অক্ষরবৃত্ত ছন্দের রূপকল্প বৈচিত্র্য

অক্ষরবৃত্ত ছন্দের রূপকল্প বৈচিত্র্য নিয়ে আজকের আলাপ। অক্ষরবৃত্ত ছন্দ বাংলা ছন্দের মধ্যে সবচেয়ে বৈচিত্র্যময়। বস্তুত এই ছন্দে যত রূপকল্পের (pattern) সৃষ্টি হয়েছে বা হতে পারে, তেমনটি আর কোনো ছন্দেই সম্ভবপর নয়। নিচে এর বিচিত্র ব্যবহারের পরিচয় দেওয়া হল : পয়ার : অক্ষরবৃত্ত ছন্দের অপর একটি অতি প্রচলিত নাম পয়ারজাতীয় ছন্দ’।

অক্ষরবৃত্ত ছন্দের রূপকল্প বৈচিত্র্য

অক্ষরবৃত্ত ছন্দের রূপকল্প বৈচিত্র্য | ছন্দ ও অলঙ্কার | ভাষা ও শিক্ষা

আবার অনেকে একে সোজাসুজি ‘পয়ার’ বলে থাকেন। প্রত্যেক চরণ দুই পর্বের। চরণের মাত্রা বিন্যাস ৮+৬ = ১৪। এবং চরণপ্রান্তে অন্ত্যমিল। দুই চরণে স্তবক গঠিত হয়। দুই পঙক্তির বাই বাইরে অর্থ যায় না, দুই পঙ্ক্তির মধ্যেই বাক্য সম্পূর্ণ হয়। যেমন- পাখী সব করে রব / রাতি পোহাইল, কাননে কুসুম কলি / সকলি ফুটিল। = ৮+৬ মাত্রা = ৮ + ৬ মাত্রা। পয়ারের শোষণশক্তি : পয়ারজাতীয় অর্থাৎ অক্ষরবৃত্ত ছন্দের একটা বিশিষ্ট লক্ষণ বা বিশেষ গুণের প্রতি আমাদের সর্বপ্রথম দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ— যিনি বাংলা সাহিত্যের অনেক ব্যাপারেই পুরোহিত- এটিকে তিনি বলেছেন “পয়ারের শোষণশক্তি’-এর অন্য নাম দেওয়া চলে ‘অক্ষরবৃত্ত ছন্দের স্থিতিস্থাপকতা গুণ।

আগে বলা হয়েছে যে, অক্ষরবৃত্ত ছন্দের একটা বিশেষ তান আছে বলেই তাকে ‘তানপ্রধান ছন্দ’ও বলা হয়। এই বিশেষ তানের জন্যই এর মধ্যে অনেক ফাঁক থেকে যায়, এর বুনট ঘনসংবদ্ধ নয়। তাই এর ফাঁকে ফাঁকে অনায়াসে অনেক ধ্বনি ঢুকিয়ে দেওয়া যায়।

এর স্থিতিস্থাপকতা গুণের জন্য তাতে আর মাত্রাবৃদ্ধি হয় না। অক্ষর ধ্বনিকে আচ্ছন্ন করে অক্ষরবৃত্ত ছন্দে যে তান বা সুরের প্রবাহ লক্ষ করা যায়, তার প্রভাবে হ্রস্ব, দীর্ঘ স্বরের কিংবা ১ যুগ্মধ্বনির প্রসারণ ও সংকোচন অতি সহজেই এতে ঘটতে পারে। অক্ষরের এত খানি স্থিতিস্থাপকতা অন্য কোনও ছন্দে দেখা যায় না।

এ কারণে যুক্ত ব্যঞ্জনের গুরুভার বহনের শক্তি অপরিসীম। ফলে, এ ছন্দে মাত্রাসংখ্যা ঠিক রেখে যুক্তাক্ষরবিহীন চরণ রচনা করা যেমন চলে, যক্তাক্ষর বহুল চরণও তেমনি সৃষ্টি করা যায়। অক্ষর বৃত্তের এ তান বৈশিষ্ট্যের ফলে যুক্তাক্ষর বিহীন পর্বকে যুক্তাক্ষর বহুল করলেও ছন্দঃপতনের লক্ষণ দেখা যায় না। যুগ্ম ধ্বনির পরিধি • সংকুচিত হয়ে একমাত্রা হিসেবে পরিগণিত হওয়াকেই রবীন্দ্রনাথ ‘পয়ারের শোষণশক্তি’ বলেছেন। ক্রমশ যুক্তাক্ষর বাড়ানো সত্ত্বেও মাত্রা-সংখ্যার যে কোনও তারতম্য হয় না। রবীন্দ্রনাথ তা নিচের উদাহরণের মাধ্যমে দেখিয়েছেন।

 

Capture 101 অক্ষরবৃত্ত ছন্দের রূপকল্প বৈচিত্র্য

 

রবীন্দ্রনাথ বলেন, মাত্রার মোট ওজন রেখে পাঠক এর মাত্রাগুলিতে অনেকটা ইচ্ছামতো চালাচালি করতে পারেন। এই শক্তির বশে অক্ষরবৃত্ত ছন্দে জয়জয়ন্তীর গম্ভীর ধ্বনি এবং পুরবি শাহানার মৃদু করুণ সুর এই দু স্বরগ্রামই একই বীণা তারে ঝঙ্কৃত হয়েছে। একাবলী : যে ছন্দে দুই মিত্রাক্ষর চরণ, প্রতি চরণে দুই পর্ব এবং মাত্রা বিন্যাস ৬+৫ হয় তাকে একাবলী বলে। পূর্ণপর্বের মাত্রাসংখ্যা ৬ বা ৮ কিংবা অন্যরকমও হতে পারে। এ ছন্দকে একপদী ছন্দও বলে। যেমন-

বড়র পিরীতি / বালির বাঁধ, ক্ষণে হাতে দড়ি / ক্ষণেকে চাঁদ। = ৬ + ৫ মাত্রা। ৬ + ৫ মাত্রা। : প্রত্যেক চরণে তিন পর্ব, প্রথমে দুই পর্বে অন্ত্যমিল এবং দুই চরণের মধ্যে অন্ত্যমিল থাকলে তাকে ত্রিপদী বলে। যথা- যে জন দিবসে জ্বালায় মোমের বাতি । আশু গৃহে তার দেখিবে না আর ৬ + ৬ + ৮ মাত্রা = ৬+৬+৮ মাত্রা। নিশীথে প্রদীপ ভাতি । মনের হরষে চৌপদী : এ ছন্দের প্রতি চরণে চারটি পদ থাকে। দুই চরণের অন্ত্যমিল ছাড়াও প্রতি চরণের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্বে অন্ত্যমিল থাকে।

যেমন- চিরসুখী জন ভ্রমে কি কখন ব্যথিত বেদ্ৰন/ বুঝিতে পারে। কি যাতনা বিষে বুঝিবে সে কিসে কভু আশীবিষে/ দংশেনি যারে। একপদী : নিয়মিতভাবে এক পর্ব দ্বারা গঠিত চরণের ছন্দকে একপদী বলা হয়। যেমন— = ৬+৬+৬+৫ মাত্রা । ৬+৬+৬+৫ মাত্রা। নন্দন কানন কোলে / ঘুমায় স্বপন ভোলে ঘুমায় দেবতা সব! / কলি যুগ অভিনব। এখানে, প্রতি পর্বে ৮ মাত্রা। অমিত্রাক্ষর ছন্দ : অমিত্রাক্ষর ছন্দ পয়ার ছন্দভিত্তিক, কিন্তু এতে পক্তির শেষে মিল নেই। এই ছন্দে এক পঙ্ক্তিতে বক্তব্য শেষ না হয়ে অন্য পঙ্ক্তিতে গড়িয়ে যায়।

এই বৈশিষ্ট্যকে প্রবহমানতা বলে। প্রতি পঙ্ক্তিতে চৌদ্দ অক্ষর থাকে। প্রতি পংক্তি ৮ + ৬ পর্বে বিভক্ত। বড় ধরনের ভাব প্রকাশে অমিত্রাক্ষর ছন্দ বিশেষ সহায়ক। মাইকেল মধুসূদন দত্ত এই ছন্দের প্রবর্তন করেন। অমিত্রাক্ষর ছন্দের দৃষ্টান্ত সম্মুখ সমরে পড়ি, বীর চূড়ামণি / বীরবাহু, চলি যবে গেলা যমপুরে অকালে, কহ, হে দেবি অমৃতভাষিণি ।

কোন বীরবরে বরি সেনাপতি পদে, পাঠাইলা রণে পুনঃ রক্ষঃকুলনিধি / রাঘবারি? গৈরিশ ছন্দ : এ ছন্দের পর্ব সংখ্যা ও দৈর্ঘ্য এক প্রকার নয়। অন্ত্যানুপ্রাস সব সময় ব্যবহৃত হয় না। প্রবহমানতা থাকে, ছেদনির্ভর হয় ও অক্ষরের স্বাভাবিক উচ্চারণ-রীতি অনুসৃত হয়। যেমন— ৪৭৪ উচ্চতর স্বনির্ভর বিশুদ্ধ ভাষা-শিক্ষা এস নাথ, । কত ক্লেশ পেয়েছ কুটীরে কা সাধ হয় মরণ সময় / মরিব তোমায় দেখে।

বলাকার ছন্দ / মুক্তক ছন্দ : ছেদ অনুসারে পর্ব গঠিত হয়, প্রবহমানতা, অন্ত্যমিল ও অর্থবিভাগ-ভিত্তিক পক্তি সৃষ্টি হয় যে ছন্দে তাকে মুক্তক ছন্দ বলা হয়। যেমন— তোমার কীর্তির চেয়ে/ তুমি যে মহৎ তাই তব জীবনের রথ = ১০ মাত্রা। = ৮+৬ মাত্রা। পশ্চাতে ফেলিয়া যায়/ কীর্তিরে তোমার = ৮ + ৬ মাত্রা। বারংবার = ৪ মাত্রা।

 

অক্ষরবৃত্ত ছন্দের রূপকল্প বৈচিত্র্য | ছন্দ ও অলঙ্কার | ভাষা ও শিক্ষা

 

তাই = ২ মাত্রা লোক চিহ্ন তব পড়ে আছে / তুমি হেথা নাই = ৮ + ৬ মাত্রা। অতিমুক্তক ছন্দ : অন্ত্যমিলহীন মুক্তক ছন্দই অমিল মুক্তক বা অতিমুক্তক ছন্দ নামে পরিচিত। যেমন- স্মৃতির মিনার ভেঙ্গেছে তোমার? ভয় কি বন্ধু, আমরা এখনো / চার কোটি পরিবার খাঁড়া রয়েছি তোণ যে ভিত কখনো কোনো রাজন্য / পারেনি ভাঙতে । গদ্যছন্দ : পরস্পর ছেদ-বিচ্ছিন্ন চরণ দ্বারা গঠিত, পর্ব বহুত্ব-বর্জিত ও চরণ-দৈর্ঘ্য অর্থানুযায়ী স্বাধীন এবং অন্ত্যমিলহীন ও প্রবহমান যে ছন্দ তাকে গদ্যছন্দ বলা হয়। যেমন- তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি । বিচিত্র ছলনাজালে হে ছলনাময়ী।

মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ পেতেছ নিপুণ হাতে সরল জীবনে। সনেট : একটিমাত্র অখণ্ড ভাব-কল্পনা বা অনুভূতি-কণা যখন চোদ্দো অক্ষর সমন্বিত (কখনো কখনো ১৮ অক্ষরও চ ব্যবহৃত হয়) চতুর্দশ পঙ্ক্তিতে একটি বিশেষ ছন্দোরীতিতে আত্মপ্রকাশ করে তখনই তা সনেট নামে অভিহিত হয়। যেমন- হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন; / তা সবে, (অবোধ আমি!) অবহেলা করি, পরধন লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ / পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি পালিলাম আজ্ঞা সুখে, পাইলাম কালে / মাতৃভাষা-রূপ খনি, পূর্ণ মণিজালে।

 

আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

অক্ষরবৃত্ত ছন্দের মূল পর্ব দুটি— আট ও ছয় মাত্রার। অক্ষরবৃত্ত ছন্দের বৈশিষ্ট্য এ ছন্দে শব্দের আদি ও মধ্যের যুগ্মধ্বনি ঠাসা বা সংশ্লিষ্ট উচ্চারণে এক মাত্রার এবং শেষের যুগ্মধ্বনি বিশ্লিষ্ট উচ্চারণে দুই মাত্রার । এ-ছন্দে সাধুভাষা বা সাধু ক্রিয়াপদেরই ব্যবহার বেশি। এ-ছন্দে লয় ধীর বা মধ্যম। ৩. 8. ৫. এ-ছন্দের চরণস্থ পর্বসমূহে অক্ষর ধ্বনিকে আচ্ছন্ন করে একটা অতিরিক্ত সুরের তান বা তরঙ্গ নিয়ত প্রবহমান। 9. এ-ছন্দ যেহেতু অক্ষর-সর্বস্ব; তাই, এর অক্ষর গুনে মাত্রা ঠিক করলেই চলে।

এ-ছন্দে আদি ও মধ্যের যুগ্মধ্বনি বা বদ্ধাক্ষর চার জায়গায় (কথ্য ক্রিয়াপদে, নির্দেশক প্রত্যয়যুক্ত শব্দে, সমাসবদ্ধ পদে, তৎসম ও তদ্ভব শব্দে) দ্বিমাত্রিক। ৬. b. এ-ছন্দে তানের প্রবাহে এর অন্তর্গত যুক্ত-ব্যঞ্জনের মাত্রা সংকুচিত হয়ে এক মাত্রার হয় এ-ছন্দের ভাব ও ভাষা গভীর, গম্ভীর, বিপুল এবং বিশাল। ১০. এ-ছন্দের প্রধান বৈশিষ্ট্য এর অসাধারণ শোষণশক্তি যার ফলে যুক্তাক্ষরবিহীন পর্বকে যুক্তাক্ষরবহুল করলেও এর মাত্রা-সংখ্যার কোনো তারতম্য হয় না।

 

সূত্র: অক্ষরবৃত্ত ছন্দের রূপকল্প বৈচিত্র্য | ছন্দ ও অলঙ্কার | ভাষা ও শিক্ষা

আরও দেখুন:

Leave a Comment