আমিও শুনি না-দিন যায় ….
খেতে বসি, দায়ী করি, দোষ ধরি পরস্পর, অশ্রু পড়ে
ভাতের থালায়

কবিকন্যা – জয় গোস্বামী
শক্তির মেয়ের সঙ্গে প্রেম করব স্বপ্ন ছিল যুবক বয়সে
শ্রোতার আসনে বসে মঞ্চে দেখা শক্তিকে দু’বার।
কন্যাটিকে একবারও নয়।
তবু ইচ্ছে,ইচ্ছে-সার,মন গাছের গোড়ায় ঢাললেই
ফুল ফুটতে দেরির কী আছে!
শক্তিদা বলার মতো সম্পর্ক যখন হল তখনও কবিকে সীমাহীন
দূরের সম্ভ্রমে রাখি।ভালোবাসি আরো সীমাহারা।
কর্মসূত্রে যে-সাক্ষাৎ,তাকে রেখে আসি কর্মস্থলে।
বাড়িতে একবার যাওয়া, জন্মদিন ভিড়ে সরগরম।
শুনেছি কন্যাটি পড়ছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে।
দু’বার যাদবপুরে তার আগেই মুখ পুড়িয়েছি
অতএব ওদিকে না… অনত্র সন্ধান করা ভাল…
দেখলাম একবার মাত্র।শেষযাত্রা চলেছে কবির…
ফুল ভরতি লরির ওপরে
ফাল্গুনের হেলে পড়া রোদ সে-দুহিতা
হাত দিয়ে আড়াল করছে বাবার মুখের সামনে থেকে…
সেই দেখা শ্রেষ্ঠ দেখা।শোকার্ত মুখটিও মনে নেই।
মনে আছে হাতখানি।জগতের সকল কবির
কন্যা সে-ই – সকলের আঘাত, বিপদ
আটকায় সে-হাতপাখা-আজ বুকুনেরই মুখে
শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের আত্মজাকে দেখতে পাই-
যখন বুকুন ওড়না দিয়ে
ট্যাক্সির জানলায় আসা রোদ থেকে আমাকে বাঁচায়।

কলঙ্ক, আমি কাজলের – জয় গোস্বামী
কলঙ্ক, আমি কাজলের ঘরে থাকি
কাজল আমাকে বলে সমস্ত কথা
কলঙ্ক, আমি চোট লেগে যাওয়া পাখি—
বুঝি না অবৈধতা।
কলঙ্ক, আমি বন্ধুর বিশ্বাসে
রাখি একমুঠো ছাই, নিরুপায় ছাই
আমি অন্যের নিঃশ্বাস চুরি ক’রে
সে-নিঃশ্বাসে কি নিজেকে বাঁচাতে চাই?
কলঙ্ক, আমি রামধনু জুড়ে জুড়ে
দিন কাটাতাম, তাই রাত কাটতো না
আজ দিন রাত একাকার মিশে গিয়ে
চিরজ্বলন্ত সোনা
কলঙ্ক, তুমি প্রদীপ দেখেছো? আর প্রদীপের বাটি?
জানো টলটল করে সে আমার বন্ধুর দুই চোখে?
আমি ও কাজল সন্তান তার, বন্ধুরা জল মাটি
ফিরেও দেখি না পথে পড়ে থাকা
বৈধ-অবৈধকে—
যে যার মতন রোদবৃষ্টিতে হাঁটি…

কাঠের ছাগল আর কাঠের মহিষ – জয় গোস্বামী
কাঠের ছাগল আর কাঠের মহিষ–জ্যান্ত হল।
খটখট লাফাঝাঁপি, খাট ও টেবিল ঘিরে বাঁধ–
মুখ নিচু ক’রে ওরা মেঝেতে স্ফুলিঙ্গ পান করে
পা নামাই খাট থেকে–মোজাইকে সূর্য দেখা দেয়
রক্তাভ কটাহে দু পা, ক্রুশে বেঁধা দুটি হাতে ডানার ফোয়ারা
আমি, জানলা দিয়ে বেরিয়ে এলাম
নীচে দূর মর্ত্যলোকে–কাঠের মহিষ, ঘোড়া, কাঠের মেষকূল
তাদের পায়ের নীচে ঘূর্ণমান–রক্তবর্ণ লোহার প্রান্তর

কিন্তু আগুনের মধ্যে গিয়ে দাঁড়াবার কথাটা মনে থাকে যেন – জয় গোস্বামী
কিন্তু আগুনের মধ্যে গিয়ে দাঁড়াবার কথাটা মনে থাকে যেন!
মাটি ফেটে তলিয়ে যাবার কথাটা
যেন মনে থাকে ভূমিকম্পের ফাটল থেকে হাত বেরিয়ে আসা
আর মরুভূমিতে দাঁড়িয়ে, ডিঙি মেরে,
সূর্যের পেটে মুখ ঢুকিয়ে দেওয়া
কয়েক যুগ পরে, সূর্য নিভে আকাশ থেকে খসে পড়ল যখন
তখন, আর কিছু না পেয়ে, খিদের চোটে, পরস্পরকে
খেয়ে নিশ্চিহ্ন করে ফেলবার কথাটাও মনে থাকে যেন…

কী দুর্গম চাঁদ তোর নৌকার কিনারে গেঁথে আছে – জয় গোস্বামী
কী দুর্গম চাঁদ তোর নৌকার কিনারে গেঁথে আছে!
অন্যদিকে কী সুন্দর মাঝি!
যার মুখ কঙ্কালের, যার বাহু জং-ধরা লোহার।
বল্, তোর মাঝিকে বল্, শুরু করতে লৌহের প্রহার।
অত যে দুর্মূল্য চাঁদ, সেও তো সুলভে ভাঙতে রাজি!
খণ্ডে খণ্ডে জলে পড়ছে, জল ছিটকে উঠছে দূরে কাছে…
বল তোর ইচ্ছে হয় না সেই দৃশ্যে দাঁড়াতে আবার
ওই উল্কাগুলি খেতে জলরাশি সরিয়ে যখন
রাক্ষুসে মাছের মুখ ভেসে উঠবে জলদেবতার?

কীভাবে এলাম এই শহরে – জয় গোস্বামী
কীভাবে এলাম এই শহরে, সে মস্ত ইতিহাস!
হামাগুড়ি দিয়ে আর ট্রেনের পিছনে ট্রেন ধরে
রেললাইনে হাতেপায়ে তালা ও শিকল বেঁধে শুয়ে
ট্রেন এসে পড়ামাত্র চক্ষের নিমিষে ড্রাইভারের
কেবিনের জানলা দিয়ে জনতার প্রতি হাত নেড়ে
টুপির ভেতর থেকে পায়রা খরগোশ ধরে, ছেড়ে,
মাথার এদিক দিয়ে রড ঢুকিয়ে ওদিকে বার করে
সম্মোহন করে নিজ সহকারিণীকে বাক্সে ভরে
সে-বাক্সের চারদিকে ঢুকিয়ে ষোলোটা তরোয়াল
টুং টাং লাইটার জ্বেলে বাক্সটি পুড়িয়ে ছাই করে
উড়ো মন্ত্র বলতে বলতে নেমে গিয়ে নিজে সে-মেয়েকে
দর্শক আসন থেকে বাহু ধরে মঞ্চে তুলে এনে
ম্যাজিকে প্রমাণ করে আমি হচ্ছি পয়লা নম্বর
তবেই শেষমেষ ডেকে জায়গা দিল আমাকে, শহর।
এখন ম্যাজিকই ধ্যান, জ্ঞান, বুদ্ধি, বাঁচামরা পেশা
ভোর থেকে হাতসাফাই, নিজের জিভ কেটে জোড়া দেওয়া
সন্ধ্যায় হাজির হওয়া মঞ্চে মঞ্চে ভরাভর্তি শো-এ
রাত্রিবেলা বাড়ি আসা ধুঁকে ধুঁকে করতালি সয়ে
ভোর থেকে প্র্যাকটিস শুরু, প্রত্যহ দাঁত দিয়ে ওই
কামড়ানো বুলেটে ধরা প্রাণ
একবার ফসকালে শেষ, মনে রেখো, ও ম্যাজিশিয়ান!

কূর্ম চলেছেন – জয় গোস্বামী
কূর্ম চলেছেন। তাঁর পিঠ থেকে হঠাৎ
পৃথিবী গড়িয়ে পড়ে যায়
শূন্যে সে-গোলক ধরতে, ঘুম ভেঙে, শশক লাফায়
আকাশ ঝকঝক করে ওঠে
শ্বেতশুভ্র একটি উল্কায়

কে বেশি কে কম – জয় গোস্বামী
চিনতে পেরে গেছে বলে যার জিভ
কেটে নিল ধর্ষণের পরে
দু’হাতে দু’টো পা ধরে
ছিঁড়ে ফেললো যার শিশুটিকে
ঘাড়ে দু’টো কোপ মেরে যার স্বামীকে
ফেলে রাখলো উঠোনের পাশে
মরা অবধি মুখে জল দিতে দিল না
সেই সব মেয়েদের ভেতরে
যে-শোকাগ্নি জ্বলছে
সেই আগুনের পাশে
এনে রাখো গুলির অর্ডার দেওয়া
শাসকের দু’ঘন্টা বিষাদ
তারপর মেপে দ্যাখো
কে বেশি কে কম
তারপর ভেবে দেখ
কারা বলেছিল
জীবন নরক করব, প্রয়োজনে
প্রাণে মারব, প্রাণে!
এই ব’লে ময়ূর আজ
মুখে রক্ত তুলে
নেচে যায় শ্মশানে শ্মশানে
আর সেই নৃত্য থেকে দিকে দিকে
ছিটকে পড়ে জ্বলন্ত পেখম |

ক্ষুধার শেষ ক্লান্তি, ক্ষার, ঘুমের শেষ জল – জয় গোস্বামী
ক্ষুধার শেষ ক্লান্তি, ক্ষার, ঘুমের শেষ জল–
যুদ্ধ, শেষ-খেলা
শেষরক্ত আকাশে পড়ে–রক্ত খেয়ে খেয়ে
সূর্য লাল ঢেলা
গোলায় পোড়া শহর, গাছ, পতাকা দিয়ে ঢাকা–
বিকেলবেলা কামানে নীল রঙ
সারাদিনের শিকার শেষ–আকাশে বেরিয়েছে
বেলুন হাতে, দেবদূতের সঙ।

গাছের জন্মান্ধ – জয় গোস্বামী
গাছের জন্মান্ধ।
দীপ, জন্ম থেকে গাছ।
দীপজন্মে যাই আমি–চোখ বাঁধা–
মাথায় শিখার তীব্র নাচ।

ঘরে রাধাবিনোদ আকাশ – জয় গোস্বামী
ঘরে রাধাবিনোদ আকাশ
ঝুলনের চাঁদটি মেঝেতে
বিছানার পাশের লণ্ঠন
তার শুধু চক্ষু দপ্দপ্
অমাবস্যা পূর্ণিমা সড়ক
ফালাফালা ক’রে সারারাত
সে খুঁজে বেড়াচ্ছে একফালি
কবিতা লেখার যোগ্য শব!

ছাই – জয় গোস্বামী
ফাল্গুনের ক্ষত, যাও, অন্ধকারে পায়ে কুশ ফুটে
তারা চিনে চিনে ফিরে এসো । এরপর ক্ষুদ্ধ হিম
শুরু হয়ে যাবে এই শুয়ে থাকো পুরনো মরুতে ।
সারারাত্রি জেগে তুমি তৈরি করে নেবে না পিদিম ?
কারো পা তীরের বালি মাড়িয়ে দৌড়েছে, আজ এই জলে তার
একগাছি চুলও যদি ভেসে থাকে নেমে তাই ধরে ধরে
তলায় সবুজ দেশ কাকে বলে ‘ছোটকাকী ফিরে এসো ঘরে ?’
কপালে জ্বলন্ত টিকলি, প্রায় সব খুলে রেখে লুকিয়ে সাঁতার
সেও তো দিয়েছে আর তেমনই লুকিয়ে তুমি ওই শিরীষের
ফাঁক দিয়ে দেখেছিলে সোনামাছ । চলে গেছে বেড়া গায়ে গায়ে
ফাল্গুনের ক্ষত যাও অন্ধকারে কুশ ফুটে পায়ে
ফিরে এসো ; তারা চিনে চিনে দিন ঠিক করো মাঘের তিরিশে
বন্যা বেশি হলে তুমি সেই কবে জেলে নৌকো ও-বাড়ির গেটে
বেঁধে দিয়ে এসেছিলে ? মনে করবার আগে দূর থেকে চিতা
নদীর ওপারে একা জ্বলে ওঠে । শুকনো পিণ্ডের দলা চেটে
পালায় শৃগাল । তুমি চাইছো যে পিদিম আমি তৈরি করেছি তা ।
বলো কে তীরের বালি মাড়িয়ে দৌড়েছে কবে চুলে তার মেখে দিলে বালি ?
পা কিছু পাচ্ছে না, শুধু ঘোলা জল ঘোলা জল, পালাবার সমস্ত প্রণালী
বাইরে ফেলে রেখে এসে দেখি আমি, ঘরে নেই কনে !
শয্যায় জ্বলন্ত টিকলি, অন্য কোণে ফুলের মুকুটে
সামান্য সিঁদুর চিহ্ন । তবে এতদূর নামা ভুল ? এই রাতে তীরে উঠে
তারা দেখে দেখে তাকে খুঁজে দেখো । নয়তো হঠাৎ কি কারণে
হিম শুরু হয়ে যাবে বুঝতেও পারবে না । এই মরুর পুরনো
খসখসে বাতাস এসে জানাচ্ছে এখন সেই ট্রাইসাইকেল
ষোল বাই দুই ডি-তে এ-ঘরে ও-ঘর বেড়াতো যে-ছেলে
ভাইকে পা ধরে তুলত জলভর্তি ড্রাম থেকে, তার কথা শোনো
আজ এই ফাল্গুনরাতে । কী শুনবে ? দূরে কলাবাগানের ধারে
লাল ফ্ল্যাগ নীল ফ্ল্যাগ রুবি ঘোষ ভিকট্রিস্ট্যান্ডে এসো । ওই পারে
শ্মশানে ঘুমোচ্ছে লোক, চিতা নেই । এখন নদীর মধ্যে নামা
উচিত হবে না, তবু উঁচু থেকে দেখা যাবে জলের তলায় মোরগেরা–
তাদের ঠ্যাং বাঁধা, গলা উড়ে গেছে । নিচু ক্লাসে মেয়েটির সাথে
তখন সে পোড়াত বাজি, আর কিছুদূরে উঁচু অন্ধকার জেল
ককিয়ে উঠতো রাত্রে, এই কথা বুঝিয়ে, যে, এরা
নিশ্বাস নেবে না আর । সেই সব দিনেই তো মেয়েটির মুখের ঘামতেল
জ্বলেছে লজ্জায়, তুমি সামনে এলে । পাশাপাশি দেখতে না লাফানো শকুন
দিনের বেলা ছিঁড়ে নিতো ছেলেদের শব থেকে মাংস আর জামা ?
সে-সব ক্ষতেরা নেই । শুধু দাগ খাঁ খাঁ করছে চারদিকের রাতে ।
মাঠে আসলাম তার কারণ, এইবার তৈরী করেছি পিদিম ।
এবার দেহের চর্বি ঢেলে দিই ওতে । যতটুকু দাহ্যগুণ
এখনো রয়েছে তাও ওই মৃত জ্বলে মেশবার
আগেই দেশলাই জ্বেলে ধরিয়ে দি রক্ত হাড় চর্বি শেষবার…
পরে যত খুশী ছাই মরুতে উড়ুক, আমি সেটা নিয়ে ভাবছি না হিম ।

ছাদে জড়ভরত সন্তান – জয় গোস্বামী
ছাদে জড়ভরত সন্তান। তার গলা
লম্বা হয়ে জল খেতে যায়
দূরের পুকুরে
রাস্তায়, বাদাড়ে নিশি থেকে থেকে ডাকে
শেষরাত্রে, মেঘের আলপথে
একটি কঙ্কাল ফেরিওয়ালা
হেঁকে যায়: চাই, দই চাই…
ছাদে জড়ভরত সন্তান, তার
খটখটে তেষ্টায় সঙ্গ দিতে
পুকুরে মুখ দিয়ে আমি খাই–
জলের বদলে রক্ত–খাই…

জগতে আনন্দযজ্ঞে – জয় গোস্বামী
জগতে আনন্দযজ্ঞে
পেয়েছি হাত সাফাইয়ের হাত
মিলেছি চোর সাধু ডাকাত
পেয়েছি হাত সাফাইয়ের হাত
জগতে আনন্দযজ্ঞে
জেনেছি নাচন কোঁদন সার
কিছুতেই টলবে না সংসার
কিছুতেই টলবে না সংসার
জগতে আনন্দযজ্ঞে
রাখিনি গুড় গুড় ঢাক ঢাক
আমরা ভাত ছড়ালেই কাক
আমরা ভাত ছড়ালেই কাক
জগতে আনন্দযজ্ঞে
যেখানে যা রাখবি তা রাখ
আমরা চিচিং চিচিং ফাঁক
আমরা চিচিং চিচিং ফাঁক
আমাদের যা ইচ্ছে হোক গে
জগতে আনন্দযজ্ঞে
আমরা সব হারানো লোক
আকাশে ভাসিয়ে দিলাম চোখ
সাগরে ভাসিয়ে দিলাম চোখ
যা রে যা চোখ ভেসে যা দূর
আমার দূরের পলাশপুর
যেখানে বাংলাদেশের মন
ঘুমোলো মা-হারা ভাই বোন
যেখানে সাত কাকে দাঁড় বায়
সুরের ময়ূরপঙ্খী না’য়
যেখানে হাওয়ায় হাওয়ায় ডাকে
ও গান মালঞ্চী কন্যাকে
মাধব মালঞ্চী কন্যাকে
ও তারে উড়িয়ে নিলো পাখা
ও তার বৃষ্টিতে মুখ ঢাকা
অঝোর বৃষ্টিতে মুখ ঢাকা
তখন ভেসেছে নৌকাটি
হাওয়ায় ভেসেছে নৌকাটি
তলায় বাংলাদেশের মাটি
মাটিতে আমরা কয়েকজন
আমরাই নির্ধনীয়ার ধন
পেয়েছি রাজকুমারীর মন
আরে যা রাজকুমারীর মন
জানি না থাকবে কতক্ষণ
নাকি সে যাবে বিসর্জন
ও ঠাকুর যাবে বিসর্জন
ও ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ ?

জননী এই আঙিনা – জয় গোস্বামী
জননী এই আঙিনা–আজ
শরীর বটচারা
বাতাস পথবালক, আর
মেয়েটি লণ্ঠন!

জল থেকে ডাঙায় উঠে ওরা – জয় গোস্বামী
জল থেকে ডাঙায় উঠে ওরা
পালিয়ে চলেছে আজীবন
এক যুগ থেকে অন্য যুগে
উড়ে আসে ক্ষেপনাস্ত্র, তীর
ছেলে বউ মেয়ে বুড়ো জননী ও শিশু কোলাহল
দাউদাউ উদ্ধাস্তু শিবির

জলহাওয়ার লেখা – জয় গোস্বামী
স্নেহসবুজ দিন
তোমার কাছে ঋণ
বৃষ্টিভেজা ভোর
মুখ দেখেছি তোর
মুখের পাশে আলো
ও মেয়ে তুই ভালো
আলোর পাশে আকাশ
আমার দিকে তাকা–
তাকাই যদি চোখ
একটি দীঘি হোক
যে-দীঘি জ্যোৎস্নায়
হরিণ হয়ে যায়
হরিণদের কথা
জানুক নীরবতা–
নীরব কোথায় থাকে
জলের বাঁকে বাঁকে
জলের দোষ? — নাতো!
হাওয়ায় হাত পাতো!
হাওয়ার খেলা? সেকি!
মাটির থেকে দেখি!
মাটিরই গুণ? — হবে!
কাছে আসুক তবে!
কাছে কোথায়? — দূর!
নদী সমুদ্দুর
সমুদ্র তো নোনা
ছুঁয়েও দেখবো না
ছুঁতে পারিস নদী–
শুকিয়ে যায় যদি?
শুকিয়ে গেলে বালি
বালিতে জল ঢালি
সেই জলের ধারা
ভাসিয়ে নেবে পাড়া
পাড়ার পরে গ্রাম
বেড়াতে গেছিলাম
গ্রামের কাছে কাছে
নদীই শুইয়ে আছে
নদীর নিচে সোনা
ঝিকোয় বালুকণা
সোনা খুঁজতে এসে
ডুবে মরবি শেষে
বেশ, ডুবিয়ে দিক
ভেসে উঠবো ঠিক
ভেসে কোথায় যাবো?
নতুন ডানা পাবো
নামটি দেবো তার
সোনার ধান, আর
বলবোঃ শোন, এই
কষ্ট দিতে নেই
আছে নতুন হাওয়া
তোমার কাছে যাওয়া
আরো সহজ হবে
কত সহজ হবে
ভালোবাসবে তবে? বলো
কবে ভালোবাসবে?

জানি যে আমাকে তুমি – জয় গোস্বামী
জানি যে আমাকে তুমি ঘৃণা করো, মেয়েদের ঘৃণা
যেখানে যেখানে পড়ে সে জায়গাটা কালো হয়ে যায়
নতুন অঙ্কুর উঠে দাঁড়াতে পারে না সোজা হয়ে
তোমার ঘেন্নার ভয়ে পালাতে পালাতে আমি এই
দিগন্তে শুয়েছি, সামনে সভ্যতা পর্যন্ত পড়ে থাকা
যতটা শরীর, তার কোথাও এক কণা শস্য নেই
শুধু কালো কালো দাগ পোড়া শক্ত ঝামা গুঁড়োমাটি
তাও তুমি আকাশপথে জলপথে বৃষ্টিপথে এসে
মুখে যে নিঃশ্বাস ফেলছ, না তাতে আবেশ, যৌনজ্বর
নেই, শান্ত ঘুম নেই—সে নিঃশ্বাসে কিছু নেই আর
তার শুধু ক্ষমতা আছে প্রেমিককে বন্ধ্যা করবার!

জ্বলতে জ্বলতে পাখি পড়ছে – জয় গোস্বামী
জ্বলতে জ্বলতে পাখি পড়ছে
জ্বলে ‘ছ্যাৎ’ আওয়াজে আমার
ঘুম ভাঙে
কোটি কোটি যুগ পরেকার
ঘুম,
যার মাথার ওপরে
হা করা আকাশগর্ত, লৌহমেঘ, আর
তার নিচে, ঘুরতে ঘুরতে, ক্রমশ তলিয়ে যাওয়া পৃথিবীর নিঃশব্দ চিৎকার।

ঝাউ গাছের পাতা – জয় গোস্বামী
মিত্রা দিদি, তোমাকে নিয়ে কাব্য
লেখেনি কোন পুরুষ কোন দিন।
গলির মোড়ে বাজেনি সম্মিলিত
শীৎকার, বখাটে ছেলেদের।
তোমাকে দেখতে আসেনি পাত্রপক্ষ,
এসেছিল শুধু মেপে নিতে,
তোমার বুক, চুল, নিতম্ব
যাবতীয় সব শারিরিক।
কত বার গেছ তুমি কামরূপ-কামাক্ষা ?
কত বার ছুঁয়েছ তুমি কাম পীঠে সিঁদুর ?
কত বার পাল্টেছ জ্যোতিষি তুমি ?
কত বার করিয়েছ জাদুটোনা ?
কত যুগ উপবাসী তুমি ঢেলেছ দুগ্ধ,
সুগঠিত শিবলিঙ্গে ?
সে খবর জানে শুধু,
একলা রাতের পাশ বালিশ।

টিউটোরিয়াল – জয় গোস্বামী
”তোমাকে পেতেই হবে শতকরা অন্তত নব্বই (বা নব্বইয়ের বেশি)
তোমাকে হতেই হবে একদম প্রথম
তার বদলে মাত্র পঁচাশি!
পাঁচটা নম্বর কম কেন? কেন কম?
এই জন্য আমি রোজ মুখে রক্ত তুলে খেটে আসি?
এই জন্যে তোমার মা কাক ভোরে উঠে সব কাজকর্ম সেরে
ছোটবেলা থেকে যেতো তোমাকে ইস্কুলে পৌঁছে দিতে?
এই জন্য কাঠফাটা রোদ্দুরে কি প্যাচপ্যাচে বর্ষায়
সারাদিন বসে থাকতো বাড়ির রোয়াকে কিংবা পার্কের বেঞ্চিতে?
তারপর ছুটি হতে, ভিড় বাঁচাতে মিনিবাস ছেড়ে
অটো-অলাদের ঐ খারাপ মেজাজ সহ্য করে
বাড়ি এসে, না হাঁপিয়ে, আবার তোমার পড়া নিয়ে
বসে পড়তো, যতক্ষণ না আমি বাড়ি ফিরে
তোমার হোমটাস্ক দেখছি, তারপরে আঁচলে মুখ মুছে
ঢুলতো গিয়ে ভ্যাপসা রান্নাঘরে?
এই জন্যে? এই জন্যে হাড়ভাঙা ওভারটাইম করে
তোমার জন্য আন্টি রাখতাম?
মোটা মাইনে, ভদ্রতার চা-জলখাবার
হপ্তায় তিনদিন, তাতে কত খরচা হয় রে রাস্কেল?
বুদ্ধি আছে সে হিসেব করবার?
শুধু ছোটকালে নয়, এখনো যে টিউটোরিয়ালে
পাঠিয়েছি, জানিস না, কিরকম খরচাপাতি তার?
ওখানে একবার ঢুকলে সবাই প্রথম হয়। প্রথম, প্রথম!
কারো অধিকার নেই দ্বিতীয় হওয়ার।
রোজ যে যাস, দেখিস না কত সব বড় বড়
বাড়ি ও পাড়ায়
কত সব গাড়ি আসে, কত বড় গাড়ি করে
বাবা মা-রা ছেলেমেয়েদের নিতে যায়?
আর ঐ গাড়ির পাশে, পাশে না পিছনে-
ঐ অন্ধকারটায়
রোজ দাঁড়াতে দেখিস না নিজের বাবাকে?
হাতে অফিসের ব্যাগ, গোপন টিফিন বাক্স, ঘেমো জামা, ভাঙা মুখ –
দেখতে পাসনা? মন কোথায় থাকে?
ঐ মেয়েগুলোর দিকে? যারা তোর সঙ্গে পড়তে আসে?
ওরা তোকে পাত্তা দেবে? ভুলেও ভাবিস না!
ওরা কত বড়লোক!
তোকে পাত্তা পেতে হলে থাকতে হবে বিদেশে, ফরেনে
এন আর আই হতে হবে! এন আর আই, এন আর আই!
তবেই ম্যাজিক দেখবি
কবিসাহিত্যিক থেকে মন্ত্রী অব্দি একডাকে চেনে
আমাদেরও নিয়ে যাবি, তোর মাকে, আমাকে
মাঝে মাঝে রাখবি নিজের কাছে এনে
তার জন্য প্রথম হওয়া দরকার প্রথমে
তাহলেই ছবি ছাপবে খবর কাগজ
আরো দরজা খুলে যাবে, আরো পাঁচ আরো পাঁচ
আরো আরো পাঁচ
পাঁচ পাঁচ করেই বাড়বে, অন্য দিকে মন দিস না,
বাঁচবি তো বাঁচার মত বাঁচ!
না বাপী না, না না বাপী, আমি মন দিই না কোনোদিকে
না বাপী না, না না আমি তাকাই না মেয়েদের দিকে
ওরা তো পাশেই বসে, কেমন সুগন্ধ আসে, কথা বলে, না না বাপী পড়ার কথাই
দেখি না, উত্তর দিই, নোট দিই নোট নিই
যেতে আসতে পথে ঘাটে
কত ছেলে মেয়ে গল্প করে
না বাপী না, আমি মেয়েদের সঙ্গে মিশতে যাই না কখোনো
যেতে আসতে দেখতে পাই কাদা মেখে কত ছেলে বল খেলছে মাঠে
কত সব দুষ্টু ছেলে পার্কে প্রজাপতি ধরছে
চাকা বা ডাঙ্গুলি খেলছে কত ছোটোলোক
না, আমি খেলতে যাই না কখোনো
খেলতে যাইনি। না আমার বন্ধু নেই
না বাপী না, একজন আছে, অপু, একক্লাসে পড়ে
ও বলে যে ওর বাবাও বলেছে প্রথম হতে
বলেছে, কাগজে ছবি, ওর বাবা, ওকে ….
হ্যাঁ বাপী হ্যা, না না বাপী, অপু বলেছে পড়াশোনা হয়নি একদম
বলেছে ও ব্যাক পাবে, ব্যাক পেলে ও বলেছে, বাড়িতে কোথায়
বাথরুম সাফ করার অ্যাসিড আছে ও জানে,
হ্যাঁ বাপী হ্যা, ও বলেছে,
উঠে যাবে কাগজের প্রথম পাতায় …..”

ঢেউগুচ্ছ – জয় গোস্বামী
আমাদের নীল মৃত্যুকাল
আমাদের সাদা সন্তরণ
আমাদের ঢেউগুচ্ছ
আমাদের এই নিচু জীবন
জলে ফেলে দেওয়া শান্ত ঢিল
ক্ষমাশীল ঢেউগুচ্ছ
গায়ে গায়ে ঘষা কালো জীবন
হাতে মুখে হাতে মেখে নেওয়া
ঈর্ষার কাঁচা রক্ত
আমাদের এই আলোজীবন
কারো কাছে কিছু নেবে না আর
জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শান্তি
আমাদের এই ভাঙা জীবন
পড়োশীর ঘর আলো করা
কচিকাঁচাদের দঙ্গল
আমাদের এই নীল মৃত্যুযান
আমাদের সাদা সন্তরণ
টেনে নেয় ঢেউগুচ্ছ
আমাদের এই চিরজীবন
মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে তুলে আনা
বন্ধুর মতো বন্ধু

তমসা, আমার সীমা জল – জয় গোস্বামী
তমসা, আমার সীমা জল
জলের উপরকার চরে
একদিন বসেছিল পৃথিবীর মতো ভারী পাখি
ভূমিতলপিণ্ড তার চাপ
এতদিনে গলিয়ে দিয়েছে
যা গলেনি
ভূমির সমান ভারী পাপ
তার নীচে চাপা পড়ে আছে
নখচঞ্চুপালকের ধ্বংস অবশেষ
তমসা, আমার সীমাতীরে
এখন অরণ্যকূল, শান্ত গৃহসারি
স্নান আর কলহাস্য, নৌকা আর সাঁতারুর ঝাঁপ
যাদের অজ্ঞাতসারে রাত্রে মাঝে মাঝে জ্বলে ওঠে
আমার পিঠের বালি-কাদায় তারকাচিহ্ন–
দানবপক্ষীর পদচ্ছাপ!

তাত লেগে চোখ খুলল – জয় গোস্বামী
তাত লেগে চোখ খুলল। বালিস্তর ঠেলে
বেরিয়ে এলাম। পাহাড় তুষারহীন
গাছেরা দণ্ডায়মান কাঠ
জনপদ লোহা ইট কংক্রিটের কালো স্তূপ মাটি
ফ্যাকাসে হলদেটে সূর্য বিরাট চাকার মতো ছড়িয়ে রয়েছে
৭০০ কোটি বছরের পরের আকাশে
সমস্ত জ্বালানি পুড়ে শেষ।
বালির সমুদ্রখাতে আমি হাত জোড় করে দাঁড়াই
আমার কপালে এসো, ঝরে পড়ো,
রৌদ্র নয়–সূর্য-পোড়া ছাই!
![কবি জয় গোস্বামীর কবিতা 3 জয় গোস্বামী [ Joy Goswami ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/04/জয়-গোস্বামী-Joy-Goswami-6-300x201.jpg)
তারাখণ্ড সমুদ্রে পড়েছে – জয় গোস্বামী
তারাখণ্ড সমুদ্রে পড়েছে
তার আগে আকাশে লম্বা আগুনের ল্যাজ–একপলক
তার আগে ঝলকে সাদা গাছপালা ভূখণ্ড পাহাড়–একপলক
উড়তে উড়তে ফ্রিজ করছে সরীসৃপ পাখি
পৃথিবী ধ্বংসের ঠিক একপলক দেরি
মৃত্যুর আগের স্বপ্নে এই দৃশ্য ফিরে আসে, সেই থেকে, সব পাখিদেরই
![কবি জয় গোস্বামীর কবিতা 2 জয় গোস্বামী [ Joy Goswami ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/04/জয়-গোস্বামী-Joy-Goswami-57-300x169.jpg)
তুমি আর তোমার ক্যাডার – জয় গোস্বামী
১
দলে দলে মোটর বাইকে ঢুকে পড়ে
কারা ঢুকে পড়ে ভোর বেলা
কারা ঢুকে পড়ে
জানা যায় না
কিন্তু তারই পরে
এ গ্রামে, ও গ্রামে, ঘরে ঘরে
অবাধে কৃষক-রক্ত ঝরে
জাগ্রত কৃষক রক্ত ঝরে
২
অস্ত্র প্রয়োগের অধিকারী
তুমি আর তোমার ক্যাডার
আমরা শুধু খুন হতে পারি
মুখ বুজে খুন হতে পারি
এই একমাত্র অধ
![কবি জয় গোস্বামীর কবিতা 58 জয় গোস্বামী [ Joy Goswami ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/04/জয়-গোস্বামী-Joy-Goswami-56-294x300.jpg)
তুমি কি বিশ্বাসহন্তা – জয় গোস্বামী
তুমি কি বিশ্বাসহন্তা? না, তুমি বিশ্বাসী?
তোমার পিছনে ঘুরছে জাঁতা ও আগুনচক্র
তোমার সম্মুখে উড়ছে সোনার পতঙ্গ আর ডানামেলা বাঁশি…
মাঝখানে অশ্বত্থগাছ। মাঝখানে দড়ি আর ফাঁসি।
![কবি জয় গোস্বামীর কবিতা 4 জয় গোস্বামী [ Joy Goswami ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/04/জয়-গোস্বামী-Joy-Goswami-55-195x300.jpg)
তোমাকে কাদার মধ্যে কাদাপাখি মনে করলাম – জয় গোস্বামী
তোমাকে কাদার মধ্যে কাদাপাখি মনে করলাম।
মাছ খুঁজছ? লম্বা সরু ঠোঁট দিয়ে আমার
খাবার জোগাড় করছ বুঝি?
ওগো ও জননী পাখি, আমি স্বপ্নে ডাকি
তোমার মা নাম
তোমার জরায়ু-কলসী এখন তো শুকনো, শুধু বালিমাটি ভরা
বুড়ি, তবু আমাকে একবার, হাত পা মুড়ে
তোমার ডিমের মধ্যে শুয়ে থাকতে দেবে?
![কবি জয় গোস্বামীর কবিতা 5 জয় গোস্বামী [ Joy Goswami ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/04/জয়-গোস্বামী-Joy-Goswami-54-300x246.jpg)
তোমার পুরুষমুখে কাঁধ অবধি ঢুকিয়ে ছিলাম – জয় গোস্বামী
তোমার পুরুষমুখে কাঁধ অবধি ঢুকিয়ে ছিলাম
এখন আঙরা-কালো কাঠকয়লা থেকে
বাষ্প উড়ছে। সবদিকে মাথা দিয়ে ঢুঁসো মারি,
বাতাসের অদৃশ্য দেওয়াল ফেটে ফেটে
গলগল আগুন ওঠে।
ও নিয়তিপুরুষ, এরপর
অর্ধেক সিংহের রূপে তোমার বিপুল অবয়ব
থাম ভেঙে একদিন আমার জানুতে আছড়ে পড়ে–
আমার কলমে, নখে, ছিন্নভিন্ন হয়।
![কবি জয় গোস্বামীর কবিতা 6 জয় গোস্বামী [ Joy Goswami ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/04/জয়-গোস্বামী-Joy-Goswami-52-300x169.jpg)
দুখানি জানুর মতো খোলা – জয় গোস্বামী
দুখানি জানুর মতো খোলা
হাড়িকাঠ
মুখ রাখো তাতে
চোখের পলক ফেলতে মাথা ছিঁটকে চলে যাবে সামনের মাঠে
![কবি জয় গোস্বামীর কবিতা 7 জয় গোস্বামী [ Joy Goswami ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/04/জয়-গোস্বামী-Joy-Goswami-51-222x300.jpg)
দোল : শান্তিনিকেতন – জয় গোস্বামী
১
বকুল শাখা পারুল শাখা
তাকাও কেন আমার দিকে?
মিথ্যে জীবন কাটলো আমার
ছাই লিখে আর ভস্ম লিখে –
কী ক’রে আজ আবীর দেবো
তোমাদের ওই বান্ধবীকে !
২
শান্ত ব’লে জানতে আমায় ?
কলঙ্কহীন, শুদ্ধ ব’লে ?
কিন্তু আমি নরক থেকে
সাঁতরে এলাম
তখন আমার শরীর থেকে
গরম কাদা গড়িয়ে পড়ছে
রক্ত-কাদা
হঠাৎ তোমায় দেখতে পেলাম
বালিকাদের গানের দলে
সত্যি কিছু লুকোচ্ছি না ।
প্রাচীন তপোবনের ধারে
তোমার বাড়ি
কখন যাবো ? – ঘুম পাচ্ছে –
বলো কখন মুখ রাখবো
তোমার কোলে !
বারণ করবে ?
![কবি জয় গোস্বামীর কবিতা 8 জয় গোস্বামী [ Joy Goswami ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/04/জয়-গোস্বামী-Joy-Goswami-50-300x300.jpg)
নিজের ছেলেকে খুন ক’রে – জয় গোস্বামী
নিজের ছেলেকে খুন ক’রে
ঐ দেখ, চলেছে অভাবী
নিজের মেয়েকে বিক্রি ক’রে
ঐ ফিরে যাচ্ছেন জননী
ওদের সঞ্চয় থেকে ফেরার রাস্তায় পড়ে যায়
অশ্রুর বদলে বালি, পয়সা ও রক্তের চাকতি–গোল
তারপর সমস্ত জল। শুধু ওই গোল গোল পাথরে
আগুন ধকধক করবে একদিন, আর সেই আগুনে পা ফেলে
ক্রোধ শোক দগ্ধ এক জলে ডোবা দেশ
পুনরায়, খুঁজে খুঁজে বেড়াবে পাগল
![কবি জয় গোস্বামীর কবিতা 9 জয় গোস্বামী [ Joy Goswami ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/04/জয়-গোস্বামী-Joy-Goswami-49-300x300.jpg)
নৌকো থেকে বৈঠা পড়ে যায় – জয় গোস্বামী
নৌকো থেকে বৈঠা পড়ে যায়
জলের তলায়
কালো ছাইরঙা জল একবার ঢেউ দিয়ে অন্ধকার
এখন কোথায় আছে সেই বৈঠাখানি?
দুটো কৌতুহলী মাছ, দু’ খণ্ড পাথর, লক্কড়, সাইকেল ভাঙা
গোল আংটির পাশে পাঁকে গাঁথা চারানা আট আনা। অন্ধকারে
ওদের চোখ জ্বলে। এই জলে থেকে থেকে
এখন ওরাও কোনো প্রাণী।
হারানো বৈঠার কাছে পৌঁছে দেখি, তার
দুধারে জন্মেছে পাখনা, পিঠে কাঁটা, নাকে খড়্গ, আর
খড়্গের রজ্জুর সঙ্গে বৃহৎ নৌকাটি বেঁধে নিয়ে
বৃষ্টিতে বৃষ্টিতে ঝাপসা জলমগ্ন ভূমণ্ডল পেরিয়া সে চলেছে আবার!
![কবি জয় গোস্বামীর কবিতা 65 জয় গোস্বামী [ Joy Goswami ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/04/জয়-গোস্বামী-Joy-Goswami-48-186x300.jpg)
পশ্চিমে বাঁশবন – জয় গোস্বামী
পশ্চিমে বাঁশবন। তার ধারে ধারে জল।
বিকেল দাঁড়াল ধানক্ষেতে।
জলে ভাঙা ভাঙা মেঘ। ফিরে আসছে মাছমারা বালকের দল।
খালি গা, কোমরে গামছা, লম্বা ছিপ, ঝুড়ি–
আবছা কোলাহল।
তোমার কি ইচ্ছে করে, এখন ওদের সঙ্গে যেতে?
কয়েদি উত্তর দেয় না। সে শুধু বিকেলটুকু
এঁকে রাখছে ঘরের মেঝেতে।
![কবি জয় গোস্বামীর কবিতা 10 জয় গোস্বামী [ Joy Goswami ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/04/জয়-গোস্বামী-Joy-Goswami-47-300x300.jpg)
পাখিটি আমাকে ডেকে – জয় গোস্বামী
পাখিটি আমাকে ডেকে বলল তার ডানার জখম
বলল যে কীভাবে তার পালকে সংসার পোড়া ছ্যাঁকা
কীভাবে পায়ের মধ্যে ফুটো করে ঢুকে এল চেন
ঠোঁট দিয়ে খাঁচার শিক কাটতে গিয়ে ঠোঁটের জখম
দ্যাখালো, বাইরে থেকে আমি নিজ ওষ্ঠ থেকে ওম
দিলাম, খাঁচার দরজা খুলে তাকে “বাঁচবিযদি আয়’,
বলে বার করে এনে রাখলাম আর একটা খাঁচায়
সেখানে দুজনে বন্দি পরস্পর দোষারোপ করি,
দোষারোপ করতে করতে বৃষ্টি আসে, সন্ধে হয়ে যায় …
![কবি জয় গোস্বামীর কবিতা 11 জয় গোস্বামী [ Joy Goswami ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/04/জয়-গোস্বামী-Joy-Goswami-46-197x300.jpg)
পাগলী, তোমার সঙ্গে – জয় গোস্বামী
পাগলী, তোমার সঙ্গে ভয়াবহ জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে ধুলোবালি কাটাব জীবন
এর চোখে ধাঁধা করব, ওর জল করে দেব কাদা
পাগলী, তোমার সঙ্গে ঢেউ খেলতে যাব দু’কদম।
অশান্তি চরমে তুলব, কাকচিল বসবে না বাড়িতে
তুমি ছুঁড়বে থালা বাটি, আমি ভাঙব কাঁচের বাসন
পাগলী, তোমার সঙ্গে বঙ্গভঙ্গ জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে ৪২ কাটাব জীবন।
মেঘে মেঘে বেলা বাড়বে, ধনে পুত্রে লক্ষ্মী লোকসান
লোকাসান পুষিয়ে তুমি রাঁধবে মায়া প্রপন্ঞ্চ ব্যন্জ্ঞন
পাগলী, তোমার সঙ্গে দশকর্ম জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে দিবানিদ্রা কাটাব জীবন।
পাগলী, তোমার সঙ্গে ঝোলভাত জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে মাংসরুটি কাটাব জীবন
পাগলী, তোমার সঙ্গে নিরক্ষর জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে চার অক্ষর কাটাব জীবন।
পাগলী, তোমার সঙ্গে বই দেখব প্যারামাউন্ট হলে
মাঝে মাঝে মুখ বদলে একাডেমি রবীন্দ্রসদন
পাগলী, তোমার সঙ্গে নাইট্যশালা জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে কলাকেন্দ্র কাটাব জীবন।
পাগলী, তোমার সঙ্গে বাবুঘাট জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে দেশপ্রিয় কাটাব জীবন
পাগলী, তোমার সঙ্গে সদা সত্য জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে ‘কী মিথ্যুক’ কাটাব জীবন।
এক হাতে উপায় করব, দুহাতে উড়িয়ে দেবে তুমি
রেস খেলব জুয়া ধরব ধারে কাটাব সহস্র রকম
লটারি, তোমার সঙ্গে ধনলক্ষ্মী জীবন কাটাব
লটারি, তোমার সঙ্গে মেঘধন কাটাব জীবন।
দেখতে দেখতে পুজো আসবে, দুনিয়া চিত্কার করবে সেল
দোকানে দোকানে খুঁজব রূপসাগরে অরূপরতন
পাগলী, তোমার সঙ্গে পুজোসংখ্যা জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে রিডাকশনে কাটাব জীবন।
পাগলী, তোমার সঙ্গে কাঁচা প্রুফ জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে ফুলপেজ কাটাব জীবন
পাগলী, তোমার সঙ্গে লে আউট জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে লে হালুয়া কাটাব জীবন।
কবিত্ব ফুড়ুত্ করবে, পিছু পিছু ছুটব না হা করে
বাড়ি ফিরে লিখে ফেলব বড়ো গল্প উপন্যাসোপম
পাগলী, তোমার সঙ্গে কথাশিল্প জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে বকবকম কাটাব জীবন।
নতুন মেয়ের সঙ্গে দেখা করব লুকিয়ে চুরিয়ে
ধরা পড়ব তোমার হাতে, বাড়ি ফিরে হেনস্তা চরম
পাগলী, তোমার সঙ্গে ভ্যাবাচ্যাকা জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে হেস্তনেস্ত কাটাব জীবন।
পাগলী, তোমার সঙ্গে পাপবিদ্ধ জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে ধর্মমতে কাটাব জীবন
পাগলী, তোমার সঙ্গে পুজা বেদি জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে মধুমালা কাটাব জীবন।
দোঁহে মিলে টিভি দেখব, হাত দেখাতে যাব জ্যোতিষীকে
একুশটা উপোস থাকবে, ছাব্বিশটা ব্রত উদযাপন
পাগলী, তোমার সঙ্গে ভাড়া বাড়ি জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে নিজ ফ্ল্যাট কাটাব জীবন।
পাগলী, তোমার সঙ্গে শ্যাওড়াফুলি জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে শ্যামনগর কাটাব জীবন
পাগলী, তোমার সঙ্গে রেল রোকো জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে লেট স্লিপ কাটাব জীবন।
পাগলী, তোমার সঙ্গে আশাপূর্ণা জীবন কাটাব
আমি কিনব ফুল, তুমি ঘর সাজাবে যাবজ্জীবন
পাগলী, তোমার সঙ্গে জয় জওয়ান জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে জয় কিষান কাটাব জীবন।
সন্ধেবেলা ঝগড়া হবে, হবে দুই বিছানা আলাদা
হপ্তা হপ্তা কথা বন্ধ মধ্যরাতে আচমকা মিলন
পাগলী, তোমার সঙ্গে ব্রক্ষ্মচারী জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে আদম ইভ কাটাব জীবন।
পাগলী, তোমার সঙ্গে রামরাজ্য জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে প্রজাতন্ত্রী কাটাব জীবন
পাগলী, তোমার সঙ্গে ছাল চামড়া জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে দাঁতে দাঁত কাটাব জীবন।
এর গায়ে কনুই মারব রাস্তা করব ওকে ধাক্কা দিয়ে
এটা ভাঙলে ওটা গড়ব, ঢেউ খেলব দু দশ কদম
পাগলী, তোমার সঙ্গে ধুলোঝড় জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে ‘ভোর ভয়োঁ’ কাটাব জীবন।
![কবি জয় গোস্বামীর কবিতা 12 জয় গোস্বামী [ Joy Goswami ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/04/জয়-গোস্বামী-Joy-Goswami-45-300x300.jpg)
পোকা উঠেছে – জয় গোস্বামী
পোকা উঠেছে। গাছের কাণ্ডের গায়ে পোকা।
ধানবীজ হাতে ঢেলে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেখছে ধুতি ও ফতুয়াপরা চাষি
হাবলা গোবলা ছেলে দৌড়ে নেমে আসছে ঢালু পিচরাস্তা থেকে
ওরে পড়ে যাবি, ওরে পড়ে যাবি, ডাকতে ডাকতে আমি
বল্মীকের স্তূপ ভেঙে সমাজ সংসারে ছুটে আসি
![কবি জয় গোস্বামীর কবিতা 13 জয় গোস্বামী [ Joy Goswami ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/04/জয়-গোস্বামী-Joy-Goswami-44-300x201.jpg)
প্রণয়গীতি – জয় গোস্বামী
এইখানে টান দাও এই এত ঠাণ্ডায়
ওই কোলে ঠাই দাও সজনী ও সজনী
দেখিতে না দেখিতে, কিলবিলে দিঘিতে
আমাকে ডোবাল মম আত্মীয়স্বজনই
আজ উঠে দেবী তোরে সকাতরে বলি হে
অধমে খাওয়াও তব হাড়মাস গলিয়ে
সঙ্গী ও সাথীরা, ছেলে-পিলে-নাতিরা
পেট ফুলে উল্টিয়ে ছিল সবকজনই
ওঠে আজ ঠ্যাংকাটা, কে উঠে ঘোড়ার মাথা
কে ছেলে কে মেয়ে ওরা -অলিঙ্গ অযোনি
শৃঙ্গী না শঙ্খিনী তুমি কি মানুষ নও?
দেখি, হাত দিয়ে দেখি-এ কী, এত উষ্ণ!
কী গরম কী গরম, আনন্দে হে চরম
একাকার হয়ে যায় দিন-রাত-রজনী
নয়দ্বার ফেটে পড়ে মাথায় নৃত্য করে
ছ-জন্ম ন-জন্ম নয়-ছয়-জননী…..
![কবি জয় গোস্বামীর কবিতা 14 জয় গোস্বামী [ Joy Goswami ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/04/জয়-গোস্বামী-Joy-Goswami-43-300x168.jpg)
প্রাক্তন – জয় গোস্বামী
ঠিক সময়ে অফিসে যায়?
ঠিক মতো খায় সকালবেলা?
টিফিনবাক্স সঙ্গে নেয় কি?
না ক্যান্টিনেই টিফিন করে?
জামা কাপড় কে কেচে দেয়?
চা করে কে আগের মতো?
দুগগার মা ক’টায় আসে?
আমায় ভোরে উঠতে হত
সেই শার্টটা পরে এখন?
ক্যাটকেটে সেই নীল রঙ টা?
নিজের তো সব ওই পছন্দ
আমি অলিভ দিয়েছিলাম
কোন রাস্তায় বাড়ি ফেরে?
দোকানঘরের বাঁ পাশ দিয়ে
শিবমন্দির, জানলা থেকে
দেখতে পেতাম রিক্সা থামল
অফিস থেকে বাড়িই আসে?
নাকি সোজা আড্ডাতে যায়?
তাসের বন্ধু, ছাইপাঁশেরও
বন্ধুরা সব আসে এখন?
টেবিলঢাকা মেঝের ওপর
সমস্ত ঘর ছাই ছড়ানো
গেলাস গড়ায় বোতল গড়ায়
টলতে টলতে শুতে যাচ্ছে
কিন্তু বোতল ভেঙ্গে আবার
পায়ে ঢুকলে রক্তারক্তি
তখন তো আর হুঁশ থাকে না
রাতবিরেতে কে আর দেখবে।
কেন, ওই যে সেই মেয়েটা।
যার সঙ্গে ঘুরত তখন।
কোন মেয়েটা? সেই মেয়েটা?
সে তো কবেই সরে এসেছে!
বেশ হয়েছে, উচিত শাস্তি
অত কান্ড সামলাবে কে!
মেয়েটা যে গণ্ডগোলের
প্রথম থেকেই বুঝেছিলাম
কে তাহলে সঙ্গে আছে?
দাদা বৌদি? মা ভাইবোন!
তিন কূলে তো কেউ ছিল না
এক্কেবারে একলা এখন।
কে তাহলে ভাত বেড়ে দেয়?
কে ডেকে দেয় সকাল সকাল?
রাত্তিরে কে দরজা খোলে?
ঝক্কি পোহায় হাজার রকম?
কার বিছানায় ঘুমোয় তবে
কার গায়ে হাত তোলে এখন
কার গায়ে হাত তোলে এখন?
![কবি জয় গোস্বামীর কবিতা 15 জয় গোস্বামী [ Joy Goswami ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/04/জয়-গোস্বামী-Joy-Goswami-42-300x172.jpg)
প্রীতি – জয় গোস্বামী
ও প্রীতি,
দীর্ঘ ঈ, হস্ব্র ই-কারের ডানা
দুদিকে অর্ধেক মোড়া
চিঠিতে বসেছ, নিতে
বলেছ। নেবো না।
ডানা মেলে উড়ে যাও, প্রীতি
দূরে দীর্ঘ ঐ জল
পার হয়েএকপিঠ ডাঙা
ঐ যে উঠেছে,
চর
জানা বা অজানা
কত সব পরিবার
ঘর ছাইবে, ঘর ছাইল,
যাও,
ঐ চরে গিয়ে নামো,
হাত লাগাও
বসতির কাজে,
আমিও তোমার পিছে উড়ে যাই
সকলের সঙ্গে গিয়ে বসি
পুরোনো পাড়ার লোক দেখে যাই বসে-বসে
আলিঙ্গন, আলিঙ্গন,
আজ একাদশী,
এখন বন্যার জল নেমে গেছে,
ছেলেরা কাঠাম তুলছে জল থেকে
ঝাঁপাঝাঁপি
নদীপাড় পোহাচ্ছে রোদ্দুর,
খালাসীর কড়াইতে ছ্যাঁকছোঁক শুকনো লঙ্কা
শুকনো কাশি, ঝাল তরকারি
ভাঙা আস্ত দুটো লঞ্চ
গায়ে লেখা লম্বা নাম
“দুর্গতিনাশিনী’ আর “জয় মা অভয়া’ …
মা ভেসে গেছেন কালকে, শুভ নমস্কার,
প্রীতি,
হ্যা, শুভ বিজয়া!
![কবি জয় গোস্বামীর কবিতা 72 জয় গোস্বামী [ Joy Goswami ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/04/জয়-গোস্বামী-Joy-Goswami-41-300x300.jpg)
প্রেতের মিলননারী নেই – জয় গোস্বামী
প্রেতের মিলননারী নেই।
সে তাই চন্দ্র ও সূর্য দুটি হাত রেখে
ক্রিয়াশীল আগ্নেয়গিরিকে ভেদ করে
পৃথিবীর সঙ্গে মিলতে চায়–
জিহ্বাহীন মুখ থেকে অতৃপ্ত রমণশব্দ
মেঘ ফেটে গেলে–শোনা যায়।

প্রেম বোলে তো – জয় গোস্বামী
এইখানে এসে প্রেম শেষ হল। শরীর মরেছে।
তোমার হাত ধরে আমি দাঁড়িয়েছি বৃষ্টির ভিতরে
গাছ থেকে জল পড়ছে, বৃষ্টিছাট ছুটে আসছে গা-য়,
“ভিজে যাবে’ -তুমি বলছ, “সরে এসো ছাতারতলায়’
আমাদের একটাই ছাতা। তাতে দুজনেরই চলে যায়।
আরও কালো করে এল, গাছে ডানা ঝাপটায়।
দুজনে দাঁড়িয়ে আছি। দুজনে দাঁড়িয়ে থাকব। যতদিন পাশে থাকা যায়।

ফুটকড়াই – জয় গোস্বামী
পরির পাশে পরির বোন,
দাঁড়িয়ে আছে কতক্ষণ।
জ্বর থেকে তো উঠল কাল,
রোদের তাপে মুখটি লাল।
লম্বা লাইন ইস্কুলের,
দাও দারোয়ান গেট খুলে।
পরির পাশে পরির মা-ও,
বলছে, ঠাকুর রোদ কমাও,
আবার অসুখ করবে ওর
নষ্ট হবে একবছর।
বয়স কত ? বয়ঃক্রম ?
সেসব ভাবার সময় কম।
ভর্তি হবার জন্য আজ,
টেষ্টে বসাই পরির কাজ।
পরি তো নয়, পরির বোন,
পাঁচ বছরের কম এখন।
এদিক তাকায়, ওদিক চায়;
গোরু বসছে গাছতলায়
একটা কুকুর দৌড়ে যায়,
ট্যাক্সি গাড়ি পাশ কাটায়
গাড়ি থামায় নীল পুলিশ…
কী ভাবছিস রে ? কী ভাবছিস ?
এ বি সি ডি, ওয়ান টু আর
ভুল করিস না, খবরদার !
ভুল করিস না লক্ষ্মীটি,
‘ছি’ দেবে কাকপক্ষিটি।
ভুল করিস না, ধরছি পা’য়
মা কী করে মুখ দেখায়।
না যদি পাস অ্যাডমিশন,
কোন চুলোতে যাই তখন।
পাশের বাড়ির বাপটুও,
দেখবি কেমন দেয় দুয়ো।
চায় না তো মা আর কিছুই,
নম্বর চায়-আনবি তুই।
নাম হবে তোর খুব বড়,
নামের পাশে নম্বরও
বাড়তে বাড়তে সাতশো মন,
না হবে তোর যতক্ষণ
দাঁড়িয়ে থাকবি, দাঁড়িয়ে থাক,
লাল সাদা আর নীল পোশাক।
পরির দিদি, পরির বোন
কতক্ষণ আর কতক্ষণ
ওই খুলেছে, ওই তো, চল,
রোদ পোড়া সব পরির দল
টুম্পি, টিমা, মম, টোকাই
মাথায় মাথায় পিন ঢোকাই।
ফুটকড়াই, ফুটকড়াই,
ঠিক ডাটা ঠিক ফিড করাই।
ব্যস, হয়েছে প্রোগ্রামিং,
তিড়িং বিড়িং তিড়িং বিং
বন্ধ এখন, জোর সে চল,
কোর্সে কোর্সে এগিয়ে চল
ঊর্ধ গগনে বাজে মাদল
মাথার ওপর যাঁতার কল
ফুটফুটে সব ছাত্রীদল
ছাত্রদল
চল রে চল
এই তো চাই, ফুটকড়াই।

বলি – জয় গোস্বামী
অনামিকা কই? কাজল কোনদিকে গেল?
সায়ন কোথায়?
পিছনে তাকিয়ে দেখি সঙ্গে কেউ নেই
প্রান্তরের মধ্যে এক যূপকাষ্ঠ—অর্ধেক প্রোথিত—
ধারে কাছে কোনও ধড় নেই
মুণ্ডুরা উধাও ।
ধুলোয় শোওয়ানো আছে খাঁড়া ।
চেনে চেনে লাগে বড় ।
ইতি পূর্বে দেখা হয়েছে কি?
সত্তর – একাত্তর – বাহাত্তর সালে
এঁদের দেখেছি বটে ।
তারপর কি কোখাও দেখিনি?
হ্যাঁ মনে পড়েছে ।
লালাবাজারে এই খাঁড়া ঝোলানো রয়েছে ।
যূপকাষ্ঠ আছে মহাকরণের বুদ্ধিঘরে ।

বাড়িটি আকাশে ফুটে আছে – জয় গোস্বামী
বাড়িটি আকাশে ফুটে আছে।
ছাদে ওই বালকবালিকা
নীচে দড়ি ফেলে ধরছে খেয়ানৌকো চাঁদ।
ক্রমশ গুটিয়ে তুলছে মেঘ থেকে আরো ঊর্ধ্বাকাশে
যা–ওদের কাছে যাবি? বিদ্যুতের মতো নীল কাছে?

বাদুড় বৃষ্টির মধ্যে দেবদারু গাছ ছেড়ে যায় – জয় গোস্বামী
বাদুড় বৃষ্টির মধ্যে দেবদারু গাছ ছেড়ে যায়
বাদুড় আমার রক্ত খেয়ে
আকাশে পালায়
পালিয়ে বাঁচে না
রাত্রে দেখা যায়
বাদুড় চাঁদের মধ্যে হুমড়ি খেয়ে পড়ে
পেট থেকে রক্ত, রক্ত নয়, বালি ওগরায়

বাংলার গা থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে – জয় গোস্বামী
১
বাংলার গা থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে,
রক্ত
গড়িয়ে পড়ছে…
কেউ ছুটে গেল খালের ওদিকে
বুক ফাটা গলায় কার মা ডাকল : “রবি রে…”
উত্তরের পরিবর্তে, অনেকের স্বর মিলে একটি প্রকাণ্ড হাহাকার
ঘুরে উঠল…
কে রবি? কে পুষ্পেন্দু? ভরত?
কাকে খুঁজে পাওয়া গেছে? কাকে আর পাওয়া যায় নি?
কাকে শেশ দেখা গেছে
ঠেলাঠেলি জনতাগভীরে?
রবি তো পাচার হচ্ছে লাশ হয়ে আরও সর লাশেদের ভিড়ে…
২
…বাংলার গা থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়েছে
রক্ত
গড়িয়ে পড়েছে
রক্ত
গড়িয়ে পড়েছে…
পিছনে কুকুর ছুটছে
ধর্, ধর্…
পিছনে শেয়াল
তার পিছু পিছু আসছে ভাণ্ড হাতে
রাজ অনুচর
এই রক্ত ধরে রাখতে হবে
এই রক্ত মাখা হবে সিমেন্টে বালিতে
গড়ে উঠবে সারি সারি
কারখানা ঘর
তারপর
চারবেলা ভোঁ লাগিয়ে সাইরেন বাজবে
এ কাজ না যদি পার, রাজা
তাহলে
বণিক এসে তোমার গা থেকে
শেষ লজ্জাবস্ত্রটুকু খুলে নিয়ে যাবে
৩
আমার গুরুত্ব ছিল মেঘে
প্রাণচিহ্নময় জনপদে
আমার গুরুত্ব ছিল…
গা ভরা নতুন শস্য নিয়ে
রাস্তার দুপশ থেকে চেয়ে থাকা আদিগন্ত ক্ষেতে আর
মাঠে
আমার গুরুত্ব ছিল…
আজ
আমার গুরুত্ব শুধু রক্তস্নানরত
হাড়িকাঠে!
৪
অনেক কিছুর মধ্য দিয়ে
সূর্য উঠে আসে
বন্ধ থাকা ইশ্কুলের গায়ে ও মাথায়
রোদ পড়ে
রোদ পড়ে মাটি খুড়ে চলা
কোদালে, বেলচায়
রোদ পড়ে নিখোঁজ বাচ্চার
রক্তমাখা স্কুলের পোশাকে…
৫
…না, না, না, না, না—
না বলে চিত্কার করছে গাছ
না বলে চিত্কার করছে এই গ্রীষ্ম দুপুরের হাওয়া
না বলে চিত্কার করছে পিঠে লাশ বয়ে নিয়ে চলা
ভ্যান গাড়ি
আর আমরা শহরের কয়েকজন গম্ভীর মানুষ
ভেবে দেখছি না বলার ভাষারীতি ঠিক ছিল কিনা তাই নিয়ে
আমরা কি বিচারে বসতে পারি?
৬
তুমি কি খেজুরি? তুমি ভাঙাবেড়া?
সোনাচূড়া তুমি?
বার বার প্রশ্ন করি । শেষে মুখে রক্ত উঠে আসে ।
আমার প্রেমের মতো ছাড়খার হয়ে আছে আজ গোটা দেশ
ঘোর লালবর্ণ অবিশ্বাসে ।
৭
আমরা পালিয়ে আছি
আমরা লুকিয়ে আছি দল বেঁধে এই
ইটভাটায়
মাথায় কাপড় ঢেকে সন্ধ্যেয় বেরোই
মন্টুর আড়তে—
মল্লিকের
বাইকের পিছন-সিটে বসে
আমরা এক জেলা থেকে অপর জেলায়
চলে যাই,
যখন যেখানে যাই কাজ তো একটাই ।
লোক মারতে হবে ।
আপাতত ইটভাঁটায়
লুকিয়ে রয়েছি…
অস্ত্র নিয়ে…
কখন অর্ডার আসে, দেখি ।
৮
পিছু ফিরে দেখেছি পতাকা ।
সেখানে রক্তের চিহ্ন, লাল ।
ক’বছর আগে যারা তোমাকে সাহায্য করবে বলে
ক’বছর আগে যারা তোমার সাহায্য পাবে বলে
রক্তিম পতাকটিকে নিজের পতাকা ভেবে কাঁধে নিয়েছিল
তাঁদের সবাইকে মুচড়ে দলে পিষে ভেঙে
দখল করেছ মুক্তাঞ্চল
পতাকাটি সেই রক্তবক্ষ পেতে ধারণ করলেন ।
তোমার কি মনে পড়ছে রাজা
শেষ রাত্রে ট্যাঙ্কের আওয়াজ?
মনে পড়ছে আঠারো বছর আগে তিয়েন-আন-মেন?
৯
ভাসছে উপুর হয়ে । মুণ্ডু নেই । গেঞ্জি পড়া কালো প্যান্ট ।
কোন বাড়ির ছেলে?
নব জানে । যারা ওকে কাল বিকেলে বাজারে ধরেছে
তার মধ্যে নবই তো মাথা ।
একদিন নব-র মাথাও
গড়াবে খালের জলে,
ডাঙায় কাদার মধ্যে উলটে পড়ে থাকবে স্কন্ধকাটা
এ এক পুরনো চক্র ।
এই চক্র চালাচ্ছেন যে-সেনাপতিরা
তাঁদের কি হবে?
উজ্জ্বল আসনে বসে মালা ও মুকুট পরবে
সেসব গর্দান আর মাথা
এও তো পুরনো চক্র । কিন্তু তুমি ফিরে দেখ আজ
সে চক্র ভাঙার জন্যে উঠে দাঁড়িয়েছে গ্রাম—
ঘুড়ে দাঁড়িয়েছে কলকাতা ।
১০
অপূর্ব বিকেল নামছে ।
রোদ্দুর নরম হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে সারা মাঠে ।
রোদ্দুর, আমগাছের ফাঁক দিয়ে নেমেছে দাওয়ায় ।
শোকাহত বাড়িটিতে
শুধু এক কাক এসে বসে ।
ডাকতে সাহস হয় না তারও ।
অনেক কান্নার পর পুত্রহারা মা বুঝি এক্ষুনি
ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন ।
যদি ঘুম ভেভে যায় তাঁর!

বালি খোঁড়ে আমার বৃশ্চিক – জয় গোস্বামী
বালি খোঁড়ে আমার বৃশ্চিক–
রৌদ্রে তার অসুবিধা হয়।
হাওয়ার, লোকের চাপে, বালি সরলে
সে বেরিয়ে আসে।
কাঁপাকাঁপা পায়ে
তটের পাথর খুঁজে তার নীচে সুড়ঙ্গ বানায়
শুধু রাত্রিবেলা তার আদিগন্ত ছড়ানো শরীর
ভেসে ওঠে সমুদ্রের উপর-আকাশে
তারকা নির্মিত দাড়া, অগ্নিময় দুটি পুচ্ছ-হুল
খেয়ালখুশিতে সে নাড়ায়
বসতি ঘুমোয়, শুধু জগতের সকল সমুদ্র যাত্রা থেকে
নাবিকরা তাকে দেখতে পায়।

বিবাহিতাকে – জয় গোস্বামী
কিন্তু ব্যাপারটা হচ্ছে, তুমি আমার সামনে দাড়ালেই আমি
তোমার ভিতরে একটা বুনো ঝোপ দেখতে পাই।
ওই ঝোপে একটা মৃতদেহ ঢাকা দেওয়া আছে।
অনেকদিন ধ’রে আছে। কিন্তু আশ্চর্য যে
এই মৃতদেহ জল, বাতাস, রৌদ্র ও সকলপ্রকার
কীট-বীজাণুকে প্রতিরোধ করতে পারে। এর পচন নেই।
বন্য প্রাণীরাও এর কাছে ঘেঁষে না।
রাতে আলো বেরোয় এর গা থেকে।
আমি জানি, মৃতদেহটা আমার।
কিন্তু ব্যাপারটা হচ্ছে, এই জারিজুরি এবার ফাঁস হওয়া প্রয়োজন।
আর তা হবেও, যেদিন চার পায়ে গুঁড়ি মেরে গিয়ে
পা কামড়ে ধ’রে, ওটাকে, ঝোপ থেকে
টেনে বার করব আমি।

বিবাহের আগে শেষ দেখা – জয় গোস্বামী
একসময় মনে হত কোনওদিন তোমাকে পাব না
একসময় মনে হত ইচ্ছে করলেই পাওয়া যায়
আজকে শেষবার আমি তোমাকে পেলাম
কালকের পর থেকে আমাকে নেবে না আর তুমি
দুপুর ফুরিয়ে এল।
এইবার ফিরে আসবে বাড়ির সবাই।
আর একবার, আর একবার, এসো__
প্রথম দিনের মতো আবার পুড়িয়ে করো ছাই !\

বিষাদ ১ – জয় গোস্বামী
শেষরাত্রে বৃষ্টি এলো, শব্দে উঠে বসলাম দুজন
মাঝখানে মেয়ে শুয়ে, উঠে পড়বে, কথা বলবোনা
কলহ অর্ধেক রেখে মাঝরাত্রে দুজনে শুয়েছি
দু-দুটো লোহার বস্তা বুকে চাপিয়ে শুয়েছি দুজন
এখন জানলায় বৃষ্টি, দুজনেই অঝোর তাকিয়ে
এখন কোথায় রাখবো লৌহভরা অভিযোগভরা
এমন সামান? আও উঠাকে লে যাও কৈ ইসে
নেবার তো কেউ নেই, বরং পেতেই বসা যাক!
শেষরাত্তিরের বৃষ্টি ঝরতে ঝরতে মাঝখান দিয়ে
একটা নদী তৈরী করল,যে নদীর শেষে মেঘলা ভোর
আকাশে রং নেই আজ, কেমন ফ্যাকাসে একটা আলো
ময়লা একটা রোদ উঠবে আর একটু পরেই, শুরুহবে
একে একে অভাব অভিযোগ শাস্তি ব্যস্ততা অশান্তি কর গোনা
কলহ অর্ধেক দেহ নিয়ে আসবে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে
ফের উঠবে সেই কথা একসঙ্গে থাকবো কি থাকবো না
কে কাকে কী কষ্ট দিল, কী পেয়েছি তোমার কাছে এসে
নিকেল, অচল পয়সা ঝনঝন করবে ঘরে
এক সময় যাকে ভাবতে সোনা
মেয়ে তো এক্খুনি উঠবে, ওর সামনে ঝগড়া কোরো না !

বিষাদ ২ – জয় গোস্বামী
ঐ যে দুজন তোমরা থামের আড়ালে ঘন হয়ে
মেট্রো স্টেশনের মধ্যে ঐ যে দুজন দাঁড়িয়েছ
যে মেয়েটি কথা বলছ ছেলেটির শার্টের বোতামে হাত রেখে
যে-ছেলেটি বান্ধবীর কপালের ঝুঁকে আসাচুল
সরাচ্ছ আঙুলে-তারা কদিন, কদিন পরে আর
শিক দিয়ে খন্তা দিয়ে এ অন্যের কয়লা ঘ্যাঁস চাপাপড়া মন
খুঁড়ে খুঁড়ে তুলবে না তো? প্রত্যাশার পচা হাড়গোড়
ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলবে না তো পাড়াপড়শী আত্মীয়বাড়িতে?
অভিযোগে অভিযোগে নোংরা ফেলে রাখবে না তো সমস্ত জায়গায়?
মেট্রো স্টেশনের মধ্যে ট্রেন ঢুকে পড়ল আর ট্রেন ছেড়ে যায়।
থামের আড়ালে তোমরা তেমনি দাঁড়িয়ে ঘন হয়ে
তোমাদের দেখে এক প্রেমভ্রষ্ট কবি আজ মিথ্যে এইসব ভয় পায় !

বৃষ্টি ভেজা বাংলা ভাষা – জয় গোস্বামী
কে মেয়েটি হঠাৎ প্রণাম করতে এলে ?
মাথার ওপর হাত রাখিনি
তোমার চেয়েও সসংকোচে এগিয়ে গেছি
তোমায় ফেলে
ময়লা চটি, ঘামের গন্ধ নোংরা গায়ে,
হলভরা লোক, সবাই দেখছে তার মধ্যেও
হাত রেখেছ আমার পায়ে
আজকে আমি বাড়ি ফিরেও স্নান করিনি
স্পর্শটুকু রাখব বলে
তোমার হাতের মুঠোয় ভরা পুস্করিণী
পরিবর্তে কী দেব আর ? আমার শুধু
দু’ চার পাতা লিখতে আসা
সর্বনাশের এপার ওপার দেখা যায় না
কিন্তু আমি দেখতে পেলাম, রাঙা আলোয়
দাঁড়িয়ে আছে সে-ছন্দ, সে-কীর্তিনাশা ।
অচেনা ওই মেয়ের চোখে যে পাঠাল
দু’-এক পলক বৃষ্টিভেজা বাংলা ভাষা ।

ভরত মণ্ডলের মা – জয় গোস্বামী
বৃদ্ধা বললেন:
‘আমার এক ছেলে গেছে,
আরেক ছেলে কে নিয়ে যাক
জমি আমি দেব না ওদের |
এই যে হাত দু’টো দেখছো বাবা…’
ব’লে তাঁর কাঁপা কাঁপা
শিরা ওঠা হাত দু’টি উঠিয়ে
দেখালেন: ‘এ দু’টো হাতে
ক্ষেতের সমস্ত কাজ
এতদিন করেছি, এবার
এই হাত দু’টো দিয়েই
জমি কেড়ে নেওয়া আটকাবো|’
মাসীমা, আপনার নেই
ইটভাটার অস্ত্রভাণ্ডার
মাসীমা, আপনার নেই
সশস্ত্র পুলিশ
মাসীমা, আপনার নেই
পুলিশ-পোষাক পরা
চটি পায়ে হাজার ক্যাডার
তা সত্বেও এত শক্তি
কোথা থেকে পান?
তা আমরা জানি না—
শুধু এইটুকু জানি
কৃষকজননী হ’য়ে মাঝে মাঝে দেবী দুর্গা
আমাদের দেখা দি

ভাঙা বাড়ি – জয় গোস্বামী
ভাঙা বাড়ি। চারিদিকে ঘাস।
এখানে কি কেউ বাস করে?
জড়বুদ্ধি ক্রোধ, হাহাকার
জমে জমে পিণ্ড হয় ঘরে
বন্ধু না–বন্ধুর জ্যান্ত লাশ
হাত নাড়ে জানলার ভিতরে
জানলার এপারে লম্বা ঘাস
পোকামাকড়ের ঝাঁক চলাচল করে!

ভূপৃষ্ঠের ধাতব মলাটে – জয় গোস্বামী
ভূপৃষ্ঠের ধাতব মলাটে
দাঁড়িয়েছে ইস্পাতের ঘাস
রাত্রি ঢেকে শুয়েছে আকাশ
না-পড়া বিদ্যুৎশাস্ত্র হাতে
ক্রীতদাস চলে যায় কারাগার হারাতে হারাতে

ময়না – জয় গোস্বামী
এই যে কাকভোরে উঠে দরজা ঝাঁট দিই
এই যে হাজারবার গিন্নিমার মুখ শুনি
বৌদির কাপড় আর দাদার ফুলপ্যান্ট কেচে
নড়া ব্যথা করি
বাবুর ধমক খাই অপিসের আগে,
বাচ্চা সামলাই আর এই যে সাতবার ক’রে
দোকানে দৌড়ৈ, সে তো
মোড়ে তুই রিক্সা নিয়ে আছিস ব’লেই, সে তো
পাসিঞ্জার তুলে কি নামিয়ে তুই
রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিস ব’লেই, সে তো
একদিন সবার মুখে ঝাড়ু মেরে ঝাঁটা মেরে
কাকভোরে আমাকে নিয়ে পালাবি ব’লেই, না কি বল?

মা এসে দাঁড়ায় – জয় গোস্বামী
মা এসে দাঁড়ায়
জানালায়
নিম্নে স্রোত, নদী
জল থেকে লাফিয়ে উঠছে এক একটা আগুনজ্বলা সাপ
আমি সে-নদীর থেকে তুলে নিতে আসি
আমি শিকলবাঁধা বাঁশি
আকাশের উঁচু জানলায়
মা এসে দাঁড়ায়
সরে যায়।

মাঠে বসে আছে জরদ্গব – জয় গোস্বামী
মাঠে বসে আছে জরদ্গব।
মাথায় পাহাড়।
সামনের থালায় মাটি। তৃণ।
সে খায়, থালায় গর্ত খুঁড়ে–
দইয়ের ভাঁড়ের মতো কেটে কেটে নামে–
আর ক্ষিদে শেষ হয় না–খনিজ সম্পদ
কমে আসে, আরো কম–সুড়ুৎ চুমুকে
জমানো তেলের গর্ভ খালি হয়ে যায়
কাদা-ঝোল মাখা হাতে, জরদ্গব, থাকা মনে ক’রে
খালি ফুটো পৃথিবী বাজায়!

মার? সে তো জানলার ওপারে এসে বসে – জয় গোস্বামী
মার? সে তো জানলার ওপারে এসে বসে।
হাত ভাণ্ড। চুমুক দিতেই
তার স্বচ্ছ গলা দিয়ে নামে
গলে যাওয়া নীহারিকা, চ্যাপ্টা সূর্য, বিন্দু বিন্দু চাঁদ–
তার শিরা উপশিরা বেয়ে
বইতে থাকে পুরো ছায়াপথ
সে যখন জানলা ছেড়ে যায়
ধোঁয়ার স্রোতের মধ্যে উল্টেপাল্টে ঘরে এসে ঢোকে
অতীত–তালগোল পিণ্ড–পিণ্ডের মতন ভবিষ্যৎ!

মালতীবালা বালিকা বিদ্যালয় – জয় গোস্বামী
বেণীমাধব, বেণীমাধব, তোমার বাড়ি যাবো
বেণীমাধব, তুমি কি আর আমার কথা ভাবো?
বেণীমাধব, মোহনবাঁশি তমাল তরুমূলে
বাজিয়েছিলে, আমি তখন মালতী ইস্কুলে
ডেস্কে বসে অঙ্ক করি, ছোট্ট ক্লাসঘর
বাইরে দিদিমণির পাশে দিদিমণির বর
আমি তখন নবম শ্রেণী, আমি তখন শাড়ি
আলাপ হলো, বেণীমাধব, সুলেখাদের বাড়ি
বেণীমাধব, বেণীমাধব, লেখাপড়ায় ভালো
শহর থেকে বেড়াতে এলে, আমার রঙ কালো
তোমায় দেখে এক দৌড়ে পালিয়ে গেছি ঘরে
বেণীমাধব, আমার বাবা দোকানে কাজ করে
কুঞ্জে অলি গুঞ্জে তবু, ফুটেছে মঞ্জরী
সন্ধেবেলা পড়তে বসে অঙ্কে ভুল করি
আমি তখন নবম শ্রেণী, আমি তখন ষোল
ব্রীজের ধারে, বেণীমাধব, লুকিয়ে দেখা হলো
বেণীমাধব, বেণীমাধব, এতদিনের পরে
সত্যি বলো, সে সব কথা এখনো মনে পড়ে?
সে সব কথা বলেছো তুমি তোমার প্রেমিকাকে?
আমি কেবল একটি দিন তোমার পাশে তাকে
দেখেছিলাম আলোর নীচে; অপূর্ব সে আলো!
স্বীকার করি, দুজনকেই মানিয়েছিল ভালো
জুড়িয়ে দিলো চোখ আমার, পুড়িয়ে দিলো চেখ
বাড়িতে এসে বলেছিলাম, ওদের ভালো হোক।
রাতে এখন ঘুমাতে যাই একতলার ঘরে
মেঝের উপর বিছানা পাতা, জ্যোৎস্না এসে পড়ে
আমার পরে যে বোন ছিলো চোরাপথের বাঁকে
মিলিয়ে গেছে, জানি না আজ কার সঙ্গে থাকে
আজ জুটেছে, কাল কী হবে? – কালের ঘরে শনি
আমি এখন এই পাড়ায় সেলাই দিদিমণি
তবু আগুন, বেণীমাধব, আগুন জ্বলে কই?
কেমন হবে, আমিও যদি নষ্ট মেয়ে হই?

মেঘ বলতে আপত্তি কি ? – জয় গোস্বামী – জয় গোস্বামী
মেঘ বলতে আপত্তি কি ?
. বেশ, বলতে পরি
. ছাদের ওপর মেঘ দাঁড়াতো
. ফুলপিসিমার বাড়ি
. গ্রীষ্ম ছুটি চলছে তখন
. তখন মানে ? কবে ?
আমার যদি চোদ্দো, মেঘের ষোলো-সতেরো হবে
. ছাদের থেকে হাতছানি দিতো
. ক্যারাম খেলবি ? … আয় …
. সারা দুপুর কাহাঁতক আর ক্যারম খেলা যায়
. সেই জন্যেই জোচ্চুরি হয়
. হ্যাঁ, জোচ্চুরি হতো
আমার যদি চোদ্দো, মেঘের পনেরো-ষোলো মত।
. ঘুরিয়ে দিতে জানতো খেলা শক্ত ঘুঁটি পেলে
. জায়গা মত সরিয়ে নিতো আঙ্গুল দিয়ে ঠেলে
শুধু আঙ্গুল ? … বোর্ডের উপর লম্বা ফ্রকের ঝুল
. ঝপাং ফেলে ঘটিয়ে দিতো ঘুঁটির দিক ভুল
. এই এখানে … না ওখানে ..
. এই এইটা না ঐটা
. ঝাঁপিয়ে পড়ে ছিনিয়ে নিলো ঘুঁটির বাক্সটা
. ঘুঁটির ও সেই প্রথম মরণ
. প্রথম মরা মানে ?
বুঝবে শুধু তারাই … যারা ক্যারাম খেলা জানে।
চলেও গেলো কদিন পরে .. মেঘ যেমন যায়
কাঠফাটা রোদ দাঁড়িয়ে পড়ল মেঘের জায়গায়
খেলা শেখাও, খেলা শেখাও, হাপিত্যেস কাক
কলসিতে ঠোঁট ডুবিয়ে ছিলো, জল তো পুড়ে খাক
খাক হওয়া সেই কলসি আবার পরের বছর জলে …
. ভরল কেমন তোমায় ? …
. ধ্যাত্, সেসব কি কেউ বলে ? …
. আত্মীয় হয় .. আত্মীয় হয় ? আত্মীয় না ছাই
. সত্যি করে বল এবার, সব জানতে চাই
দু এক ক্লাস এর বয়স বেশি, গ্রীষ্ম ছুটি হলে
ঘুরেও গেছে কয়েক বছর, এই জানে সক্কলে
আজকে দগ্ধ গ্রীষ্ম আমার তোমায় বলতে পারি
মেঘ দেখতাম, ছাদের ঘরে, ফুলপিসিমার বাড়ি।

মেঘবালিকার জন্য রূপকথা – জয় গোস্বামী – জয় গোস্বামী
আমি যখন ছোট ছিলাম
খেলতে যেতাম মেঘের দলে
একদিন এক মেঘবালিকা
প্রশ্ন করলো কৌতুহলে
‘এই ছেলেটা, নাম কি রে তোর?’
আমি বললাম, ফুস মন্তর
মেঘবালিকা রেগেই আগুন,
মিথ্যে কথা, নাম কি অমন হয় কখনো?
আমি বললাম, নিশ্চয়ই হয়, আগে আমার গল্প শোনো
সে বলল, শুনবো না যাঃ, সেই তো রাণী সেই তো রাজা
সেই তো একই ঢাল তলোয়ার
সেই তো একই রাজার কুমার পক্ষিরাজে
শুনবো না আর ওসব বাজে।
আমি বললাম, তোমার জন্য নতুন করে লিখব তবে।
সে বলল, সত্যি লিখবি! বেশ তাহলে মস্ত করে লিখতে হবে।
মনে থাকবে? লিখেই কিন্তু আমায় দিবি।
আমি বললাম, তোমার জন্য লিখতে পারি এক পৃথিবী।
লিখতে লিখতে লেখা যখন সবে মাত্র দু চার পাতা
হঠাৎ তখন ভুত চাপলো আমার মাথায়
খুঁজতে খুঁজতে চলে গেলাম ছোটবেলার মেঘের মাঠে
গিয়েই দেখি, চেনা মুখ তো একটিও নেই এ তল্লাটে
একজনকে মনে হল ওরই মধ্যে অন্যরকম
এগিয়ে গিয়ে বলি তাকেই
তুমি কি সেই মেঘবালিকা, তুমি কি সেই?
সে বলেছে, মনে তো নেই। আমার ওসব মনে তো নেই
আমি বললাম, তুমি আমায় লেখার কথা বলেছিলে।
সে বলল, সঙ্গে আছে? ভাসিয়ে দাও গাঁয়ের ঝিলে।
আর হ্যা, শোন, এখন আমি মেঘ নই আর
সবাই এখন বৃষ্টি বলে ডাকে আমায়।
বলেই হঠাৎ এক পশলায় আমায় পুরো ভিজিয়ে দিয়ে
অন্য অন্য বৃষ্টি বাদল সঙ্গে নিয়ে
মিলিয়ে গেল দূরে কোথায়, দূরে দূরে…।
বৃষ্টি বলে ডাকে আমায়….
বৃষ্টি বলে ডাকে আমায়….আপন মনে বলতে বলতে
আমিই কেবল বসে রইলাম ভিজে এক-সা কাপড় জামায়
গাছের তলায় বসে রইলাম
বৃষ্টি নাকি মেঘের জন্য…
এমন সময় অন্য একটি বৃষ্টি আমায় চিনতে পেরে বলল
তাতে মন খারাপের কি হয়েছে?
যাও ফিরে যাও-লেখ আবার
এখন পুরো বর্ষা চলছে, তাই আমরা সবাই এখন নানান দেশে ভীষণ ব্যস্ত
তুমিও যাও, মন দাও গে তোমার কাজে।
বর্ষা থেকে ফিরে আমরা নিজেই যাব তোমার কাছে।
এক পৃথিবী লিখবো আমি
এক পৃথিবী লিখবো বলে ঘর ছেড়ে সেই বেড়িয়ে গেলাম
ঘর ছেড়ে সেই ঘর বাঁধলাম গহিন বনে
সঙ্গী শুধু কাগজ কলম
একাই থাকব, একাই দুটো ফুটিয়ে খাব
ধুলোবালি দু এক মুঠো যখন যারা আসবে মনে
তাদের লিখব, লিখেই যাব।
এক পৃথিবীর একশ রকম স্বপ্ন দেখার সাধ্য থাকবে যে রূপকথার
সে রূপকথা আমার একার।
ঘাড় গুজে দিন লিখতে লিখতে
ঘাড় গুজে রাত লিখতে লিখতে
মুছেছে দিন মুছেছে রাত
যখন আমার লেখবার হাত অসাড় হল
মনে পড়ল, সাল কি তারিখ, বছর কি মাস
সেসব হিসেব আর রাখি নি।
লেখার দিকে তাকিয়ে দেখি
এক পৃথিবী লিখব বলে একটা খাতাও শেষ করিনি।
সঙ্গে সঙ্গে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি এল খাতার উপর, আজীবনের লেখার উপর
বাইরে তখন গাছের নিচে নাচছে ময়ূর আনন্দিত
এ গাছ ও গাছ উড়ছে পাখি, বলছে পাখি
এই অরণ্যে কবির জন্যে আমরা থাকি
বলছে ওরা, কবির জন্য আমরা কোথাও, আমরা কোথাও, আমরা কোথাও হার মানিনি।
কবি তখন কুটির থেকে, তাকিয়ে আছে অনেক দূরে
বনের পরে মাঠের পরে নদীর পরে
সেই যেখানে সারা জীবন বৃষ্টি পড়ে বৃষ্টি পড়ে
সেই যেখানে কেউ যায়নি, কেউ যায় না কোনদিনই
আজ সে কবি দেখতে পাচ্ছে
সেই দেশে সেই ঝর্ণা তলায়
এদিক ওদিক ছুটে বেড়ায়
সোনায় মোড়া মেঘ হরিণী
কিশোর বেলার সেই হরিণী।

মেঘবালিকার জন্য রূপকথা – জয় গোস্বামী – জয় গোস্বামী
আমি যখন ছোট ছিলাম
খেলতে যেতাম মেঘের দলে
একদিন এক মেঘবালিকা
প্রশ্ন করলো কৌতুহলে
‘এই ছেলেটা, নাম কি রে তোর?’
আমি বললাম, ফুস মন্তর
মেঘবালিকা রেগেই আগুন,
মিথ্যে কথা, নাম কি অমন হয় কখনো?
আমি বললাম, নিশ্চয়ই হয়, আগে আমার গল্প শোনো
সে বলল, শুনবো না যাঃ, সেই তো রাণী সেই তো রাজা
সেই তো একই ঢাল তলোয়ার
সেই তো একই রাজার কুমার পক্ষিরাজে
শুনবো না আর ওসব বাজে।
আমি বললাম, তোমার জন্য নতুন করে লিখব তবে।
সে বলল, সত্যি লিখবি! বেশ তাহলে মস্ত করে লিখতে হবে।
মনে থাকবে? লিখেই কিন্তু আমায় দিবি।
আমি বললাম, তোমার জন্য লিখতে পারি এক পৃথিবী।
লিখতে লিখতে লেখা যখন সবে মাত্র দু চার পাতা
হঠাৎ তখন ভুত চাপলো আমার মাথায়
খুঁজতে খুঁজতে চলে গেলাম ছোটবেলার মেঘের মাঠে
গিয়েই দেখি, চেনা মুখ তো একটিও নেই এ তল্লাটে
একজনকে মনে হল ওরই মধ্যে অন্যরকম
এগিয়ে গিয়ে বলি তাকেই
তুমি কি সেই মেঘবালিকা, তুমি কি সেই?
সে বলেছে, মনে তো নেই। আমার ওসব মনে তো নেই
আমি বললাম, তুমি আমায় লেখার কথা বলেছিলে।
সে বলল, সঙ্গে আছে? ভাসিয়ে দাও গাঁয়ের ঝিলে।
আর হ্যা, শোন, এখন আমি মেঘ নই আর
সবাই এখন বৃষ্টি বলে ডাকে আমায়।
বলেই হঠাৎ এক পশলায় আমায় পুরো ভিজিয়ে দিয়ে
অন্য অন্য বৃষ্টি বাদল সঙ্গে নিয়ে
মিলিয়ে গেল দূরে কোথায়, দূরে দূরে…।
বৃষ্টি বলে ডাকে আমায়….
বৃষ্টি বলে ডাকে আমায়….আপন মনে বলতে বলতে
আমিই কেবল বসে রইলাম ভিজে এক-সা কাপড় জামায়
গাছের তলায় বসে রইলাম
বৃষ্টি নাকি মেঘের জন্য…
এমন সময় অন্য একটি বৃষ্টি আমায় চিনতে পেরে বলল
তাতে মন খারাপের কি হয়েছে?
যাও ফিরে যাও-লেখ আবার
এখন পুরো বর্ষা চলছে, তাই আমরা সবাই এখন নানান দেশে ভীষণ ব্যস্ত
তুমিও যাও, মন দাও গে তোমার কাজে।
বর্ষা থেকে ফিরে আমরা নিজেই যাব তোমার কাছে।
এক পৃথিবী লিখবো আমি
এক পৃথিবী লিখবো বলে ঘর ছেড়ে সেই বেড়িয়ে গেলাম
ঘর ছেড়ে সেই ঘর বাঁধলাম গহিন বনে
সঙ্গী শুধু কাগজ কলম
একাই থাকব, একাই দুটো ফুটিয়ে খাব
ধুলোবালি দু এক মুঠো যখন যারা আসবে মনে
তাদের লিখব, লিখেই যাব।
এক পৃথিবীর একশ রকম স্বপ্ন দেখার সাধ্য থাকবে যে রূপকথার
সে রূপকথা আমার একার।
ঘাড় গুজে দিন লিখতে লিখতে
ঘাড় গুজে রাত লিখতে লিখতে
মুছেছে দিন মুছেছে রাত
যখন আমার লেখবার হাত অসাড় হল
মনে পড়ল, সাল কি তারিখ, বছর কি মাস
সেসব হিসেব আর রাখি নি।
লেখার দিকে তাকিয়ে দেখি
এক পৃথিবী লিখব বলে একটা খাতাও শেষ করিনি।
সঙ্গে সঙ্গে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি এল খাতার উপর, আজীবনের লেখার উপর
বাইরে তখন গাছের নিচে নাচছে ময়ূর আনন্দিত
এ গাছ ও গাছ উড়ছে পাখি, বলছে পাখি
এই অরণ্যে কবির জন্যে আমরা থাকি
বলছে ওরা, কবির জন্য আমরা কোথাও, আমরা কোথাও, আমরা কোথাও হার মানিনি।
কবি তখন কুটির থেকে, তাকিয়ে আছে অনেক দূরে
বনের পরে মাঠের পরে নদীর পরে
সেই যেখানে সারা জীবন বৃষ্টি পড়ে বৃষ্টি পড়ে
সেই যেখানে কেউ যায়নি, কেউ যায় না কোনদিনই
আজ সে কবি দেখতে পাচ্ছে
সেই দেশে সেই ঝর্ণা তলায়
এদিক ওদিক ছুটে বেড়ায়
সোনায় মোড়া মেঘ হরিণী
কিশোর বেলার সেই হরিণী।

যে-ছাত্রীটি নিরুদ্দেশ হয়ে যাবে – জয় গোস্বামী – জয় গোস্বামী
কী বুঝেছে সে-মেয়েটি ?
সে বুঝেছে রাজুমামা মায়ের প্রেমিক।
কী শুনেছে সে-মেয়েটি ?
সে শুনেছে মায়ের শীৎকার।
কী পেয়েছে সে-মেয়েটি ?–সে পেয়েছে জন্মদিন ?
চুড়িদার, আলুকাবলি–কু-ইঙ্গিত মামাতো দাদার।
সে খুঁজেছে ক্লাসনোট, সাজেশন–
সে ঠেলেছে বইয়ের পাহাড়
পরীক্ষা, পরীক্ষা সামনে–দিনে পড়া, রাতে পড়া–
ও পাশের ঘর অন্ধকার
অন্ধকারে সে শুনেছে চাপা ঝগড়া, দাঁত নখ,
ছিন্ন ভিন্ন মা আর বাবার।

রাস্তায় পড়েছে ব্রিজ–জল নেই–বালি – জয় গোস্বামী
রাস্তায় পড়েছে ব্রিজ–জল নেই–বালি
রাস্তায় পড়েছে শুকনো ধুলো ও আগাছা ভরা বিরাট ইঁদারা
শ্মশান? পড়েছে তাও–
চিতায় চাদর ঢেকে শুনেছিল যারা
তারা কাজে বেরিয়েছে প্রান্তরে, কামান গাড়ি ঠেলে
হঠাৎ কোথায় হাওয়া? চাপাচুপি খড়ের নিঃশ্বাস?
কবরে, বোমার গর্তে ঝুঁকে ঝুঁকে দেখি
মা, আর মায়ের হাতে মুখ চাপা অনাথ।

রেণু মা, আমার ঘরে তক্ষক ঢুকেছে – জয় গোস্বামী
রেণু মা, আমার ঘরে তক্ষক ঢুকেছে
তক্-খো, তক্-খো–তার ডাক
রেনু মা, সংকেতগাছ দূরে দাঁড়িয়েছে
জ্যোৎস্না লেগে পুড়ে গেছে কাক
আমি সে-গাছের ডালে, দড়ি ভেবে, সর্প ধরে উঠি
সর্প থেকে বিষ খসে যায়
রেণু মা, তোমার হাতে তালি বাজে–রাতের আকাশে
ডানা মেলে জ্যোতির্ময় তক্ষক পালায়

শবগাছ, হাত-মেলা মানুষ – জয় গোস্বামী
শবগাছ, হাত-মেলা মানুষ
তার সামনে দিয়ে জলধারা
চলে গেছে শেষ প্রান্তে, বহুদূর ভোরের ভিতরে
স্বল্প আলোকিতমুখ গুহাটির গলা অব্দি জল…
ওই পারে দিন
এপারে সমাপ্তি কবি, যার মুখ সূর্যাস্তরঙিন!

শান্তি শান্তি শান্তি শান্তি যখন সোনালী পাগলিনী – জয় গোস্বামী
শান্তি শান্তি শান্তি শান্তি যখন সোনালী পাগলিনী
তীরে বসে বসে খায় সূর্যাস্ত একের পর এক
হা সমুদ্র জলরাশি শুকিয়ে রক্তাভ বালিখাত
পিছনে শহর মরা ইটকাঠ ইটকাঠ স্তূপ
ভোর দ্বিপ্রহর ধ্বংস, সন্ধ্যা বা নিশীথকাল শেষ
বাতাসে গর্জনশীল সোনাগুঁড়ো বালিগুঁড়ো শুষে
শান্তি শান্তি শান্তি ডাকে তীরে যে-সহিংস পাগলিনী
সূর্যেরা কেবলই অস্তে চলে তার গণ্ডূষে গণ্ডূষে…

শাসকের প্রতি – জয় গোস্বামী
আপনি যা বলবেন
আমি ঠিক তাই কোরবো
তাই খাবো
তাই পরবো
তাই গায়ে মেখে ব্যাড়াতে যাবো
কথাটি না বলে
বললে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে থাকবো সারা রাত
তাই থাকবো
পরদিন যখন বলবেন
এবার নেমে এসো
তখন কিন্তু লোক লাগবে আমাকে নামাতে
একা একা নামতো পারবো না
ও টুকু পারি নি বলে
অপরাধ নেবেন না যেন


শিরচ্ছেদ, এখানে, বিষয় – জয় গোস্বামী
শিরচ্ছেদ, এখানে, বিষয়।
মাটি তাই নরম, কোপানো।
সমস্ত প্রমাণ শুষছে ভয়
কখনো বোলো না কাউকে কী জানো, বা, কতদূর জানো।

আরও পড়ুন: