“আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে” কবিতা — কবিগুরুর স্বীকৃতি পাওয়ার প্রেরণায় রচিত একটি অনবদ্য সৃষ্টি। আলিপুরের কারাগারে বন্দি থাকাকালীন সময়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই কবিতাটি রচনা করেন। এই কবিতায় তিনি জীবনের জটিলতা ও যন্ত্রণার মধ্যেও আনন্দ আর আশার প্রদীপ জ্বালাতে চেয়েছেন। কবিতার প্রথম স্তবকে তিনি লিখেছেন:
“আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে
মোর মুখ হাসে মোর চোখ হাসে
মোর টগবগিয়ে খুন হাসে
আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে।”
এই উক্তিতে জীবনের প্রতি তাঁর অপার ভালোবাসা, আশাবাদী মনোভাব এবং মানবতার প্রতি গভীর অনুরাগ ফুটে ওঠে। বন্দিত্বের বেদনা ভুলে তিনি বিশ্বজুড়ে সৃষ্টির আনন্দে উল্লসিত হয়ে জীবনকে নতুন আশার আলোয় আলোকিত করেছেন। এই কবিতার মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ প্রমাণ করেন, সৃষ্টির আনন্দ ও সুখ মানুষের অন্তরে লুকিয়ে থাকে, যা কোনো কঠোর সময় বা বাধার দ্বারা মুছে ফেলা সম্ভব নয়। তাই “আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে” শুধু একটি কবিতা নয়, এটি মানবজীবনের এক অমর সুর, যা আমাদের সুখ এবং আশা উপলব্ধির জন্য চিরন্তন অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।
আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে কবিতা – কাজী নজরুল ইসলাম
আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে–
মোর মুখ হাসে মোর চোখ হাসে মোর টগবগিয়ে খুন হাসে
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে।
আজকে আমার রুদ্ধ প্রাণের পল্বলে –
বান ডেকে ঐ জাগল জোয়ার দুয়ার – ভাঙা কল্লোলে।
আসল হাসি, আসল কাঁদন
মুক্তি এলো, আসল বাঁধন,
মুখ ফুটে আজ বুক ফাটে মোর তিক্ত দুখের সুখ আসে।
ঐ রিক্ত বুকের দুখ আসে –
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে!
আসল উদাস, শ্বসল হুতাশ
সৃষ্টি-ছাড়া বুক-ফাটা শ্বাস,
ফুললো সাগর দুললো আকাশ ছুটলো বাতাস,
গগন ফেটে চক্র ছোটে, পিণাক-পাণির শূল আসে!
ঐ ধূমকেতু আর উল্কাতে
চায় সৃষ্টিটাকে উল্টাতে,
আজ তাই দেখি আর বক্ষে আমার লক্ষ বাগের ফুল হাসে
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে!
আজ হাসল আগুন, শ্বসল ফাগুন,
মদন মারে খুন-মাখা তূণ
পলাশ অশোক শিমুল ঘায়েল
ফাগ লাগে ঐ দিক-বাসে
গো দিগ বালিকার পীতবাসে;
আজ রঙ্গন এলো রক্তপ্রাণের অঙ্গনে মোর চারপাশে
আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে!
আজ কপট কোপের তূণ ধরি,
ঐ আসল যত সুন্দরী,
কারুর পায়ে বুক ডলা খুন, কেউ বা আগুন,
কেউ মানিনী চোখের জলে বুক ভাসে!
তাদের প্রাণের ‘বুক-ফাটে-তাও-মুখ-ফোটে-না’ বাণীর বীণা মোর পাশে
ঐ তাদের কথা শোনাই তাদের
আমার চোখে জল আসে
আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে!
আজ আসল ঊষা, সন্ধ্যা, দুপুর,
আসল নিকট, আসল সুদূর
আসল বাধা-বন্ধ-হারা ছন্দ-মাতন
পাগলা-গাজন-উচ্ছ্বাসে!
ঐ আসল আশিন শিউলি শিথিল
হাসল শিশির দুবঘাসে
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে!
আজ জাগল সাগর, হাসল মরু
কাঁপল ভূধর, কানন তরু
বিশ্ব-ডুবান আসল তুফান, উছলে উজান
ভৈরবীদের গান ভাসে,
মোর ডাইনে শিশু সদ্যোজাত জরায়-মরা বামপাশে।
মন ছুটছে গো আজ বল্গাহারা অশ্ব যেন পাগলা সে।
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে!
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে!!
আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে কবিতা এর ইতিহাসঃ
১৩২৮ সাল নজরুলের প্রথম গ্রন্থ,গল্প সংকলন ’ব্যথার দান’ প্রকাশিত হয়।নজরুল প্রায় প্রতিটা গ্রন্থের ক্ষেত্রে প্রকাশকরা বলা য়ায় নজরুলকে ঠকিয়েছেন।কারন সবসময় তিনি অর্থ সংকটে থাকায় প্রকাশরা এই সুযোগ নিতেন।
রবীন্দ্রনাথের তখন বিশ্বজোড়া খ্যাতি আর নজরুলের সবে শুরু।জুহুরি যেমন জুহুরি চিনে তেমনি রবীন্দ্রনাথও নজরুলকে চিনতে ভূল করেননি।১৯২১ সালে রবীন্দ্রনাথে জোড়াসাকোর ঠাকুর বাড়িতেই নজরুল রবীন্দ্রনাথের সাথে দেখা করতে যান।প্রথম দেখাতে নজরুল রবীন্দ্রনাথ এর মধ্যে কবিতা-সাহিত্য নিয়ে আলাপ হয়।উপরের লাইনগুলো নজরুলের অনুরোধে রবীন্দ্রনাথ নজরুলের ধুমকেতু পত্রিকার জন্য লিখে দেন, যা ধুমকেতুর উপরে লেখা থাকত।পরবর্তীতে নজরুল তার ’সঞ্চিতা’ কাব্য গ্রন্থটি রবীন্দ্রনাথকে উৎসর্গ করেন।
আর আলিপুর জেলে থাকা অবস্থায় রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে ’বসন্ত’ নাটিকাটি উৎসর্গ করেন।আর এতে নজরুল এত খুশি হন যে তার জেল জীবনে সকল কষ্ট ভুলে গিয়ে রচনা করেন তার বিখ্যাত কবিতা ’আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’।
আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে কবিতা আবৃত্তিঃ