আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ও তথ্যপ্রযুক্তি | বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক | বাংলা রচনা সম্ভার

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ও তথ্যপ্রযুক্তি | বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক | বাংলা রচনা সম্ভার ,  ভূমিকা : একুশ শতকের অর্থনীতির মূল সম্পদ জ্ঞান। জ্ঞানকর্মীরাই তৈরি করবেন এই নয়া সম্পদ। সেদিক থেকে চিন্তা করলে বলা যায়, প্রতিটি দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হয় তাদের বিদ্যায়তনগুলোতে। কিন্তু আমাদের দেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে দেখা যায় যে, শিক্ষায়তনগুলোতে যথাযথ ও সময়োপযোগী শিক্ষার অভাবে ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা যে তিমিরে সে তিমিরেই থেকে যায়। বিশেষ করে উন্নত ও অনুন্নত বা উন্নয়নশীল বিশ্বের মাঝে যে ডিজিটাল ডিভাইড (Digital Divide) সৃষ্টি হয়েছে তারই শিকার হয়ে আমাদের সমাজ আজ অনেক দূর পিছিয়ে রয়েছে।

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ও তথ্যপ্রযুক্তি | বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক | বাংলা রচনা সম্ভার

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ও তথ্যপ্রযুক্তি

শিক্ষার্থীরা তথ্যপ্রযুক্তির সুফল সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে পারছে না। ফলে আমাদের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা যুগোপযোগী মানব সম্পদ সৃষ্টি করতে পারছে না। আজকের দিনে জ্ঞানকর্মী সৃষ্টিই যেখানে হওয়া উচিত শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য সেখানে শিক্ষায় প্রযুক্তির ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জাপান শিক্ষায় এত উন্নত হওয়া সত্ত্বেও সম্প্রতি নতুন শিক্ষা কমিশন গঠন করেছে, যার প্রধান লক্ষ্য হলো তথ্যপ্রযুক্তিকে কিভাবে শিক্ষার অঙ্গ করা যায় তা বের করা।

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ও তথ্যপ্রযুক্তি | বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক | বাংলা রচনা সম্ভার

 

শিক্ষা ও তথ্যপ্রযুক্তির আন্তঃসম্পর্ক :

শিক্ষা ও প্রযুক্তি একটি অপরটির পরিপূরক। শুধু প্রযুক্তিগত শিক্ষা নয় বরং শিক্ষাদানেও প্রযুক্তির ব্যবহার আজকাল বেশ জনপ্রিয়। বিশেষ করে শিক্ষা প্রশাসন, ব্যবস্থাপনা, পাঠদানসহ শিক্ষার প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে আধুনিককালে প্রযুক্তির ব্যবহার লক্ষণীয়। অন্যদিকে প্রযুক্তির ব্যবহার ও শিক্ষাক্ষেত্রে এর প্রয়োগের জন্যও প্রযুক্তিগত জ্ঞানের আবশ্যকতা রয়েছে।

সেজন্য চাই তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মানব সম্পদ। কেননা শিক্ষাক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তির সফল প্রয়োগের জন্য প্রথমত প্রযুক্তিগত জ্ঞান আবশ্যক। আবার প্রযুক্তিগত শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ছাড়া শিক্ষাকে প্রকৃত শিক্ষায় রূপায়িত করা যাবে না। ফলে শিক্ষাকে কর্মোপযোগী ও লাগসই করার মূল উদ্দেশ্যই ব্যাহত হতে বাধ্য। আবার শিক্ষিত জনগোষ্ঠী ছাড়া অশিক্ষিত জনগোষ্ঠী প্রযুক্তিকে জীবনের বাহন করে তুলতে পারবে না ।

শিক্ষাক্ষেত্রে প্রযুক্তির আবশ্যকতা :

আধুনিক শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহার খুবই জনপ্রিয় এবং শিক্ষা মনোবিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞগণ শিক্ষাক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহারকে কেবল উৎসাহিতই করেন না তাদের মতে, তা খুবই জরুরি।

প্রথমত, শিক্ষাক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহার যথাযথ ও কার্যকর শিক্ষাদান প্রক্রিয়ায় সহায়ক হিসেবে কাজ করে। গতানুগতিক শিক্ষাদান কার্যক্রমের বাইরে শিশুদেরকে বৈজ্ঞানিক উপকরণ ব্যবহার করে শিক্ষাদান করলে তা শিশুদের মনে খুব দ্রুত প্রভাব ফেলতে পারে। তাছাড়া এ সকল বৈজ্ঞানিক উপকরণ যেমন—কম্পিউটার, ইন্টারনেট, মডিউলেটরসহ অন্যান্য উপকরণসমূহ ব্যবহার করলে দ্রুততর ও যথাযথ উপায়ে শিক্ষার্থীদেরকে বাস্তব জীবনের সাথে পরিচিত করে তোলা যায়।

দ্বিতীয়ত, শিক্ষাক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহারের অর্থ হলো আধুনিক জীবন, জগৎ ও বিশ্বাসের সাথে ছাত্রাবস্থায়ই যথাযথ ধারণা লাভ, যা পরবর্তী জীবনের বৃহত্তর পরিসরে নিজেকে উপস্থাপনের উপযোগী হয়ে গড়ে উঠতে সহায়তা করবে। কেননা আধুনিক বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তির সাথে প্রায়োগিক সম্পর্ক না থাকলে অনেক বেশি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জন করেও বাস্তব জীবনে এগুলোর যথাযথ ব্যবহার ও প্রয়োগ সম্ভব হয় না ।

তৃতীয়ত, শিক্ষাক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার আমাদেরকে একটি বিজ্ঞানমন জাতি হিসেবে গড়ে উঠতে সহায়তা করবে, যা জাতীয় উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য খুবই জরুরি। কেননা বৈজ্ঞানিক এবং প্রযুক্তিগত বিকাশ ও উন্নয়নের সকল প্রচেষ্টাই নিষ্ফল হতে বাধ্য যদি না জাতি বিজ্ঞানমনস্ক হয়। কেননা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিকট একে আকর্ষণীয় ও জীবনের জন্য আবশ্যক বলে প্রমাণিত করতে না পারলে তারা একে মনেপ্রাণে গ্রহণ করবে না। তাই প্রাইমারি পর্যায়ে, বিশেষ করে মাধ্যমিক পর্যায়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সাথে তাদের ভালোভাবে পরিচিত করতে না পারলে তাদেরকে এগুলোর ব্যাপারে মানসিকভাবে প্রস্তুত করে তোলাও কষ্টসাধ্য হবে।

চতুর্থত, শিক্ষা ব্যবস্থাপনা ও প্রশাসনের ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার এক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে যথেষ্ট সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। শিক্ষার মান সংরক্ষণ, নিয়ন্ত্রণ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার ক্ষেত্রে কম্পিউটার, ইন্টারনেটের মাধ্যমে আন্তঃপ্রতিষ্ঠান নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠানের তথ্য ইন্টারনেটে সরবরাহ করাসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহার সময় ও অর্থ অপচয় রোধসহ ব্যবস্থাপনায় অনেক বেশি দক্ষতা ও স্বচ্ছতা এনে দিতে পারে।

কিন্তু অতীব দুঃখের বিষয় হলো, অর্থনৈতিক পশ্চাৎপদতা, হীনম্মন্যতা আর রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে আমাদের শিক্ষাকে এখনো তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর করে তুলতে পারিনি। আমাদের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হলো আমরা প্রযুক্তিকে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার অঙ্গ বানাতে পারিনি। অথচ জাপান শিক্ষায় এতটা উন্নত হওয়া সত্ত্বেও সম্প্রতি নতুন শিক্ষা কমিশন গঠন করেছে। কি করে তথ্যপ্রযুক্তিকে শিক্ষার অঙ্গ করা যায় সেটিই হচ্ছে এ কমিশনের পয়লা নম্বর লক্ষ্য। শিক্ষাতে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে বিকশিত করার জাপানি এ উদ্যোগ থেকে আমাদের অনেক কিছুই শেখার আছে। সিঙ্গাপুরের শিক্ষাব্যবস্থাতেও তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার লক্ষণীয়।

সীমাবদ্ধতা :

শিক্ষাক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারে আমাদের যে পশ্চাৎপদতা তার পেছনে রয়েছে আমাদের মান্ধাতার আমলের দৃষ্টিভঙ্গি, অর্থনৈতিক দৈন্য আর অবকাঠামোগত অসুবিধা। সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা হলো আমাদের অভিভাবক, শিক্ষা কিংবা শিক্ষা ব্যবস্থাপনা এবং পরিচালনার সাথে জড়িত ব্যক্তিদের আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির সাথে অপরিচিতি। সুতরাং এক্ষেত্রে আমাদের প্রধান সীমাবদ্ধতাগুলো হলো :

প্রথমত, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সাম্য আমাদের শিশুদেরকে সমানভাবে তথ্যপ্রযুক্তির জগতে প্রবেশ করতে দিচ্ছে না। ফলে অভিজ্ঞনরা টাকার বিনিময়ে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষা কিনতে পারলেও অভাজনদের সন্তানদেরকে সেই পুরনো দিনের সরকারি প্রতিষ্ঠানের পশ্চাৎপদ শিক্ষাই গ্রহণ করতে হচ্ছে। ফলে অর্থনৈতিক বৈষম্য আমাদের শিক্ষার সুযোগ লাভের ক্ষেত্রে যে বৈষম্য সৃষ্টি করছে তা জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট বিভাজন চিহ্ন এঁকে দিচ্ছে।

দ্বিতীয়ত, আমাদের অর্থনৈতিক দৈন্য ও পশ্চাৎপদতার কারণে আমরা শিক্ষাক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তির প্রয়োগ ও ব্যবহার সংক্রান্ত নানা পরিকল্পনা, কর্মসূচি গ্রহণ করেও যথার্থভাবে তার সফল বাস্তবায়ন করতে পারছি না। সাম্প্রতিককালে দেশের সকল স্কুলে কম্পিউটার প্রদানের একটি সরকারি প্রজেক্ট অর্থসংস্থানের অভাবে সকল প্রস্তুতি সম্পন্নের পরেও চালু করা যাচ্ছে না বলে বিজ্ঞান এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রী জানান। তাই দেখা যাচ্ছে, প্রয়োজনীয় অর্থসংস্থানের অভাবে সরকার যেমন জনগণের তথ্যপ্রযুক্তির অধিকার নিশ্চিত করতে পারছে না, তেমনি জনগণও একই কারণে নিজে নিজে সে সুযোগ গ্রহণ করতে পারছে না।

তৃতীয়ত, আমাদের আরেকটি সীমাবদ্ধতা হলো, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সাথে জড়িত অধিকাংশ কর্তা ব্যক্তিই বিজ্ঞানমনষ্ক নন। কথিত আছে, কোনো এক কৃষি গবেষক একবার এরশাদ সরকারের কোনো এক প্রাক্তন কৃষি মন্ত্রীকে বলল, স্যার আমাদের একটা জীন ব্যাংক স্থাপন আবশ্যক। তখন উনি কিছু বুঝতে না পেরে সাবলীলভাবে বললেন, ব্যাংক স্থাপনের বিষয়টি অর্থ মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ারভুক্ত। সুতরাং এতে কৃষি মন্ত্রণালয়ের কোনো হাত নেই ।

চতুর্থত, আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রযুক্তির ব্যবহারের ক্ষেত্রে আরেকটি সমস্যা হলো উপযুক্ত প্রশিক্ষকের অভাব এবং শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কারিগরি জ্ঞানের অভাব। স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসাগুলোতে কম্পিউটার, ফটোকপিয়ার বা অন্যান্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি অধিকাংশ সময়ই প্রয়োজনীয় লোকবলের অভাবে অব্যবহার্য পড়ে থাকতে দেখা যায়। কেননা কারিগরি জ্ঞানহীন লোকদেরকে বাদ দিয়ে উপযুক্ত লোক নিয়োগেও রয়েছে নানা বাধা ।

পঞ্চমত, দুর্নীতির ফলে প্রযুক্তিগত উন্নয়নের অনেক প্রকল্পই তার প্রয়োজনীয় লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। ইতিমধ্যেই প্রতিটি কলেজে একটি করে কম্পিউটার প্রদানের যে কর্মসূচির কথা বলা হচ্ছে তা আদৌ বাস্তবায়িত হবে কিনা তা বলা মুশকিল।

ষষ্ঠত, উপযুক্ত পরিকল্পনার অভাব ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণেও অনেক উদ্যোগ বাস্তবায়িত হয়নি বা হচ্ছে না। বিশেষ করে তথ্যপ্রযুক্তি সংক্রান্ত নীতি প্রণয়ন ও রূপায়ণের দায়িত্বে নিয়োজিতদের অদক্ষতা ও সিদ্ধান্তহীনতাও আমাদেরকে এক্ষেত্রে পিছিয়ে দিচ্ছে।

আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

করণীয় :

শিক্ষাক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার এবং প্রসারে নিম্নলিখিত ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি :

১. শিক্ষাক্ষেত্রে কম্পিউটার ব্যবহারের পাশাপাশি ইন্টারনেট ব্যবহারের খরচ বিপুলভাবে কমাতে হবে । প্রতি মিনিটে এর খরচ কোনো ক্রমেই পঁচিশ পয়সার বেশি হওয়া উচিত নয় ।

২. গ্রাম ও শহরের প্রতিটি স্কুল যাতে খুব শিগগিরই কম্পিউটার আর ইন্টারনেট সংযোগ পায় সে লক্ষ্য সামনে রেখে নীতিনির্ধারকদের কাজ করে যেতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে আইটি সম্পর্কিত যে টাস্কফোর্স গঠিত হয়েছে তার অন্যতম কাজই হওয়া উচিত কি করে শিক্ষাঙ্গনে ইন্টারনেট সংযোগ সম্প্রসারণ করা যায়।

৩. ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে নয়, বরং আবশ্যিক বিষয় হিসেবে তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে একটি কোর্স চালু করা প্রয়োজন। পাশাপাশি বছর বছর সিলেবাস আপগ্রেড করা এবং ইন্টারনেট থেকে শিক্ষা উপকরণ ডাউনলোড করার সুযোগ তৈরি করতে হবে।

৪. সারা দেশের ই-লার্নিং চালু করার মতো টেলিযোগাযোগ অবকাঠামো এবং শিক্ষা অবকাঠা গড়ে তুলতে হবে। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের আসলে এই ই-লার্নিং শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব। গ্রামীণ ফোন রেলওয়ের ফাইবার অপটিক লাইন লিজ নিয়ে মোবাইল ফোনের ব্যবসা করছে। এই লাইনটি সহজেই ই-শিক্ষাতেও ব্যবহার করা যায়। আর এটা করতে পারলে ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সবাইকে আধুনিক শিক্ষার আওতায় নিয়ে আসা সম্ভব হবে।

৫. স্কুল এবং কলেজগুলোতে কম্পিউটার ল্যাব দরকার। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় ব্যবহারিক কার্যক্রমের চেয়ে তাত্ত্বিক অংশ বেশি প্রাধান্য পায়। অথচ তথ্যপ্রযুক্তিতে প্র্যাকটিক্যাল অংশ মুখ্য হিসেবে বিবেচ্য। প্রতিটি স্কুল ও কলেজে উন্নত কম্পিউটার ল্যাব করা সরকারের পক্ষে সম্ভব না-ও হতে পারে। বিকল্প হিসেবে প্রবাসীদের এবং স্থানীয় বিত্তবানদেরকে নিজ নিজ এলাকার স্কুল, কলেজে কম্পিউটার ল্যাব করে দেয়ার জন্য সরকার উৎসাহিত করতে পারে।

যে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এই ল্যাব করে দেবে তার নাম অনুসারে ল্যাবের নামকরণ করা যেতে পারে। একটি দশ বা বিশ কম্পিউটার বিশিষ্ট ল্যাব করতে বড় জোর তিন থেকে ছয় লাখ টাকা প্রয়োজন । প্রবাসী বা স্থানীয় অনেক বিত্তবান লোককেই পাওয়া যাবে যারা এ ব্যাপারে এগিয়ে আসবে। স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে স্থানীয় সরকার এলাকার বিত্তবানদের সাথে যোগাযোগ করে তাদেরকে গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার বা পরিচয় পর্বের মাধ্যমে দেশের লোকদের মাঝে বিপুল উৎসাহের সৃষ্টি করতে পারে।

৬. তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক যে সিলেবাস সরকার (জাতীয় পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড) প্রণয়ন করছে, বিশেষ করে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের জন্য, তা আরো যুগোপযোগী করতে হবে। এই সিলেবাস প্রণয়নের এবং স্কুল ও কলেজের তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক শিক্ষাব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্ব বুয়েট এবং শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স ডিপার্টমেন্টকে দেয়া যেতে পারে।

৭. প্রতিটি স্কুল এবং কলেজে তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক পৃথক বিভাগ করা দরকার। স্কুলগুলোতে পলিটেকনিক (সরকারি/বেসরকারি) থেকে পাস করা ডিপ্লোমা ইন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারদের বিশেষ ট্রেনিং দিয়ে নিয়োগ দেয়া দরকার এবং কলেজগুলোতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার বিজ্ঞানে পাস করা লোকদের নিয়োগ দেয়া দরকার। এদের বেতন ও সুযোগ-সুবিধা অবশ্যই বেশি থাকতে হবে। গণিত ও পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষকদের (ট্রামস-এ) সামান্য ট্রেনিং দিয়ে কম্পিউটার শিক্ষার শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত করা বন্ধ করতে হবে। কমপক্ষে তিন বছরের ডিপ্লোমা কোর্স করা না থাকলে বা সমমানের প্রশিক্ষণ না থাকলে স্কুলগুলোতে কম্পিউটার বিজ্ঞানের শিক্ষক হতে পারবে না এ ধরনের নীতি বাস্তবায়ন করতে হবে।

৮. স্কুল-কলেজের শিক্ষাব্যবস্থায় কারিগরি শিক্ষাকে অর্থাৎ তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়কে প্রাধান্য দিতে হবে। একটি শিশু যখন ‘অ-আ-ক-খ’ শেখে তখন থেকেই সে যেন কম্পিউটার কি, কেন দরকার, এ সম্পর্কে বুঝতে পারে।

৯. উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়তে পারে এ ধরনের শিক্ষার্থীদের সংখ্যা খুব বেশি নয়। অনেক শিক্ষার্থীই এসএসসি পরীক্ষা দেয়ার পরপরই লেখাপড়া বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়। এই বিপুল শিক্ষার্থীদেরকে সরকার পলিটেকনিক শিক্ষায় উৎসাহিত করতে পারেন। সেজন্য প্রাইমারি শিক্ষা  শেষ করার পর পরই দুটি বিকল্প থাকতে পারে। একটি হচ্ছে যারা সম্মান পড়বে, আরেকটি হচ্ছে যারা ডিপ্লোমা পড়বে। প্রাইমারি শিক্ষার পরপরই এই দুই ভাগের শিক্ষা পদ্ধতি প্রবর্তন করতে হবে। দুই দিকে দুই দল চলে যাবে। অর্থাৎ যারা ডিপ্লোমা পড়বে তাদের কারিগরি শিক্ষা ষষ্ঠ শ্রেণী থেকেই শুরু হবে, যাতে করে একটি ছেলে অষ্টম বা নবম শ্রেণীতে উঠেই নিজে কিছু রোজগার করতে পারে। সিঙ্গাপুরে এ ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা চালু করে ভালো ফল পাওয়া গেছে।

১০. বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কম্পিউটার, টেলিকমিউনিকেশন ইত্যাদি বিষয়গুলোর আসন সংখ্যা বাড়াতেই হবে এমন নয়। বরং যারা আইটি বাদে অন্য বিষয়ে পড়ছে তাদের কোর্সগুলোতে আইটি এক বড় অংশ হিসেবে যুক্ত হতে পারে। যেমন যারা বাংলা, ইতিহাস বা বাণিজ্য পড়ছে তাদের এক বা দেড় বছরের একটি Multimedia Engineering কোর্স থাকতে পারে। যারা সিভিল বা কেমিক্যাল পড়ছে, তাদের বিষয়ে Database Programming-এর এক বছরের একটি কোর্স যোগ করা যায়। বিশ্ববিদ্যালয় লেভেলে সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল কম্পিউটার বোর্ড মেকানিক্যাল ও ইলেকট্রনিক্সের সমন্বয়ে মেকাট্রনিক্স নামে নতুন এক বিষয় চালু করেছে।

১১. শুধু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নয়, অপ্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়েও যাতে তথ্যপ্রযুক্তির প্রসার, বিশেষ করে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে তার প্রাধান্য বৃদ্ধি পায় সেজন্যে সহায়ক নীতি সমর্থন দিয়ে যেতে হবে। এখন অসংখ্য প্রোগ্রামার ও সফটওয়্যারের প্রয়োজন হবে। এভাবে দেশীয় সফটওয়্যার ফার্মগুলোতে  কাজের সুযোগ প্রসারিত হবে। এর প্রভাব গিয়ে শিক্ষার ওপর পড়বে। অনেক সাধারণ ঘরের ছেলেমেয়েরাও তখন ই-শিক্ষায় শিক্ষিত হবার উদ্যোগ নেবে।

উপসংহার :

শিক্ষাব্যবস্থায় বৈষম্য বিরাজমান থাকলে গরিব হিতৈষী কার্যক্রমের প্রসারে এই শিক্ষা বরং অন্তরায় হিসেবেই কাজ করবে। সে কারণেই শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করার লক্ষ্যে একই ধরনের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। এই পর্যায়ে দেশ, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতি বিশ্বস্ত থেকে প্রযুক্তি-সহায়ক আধুনিক সুষম শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। রাষ্ট্র একা এ ধরনের শিক্ষা নিশ্চিত করতে পারবে বলে মনে হয় না। তবে নেতৃত্ব রাষ্ট্রের হাতেই থাকতে হবে।

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ও তথ্যপ্রযুক্তি | বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক | বাংলা রচনা সম্ভার

 

প্রাথমিক শিক্ষার মতো সামাজিক পণ্য মূলত রাষ্ট্রকেই নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য তথ্যপ্রযুক্তি সহায়ক সকল ধরনের অবকাঠামো উন্নয়নে রাষ্ট্রকেই আরো বেশি তৎপর হতে হবে। ভারতের অন্ধ্র প্রদেশ বা মহারাষ্ট্রের সরকারি ভূমিকা লক্ষ্য করলেই এ বিষয়টি আরো স্পষ্ট হবে। পাশাপাশি ব্যক্তি ও অলাভজনক খাতকেও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। তাছাড়া শিক্ষাঙ্গনে যে অব্যবস্থাপনা ও অরাজকতা বিরাজ করছে তার মোকাবিলাও সমাজকেই করতে হবে। রাষ্ট্র একা তা করতে পারবে না।

 

আরও দেখুন:

Leave a Comment