Site icon Bangla Gurukul [ বাংলা গুরুকুল ] GOLN

“কবিরঞ্জন” রামপ্রসাদ সেন: শাক্তভক্তি, সংগীত ও বাংলার লোকচেতনায় এক প্রগাঢ় নাম

বাংলা লোকসংস্কৃতি ও শাক্তভক্তিমূলক সংগীতের ধারায় একটি উজ্জ্বল নাম হলেন রামপ্রসাদ সেন, যিনি সাধারণত পরিচিত কবিরঞ্জন” নামে। ১৮শ শতকের মধ্যভাগে জন্ম নেওয়া এই গীতিকবি ও সাধক শুধু বাংলা সাহিত্যের নয়, লোকসংগীত, ধর্মীয় চেতনা এবং শাক্তধর্মের ইতিহাসেও এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। তাঁর রচিত “রামপ্রসাদী গান” বাংলার ঘরে ঘরে মা কালীর বন্দনার অংশ হয়ে উঠেছে, যা গভীর আবেগ, দর্শন ও আত্মনিবেদনে পূর্ণ।

জীবনের পটভূমি

রামপ্রসাদ সেনের জন্ম হয় পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার কামারপুকুরের কাছাকাছি একটি গ্রামে, প্রায় ১৭১৮ খ্রিষ্টাব্দে (মতান্তরে ১৭২৩)। তিনি এক মধ্যবিত্ত ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। কৈশোর থেকেই ঈশ্বরভক্তি, সাধন ও সংগীতচর্চায় তিনি আকৃষ্ট হন। পিতা রামরাম সেন চেয়েছিলেন ছেলেকে সংস্কৃত শাস্ত্রে পারদর্শী করে তুলতে, কিন্তু রামপ্রসাদের ঝোঁক ছিল শাক্তসাধনা ও সংগীতের দিকে।

কবি ও সাধক হিসেবে উত্থান

রামপ্রসাদ সেনের কাব্যচর্চা এবং গীতিকবিতায় ছিল এক অনন্য বৈশিষ্ট্য—তিনি ঠাকুর মা কালীকে মায়ের মতো করে ডাকতেন, কখনও সন্তানসুলভ আবদারে, কখনও প্রেমিকসুলভ নিবেদন আর কখনও ভক্তের আত্মনিবেদিত কণ্ঠে। তাঁর গানগুলিকে “রামপ্রসাদী গান” বলা হয়, এবং এগুলো মূলত শাক্তপদাবলি। তিনি শাক্তভাবান্ধব তন্ত্র ও পুরাণসাহিত্যের জ্ঞানকে সহজভাষায় ও সুরে রূপান্তর করে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেন।

রামপ্রসাদী গানের বৈশিষ্ট্য

রামপ্রসাদের গানগুলি মূলত নির্ভরতা, প্রেম, দুঃখ আত্মার উন্মোচনের গান। তাঁর গানগুলিতে দেখা যায়, মা কালীর প্রতি এক নিখাদ প্রেম ও উজাড় করা আত্মনিবেদন। উদাহরণস্বরূপ:

“তোকে আর ধরব না মা, ছাড়বই তোকে…”

এই ধরনের গানগুলি একজন ঈশ্বরভক্ত মানুষের জীবনের গভীর যন্ত্রণা, আনন্দ ও আত্মত্যাগের এক জীবন্ত দলিল। তাঁর কবিতার ভাষা ছিল সরল, হৃদয়স্পর্শী এবং সুরবদ্ধ—যা সাধকদের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে।

লোকায়ত দর্শন ও সাধারণ মানুষের কাছে জনপ্রিয়তা

রামপ্রসাদ সেন এমন এক সময়ে গান লিখেছিলেন, যখন সমাজে অন্ধবিশ্বাস ও কঠোর ধর্মীয় অনুশাসনের প্রভাব প্রবল ছিল। তিনি ধর্মকে প্রাণের বিষয় হিসেবে দেখেছিলেন, যেখানে ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি নিছক আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং এক আত্মিক সম্পর্ক। তাঁর গানগুলি সাধারণ মানুষকে ঈশ্বরের সান্নিধ্যে নিয়ে যেতে সহায়তা করে, কারণ সেগুলো ছিল হৃদয়গ্রাহী এবং জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতায় গাঁথা।

কবিরঞ্জন নামে পরিচিতি

“কবিরঞ্জন” উপাধিটি রামপ্রসাদ সেনের ক্ষেত্রে এক বিশেষ অর্থ বহন করে। “কবি” ও “রঞ্জন”— অর্থাৎ যিনি কবিতার মাধ্যমে মাতৃভাবকে রঞ্জিত করেন, ঈশ্বরকে আনন্দ দেন। রামপ্রসাদের কাব্য ও সংগীত ঈশ্বরকে তুষ্ট করে বলেই তাঁকে “কবিরঞ্জন” বলা হয়। তিনি ছিলেন সাধক-কবি, তাই তাঁর কবিতা ও গান শুধু শিল্প নয়, ছিল আরাধনা।

প্রভাব ও উত্তরাধিকার

রামপ্রসাদের পরবর্তী অনেক সাধক, কবি ও সংগীতশিল্পী তাঁর গান ও কাব্যচর্চা অনুসরণ করেন। রামপ্রসাদী ধারায় রচিত গান গেয়েছেন কামিনীকুমার সাহা, দীনেশচন্দ্র সেন, ভবানী দত্ত, এমনকি নজরুল ও রবীন্দ্রনাথও রামপ্রসাদকে স্মরণ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, “রামপ্রসাদের গান বাংলা সাহিত্যে এক অনুপম সম্পদ।”

 

কবিরঞ্জন রামপ্রসাদ সেন

 

রামপ্রসাদ সেন বা কবিরঞ্জন ছিলেন বাংলার চৈতন্যজাগ্রত সাধনা ও শাক্তভক্তির এক অগ্রদূত। তিনি গান ও সাধনার মাধ্যমে ঈশ্বরচেতনার যে প্রবাহ সৃষ্টি করেছিলেন, তা আজও অম্লান। লোককবিতা, শাস্ত্র ও জীবনের মধ্যে তিনি এক সেতুবন্ধন রচনা করেছিলেন যা বাংলা সংস্কৃতিকে দিয়েছে এক পরম মূল্যবান ঐতিহ্য। তাঁর জীবন ও কাব্য আজও ধর্মীয়তা, মানবতা ও সাহিত্যিক অভিব্যক্তির এক অনন্য দৃষ্টান্ত।

Exit mobile version