উন্নয়নে নারী সমাজের ভূমিকা সম্পর্কে মঞ্চ ভাষণ | ভাষণ | ভাষা ও শিক্ষা

উন্নয়নে নারী সমাজের ভূমিকা সম্পর্কে মঞ্চ ভাষণ এর একটি খসড়া তৈরি করে দেয়া হলো শিক্ষার্থীদের সুবিধার্থে এই পাঠটি “ভাষা ও শিক্ষা” সিরিজের,  “ভাষণ” বিভাগের একটি পাঠ|

উন্নয়নে নারী সমাজের ভূমিকা সম্পর্কে মঞ্চ ভাষণ

‘জাতি গঠনে । উন্নয়নে নারী সমাজের ভূমিকা’ বিষয়ে আয়োজিত এই মহতী অনুষ্ঠানের সম্মানিত সভাপতি, মাননীয় প্রধান অতিথি, মঞ্চে উপবিষ্ট সম্মানিত আলোচকবৃন্দ এবং উপস্থিত সুধীবৃন্দ, আজ অত্যন্ত একটি প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আমরা আলোচনায় অংশ নিচ্ছি। জাতি গঠনে নারী বা উন্নয়নে নারী— অভিধানে একটি অতি আধুনিক সংযোজন এবং একটি ধারণা যা বৈশ্বিক ও জাতীয় পর্যায়ে সামাজিক এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে নারীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা বা অবদানকে স্বীকার করে। জাতি গঠনে নারী বা উন্নয়নে নারী ধারণাটি এও বোঝায় যে নারীরা উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত এবং উন্নয়নে তাদের অংশগ্রহণের পরিবেশ অনুকূল করা অত্যাবশ্যক। জাতি গঠনে নারীসমাজের ভূমিকা যে অনস্বীকার্য তা আমরা জাতীয় কবি নজরুলের কবিতাতেই পাই—

‘বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর/ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।’

সম্মানিত সুধীবৃন্দ, আজ নবযুগের নবীন প্রভাতে দিকে দিকে নারী প্রগতির জয়ধ্বনি ঘোষিত হচ্ছে। নারী এতকাল ছিল পুরুষের ওপর নির্ভরশীল। নারীর কোনো স্বতন্ত্র সত্তা স্বীকৃত ছিল না। নারীর পরিচয় ছিল কখনো কন্যারূপে, কখনো ভগ্নীরূপে, কখনো পত্নীরূপে, কখনো মাতারূপে। সর্বত্রই ছিল তার গণগ্রহতা ও অসহায়তার প্রকট রূপ। কিন্তু নারী আজ আর সেই বিগত শতাব্দীর অন্ধকারাচ্ছন্ন অন্তঃপুরে মৌনম্লান মুখে বসে নেই। সে সেই আলোহীন, প্রাণহীন দুর্ভেদ্য অন্তরাল থেকে বের হয়ে আজ আলোকিত জগতের উদার প্রাঙ্গণে এসে দাঁড়িয়েছে। আজ আমরা বুঝতে পেরেছি, নারী ও পুরুষ সমাজ-জীবনের দুটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। সমাজ গঠনে উভয়েরই সমান ভূমিকা রয়েছে। দেশ ও জাতির সার্বিক উন্নয়নের জন্যে নারী-পুরুষ উভয়ের ভূমিকাই গুরুত্বপূর্ণ। সুধীবৃন্দ, ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকেই এ উপমহাদেশে নারী জাগরণের উন্মেষ ঘটে।

 

উন্নয়নে নারী সমাজের ভূমিকা সম্পর্কে মঞ্চ ভাষণ

 

ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলন, পাকিস্তান আমলে ভাষা আন্দোলন, ‘৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান এবং স্বাধিকার আন্দোলনেও নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল অসাধারণ। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও অসামান্য অবদান রাখে। বর্তমানে দেশের জাতীয় উৎপাদনে নারীর অংশগ্রহণ ও অবদান চোখে পড়ার মতো। বর্তমানে প্রশাসনের এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যেখানে নারী তার কর্মের মধ্য দিয়ে অবদান না রাখছে। বাংলাদেশে নারী শ্রমশক্তির পরিমাণ প্রায় ২৫ মিলিয়ন। এর মধ্যে কয়েক লক্ষ নারী নিয়োজিত প্রশাসনিক ও ব্যবস্থাপনা পেশায়।

প্রায় ৭৯% নারী কাজ করে কৃষিখাতে (মৎস্য ও বনায়ন সহ), ৯.৯% নারী কাজ করে ম্যানুফ্যাকচারিং ও পরিবহণ খাতে, ২.২% নারী বিপনন শ্রমিক ও ০.৬% নিয়োজিত করণিক পর্যায়ের কাজে সুধী, নারীসমাজ আজ স্বাবলম্বী হয়ে ঘরে বসে কিংবা বাইরে গিয়ে জামা-কাপড় সেলাই, সূচিকাজ, বাঁশ ও বেতের বিভিন্ন সামগ্রী তৈরি করে পরিবারের ভরণপোষণের ব্যবস্থা করছে। দেশের প্রধানমন্ত্রী, দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের প্রধান হিসেবে এবং বিমানের পাইলট থেকে শুরু করে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, জজ, ম্যাজিস্ট্রেট, উকিল, দারোগা, পুলিশ, শিক্ষক, চলচ্চিত্র নির্মাণ, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী, প্রশাসক, মডেলিং, ফ্যাশন ডিজাইনিংসহ এমন কোনো পেশা নেই যেখানে নারীরা তাদের মর্যাদাপূর্ণ উপস্থিতি ঘোষণা করে নি।

দারিদ্র্যের কষাঘাতে পিষ্ট হয়েও নারীরা পিছু হটে নি বরং দারিদ্র্যকে পিছনে ফেলে কাঙ্ক্ষিত সাফল্যে পৌঁছেছেন এমন নারীর সংখ্যাও কম নয়। উদাহরণস্বরূপ নড়াইল জেলার লোহাগড়া উপজেলার চোরখালী গ্রামের কুলসুম বেগম, নেত্রকোণার দুর্গাপুর উপজেলার দশাল গ্রামের রহিমা বেগম এবং রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার পরিদাপাড়া গ্রামের স্বামী পরিত্যক্তা আরজিনা খাতুন। সহায়সম্বলহীন এই নারীরা সামান্য পুঁজি নিয়ে ব্যবসায় করে আজ সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। সুতরাং জাতি গঠনে নারীর ভূমিকা নিয়ে আজ আর কারও মনে কোনো দ্বিমত নেই।

 

আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

সুধীবৃন্দ, আপনারা জানেন, শিল্পশ্রমে নারীর অধিক সংখ্যায় অংশগ্রহণ আজ বাংলাদেশের শ্রমবাজারের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। বিশেষভাবে পোশাক শিল্পে নারীসমাজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ও অবদান রাখছে। অন্যান্য শিল্প, যেমন : ক্যামিকেল, রাবার, প্লাস্টক, পাট, বস্ত্র, চর্ম ইত্যাদি শিল্পেও নারীর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। বর্তমানে দেশে নারী শিক্ষার হারও কম নয়। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পেশায় নারীদের অংশগ্রহণ ও অবদান বস্তুত দেশ ও জাতি গঠনে নারীদের অবদানেরই নামান্তর। আর এ জন্যই নেপোলিয়ান বলেছিলেন, “আমাকে একটি শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের একটি শিক্ষিত জাতি উপহার দেব।”

তাঁর এ উক্তি থেকেও বোঝা যায়, দেশ ও জাতি গঠনে নারীসমাজের ভূমিকা কতটা অগ্রগণ্য। নারীর অমর্যাদা করে, তার প্রতি বৈষম্য জিইয়ে রেখে এবং তাকে শোষণের শিকার বানিয়ে পারিবারিক শান্তি, সামাজিক অগ্রগতি কিংবা জাতীয় উন্নতি কোনোটাই সম্ভব হবে না। নারীকে দেখতে হবে মানুষ হিসেবে। নারী এবং পুরুষের মাঝে প্রকৃতিপ্রদত্ত পার্থক্য যেমন স্বাভাবিক, তেমনি মানবসৃষ্ট বৈষম্য অপরিসীম। নারীমুক্তির পথ খুঁজতে হবে দেশ ও সমাজের বাস্তবতায়, জাতির মূল্যবোধ ও ঐতিহ্যের মাঝে।

 

উন্নয়নে নারী সমাজের ভূমিকা সম্পর্কে মঞ্চ ভাষণ

 

প্রকৃত প্রস্তাবে, আমরা চাই, শিক্ষা-দীক্ষায়, কৃষ্টি ও সংস্কৃতিতে একটি সুখী সমৃদ্ধ আদর্শ পরিবার রচনায় নারীর ভূমিকা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি দেশ ও জাতি গঠনে নারীর ভূমিকা হবে অবিস্মরণীয়। মোট কথা, আমাদের সমাজে আমরা চাই আদর্শ জননী, চাই আদর্শ পত্নী, চাই আদর্শ কন্যা- আদর্শ জীবন, সমাজ ও দেশ গঠনে চাই নারীসমাজের ভূমিকা । পরিশেষে যারা অক্লান্ত পরিশ্রম করে আজকের এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আমাকে কিছু বলার সুযোগ করে দিয়েছেন এবং এতক্ষণ যারা অসীম ধৈর্য নিয়ে আমার বক্তব্য শুনেছেন— আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ।

আরও দেখুন:

Leave a Comment