আলোকিত মানুষ চাই শীর্ষক আলোচনা সভায় মঞ্চ ভাষণ | ভাষণ | ভাষা ও শিক্ষা

আলোকিত মানুষ চাই শীর্ষক আলোচনা সভায় মঞ্চ ভাষণ | ভাষণ | ভাষা ও শিক্ষা ‘আলোকিত মানুষ চাই’ শীর্ষক আলোচনা সভার সম্মানিত সভাপতি, আমন্ত্রিত আলোচকবৃন্দ ও সুধীবৃন্দ— সকলের প্রতি আমার আন্তরিক সালাম ও শুভেচ্ছা। আজকের এই আলোচনা আমাদের নাগরিক সচেতনতারই নিদর্শন। আজ সময়োপযোগী একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রধান বক্তা হিসেবে বক্তৃতাদানের সুযোগ পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে করছি। এজন্য সভার আয়োজকদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। সুধীবৃন্দ, ‘আলোকিত মানুষ চাই’ কথাটি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গেই একজন মহৎপ্রাণ ও সাদা মনের মানুষ অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ-এর কথা সম্মাণের সঙ্গে স্মরণ করতে হয়। তিনি প্রায়ই বলে থাকেন এবং তাঁর প্রতিটি লেখাতেই দেখা যায় আলোকিত মানুষের কথা।

আলোকিত মানুষ চাই শীর্ষক আলোচনা সভায় মঞ্চ ভাষণ

 

অর্থাৎ কোনো দেশ বা কোনো জাতি সভ্য ও উন্নত হবে যদি সে দেশ বা জাতিতে আলোকিত মানুষ বেশি থাকে। তাই জাতির উন্নয়নে আলোকিত সমাজ গড়তে হবে। সুধী, ১৯৭১ সালে যুদ্ধ জয়ের মাধ্যমে আমরা অর্জন করি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। অর্জন করি গাঢ় সবুজের বুকে লাল সূর্য আঁকা চির-গৌরবের দীপ্তিময় পতাকা। অনেক রক্তের বিনিময়ে আমরা অর্জন করেছি আমাদের স্বাধীনতা, আমাদের বিজয়। সমগ্র দেশবাসীর আকাঙ্ক্ষা ও আত্মত্যাগের ফলেই এই স্বাধীনতা লাভ সম্ভব হয়েছিল। স্বাধীনতার পর দীর্ঘদিন অতিবাহিত হয়েছে। একটি প্রজন্ম অতিক্রান্ত হয়ে আরেকটি প্রজন্মের সূচনা ঘটেছে।

কিন্তু স্বাধীনতা শব্দটির সঙ্গে যে স্বপ্ন একদা দেশবাসী দেখেছিলেন আজও তা বাস্তবে রূপায়িত করা সম্ভব হয় নি। বাংলার দুঃখী মানুষের ভাগ্য রয়েছে অপরিবর্তিত। সমাজব্যবস্থা আজ মুখ থুবড়ে পড়েছে। বর্তমানে আমাদের সমাজজীবনে চরম অবক্ষয়ের চিত্র জীবন্ত হয়ে আছে। এ অবক্ষয় যুবসমাজকেও প্রভাবিত করছে, দোলা দিচ্ছে তাদের মন-মানসিকতাকে। আমাদের যুবসমাজের সামনে আজ কোনো আদর্শ নেই। নেই অনুপ্রাণিত করার মতন কোনো মহৎ-প্রাণ আলোকিত মানুষ। ঘরে-বাইরে সর্বত্রই আজ মনুষ্যত্বের দীনতার চিত্র।

বর্তমান সমাজব্যবস্থায় বড়দের কাছ থেকে ভালো কিছু শেখার আশা করা যায় না। বড়রা শিক্ষা বলতে বোঝেন পরীক্ষা ও ডিগ্রি এবং জীবনে উন্নতি বলতে বোঝেন টাকা ও প্রতিপত্তি। ফলে শিক্ষার মধ্যে তরুণ সমাজ খুঁজে পায় না মহত্তর কোনো জীবন-বোধ। তাদের সামনে নেই কোনো আদর্শের পথ, আলোর পথ। যুব সমাজকে নতুন চেত মতো কোনো পরিকল্পনা নেই, ফলে তারা প্রতিনিয়ত অবক্ষয়ের দিকে অগ্রসরমান।

একদিকে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-কলহ, অপরদিকে অর্থনৈতিক দুর্দশা, ফলে শিক্ষাজগতে নৈরাজ্য, সমাজসেবার নামে নিজের স্বার্থ হাসিল এবং স্বেচ্ছাচারিতা যুবসমাজকে বিপথগামী করছে, অন্ধকারের দিকে ধাবিত করছে। তরুণসমাজ অবাক বিস্ময়ে প্রত্যক্ষ করে, সমাজে সমাজ-বিরোধীর যে সম্মান, যে প্রতিপত্তি, সেখানে একজন জ্ঞানী, সৎ মানুষের মূল্য তুচ্ছ। সততা সেখানে লাঞ্ছিত, অসহায়। বিবেক সেখানে বিবর্জিত। জ্ঞানী-গুণীরাও তাদের খাতির করে। রাজনৈতিক নেতাদের তারা ডান হাত। জঘন্য, নিষ্ঠুর কাজকর্ম করেও তারা আইনের চোখে নিরাপদ। প্রশাসন প্রয়োজন মতো ওদের ব্যবহার করে।

কী তাদের মূলধন? তারা অনায়াসে মানুষ খুন করে, ডাকাতি করে, জনজীবনে ত্রাসের সৃষ্টি করে। এই মূলধন নিয়েই ওরা সমাজের বিশিষ্ট মানুষ। আজ তাই মানবিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধও গৌণ হয়ে উঠেছে। বস্তুত সমাজের সর্বস্তরে আজ যে মূল্যবোধের অভাব, তার মারাত্মক প্রতিক্রিয়া যুবকদের মাঝে প্রতিনিয়ত বিস্তৃতি ঘটছে। গোটা প্রশাসনকে দুর্নীতিবাজদের অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র বানিয়ে একশ্রেণীর রাজনীতিক-আমলা-অসাধু ব্যবসায়ী এবং দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ বিভিন্ন সংস্থার দুর্নীতিবাজেরা বিদেশি অর্থ, সাধারণের বাস্তুভিটা, খাল-বিল-নদী-নালা-পাহাড়, বন-বাদাড় দখল করে বিলাস- ব্যাসনে মত্ত হয়েছে।

ওইদিকে সেদিনের টগবগে যুবকটি শিক্ষা শেষে চাকরি না পেয় ধুঁকে ধুঁকে মরছে। ক্লিষ্ট, ক্লান্ত, ধ্বস্ত জীবনকে আঁকড়ে ধরে কোনোমতে সে বেঁচে আছে। জীবনযুদ্ধে পরাজিত দিশেহারা এই যুবকটি যদি পথ খুঁজতে খুঁজতে বিপথগামী হয়ে পড়ে কিংবা অজ্ঞাতে কোনো নৈতিক অবক্ষয়ের পথে পা বাড়ায়, তবে সে দোষ কার? কে নেবে তার ভার? আজ বেকারের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে হয়েছে চার কোটি পৌনে চার কোটি। বেকারত্বের অভিশাপ যে কতটা কষ্টদায়ক, তা ভুক্তভোগীরাই জানে। লেখাপড়া শেষ করেও যখন চাকরি মেলে না, তখন হতাশা আর অর্থনৈতিক সংকটের মুখে অসহায় এই যুবকটির করণীয় কী?

কে দিবে তাকে আলোর পথের সন্ধান? কে নিয়ে যাবে তাকে সেই আলোর পথে? আমাদের সামাজিক জীবনে এবং জাতীয় জীবনে আলোকিত মানুষ আজ খুবই জরুরি। সুধী, আমাদের দেশে লক্ষ করলে দেখা যায় সর্বত্রই একটা অস্থিরতা। সকল মানুষ যেন Impatient, সকলেই যেন কোনো না কোনো অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। অথচ দেশে শিক্ষার বা স্বাক্ষরতার হার (৬৪%) বেড়েছে, বেড়েছে মাথাপিছু আয় (৩৬৯ মার্কিন ডলার); সঞ্চয়ও কিছুটা বেড়েছে। শিক্ষার হার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের নিরাপত্তা বাড়ার কথা ছিল সামাজিক মূল্যবোধ বাড়ার কথা ছিল। সামাজিক অগ্রগতি ত্বরান্বিত হওয়ার কথা ছিল; কিন্তু এসব না হয়ে হয়েছে উল্টোটাই। আমাদের সন্ত্রাস বেড়েছে, বেড়েছে দুর্নীতি, মূল্যবোধের অবক্ষয়, অনিশ্চয়তা, অস্থিরতা, দারিদ্র্য। কিন্তু বাড়ছে না মানুষের জন্য মানুষের সংবেদনশীলতা। কিন্তু কেনো?

 

আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

এই কেনোর জবাব খুঁজতে গেলে এক কথায় বলতে হবে— সমাজে আলোকিত মানুষ, পরিশীলিত মানুষের আজ বড়ই অভাব। এ থেকে পরিত্রাণের জন্য চাই আলোকিত মানুষ। যার মধ্য দিয়ে আমরা পেতে পারি কাঙ্ক্ষিত আলোকিত সমাজ। সুধী, সুষ্ঠু সমাজ গঠনের জন্য অসুস্থ প্রতিযোগিতা থেকে আমাদের সন্তানদের ফিরিয়ে আনতে হবে। আর এ কাজের প্রাথমিক দায়িত্ব বাবা-মা বা অভিভাবকের। আর্নল্ড টয়েনবি এবং দাইসাকু ইকেদা তাঁদের লেখা সৃজনমূলক জীবনের দিকে বইতে বলেছেন, সুস্থ সমাজ গঠনে, পরিশীলিত ও রুচিবোধ সম্পন্ন মানুষ তৈরিতে সৃজনশীল পাঠ একান্ত জরুরি। পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি সৃজনশীল বই পাঠে আমাদের শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করা চাই।

সৃজনশীল পাঠের মাধ্যমেই একজন মানুষ আলোর পথের সন্ধান পেতে পারে। নিজেকে গড়ে তুলতে পারে একজন আলোকিত মানুষ হিসেবে। দূর অতীত হতে সুসভ্য ও সুষম সমাজ গঠনের জন্য যুগে যুগে পৃথিবীতে আদর্শবাদী মানুষের জন্ম হয়েছে। তাদের সে সকল আদর্শের বাণী, যা সমাজকে স্থিতিশীল, সুসংগঠিত, ধৈর্যশীল, প্রকৃতি-প্রেমিক, পরিবেশ-বান্ধব ইত্যাদি করতে পারে, পরিবেশ অবাধ্যতা থেকে বিরত রাখে, তার সবকিছুই গ্রন্থরূপে বিধৃত হয়েছে মানব কল্যাণের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শনের জন্যেই।

সে কারণে মানুষ যখন পরিশীলিত জ্ঞানার্জনের লক্ষ্যে সৃষ্টি রহস্য অনুধাবনের উদ্দেশ্যে নিজের মধ্যে মেধা ও মননকে শাণিত করে, তখন সে অভিভূত হয় প্রকৃতির সৌন্দর্য উন্মোচনে। ‘জীবে প্রেম করে যেইজন, সেইজন সেবিছে ইশ্বর’— এই উপলব্ধি একজন মানুষ যখন নিজস্ব চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আবিষ্কার করে, অন্যজন তা আস্বাদন করে পাঠের মাধ্যমে। জীব থেকে জীবে, পরিবেশ থেকে পরিবেশে, মানুষ থেকে সমাজে, ঘটনাপ্রবাহ, নবচেতনা, জ্ঞানের উপকরণ হয়ে, গ্রন্থের মাধ্যমে বিস্তৃত হয়ে মানুষকে পরস্পরের কাছাকাছি এনেছে। সমাজকে সুসংগঠিত ও বিন্যস্ত করার ক্ষেত্রে গ্রন্থের যে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রয়েছে, পাঠাভ্যাস মানুষের মধ্যে তা সুদৃঢ় করতে পারে।

চৈনিক দার্শনিক কনফুসিয়াসের একটি উপদেশ প্রণিধানযোগ্য— ‘তুমি পৃথিবীকে যেমন পেয়েছ তার চেয়ে উন্নততর করে রেখে যাওয়ার চেষ্টা করবে।” সুধীসমাজ, পশু জন্ম নিলেই পশু হিসেবে গড়ে উঠতে পারে কিন্তু মানুষের মানুষ হিসেবে গড়ে উঠা ততো সহজ নয়। তার জন্য চাই পরিবেশ, শিক্ষা এবং নিরন্তর প্রচেষ্টা ও সাধনা। এই নিরন্তর প্রচেষ্টায় শিক্ষা অন্যতম উপাদান। শিক্ষার জন্য চাই বই। বইয়ের উৎস লাইব্রেরি। অর্থাৎ সুশীল মানুষ তথা আলোকিত মানুষ তৈরিতে গ্রন্থাগারের ভূমিকা অনস্বিকার্য। একজন পরিশীলিত মানুষকে মানুষ শ্রদ্ধা করে, ভালোবাসে; তাকে ভয় পায় না। সে সমাজ গঠনে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারে। তার জন্য চাই নৈতিক এবং ধর্মীয় শিক্ষা, কারণ মানব জীবনের চালিকা শক্তি হচ্ছে ধর্ম।

আমাদের সামাজিক জীবনে এবং জাতীয় জীবনে আলোকিত মানুষ আজ খুবই জরুরি। রাজনীতিবিদ, আমলা, বিচারক, প্রশাসক, শিক্ষক, চিকিৎসক, আইনজীবী এবং অন্যান্য পেশাজীবী মানুষের সম্মিলিত প্রয়াস আমাদেরকে বর্তমান অবস্থা থেকে উত্তরণে সাহায্য করতে পারে। তাই জাতির উন্নয়নে আলোকিত সমাজ গড়ার কোনো বিকল্প নেই। সচেতন সুধীসমাজ, আলোকিত মানুষ তৈরিতে এবং আলোকিত সমাজ গঠনে গৃহীত কিছু পদক্ষেপ নিম্নরূপ হতে পারে— শৈশব থেকেই বাবা-মা বা অভিভাবক তাদের সন্তানকে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি নৈতিক শিক্ষা জোরদার করতে হবে।

শিক্ষার্থীদের সকল পর্যায়ে পাঠ্য বইয়ের পাশাপাশি সৃজনশীল পাঠে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। মানুষ ও প্রকৃতির প্রতি যাতে মমত্ববোধ জন্মায় তার জন্য শিক্ষার্থীদেরকে মটিভেশনাল শিক্ষা দিতে হবে। ছেলেবেলা থেকেই লাইব্রেরি ব্যবহারের নিয়মকানুন শেখানোর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের লাইব্রেরীমুখী করতে হবে। সুধী, এখনো আমরা আমাদের স্বপ্নকে, তথা সোনার বাংলাকে ঘিরে যে স্বপ্ন দেখেছি তা বাস্তবে রূপ দিতে পারি নি।” সমাজের কাছে আমরা প্রতিটি মানুষ দায়বদ্ধ।

ঋণ পরিশোধের দায়-দায়িত্ব ও কর্তব্যও আছে আমাদের। অন্নহীনে অনু এবং নিরক্ষরকে জ্ঞানের আলো দিয়ে আলোকিত মানুষ গড়ে তুলতে হবে। সবরকম বিভেদ-বিচ্ছেদ ভুলে, হানাহানি সংঘাত ভুলে, সংকীর্ণ স্বার্থচিন্তা জলাঞ্জলি দিয়ে দেশ গড়ার কাজে ব্রতী হতে হবে, তবেই আমাদের স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিবে। আর এ জন্যে চাই আলোকিত মানুষ ও আলোকিত সমাজ। পরিশেষে যারা অক্লান্ত পরিশ্রম করে আজকের এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আমাকে কিছু বলার সুযোগ করে দিয়েছেন এবং এতক্ষণ যারা অসীম ধৈর্য নিয়ে আমার বক্তব্য শুনেছেন- আপনাদের সবাইকে আবারও ধন্যবাদ।

Leave a Comment