ইন্টারনেট এর গুরুত্ব বর্ণনা করে মঞ্চ ভাষণ রচনা | ভাষণ | ভাষা ও শিক্ষা আজকের এই মহতী অনুষ্ঠানের সম্মানিত সভাপতি, মাননীয় প্রধান অতিথি, মঞ্চে উপবিষ্ট সম্মানিত আলোচকবৃন্দ এবং উপস্থিত সুধীবৃন্দ, বর্তমান বিশ্বে তথ্যপ্রযুক্তির বৈপ্লবিক বিস্তার দেখে আমাদের বিস্মিত হতে হয়। আজ যে কোনো মানুষ ঘরে বসেই একটি ছোট্ট মনিটরের পর্দায় (কম্পিউটার মনিটরে) সারা দুনিয়া ঘুরে আসতে পারে। সবই হচ্ছে বিজ্ঞানের বিস্ময়কর আবিষ্কার ইন্টারনেটের কল্যাণে। ভৌগোলিক সীমারেখা পার হওয়া ছাড়াই একের জীবন জুড়ে যাচ্ছে হাজার লক্ষ- কোটি মানুষের সঙ্গে। দিন দিন এক অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে বেড়ে চলেছে ইন্টারনেটের প্রয়োগের ক্ষেত্র ও প্রয়োজনীয়তা।
ইন্টারনেট এর গুরুত্ব বর্ণনা করে মঞ্চ ভাষণ রচনা
কম্পিউটার ও ইন্টারনেটকে বাদ দিয়ে আধুনিক সভ্যতার কথা কল্পনাও করা যায় না। তাই ইন্টারনেটের গুরুত্ব অনুধাবন না করে আমাদের দ্বিতীয় কোনো পথ নেই। ইন্টারনেট সম্পর্কে আমাদের অল্প-বিস্তর জ্ঞান থাকা চাই। চাই, ইন্টারনেট ব্যবহারের পদ্ধতি ও এর প্রয়োগের ক্ষেত্র সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা দেখাত ও এর সুধী, আপনারা সবাই জানেন যে, ইন্টারন্যাশনাল কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সার্ভিস ইন্টারনেট নামে পরিচিত। এটি কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সমূহের একটি বিশ্বব্যবস্থা। কোনো নেটওয়ার্কভুক্ত কম্পিউটারের সঙ্গে অন্য নেটওয়ার্কভুক্ত কম্পিউটারের সঙ্গে নেটওয়ার্ক গড়ে তোলাই ইন্টারনেটের কাজ।
বিভিন্ন নেটওয়ার্ক একত্র হয়ে পৃথিবীব্যাপী যে নেটওয়ার্ক সিস্টেম তৈরি হয় তাকেই ইন্টারনেট বলে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে পৃথিবীর এক প্রান্তের কম্পিউটার থেকে অন্য প্রান্তের আর একটি কম্পিউটারে ছবিসহ যাবতীয় তথ্য দ্রুত সংগ্রহ ও প্রেরণ করা যায়। ইন্টারনেট একটি বিশাল নেটওয়ার্কিং সিস্টেম যার বিস্তৃতি পৃথিবীময়। বিশ্বের লাখ লাখ বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানসহ কোটি কোটি লোকের ব্যক্তিগত কম্পিউটারের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে ইন্টারনেট। আর ইন্টারনেট সংযুক্তিকরণের জন্যে সর্বপ্রথম প্রয়োজন একটি কম্পিউটার। কম্পিউটারের সঙ্গে লাগবে একটি মডেম। আর লাগবে নিজস্ব টেলিফোন লাইন।
ইন্টারনেট সার্ভিস দেয় এমন কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে নির্দিস্ট মাসিক ফি-র বদলে সংযোগ নিতে হয়। সুধীমণ্ডলী, এটা আর বলার অবকাশ রাখে না যে, ইন্টারনেটের মাধ্যমে নানারকম সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায়। ইন্টারনেটের শত-সহস্র ব্যবহারিক সুবিধার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ দু-একটি উল্লেখ না করলেই নয়। আপনারা হয়তো জানেন— ইন্টারনেটে নিউজগ্রুপ ব্যবহার করে বিশ্বের খবরাখবরসহ নানা তথ্য, তত্ত্ব জানা যায়। বিশেষ করে গবেষণাধর্মী বইয়ের জন্যে অনেককে বিদেশে যেতে হয়।
কিন্তু ইন্টারনেটের মাধ্যমে বাংলাদেশে বসে আমেরিকার ‘ইউনাইটেড স্টেট অব কংগ্রেস’ বা হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিসহ বিশ্বের যে কোনো লাইব্রেরির সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা যায় এবং দুষ্প্রাপ্য তথ্যাদি জানা যায়। এর সাহায্যে এক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আরেক প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায় – বাণিজ্য সম্পর্কিত লেনদেন সম্পাদন করা যায়। ইন্টারনেটের মাধ্যমে ঘরে বসেই দেশ-বিদেশের আইনি যে কোনো পরামর্শ লাভ করা যায়। ভ্রমণের ক্ষেত্রেও ইন্টারনেট অত্যন্ত সহজ পথের সন্ধান এনে দিয়েছে। অফিসের হাজারো ফাইলের মধ্য থেকে প্রয়োজনীয় ফাইলটি খুঁজে বের করা যায় ইন্টারনেটের ‘Archi’ পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে।

ইন্টারনেটের সুবাদে ঘরে বসেই উন্নত চিকিৎসা লাভ করা যায়। বর্তমানে ব্যাংকেও ইন্টারনেট ব্যবহৃত হচ্ছে। তাছাড়া বিভিন্ন ধরনের খেলা, গান শোনা, সিনেমা দেখা, রান্না শেখা, ফ্যাশন সম্পর্কে জানা এমনকি বিয়ের সম্পর্কও করা যায় ইন্টারনেটের মাধ্যমে। এভাবেই ইন্টারনেট বিভিন্ন কাজের এক সহজ মাধ্যম হিসেবে সুযোগ সৃষ্টি করেছে। সুধী, আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির অন্যতম অবদান হলো ইন্টারনেট। এর সাহায্যে আমরা যে যেখানেই থাকি না কেন পরস্পরের সঙ্গে মতবিনিময় করতে পারি, প্রত্যেকের জন্য তথ্যপ্রবাহ নিশ্চিত করতে পারি। মানব ইতিহাসে ইন্টারনেটই হচ্ছে সবচেয়ে উন্মুক্ত নেটওয়ার্ক।
এই প্রযুক্তির মধ্য দিয়ে সরাসরি স্পর্শ করতে না পারলেও আমাদের ধারণা, আবেগ, অনুভূতিকে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি বিনিময় করতে পারি বস্তুত গত দুই দশকে বিশ্বজুড়ে তথ্যপ্রযুক্তিতে ঘটেছে অভাবনীয় সব পরিবর্তন ও সাফল্য। মানুষ তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে সময় ও দূরত্বকে জয় করেছে। বাংলাদেশেও তথ্য প্রযুক্তির এ জীয়নকাঠির স্পর্শে ধীরে ধীরে জেগে উঠেছে। দেশে তথ্যপ্রযুক্তির উল্লেখযোগ্য বিকাশ ঘটেছে। আর এই তথ্য প্রযুক্তির মূল হোতা ইন্টারনেট। বর্তমান সরকারের “ডিজিটাল বাংলাদেশ’— এর পথে তথ্য-যোগাযোগ প্রযুক্তিতে বিপ্লব সাধিত হবে বলে আশা করা যায়।
তরুণসমাজ দেশের প্রাণ ও ভবিষ্যৎ। এ তরুণ সমাজকে কম্পিউটার ও আইসিটি বিষয়ে শিক্ষিত করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে ৬৪ জেলার ১২৮টি সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ১৬টি কম্পিউটার, ২টি প্রিন্টার, ১টি মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর এবং ইন্টারনেট সংযোগসহ একটি পূর্ণাঙ্গ কম্পিউটার ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে। কম্পিউটার ও তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগসহ কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আমদানী-রপ্তানী, সরকারি-বেসরকারিসহ সকল কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রিত হবে অটোমেটিক ডিজিটাল পদ্ধতিতে।
তথ্য প্রযুক্তি সেবায় প্রবেশাধিকার বৃদ্ধির মাধ্যমে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য বিমোচন ও ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে দেশের ৫টি এলাকায় কমিউনিটি ই-সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। কমিউনিটি ই-সেন্টারের উল্লেখযোগ্য সেবাসমূহ হচ্ছে : কম্পিউটার ব্যবহার, ইন্টারনেট, ইমেইল, ওয়েবসাইট ব্রাউজিং, কৃষিস্বাস্থ্য ও শিক্ষা সংক্রান্ত তথ্য, ইন্টারনেট বা অনলাইন ভিডিও কনফারেন্স, কৃষি পণ্যের বাজার সংক্রান্ত তথ্য, চাকরি সংক্রান্ত তথ্য, ইন্টারনেট বা অনলাইনে আবেদপত্র জমা, সরকারি বিভিন্ন ফরম, হজ্ব সংক্রান্ত ফরম, জাতীয় পরীক্ষার ফল, অনলাইনে পণ্য বেচাকেনা, দেশি-বিদেশি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি সংক্রান্ত তথ্য, ডিজিটাল ফটো ও ভিডিও এবং শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের জন্য তথ্য প্রযুক্তি প্রশিক্ষণ।
এসব কার্যক্রম পরিচালনায় সরকারি পর্যায়ে ১৪টি ইউনিয়ন তথ্যকেন্দ্র, ২০টি কৃষি তথ্য ও যোগাযোগকেন্দ্র এবং ২১টি মৎস্য তথ্য ও যোগাযোগ কেন্দ্রসহ সারাদেশে এখন ২ হাজারেরও বেশি অনুরূপ কেন্দ্র গড়ে ওঠেছে। বিভাগ, জেলা ও উপজেলার মধ্যে নেটওয়ার্ক স্থাপনের জন্যে ‘গভনেট’ প্রকল্প চালু হয়েছে। এর আওতায় মন্ত্রণালয়, বিভাগ, জেলা ও ৬৪টি উপজেলার মধ্যে নেটওয়ার্ক চালু করা হয়েছে। ক্রমান্বয়ে সমগ্র বাংলাদেশকে পরিণত করা হবে ডিজিটাল বাংলাদেশে। সুধী, পৃথিবী বদলে যাচ্ছে। নতুন পৃথিবী, নতুন স্বপ্ন। পৃথিবীর মানুষ এই নতুন স্বপ্নে বিভোর।
আমরা বুঝতে পারছি না পৃথিবীতে নতুন যুগের সূচনা হয়েছে, নতুন রেনেসাঁস। এই নতুন রেনেসাঁস ও নতুন জীবনদর্শনের তাৎপর্যই আলাদা । এই নতুন জীবনদর্শনের মূল কথাই হচ্ছে জীবনকে ঋদ্ধ ও পরিপূর্ণ করা। সেজন্যই এতো আয়োজন, এতো উদ্যোগ, এতো শ্রম ও সাধনা। জ্ঞানে, বিজ্ঞানে, নৈপুণ্যে, দক্ষতায়, শিল্পে, সাহিত্যে, সঙ্গীতে, ক্রীড়ায়, আবিষ্কারে, উদ্ভাবনে। সে তার শ্রম ও সাধনায় আলোকিত, বিকশিত, উদ্ভাসিত করছে পৃথিবী। আর এ-সবকিছুর মূলে রয়েছে তথ্যপ্রযুক্তি । তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোতে আজ আধুনিক প্রযুক্তিবিদ্যার প্রবেশ অপরিহার্য। কম্পিউটার ইন্টারনেটকেও আজ আর ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব নয়।
অনিবার্যভাবেই তার আগমন ঘটে গেছে সারা দুনিয়ায়। বিজ্ঞানের এসব নিত্যনতুন সৃষ্টি ও উপযোগিতা সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানার্জনের জন্য এবং ব্যবহারিক জীবনে তা সঠিকভাবে কাজে লাগানোর জন্য বিজ্ঞানের এ-বিস্ময়কর আবিষ্কার সম্পর্কে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। পরিশেষে যারা অক্লান্ত পরিশ্রম করে আজকের এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আমাকে কিছু বলার সুযোগ করে দিয়েছেন এবং এতক্ষণ যারা অসীম ধৈর্য নিয়ে আমার বক্তব্য শুনেছেন— আপনাদের সবাইকে আবারও ধন্যবাদ।