জীবনানন্দ দাশের “আদিম কবিতা” বাংলা আধুনিক কবিতার একটি অনন্য ও গভীর অর্থবহ সৃষ্টি। এই কবিতায় তিনি আমাদের সভ্যতার শিকড়, মানুষের চিরন্তন অস্তিত্বচেতনা এবং প্রাকৃতিক জীবনের অন্তর্লীন সম্পর্ককে তুলে ধরেছেন এক রহস্যময়, ধ্যানীভঙ্গির কাব্যিক ভাষায়।
“আদিম কবিতা”-য় তিনি ফিরে যেতে চেয়েছেন সেই মানবসভ্যতার সূচনালগ্নে, যেখানে মানুষ ছিল প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ—যেখানে জীবন ছিল সহজ, সরল, আর প্রকৃতিনির্ভর। কবিতায় প্রতিধ্বনিত হয় এক আদিম জীবনের অনুরণন, যেখানে শিল্প, ভাষা কিংবা বুদ্ধিবৃত্তিক গঠন ছিল অনুপস্থিত, কিন্তু ছিল এক নিবিড় অনুভবের আবহ।
জীবনানন্দ দাশের কবিতার পরিচিত গুণ যেমন ধ্বনি-সৌন্দর্য, ধীর গতির সচেতনতা, নিঃসঙ্গতার রোমান্টিকতা এবং অস্তিত্বের গভীর অনুসন্ধান — “আদিম কবিতা”-তেও তার স্পষ্ট উপস্থিতি রয়েছে।
এই কবিতার মাধ্যমে তিনি প্রশ্ন রাখেন—আমাদের এই আধুনিকতা, যান্ত্রিকতা, নগরায়ণের আড়ালে আমরা কী হারিয়ে ফেলছি? সেই আদিম অনুভব, প্রাকৃতিক সংযোগ, জীবনের মৌলিক সৌন্দর্য কি হারিয়ে যাচ্ছে?
সারাংশে, “আদিম কবিতা” আধুনিক জীবনের জটিলতার বিপরীতে এক ধরনের প্রত্যাবর্তনের ইঙ্গিত দেয়—একটি ফিরে দেখা, ফিরে পাওয়া এবং মানবিকতাকে নতুন করে চিনে নেওয়ার প্রয়াস। এটি শুধু একটি কবিতা নয়, বরং এক ধরণের দার্শনিক চিন্তাধারা, যা জীবনানন্দের কাব্যসাধনার একটি অনন্য দিক উন্মোচন করে।
আদিম কবিতা – জীবনানন্দ দাশ
প্রথম মানুষ কবে
এসেছিল এই সবুজ মাঠের ফসলের উৎসবে!
দেহ তাহাদের এই শস্যের মতো উঠেছিল। ফলে,
এই পৃথিবীর ক্ষেতের কিনারে, সবজির কোলে কোলে
এসেছিল তারা ভোরের বেলায় রৌদ্র পোহাবে ব’লে—
এসেছিল তারা পথ ধরে এই জলের গানের রবে!
এই পৃথিবীর ভাষা
ভালোবেসেছিল, ভালো লেগেছিল এ মাটির ভালোবাসা!
ভালো লেগেছিল এ বুকের ক্ষুধা, শস্যের মতো সাধ!
এই আলো আর ধুলোর পিপাসা, এই শিশিরের স্বাদ
ভালো লেগেছিল—বুকে তাহাদের জেগেছিল আহ্লাদ!
প্রথম মানুষ—চোখে তাহাদের প্রথম ভোরের আশা!
এসেছিল সন্তান—
দেহে তাঁহাদের নীল সাগরের ঢেউয়ের ফেনার ঘ্রাণ!
শঙ্খের মতো কানে তাহাদের সিন্ধু উঠিত গেয়ে।
শস্যের মতো তারা ওই নীল আকাশের পানে চেয়ে
গেয়ে গেছে গান! ধানের গন্ধে পৃথিবীর ক্ষেত ছেয়ে
আলোয় ছায়ায় ফসলের মতো করিয়া গিয়াছে স্নান!
সে কোন প্রথম ভোরে
প্রথম মানুষ আসিল প্রথম মানুষীর হাত ধরে!
ভালো লেগেছিল এ দেহের ক্ষুধা, শস্যের মতো সাধ!
এই আলো আর ধুলোর পিপাসা, এই শিশিরের স্বাদ
ভালো লেগেছিল–বুকে তাহাদের জেগেছিল আহ্লাদ!
নীল আকাশের প্রথম রৌদ্র ক্ষেতে পড়েছিল ঝরে!