বাংলা ভাষারীতি ও আঞ্চলিক ভাষার কথ্য রূপ – বিষয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি “ভাষা ও শিক্ষা” বিষয়ের “বাংলা ভাষা” বিভাগের একটি পাঠ।
Table of Contents
বাংলা ভাষারীতি ও আঞ্চলিক ভাষার কথ্য রূপ
বাংলা ভাষারীতি :
পৃথিবীর বহু উন্নত ভাষার মতো ভাষাতেও দু ধরনের ভাষারীতি বিদ্যমান। এই রীতি বিভিন্ন রূপ ও প্রকাশভঙ্গির মধ্য দিয়ে ফুটে ওঠে। এর একটি মৌখিক বা কথ্য রীতি এবং অপরটি লৈখিক বা লেখ্য রীতি।
মৌখিক বাংলাকে দুটো প্রধান ভাগে ভাগ করা যায় :
(ক) আঞ্চলিক ভাষা (উপভাষা), (খ) প্রমিত ভাষা।
লৈখিক বাংলাও দুটো রীতিতে বিভক্ত :
(১) মান্য চলিত ভাষা, (২) সাধু ভাষা।
বাংলা ভাষার রীতিভেদকে পাশের রেখাচিত্রের মাধ্যমে দেখানো যায় :
আঞ্চলিক ভাষার কথ্য রূপ:
ম্যাক্সমুলার বলেছেন, “The real and natural life of language is in its dialect.
ভাষাতাত্ত্বিক লিওনার্ড ব্লুমফিলড ভাষার পাঁচটি রূপের কথা উল্লেখ করেছেন : সাহিত্যিক ভাষা (literary standard), মানা চলিত ভাষা (colloquial standard), প্রাদেশিক মান্য ভাষা (provincial standard), গ্রাম্যভাষা (substandard), এবং আঞ্চলিক ভাষা (local dialect)। মুখের ভাষাকে ব্লুমফিলড় বা অন্য ভাষাতাত্ত্বিকরা ভাষার মূল কাঠামো হিসেবে গ্রহণ করেছেন। শুধু ভাষাতাত্ত্বিকরাই নন, চিহ্নতত্ত্বের (semiology) অগ্রণী পুরুষ, সাহিত্য সমালোচক রোলী বার্থ লক্ষ করেছেন ভাষার শুরু কথোপকথন থেকে। ঐতিহাসিকভাবে কথা-প্রচেষ্টা থেকেই পূর্ণাকা ভাষারীতির উদ্ভব (রোগী বার্থ, ১৯৬৮, ১৬)। অর্থাৎ বলা যায়, কথা বা আঞ্চলিক ভাষাই হচ্ছে ভাষার মূল্য কাঠামো।
Dialect শব্দটি প্রথম ইংরেজিতে ব্যবহৃত হয় ষোড়শ শতকে। শব্দটি প্রথমে গ্রিক ভাষায় প্রচলিত ছিল এবং পরে লাতিন ও ফরাসি ভাষা থেকে ইংরেজিতে গৃহীত হয়। গ্রিকে ‘উপভাষা’র অর্থ ছিল ‘কথা বলার প্রকৃতি’। প্রাচীন ইংরেজিতে ‘উপভাষা’র অর্থ ছিল ‘কথাবলার ধরন’, বিশেষ সম্প্রদায় দ্বারা অনুসৃত ভাষা-রূপ। এ থেকে বোঝা যায় যে-উপভাষা আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যানুযায়ী চলিত ভাষারই ভিত্তিভূমি।
Dialect শব্দেরই বাংলা পরিভাষা হল ‘উপভাষা’। আক্ষরিক অর্থে ‘ভাষা’র চেয়ে একটু নিম্নে বা কিছুটা কম মর্যাদা সম্পন্ন ভাষাকে বোঝায়। অনেকের কাছে উপভাষা হচ্ছে বিকৃত ভাষা। অনেকেই এমন ভুল ধারণা পোষণ করে যে, উপভাষা হচ্ছে কোনো একটি উন্নত-অভিজাত- মানভাষার বিকৃতির ফল। এ-ধারণাগুলোর কোনোটিই সত্য নয়, তবে এ-কথা সত্য যে, উপভাষার প্রতি বিশ্ববাসী খুব শ্রদ্ধাশীল নয়।
সাধারণভাবে উপভাষা বলতে বোঝানো হয় দেশের বিভিন্ন ক্ষুদ্র অঞ্চলে ব্যবহৃত ভাষাকে বা আঞ্চলিক ভাষাকে বা বিশেষ অঞ্চলের দৈনন্দিন জীবন-যাপনের ভাষাকে। তবে এখন উপভাষা শব্দটি শুধু আঞ্চলিক ভাষিক বৈচিত্র্যের প্রতিই নির্দেশ করে না, বরং বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার ভাষার প্রতিও নির্দেশ করে। যেমন উকিলের উপভাষা, চোরের উপভাষা, আমলার উপভাষা ইত্যাদি। তবে উপভাষা শব্দটির প্রধান অর্থ আঞ্চলিক ভাষা।
আঞ্চলিক ভাষা অর্থে উপভাষার নানা অর্থ প্রচলিত সবগুলো একই অর্থ নির্দেশ করে। যেমন, ওয়েকলিন বুঝিয়েছেন সরলভাবে, কোনো ভাষার অন্তর্গত বিচিত্র, পরস্পরবোধগম্য, রূপকে। কিন্তু ফার্গুসন বলেছেন, ‘উপভাষা হচ্ছে কোনো ভাষার এক বা একাধিক বৈচিত্র্যের গুচ্ছ, যেগুলোতে বিদ্যমান থাকে একটা বা একগুচ্ছ সাধারণ বৈশিষ্ট্য, যা তাদের স্বতন্ত্র করে দেয় ভাষার অন্যান্য বৈচিত্র্য থেকে; এবং ওই বৈশিষ্ট্যগুলোকে ভাষিক বা অতাধিক ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যায় এককরূপে।’
পৃথিবীর প্রায় সব ভাষাতেই উপভাষা আছে। বস্তুত ভাষা ও উপভাষার মধ্যে কোন আন্তর সহজাত পার্থক্য নেই, উপভাষা হল একটি ভাষার ভৌগোলিক রূপভেদ। কোনো ব্যাপক ভাষা অঞ্চলে ব্যবহৃত ভাষার বিচিত্র আঞ্চলিক স্তূপ, যেগুলোর মধ্যে বিদ্যমান নানা পার্থক্য। কিন্তু তা বোধগম্য। পরস্পর বোধগম্যতা হারালে তা পরিণত হয় ভিন্ন ভাষায়। ভারতের পুরোনো উপভাষারাশিকে বলা হতো প্রাকৃত, এবং নামকরণ হতো বিভিন্ন অঞ্চলের নামানুসারে ৮ মাগধি বা শৌরসেনি ইত্যাদি।
বস্তুত বিশেষ বিশেষ জনগোষ্ঠী এক-একটি ভাষার স্রষ্টা। বিভিন্ন ভৌগোলিক বা সামাজিক প্রতিবেশ ভিন্ন ভিন্ন ভাষাকে লালন করে। তাকে অবলযান করে বিকশিত হয়ে ওঠে সেই অঞ্চলের সাহিত্য সংস্কৃতি। উপভাষায় রচিত প্রাচীন মৌখিক সাহিত্যই ‘লোক-সাহিত্য’। উপভাষার শব্দাবলির মধ্যে রয়েছে একটি জাতির ঐতিহাসিক, নৃতাত্ত্বিক ও সামাজিক পরিচয়। মূল মান ভাষার একান্ত আঞ্চলিক রূপটি আছে উপভাষাতেই। অকৃত্রিম সারল্য এবং উপভাষার মধ্যে রয়েছে কোনো ভাষার মূলশক্তি।
কথ্য ভাষাই কালক্রমে রূপান্তরিত হয় লেখা বা সাহিত্যিক ভাষায়। অর্থাৎ সব দেশে কথা ভাষাই সাহিত্যিক ভাষার আদি জননী। যে-কোনো ভাষা উপযুক্ত লালনপালন পেলে যে-কোন জাতির জন্যে শ্রদ্ধেয় মানভাষায় পরিণত হতে পারে। বৈদিক ভাষাত ছিল তৎকালীন অর্থ-যাযাবর আর্যদের মৌখিক ভাষাই। গতি বা চলমানতাই ভাষার জীবনীশক্তি এবং জনগণই তার ধারক ও বাহক। কিন্তু কোন কারণে ভাষা যখন জনগণের সঙ্গে তার সংযোগসূত্র ছিন্ন করে আভিজাত্যের পর্বে দূরে সরে গেছে, তখনই ঘটেছে তার অপমৃত্যু।
এইভাবে সংস্কৃত, গ্রিক, লাতিন ইত্যাদি সমৃদ্ধ ভাষা আজ ইতিহাসের জাদুঘরে স্থান পেয়েছে, কিন্তু তবু সভ্যতার ইতিহাসে সেই সমৃদ্ধ ভাষাগুলো একেবারে নিষ্ফলা হয়ে নেই। আজ আধুনিক ইউরোপীয় এবং ভারতীয় আর্য-ভাষাগুলোর উৎস সন্ধানে যাত্রা করে আমাদের অনিবার্যভাবে সেই অধুনা বিলুপ্ত ভাষাগুলোর উপকূলে গিয়ে উপনীত হতে হয়।

বাংলা ভাষা-অঞ্চলে আছে বহু উপভাষা। বাংলা ভাষায় কতগুলো উপভাষা তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে ব্রিটিশরাজের উচ্চপদসহ আমলা জর্জ আব্রাহাম গ্রিয়ারসন ভারতের উপভাষাগুলো জরিপ করেন। ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় তাঁর ‘লিংগুইস্টিক সার্ভে অফ ইন্ডিয়া’ নামক এগারো খন্ডে সম্পূর্ণ জরিপের পঞ্চম খন্ড। এ-গ্রন্থে আছে বিভিন্ন বাংলা উপভাষার নমুনা। কয়েকটি নমুনা নিম্নরূপ :
কলকাতার (নারীদের) উপভাষা :
এক জনের দুই ছেলে ছেল। তাদের যে ছোট, সে তার বাপকে বলে, বাবা, আমার ভাগে যা পড়ে তা আমাকে দাও। বাপ তার বিষয় আশয় তাদের বেঁটে দিলে। দিন কতক পরে ছোট ছেলে তার সমস্ত জিনিসপত্তর নিয়ে দূর দেশে চলে গেল, সেখানে বদখেয়ালি করে সমস্ত উড়িয়ে দিলে।
হাওড়ার উপভাষা :
কোনো দুটি ছেলে ছিল। তাদের মধ্যে ছোটটি তার বাপকে বলে, বাবা, আমার ভাগে বিষয়ের যা পড়ে তা আমাকে দিন। তাতে সে তার বিষয় তাদিগকে ভাগ করে দিলে। অল্প দিন পরে ছোট ছেলে তার অংশের সব বিষয় একত্তরে জড় করে নিয়ে দূর দেশে চলে গেল, আর সেখানে বদ-খেয়ালি করে সর্বস উড়িয়ে দিল।
মেদেনীপুরের উপভাষা :
এক লোকার দুটা পো থাইল। তানেকার মানু কোচা পো নিজের বায়ুকে বহু বায়ুহে। বিষে আশৈর যে বাটী মুই পার সেটা মোকে দ্যা। সে তানাকার মানু বিষৈ বাটা কোরা দিল। ভোৎ দিন যাইনি কোড্যা পো সুমচ্যা গুটি লিয়া ভোৎ দূরে এক গায়ে চোল্যা গ্যাল। সেঠি সে আকুত্তা গচ্চাপতর কোরা নিজের বিবে- আশৈ একাদমে ফুকা-প্যাল্ল।
বগুড়ার উপভাষা :
এক অনের দুই ব্যাটাছেল আছিল। তারকেরে মধ্যে চোটান কৈল বা হামি যা পামু তা হামাক বাট্যা দে। তাই শুনে বাপে বাঁটা দিল। ছোটবন বাঁটা গেওয়ার কদিন পর ভিন দেশে গেল। সেটা যায় গাঠামো করা টাকাকড়ি উড়া দিল।
পাবনার উপভাষা :
কোনো মানুষের দুই ছাওয়াল ছিল। তার মধ্যি ছোডোটা বাপেক কোলেজ, বাবা জিনিস পত্তোরের পাওয়ানা ভাগ আমাকে গুনে দ্যাও। ইয়েই শুনে, তার বাপ তার নিজির জিনিস পত্তোর বাঁটা দিলো। অল্প দিন পরে ছোডো ছাওয়াল সকল জিনিস পত্তোর জড়ো করা দূর দ্যাশে যাত্তারা করলো। এবং সেখানে বদ্কাম করা। নিজের বিষেয় আসেয় উড়ায়ে দিলো।
মানিকগঞ্জের উপভাষা :
থ্যাক জনের দুইডী ছাওয়াল আছিলো। তাগো মৈদ্দে ছোটডি তার বাপেরে কৈলো, আমার ভাগে যে বিত্তি ব্যাসাদ পরে তা আমারে দ্যাও। তাতে তিনি তান বিষয় সাম্পত্তি তাগো মৈদ্দে বাইটা দিল্যান। তারপর কিছুদিন পরে ঐ ছোট ছাওয়ালডি তার সগল টাকাকড়ি য়্যাকাত্র কইরা স্ন্যাক দূর দ্যাশে চইলা গ্যালো। সেখানে গিয়া তার যা কিছু আছিলো তার বন্ধ্যালী কৈরা উড়াইয়া দিলো।
ময়মনসিংহের উপভাষা :
এক জনের দুই পুৎ আছিল। তার ছুডু পুতে বাপেরে কইলেঅ বাজি। মাল ব্যাসাতের যে বন্ধুরা আমি পাইবাম্ তা আমারে দেউখাইন। হে তারারে মালপাতি বাট কৈরা দিল। পুরা দিন বাদে ছোট্কা তার হগগল মালব্যাসাৎ থুবাইয়া দূর মুল্লুকে গেল। হেইখানে ফেলামী কৈরা হগগল খোয়াইল।
নোয়াখালির উপভাষা :
একজন মাইনসের দুগা হোলা আছিল। হিয়ার মধ্যে ঘুড়গায় হেইতার রাফেরে কইল আব্বা আর তাগে মাল যিগিন হড়ে হিগিন আরে দেও। আর হেইতেও হেইতার ব্যাকবিও হোলাইনেরে ভাগ করি দিল। হিয়ার কদিন বাদে ছোড হোলা ব্যাকগিন অত্তর করি লই এক দূর এক দেশে বেড়াইতে গেল, হিয়ানে হেইতে যণ্ডামি করি হেইতার ব্যাক কিন্তু উড়াই দিল ।
“এমন বিচিত্র স্বর সুর টান আর রঙের ভাষা বাংলা। অঞ্চলে অঞ্চলে তার আঞ্চলিক শোভা। এ-ভাষা নদীর ঢেউয়ে ছলকে ওঠে। কলাপাতার কম্পনে দুলে ওঠে। রাখালের মুখ থেকে মাঠে ময়দানে ঝ’রে পড়ে। পুকুরপাড়ে নতুন বউর মুখে মুখর হয়ে ওঠে। ক্রোধে গর্জন করে ওঠে পদ্মার চরে। নানা ঘরে মুখর বাংলা ভাষার ভূভাগ।’
বাংলা উপভাষার আঞ্চলিক অভিধান প্রস্তুতে বাংলা একাডেমির উদ্যোগ বিশেষ প্রশংসনীয়। অ্যাকাডেমির উদ্যোগেই পরলোকগত ভাষাতাত্ত্বিক ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর তত্ত্বাবধানে ও সম্পাদনায় বাংলা ভাষার প্রথম আঞ্চলিক অভিধান (১৯৬৬) প্রকাশিত হয়। ১৯৫৮ সাল থেকে অভিধানের প্রাথমিক কাজ রূপমূল সংগ্রহ শুরু হয় এবং আট বছরের নিরন্তর পরিশ্রমের পর অভিধানটি দুটো খণ্ডে প্রকাশিত হয়।
বাংলাদেশের প্রতিটি অঞ্চল থেকে রূপমূল সংগৃহীত হয়ে অভিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়। আঞ্চলিক অভিধানে রূপমূল এবং যে অঞ্চলে রূপমূল ব্যবহৃত হয় তা বন্ধনীর সাহায্যে নির্দেশ করা হয়েছে। অভিধানে রূপমূলের অর্থ ও ব্যাকরণগত পদ-প্রকরণের দিকটি ছাড়া অন্য কোন দিক নির্দেশিত হয় নি। অধিকাংশ রূপমূলেরই তুলনামূলক বিচারের সাহায্যে আরবি এবং ফারসি থেকে গৃহীত রূপমূলের সঙ্গে সম্পর্ক ও মূল। রূপ নির্দেশের চেষ্টা লক্ষণীয়।
অভিধানে অন্তর্ভুক্ত কয়েকটি রূপমূলের নমুনা:
অভিধানে অন্তর্ভুক্ত কয়েকটি রূপমূলের নমুনা নিচে উদ্ধৃত হল : –
ক. আখাইল (রংপুর)- বিশেষ্য অ (ষার্ধে) + খরলে ফারসি। অতিরিক্ত।
খ. আঁইল (চট্টগ্রাম) বিশেষ্য। আমইল আমলই আমলকী।
গ. অ্যারেনা যেশোহর। বিশেষ্য। গিরগিটি জাতীয় জীব।
ঘ. কিছুকিতি (সিলেট)- অব্যয়। শিং মাছের শব্দ বিশেষ।
ঙ. চরুশ (রাজশাহী) বিশেষণ। চিকন সমান। চৌরস • চতর সং।
রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘এই যে বাংলায় আমরা কথাবার্তা কহিয়া থাকি, ইহাকে বুঝিবার সুবিধার জন্য প্রাকৃত বাংলা নাম দেওয়া যাইতে পারে। যে-বাংলা ঘরে ঘরে মুখে মুখে দিনে দিনে ব্যবহার করা হইয়া থাকে, বাংলার সমস্ত প্রদেশেই সেই ভাষার অনেকটা ঐক্য থাকিলেও সাম্য নাই। থাকিতেও পারে না। সকল দেশেরই কথিত ভাষায় প্রাদেশিক ব্যবহারের ভেদ আছে। তাতেই উপভাষার উদ্ভব।
বাংলা ভাষার উপভাষাকে প্রধানত পাঁচ ভাগে ভাগ করা হয়। ১. রাঢ়ি (পশ্চিম ও মধ্যবঙ্গ)। ২. ঝাড়খণ্ড (দক্ষিণ পশ্চিমবঙ্গ, সিংভূম, মানভূম, পুরুলিয়া অঞ্চল)। ৩. বরেন্দ্র (উত্তর বঙ্গ)। ৪. বঙ্গালি (পূর্ব ও দক্ষিণ পূর্ববঙ্গ, বাংলাদেশ)। ৫. কামরূপি (উত্তর পূর্ববঙ্গ, কোচবিহার, কাছাড়)।
আচার্য সুনীতিকুমারের অনুসরণে একটি দৃষ্টান্ত সহযোগে বাংলার এই উপভাষা পদকের বৈশিষ্ট্য স্পষ্টরূপে ধরার চেষ্টা করা যাক:
এক- রাঢ়ি উপভাষা:
সে একজন চাকরকে ঢেকে দিলেন করণে এসব ব্যাপার হচ্ছে কেন? তাতে চাকরটি বলছে— আপনার তাই ফিরে এসেছেন, আর আপনার বাবা তাঁকে ভাে ভালোয় ফিরে পেয়েছেন বসে খাওয়া-দাওয়া নাচ-গান করছেন।
দুই- ঝাড়খন্ডি উপভাষা:
সে একজন মুনিশকে বুলিয়ে পুছলেক যে এসব কিসের পিয়ে হচ্ছে মুনিশা বললে- তুমার ভাই আইছেন ন. এহাতে তুমার বাপ কুটুম খাওয়াচ্ছেন, কেননাউহাকে ভাষায় ভাষায় পাওয়া গেছে।
তিন- বরেন্দ্রি উপভাষা:
তার একজন চোরার ডাকেয়া পুহ করি তখন তার তার কইল- তোর তাই আইতে তোর বাপ তার ভাগে-ভাগে পাওয়া একটা বড় ভাণ্ডারা করছে।
চার- বঙ্গালি উপভাষা:
তোমার বাই আইচে, ভাৱে বালে বালে পাইয়া তোমার বাপে এক খাওন দিছেন হে একজন চাকরকে ডাইক্যা জিয়াই এ হল ।ইতা। কিয় যে তাকে কই, তুমার বাই বারীৎ আইছে। এর লাইগা ডুমার বাপ বর বানি দিছইন, কারণ তারে তালাতা ফিরা পাইছন।
পাঁচ- কামরূপি উপভাষা:
সে একজন চাকরের ডাইক্যা জিগানা কৈল্লো- ইয়ার মানে কি? সে কৈলো-
বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষা বা উপভাষার বৈশিষ্ট্য অনুসারে নিম্নরূপ শ্রেণিবদ্ধ করা যায় :
১. উত্তরবঙ্গীয়—দিনাজপুর, রাজশাহী, বগুড়া ও পাবনা। ২. রাজবংশি-রংপুর। ৩. পূর্ববঙ্গীয় : কে) ঢাকা ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, বরিশাল। (খ) ফরিদপুর, যশোর, খুলনা। (গ) সিলেট।
উপভাষা বা আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার:
গল্পের কাহিনীতে বাস্তবতার প্রতিফলন ঘটাতে অনেক সময় লেখক আঞ্চলিক ভাষা বা উপভাষার আশ্রয় নিয়ে থাকেন। বিশেষ করে চরিত্রের সংলাপে এ ধরনের আঞ্চলিক ভাষা প্রাধান্য পেয়ে থাকে। আজকাল বাংলা সাহিত্যে, নাটকে কম-বেশি আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহৃত হচ্ছে। যেমন : ‘মিয়ান শেখ গাই ক্ষীরাচ্ছে ! দোহাচ্ছে]। বাছুর ধরেছে আট বছরের মেয়ে জৈগুন। বাঁট ধরে মিয়াদ শেখ জোরে জোরে টানছে আর তীরের ফলার মতো দুধ এসে ছিটকে পড়ছে সোনার [দুধ রাখার পাত্র। ভেতর।’
সাহিত্যের ক্ষেত্রে আঞ্চলিক ভাষার প্রয়োজন রয়েছে, কেননা অঞ্চলবিশেষে বা নির্দিষ্ট কোনো এলাকাকে কেন্দ্র করে কোনো সাহিত্য গড়ে উঠলে সে ক্ষেত্রে অবশ্যই ক্ষেত্রবিশেষে আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করতে হবে, নচেৎ সে সাহিত্যে প্রাণ খুঁজে পাওয়া যাবে না। অর্থাৎ যে-উদ্দেশ্যে কোনো বিশেষ অঞ্চল বা এলাকাকে কেন্দ্র করে সাহিত্যটি গড়ে উঠেছে, সে উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হবে।
ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, “ভাষার জীবন্ত রূপ ‘কথ্য ভাষায়”। বাংলা সাহিত্যের কয়েকটি বিখ্যাত গ্রন্থে আঞ্চলিক শব্দের প্রচুর ব্যবহার রয়েছে। যেমন পদ্মানদীর মাঝি- মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সূর্যদীঘল বাড়ী— আবু ইসহাক, কর্ণফুলী – আলাউদ্দিন আল আজাদ, তিতাস একটি নদীর নাম- অদ্বৈত মল্লবর্মণ ইত্যাদি।
সাধারণত উপভাষায় স্থূলতা, গালাগালি, শিষ্ট শব্দের উচ্চারণবিকৃতি ও ব্যাকরণগত ত্রুটি লক্ষ করা যায়। যেমন : “কুরের হাকিয়া দাম জিজ্ঞাসা করে। সন্ধ্যাবেলা আজ পৌনে পাঁচ এবং সওয়া পাঁচ টাকা দরে মাছ বিক্রি হইয়াছে। শুনিয়া ধনঞ্জয় বলে, কাইল চাইরে নামব। হালার মাছ ধইরা জুত নাই।”— মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (পদ্মানদীর মাঝি)।
সমাজ উপভাষা (Sociolect):
সমাজের কোনো বিশেষ শ্রেণির ভাষাকে সামাজিক উপভাষা বলে। সামাজিক জীবিকা, স্তর, শ্রেণি, সম্প্রদায় ইত্যাদি নানা কারণেই সামাজিক উপভাষার সৃষ্টি হয়ে থাকে। যেমন : আর্থ-সামাজিক অবস্থা, নৃজাতিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের পার্থক্য, লিঙ্গা ইত্যাদি। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত— এ তিন অর্থনৈতিক শ্রেণির ব্যবহৃত ভাষায় ভিন্ন ভিন্ন রূপ দেখা যায়। সামাজিক অবস্থান ও শিক্ষার কারণেও ভাষাগত পার্থক্য দেখা যায়।
অর্থনৈতিক মাপকাঠিতে উচ্চ অবস্থানে থাকা সত্ত্বেও শিক্ষাক্ষেত্রে অনগ্রসর শ্রেণির ভাষা আর অভিজাত ও শিক্ষিত সমাজের ভাষা একরকম নয়। এ ক্ষেত্রে ভাষার দু রকমের বৈচিত্র্য (varity) লক্ষ করা যায়। সমাজের অধিকতর সুযোগ-সুবিধা যারা লাভ করেছে তাদের ভাষাকে আমরা উচ্চশ্রেণির ভাষা (High-class variety) বা অভিজাতদের ভাষা বলি। অপ্যাপিকে সামাজিক সুযোগ-সুবিধা যারা কম লাভ করেছে, শিক্ষা-দীক্ষার সুযোগ যারা তেমন পায়নি, যারা নিরক্ষর, আর্থিক দিকে থেকে তেমন যক্ষ্মা নয়, তাদের ভাষাকে আমরা নিম্নশ্রেণির – (Low-class variety) বদি। মধ্যবিত্তের মধ্যে এক ধরনের মিশ্র বাংলার ব্যবহার দেখা যায় যা সুনির্দিষ্ট কোনো ভৌগোলিক উপভাষা নয়, বরং শহর কেন্দ্রিক সামাজিক একটি উপভাষা।
এ উপভাষার শব্দভান্ডারে ভিন্ন ভিন্ন উপভাষিক শব্দ থাকে। আবার প্রমিত বাংলার সঙ্গে ক্রিয়াপদের সুস্পষ্ট পার্থক্যও পরিলক্ষিত হয়। যেমন- আমি আসছি আমি আশতেসি। আমি এসেছি আমি আশলি সে-এর উচ্চারণ ইংরেজি ১-এর মতো। বাংলাভাষীদের মধ্যে তরুণ সমাজে মিশ্র ভাষার ব্যাপক ব্যবহার দেখা যায় এবং আনুষ্ঠানিক পরিবেশে প্রমিত চলিত ভাষারূপের কিছুটা ব্যবহার থাকলেও তাতে বহুল পরিমাণে ইংরেজি শব্দের ব্যবহার ও অনেক ক্ষেত্রে ইংরেজি উচ্চারণে বাংলা বলার প্রবণতা লক্ষ করা যায়।
উল্লেখযোগ্য সংখ্যক উপভাষী একে মর্যাদাসূচক হিসেবে মনে করে। অপরাধ জগতের ভাষা, বিশেষ বিশেষ বৃত্তিতে নিয়োজিত মানুষজনের ভাষা কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে ব্যবসায়ীদের ভাষা সমাজ-উপভাষা হিসেবে গণ্য হতে পারে।
বাংলা ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে শিক্ষিত, অভিজাত ও উচ্চ-মধ্যবিত্তদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত প্রমিত চলিত ভাষা ব্যবহারের প্রবণতা লক্ষণীয়।
আরও দেখুন: