আমার পরিচয় কবিতাটি সৈয়দ শামসুল হকের ‘কিশোর কবিতা সমগ্র’ থেকে সম্পাদিত আকারে চয়ন করা হয়েছে। আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জাতিসত্তা গঠনের পেছনে রয়েছে সমৃদ্ধ ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির পটভূমি। কবিতাটির মাধ্যমে লেখক বাঙালি জাতির বর্তমান অবস্থার পেছনের বর্ণিল ইতিহাসের কথা তুলে ধরেছেন। ইতিহাসের ধারাবাহিক বিবর্তনে বাঙালি জাতি সেই সুদীর্ঘ সংগ্রামী ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতির পরিচয় এবং কৃতি সন্তানদের যেন ভুলে না যায় সেই শ্রদ্ধা বোধ থেকেই তিনি কবিতাটি রচনা করেছেন ।
পাঠ পরিচিতি :
সৈয়দ শামসুল হকের ‘কিশোর কবিতা সমগ্র’ থেকে ‘আমার পরিচয়’ শীর্ষক কবিতাটি সম্পাদিত আকারে চয়ন করা হয়েছে। বাংলাদেশ আজ স্বাধীন সার্বভৌম একটি দেশ। আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন এই স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র ও জাতিসত্তা প্রতিষ্ঠার পশ্চাতে আছে সমৃদ্ধ এক ইতিহাস। সৈয়দ শামসুল হক গভীর মমত্বের সঙ্গে কবিতার আঙ্গিকে চিত্রিত করেছেন সমৃদ্ধ সেই ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির পটভূমি। সহজিয়া পন্থী বৌদ্ধ কবিদের সৃষ্ট চর্যাপদের মধ্যে বাঙালি জাতিসত্তার যে অসাম্প্রদায়িক জীবনবোধের পরিচয় মুদ্রিত হয়ে আছে – যুগে যুগে নানা আন্দোলন, বিপ্লব-বিদ্রোহ, আর মতাদর্শের বিকাশ হতে হতে আমরা এসে পৌঁছেছি আজকের বাংলায়।
সৈয়দ শামসুল হক এই বিবর্তনের বিচিত্র বাঁক ও মোড় তাৎপর্যময় করে তুলেছেন। চাঁদ-সওদাগরের বাণিজ্য যাত্রা, কৈবর্তবিদ্রোহ, পালযুগের চিত্রকলা আন্দোলন, বৌদ্ধবিহারের জ্ঞানচর্চা, মুসলিম ধর্ম ও সাহিত্য সংস্কৃতির বিকাশ, বারোভূঁইয়াদের উত্থান, ময়মনসিংহ গীতিকার জীবন, তিতুমীর আর হাজী শরিয়তের বিদ্রোহ, রবীন্দ্র-নজরুলের কালজয়ী সৃষ্টি, বৃটিশ-বিরোধী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন এবং পরিশেষে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীন বাংলাদেশ – ‘আমার পরিচয়’ কবিতার মধ্যে এই বিপুল বাংলাদেশ অনবদ্যরূপ লাভ করেছে।
Table of Contents
আমার পরিচয় কবিতা – সৈয়দ শামসুল হক
আমি জন্মেছি বাংলায়
আমি বাংলায় কথা বলি।
আমি বাংলার আলপথ দিয়ে, হাজার বছর চলি।
চলি পলিমাটি কোমলে আমার চলার চিহ্ন ফেলে।
তেরশত নদী শুধায় আমাকে, কোথা থেকে তুমি এলে ?
আমি তো এসেছি চর্যাপদের অক্ষরগুলো থেকে
আমি তো এসেছি সওদাগরের ডিঙার বহর থেকে।
আমি তো এসেছি কৈবর্তের বিদ্রোহী গ্রাম থেকে
আমি তো এসেছি পালযুগ নামে চিত্রকলার থেকে।
এসেছি বাঙালি পাহাড়পুরের বৌদ্ধবিহার থেকে
এসেছি বাঙালি জোড়বাংলার মন্দির বেদি থেকে।
এসেছি বাঙালি বরেন্দ্রভূমে সোনা মসজিদ থেকে
এসেছি বাঙালি আউল-বাউল মাটির দেউল থেকে।
আমি তো এসেছি সার্বভৌম বারোভূঁইয়ার থেকে
আমি তো এসেছি ‘কমলার দীঘি’ ‘মহুয়ার পালা’ থেকে।
আমি তো এসেছি তিতুমীর আর হাজী শরীয়ত থেকে
আমি তো এসেছি গীতাঞ্জলি ও অগ্নিবীণার থেকে।
এসেছি বাঙালি ক্ষুদিরাম আর সূর্যসেনের থেকে
এসেছি বাঙালি জয়নুল আর অবন ঠাকুর থেকে।
এসেছি বাঙালি রাষ্ট্রভাষার লাল রাজপথ থেকে
এসেছি বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর থেকে।
আমি যে এসেছি জয়বাংলার বজ্রকণ্ঠ থেকে
আমি যে এসেছি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ থেকে।
এসেছি আমার পেছনে হাজার চরণচিহ্ন ফেলে
শুধাও আমাকে ‘এতদূর তুমি কোন প্রেরণায় এলে ?
তবে তুমি বুঝি বাঙালি জাতির ইতিহাস শোনো নাই-
‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’
একসাথে আছি, একসাথে বাঁচি, আজো একসাথে থাকবোই
সব বিভেদের রেখা মুছে দিয়ে সাম্যের ছবি আঁকবোই।
পরিচয়ে আমি বাঙালি, আমার আছে ইতিহাস গর্বের-
কখনোই ভয় করিনাকো আমি উদ্যত কোনো খড়গের।
শত্রুর সাথে লড়াই করেছি, স্বপ্নের সাথে বাস;
অস্ত্রেও শান দিয়েছি যেমন শস্য করেছি চাষ;
একই হাসিমুখে বাজায়েছি বাঁশি, গলায় পরেছি ফাঁস;
আপোষ করিনি কখনোই আমি- এই হ’লো ইতিহাস।
এই ইতিহাস ভুলে যাবো আজ, আমি কি তেমন সন্তান ?
যখন আমার জনকের নাম শেখ মুজিবুর রহমান;
তারই ইতিহাস প্রেরণায় আমি বাংলায় পথ চলি-
চোখে নীলাকাশ, বুকে বিশ্বাস পায়ে উর্বর পলি।
আমার পরিচয় কবিতার শব্দার্থ ও টীকা :
আলপথ – জমির সীমানার পথ। এখানে হাজার বছর ধরে বাঙালি জাতির পথ চলার কথা বলা হয়েছে; চর্যাপদ – বাংলা ভাষা ও সাহিত্য-ঐহিত্যের প্রথম নিদর্শন। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপাল থেকে চার্যাপদের পাণ্ডুলিপি উদ্ধার করেন। ছয়শত শতাব্দী থেকে এগারশ শতকের মদ্যে পদগুলো রচিত হয়েছে। এই পদগুলোর মধ্যে প্রাচীন বাংলার অতি সাধারণ মানুষের প্রাণময় জীবন চিত্র ফুটে উঠেছে;
সওদাগরের ডিঙার বহর – মঙ্গলকাব্যে চাঁদ সওদাগরের বাণিজ্যের কথা আছে। কবি আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের ঐতিহ্য বোঝাতে এই লোককাহিনীর আশ্রয় গ্রহণ করেছেন।
কৈবর্ত বিদ্রোহ – আনুমানিক ১০০-৭৫ খ্রিষ্টাব্দে মহীপালের বিরুদ্ধে অনন্ত-সামন্ত-চক্র মিলিত হয়ে যে বিদ্রোহ করেন তা-ই আমাদের ইতিহাসে কৈবর্ত বিদ্রোহ নামে খ্যাত। এই বিদ্রোহের নেতা ছিলেন কৈবর্ত সম্প্রদায়ের লোক। তাঁর নাম দিব্য বা দিবেক। বাঙালি জাতির বিদ্রোহের ঐতিহ্য বোঝাতে এই বিদ্রোহের উল্লেখ করা হয়েছে।
পালযুগ – ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দে গোপালের রাজ্য শাসনের মধ্য দিয়ে বঙ্গে পালযুগের সূচনা হয়। তারপর চারশত বছর পাল বংশের রাজত্ব টিকে ছিল। এ সময় শিল্প-সাহিত্যের অসামান্য বিকাশ সাধিত হয়। চিত্রকলায়ও এই সময়ের সমৃদ্ধি লক্ষযোগ্য। কবি আমাদের শিল্পের সমৃদ্ধ ঐতিহ্য বোঝাতে পালযুদ্ধের চিত্রকলার উল্লেখ করেছেন।
পাহাড়পুরের বৌদ্ধবিহার – বর্তমান নওগাঁ জেলার বদলগাছি থানায় পাহাড়পুর গ্রামে এই প্রাচীন বিহার অবস্থিত। ১৮৭৯ সালে স্যার কানিংহাম এই বিশাল কীর্তি আবিষ্কার করেন। দ্বিতীয় পাল রাজা শ্রী ধর্মপালদেব (রাজত্বকাল ৭৭৭-৮১০ খ্রি.) এই বিশাল বিহার তৈরি করেছিলেন। একে সোমপুর বিহারও বলা হয়। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বিহারগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। কবি আমাদের প্রত্নতাত্ত্বিক ঐহিত্যের পরিচয় দিতে পাহাড়পুরের বৌদ্ধবিহারের উল্লেখ করেছেন।
বরেন্দ্রভূমি সোনামসজিদ – বরেন্দ্রভূমে সোনামসজিদ বলতে চাঁপাই নবাবগঞ্জ জেলায় অবস্থিত ছোট সোনামসজিদকে বোঝানো হয়েছে। বড় সোনামসজিদ ভারতের গৌড়ে অবস্থিত। হোসেন শাহের (রাজত্বকাল ১৪৯৩-১৫১৯ খ্রি.) আমলে এই মসজিদটি নির্মিত হয়। অসাধারণ শিল্পসৌন্দর্যমণ্ডিত স্থাপত্যকর্ম হিসেবে সোনামসজিদ অন্যতম। কবি আমাদের মুসলিম ঐতিহ্যের সুমহান নিদর্শন দিয়ে এটি উল্লেখ করেছেন;
দেউল – দেবালয়;
সার্বভৌম বারো ভূঁইয়া – বাংলায় পাঠান র্ক্রানী বংশের রাজত্ব দুর্বল হয়ে পড়লে খুলনা, বরিশাল, সোনারগাঁও, ময়মন ও শ্রীহট্টে স্বাধীন জমিদারদের উত্থান ঘটে। ১৫৭৫ সালে মোগল সম্রাট আকবর বাংলা জয় করার পর এই স্বাধীন জমিদারগণ ঈসা খাঁর নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়ে মুগল শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। ইতিহাসে এঁরাই বারোভূঁইয়া নামে পরিচিত। এঁরা হলেন ঈশা খাঁ, চাঁদ রায়, কেদার রায়, প্রতাপাদিত্য, লক্ষ্মণ মাণিক্য প্রমুখ;
কমলার দীঘি – মৈমনসিংহ গীতিকার একটি পালা;
মহুয়ার পালা – মৈমনসিংহ গীতিকার একটি পালা;
তিতুমীর – চব্বিশ পরগণা জেলার হায়দরপুর গ্রামে ১৭৮২ সালে মীর নিসার আলী ওরফে তিতুমীর জন্মগ্রহণ করেন। তিনি অত্যাচারী ইংরেজী ও হিন্দু জমিদারদের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন সংগ্রাম করেছেন। ১৮৩১ সালের ১৯শে নভেম্বর ইংরেজ বাহিনীর সঙ্গে লড়াই করে তিনি সহিদ হন।হাজী
শরীয়ত – হাজী শরীয়তউল্লাহ (১৭৮১-১৮৪০ খ্রি.) মাদারীপুর জেলার শিবচর থানার সামাইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি দীর্ঘকাল মক্কায় অবস্থান করে ইসলাম ধর্ম বিষয়ে অগাদ পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। তিনি ধর্মকে আশ্রয় করে সকল সুসংস্কারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। তাঁর এই আন্দোলনকে ফরায়েজি আন্দোলন বলে।
এরপর তিনি আবদুল ওহাব নামক এক ধর্মসংস্কারকের মতাদর্শে বিশ্বাসী হয়ে ওহাবী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। তিনি সাধারণ মানুষকে ধর্মের প্রকৃত রূপ ও তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করার চেষ্টা করেছেন। তাছাড়া বিদেশি শাসন-শোষণ; জমিদার, জোতদার ও মহাজনদের অত্যাচার থেকে মানুষকে মুক্ত করার জন্য আন্দোলন করেন।
ক্ষুদিরাম – ক্ষুদিরাম বসু (১৮৮৯-১৯০৮ খ্রি.) মেদিনীপুর জেলার মৌবনি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব থেকেই ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। অত্যাচারী ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে হত্যা করতে গিয়ে ভুলবশত দুইজন ইংরেজ মহিলাকে হত্যাকে করেন। ১৯০৮ সালের ১১ই আগস্ট এই মহান বিপ্লবীর ফাঁসির আদেশ কার্যকর হয়।
সূর্য সেন – মাষ্টার দা সূর্য সেন (১৮৯৩-১৯৩৪ খ্রি.) চট্টগ্রাম জেলার রাউজান থানার নোয়াপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। আজীবন তিনি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৩০ সালে তিনি চট্টগ্রামকে ইংরেজমুক্ত করে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। কিন্তু বেশীদিন তা রক্ষা করতে পারেন নি। ১৯৩৪ সালের ১২ই জানুয়ারি তাঁর ফাঁসি হয়।
জয়নুল – জয়নুল আবেদিন (১৯১৭-১৯৭৬ খ্রি.) কিশোরগঞ্জের কেন্দুয়া থানায় জন্মগ্রহণ করেন। ‘শিল্পাচার্য’ হিসেবে তিনি খ্যাত। দেশজ ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির পটভূমিতে তাঁর বিপুল শিল্পকর্ম রচিত। দুর্ভিক্ষ তাড়িত জীবন ও জগতের ছবি এঁকে তিনি অসামন্য এক জীবন-তৃষ্ণার পরিচয় দিয়েছেন। বাংলাদেশে শিল্পকলা আন্দোলনের তিনি পথিকৃত।
অবন্ঠাকুর – অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৭১-১৯৫১ খ্রি.) কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বিখ্যাত চিত্রশিল্পী। তবে শিশুসাহিত্যিক হিসেবেও তিনি অসাধারণ প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন।
রাষ্ট্রভাষার লাল রাজপথ – ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা বাংলার অধিকারের জন্য এদেশের মানুষের রক্তে রঞ্চিত হয়েছে ঢাকার রাজপথ। আর সেই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সাফল্যের পথ ধরেই সূচিত হয় স্বাধীনতা আন্দোলন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর – বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (১৯২০-১৯৭৫ খ্রি.) ফরিদপুর জেলার (বর্তমান গোপালগঞ্জ) টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাঙালি জাতির তিনি অবিসংবাদিত নেতা, জাতির পিতা। তাঁর বিস্ময়কর প্রতিভাদীপ্ত নেতৃত্বে দীর্ঘ সংগ্রামের পথ অতিক্রম করে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনযুদ্ধে জয়লাভ করে। তিনি আমাদের স্বাধীনতার প্রতীক, মুক্তির প্রতীক, সমৃদ্ধির প্রতীক।
জয়বাংলা – মুক্তিযুদ্ধের সময়ে জাতীয় স্লোগান হিসেবে অসাধারণ এক প্রেরণা সঞ্চারী শব্দমালা। এই স্লোগান ঐক্য ও সংহতির প্রতীক।
আমার পরিচয় কবিতার কবি পরিচিতি :
সৈয়দ শামসুল হক ২৭শে ডিসেম্বর ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে কুড়িগ্রাম শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ডা. সৈয়দ সিদ্দিক হুসাইন এবং মাতার নাম সৈয়দা হালিমা খাতুন। তিনি ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে ম্যাট্রিক, জগন্নাথ কলেজ থেকে ইন্টারমিডেয়েট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে কিছুদিন পড়াশোনা করেন। একসময় পেশায় সাংবাদিকতাকে বেছে নিলেও পরবর্তী সময়ে তিনি সার্বক্ষণিক সাহিত্যকর্মে নিমগ্ন থেকে বৈচিত্র্যময় সম্ভারে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন।
সৈয়দ শামসুল হক কবিতা, গল্প, উপন্যাস ও নাটক রচনা করেছন। তাঁর শিশুতোষ রচনাও রয়েছে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি বাংলা একাডেমী পুরস্কারসহ অনেক সাহিত্য-পুরস্কার লাভ করেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ : একদা এক রাজ্যে, বৈশাখে রচিত পঙ্ক্তিমালা, অগ্নি ও জলের কবিতা, রাজনৈতিক কবিতা; গল্প : শীত বিকেল, রক্তগোলাপ, আনন্দের মৃত্যু, জলেশ্বরীর গল্পগুলো; উপন্যাস: বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ; নাটক : পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়, নূরুলদীনের সারাজীবন, ঈর্ষা; শিশুতোষ গ্রন্থ : সীমান্তের সিংহাসন।
আমার পরিচয় কবিতার মূলভাব:
‘আমার পরিচয়’ কবিতায় কবি সৈয়দ শামসুল হক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র ও আত্মমর্যাদাবোেধসম্পন্ন জাতিসত্তা প্রতিষ্ঠার নেপথ্যের সমৃদ্ধ ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক পটভূমি তুলে ধরেছেন। কবিতায় কবি আত্মপরিচয় নির্দেশ করতে গিয়ে বাঙালির বহু পুরনাে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং সুদীর্ঘ সংগ্রামী ইতিহাস আমাদের সামনে এনেছেন। এতে তাঁর আত্মমর্যাদাবােধ জাগ্রত হয়েছে। হঠাৎ করে পাওয়া বা রাতারাতি গড়ে ওঠা কোনাে বিষয় কবির এই আত্মপরিচয়ের পেছনে কাজ করেনি। তার আত্মপরিচয় এদেশের ঋদ্ধ, সমৃদ্ধ সংগ্রামী ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে ঘেরা একটি সমৃদ্ধ পরিচয়।
কবির আত্মপরিচয়ের সঙ্গে চর্যাপদের অসাম্প্রদায়িক চেতনা, চাঁদ সওদাগরের বাণিজ্য যাত্রা, পালযুগের চিত্রকলা, বৌদ্ধবিহারের জ্ঞানচর্চা, মুসলিম ধর্ম ও সাহিত্য-সংস্কৃতির বিকাশ, জমিদারি প্রথা, মৈমনসিংহ গীতিকার জীবন, কৈবর্ত বিদ্রোহ থেকে শুরু করে তিতুমীর, হাজী শরিয়তুল্লাহ, সূর্য সেন, ক্ষুদিরাম প্রমুখের বিপ্লব-বিদ্রোহ একাকার হয়ে আছে।
রবীন্দ্রনাথের বিশাল সৃষ্টি, নজরুলের সমস্ত বিদ্রোহী চেতনা ও সাম্যবাদের মুক্তির চেষ্টার সঙ্গেও একাত্ম হয়ে আছে কবির আত্মপরিচয়। তিনি বাঙালির ভাষা আন্দোলনের পথপরিক্রমায় ১৯৭১ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যােগ্য নেতৃত্বে মুক্তিসংগ্রামের মাধ্যমে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয় অর্জনের সঙ্গে আত্মপরিচয়টি জুড়ে দিয়েছেন। আমার পরিচয়’ কবিতায় মূলত ঐতিহ্যমণ্ডিত বাংলাদেশের অনবদ্য রূপটি প্রকাশ পেয়েছে।
আমার পরিচয় কবিতার ব্যাখ্যা:
» আমি জন্মেছি বাংলায়, আমি বাংলায় কথা বলি,
আমি বাংলার আলপথ দিয়ে হাজার বছর চলি।
ব্যাখ্যাঃ কবি বাংলায় জন্মেছেন। বাংলায় কথা বলে তিনি ভাব বিনিময় করেন। তিনি বাংলার আলপথ দিয়ে হাজার বছরের পথ পার হয়ে এসেছেন।
» আমি তাে এসেছি সওদাগরের ডিঙার বহর থেকে।
ব্যাখ্যাঃ প্রাচীনকাল থেকে বড় বড় বাণিজ্যতরিতে করে ব্যবসায়বাণিজ্য করতেন সওদাগরেরা। এখানে মালকাব্যে বর্ণিত চাঁদ সওদাগরের সপ্তডিঙা মধুকরের কথা স্মরণ করা হয়েছে।
» আমি তাে এসেছি কৈবর্তের বিদ্রোহী গ্রাম থেকে।
ব্যাখ্যাঃ বাঙালি জাতির বিদ্রোহের ঐতিহ্য বােঝাতে কৈবর্ত বিদ্রোহের কথা এখানে উল্লেখ করা হয়েছে। এ বিদ্রোহের নেতা ছিলেন কৈবর্ত সম্প্রদায়ের বীর দিব্য বা দিব্বোক । আনুমানিক ১০৭০-১০৭৭ খ্রিষ্টাব্দে মহীপালের বিরুদ্ধে এ বিদ্রোহ করেন অনন্তসামন্ত চক্রের মিলিত শক্তি। ইতিহাসে এটি কৈবর্ত বিদ্রোহ নামে খ্যাত।
» আমি তাে এসেছি পালযুগ নামে চিত্রকলার থেকে।
ব্যাখ্যাঃ কবি এদেশের শিল্পসমৃদ্ধ ঐতিহ্য বােঝাতে পালযুগের চিত্রকলার উল্লেখ করেছেন। ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দে গােপালের রাজ্য শাসনের মধ্য দিয়ে বঙ্গে পালযুগের সূচনা হয়। পালদের রাজত্ব চারশত বছর টিকে ছিল। এ সময় শিল্প-সাহিত্যের অসামান্য বিকাশ সাধিত হয়।
» এসেছি বাঙালি বরেন্দ্রভূমে সােনা মসজিদ থেকে।
এসেছি বাঙালি আউল-বাউল মাটির দেউল থেকে।
ব্যাখ্যাঃ কবি বাংলার মুসলিম ঐতিহ্যের সুমহান নিদর্শনের পরিচয় দিতে গিয়ে সােনামসজিদের কথা বলেছেন। অসাধারণ শিল্প সৌন্দর্যমণ্ডিত এই স্থাপত্যকর্ম হােসেন শাহের রাজত্বকালে (১৪৯৩-১৫১৯ খ্রি.) নির্মিত হয়। এটি চাপাইনবাবগঞ্জের বরেন্দ্রভূমে অবস্থিত ছােট সােনামসজিদ। একই সঙ্গে কবি আউল-বাউল, মাটির দেউলের কথাও বাঙালির ঐতিহ্য হিসেবে স্মরণ করেছেন।
» আমি তাে এসেছি সার্বভৌম বারাে ভূঁইয়ার থেকে।
আমি তাে এসেছি ‘কমলার দীঘি’ ‘মহুয়ার পালা’ থেকে।
ব্যাখ্যাঃ বাংলার স্বাধীনতা ঘােষণাকারী বারাে ভূঁইয়াদের কথা কবি বিশেষ ঐতিহ্য হিসেবে উল্লেখ করেছেন। বাংলায় পাঠান করানী বংশের রাজত্ব দুর্বল হয়ে পড়লে স্বাধীন জমিদারদের উত্থান ঘটে। ১৫৭৫ সালে মােগল সম্রাট বাংলা জয় করার পর এই জমিদাররা ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিদ্রোহ করেন। এঁরাই ইতিহাসে বারাে ভূঁইয়া নামে পরিচিত। লােককাহিনির প্রাচীন ঐতিহ্য হিসেবে কবি ‘কমলার দীঘি’ ও মহুয়ার পালা’র কথা উল্লেখ করেছেন। এ দুটিই মৈমনসিংহ গীতিকার বিখ্যাত পালা।
» আমি তাে এসেছি তিতুমীর আর হাজী শরিয়ত থেকে।
ব্যাখ্যাঃ অত্যাচারী ইংরেজদের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন সংগ্রামকারী বাঙালি বীর হিসেবে তিতুমীরের কথা স্মরণ করেছেন কবি। চব্বিশ পরগনার হায়দরপুর গ্রামে ১৭৮২ সালে মীর নিসার আলী ওরফে তিতুমীর জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৮৩১ সালের ১৯ নভেম্বর ইংরেজ বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করে শহিদ হন। হাজী শরীয়তউল্লাহ বিদেশি শাসন-শােষণ, জমিদার ও মহাজনদের অত্যাচার থেকে মানুষকে মুক্ত করার আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তিনি (১৭৮১-১৮৪০ খ্রি.) মাদারীপুর জেলার শিবচর থানার সামাইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ধর্মকে আশ্রয় করে সব কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সােচ্চার হন।
» আমি তাে এসেছি গীতাঞ্জলি ও অগ্নিবীণার থেকে।
ব্যাখ্যাঃ নােবল বিজয়ী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গীতাঞ্জলি’ ও বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের অগ্নিবীণা’ বাংলা সাহিত্যের অবিস্মরণীয় কীর্তি। এ দেশের মানুষের অধিকার আদায়ে ও স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁদের গান ও কবিতা ছিল আমাদের অনুপ্রেরণার উৎস।
» এসেছি বাঙালি ক্ষুদিরাম আর সূর্য সেনের থেকে।
ব্যাখ্যাঃ ব্রিটিশবিরােধী আন্দোলনের সশস্ত্র যোদ্ধা মাস্টার দা সূর্য সেন আর ক্ষুদিরামকে কবি বাঙালি ঐতিহ্য হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ক্ষুদিরাম বসু (১৮৮৯-১৯০৮ খ্রি.) মেদিনীপুর জেলার মৌবনি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯০৮ সালের ১১ আগস্ট ফাসিতে ঝুলিয়ে এই মহান বিপ্লবীকে হত্যা করা হয়। মাস্টার দা সূর্য সেন (১৮৯৩-১৯৩৪ খ্রি.) চট্টগ্রাম জেলার রাউজান থানার নােয়াপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ইংরেজদের অস্ত্রাগার লুট করে তিনি তাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে লিপ্ত হন এবং চট্টগ্রামের স্বাধীনতা ঘােষণা করেন। তাকেও ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়।
» এসেছি বাঙালি জয়নুল আর অবন ঠাকুর থেকে।
ব্যাখ্যাঃ বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির বিপুল শিল্পকর্মের পটভূমিতে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ও অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে কবি স্মরণ করেছে। জয়নুল আবেদিন (১৯১৪- ১৯৭৬ খ্রি.) কিশােরগঞ্জের কেন্দুয়া থানায় জন্মগ্রহণ করেন। চিত্রশিল্পী ও শিশুসাহিত্যিক অবনঠাকুর (১৮৭১-১৯৫১ খ্রি.) কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।
» এসেছি বাঙালি রাষ্ট্রভাষার লাল রাজপথ থেকে।
ব্যাখ্যাঃ ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে কবি বাঙালির ঐতিহ্য হিসেবে স্মরণ করেছেন। কারণ বাংলা ভাষার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী চেতনার পথ ধরেই সূচিত হয় স্বাধীনতা আন্দোলন।
» এসেছি বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর থেকে।
আমি যে এসেছি জয়বাংলার বজ্রকণ্ঠ থেকে।
আমি যে.এসেছি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ থেকে।
ব্যাখ্যাঃ বাংলা ও বাঙালির অবিসংবাদী নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিস্ময়কর প্রতিভাদীপ্ত নেতৃত্বে দীর্ঘ সংগ্রামের পথ অতিক্রম করেই বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। বাঙালির ঐক্য ও সংহতির প্রতীক ‘জয় বাংলা’ স্লোগান এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বজ্রকণ্ঠের ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের অবিস্মরণীয় ভাষণ বাঙালির প্রেরণার উৎস।

অনুশীলনী
কর্ম-অনুশীলন:
১.তোমার দেখা বা তোমার এলাকার কোনো ঐতিহ্য নিদর্শনের পরিচয় দাও।
বহুনির্বাচনি প্রশ্ন :
১। আমার পরিচয় কবিতায় উল্লেখিত নদীর সংখ্যা কত ?
ক. ১২০০
খ. ১৩০০
গ. ১৪০০
ঘ. ১৫০০
২।‘আমি তো এসেছি চর্যাপদের অক্ষরগুলো থেকে’ – এখানে ‘চর্যাপদের অক্ষরগুলো’ বলতে কবি কী বুঝিয়েছেন ?
ক. অতীত ঐতিহ্য
খ. সংস্কৃতিক রূপ
গ. ঐতিহাসেক পটভূমি
ঘ. সাংস্কৃতিক পরিচয়
নিচের উদ্দীপকটি পড়ে ৪ ও ৫ নং প্রশ্নের উত্তর দাও :
উপমহাদেশে শাসন ব্যবস্থার ক্রমবিকাশ পড়াতে গিয়ে জনাব মো: কামরুজ্জামান এর ধারাবাহিকভাবে পাল, সেন, মোগল, পাঠান ইত্যাদি শাসকগোষ্ঠীর শাসনকাল, শাসন ব্যবস্থা নিয়ে কথা বলেন। এ সময়কালের স্থাপত্যের নিদর্শন স্বরূপ বেশ কিছু বিষয়ের উল্লেখ করেন।
৩। উদ্দীপকের সাথে ‘আমার পরিচয়’ কবিতায় সাদৃশ্য রয়েছে –
i. জাতিগত পরিচয়ের
ii. ঐতিহাসিক পরিচয়ের
iii. সাংস্কৃতিক বিবর্তন ধারার।
নিচের কোনটি সঠিক ?
ক. i ও ii
খ. i ও iii
গ. ii ও iii
ঘ. i, ii ও ii
৪। এরূপ সাদৃশ্যের কারণ কী ?
ক. সামগ্রিকতা
খ. পটভূমি
গ. ঐক্যসূত্র
ঘ. ঐতিহ্য
সৃজনশীল প্রশ্ন :
ইংরেজ শাসকদের কাছ থেকে উপমহাদেশের মানুষের মুক্তির জন্য মহাত্মগান্ধী এক সময় এদেশের মানুষদের ঐক্যবদ্ধ করেন। নানাভাবে তাদের মাঝে দেশপ্রেম জাগ্রত করার চেষ্টা করেন। এরই ধারাবাহিক ফসল স্বদেশি আন্দোলন, অহিংস আন্দোলন ইত্যাদি। কালের বিবর্তনে নেয় পাকিস্তান ও ভারত নামক দুটো পৃথক রাষ্ট্রের এবং পরবর্তীকালে বাংলাদেশের।
ক.বৌদ্ধবিহার কোথায় অবস্থিত ?
খ.‘আমি তো এসেছি ‘কমলার দীঘি’, ‘মহুয়ার পালা’ থেকে’ – একথা দ্বারা কবি কী বোঝাতে চেয়েছেন ?
গ.উদ্দীপকটি ‘আমার পরিচয়’ কবিতার সাথে যে দিক দিয়ে সাদৃশ্যপূর্ণ তা ব্যাখ্যা কর।
ঘ.উদ্দীপকটি ‘আমার পরিচয়’ কবিতার খণ্ডাংশ মাত্র, পূর্ণচিত্র নয় – যুক্তিসহ লেখ।
আও দেখুন: