আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা রচনা [ ২০০০ শব্দ ]

আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা নিয়ে রচনার একটা নমুনা তৈরি করবো আজ। এই রচনাটি আমাদের “নীতি চরিত্র মূল্যবোধ” সিরিজের একটি রচনা। আমাদের সকল রচনা শিক্ষার্থীদের ধারণা দেবার জন্য। মুখস্থ করার জন্য নয়। এই রচনা থেকে শিক্ষার্থীরা শুধুমাত্র ধারণা নেবেন। তারপর নিজের মতো করে নিজের নিজের ভাষায় লিখবেন।

আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা

আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা

 

নীতি চরিত্র মূল্যবোধ | বাংলা রচনা সম্ভার ,  সূচনা : আইন হচ্ছে শৃঙ্খলার বিধান। অর্থাৎ একটি সমাজ বা দেশের সদস্যেরা কী করতে পারবে এবং কী করতে পারবে না, তারই বিধান হলো আইন। আপাতদৃষ্টিতে বা বাহ্যিক বিচারে আইন সংশ্লিষ্ট সকল নাগরিকের ওপর সমভাবে প্রযোজ্য হওয়ার কথা। কিন্তু সভ্যতার আদিকাল থেকে আইনের ইতিহাস নিলে দেখা যায় যে, আইন আসলে ক্ষমতাবানদেরই নিরঙ্কুশ স্বার্থরক্ষার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে। শক্তিমানরা প্রায়শই অবস্থিত আইনকে লঙ্ঘন করে ক্ষমতা দখল করেছেন, আইনের পরিবর্তন করেছেন। দাসসমাজে আইন ছিল দাস প্রথাকে পাকাপোক্ত রেখে দাস-মালিকদের একচ্ছত্র স্বার্থরক্ষার হাতিয়ার। অনুরূপভাবে সামন্তসমাজের আইন ছিল সামন্তপ্রভূদের নিরঙ্কুশ স্বার্থেরই রক্ষাকবচ।

পুঁজিবাদী সমাজে আইন কার্যত পুঁজি ও পুঁজিপতির স্বার্থই রক্ষা করে। সমাজতান্ত্রিক দেশে ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টি (প্রায়শই পলিটব্যুরো কিংবা পার্টিপ্রধান)-এর অভিলাষই আইনে রূপ লাভ করে। মোটকথা, যারাই যখন ক্ষমতায় যান, আইন তাদেরই হাতিয়ারে পরিণত হয়। বর্তমানে বিশ্বে আইন মূলত দু প্রকার। যথা: ১. জাতীয় আইন এবং ২. আন্তর্জাতিক আইন। জাতীয় বা একটি দেশের অভ্যন্তরীণ আইনের মতো আন্তর্জাতিক আইনের সুবিধাও প্রধানত ভোগ করে প্রবল বা শক্তিধর রাষ্ট্রসমূহ । আইনের এরূপ বৈশিষ্ট্য সত্ত্বেও এ কথা অনস্বীকার্য যে, আইন আছে বলেই সমাজ ও জনগণ বল্গাহীন নৈরাজ্য ও অপরাধপ্রবণতা থেকে রক্ষা পেয়ে আসছে।

আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা | নীতি চরিত্র মূল্যবোধ | বাংলা রচনা সম্ভার

 

বাংলাদেশের আইনব্যবস্থা :

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর প্রথম পর্যায়ে আইন ও বিচার ব্যবস্থায় কোনো পরিবর্তন আসেনি। ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের সংবিধান কার্যকর হওয়ার পর হাইকোর্ট বিভাগ ও আপিল বিভাগ নিয়ে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট প্রতিষ্ঠিত হয়। সর্বোচ্চ আদালত হিসেবে হাইকোর্ট বিভাগ অধস্তন আদালত থেকে আগত আপিলের শুনানি ও পুনর্বিচার মামলা গ্রহণের ক্ষমতা লাভ করে । এছাড়া রিট হিসেবে এ বিভাগকে মৌলিক অধিকার কার্যকর করার জন্য আদেশ ও নির্দেশনা জারি করা এবং রিটের আওতায় অন্যান্য ছাড় প্রদানের ক্ষমতাও দেয়া হয় । আপিল বিভাগের রয়েছে হাইকোর্ট ডিভিশন এবং যে কোনো সংবিধির অধীন অন্যান্য সংস্থার সিদ্ধান্তের ওপর আপিলের শুনানি গ্রহণ করার ক্ষমতা ।

হাইকোর্ট বিভাগে রয়েছে অধস্তন আদালত ও ট্রাইব্যুনাল তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা। সুপ্রিম কোর্ট হলো কোর্ট-অব-রেকর্ড এবং তা সুপ্রিম কোর্টের অবমাননা অথবা এ কোর্টের অধস্তন আদালতের অবমাননার জন্য যে-কাউকে শাস্তি দিতে পারে। আপিল বিভাগ ঘোষিত আইনগুলো হাইকোর্ট বিভাগের জন্য বাধ্যতামূলক এবং উভয় বিভাগের যে কোনোটির ঘোষিত আইন সকল অধস্তন আদালতের জন্য বাধ্যতামূলক। হাইকোর্ট বিভাগ মৌলিক অধিকারের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ যে কোনো আইন বাতিল ঘোষণা করতে পারে। প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি  সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শক্রমে অধস্তন আদালতসমূহের বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা বজায় রাখেন। শ্রমবিরোধ নিষ্পত্তির জন্য শ্রম আদালত এবং শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনাল রয়েছে।

সরকারি কর্মচারীদের চাকরি সম্পর্কিত বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল ও প্রশাসনিক আপিল ট্রাইব্যুনাল আছে। একইভাবে আয়কর সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য আয়কর আপিল ট্রাইব্যুনাল এবং শুল্ক, আবগারি শুল্ক ও ভ্যাট সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য শুল্ক, আবগারি শুল্ক ও ভ্যাট আপিল ট্রাইব্যুনাল, আর পরিত্যক্ত সম্পত্তি সম্পর্কিত বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য কোর্ট অব সেটেলমেন্ট। এছাড়া সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি মামলার জন্য রয়েছে বিশেষ বিচারক। ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে ফৌজদারি মামলা বিচারের জন্য আছে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল এবং শিশু ও নারীর বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধ বিচারের জন্য নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালত । নির্বাচনী বিরোধসমূহ নিষ্পত্তির জন্য রয়েছে বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে নির্বাচন ট্রাইব্যুনাল। অন্যান্য ট্রাইব্যুনালও একই পদ্ধতি অনুসরণ করে।

পারিবারিক বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য সহকারী বিচারকের সমন্বয়ে পারিবারিক আদালত গঠন করা হয়েছে। ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আর্থিক দাবি নিষ্পত্তির জন্য গঠিত অর্থঋণ আদালতে বিচারকগণ সভাপতিত্ব করে থাকেন। জেলা অথবা অতিরিক্ত জেলা বিচারকদের সভাপতিত্বে গঠিত দেউলিয়া আদালতে ঋণখেলাপি হওয়ায় দেউলিয়া ঘোষণার ব্যবস্থা রয়েছে। অনূর্ধ্ব ষোল বছর বয়সী কিশোর-কিশোরীদের অপরাধের বিচার করার জন্য দায়রা বিচারক ও ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ে কিশোর আদালত গঠিত হয়েছে।

কিশোর আদালত শিশু আইনের বিশেষ বিধিসমূহ অনুসরণ করে। সেনাবাহিনী আইন, বিমানবাহিনী আইন ও নৌবাহিনী অধ্যাদেশের ধারাবলে কোর্ট মার্শাল আদালতে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের দ্বারা সংঘটিত অপরাধসমূহের বিচার করা হয়। এসব কোর্টের সিদ্ধান্ত সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জ করা যায় না। ছোটখাটো দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলা নিষ্পত্তির জন্য গ্রামে গ্রামীণ আদালত এবং শহর এলাকায় পৌর সালিশ বোর্ড রয়েছে। অধস্তন ভূমি রাজস্ব কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে আপিল গ্রহণের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ হলো ভূমি আপিল বোর্ড। এছাড়া জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সর্বোচ্চ পর্যায়ে কর, শুল্ক, আবগারি শুল্ক ও ভ্যাট সংক্রান্ত মামলাসমূহ নিষ্পত্তি করে।

ব্রিটিশ আমলে প্রণীত অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কিত প্রায় সকল মূল আইন মাঝে মাঝে সংশোধিত হয়ে এখনো কার্যকর রয়েছে। ফৌজদারি কার্যবিধিতে আনীত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী হলো অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে আপাতদৃষ্টিতে মামলা গ্রহণ করে দায়রা আদালতে বিচারের জন্য প্রেরণ করা হবে কিনা তা ম্যাজিস্ট্রেট দ্বারা তদন্তের বিধানের এবং নির্ধারক বা অ্যাসেসর দ্বারা দায়রা মামলার বিচার সম্পন্ন করার বিধানের বিলুপ্তি। বাংলাদেশের আইনব্যবস্থা মূলত একটি প্রচলিত আইনব্যবস্থা। কেবল ব্যতিক্রম হলো, সুপ্রিম কোর্ট সংসদ কর্তৃক প্রণীত আইন শুধু ব্যাখ্যাই নয়, বাতিল করতে এবং নাগরিকদের মৌলিক অধিকার কার্যকর করতে পারে।

আইনব্যবস্থা ইংল্যান্ডের প্রচলিত আইনের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হলেও বাংলাদেশের অধিকাংশ আইন সংবিধিবদ্ধ আইন, যা আইনসভা প্রণয়ন করেছে এবং উচ্চতর আদালত ব্যাখ্যা করেছে। পদ্ধতিগত আইনসমূহ (ফৌজদারি আইন) প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক মামলার সুযোগ করে দেয়, যে মামলায় ফরিয়াদিকে অভিযুক্ত ব্যক্তির অপরাধ প্রমাণ করতে হয়। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া অভিযুক্ত ব্যক্তির ওপর কোনো কিছু প্রমাণের দায়িত্ব বর্তায় না এবং  তাকে বিচারে অপরাধী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত তাকে নির্দোষ বলে ধরে নেয়া হয়। পক্ষান্তরে, দেওয়ানি মামলায় উভয় পক্ষের ওপরই প্রমাণের দায়িত্ব বর্তায়। উপরন্তু আইনসভা, নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার বিভাজন রয়েছে।

সুপ্রিম কোর্ট অন্যান্য অঙ্গসংস্থা থেকে শুধু স্বাধীনই নয়, বরং সংবিধানের অভিভাবক হিসেবেও কাজ করে। অধস্তন আদালত বিচার সম্পর্কিত ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে স্বাধীন হলেও নিম্ন আদালতকে নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা না করার ফলে সেগুলো অনেকটা অন্তরালবর্তী হয়ে রয়েছে। পরবর্তী ধারাবাহিক সরকারগুলো বিচার ও নির্বাহী বিভাগ আলাদা করার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও প্রাথমিক পর্যায়ে এ পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা গৃহীত হয়নি। সংসদ আইন প্রণয়ন করতে পারে, কিন্তু তা বেশকিছু মৌলিক অধিকারসহ সংবিধানের ধারার সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ হতে পারে না। সুতরাং বাংলাদেশ সংসদের আইন প্রণয়ন ক্ষমতা ব্রিটিশ পার্লামেন্টের ক্ষমতার মতো অসীম নয়।

আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

বাংলাদেশের মৌলিক আইন হলো সময়ে সময়ে সংশোধিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান, ১৯৭২। ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত সংবিধানে ১৩টি সংশোধনী আনা হয়েছে। দেশের সকল আইন হলো নির্বাচিত সংসদ দ্বারা প্রণীত অধীন আইন, যা সংবিধানের মতাদর্শের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। আইনসভা প্রণীত ও বর্তমানে কার্যকর আইনসমূহ জীবনের প্রায় সকল ক্ষেত্র নিয়ন্ত্রণ করছে। সাধারণভাবে নির্বাহী কর্তৃপক্ষ ও সংবিধিবদ্ধ কর্পোরেশনগুলো কোনো আইন প্রণয়ন করতে পারে না, তবে আইনসভা দ্বারা ক্ষমতাপ্রাপ্ত মাত্রানুসারে উপ-আইন প্রণয়ন করতে পারে।

এ ধরনের অধীন আইনগুলো বিধি বা প্রবিধান হিসেবে পরিচিত। মূল আইনের এখতিয়ার বহির্ভূত না হলে এ ধরনের বিধি বা প্রবিধান সংসদ কর্তৃক প্রণীত আইনের মতোই আদালত কর্তৃক বলবৎযোগ্য। দেশের গুরুত্বপূর্ণ আইনসমূহকে কয়েকটি প্রধান ভাগে বিভক্ত করা যায়। যেমন— ভূমি ও সম্পত্তি আইন, ব্যক্তি আইন, বাণিজ্য আইন, শ্রম ও শিল্প আইন, নির্বাচন আইন, অপরাধ আইন, চাকরি আইন, অর্থ আইন, প্রেস আইন ও প্রতিকার সম্পর্কিত আইন ।

অধিকন্তু আরো বিভিন্ন বিষয়ে বিভিন্ন ধরনের আইন রয়েছে, যা জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্র এবং পরিমণ্ডলে কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। কোনো ব্যক্তিকে প্রতিবিধানের জন্য যথাযথ আদালত বা কর্তৃপক্ষের নিকট অভিযোগ দায়ের করতে হয়। দাবির মূল্য অনুযায়ী অর্থ, সম্পত্তি, ক্ষতিপূরণ ইত্যাদি সম্পর্কিত অভিযোগ দেওয়ানি আদালতে এবং অপরাধের বিরুদ্ধে অভিযোগ স্থানীয় থানায় অথবা এলাকার প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেটের ফৌজদারি আদালতে দায়ের করতে হয়। যে থানায় মামলা দায়ের করা হয় সে থানার পুলিশ মামলার তদন্ত করে এবং বিচারের সময় সাক্ষী উপস্থিত করে থাকে।

পক্ষান্তরে, লিখিত অভিযোগের ভিত্তিতে ম্যাজিস্ট্রেট বিচারকার্যে অভিযোগ গ্রহণ করলে আদালতে সাক্ষীদের উপস্থিত করার দায়িত্ব অভিযোগকারীর উপর বর্তায়। ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ অন্যান্য কর্তৃপক্ষের মাধ্যমেও প্রতিবিধান চাইতে পারে। এসব কর্তৃপক্ষের মধ্যে রয়েছে প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ অথবা ট্রাইব্যুনাল। মৌলিক অধিকার কার্যকরকরণ, সামুদ্রিক বাণিজ্য, কোম্পানির বিষয়াদি ও রিট আবেদন ব্যতীত কোনো বিষয়ে হাইকোর্ট বিভাগের নিকট সরাসরি প্রতিবিধান চাওয়া যায় না, কারণ হাইকোর্ট বিভাগ প্রধানত অধস্তন আদালতসমূহের সিদ্ধান্তের ওপর আপিল ও সংশোধন নিয়ে কাজ করে থাকে।

আইনব্যবস্থা এত ব্যাপক ও জটিল যে একজন সাধারণ ব্যক্তি কোনো আইনজীবীর সাহায্য ছাড়া আদালত, প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ অথবা ট্রাইব্যুনাল থেকে কার্যকরভাবে আইনগত প্রতিবিধান পেতে পারে  এ, যদিও আইনজীবী নিয়োগ ব্যতীত সরাসরি প্রতিবিধা চাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো আইনগত বাধা নেই। সরকারের মুখ্য আইন কর্মকর্তা হলেন অ্যাটর্নি জেনারেল। তিনি পদাধিকারবলে বার কাউন্সিলের চেয়ারম্যান এবং আইনজীবীদের নেতা। তাকে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল, উপ-অ্যাটর্নি জেনারেলগণ ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেলগণ সাহায্য করেন। তারা সুপ্রিম কোর্টে রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব এবং রাষ্ট্রের পক্ষে মামলাসমূহ পরিচালনা করেন।

জেলায় সরকারি উকিল হলেন মুখ্য সরকারি আইন কর্মকর্তা এবং তাকে সহায়তা প্রদান করেন অতিরিক্ত ও সহকারী সরকারি উকিলগণ। তারা অধস্তন দেওয়ানি আদালতে রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব এবং রাষ্ট্রের পক্ষে মামলা পরিচালনা করেন। একইভাবে ফৌজদারি বিষয়ে জেলার সরকারি উকিল বা পাবলিক প্রসিকিউটর হলেন আরেকজন মুখ্য আইন কর্মকর্তা। তাকে সাহায্য করেন সহকারী আইনজীবী। তারা জেলার দায়রা আদালত, দায়রা পর্যায়ের আদালত বা ট্রাইব্যুনালসমূহে রাষ্ট্রের পক্ষে মামলা পরিচালনা করেন। ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট পুলিশ ইন্সপেক্টর রাষ্ট্রের পক্ষে মামলা পরিচালনা করেন ।

বাংলাদেশে আইনের দৃষ্টিতে সকলেই সমান, আইনের সুরক্ষা পাওয়ার সমান অধিকারী এবং এখানে ধর্ম, জাতি, লিঙ্গ ইত্যাদির কারণে কোনো বৈষম্য থাকতে পারে না। আইনের অনুমোদন ব্যতীত কারো জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, খ্যাতি বা সম্পত্তির কোনো ক্ষতি সাধন অবৈধ। আইনের শাসন হলো বাংলাদেশের আইন ব্যবস্থার অন্যতম মৌলিক বৈশিষ্ট্য।

আইনের গঠন ও প্রয়োগ :

শাসনকার্য পরিচালনার জন্য আইন পরিষদ কর্তৃক আইন প্রণীত হয়। নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে আইনের ব্যবহার ও প্রয়োগ হয়ে থাকে। রাষ্ট্রের আইন-শৃঙ্খলা রাষ্ট্রে ব্যবসায়-বাণিজ্য, চাকরি, সমাজ, পরিবার, শিক্ষা, চিকিৎসা, প্রতিটি ক্ষেত্রে কার্যত সংবিধি হিসেবে জনস্বার্থকে সমুন্নত রেখে প্রযুক্ত হয়। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পার্লামেন্ট হচ্ছে সর্বোচ্চ আইন প্রণয়নকারী সংস্থা। বাংলাদেশে সকল আইন প্রেসিডেন্টের অধ্যাদেশ, পার্লামেন্ট বা সংসদ কর্তৃক অনুমোদিত ও গৃহীত হতে হয়। এরপর সরকারের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসমূহ সেগুলোর প্রয়োগ নিশ্চিত করে। আমাদের দেশে আইনের লঙ্ঘন, নাগরিক অধিকার হননের জন্য সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের শরণাপন্ন হতে পারে যে কোনো ব্যক্তি। অনেক সময় আইনের গঠন সুষ্ঠু হলেও নানা কারণে এর প্রয়োগ সুষ্ঠু হয় না।

আইনের কানাগলি বের করে নানা স্বার্থে মানুষ অন্যকে হয়রানি করতে ভালোবাসে। আমাদের দেশে এমন কিছু আইন আছে যেগুলোর প্রয়োগ দুঃসাধ্য। তবে সামাজিক, পারিবারিক সম্প্রীতি রক্ষার্থে এ দেশে পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশের মাধ্যমে পারিবারিক আইন প্রয়োগের বিধান রয়েছে। অর্থাৎ রাষ্ট্রের সংবিধানে নাগরিকের জীবন ও জানমালের নিরাপত্তা বিধানের নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়। এজন্য জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে যারা রাষ্ট্রক্ষমতায় যান তারা জনগণের অধিকার ও কল্যাণ প্রতিষ্ঠার জন্য নানারকম আইনের প্রয়োগ করেন। রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত আইনের প্রতি প্রজাসাধারণের শ্রদ্ধাশীলতা প্রদর্শন করা কর্তব্য ।

শ্রদ্ধাশীলতার হেতু :

আইনের চোখে ধনী-গরিব ছোট-বড় বলে কিছু নেই। আইন হস্তান্তরযোগ্য ন টাকা-পয়সা দিয়ে আইন কেনা-বেচারও ব্যবস্থা নেই। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সংস্থা কর্তৃক আইন প্রণীত হওয়ার পর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ব্যক্তিবর্গ তা প্রয়োগের ব্যবস্থা করেন। কেউ ক্ষমতাদস্ত কিংবা প্রতিপত্তির  জোরে যদি আইন অমান্য করেন কিংবা নিজ হাতে আইন তুলে নিয়ে অপরের ক্ষতিসাধন করেন তাহলে তিনি আইনের চোখে অপরাধী। আইন কোনো ব্যক্তিবিশেষকে অপরাধ সংঘটনের জন্য বাহবা দেয় না এবং একই অপরাধে একজনকে শাস্তি দিয়ে অন্যজনকে তারিফ করে না। আইন তার নিজস্ব গতিতে চলে, আইনের নিয়মভঙ্গকারী তার দিকে আইনকে নিয়ে যেতে পারেন না। তবে আইনের রক্ষক হয়ে যারা ভক্ষকের ভূমিকা পালন করেন তারা ধিকৃত হন।

১৯৩১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর হিজলি জেলে সন্তোষ মিত্র ও তারকেশ্বর দত্তকে শাস্ত্রীরা গুলি করে হত্যা করে। এর প্রতিবাদ করেছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বন্দি বাঘকে হত্যা করার মধ্যে কোনো কৃতিত্ব না থাকলেও আইনের রক্ষকরা এরূপ ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটিয়েছে নানা সময়ে। ১৯৫০ সালের ২৪ এপ্রিল জেলের পুলিশরা জেলারের নির্দেশে গুলি করে ৭ জন রাজনৈতিক বন্দিকে খুন করেছিল।

১৯৭৫ সালে ৪ জন জাতীয় নেতাকেও জেলের মধ্যে গুলি করে হত্যা করে আইন প্রয়োগকারী সেনাকর্মীরা। এগুলো ছিল নিছক স্বেচ্ছাচারিতা। কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আইন নিয়ে স্বেচ্ছাচারিতার এমনটি সুযোগ নেই। কাজেই সমাজ পরিবেশের অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়াতে চাইলে আইনকে মানতে হবে। কেবল এর প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা বৃদ্ধি করেই সমাজের নাজুক পরিস্থিতির মোকাবিলা করা সম্ভব।

আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা | নীতি চরিত্র মূল্যবোধ | বাংলা রচনা সম্ভার

 

উপসংহার :

সঠিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে এর প্রয়োগ বিধানে সুনাগরিকের যত্নবান হওয়া উচিত। এতে উপকারই আছে। অশ্রদ্ধাবশত আইনকে না মানলে কিংবা নিজের হাতে আইন তুলে নিলে জেল-জরিমানা থেকে শুরু করে অনেক কিছুই হয়ে যেতে পারে। অনেক সময় ক্ষমতা কুক্ষিগত করার মানসে কালো আইন প্রণীত হয়। এসব কালো আইনে মদদ দিলে জাতির ক্ষতিই সাধিত হয়। বাংলাদেশের বহু আলোচিত ইনডেমনিটি বিল অবশ্যই একটি অনুচিত কালো আইন। কারণ একটি মানুষ যতই অপরাধী হোক তাকে বিনা বিচারে শাস্তি প্রদান বা হত্যা করা অন্যায়। তার চেয়ে বেশি ঘৃণ্য কাজ তার পরিবারের সবাইকে হত্যা করা। কাজেই আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা ও সম্মান প্রদর্শন সচেতন মানুষ মাত্রেই প্রয়োজন ।

 

আরও দেখুন:

Leave a Comment