আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস নিয়ে রচনার একটা নমুনা তৈরি করি আজ। এই রচনাটি আমাদের আন্তর্জাতিক ও জাতীয় দিবস সিরিজের একটি রচনা। আমাদের সকল রচনা শিক্ষার্থীদের ধারণা দেবার জন্য। মুখস্থ করার জন্য নয়। এই রচনা থেকে শিক্ষার্থীরা শুধুমাত্র ধারণা নেবেন। তারপর নিজের মতো করে নিজের নিজের ভাষায় লিখবেন।
Table of Contents
আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস
ভূমিকা :
নিরক্ষরতা একটি অভিশাপ। একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে সারা বিশ্বে প্রায় একশ কোটি লোকেরও বেশি নিরক্ষর। আর এ একশ কোটি লোকের মধ্যে প্রায় সাতষট্টি কোটি নিরক্ষর লোকের বাস দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে। এই পিছিয়ে থাকা নিরক্ষর জনগোষ্ঠীর সাক্ষরতার গুরুত্ব অনুধাবন করে প্রতি বছর ৮ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়।
সাক্ষরতা :
বাংলাদেশের ভৌগোলিক পরিসরে ‘সাক্ষরতা’ শব্দের প্রথম উল্লেখ দেখা যায় ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে, লোকগণনার অফিসিয়াল ডকুমেন্টে। সাক্ষরতা কথাটি উদ্ভব ঘটেছে সাক্ষর শব্দ থেকে। সাক্ষর বলতে অক্ষরযুক্ত অর্থাৎ অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন মানুষকে বোঝায়। আর অক্ষরজ্ঞান রয়েছে এমন নাগরিকের সংখ্যা হলো সাক্ষরতা। উল্লেখ্য যে সাক্ষর ও ‘স্বাক্ষর’ শব্দ দুটির মধ্যে তেমন কোনো ধ্বনিগত পার্থক্য নেই কিন্তু অর্থগত ও বানানগত পার্থক্য রয়েছে। ‘স্বাক্ষর’-এর শাব্দিক অর্থ হলো দস্তখত বা সই করা।
কিন্তু ব্যবহারিক অর্থে স্ব-অক্ষরের সঙ্গে পরিচয় রয়েছে যার তিনিই স্বাক্ষর। অর্থাৎ তার নাম লেখার জন্য যে কয়টি বর্ণমালা প্রয়োজন তা ছাড়া অন্য কোনো বর্ণের সাথে তার পরিচয় নেই। শুরুতে এই ছিল সাক্ষরতার সংজ্ঞা। পরবর্তী পর্যায়ে ১৯৪০-এর দশকে পড়া ও লেখার দক্ষতাকে ‘সাক্ষরতা’ বলে অভিহিত করা হতো। ষাটের দশকে পড়া ও লেখার দক্ষতার সঙ্গে সহজ হিসাব-নিকাশের যোগ্যতাসম্পন্ন মানুষই সাক্ষর মানুষ হিসেবে পরিগণিত হতো।
সত্তরের দশকে পড়া, লেখা ও হিসাব-নিকাশের পাশাপাশি সচেতনতার দক্ষতা এবং আশির দশকে পড়া, লেখা, হিসাব-নিকাশ, সচেতনতা ও দৃশ্যমান বস্তুসামগ্রী পঠনের ক্ষমতা সাক্ষরতার দক্ষতা হিসেবে স্বীকৃত হয়। নব্বইয়ের দশকে সাক্ষরতা বিষয়ে জনমানুষের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ার সাক্ষরতার দক্ষতা হিসেবে আরো নতুন নতুন বিষয় সংযোজিত হয়। এগুলো হলো, যোগাযোগের দক্ষতা, ক্ষমতায়নের দক্ষতা, জীবননির্বাহী দক্ষতা, প্রতিরক্ষায় দক্ষতা ও সাংগঠনিক দক্ষতা।
সাক্ষরতা অধিকার:
সাক্ষরতা হলো মানুষের মৌলিক অধিকারসমূহের একটি। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে ঘোষিত জাতিসংঘের মানবাধিকার ঘোষণার ধারা ২৬-এ এই অধিকারের কথা সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। এই ঘোষণায় বলা হয়: ‘শিক্ষা প্রতিটি মানুষের একটি অধিকার। এই শিক্ষা মৌলিক স্তব পর্যন্ত হবে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। এছাড়া কারিগরি ও পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির সুযোগও বিস্তৃত হতে হবে। জাতিসংঘের এই ঘোষণার পর সদস্যভুক্ত প্রায় প্রতিটি দেশ সাংবিধানিকভাবে সাক্ষরতাকে প্রতিটি নাগরিকের অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
বাংলাদেশের সংবিধানের ধারা ১৭-তে দেশের প্রতিটি নাগরিকের সাক্ষরতা প্রদানের বিধান রয়েছে। ১৯৬৫-এর ৮ সেপ্টেম্বর ইরানের তেহরান শহরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শিক্ষামন্ত্রীদের সম্মেলন থেকে আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস হিসেবে পালনের ঘোষণা দেয়া হয়। ১৯৯০-এ থাইল্যান্ডের জমতিয়েনে সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করার অঙ্গীকার ঘোষণা করা হয়। সবার জন্য শিক্ষার মূল লক্ষ্য প্রত্যেক নিরক্ষর ব্যক্তিকে সাক্ষর করে তোলা।
সাক্ষরতা সংজ্ঞার বিবর্তন :
সাক্ষরতা দক্ষতার বিস্তৃত পরিধির কারণে সাক্ষরতার সংজ্ঞাও বিবর্তিত হয়েছে । আর অর্জিত দক্ষতার ক্ষেত্রেরও সম্প্রসারণ ঘটেছে। নতুন সাক্ষররা জীবনের নানা ক্ষেত্রে অর্জিত দক্ষতা ব্যবহার করে তা তাদের জীবন, জীবিকা ও জীবনচর্যার নানা পরিসরে প্রভাব ফেলছে। সাক্ষরতার সংজ্ঞা সময়ের ব্যাপ্ত পরিসরে বিবর্তিত হয়েছে। বিবর্তিত সংজ্ঞাগুলো নিচে উপস্থাপন করা হলো :
১৯০১ :
মাতৃভাষায় নাম স্বাক্ষর করতে পারার ক্ষমতা ।
১৯৫১ :
স্পষ্ট ছাপার অক্ষরে লেখা যে কোনো বাক্য পড়তে পারার ক্ষমতা।
১৯৬১ :
যে বুঝে কোনো ভাষা পড়তে পারে সে-ই সাক্ষর।
১৯৭৪ :
যে কোনো ভাষায় চিঠি লিখতে পারার ক্ষমতা থাকলে তাকে সাক্ষর হিসেবে গণ্য করা যায় । ১৯৮১ : যে কোনো ভাষায় চিঠি লিখতে পারার ক্ষমতা থাকলেও তাকে সাক্ষর বলা যায় ।
১৯৮৯ :
মাতৃভাষায় কথা শুনে বুঝতে পারা, মৌখিকভাবে ও লিখিতভাবে তা ব্যক্ত করার সাথে সাথে প্রয়োজনীয় দৈনন্দিন হিসাব করার এবং লিপিবদ্ধ করে রাখার ক্ষমতালাভ ।
২০০৩ :
যে বাংলা ভাষায় কথা শুনে বুঝতে পারবে, মৌখিক ও লিখিতভাবে তা প্রকাশ করতে পারবে, সমাজ পরিবেশকে বিশ্লেষণ করতে পারবে, দৃশ্যমান বস্তুসামগ্রী যেমন আলোকচিত্র, লেখচিত্র, পোস্টার, ছবি, চার্ট, কার্টুন ইত্যাদি পড়তে ও ব্যাখ্যা করতে পারবে এবং সেই সঙ্গে অতি প্রয়োজনীয় হিসাব-নিকাশ করতে ও তা টুকে রাখতে পারবে ।
সাক্ষরতা দিবসের তাৎপর্য :
আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবসে সভা, সেমিনার এবং আয়োজিত বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে একটি বিষয়কেই বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়, আর সেটি হলো সাক্ষরতার ব্যাপক সম্প্রসারণ। শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে নিরক্ষর জনগণকে সচেতন করা, বিভিন্ন দেশে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে যেসব উদ্যোগ নেয়া হয় তাতে জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, নিরক্ষরতার ভয়াবহতা জনগণ যাতে করে উপলব্ধি করতে পারে সে ব্যাপারে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে সচেতন করা, শিক্ষাকে ব্যাপক জনগোষ্ঠীর কাছে সহজে পৌঁছে দেয়া ইত্যাদি লক্ষ্য নিয়ে দিবসটি উদযাপিত হয়। এটি একটি প্রতীকী দিন। তাই সাক্ষরতা দিবসের লক্ষ্য কেবল একটি দিনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এ লক্ষ্য অর্জনে কাজ করে যেতে হবে সারা বছর ।
সাক্ষরতার স্তর :
সাক্ষরতার মান ও দক্ষতা বিবেচনায় এর চারটি স্তরের উল্লেখ পাওয়া যায় । যথা-
ক. অ-সাক্ষর :
বর্ণ ও শব্দ পড়তে ও লিখতে না পারা, গণনা করতে না পারা এবং এ কারণে এই দক্ষতাগুলো দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার করতে না পারা।
খ. প্রাক সাক্ষর:
কিছু শব্দ পড়তে ও লিখতে পারা, ন্যূনতম গণনার দক্ষতা অর্জন এবং দৈনন্দিন জীবনে এই দক্ষতাগুলোকে খুবই সীমিতভাবে ব্যবহার করতে পারা।
গ. প্রারম্ভিক সাক্ষর;
পরিচিত বিষয়াবলী সম্পর্কিত সহজ বাক্যসমূহ পড়তে ও লিখতে পারা, পাটিগণিতের চারটি মৌলিক নিয়মে অংক কষতে পারা এবং প্রাত্যহিক জীবনের পরিচিত পরিবেশে এই দক্ষতা ও যোগ্যতাগুলো সীমিতভাবে ব্যবহার করতে পারা।
ঘ. উচ্চস্তর সাক্ষর:
বিচিত্র বিষয়াবলী সম্পর্কিত লেখা সাবলীলভাবে পড়তে পারা, এ ধরনের বিষয়াবলী সম্পর্কে স্বাচ্ছন্দ্যে লিখতে পারা, পাটিগণিতের মৌলিক চার নিয়মে দক্ষতা লাভসহ গাণিতিক কার্যকারণ বুঝতে পারা, প্রাত্যহিক জীবনে এই দক্ষতাগুলো ব্যবহার করতে পারা এবং অধিকতর শিক্ষা গ্রহণকল্পে সামগ্রিক সাক্ষরতা দক্ষতাকে স্বাধীনভাবে প্রয়োগ করতে পারা।
সাক্ষরতার আন্তর্জাতিক পরিপ্রেক্ষিত:
ষোড়শ শতাব্দীতে বাইবেল পড়তে শেখানোর ব্রত নিয়ে জার্মানি, সুইডেন ও স্কটল্যান্ডে শিশু ও বয়স্ক শিক্ষা ক্ষেত্রে নতুনমাত্রা ‘সাক্ষরতা’ আন্দোলনের সূচন হয়। পরবর্তীতে দুশো বছরের মধ্যে সাক্ষরতার হার উচ্চমাত্রা অর্জনে সক্ষম হয়। উন্নয়নশীল দেশসমূহে ইউরোপীয় ও উত্তর আমেরিকান মিশনারীরাই মূলত প্রথম, যারা স্থানীয় সনাতন ভাষাকে লিখিতরূপ দেন এবং পড়তে শেখান। সাক্ষরতা প্রত্যেক ধর্ম গ্রন্থের সাথে সুদৃঢ়ভাবে সম্পর্কিত ইসলাম ধর্মের পবিত্র গ্রন্থ আল-কুরআনের প্রথম বক্তব্য ছিল ‘পড়’। সাক্ষরতার ইতিহাস পুরনো হলেও আধুনিককালে বিশ্বব্যাপী এই টার্ম নিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম বিগত দু’শো বছরের।
নিরক্ষরতা দূরীকরণে রাশিয়ার ইতিহাস দীর্ঘ। স্মরণকালে পৃথিবীতে রাষ্ট্রীয়ভাবে জাতীয় সাক্ষরতা অভিযান পরিচালিত হয় বিংশ শতাব্দীতে সোভিয়েত ইউনিয়নে, ১৯১৭ সালের বিপ্লবের পর। ১৯৮২ সালে জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী ১৯৫০-১৯৬০ সাল পর্যন্ত পৃথিবীব্যাপী ৫০টি সাক্ষরতা অভিযান পরিচালিত হয় । কিউবায় ১৯৬১ সালে নয় মাসব্যাপী ৯৫ হাজার নিবেদিত তরুণের পরিচালিত সাক্ষরতা অভিযানে শতকরা ৭০ ভাগ লোক সাক্ষর হয়। ১৯৬১ সালের ২২ ডিসেম্বর ফিদেল ক্যাস্ট্রো কিউবাকে নিরক্ষরমুক্ত দেশ হিসেবে ঘোষণা করেন । নিকারাগুয়ার সাক্ষরতা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
সান্দিনিস্তা বিজয়ের অব্যবহিত পরেই ১৯৮০ সালে পরিচালিত এ সাক্ষরতা অভিযানের যুক্তি হিসেবে বলা হয় বিপ্লবকে সংহত ও বিপ্লবের প্রক্রিয়াকে বহন করে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় শ্রমশক্তি সৃষ্টির পদক্ষেপ হিসেবে নিরক্ষরতা দূরীকরণ অপরিহার্য ছিল।’ (ডেইনার : ১৯৮১)। চীনে ১৯৪৯ সালের বিপ্লবের পর সর্বজনীন সাক্ষরতা অর্জনের লক্ষ্যে অভিযান শুরু হয়। সাক্ষরতা চীনের জাতীয় মৌলিক লক্ষ্য হলেও তা অর্জিত হয়নি। তানজানিয়াতে নিরক্ষরতা দূরীকরণে বিভিন্ন কর্মসূচিতে সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু সাক্ষরতা ধরে রাখা ও সাক্ষরতা দক্ষতার কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত করা তাদের কাছে কঠিন বলে প্রতিভাত হয়েছে।
– ফিলিপাইন সাক্ষরতা অভিযানের অংশ হিসেবে ‘প্রতিজন শেখাও একজন’ (Each One Teach One) কৌশল গ্রহণ করেছে। সেখানকার লাকাব উন্নয়নশীল দেশে জাতীয় বয়স্ক সাক্ষরতা অভিযানের প্রথম দিকের প্রবক্তাদের অন্যতম ।
– ভারত নিরক্ষরতা দূরীকরণে ব্যর্থ হয়ে ১৯৮৮ সালে সার্বিক সাক্ষরতা অভিযান (টিএলসি) শুরু করে। ইউনেস্কো ১৯৬৭ সালে প্রবর্তিত ‘পরীক্ষামূলক বিশ্ব সাক্ষরতা কর্মসূচি’ চালু করে। পরীক্ষামূলক বিশ্ব সাক্ষরতা কর্মসূচির প্রধান কর্মকাণ্ড ছিল পাঁচটি। দক্ষতা, প্রশিক্ষণ, ব্যবস্থাপনা, আকার ও সময়ব্যাপ্তির দিক থেকে এগুলো একেকটি একেক রকম ছিল। ১৯৬৭ সালে আলজেরিয়া, ইকুয়েডর, ইরান, মালি, ১৯৬৮ সালে ইথিওপিয়া, গিনি, মাদাগাস্কার এবং তানজানিয়া, ১৯৬৯ সালে সুদানে সাক্ষরতা অভিযান চলে।
১৯৭০ সালে পাওলো ফ্রেইরি ‘মনোসামাজিক পদ্ধতি’ বলে খ্যাত সাক্ষরতা আন্দোলন শুরু করেন। ফ্রেইরি সাক্ষরতা অর্জনকে আধিপত্য ও পারস্পরিক যোগাযোগ সম্পর্কিত সমস্যার উত্তর হিসেবে বর্ণনা করেছেন। বাংলাদেশের অ্যাকশন এইডের শিক্ষা প্রকল্পে প্রবর্তিত RELECT ( Regenerated Freirean Literacy through Empowering Community Techniques) পদ্ধতিতে ফ্রেইরির উদ্ভাবিত পদ্ধতির প্রভাব লক্ষণীয় ।
আন্তর্জাতিকভাবে সাক্ষরতা কার্যক্রম সফল করার জন্য ১৯৯৭ সালে হামবুর্গে পঞ্চম আন্তর্জাতিক বয়স্ক শিক্ষা সম্মেলন থেকে সাক্ষরতা দশকের ধারণার সূত্রপাত। বিশ্বব্যাপী ‘সবার জন্য শিক্ষা’ উদ্যোগের অতিরিক্ত প্রেরণা হিসেবে এই ধারণা ২০০০ সালে ডাকারে অনুষ্ঠিত বিশ্ব শিক্ষা ফোরামে বিভিন্ন দেশের জোরালো সমর্থন অর্জন করে। অতঃপর ‘সবার জন্য শিক্ষা’ বিশ্বব্যাপী বাস্তবায়নের লক্ষ্যে জাতিসংঘ ঘোষিত ‘আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দশক (২০০৩-২০১২) গত বছর থেকে শুরু হয়েছে। যার মূলমন্ত্র ‘সাক্ষরতা তথা স্বাধীনতা’। আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দশকের উদ্দেশ্য হলো ২০১৫ সালের মধ্যে সবার জন্য শিক্ষা’র লক্ষ্য অর্জনে বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিশ্রুতির নবায়ন।
বিভিন্ন সনদ ও সংবিধানে সাক্ষরতা:
জাতিসংঘ সনদ :
জাতিসংঘ সনদের নবম অধ্যায় ‘আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক সহযোগিতা’-এর ৫৭ নং ধারার ১ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- আন্তঃসরকার চুক্তির দ্বারা প্রতিষ্ঠিত এবং মূল চুক্তিপত্রের বর্ণনা অনুযায়ী অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়সমূহ সম্পর্কে ব্যাপকভাবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দায়িত্বশীল বিশেষ এজেন্সিগুলোর সাথে ধারা ৬৩ অনুসারে জাতিসংঘের সম্পর্ক স্থাপন করা হবে। শিশু অধিকার সনদ অনুচ্ছেদ ২৮ : অংশগ্রহণকারী রাষ্ট্র সমান সুযোগের ভিত্তিতে শিশুর শিক্ষা লাভের অধিকারকে স্বীকার করবে এবং এ অধিকারকে অধিক বাস্তবায়নের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করবে, বিশেষ করে :
ক. সবার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক এবং সহজলভ্য করতে হবে।
খ. সাধারণ ও বৃত্তিমূলক শিক্ষাসহ বহুমুখী মাধ্যমিক শিক্ষাকে উৎসাহ দিতে হবে।
গ. বিদ্যালয়ে নিয়মিত উপস্থিতি উৎসাহিত করা এবং স্কুল ত্যাগের হার কমানোর লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
বাংলাদেশ সংবিধানে সাক্ষরতা:
সংবিধানের ১৭ অনুচ্ছেদে জাতীয় শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ জ্বর, অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা সম্পর্কে বলা হয়েছে-
ক. একই পদ্ধতির গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সকল বালক-বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের জন্য;
খ. সমাজের প্রয়োজনের সঙ্গে শিক্ষাকে সঙ্গতিপূর্ণ করার জন্য এবং সেজন্য প্রয়োজনসিদ্ধ করার উদ্দেশ্যে যথাযথ প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ও সদিচ্ছা প্রণোদিত নাগরিক সৃষ্টির জন্য নির্ধারিত এবং
গ. আইনের দ্বারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিরক্ষরতা দূর করার জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে ।
বাংলাদেশে সাক্ষরতা আন্দোলন :
সাক্ষরতা আন্দোলন বাংলাদেশে সফল না হলেও এর ইতিহাস অনেক পুরানো। ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ আমলে ১৮৮২ সালে স্যার উইলিয়াম হান্টারের প্রতিবেদনে নৈশ বিদ্যালয়ের ধারণার উল্লেখ পাওয়া যায়। ১৯১৭-১৮ তে নিরক্ষরতা দূরীকরণে নৈশ বিদ্যালয় স্থাপন, অবিভক্ত বঙ্গে ১২৬টি নৈশ বিদ্যালয় ও ১৪০টি বয়স্ক শিক্ষা কেন্দ্র ছিল। ১৯৩৮ সালে নিরক্ষরতা দূরীকরণ কর্মসূচি আরও বৃদ্ধি পায়। ১৯৬০ সালে বার্ড (Bangladesh Academy for Rural Development) কুমিল্লায় ব্যাঙ্ক শিক্ষা চালু করে। ১৯৬৩ সালে সরকার জনশিক্ষা পরিদপ্তরে একটি বয়স্ক শিক্ষা শাখা স্থাপন করে । প্রথমে ৪ জেলার ৪ থানায়, পরে ১৯৬৭ সালে আরো নতুন ৪টি থানায় শিক্ষা কর্মসূচি চলে ।
১৯৭৯ সালে কর্মসূচির সর্বশেষ মূল্যায়ন রিপোর্ট অনুযায়ী ১৯৬৩-৭৯ পর্যন্ত মহিলাদের জন্য ৬৯০৪টি কেন্দ্রসহ সর্বমোট ১৪,৪৭৬টি সাক্ষরতার শিক্ষাকেন্দ্র চালু ছিল। ১৯৭১ সালে ‘বাংলাদেশ বয়স্ক শিক্ষা সংসদ রংপুরের রৌমারি এলাকায় ২৭টি শিক্ষাকেন্দ্র চালু করে। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ পল্লী প্রগতি পরিষদ (ব্র্যাক) সিলেটের সাল্লাতে সাক্ষরতা কর্মসূচি চালু করে। ১৯৭৪ সালে ব্র্যাক ‘ওয়ার্ল্ড এডুকেশন’ সংঘের সহযোগিতায় ব্যবহারিক সাক্ষরতা কর্মসূচি উদ্ভাবনের প্রচেষ্টা চালায়। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ জাতীয় সমবায় ইউনিয়নের পরিকল্পনা অনুযায়ী ১০জন স্বেচ্ছাসেবককে প্রশিক্ষণ দিয়ে নৈশ বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়। ১৯৭২ সালের ৭ জুলাই ঠাকুরগাঁও মহকুমার কচুবাড়ী গ্রামে সাক্ষরতা অভিযান শুরু হয় এবং সেপ্টেম্বরে গ্রামটিকে ‘নিরক্ষরতা মুক্ত’ বলে ঘোষণা দেয়া হয়।
এই কচুবাড়ী-কৃষ্টপুর গ্রাম সর্বপ্রথম নিরক্ষরতা মুক্ত গ্রাম বলে স্বীকৃতি পায়। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ সাক্ষরতা সমিতি ৬৮টি গণশিক্ষা কেন্দ্র সংগঠিত করে। ১৯৮০ সালে বাংলাদেশ সরকার দেশব্যাপী গণশিক্ষা কার্যক্রম গ্রহণ করেন। দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় (১৯৮০-৮৫) গণশিক্ষা কার্যক্রমে ৪০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়। ১৯৮৭ সালে পুনরায় এ কর্মসূচি চালু হয়। তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় (১৯৮৫-৯০) সাক্ষরতার হার হয় ৪৫ শতাংশ। চতুর্থ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার (১৯৯০-৯৫) আওতায় ‘ইনফেক’ দেশব্যাপী সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত করে। ১৯৯৭ পর্যন্ত এ কার্যক্রম বর্ধিত করা হয়। পরে ১৯৯৭-২০০২ পর্যন্ত উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রকল্প বেশ সফল হয়। বাংলাদেশে বর্তমানে ‘সবার জন্য শিক্ষা’ এবং সাক্ষরতা দশকের আওতায় সরকারি – বেসরকারি পর্যায়ে শিক্ষা কার্যক্রম চলছে।
সাক্ষরতায় জাতিসংঘের ভূমিকা :
ইউনেস্কা ১৯৬৭ সালে সাক্ষরতা কার্যক্রম শুরু করে। প্রথমে ইউএনডিপির অর্থায়নে আলজেরিয়া, মালি, ইকুয়েডরে সাক্ষরতা অভিযান চলে। বর্তমানে ১৫৫টি দেশে জাতিসংঘের মাধ্যমে শিক্ষাকার্যক্রম চলছে। ইউনেস্কো বার্ষিক কর্মসূচির আওতায় ১৪% শিক্ষাখাতে ব্যয় করে থাকে । ১২০টি দেশে ইউনেস্কো ক্লাব সাক্ষরতা অভিযানে সক্রিয় অংশ নিয়েছে। এ ছাড়া জাতিসংঘ শিশু তহবিল বিভিন্ন দেশে শিশুশিক্ষায় সহযোগিতা করে। বাংলাদেশে জাতিসংঘের সহযোগী সংস্থাগুলো শিক্ষা ও সাক্ষরতার ক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে আসছে। এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে জাতিসংঘ শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা।
উপসংহার :
দেশকে নিরক্ষরমুক্ত করতে হলে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারিভাবে উদ্যোগ নিতে হবে। এগিয়ে আসতে হবে শিক্ষিত সচেতন নাগরিককে। তবেই আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবসের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সফল হবে। সাক্ষরতা দশক (২০০৩-২০১২) সফল করতে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।

যেমন— সাক্ষরতা আন্দোলনে সাফল্যের জন্য, কিশোর-কিশোরী, তরুণদের উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা, বয়স্ক শিক্ষার সমন্বয় প্রয়োজন; সাক্ষরতা পরিস্থিতির উন্নয়নে সর্বাগ্রে প্রয়োজন প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়ন; মৌলিক সাক্ষরতার দক্ষতা উন্নয়ন, শুধু যান্ত্রিকভাবে বর্ণমালা পরিচয় নয়; সাক্ষরতা উত্তর আয় দক্ষতা বৃদ্ধির ব্যবস্থাপনা করা; সাক্ষরতায় প্রশিক্ষক ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থাপনাকারীদের দক্ষ করে তোলা; সাক্ষরতায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে জবাবদিহিতার মধ্যে শিক্ষা কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত করা; সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্য কর্মদ্যোগ, কর্মনীতি প্রণয়ন করা; অব্যাহত শিক্ষা ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষায় সরকার ও সুশীল সমাজের যৌথ অংশীদারিত্ব আবশ্যক; জাতীয় কর্ম পরিকল্পনায় (এনপিএ) জীবনব্যাপী শিক্ষার প্রতিফলন ঘটানো। এসব পদক্ষেপের যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমেই সকলকে সাক্ষর করে তোলা সম্ভব।