আর্সেনিক দূষণ রচনা

আর্সেনিক দূষণ রচনার একটা নমুনা তৈরি করবো আজ। এই রচনাটি আমাদের “প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও পরিবেশ দূষণ” সিরিজের একটি রচনা। আমাদের সকল রচনা শিক্ষার্থীদের ধারণা দেবার জন্য। মুখস্থ করার জন্য নয়। এই রচনা থেকে শিক্ষার্থীরা শুধুমাত্র ধারণা নেবেন। তারপর নিজের মতো করে নিজের নিজের ভাষায় লিখবেন।

Table of Contents

আর্সেনিক দূষণ রচনা

আর্সেনিক দূষণ রচনা

 

ভূমিকা :

বাংলাদেশের ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিক দূষণ ধরা পড়েছে এবং দূষণ মাত্রা দিন দিন বেড়েই নলকূপের চলছে। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে সর্বপ্রথম এ দূষণ ধরা পড়ে। এখন দক্ষিণাঞ্চল ও পশ্চিম- উত্তরাঞ্চলের নলকূপের পানিও আর্সেনিকদুষ্ট। ১৯৯৬ সালে ৭টি জেলার প্রায় অধিকাংশ পানিতে আর্সেনিক দূষণ চিহ্নিত করা হয়েছিল। ১৯৯৭ সালের মাঝামাঝি এ দূষণ পাওয়া ৩৪টি জেলায় এবং বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৯টিতে। ধারণা করা হচ্ছে মোট জনসংখ্যার প্রায় এক- তৃতীয়াংশ মানুষ বিষাক্ত আর্সেনিকের কবলে।

আর্সেনিক ও এর ধর্ম :

আর্সেনিক একটি স্বাদহীন ভঙ্গুর ধাতু-কল্প ধাতু, যার রং ধূসর রুপালি বা রাংতা সাদা। এটি দানাদার পদার্থ; বায়ুতে কালো রঙে পরিণত হয়। কালো রূপের আর্সেনিক কখনো কখনো পাউডাররূপে অবস্থান করে। আর্সেনিকের বহুরূপিতা হলো হলদে (খুব বিষাক্ত) বা বাদামি বা ধূসর পাউডার। আর্সেনিক বায়ুতে পোড়ালে রসুনের গন্ধযুক্ত ঘন সাদা ধোঁয়ার আর্সেনিক ট্রাই অক্সাইডে রূপান্তরিত হয়।

আর্সেনিক দূষণ | প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও পরিবেশ দূষণ | বাংলা রচনা সম্ভার

 

প্রাকৃতিক উপায়ে আর্সেনিক মাটি, বায়ু ও পানিতে সাধারণ সালফার যৌগ ও অন্যান্য ধাতুযৌগ যেমন তামা, সোনা, কোবাল্ট, সিসা, জিঙ্ক ইত্যাদি রূপে অবস্থান করে। ১৫০ ধরনের আর্সেনিক প্রজাতির মধ্যে খুবই সাধারণ হলো আর্সেনোপাইরাইট, ইনারজিট, রেগুলার এবং ওরপিম্যান্ট রাসায়নিকভাবে আর্সেনিক যৌগ জৈব ও অজৈব এ দুপ্রকারে চিহ্নিত করা হয়। অজৈব যৌগ জৈব যৌগ অপেক্ষা বিষাক্ত। ভূ-গর্ভস্থ পানিতে চার ধরনের প্রজাতির মধ্যে আর্সেনিক ট্রাই ও পেন্টা অক্সাইডের পর্যাপ্ততা বেশি।

আর্সেনিকের ব্যবহার :

আর্সেনিক ফুড অ্যাডিটিভ, কীটনাশক, সীসার গুলি কাঠিন্য, তামার প্রলেপ, ব্যাটারির সীসাযুক্ত শিকে প্রলেপ, বিয়ারিং তারের আবরণ, অ্যাডনোড, অধিক তাপে পিতল, চুল্লি নলে প্রলেপ, অ্যামালগাম আকারে ওষুধ ইত্যাদিতে ব্যবহৃত হয়।

আর্সেনিকের প্রাপ্তিস্থান :

আর্জেন্টিনা, মেক্সিকো, চিলি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, থাইল্যান্ড, মঙ্গোলিয়া, তাইওয়ান, ভারত প্রভৃতি দেশে আর্সেনিক দূষণ সম্বন্ধে পূর্বেই জানা গিয়েছিল। ভারতে আর্সেনিক দূষণ ভয়াবহরূপ ধারণ করছে পশ্চিমবঙ্গে। ১৯৮৩ সালে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায় এ রোগ প্রথম ধরা পড়ে। ১৯৯৩ সালে প্রথম বাংলাদেশে আর্সেনিক দূষণ শনাক্ত করা হয়। শুধু বরেন্দ্র অঞ্চল এবং পাহাড়ি অঞ্চল ছাড়া সারা বাংলাদেশ আর্সেনিক দূষণে কবলিত। আক্রান্ত পুংরোগী ৫৩% আর স্ত্রীরোগী ৪৭%। বাংলাদেশে আর্সেনিক দূষণযুক্ত টিউবওয়েল ২৮%।

আর্সেনিকের সন্ধান :

পানির অপর নাম জীবন। মানব শরীর গঠনের উপাদানগুলোর মধ্যে পানির পরিমাণ যেমন বেশি তেমনি প্রাকৃতিক অন্যান্য উপাদানের চেয়ে দৈনন্দিন জীবনে পানির প্রয়োজনীয়তা বেশি। জীবন ধারণের এই উপাদান পানি নানাভাবে বিষাক্ত হয়ে আমাদের জীবন নাশের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। নানা ধরনের জীবাণু পানিতে প্রবাহিত হওয়ার ফলে জীবাণুমুক্ত পানিই মানবজীবনে প্রত্যাশিত। নানা কারণে পানি জীবাণুযুক্ত হয়ে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে।

বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ১৯৯৩ সালে আর্সেনিকের বিষক্রিয়ার ঘটনা ধরা পড়ে। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর উত্তরের সীমান্তবর্তী কয়েকটি জেলার আর্সেনিক দূষণ শনাক্ত করে। কিন্তু তথ্যটি তখন প্রকাশ হয়নি। ১৯৯৬ সালের ৩ জুলাই পাবনার পাকশীতে পাবনা কমিউনিটি ক্লিনিকের উদ্যোগে একটি স্বাস্থ্য শিবিরের আয়োজন করা হয়। চিকিৎসা কেন্দ্রে চিকিৎসক ছিলেন ঢাকা কমিউনিটি সেন্টারের চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. সাইফুল কবীর । তিনি স্বাস্থ্য শিবিরের কয়েকজন রোগীকে দেখে আর্সেনিক দূষণ আক্রান্ত হিসেবে চিহ্নত করেন। এ সংবাদ স্থানীয় সাংবাদিকদের জানালে দেশবাসী প্রথম আর্সেনিকের সম্পর্কে জানতে পারেন ।

আর্সেনিকের সহনীয় মাত্রা :

পানিতে প্রতি লিটারে ০.০১ মিলিগ্রাম আর্সেনিক থাকলে তা পানের উপযোগী থাকে। তবে বাংলাদেশে প্রতি লিটারে ০.০৫ মিলিগ্রাম পর্যন্ত অনুমোদন যোগ্য। বাংলাদেশে কোন কোন অঞ্চলের নলকূপের পানিতে অনুমোদিত মাত্রার চেয়ে ১০০ ভাগ বেশি আর্সেনিক মিশ্রণ পাওয়া গেছে। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশে প্রায় চারকোটি লোক আর্সেনিক বিষ দ্বারা আক্রান্ত ।

আর্সেনিক দূষণ :

পানিতে সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি পরিমাণ আর্সেনিক থাকে তখন সেই পানিকে আর্সেনিক দূষণ যুক্ত পানি বলে যা মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। দেশের নানা স্থানে নলকূপের পানিতে অতিরিক্ত আর্সেনিক পাওয়া গিয়েছে। সহনীয় মাত্রার চেয়ে সামান্য বেশি হলে শরীরে বিষক্রিয়া শুরু হয়। বর্তমানে এটি আমাদের দেশে এক নম্বর সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে ।

আর্সেনিকের লক্ষণ:

আর্সেনিক যুক্ত পানি পান ও ব্যবহারে মানুষের শরীরে নতুন কিছু লক্ষণ বা উপসর্গ দেখা যায় যা আর্সেনিক যুক্ত পানির প্রতিক্রিয়া হিসেবে চিহ্নিত লক্ষণগুলো নিম্নরূপ :

১. আর্সেনিক আক্রান্ত রোগীদের হাত ও পায়ের তালুতে এক ধরনের গুটি দেখা যায় ।

২. গুটিগুলো থেকে অসহ্য যন্ত্রণার সৃষ্টি হয়।

৩. শরীরের চামড়া ফেটে যায় এবং অসহনীয় যন্ত্রণার সৃষ্টি হয় ।

৪. পেট ব্যথা, কাশি বিভিন্ন ধরনের রোগের সূত্রপাত হয়।

৫. চোখের মনি পর্যন্ত সাদা হয়ে চোখ দিয়ে নিরন্তর পানি ঝরতে শুরু করে।

৬. যৌনাঙ্গে ক্ষতের সৃষ্টি হয়, যা পরবর্তীতে ক্যান্সারে রূপ নেয়।

৭. আর্সেনিকের বিষক্রিয়ার পরিণতিতে শরীরের পচন রোগ, লিভার ও কিডনি অকেজো, ত্বক ও ফুসফুসে ক্যান্সার হতে পারে।

৮. বারবার বমি ও ডায়রিয়ার লক্ষণ দেখা যায়।

বাংলাদেশে আর্সেনিক আক্রান্ত এলাকাসমূহ :

ইউনিসেফের আর্থিক সাহায্য জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের একটি জরিপের মাধ্যমে সারা দেশের ২৫,০০০টি টিউবয়েলের পানি পরীক্ষা করা হয়েছে এবং দেখা গেছে যে, দেশের মধ্যাঞ্চল অর্থাৎ পশ্চিমে চাপাইনবাবগঞ্জ থেকে পূর্বে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পর্যন্ত আর্সেনিক দূষণে আক্রান্ত । বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলেও আর্সেনিকের লক্ষণ দেখা গেছে। দেশের উত্তরাঞ্চল এবং উপকূলীয় এলাকায় বিচ্ছিন্নভাবে আর্সেনিক আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা জানা গেছে। এটি হচ্ছে এ সময়কালে জাতীয় ভিত্তিতে পরিচালিত সবচেয়ে বড় জরিপ।

ব্রিটিশ জিওলজিক্যাল সার্ভে (BGS/MMI 1998) কর্তৃক পরিচালিত ১৯৯৮ জরিপে ডিপিএইচই-ইউনিসেফ জরিপের ফলাফল অনুযায়ী প্রাপ্ত আর্সেনিকের সাধারণ মাত্রা অনুমোদন করা হয়েছে। ডিপিএইচই-ইউনিসেফ জরিপে দেশের ৩৯৭টি থানার টিউবওয়েলে পানি পরীক্ষা করা হয়। এর মধ্যে ২১৮টি থানা অথবা ৫৬ শতাংশ থানার টিউবওয়েলের আর্সেনিক পাওয়া যায়নি। এই জরিপে দেখা যায়, ৫টির মধ্যে ১টি টিউওয়েল, অর্থাৎ ২২ শতাংশ টিউবওয়েল আর্সেনিক দূষণে দুষ্ট।

আর্সেনিক দূষণের কারণ :

বিজ্ঞানীরা বাংলাদেশে আর্সেনিক দূষণের জন্য যে সমস্ত কারণকে দায়ী করেছেন তা নিচে উল্লেখিত হলো :

ক. প্রাকৃতিক কারণ

১. বাংলাদেশ ভাটি অঞ্চল হওয়াতে : পার্শ্ববর্তী ভারতের চেয়ে বাংলাদেশ ভাটি এলাকায় বিধায় পশ্চিমবঙ্গ সংলগ্ন নদীগুলোর প্রবাহিত পানি থেকে এ দেশে আর্সেনিকের বিস্তার লাভ হতে পারে।

২. আর্সেনিক যুক্ত খনিজের দ্রবীভূত হওয়া : বাংলাদেশের পলল শিলায় পর্যাপ্ত পরিমাণ আর্সেনিক সমৃদ্ধ খনিজ পাইরাইট আছে। এ পাইরাইট দ্রবীভূত হয়ে ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিক দূষণ ঘটাচ্ছে।

৩. বর্ষার আগে ও পরে ভূগর্ভস্থ পানির তলের উঠা নামা।

খ. মনুষ্য সৃষ্ট কারণ :

মানুষের বিভিন্ন অনভিপ্রেত ক্রিয়াকলাপের ফলে আর্সেনিক দূষণ ঘটে থাকে। যেমন-

১. ফারাক্কাসহ বিভিন্ন বাঁধের প্রভাব :

ভারতের দেয়া বাংলাদেশের নদীমুখে ফারাক্কাসহ বিভিন্ন বাঁধের কারণে নদীতে পানি প্রবাহ কমে যায়। এর ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অনেক নিচে নেমে যাওয়ায় সেখানে যে পানি শূন্যতাজনিত অবস্থার সৃষ্টি হয়, তার প্রতিক্রিয়ায় ভূগর্ভস্থ আর্সেনিকের স্তর উন্মুক্ত হয়ে আর্সেনিকের বিস্তার হতে পারে।

২. অধিক হারে ভূগর্ভস্থ পানি উঠানো :

অতিরিক্ত জনসংখ্যার পানি চাহিদা ও সেচ কাজের জন্য অধিক হারে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনে আর্সেনিক দূষণ ঘটছে ।

৩. বোরিং:

যত্রতত্র মাটিতে বোরিং করার ফলে সৃষ্ট ছিদ্রের কারণে আর্সেনিক দূষণ হচ্ছে। এছাড়া অন্যান্য বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে মনুষ্য ঘটিত কারণে আর্সেনিকের দূষণ হয়ে থাকে। তবে সামগ্রিক অর্থে বাংলাদেশে এরূপ ক্ষেত্র থেকে আর্সেনিক দূষণ অতি সমান্য ধারণা করা হয়। 

৪. কৃষি থেকে :

কীটনাশক, আগাছানাশক, কাঠ সংরক্ষক, বাকল ছাড়ানোর জন্য মাটি নির্বীজক ইত্যাদি থেকে ।

৫. হাঁস-মুরগির খামার থেকে :

ফুড অ্যাডিটিভ, পশু পাখির রোগ প্রতিরোধক, কৃমিনাশক ইত্যাদি থেকে।

৬. চিকিৎসা থেকে :

সিফিলস, ট্রাইকোনোসোমিয়াসিস ও অ্যামিবিয়াসিসের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ থেকে।

৭. ইলেক্ট্রনিক ওয়েস্ট:

ইলেক্ট্রনিক হতে সোলার সেল, অপ্টো-ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস, সেমি কনডাক্টর ইত্যাদি থেকে ।

৮. শিল্প থেকে :

কাঁচের জিনিস, ইলেক্ট্রো ফটোগ্রাফি, রঞ্জক, সাবান, ওষুধ কারখানায় ব্যবহৃত আর্সেনিক থেকে।

৯. ধাতু শিল্প থেকে :

সংকর ধাতু, ব্যাটারি প্লেট শক্ত করার কাজে আর্সেনিকের ব্যবহার থেকে আর্সেনিক দূষণ ঘটে ।

 

আর্সেনিক দূষণের ক্ষতিকর প্রভাব:

আর্সেনিক প্রধানত তিনটি রাসায়নিক বিক্রিয়ায় অংশ গ্রহণ করে থাকে। বিক্রিয়া তিনটি হলো :

ক. প্রেটিনের কোয়াগুলেশান।

খ. কো-এনজাইমে জটিলতা সৃষ্টি ।

গ. ফসফোরাইলেশানের সময় ফসফেট মুক্ত করে দেয়া। ১. অ্যাকিউট বিষাক্ততা : মাত্র ১০০ mg আর্সেনিক যুক্ত পানি পান করার ফলে এ ধরনের বিষাক্ততা দেখা দেয় । এর দরুন সাথে সাথে মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত ঘটে থাকে।

২. ক্রনিক বিষাক্ততা : দীর্ঘদিন ধরে অল্প পরিমাণ আর্সেনিক যুক্ত পানি পান করার ফলে এ ধরণের বিষাক্ততা দেখা দেয় । এ ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত পরিবর্তনগুলো দৃষ্টিগোচর হয় ।

i. চামড়ার রং পরিবর্তিত হয়ে যায় এবং চামড়ায় কালো কালো দাগ সৃষ্টি হয়।

iiশরীরের বিভিন্ন স্থানে বিশেষ করে হাত ও পায়ের তালুতে বিশেষ ধরনের গুটির সৃষ্টি হয় ।

iii. চামড়া, যকৃত, বৃক্ষ ও পিত্তথলির ক্যান্সার হবার সম্ভাবনা বেড়ে যায় ।

আর্সেনিক দূষণ | প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও পরিবেশ দূষণ | বাংলা রচনা সম্ভার

 

আর্সেনিকের ভয়াবহতা :

আর্সেনিকের বিষক্রিয়া শরীরে ধীরে ধীরে ক্ষতি করে। আর্সেনিকের বিষক্রিয়ার পর রোগের পূর্ণ লক্ষণ পেতে ৭/৮ বছর সময় লাগে। যারা সৃষ্টিকর খাদ্য খায় তাদের রোগের লক্ষণ ধরা পড়তে বেশ দেরি হয়। তবে দুর্বল লোকের বেলায় ৩/৪ বছরের মধ্যে আর্সেনিকের লক্ষণ প্রকাশ পায়। প্রাথমিক পর্যায়ে আর্সেনিকের বিষক্রিয়া ধরা সম্ভব হয় না। দেখা গেছে, রোগের প্রাথমিক লক্ষণে চামড়ার রং কালো হয়। যতই দিন যেতে থাকে ততই লক্ষণগুলো স্পষ্ট থাকে এবং ধীরে ধীরে আক্রান্ত মানুষ মৃত্যুর মুখে পতিত হয়।

বাংলাদেশ ধীরে ধীরে আর্সেনিকের বিষাক্ত থাবার মধ্যে প্রবেশ করছে। ঈশ্বরদীর একটি ইউনিয়নে অধিক লোকের মৃত্যু এবং অন্য তিন ইউনিয়নে অর্থ সহস্রাধিক মানুষ আর্সেনিকের শিকার হয়ে মৃত্যুর জন্য দিন শুনছে। আর্সেনিকের ভয়াবহতা দিন দিন সম্প্রসারিত হচ্ছে। মূলত আর্সেনিক যুক্ত বিষাক্ত পানি পানে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটছে। কিন্তু পূর্বে আমাদের জানা ছিল ছিল না যে এ মৃত্যুর পেছনে রয়েছে আর্সেনিক নামক ঘাতক বিষাক্ত উপাদান। যা আমাদের কাছে এক ভয়াবহ মারাত্মক বিষ।

 

বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিতে আর্সেনিক:

বিশেষজ্ঞদের মতে, পৃথিবীর ভূ-ত্বকের মাটিতে আর্সেনিক থাকাটা স্বাভাবিক। বাংলাদেশের মতো ভারতের পশ্চিম বঙ্গে আর্সেনিক বিষক্রিয়ায় সমস্যা ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। চীন, জাপান, ব্রাজিল এবং চিলিতে আর্সেনিক সমস্যা রয়েছে। জাপানে যে অঞ্চলে আর্সেনিক অধিক মাত্রায় পাওয়া গেছে সেখান থেকে জনগণকে মাইগ্রেশন করে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বাংলাদেশে ভূ-গর্ভের উপরিস্তরের পানিতে আর্সেনিক অধিক মাত্রায় থাকার কারণ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা  এখনো নিশ্চিত হতে পারেনি। কিছুদিন আগে মনে করা হতো ফারাক্কা বাঁধের কারণে পরিবেশ বিপর্যয়ের ফলে পদ্মার নিকটবর্তী পশ্চিবঙ্গ ও এদেশের সীমান্ত জেলাগুলোতে আর্সেনিক সমস্যা দেখা যাচ্ছে।

কিন্তু বর্তমানে দেশের অধিকাংশ জেলাগুলোতে আর্সেনিক পাওয়ার ধারণাটি ভুল প্রমাণিত হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের তথ্যানুযায়ী দেশে প্রায় ৮২ লাখ হেক্টর আবাসযোগ্য জমির ৪০ শতাংশ সেচ ব্যবস্থার অধীনে। এর মধ্যে ৭০ শতাংশ ভূ-গর্ভস্থ এবং ৩০ শতাংশ ভূ-পৃষ্ঠের পানি সেচের জন্য ব্যবহার করে থাকে। ভূ-গর্ভস্থ পানিতে সেচ কার্যক্রম দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়া ৪৫ লাখ টিউবওয়েলে ও ৫ লাখের অধিক গভীর ও অগভীর নলকূপের মাধ্যমে পানি তুলে দৈনন্দিন কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। এই অতিরিক্ত পানি উত্তোলনের কারণে ভূ-গর্ভের আর্সেনিক পানিতে মিশে যাচ্ছে। তবে অনেক বিশেষজ্ঞ ধারণা করেছে আর্সেনিক সমস্যাটি একটি প্রাকৃতিক সমস্যা।

 

আন্তর্জাতিক আর্সেনিক সম্মেলন :

১৯৯৮ সালে ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ১২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাতে অনুষ্ঠিত হয় ৫ দিন ব্যাপী আন্তর্জাতিক আর্সেনিক সম্মেলন। এই সম্মেলনে দশটি বৈজ্ঞানিক অধিবেশন আলোচনা এবং সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে তৈরি হয় ‘ঢাকা ঘোষণা’ ঢাকা ঘোষণাটি দুটি পর্বে বিভক্ত যা ছিল নিম্নরূপ :

প্রথম পর্ব :

প্রথম পর্বে বলা হয় – বাংলাদেশ বিশাল এলাকার ভূ-গর্ভের পানি আর্সেনিক দূষণে আক্রান্ত। এ দূষণের কারণ ভূ-তাত্ত্বিক। নারী-শিশুসহ বিপুল সংখ্যক মানুষ দীর্ঘস্থায়ী আর্সেনিক বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত। দেশের স্বাস্থ্যগত এবং সামাজিক কাঠামোর প্রতি এটি হুমকিস্বরূপ যার একমাত্র সমাধান আর্সেনিক মুক্ত পানি সরবরাহ ।

দ্বিতীয় পর্ব :

এই পর্বে বলা হয় সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীরা মনে করেন, বাংলাদেশে এ সমস্যাটি জরুরি সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হওয়া দরকার। সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীরা ঘোষণা করেন যে, তাৱা তাদের গবেষণা কাজ সকল মানুষের কল্যাণে পরিচালিত করবেন। তারা মানুষের জন্য নিরাপদ পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করার লক্ষ্যে তাদের মেধা, দক্ষতা এবং সমন্বিত সম্পদ কাজে লাগাবেন। তারা আর্সেনিক দূষণ আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা করবেন। যারা এর ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন তাদেরকে চিহ্নিত করবেন । মানুষকে আর্সেনিক দূষণ থেকে বাঁচাতে তারা সমন্বিতভাবে কাজ করে যাবেন। পানিতে আর্সেনিকের পরিমাণ নির্ণয়

১. নিপসম কিট ব্যবহার করে।

২. এটোমিক অবসপশান স্পেকটোফটোমিটার ব্যবহার করে। ৩. সিলভার ডাই থায়োকার্বনেট ব্যবহার করলে।

 

আর্সেনিক রেগীর প্রতিকারের উপায় :

এখন পর্যন্ত আর্সেনিক আক্রান্ত রোগীর জন্য কোনো কার্যকর চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়নি। তাই আর্সেনিক মুক্ত পানি পান করাই আর্সেনিকের বিষক্রিয়া থেকে মুক্ত থাকার একমাত্র উপায়। এজন্য নিম্নলিখিত ব্যবস্থানি গ্রহণ করা যায় :

১. আর্সেনিকযুক্ত নলকূপের পানি ব্যবহার না করা :

আর্সেনিকযুক্ত নলকূপের পানি ব্যবহার না করে নদী, খাল, বিল, পুকুর ইত্যাদি দূষণমুক্ত জলাশয়ের পানি যথাযথভাবে জীবাণুমুক্ত করে পান করা।

২. গভীর নলকূপের পানি পান:

অগভীর স্তরের চেয়ে গভীর স্তরে আর্সেনিকের দূষণ ঘটার সম্ভাবনা  অনেক কম। ২০০ মিটারের বেশি গভীরে স্থাপিত নলকূপের পানিতে আর্সেনিকের ঝুঁকি অনেক কম।

৩. বৃষ্টির পানির ব্যবহার :

বৃষ্টির পানি ধরে রাখা এবং তা পান করা ।

৪. ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট:

ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট স্থাপন করে ও পানিকে আর্সেনিক মুক্ত করে ব্যবহার করা।

৫. পন্ড-স্যান্ড ফিল্টার :

নুড়ি আর বালি ভর্তি বড় ট্যাংক যা পন্ড-স্যান্ড ফিল্টার নামে পরিচিত, তার ভেতর দিয়ে আর্সেনিকযুক্ত পানি ছেঁকে নিলে পানি অনেক পরিমাণে আর্সেনিক মুক্ত হয়। নির্দিষ্ট সময় অন্তর বালির ওপরের স্তর ধুয়ে ফেলে দিয়ে পণ্ড-স্যান্ড ফিল্টার পরিষ্কার করতে হবে।

৬. এ্যাক্টিভেটেড অ্যালুমিনা ফিল্টার :

এটি হচ্ছে একটি বালি জাতীয় পদার্থ, যার মধ্যে আর্সেনিক খুব শক্তভাবে আটকে থাকে । এই ফিল্টারের মধ্যে দিয়ে দূষিত পানি ছেঁকে নিলে আর্সেনিক দূর হয়ে যায় ।

৭. আয়রন বা অ্যালুমিনা লবণ :

এক কলসী আর্সেনিক যুক্ত পানিতে সামান্য আয়রন (ফেরাস)-এর অ্যালুমিনা লবণ মিশিয়ে কমপক্ষে ১২ ঘণ্টা স্থির অবস্থায় রেখে দিলে আর্সেনিক তলানী হিসেবে কলসীর তলায় জমা হবে। তখন ওপর থেকে পরিষ্কার পানি ঢেলে নিয়ে পান করতে হবে ।

৮. জলজ পানা স্থাপন করে :

সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আবদুল আজীজ পরীক্ষাগারে আর্সেনিকযুক্ত পানিতে Spirodela ও Azolla নামক ক্ষুদে জপানা স্থাপন করে দেখেছেন দুটো উদ্ভিদই আর্সেনিক শোষণ করে আর্সেনিক মুক্ত করা যায়। যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার ফার্ন জাতীয় উদ্ভিদ দ্বারা আর্সেনিক শোষণের প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে।

৯. স্পিরুলিনা ট্যাবলেট :

সম্প্রতি ঢাকাস্থ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসক বিশেষজ্ঞদের গবেষণায় দেখা গেছে আর্সেনিক আক্রান্ত রোগীকে Spirulina নামক অভিপ্রোটিন সমৃদ্ধ শৈবাল থেকে তৈরি ট্যাবলেট খাওয়ালে রোগী সুস্থ হয়ে ওঠে। তাই Spirulina ট্যাবলেট একটি প্রতিকারক হতে পারে।

১০. ব্রিটিশ একটিলুসিড ইনজেকশন :

আর্সেনিক বিষে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ব্রিটিশ এবটিলুসিড’ (British Abtilucide) যার সংক্ষিপ্ত নাম ‘বাল’ (BAL) ইঞ্জেকশন দিয়ে চিকিৎসা হচ্ছে। ১১. পুষ্টিকর খাদ্য ঃ এ ছাড়া ডাক্তাররা আর্সেনিক বিষাক্ততা থেকে মুক্ত হতে পুষ্টিকর খাদ্য, শাক- সবজি, ডাল, মাছ, বেশি করে খেতে পরামর্শ দিচ্ছেন।

আর্সেনিক দূষণ | প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও পরিবেশ দূষণ | বাংলা রচনা সম্ভার

 

উপসংহার:

বাংলাদেশে আর্সেনিক দূষণ এক ভয়াবহ সমস্যা। এ সমস্যাটি যথাযথভাবে প্রথম দিকে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। বর্তমানে সমস্যাটি ক্রমেই ব্যাপক এলাকাভিত্তিক হওয়ায় এবং দূষণ পানি পানের দীর্ঘ প্রতিক্রিয়া হিসেবে জটিল রোগের ফলশ্রুতিতে কিছু লোকের মৃত্যুতে উদ্বেগের সৃষ্টি হয়। এ থেকে রক্ষা পেতে হলে আমাদের আর্সেনিক মুক্ত পানি পান করতে হবে। আন্তর্জাতিক সম্মেলনে গৃহীত ঘোষণায় এ দূষণ পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য যে সমস্ত পদেক্ষেপের কথা উল্লেখ করা হয়েছে তার আর বাস্তবায়ন একান্ত প্রয়োজন ।

 

আরও দেখুন:

Leave a Comment