কবি সৈয়দ শামসুল হক এর কবিতা , সৈয়দ শামসুল হক এর জন্ম ২৭ ডিসেম্বর ১৯৩৫, কুড়ি গ্রাম, বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি, ব্রিটিশ ভারত। তার বাবা সৈয়দ সিদ্দিক হুসাইন ও মা হালিমা খাতুন। বাবা সৈয়দ সিদ্দিক হুসাইন পেশায় ছিলেন হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার। সৈয়দ হক তার বাবা-মায়ের আট সন্তানের জ্যেষ্ঠতম। সৈয়দ হকের শিক্ষাজীবন শুরু হয় কুড়িগ্রাম মাইনর স্কুলে ।
এরপর ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে গণিতে লেটার মার্কস নিয়ে সৈয়দ শামসুল হক ম্যাট্রিক (বর্তমানের এসএসসি) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পিতার ইচ্ছাকে অগ্রাহ্য করে তিনি ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে বম্বে পালিয়ে যান। সেখানে তিনি বছর খানেকের বেশি সময় এক সিনেমা প্রডাকশন হাউসে সহকারী হিসেবে কাজ করেন।
সৈয়দ হক প্রথিতযশা লেখিকা ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. আনোয়ারা সৈয়দ হককে বিয়ে করেন। তাদের এক ছেলে ও এক মেয়ে।

সৈয়দ শামসুল হকের ভাষ্য অনুযায়ী তার রচিত ১ম পদ তিনি লিখেছিলেন ১১ থেকে ১২ বছর বয়সে। টাইফয়েডে শয্যাশায়ী কবি তার বাড়ির রান্নাঘরের পাশে সজনে গাছে একটি লাল টুকটুকে পাখি দেখে দু’লাইনের একটি পদ ” আমার ঘরে জানালার পাশে গাছ রহিয়াছে / তাহার উপরে দুটি লাল পাখি বসিয়া আছে ” রচনা করেন। ১৯৪৯-৫০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে ম্যাট্রিক পরীক্ষার পরে ব্যক্তিগত খাতায় ২০০টির মতো কবিতা রচনা করেন তিনি। সৈয়দ শামসুল হকের প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে, ফজলে লোহানী সম্পাদিত ‘অগত্যা’ পত্রিকায়। সেখানে ‘উদয়াস্ত’ নামে তার একটি গল্প ছাপা হয়। সৈয়দ হক তার বাবা মারা যাবার পর অর্থকষ্টে পড়লে চল-চ্চিত্রের জন্য চিত্র-নাট্য লেখা শুরু করেন। ১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মাটির পাহাড় চল-চ্চিত্রের চিত্র-নাট্য লিখেন। বড় ভাল লোক ছিলো ও পুরস্কার নামে ২টি চল-চ্চিত্রের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ চিত্র-নাট্যকার বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে বাংলাদেশ ত্যাগ করে লন্ডন চলে যান এবং সেখানে বিবিসির বাংলা খবর পাঠক হিসেবে চাকুরি গ্রহণ করেন। তিনি ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসর্মপণের খবরটি পাঠ করেছিলেন। পরে ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বিবিসি বাংলার প্রযোজক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
Table of Contents
কবি সৈয়দ শামসুল হক এর কবিতাঃ

অদ্ভুত বোল – সৈয়দ শামসুল হক
যেতে যেতে হাত পেতে যেই দাঁড়ালাম_
টপ্ করে খসে পড়ে আকাশের ঘাম ।
আকাশের ঘামাচি কি ঘন কালো মেঘ ?
বিদ্যুত বলে, আগে কোবরেজি শেখ !
তার সাথে তালি দিয়ে ঝর ঝর ঝর
মাঠ ঘাট খাল বিল ঘামের সাগর ।
আরে বাপু, ঘাম নয়_ বৃষ্টি কী বৃষ্টি ।
খোদার কি কাজ নেই ? মূর্খের সৃষ্টি !
আমি বলি, মূর্খরা নয় রে পাগল ।
এ হলো পদ্যের টানে অদ্ভুত বোল ।
আচমকা জুড়ে দিয়ে বৃষ্টি আর ঘাম
মুহূর্তেই পদ্যটা লিখে ফেললাম ।

আগে এবং পরে – সৈয়দ শামসুল হক
তোমাকে গভীর ভালোবাসবার আগে।
আমার সঞ্চয়ে ছিল বিকট শূন্যতা যেনবা শ্রেষ্ঠীর ঘরে নমিত পতাকা, তরুণ শবের পাশে যুবতীরা জাগে।
তোমাকে গভীর ভালোবাসবার আগে।
আমার ফলকে ছিল অংকের ভিন্নতা –
যেনবা মাটির তলে সামান্য যা রাখা মুহূর্তেই মহাজন গ্রাস করে তাকে।
তোমাকে গভীর ভালোবাসবার পরে আমার জাহাজ পায় সমুদ্রের স্বাদ;
তোমার বন্দরে আছে পণ্য থরে থরে এবং সেখানে নেই বাণিজ্যে বিবাদ।।

আমার পরিচয় – সৈয়দ শামসুল হক
আমার পরিচয় কবিতা – সৈয়দ শামসুল হক ( ভিডিও ক্লাস সহ)
আমি একটুখানি দাঁড়াব – সৈয়দ শামসুল হক
আমি একটুখানি দাঁড়াব এবং দাঁড়িয়ে চলে যাব;
শুধু একটু থেমেই আমি আবার এগিয়ে যাব;
না, আমি থেকে যেতে আসিনি;
এ আমার গন্তব্য নয়;
আমি এই একটুখানি দাঁড়িয়েই
এখান থেকে
চলে যাব।
আমি চলে যাব
তোমাদের এই শহরের ভেতর দিয়ে খুব তাড়াতাড়ি
এর মার্চপাস্টের যে সমীকরণ
এবং এর হেলিকপ্টারের যে চংক্রমণ,
তার তল দিয়ে তড়িঘড়ি;
আমি চলে যাব
তোমাদের কমার্সিয়াল ব্লকগুলোর জানালা থেকে
অনবরত যে বমন
সেই টিকার-টেপের নিচ দিয়ে
এক্ষুনি;
আমি চলে যাব
তোমাদের কম্পিউটারগুলোর ভেতরে যে
বায়ো-ডাটার সংরক্ষণ
তার পলকহীন চোখ এড়িয়ে
অবিলম্বে;
আমি চলে যাব
যেমন আমি যাচ্ছিলাম আমার গন্তব্যের দিকে
ধীরে ধীরে
বহুকাল ধরে
আমি একটি
দু’টি
তিনটি
প্রজন্ম ধরে।
আমি কথা দিচ্ছি
তোমাদের কোনো রমণীকে আমি চুম্বন করব না;
আমি কথা দিচ্ছি
তোমাদের কোনো সন্তানকে আমি কোলে করব না;
এবং কথা দিচ্ছি
তোমাদের এপার্টমেন্টের জন্যে আমি দরখাস্ত করব না,
তোমাদের ব্যাংক থেকে আমি ঋণ গ্রহণ করব না,
তোমাদের শাসন-পরিষদে আমি সদস্য হতে চাইব না,
তোমাদের নির্বাচনে আমি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করব না;
এবং আমি আরো কথা দিচ্ছি
তোমাদের বেতারে কোন ভাষণ দেব না,
তোমাদের কম্পিউটারে কোন তথ্য ফিড করব না,
তোমাদের হেলিকপ্টারে আমি উড্ডীন হতে চাইব না,
তোমাদের মার্চপাস্টে আমি ড্রামবাদক হব না।
তোমাদের এপার্টমেন্ট আমার কষ্ট,
তোমাদের উনোন আমার কষ্ট,
তোমাদের ব্যাংক আমার কষ্ট,
তোমাদের পরিষদ আমার কষ্ট,
তোমাদের আয়না আমার কষ্ট,
তোমাদের গেলাশ আমার কষ্ট,
তোমাদের রমণী আমার কষ্ট,
তোমাদের সন্তান আমার কষ্ট।
আমি শুধু একটু সময় দাঁড়িয়ে দেখে যাব-
এ সবের ভেতর দিয়েই তো আমার বাড়ি যাবার পথ,
আমি বাড়ি যাব,
পৃথিবীতে সমস্ত বাড়ি যাবার পথেই আছে
এরকম একেকটি শহর;
আমি এক্ষুনি এগিয়ে যাব।
তোমাদের যে এপার্টমেন্ট, আমি জানি, তার ছাদ নেই;
তোমাদের যে উনোন, আমি জানি, তার আগুন নেই;
তোমাদের যে ব্যাংক, আমি জানি, তার স্বচ্ছলতা নেই;
তোমাদের যে পরিষদ – কারো সম্মতি নেই;
তোমাদের যে আয়না – কোনো প্রতিফলন নেই;
তোমাদের যে গেলাশ – কোনো পানীয় নেই;
আমি জানি
তোমাদের রমণীদের গর্ভধারণ করবার ক্ষমতা নেই;
আমার জানা আছে
তোমাদের সন্তানদের হাতে শস্যের একটিও বীজ নেই।
একটি দু’টি তিনটি প্রজন্ম ধরে আমি
একাধিক যুদ্ধ – একটি শান্তিকে,
একাধিক মন্বন্তর – একটি ফসলকে,
একাধিক স্তব্ধতা – একটি উচ্চারণকে,
একাধিক গণহত্যা – একটি নৌকোকে,
একাধিক পতাকা – একটি স্বাধীনতাকে
শরীরে আমার বীভৎস ক্ষতের মধ্যে লাল স্পন্দনের মতো
অনুভব করতে করতে
এই যে ক্রমাগত এগিয়ে চলেছি-
সে একটি বাড়ির দিকে যে কখনো ভেঙে পড়ে না,
সে একটি উনোনের দিকে যে কখনো নিভে যায় না,
সে একটি ব্যাংকের দিকে যে কখনো দেউলে হয় না,
সে একটি পরিষদের দিকে যে কখনো যুদ্ধ ঘোষণা করে না,
এমন একটি আয়নার দিকে যেখানে প্রতিফলন,
এমন একটি গেলাশের দিকে যেখানে পরিস্রুত পানীয়,
এমন একটি রমণীর দিকে যে এইমাত্র চুল খুলেছে,
এমন এক সন্তানের দিকে যে এইমাত্র বর্ষায় ভিজেছে।
আমার এই অগ্রসর
সে তোমাদের ভেতর দিয়েই অগ্রসর।
রাতের পর রাত ভেঙে উৎকর্ণ জন্তুর মতো চলেছি
চাঁদের নিচে পানির সন্ধানে,
সমস্ত স্তব্ধতাকে মাকড়শার জালের মতো ছিঁড়ে ছিঁড়ে
গুহাবন্দী মানুষের মতো আমি চলেছি
পানির শব্দ নির্ণয় করে।
আমি এখনো জানি না তার শেষে অপেক্ষা করছে কিনা
একটি রমণী অথবা তার হাঁসুলী ছেঁড়া পুঁতি;
আমি এখনো জানি না তার শেষে দেখতে পাব কিনা
সরোবরের ভেতরে চাঁদ অথবা কাদার ভেতরে করোটি।
তবু আমাকে যেতে হবে
এবং তবু আমাকে যেতেই হবে, সহস্র ক্ষত শরীরে।
তোমাদের এই শহরের ভেতর দিয়ে যেতে
যদিবা আমার চোখে পড়ল কচিৎ একটি যুগল
যাদের গান এখনো বহন করতে বাতাস বড় ইচ্ছুক,
আমি জানি আমিও তো একটি যুগল হতে চেয়েছি-
তাই আমার একটুখানি থামা।
যদিবা আমার চোখে পড়ল ছেঁড়া কিছু কাগজ
যার ভেতরে বন্দী কোনো কবির লেখা ছিন্ন ক’টি অক্ষর,
আমি জানি আমিও তো একটি কবিতার জন্যে কলম ধরেছি-
তাই আমার একটু এই দাঁড়ানো।
যদিবা আমার চোখে পড়ল শাদা একটি ফুল
যা রাতের অন্ধকারে ছোট্ট কিন্তু তীব্র সুগন্ধ নিয়ে ফুটেছিল,
আমি জানি আমিও তো একটি উদ্যানই আমার স্বপ্নে দেখেছি-
তাই আমার একটু শুধু বিরতি।
আমাকে এক রমণী তার রাতের প্রস্তুতি নিয়ে ডাকছে,
আমাকে যেতেই হবে;
আমাকে একটি কাগজ তার কবিতার সম্ভাবনা নিয়ে ডাকছে,
আমাকে যেতেই হবে;
আমাকে একটি উদ্যান তার চারাগাছগুলো নিয়ে ডাকছে,
আমাকে যেতেই হচ্ছে
আমাকে ডাকছে একটি শিশু,
আমাকে ডাকছে একটি রাষ্ট্র,
আমাকে ডাকছে একটি আয়না তার সমুখে স্থাপিত হবার জন্যে।
তাই একটুখানি দাঁড়িয়েই আমি এগিয়ে যাব আবার
যেমন যাচ্ছিলাম
ধীরে ধীরে
বহুকাল ধরে
আমি একটি
দু’টি
তিনটি
প্রজন্ম ধরে।
তোমাদের ভেতর দিয়েই তো সর্বকাল চলে গেছে আমার পথ
এবং সর্বকাল আমি দাঁড়িয়েছি আমি আবার নিয়েছি পথ।

একদা এক রাজ্যে – সৈয়দ শামসুল হক
ওটা ছিল পার্কে যাবার রাস্তা;
আর যা আমাকে পেয়ে বসেছিল তা রোদন;
তুমি মনে করো, যদি মনে থাকে, সেই ছেলে তিনটের কথা
উলঙ্গ, উৎসর্গ ধূলায় যারা জননীর, যারা
তখন হাত পেতে দাঁড়িয়েছিল আমার তিনটে পয়সার জন্য;
আমি তখন প্যান্টের পকেটে হাত রেখে
যা বলতে পারিনি
বানাতে পারছি না কান্নার বিরোধী বর্ম;
বাতাসে ফুলে উঠছে ফুসফুস
আমি সেই বাদাম তোলা জাহাজের মতো অচেনা সমুদ্রে;
তুমি ওভাবেই পছন্দ করলে বিদায়।
সিঁড়ির শেষধাপে যদি দাঁড়াতে, দাঁড়াতে পারতে;
আর তোমার পেছনে থাকতো সূর্য, সূর্যের আভা, সে আভায়
যদি শিথিল হয়ে আসতো ডাইনে বাঁয়ে পেছনে ধুলোয় দীর্ঘ
থামগুলো;
জ্বলতো, পুড়তো ছাইদানে ধূপ;
সঞ্চিত হতো রাত,
ছড়াতো, ছড়িয়ে পড়তো, তোমার মুখের মতো তাল তাল সৌরভ:
ওদিকে রাত্রি তার কনকনে হাওয়ায় চিৎকার করে বলতো —
এসো এই কবোষ্ণ গর্তে:
কিন্তু আমরা সৃষ্টি করি আমাদের মৃত্যুকে
আর জীবনকে ফেলে রাখি ছুরির মতো বিপজ্জনক বাতাসে;
তোমার বিদায় ছিল এভাবেই।
তখন কি জানি কিসের জীবন্ত উল্লাসে জেগে উঠতে চেয়েছিল
জানালায় জনকের মুখ।
— দরোজায় নিশব্দ টোকা— দেখলাম
দেয়ালে আলো দিচ্ছে তাঁর হাতের সাঁড়াশি
যেন একটা মাছ।
দাঁতটা তুলতে হবে — ব্যথা করবে না —
গরমের সকালে আমি চোখ বুজে অপেক্ষায় কাঁপছি
বারান্দায়, কাল রাতেও অন্ধকারে
যেখানে নড়ে উঠেছে স্বপ্নের ঘোড়া।
সরে দাঁড়ায়নি দেয়াল,
আমার পিঠের সঙ্গে হয়ে উঠেছে শরীর;
তোমার পেছনে ছিল দালান, দ্রুত মোটর,
স্টেডিয়ামের মোড়। বিজ্ঞাপন বাতির নৃত্যে
তোমার পাথরের মুখ আরেকটি অবশ্য অংশ—
আমি কি দেখেছি তোমাকে, তোমার বিদায়ে?
প্রতিহত তীব্র ধ্বনির মতো একটা জগ
যা গেছে
জেগে উঠবো, আবার, এভাবে, তোমাকে বিদায় দিতে
একদা এক রাজ্যে।

একুশের কবিতা – সৈয়দ শামসুল হক
সভ্যতার মণিবন্ধে সময়ের ঘড়ি
শিশুর জন্ম থেকে জরাদেহ ক্ষীণশ্বাস মানবের অবলুপ্তির সীমারেখায়
বলে গেল সেই কথা। সেই কথা বলে গেল অনর্গল–
তপ্তশ্বাস হাহুতাশ পাতাঝরা বিদীর্ণ বৈশাখীর জ্বালাকর দিগন্তে
আষাঢ়ের পুঞ্জীভূত কালো মেঘ আসবেই ঠিক।
সাগরের লোনাজলে স্নিগ্ধ মাটীর দ্বীপ
শ্যামলী স্বপ্নের গান বুকে পুষে
নবীন সূর্য্যেরে তার দৃঢ় অঙ্গীকার জানাবেই।
সংখ্যাহীন প্রতিবাদ ঢেউয়েরা আসুক, তুমি স্থির থেকো।
প্রাকৃতিক ঝঞ্ঝাবাত অবহেলা করি
সঞ্চয় করে যাও মুঠো মুঠো গৈরিক মাটী:
সবুজ গন্ধবাহী সোনালী সূর্য্যের দিশা
অকস্মাৎ উদ্ভাসিত কোরে দেবে তোমার চলার পথ।
সভ্যতার মণিবন্ধে সময়ের ঘড়ি
শিশুর জন্ম থেকে জরাদেহ ক্ষীণশ্বাস মানবের অবলুপ্তির সীমারেখায়
বলে গেল সেই কথা। সেই কথা বলে গেল অনর্গল–
পৃথিবীর জিজীবিষু আত্মার আছে। ঘনীভূত জনতার হৃদয়ে হৃদয়ে
উজ্জ্বল শিখা সেই অমর সংবাদে ঢেউ তুলে দিয়ে গেল।।

একেই বুঝি মানুষ বলে – সৈয়দ শামসুল হক
নষ্ট জলে পা ধুয়েছো এখন উপায় কি?
আচ্ছাদিত বুকের বোঁটা চুমোয় কেটেছি।
কথার কোলে ইচ্ছেগুলো বাৎসায়নের রতি,
মানে এবং অন্য মানে দুটোই জেনেছি।
নষ্ট জলে ধুইয়ে দেবে কখন আমার গা,
তোমার দিকে হাঁটবে কখন আমার দুটো পা?
সেই দিকে মন পড়েই আছে, দিন তো হলো শেষ;
তোমার মধ্যে পবিত্রতার একটি মহাদেশ
এবং এক জলের ধারা দেখতে পেয়েছি-
একেই বুঝি মানুষ বলে, ভালোবেসেছি।

এখন দূরে ডাকছে কেউ – সৈয়দ শামসুল হক
তোমার যদি ঘুম পেয়েছে, ঘুমোতে যাও তুমি
আমার নেই বিছানা, নেই ঘর।
তারার নিচে এখন চিৎ আমার জন্মভূমি
চতুর্দিকে ক্রন্দনের স্বর।
এখন চাঁদ অন্নহীনের শূন্য কাঁসার থাল
আছাড় দেয় আলো মাটির ‘পর।
আমার চোখে ঘুম আসে না, নদীর পানি লাল
হাড়ের মতো শাদা নদীর চর।
এখন দূরে ডাকছে কেউ, পাথার ভেঙে আসে
ও কার এত ব্যাকুল কন্ঠস্বর?
আগুন আছে অপেক্ষায় নদীর উৎসমূলে
আমাকে দিতে হবে যে উত্তর!

এখন মধ্যরাত – সৈয়দ শামসুল হক
এখন মধ্যরাত।
তখন দুপুরে রাজপথে ছিলো মানুষের পদপাত।
মিছিলে মিছিলে টলমল ছিলো সারাদিন রাজধানী।
এখন কেবল জননকূল ছল বুড়িগঙ্গার পানি
শান্ত নীরব
নিদ্রিত সব।
ওই একজন জানালায় রাখে তার বিনিদ্র হাত
ছিলো একদিন তার
উজ্জ্বল দিন, ছিলো যৌবন ছিলো বহু চাইবার।
সারা রাত চষে ফিরেছে শহর খুঁজেছে সে ভালোবাসা।
পেতেছে সে হাত জীবনের কাছে ছিলো তারও প্রত্যাশা পাওয়া না পাওয়ার
প্রশ্নে হাওয়ার
বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে এখন সারারাত হাহাকার।
পথে ওড়ে ধুলো, ছাই ওড়ে শুধু পথে যে আগুন ছিলো
একদা সে জ্বেলে ছিলো।
হৃদয়ে এখন সৌধের ভাঙা টুকরো আছাড় খায়।
আলো নিভে যায়, নিভে যায় আলো একে একে জানালায়।
থেমে যায় গান
তারপরও প্রাণ
বাঁশিটির মতো বেজে চলে যেন সবই আছে সবই ছিলো।

কবিতা ২০৪ – সৈয়দ শামসুল হক
আমাদের পদচিহ্ন পড়ে থাক ঐ রাস্তায় কি সিঁড়িতে গোলাপের কাছে থাক তার গন্ধ
আর
ছায়াদুটো সঙ্গ নিক অন্যকারো।
যেখানে শয্যার পাশে রাত গলছে পুরনো মোমের মত আমরা সেই ঘরমুখো ।

কাব্যগ্রন্থ সবুজ নীল লাল জামা’র উৎসর্গ পত্রের কবিতা – সৈয়দ শামসুল হক
যাদু আর কবিতার কিবা পার্থক্য । জামাটার খেলাটার ভাবটাই লক্ষ্য !
সই সে তো সইবার,
বই নয় বইবার,
মইটি তো উঠবারই হবে কার ভাগ্য ? সদ্যই কবি দেবে পদ্যেই সাক্ষ্য ।
সই বই মই– কই পাত্র বা পাত্রী ? মেয়ে দেবে কার ঠেয়ে– ভাবনায় ধাত্রী । ভাষা আছে ভাসবার,
হাসি আছে হাসবার,
ছন্দেরও সহায়তা পাওয়া যায় হাত্-রি জোছনায় তবে ঝুলে পড়ে যাক রাত্রি ।।

কিছু শব্দ উড়ে যায় – সৈয়দ শামসুল হক
কিছু শব্দ উড়ে যায়, কিছু শব্দ ডানা মুড়ে থাকে,
তরল পারার মতো কিছু শব্দ গলে পড়ে যায়।
এমন সে কোন শব্দ নক্ষত্রের মতো ফুটে থাকে_
তুমি কি দেখেছো তাকে হৃদয়েশ্বরের আয়নায়?
দ্যাখোনি যখন কালো অন্ধকার উঠে আসে_ গ্রাসে।
যখন সৌজন্য যায় কবরে মাটি কল্পতায়,
যখন স্তব্ধতা গিলে খেতে থাকে কামুকেরা ত্রাসে,
তখন তাকিয়ে দেখো শুদ্ধতার গভীর ব্যাথায়_
আমার ঠোঁটের থেকে একটি যে শব্দ একদিন
ফুটেছিলো এই ঠোঁটে তোমারই যে দেহস্পর্শ তাপে,
আজ সেই শব্দ দ্যাখো পৃথিবীর বুকে অন্তরীণ_
তবু তারই উচ্চারণে বৃক্ষপাতা বারবার কাঁপে।
পড়ে নিও তুমি তাকে, দেখে নিও আকাশে নয়তো
সেই শব্দ ‘ভালোবাসি’ নক্ষত্রের মতোই হয়তো।।

জীবনের মতো – সৈয়দ শামসুল হক
যে আমাকে ইচ্ছে করেছে,
আমি তার
আর যে আমাকে করেনি,
আমি তারো।
প্রেম একটা জীবনের মতো, জীবন অনেকের।

তার মৃত্যু – সৈয়দ শামসুল হক
ইজদানি মারা গেছে বিমান-পতনে ।
স্পর্ধা ছিল পৃথিবীকে মুঠো করে ধরে
নরোম সুগোল এক কমলালেবুর মতো।
মাথা ভরা ছিল তার বইয়ের মলাট, ট্রাই, নাম
আর নকটান ভিউ, সম্ভবতঃ আলো ছিল
গজ দুই নাইলন সুতো;
মারা গেল অল্প বয়সেই
অনেক ওপর থেকে নানা চাপ হাওয়া সাঁতারিয়ে।
তোমরা এখনো যারা যাবে কোনো চায়ের বিকেলে
সদাশয়া মহিলার কাছে;
–একদিন সমবেত শোক করা গেছে
আজকে আসেনি ওরা?
চায়ে চিনি নেই?
কথা আর হাওয়া এই
র্যাবো কি মাতাল কোনো কিশোর লেখক?
যাই বলো ক কতো সে বড্ড বেয়াড়া। –
জেনে রেখো, ইজাদানি সুস্থ দেহে পেছনেই আছে।

তারপর – সৈয়দ শামসুল হক
কত জল পড়ে গেছে, কত জল সরে গেছে, আরো কত জল মরে যাবে,
আরো কত চর দেখা দেবে, আরো কত বীজ উড়ে সেখানে ছড়াবে,
আরো কত ঘাস, আরো কত শস্য দিয়ে মাঠ ভরে যাবে,
এবং বিশাল কত বৃক্ষ এসে সেই মাঠে আবার দাঁড়াবে,
আরো কত ঘর হয়ে যাবে, সেই ঘরে লোক হয়ে যাবে,
আরো কত লোক এসে করতলচিহ্ন রেখে যাবে
আমার দেয়ালে, আরো কত চেনা লোক পর হয়ে যাবে,
আরো কত দূরে চলে যাবে; তবু তার মতো আর
কে আর আমার কাছে একদা-র মতো এসে ও ভাবে দাঁড়াবে?

তুমিই শুধু তুমি – সৈয়দ শামসুল হক
তোমার দেহে লতিয়ে ওঠা ঘন সবুজ শাড়ি।
কপালে ওই টকটকে লাল টিপ।
আমি কি আর তোমাকে ছেড়ে
কোথাও যেতে পারি?
তুমি আমার পতাকা, আমার কৃষির বদ্বীপ।
করতলের স্বপ্ন-আমন ধানের গন্ধ তুমি
তুমি আমার চিত্রকলার তুলি।
পদ্য লেখার ছন্দ তুমি−সকল শব্দভুমি।
সন্তানের মুখে প্রথম বুলি।
বুকে তোমার দুধের নদী সংখ্যা তেরো শত।
পাহাড় থেকে সমতলে যে নামি−
নতুন চরের মতো তোমার চিবুক জাগ্রত−
তুমি আমার, প্রেমে তোমার আমি।
এমন তুমি রেখেছ ঘিরে−এমন করে সব−
যেদিকে যাই−তুমিই শুধু−তুমি!
অন্ধকারেও নিঃশ্বাসে পাই তোমার অনুভব,
ভোরের প্রথম আলোতেও তো তুমি!
তৈয়বর – সৈয়দ শামসুল হক
তৈয়বর ছাত্র সে এলাকার অত্র ।
বাবার হোটেলে তার অন্নের সত্র ।
মিষ্টির দোকানে সে খোঁজ করে গামছা,
মেছোহাটে খোঁজে বইপত্র,
আদরের আকারে সে দেয় পিঠে খামছা,
উনোনের শিরে ধরে ছত্র।
বিজ্ঞানে নাই ভেদ জল আর বাষ্পে
এই কথা যদি বলি, ওরে শোন ।
তিনবার লাফ দিয়ে এক পেট হাসবে ।
গরু তবে আদতেই বাইসন।
এতটাই পন্ডিত, তবে কেন নিত্য
ঠিক পেতে যায় ভুল ঠিকানায় ?
দিনে দিনে পাগলামি বাড়ে অতিরিক্ত
প্রান্তর পাড়ি দেয় ডিঙা নায় ।
গল্পের গরু তুলে খেজুরের গাছটায়
তৈয়বর লম্বিত ঐ দ্যাখো রাস্তায় !

তোমাকে অভিবাদন, বাংলাদেশ – সৈয়দ শামসুল হক
তোমাকে অভিবাদন, বাংলাদেশ,
তুমি ফিরে এসেছ তোমার মানচিত্রের ভেতরে
যার ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে তেরো শো নদীর ধারা ;
তোমাকে অভিবাদন, বাংলাদেশ,
তুমি ফিরে এসেছ তোমার করতলে পাঙরাটির বুকে
যার ডানা এখন রক্ত আর অশ্রুতে ভেজা ;
তোমাকে অভিবাদন, বাংলাদেশ,
তুমি ফিরে এসেছ তোমার বৃষ্টিভেজা খড়ের কুটিরে
যার ছায়ায় কত দীর্ঘ অপেক্ষায় আছে সন্তান এবং স্বপ্ন ;
তোমাকে অভিবাদন, বাংলাদেশ,
তুমি ফিরে এসেছ তোমার তোমার নৌকার গলুইয়ে
যার গ্রীবা এখন ভবিষ্যতের দিকে কেটে চলেছে স্রোত ;
তোমাকে অভিবাদন, বাংলাদেশ,
তুমি ফিরে এসেছ তোমার মাছধরা জালের ভেতরে
যেখানে লেজে মারছে বাড়ি একটা রুপালী চিতল ;
তোমাকে অভিবাদন, বাংলাদেশ,
তুমি ফিরে এসেছ তোমার হালের লাঙলের ভতরে
যার ফাল এখন চিরে চলেছে পৌষের নবান্নের দিকে ;
তোমাকে অভিবাদন, বাংলাদেশ,
তুমি ফিরে এসেছ তোমার নেহাই ও হাতুড়ির সংঘর্ষের ভতরে
যার একেকটি স্ফুলিঙ্গে এখন আগুন ধরছে অন্ধকারে ;
তোমাকে অভিবাদন, বাংলাদেশ,
তুমি ফিরে এসেছ তোমার কবিতার উচ্চারণে
যার প্রতিটি শব্দ এখন হয়ে উঠছে বল্লমের রুপালী ফলা ;
তোমাকে অভিবাদন, বাংলাদেশ,
তুমি ফিরে এসেছ তোমার দোতারার টান টান তারের ভেতরে
যার প্রতিটি টঙ্কার এখন ইতিহাসকে ধ্বনি করছে ;
তোমাকে অভিবাদন, বাংলাদেশ,
তুমি ফিরে এসেছ তোমার লাল সূর্য্ আঁকা পতাকার ভেতরে
যার আলোয় এখন রঞ্জিত হয়ে উঠছে সাহসী বদ্বীপ ;
তোমাকে অভিবাদন, বাংলাদেশ,
তুমি ফিরে এসেছ তোমার অনাহারী শিশুটির কাছে
যার মুঠোর ভেতরে এখন একটি ধানের বীজ ;
তোমাকে অভিবাদন, বাংলাদেশ,
তুমি ফিরে এসেছ তোমার প্লাবনের পর কোমল পলিমাটিতে
যেখানে এখন অনবরত পড়ছে কোটি কোটি পায়ের ছাপ ।

দরজা খুলে দিলেই দেখবে – সৈয়দ শামসুল হক
চাঁদ উঠেছে ফুল ফুটেছে কোন ক্যাসেটে গান
মধ্যরাতের মাতাল মাস্তান
দরজা ধরে দিচ্ছে ভীষণ টান ;
আমার এখন ভেতরটাতে তিনটে পোকার বাসা-
প্রথম দু’টো নাই শুনলে, শেষটা ভালোবাসা ;
ভালোবাসাই প্রথম সাঁকো, দ্বিতীয় সাঁকো, তৃতীয় চতুর্থ –
দীর্ঘজীবন আসলে তো একটিই মুহূর্ত ;
প্রথম দু’টো তোমার চোখ এবং তোমার মন ;
দরজা খুলে দিলেই দেখবে চৌকাঠে চরণ।
দানপত্র – সৈয়দ শামসুল হক
তোমাকে সাক্ষাৎ জেনে দানপত্রে দিলাম স্বাক্ষর।
নিতান্ত গরীব নই, সঞ্চয় সামান্য নয় এ কয় বৎসরে।
আমার সিন্দুক খুলে দ্যাখো তুমি আছো থরে থরে
তোমার রাজত্বকালে প্রচলিত সোনার মোহর।
উজ্জ্বল উৎকীর্ণ তুমি, সিংহাসন আমার সংগমে,
তোমার বাঁ হাতে আছে তরবারি, দক্ষিণে ঈগল,
বুঝিবা বাতাস বয়, তাতে ওড়ে তোমার আঁচল,
অন্য পিঠে লেখা সন পরিচয় সুতীক্ষ্ণ কলমে।
এখনো ভুলিনি আমি অপেক্ষায় উষর প্রান্তর
কোমল লাঙলে চষে অবিরাম যে শস্য করেছি,
যে শ্রম দিয়েছি আমি বিনিময়ে মজুরি পেয়েছি,
আমাকে দিয়েছ তুমি কবিতার গাঢ় কন্ঠস্বর।
পুত্র নয়, কন্যা নয়, তোমারই এ উত্তরাধিকার,
সকল রাজস্ব জমা, বস্তুত এ অস্তিত্ব আমার।।

নষ্ট – সৈয়দ শামসুল হক
জল নষ্ট
চাঁদ নষ্ট
আরো নষ্ট মেয়ে
ছেলেটির কাছে
কষ্ট পেয়ে ।

পরানের গহীর ভিতর-১ – সৈয়দ শামসুল হক
জামার ভিতর থিকা যাদুমন্ত্রে বারায় ডাহুক,
চুলের ভিতর থিকা আকবর বাদশার মোহর,
মানুষ বেকুব চুপ,হাটবারে সকলে দেখুক
কেমন মোচড় দিয়া টাকা নিয়া যায় বাজিকর ৷
চক্ষের ভিতর থিকা সোহাগের পাখিরে উড়াও,
বুকের ভিতর থিকা পিরীতের পূর্ণিমার চান,
নিজেই তাজ্জব তুমি – একদিকে যাইবার চাও
অথচ আরেক দিকে খুব জোরে দেয় কেউ টান৷
সে তোমার পাওনার এতটুকু পরোয়া করে না,
খেলা যে দেখায় তার দ্যাখানের ইচ্ছায় দেখায়,
ডাহুক উড়ায়া দিয়া তারপর আবার ধরে না,
সোনার মোহর তার পড়া থাকে পথের ধূলায় ৷
এ বড় দারুণ বাজি, তারে কই বড় বাজিকর
যে তার রুমাল নাড়ে পরানের গহীন ভিতর ৷

পরানের গহীন ভিতর-২ – সৈয়দ শামসুল হক
আন্ধার তোরঙ্গে তুমি সারাদিন কর কি তালাশ?
মেঘের ভিতর তুমি দ্যাখ কোন পাখির চক্কর?
এমন সরল পথ তবু ক্যান পাথরে টক্কর?
সোনার সংসার থুয়া পাথারের পরে কর বাস?
কি কামে তোমার মন লাগে না এ বাণিজ্যের হাটে?
তোমার সাক্ষাৎ পাই যেইখানে দারুণ বিরান,
ছায়া দিয়া ঘেরা আছে পরিস্কার তোমার উঠান
অথচ বেবাক দেখি শোয়া আছে মরনের খাটে।
নিঝুম জঙ্গলে তুমি শুনছিলা ধনেশের ডাক?
হঠাৎ আছাড় দিয়া পড়ছিল রূপার বাসন?
জলপির গাছে এক কুড়ালের কোপের মতন
তাই কি তোমার দেহে ল্যাখা তিন বাইন তালাক?
এমন বৃক্ষ কি নাই, যার ডালে নাই কোন পরী?
এমন নদী কি নাই, যার বুকে নাই কোন তরী?

পরানের গহীন ভিতর-৩ – সৈয়দ শামসুল হক
সে কোন বাটিতে কও দিয়াছিলা এমন চুমুক
নীল হয়া গ্যাছে ঠোঁট, হাত পাও শরীল অবশ,
অথচ চাও না তুমি এই ব্যাধি কখনো সারুক।
আমার জানতে সাধ, ছিল কোন পাতার সে রস?
সে পাতা পানের পাতা মানুষের হিয়ার আকার?
নাকি সে আমের পাতা বড় কচি ঠোঁটের মতন?
অথবা বটের পাতা অবিকল মুখের গড়ন?
তুঁতের পাতা কি তয়, বিষনিম, নাকি ধুতুরার?
কতবার গেছি আমি গেরামের শ্যাষ সীমানায়
আদাড় বাদার দিয়া অতিঘোর গহীন ভিতরে,
কত না গাছের পাতা কতবার দিয়াছি জিহ্বায়,
এমন তো পড়ে নাই পানি এই পরানে, শিকড়ে।
তয় কি অচিন বৃক্ষ তুমি সেই ভুবনে আমার,
আমারে দিয়াছো ব্যাধি, নিরাময় অসম্ভব যার?

পরানের গহীন ভিতর-৪ – সৈয়দ শামসুল হক
আমি কার কাছে গিয়া জিগামু সে দুঃখ দ্যায় ক্যান,
ক্যান এত তপ্ত কথা কয়, ক্যান পাশ ফিরা শোয়,
ঘরের বিছান নিয়া ক্যান অন্য ধানখ্যাত রোয়?
অথচ বিয়ার আগে আমি তার আছিলাম ধ্যান।
আছিলাম ঘুমের ভিতরে তার য্যান জলপিপি,
বাঁশির লহরে ডোবা পরানের ঘাসের ভিতরে,
এখন শুকনা পাতা উঠানের পরে খেলা করে,
এখন সংসার ভরা ইন্দুরের বড় বড় ঢিপি।
মানুষ এমন ভাবে বদলায়া যায়, ক্যান যায়?
পুন্নিমার চান হয় অমাবস্যা কিভাবে আবার?
সাধের পিনিস ক্যান রঙচটা রদ্দুরে শুকায়?
সিন্দুরমতির মেলা হয় ক্যান বিরান পাথার?
মানুষ এমন তয়, একবার পাইবার পর
নিতান্ত মাটির মনে হয় তার সোনার মোহর।।

পরানের গহীন ভিতর-৫ – সৈয়দ শামসুল হক
তোমার দ্যাশের দিকে ইস্টিশানে গেলেই তো গাড়ি
সকাল বিকাল আসে, এক দন্ড খাড়ায়া চম্পট,
কত লোক কত কামে দূরে যায়, ফিরা আসে বাড়ি-
আমার আসন নাই, যাওনেরও দারুন সংকট।
আসুম? আসার মতো আমি কোনো ঘর দেখি নাই।
যামু যে? কোথায় যামু, বদলায়া গ্যাছে যে বেবাক।
কেমন তাজ্জব সব পাল্টায়া যায় আমি তাই
দেইখাছি চিরকাল। পরানের ভিতরে সুরাখ-
সেখানে কেবল এক ফরফর শব্দ শোনা যায়,
পাখিরা উড়াল দিয়া গ্যাছে গিয়া, এখন বিরান,
এখন যতই আমি ছড়া দেই কালিজিরা ধান,
সে কি আর আঙিনায় ফিরা আসে? আর কি সে খায়?
সকাল বিকাল গাড়ি, চক্ষু আছে তাই চক্ষে পড়ে;
পলকে পলকে গাড়ি সারাদিন মনের ভিতরে।।

পরানের গহীন ভিতর-৬ – সৈয়দ শামসুল হক
তোমার খামাচির দাগ এখনো কি টকটাকা লাল,
এখনো জ্বলন তার চোৎরার পাতার লাহান।
শয়তান, দ্যাখো না করছ কি তুমি কি সোন্দর গাল,
না হয় দুপুর বেলা একবার দিছিলাম টান?
না হয় উঠানে ছিল লোকজন কামের মানুষ,
চুলায় আছিল ভাত, পোলাপান পিছের বাগানে,
তোমারে পরান দিছি, তাই বইলা দেই নাই হুঁশ,
আমি তো তোমারে নিতে চাই নাই ঘরের বিছানে।
হ, জানি নিজের কাছে কোনো কথা থাকে না গোপন।
দিনের দুফুর বেলা যেই তুমি আসছিলা ঘরে
আতখা এমন মনে হইছিল- আন্ধার যেমন,
আতখা এমন ছায়া সোহাগের আর্শির ভিতরে।
আবার ডাকলে পরে কিছুতেই স্বীকার হমু না।
বুকের পাষাণ নিয়া দিমু ডুব শীতল যমুনা।।

পরানের গহীন ভিতর-৭ – সৈয়দ শামসুল হক
নদীর কিনারে গিয়া দেখি নাও নিয়া গ্যাছে কেউ
অথচ এই তো বান্ধা আছিল সে বিকাল বেলায়।
আমার অস্থির করে বুঝি না কে এমন খেলায়,
আমার বেবাক নিয়া শান্তি নাই, পাচে পাছে ফেউ।
পানির ভিতরে য্যান ঘুন্নি দিয়া খিলখিল হাসে
যত চোর যুবতীরা, গ্যারামের শ্যাষ সীমানায়
বটের বৈরাগী চুল, ম্যাঘে চিল হারায় বারায়,
বুকের ভিতরে শিস দিয়া সন্ধা হাঁটে আশেপাশে।
এখন কোথায় যাই, এইখানে বড় সুনসান,
মানুষের দুঃখ আছে, জগতের আছে কিনা জানি না-
জগৎ এমনভাবে হয়া যায় হঠাৎ অচিনা।
মনে হয় আমার থিকাও একা বৃক্ষের পরান,
আমার থিকাও দুঃখী যমুনার নদীর কিনার।
আমার তো গ্যাছে এক, কত কোটি লক্ষ গ্যাছে তার।।

পরানের গহীন ভিতর-৮ – সৈয়দ শামসুল হক
আমারে তলব দিও দ্যাখো যদি দুঃখের কাফন
তোমারে পিন্ধায়া কেউ অন্যখানে যাইবার চায়
মানুষ কি জানে ক্যান মোচড়ায় মানুষের মন,
অহেতুক দুঃখ দিয়া কেউ ক্যান এত সুখ পায়?
নদীরে জীবন কই, সেই নদী জল্লাদের মতো
ক্যান শস্য বাড়িঘর জননীর শিশুরে ডুবায়?
যে তারে পরান কই, সেই ব্যাক্তি পাইকের মতো
আমার উঠানে ক্যান নিলামের ঢোলে বাড়ি দ্যায়?
যে পারে উত্তর দিতে তার খোঁজে দিছি এ জীবন,
দ্যাখা তার পাই নাই, জানা নাই কি এর উত্তর।
জানে কেউ? যে তুমি আমার সুখ, তুমিই কি পারো
আমারে না দুঃখ দিয়া? একবার দেখি না কেমন?
কেমন না যায়া তুমি পারো দেখি অপরের ঘর?-
অপর সন্ধান করে চিরকাল অন্য ঘর কারো।।

পরানের গহীন ভিতর-৯ – সৈয়দ শামসুল হক
একবার চাই এক চিক্কুর দিবার, দিমু তয়?
জিগাই কিসের সুখে দুঃখ নিয়া তুমি কর ঘর?
আঙিনার পাড়ে ফুলগাছ দিলে কি সোন্দর হয়,
দুঃখের কুসুম ঘিরা থাকে যার, জীয়ন্তে কবর।
পাথারে বৃক্ষের তরে ঘন ছায়া জুড়ায় পরান,
গাঙের ভিতরে মাছ সারাদিন সাঁতরায় সুখে,
বাসরের পরে ছায়া য্যান দেহে গোক্ষুর জড়ান,
উদাস সংসারে ব্যথা সারাদিন ঘাই দেয় বুকে।
তবুও সংসার নিয়া তারে নিয়া তুমি কি পাগল,
তোলো লালশাক মাঠে, ফসফস কোটো পুঁটিমাছ,
সাধের ব্যাঞ্জন করো, রান্ধো ক্ষীর পুড়ায়া আঞ্চল,
বিকাল বেলায় কর কুঙ্কুমের ফোঁটা দিয়া সাজ।
ইচ্ছা করে টান দিয়া নিয়া যাই তোমারে রান্ধুনি,
তোমার সুতায় আমি একখান নীল শাড়ি বুনি।।

পরানের গহীন ভিতর-১০ – সৈয়দ শামসুল হক
কে য্যান কানতে আছে- তার শব্দ পাওয়া যায় কানে,
নদীও শুকায়া যায়, আকালের বাতাস ফোঁপায়,
মানুষেরা বাড়িঘর বানায় না আর এই খানে,
গোক্ষুর লতায়া ওঠে যুবতীর চুলের খোঁপায়।
বুকের ভিতর থিকা লাফ দিয়া ওঠে যে চিক্কুর,
আমি তার সাথে দেই শিমুলের ফুলের তুলনা,
নিথর দুফুর বেলা, মরা পাখি, রবি কি নিষ্ঠুর,
আগুন লাগায়া দিবে, হবে খাক, তারি এ সূচনা।
অথচ আমারে কও একদিন এরও শ্যাষ আছে-
আষাঢ়ের পুন্নিমার আশা আর এ দ্যাশে করি না,
চক্ষু যে খাবলা দিয়া খায় সেই পাখি বসা গাছে,
অথচ খাড়ায়া থাকি, এক পাও কোথাও নড়ি না।
সকল কলস আমি কালঘাটে শূণ্য দেইখাছি,
তারে না দেইখাছি তাই দ্যাখনের চক্ষু দিতে রাজি।।

পরানের গহীন ভিতর-১১ – সৈয়দ শামসুল হক
কি আছে তোমার দ্যাশে? নদী আছে? আছে নাকি ঘর?
ঘরের ভিতরে আছে পরানের নিকটে যে থাকে?
উত্তর সিথানে গাছ, সেই গাছে পাখির কোটর
আছে নাকি? পাখিরা কি মানুষের গলা নিয়া ডাকে?
যখন তোমার দ্যাখা জানা নাই পাবো কি পাবো না,
যখন গাছের তলে এই দেহ দিবে কালঘুম,
যথন ফুরায়া যাবে জীবনের নীল শাড়ি-বোনা
তখন কি তারা সব কয়া দিবে আগাম-নিগুম?
আমার তো দ্যাশ নাই, নদী নাই, ঘর নাই, লোক,
আমার বিছানে নাই সোহাগের তাতের চাদর,
আমার বেড়ায় খালি ইন্দুরের বড় বড় ফোক,
আমার বেবাক ফুল কাফনের ইরানী আতর।
তোমার কি সাধ্য আছে নিয়া যাও এইখান থিকা,
আমার জীবন নিয়া করো তুমি সাতনরী ছিকা।

পরানের গহীন ভিতর-১২ – সৈয়দ শামসুল হক
উঠানের সেই দিকে আন্ধারের ইয়া লম্বা লাশ,
শিমের মাচার নিচে জোছনার সাপের ছলম,
পরীরা সন্ধান করে যুবতীর ফুলের কলম,
তারার ভিতরে এক ধুনকার ধুনায় কাপাশ,
আকাশে দোলায় কার বিবাহের রুপার বাসন,
গাবের বাবরি চুল আলখেল্লা পরা বয়াতির,
গাভির ওলান দিয়া ক্ষীণ ধারে পড়তাছে ক্ষীর,
দুই গাঙ্গ এক হয়া যাইতাছে- কান্দন, হাসন।
একবার আসবা না?- তোমারেও ডাক দিতে আছে
যে তুমি দুঃখের দিকে একা একা যোজন গিয়াছো?
একবার দেখবা না তোমারেও ডাক দিতে আছে
যে তুমি আঘাত নিয়া সারাদিন কি তফাত আছো?
যে নাই সে নাই সই, তাই সই, যা আছে তা আছে,
এমন পুন্নিমা আইজ, কোন দুঃখে দুয়ার দিয়াছো?

প্রথম বসতি ১ – সৈয়দ শামসুল হক
এখন আমার কাছে এ শহর বড় বেশী ধূসর
ধূসর বলে মনে হয়।
কন্ঠস্বরে আকাশের নখ ;
মুক্তোর ভেতর দিয়ে পথ – সেই পথে –
রূপদক্ষ যুবতীরা চলে গেছে যে যার পছন্দমতো রমিত বাড়ীতে ;
এ শহরে আজকাল
অধিকাংশ যুবকের চোখে কালো কাচ,
নষ্ট মুক্তিযুদ্ধের ফ্যাশানে
এখনো দ্রষ্টব্য দাড়ি,
অতি খর্ব ভ্রমণের ঘ্রাণ পিতাদের জামায় এখন।
আমি যাকে চিনতাম
যার বুক ভেঙ্গে আমি পুরানা পল্টন ঘিরে হাঁটতাম দুপুর গভীরে
প্রথম প্রেমের মতো যার গলা হঠাৎ জড়িয়ে
কবিতা লেখার হাতে
এই দুটো হাতে –
দুঃখসুখ মেশানো দু’চোখে আমি কাঁদতাম
আমার শহর সেই ডুবে গেছে কোন কালীদহে ।
হিন্তাল কাঠের লাঠি থেকে থেকে এখন আমার
শহরের মাথা দিয়ে বিদ্যুতের দ্রুততায় উড়ে যায়।
নিঃশব্দে সুনীলে।

বলেছি তাকে, নিভৃত নীল পদ্ম – সৈয়দ শামসুল হক
আমার সাথে কথা বলো তুমি নদীর মতো, আমার শরীরে
গাছের মতো বড় হও তুমি, আমার আঙুলে তুমি হাত রাখো
বাতাসের মতো, আমার হৃদয়ে তুমি জলপান করতে আসো
বাঘিনীর মতো, আমার চিন্তায় তুমি উড়ন্ত রূপালী হও
বিমানের মতো, আমার স্বপ্নের মধ্যে সুগন্ধ খাদ্যের মতো
বিস্তৃত হও, আমার দুঃখের স্রোতে ভাসো তুমি নৌকোর
মতো, আমার সুখের নীলে জ্বলো তুমি সূর্যের মতো, আমার
বিশাল ক্ষতে সাহসী মাংসের মতো কোষে কোষে গড়ে ওঠো
তুমি, আমার পরাজয়ে উত্তোলিত হও তুমি ছিন্ন পতাকার
মতো, আমার মৃত্যুতে তুমি শোকের পেরেক হয়ে বিদ্ধ হও
যিসাসের দেহে, আমার জন্মের দিনে বিপুল বিভায় তুমি
ফেটে পড়ো সৌর-মহামন্ডলের মতো ।।

মিষ্টি মরণ – সৈয়দ শামসুল হক
চমকায় চমচম! সন্দেশ শংকায়!
ওই বুঝি ওঠে রোল মরণের ডংকায়!
গণেশটা গপ্ করে চমচম গিলে খায়।
সন্দেশে সোলেমান কুচ্ করে দংশায়।
চমচম পেটে যায়
সন্দেশ খুঁটে খায়
মিষ্টির সৃষ্টি এ দ্রুত যায় গোল্লায়।
অশ্রুর সমাবেশ রসে রসগোল্লায়!

সবার দেশ কবিতা – সৈয়দ শামসুল হক
বিচার যদি করতে চাও
ঝড়তি এবং পড়তি কে?
খবর তবে দিতেই হলো
বিনয় চক্রবর্তীকে ।
লোকটা বুঝি সংখ্যালঘু ?
বিদ্যেতে সে লঘু নয় ।
সার্টিফিকেট দিচ্ছি লিখে ।
মনঃপূত তবুও নয় ?
বেশ তো ডাকো সাইমনকে_
চলন বলন মিষ্ট,
পালন করেন বলেন যাহা
প্রভু যিশু খ্রিষ্ট ।
তাকেও না ? তাকেও না !
_তোমরা তোলো ধুয়া ।
সর্বশেষ ডাকছি তবে
সরোজ বড়ুয়া ।
নাড়ছ মাথা ঘনঘন,
বন্ধ করে রাখছ কান ।
খবর যদি দিতেই হয়
ডাকো তবে মুসলমান ?
কিন্তু এই দেশটা তো আর
শুধু মুসলমানের নয়_
এমনকি সে খ্রিষ্টানের,
হিন্দুর বা বৌদ্ধের নয় ।
মানুষ এই পরিচয়েই
আমরা সব বাঙালি তো !
কেউ এখানে কক্ষোনো নয়
বাড়তি এবং পড়তিও ।।

কবি সৈয়দ শামসুল হক এর গল্পঃ
![কবি সৈয়দ শামসুল হক এর কবিতা 38 সৈয়দ শামসুল হক [ Syed Shamsul Haque ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/05/সৈয়দ-শামসুল-হক-Syed-Shamsul-Haque-74-300x172.jpg)
তাস – সৈয়দ শামসুল হক
দুখানা দশ হাত বারো হাত কামরার সামনে একচিলতে বারান্দা আর বিশ্রীরকমের ছোট এক দরজা এক জানালা নিয়ে রান্নাঘর । রান্নাঘর বলতেও ওই, ভাঁড়ার বলতেও ওই । শোবার ঘরদুটো তাই তৈজসপত্র এটা-সেটায় এত গাদাগাদি যে নিশ্বাস ফেলবার জায়গাটুকু খালি নেই।
পথ থেকে ডানধারের কামরায় আবার পার্টিশন দিয়ে একটা বসবার ঘরের মতো করা হয়েছে। বারান্দার নিচে হাত-তিনেক ঢালু জায়গা, তারও অর্ধেক আবার কুয়োয় আটকানো। বারান্দা থেকে দাঁড়িয়ে কখনও আকাশ দেখা যায় । জানালা দিয়ে মুখ ফেরালে পথটুকু। বাসা বলতে তো এই ৷
ঘষে-মেজে সাফ-সুতরো করবার কোনো কথাই ওঠে না। তবুও কি মা দিনরাত কম চেষ্টা করেন একটু ছিমছাম করে তোলার জন্য। কিন্তু হলে হবে কী, আশপাশের আবহাওয়াই এমনিতর যে, সব সময়েই মনে হয় বাসাটা যেন মুখ ভার করে রয়েছে। এত করেও কিছু হয় না।
তবুও আজ মা-র কেমন ছায়া-ছায়া অন্ধকার বলে সব মনে হল। মনে হল কে যেন পুরু করে সারা বাসায় মেখে দিয়েছে গা-ছমছম-করা নির্জনতা। অথচ সকলেই তো রয়েছে বাসায়। সন্ধে হয়েছে একটু আগেই । কিন্তু কেমন যেন পুরু অন্ধকার করে এসেছে চারদিক এখনই।
বারান্দায় চালভরা কুলো হাতে করে মা ভাবলেন, সালেহা রান্নাঘরে, বুলু-টুনু-বেবি ওই তো বাঁ-ধারের ঘরেই তো রয়েছে, হয়তে পড়ছে। আর খোকন–। তবু মা’র যেন বড্ড একলা মনে হল। মনে হল, অন্ধকার কোনো এক পাথারে তিনি একা । নিঃসঙ্গ । কেউ নেই !
পা দুটে মা-র থরথর করে কেঁপে উঠল। হয়তো দুর্বলতায় । তাড়াতাড়ি তিনি কুলো হাতে করে বসে পড়লেন। তারপর আনমনে যেটুকু আলো এ-ঘর ও-ঘর থেকে বারান্দার অন্ধকার মুছে দিচ্ছিল তাতেই তিনি চাল বাছতে বসলেন।
বারান্দার উত্তরকোণে দাঁড়িয়ে বাঁ-ধারের কামরার দেয়ালঘড়িটা স্পষ্ট দেখা যায় দরজার ফাঁক দিয়ে । কেমন বড় আর অদ্ভুত এই পুরনো ঘড়িটা। সেকেন্ড থেকে শুরু করে মিনিট থেকে ঘণ্টা অবধি, এমনকি মাসের আজ কত তারিখ, সব তুমি ঘড়ি দেখে বলে দিতে পারবে। একটুও কষ্ট হবে না।
সেই কবে যে ওটা কেনা হয়েছিল তা মা নিজেই বলতে পারবেন না । এতদিন ওটা দেশের বাড়িতে বড়ঘরে, পেছনের দেয়ালে,খুঁটিতে ঝোলানো ছিল । খোকন যখন শহরে চাকরি পেল, তিনিই তো তখন ওটা ছেলেকে বলে এখানে নিয়ে এসেছিলেন। তারপর থেকে সেই এক জায়গাতেই ঘড়িটা রয়েছে। একটুও নড়চড় হয়নি।
বেশ মনে পড়ে তার, বিয়ের পর পাঁচগাঁ থেকে যখন কদমতলি শ্বশুরবাড়িতে এলেন তিনি স্বামীর হাত ধরে, যখন উৎসবের অত কোলাহল আর নিজের নিদারুণ লজ্জায় বুকের রক্ত হিম হয়ে যাচ্ছিল, তখনও তিনি স্পষ্ট শুনতে পেয়েছিলেন, বড়ঘর থেকে অদ্ভুত গম্ভীর সুরে ঢং ঢং করে পাঁচটা বাজল। এক দুই তিন করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে শুনেছিলেন তিনি।
তারপর রাতে শোবার পালা। কারা যেন হাত ধরে তাকে টেনে বড়ঘবে নিয়ে এসে কানে কানে বলেছিল কী যেন ভালো করে মনে নেই। এ-কথা সে-কথায় স্বামী হাত ধরে আরও কাছে এনে মিষ্টি গলায় জিগ্যেস করেছিলেন, ঘড়ি দেখতে জানো তুমি?
এখনও তিনি চোখের সামনে দেখতে পান স্বামীর বাঁ-হাত ঘড়িটার দিকে তুলে ধরা। তর্জনীর দৃঢ় সৌষ্ঠব আজও তিনি ভোলেননি । তারপর হাত ধরে ধরে কেমন তৃপ্তস্বরে স্বামী তাকে শিখিয়েছিলেন ঘড়ি-দেখা।
আর ওই-যে পেতল-রঙ সরু কাঁটা দেখছ, ওটা মাসের আজ কত তারিখ তা বলে দেয়।
আশ্চর্য, হুবহু মনে পড়ে তার। একটা হারিকেনই বুঝি মৃদু আলোতে ঘর ভরে দিয়েছিল সে-রাতে।
সেই থেকে এইতো সেদিন অবধি কতবার যে ঘড়ি দেখে সময় জেনেছেন, তারিখ জেনেছেন, তার তো আর লেখাজোখা নেই ।
নির্জন দুপুরবেলায় গোটা পৃথিবী যখন অলস হয়ে পড়ে, যখন বাসায় কেউ থাকে না, তখন বিধবা মেয়ে সালেহার পাশে বসে এটা-সেটা কথা কইতে কইতে তিনি পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে ঘড়িটার দিকে তাকান। চোখ ফিরিয়ে আনতে পারেন না।
স্বামীর স্পর্শ যেন এখনও লেগে রয়েছে ঘড়িটার গায়ে। এখনও ঘড়িটা যখন ঢং ঢং করে বেজে ওঠে তখন মাঝে মাঝে কিশোরীবয়সের সেই লজ্জা আর চঞ্চলতা ভিড় করে এসে তাকে বিমূঢ় করে দেয় ।
ঘড়িটার চারধারের ফ্রেম ঘুণে খেয়ে ফেলেছে আর চকচকে কালো বার্নিশ তো কবেই উঠে গেছে, তার খোঁজ কে রাখে।
স্বামী মারা গেছেন আজ প্রায় পাঁচ বছর। এরপর থেকে প্রত্যেক সপ্তাহে তিনি নিজহাতে দম দিয়েছেন ঘড়িতে। আর খোকনের সাথে শহরে যখন এলেন, তখন তিনি ছাড়া আর কেউ কি ঘড়িটার দিকে এতটুকু নজরও দিয়েছিল! ক’টা বাজে? খোকন ফস করে বাঁ হাত ওঠায় । হাতঘড়িগুলো দুচোখে দেখতে পারেন না তিনি।
এতবড় একটা ঘড়ি থাকতে ঘরের মধ্যিখানে খোকনের কাছে সবাই সময় জানতে হুড়মুড় করে পড়ে কেন, মা ভেবে পান না। অবশেষে কী করে যে নিজের ওপরেই দুঃখ হয় তা তিনি নিজেই বুঝতে পারেন না।
জানালাটা খুলে দাঁড়ালে এবড়োথেবড়ো খোয়া-ওঠা পথ চোখে পড়ে। কেমন একে-বেঁকে মুদি দোকানের সমুখ দিয়ে, কয়েকটা হালকা একতলা বাড়িতে ডানহাতিতে ফেলে তারপর মোড় নিয়ে কোন সড়কে উঠেছে, কে জানে?
জানালার ধারে কতদিন পথ দেখতে দেখতে মা ভেবেছেন— রাজার মতো লোক ছিলেন খোকনের বাবা, দুধের বাটিতে হাত ডুবিয়ে ননী দেখে তবেই না একচুমুকে সবটুকু খেয়ে ফেলতেন। সে কথা তো আজও ভোলেননি; এলোমেলো খাপছাড়া সব স্মৃতি মা-র মনে এসে ভিড় করে।
অসহায়ের মতো তিনি ভাবেন, বাবাকে খোকন ওরা কেউ ভালোবাসে না, একটু ও শ্রদ্ধা করে না । নইলে আজ কয়েক সপ্তাহ ধরে, মা-র জীবনে এই প্রথম, ঘড়িটা বেঠিক চলছে। ভুল সময়ে বেজে ওঠে ঢং ঢং । অথচ খোকনের এতটুকু ভ্রুক্ষেপ নেই। কতবার বলে বলে হদ্দ হয়ে গেলেন, কই খোকন তো কোনো গরজ দেখায়নি।
ওরা কি জানে, ঘড়িটা বেঠিক চললে, অন্ধকারে পথ চলার মতো তারিখের কাঁটা এলোপাতাড়ি চললে, তার মন কেমন করে ওঠে। কেমন এক দম-আটকানো কান্না তার গলার কাছে এসে পাথরের মতো আটকে রয়েছে, ওরা তার কী জানবে? ভারি কান্না পায় মা-র। হয়তো তিনি কাঁদেনও। নইলে হঠাৎ কেন তিনি আঁচল খুলে চোখ মুছতে যাবেন?
এটা হয়তো মা-র বাড়াবাড়ি। স্বামীকে তিনি ভালোবেসেছিলেন সত্যিকারের । দেবতার মতো তাঁকে করেছেন শ্রদ্ধা। আর দেবদাসীর মতো করেছেন সেবা ! তাই না স্বামীর ব্যক্তিত্বের প্রভাব আজ অবধি তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে নিবিড় ছায়ার মতো।
কেমন যেন তার ভালো লাগে ভাবতে, সারাটা জীবন ভেবেছেনও– স্বামীকে তিনি ছাড়া আর কেউ আপন করে দেখেনি। তাই কেউ যদি ওঁকে আপনার বলে দাবি করে, শ্রদ্ধা জানায় তাহলে তার চোখ অবিশ্বাসে ভরে ওঠে ! তিনি ভাবেন এটা ওদের কর্তব্য, তাই করে গেল ।
তাই আজও স্বামীর স্মৃতিকে তিনি একলাই একটু-একটু করে সম্পূর্ণ উপভোগ করতে চান। কিন্তু লজ্জা এসে দেখা দেয়, দ্বিধা জাগে। ভয় হয়, পাছে কেউ জেনে ফেলে। তাই ভেতরে ভেতরে গুমরে মরেন তিনি। ভালো করে খোকনকে বলতে পারেন না, আদেশের কথা তোলাই থাক, অনুরোধ করতেও কেমন সঙ্কোচ দেখা দেয় । কিন্তু এ তিনি কেমন কেমন করে ভাবেন যে, তার নিজের ছেলেরা অবধি ওঁকে ঠিকমতো শ্রদ্ধা করে না, যতটুকু করে তাও হয়তো লৌকিকতা। এটা হয়তো মা-র বাড়াবাড়ি ।
কেন, আজকেই তো সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই খোকন বলেছে, মা, আজ মাইনে পাবার তারিখ । আজকেই ভালো মেকার নিয়ে আসব’খন দেওয়ালঘড়িটা মেরামত করাতে। তারপর একটু থেমে চোখ তুলে বলেছিল, দিন মাত্র ঘড়িটা বেতালা হয়েছে আর দেখ দিকি।
কী মনে করে মা ফস করে বলে বসেছিলেন, ‘কিন্তু অল্প’র জন্য কি এতদিনের পুরনো ঘড়িটা নষ্ট হয়ে যাবে?’
সহসা তাঁর দৃষ্টি শঙ্কাতুর হয়ে উঠেছিল গভীরভাবে। কিন্তু কী ভাগ্যি, খোকনের চোখে পড়েনি। খোকন বলেছিল, ধেৎ, তুমিও যেমন, কালকের সকালের ভেতরই দেখবে কেমন নতুন হয়ে গেছে ঘড়িটা। ভাবছি একপোঁচ রঙ করাব আবার ফ্রেমে। আচ্ছা মা, কী রঙ করলে ভালো মানাবে বলো তো?
ঘুণেধরা কাঠে আবার রঙ দিয়ে শুধু শুধু—তার চেয়ে আগে ঠিক হােক তো ঘড়িটা।
খোকন সহসা মিষ্টি হাসে। ঠিক হয়েছে, মেহগনি রঙ করাব। গাঢ় মেহগনিতে পুরনো জিনিস ভারি মানায় কিন্তু।
আগে ঘড়িটাতো ঠিক কর্, তারপর ওসব দেখা যাবে।
খোকন অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে বিছানায় শুয়ে। মা শুধুশুধু দাঁড়িয়ে থেকে কী করবেন ভেবে পেলেন না।
মা, চা হল?
একটা ছুতো পেয়ে মা চঞ্চল হয়ে ওঠেন।
সালেহা মুড়ি তেল মাখাচ্ছে। আমি নিয়ে আসছি, তুই উঠে বস্ । খেতে খেতে চা হয়ে যাবে’খন।
সালেহার দিকে তাকিয়ে চায়ে চুমুক দিতে দিতে খোকন ভাবে, সালেহার বিয়ে দিয়েছিলেন বাবা বড় আদর করে। অনেক খরচ করে। কিন্তু টেকেনি সে সুখের সংসার। খোকনের চাকরি পাবার কিছুদিন বাদেই নিরাভরণ সালেহা এসে পা দিয়েছিল এই বাসায়। আর তার চোখ পানিতে ভরে উঠেছিল।
বাবা বেঁচে থাকলে দুঃখ পেতেন অনেক। হঠাৎ তার মনে পড়ল মাসখানেক আগে ও একখানা চুলপেড়ে ধুতি চেয়েছিল তার কাছে । মিহি জমিন হলে ভালো হয়, কত সময়ে লাগে, এমনি কী কী যেন বলেছিল সালেহা। কথাটা একেবারেই ভুলে গিয়েছিল সে। জিগ্যেস করল, আচ্ছা সালেহা, কাপড় চেয়েছিলি না তুই?
সালেহা কোনো উত্তর করে না।
কাপড় চাইতেও তোর লজ্জা? এক্কেবারে ছেলেমানুষ তুই । যা দরকার চাইবি, চাইবি বৈকি।
খুব বেশি দরকার নেই আমার।
মিছে কথা। আজকেই আনব’খন । দেখিস তুই ।
দাঁড়াও– বেবির পড়া বলে দিয়ে আসি।
হুঁ।
পড়তে জানে না মোটে, তুমি ফোরে ভর্তি করে দিয়েছ, এখন ভুগছে দেখছ তো।
সালেহা কথা বলতে বলতে বাঁদিকের কামরায় ঢােকে। এ-ঘরে বসেও স্পষ্ট বুঝতে পারে সে, সালেহা চুপ করে গিয়ে জানালার ধারে দাঁড়াল। জানালাটা দিয়ে পথ দেখা যায়।
কেমন এক অদ্ভুত মানসিকতায় মা ভাবতে শুরু করেন, কী বা প্রয়োজন ছিল খোকনের আপিস থেকে ফিরবার পথে রিকশা করবার । কেন, অন্যদিনের মতো বাসে করে এলে কি তার শাস্ত্র অশুদ্ধ হত? মা ঠিক জানেন না রিকশার ভাড়া আপিস থেকে কত, কিন্তু এটা তো ঠিক জানেন মিছেমিছে কতগুলো পয়সা খোকন অপব্যয় করল ।
কিন্তু খোকন যখন সন্ধের একটু আগে বাসার দরজায় রিকশা থেকে নামল তখনও তো মা-র মন এই সামান্য অপব্যয়ে বিচলিত হয়ে ওঠেনি।
খোকনের এটা অনেক দিনের অভ্যাস । মাইনে পেয়ে ফিরতি পথে কোনোদিন বাসে কিংবা হেঁটে ফেরেনি । পুরানা পল্টনের মোড় থেকে একটা রিকশা করে ফেরা অন্তত সেদিনের জন্য প্রয়োজন বলে মনে করেছে।
মাইনে নিয়ে সে আজ একটু সকাল সকালেই আপিস থেকে বেরিয়েছিল। পথে এটা সেটা কিনে যখন বাসায় ফিরল তখন সন্ধে হতে আর বড়বেশি বাকি নেই। মা এসে দরজা খুলে দিলেন।
ঘরে চৌকির উপর বসল খোকন। বুলু, টুনু, বেবি আর সালেহা কাছাকাছি ভিড় করে এসে দাঁড়ায়। মা একটু দূরেই দাঁড়িয়ে রইলেন।
সালেহা, এই নে তোর মিহি জমিন কাপড়। দ্যাখ তো কেমন হয়েছে? খোকন কাগজের মোড়ক খুলে কাপড়টা ওর দিকে ছুড়ে দিল। দাম যদিও নিয়েছে পনেরো টাকা আট আনা, কিন্তু জিনিস ভালো। আর মা, এই নাও তোমারও কাপড়। তুমি তো আর কোনোদিনই চাইবে না কিছু। নাও।
মা ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে কাপড়খানা হাতে তুলে নেন। কিন্তু ক্রমেই তিনি অধৈর্য হয়ে পড়ছেন, আজকেই তো খোকনের কথা ছিল ঘড়িওয়ালাকে নিয়ে আসবার। কই খোকন তো কোনো কথাই বলছে না সে নিয়ে। ভাবলেন তিনি একবার জিগ্যেস করবেন, পরমুহূর্তেই আবার সেই লজ্জা এসে তাঁকে ঘিরে ধরল ।
বুলু, টুনু, বেবির জন্য খাতা কলম মার্বেল এটা-সেটা আরো কত কী কিনেছে ও। হাতে ধরে তুলে দিচ্ছে। তবুও এক অদ্ভুত অতৃপ্তি মাকে ক্রমে আচ্ছন্ন করে ফেলল।
বুলু, এই দ্বিতীয়বার তোমায় কলম কিনে দিলাম, এবারও যদি হারাও তাহলে আর রক্ষে নেই । যাও সন্ধে হয়ে গেছে পড়তে বসো গিয়ে।
ওরা সবাই চলে গেল । মা-ও নিঃশব্দে পিছনে বেরিয়ে এলেন।
তারপর মা অস্থির অশান্ত হৃদয়ে বারকয়েক উঠানে পায়চারি করলেন। দু-একটা তারা ফুটে উঠছে আকাশে, তাকিয়ে দেখলেন খানিক। অবশেষে যখন মোড়ের মসজিদ থেকে বুড়ো মোয়াজ্জিনের আজান ভেসে এল তার কানে তখন চমক ভাঙল। কুয়ার পাড় থেকে ওজু করে এসে বারান্দার এককোণে পাটি বিছিয়ে মনকে শান্ত সংযত করে বসলেন মাগরিবের নামাজ আদায় করতে।
খোকন মুগ্ধ হয়ে গেল । মায়ের এমন মূর্তি সে কোনোদিন দেখছে বলে মনে পড়ল না তার! কী সৌম্য সংযত মা-র মুখখানি। আর কী তন্ময়তা তার প্রতিটি মুহূর্তে। খোকন বিস্মিত হয়ে গেল । মাকে খুঁজতে এসে সে দেখল মা নামাজ আদায় করছেন । হাতমুখ ধুয়ে সে পথের দিকের দরজা খুলে চেয়ারে এলিয়ে পড়ল ।
পেছনে ফিরে থেকেও খোকন স্পষ্ট বুঝতে পারল, মা হাঁটছেন বারান্দায় । ডাকল, মা ।
মা এসে ঘরে ঢুকলেন। খোকন পেছন ফিরে মা-র দিকে তাকিয়ে একটু হেসে উঠে দাঁড়াল। শার্টের পকেট থেকে টাকাগুলো বের করল। তারপর এক দুই করে দশ টাকার নোট দশখানা গুনে মা-র হাতে তুলে দিয়ে বলল, এই নাও এ-মাসের বাজারের টাকা।
ওতেই হবে বোধ হয়, তাই না? ওদের ইস্কুলের বেতন কালকে আমি দিয়ে দেব’খন। আর শোনো, বাড়িওয়ালা এলে সন্ধের পর আমার সাথে দেখা করতে বােলো।
মা টাকাগুলো হাতে নিয়ে কী যেন বলতে যাচ্ছিলেন, এমন সময়, নিতান্তই অপ্রত্যাশিতভাবে পাশের ঘরে দেয়ালঘড়িটা বােকার মতো ঢং ঢং করে তিনটে বেজে চুপ হয়ে গেল। মা চকিতে পাশের কামরার দিকে তাকালেন । তিনিও আশা করেননি, ঘড়িটা এমন বেমওকা বেজে উঠবে । খোকন যেন ঘড়ির ঘন্টার প্রতিধ্বনি করেই বলল, ওই যাহ্। দেখেছ, একেবারে ভুলে গেছি।
আসবার সময়, সেই কোন সকাল থেকে মনে করে রেখেছি, চাঁদ মিয়া মেকারকে ধরে আনব ঘড়িটা নিয়ে যেতে— দ্যাখো তো কাণ্ড! এমন ভুল মানুষের হয় কখনো?
মা অস্ফুটস্বর উচ্চারণ করলেন, এমন ভুল মানুষের হয় কখনো! কিন্তু শোনা গেল না। কী আশ্চর্য, একটু পরেই ছোট্ট হাসি হেসে নোট কখানা নাড়তে নাড়তে বললেন, সন্ধেবেলায় না-ডেকে ভালোই হল, কাল সকালেই সব বুঝেসুঝে নিতে পারবে। কালকে এলেও হবে ।
সেই ভালো।
খোকন একটু উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। কিন্তু মিইয়ে পড়েন মা। চুপসে যান তিনি একেবারেই। তিনি আশা করেননি খোকন এত ছোট্ট জবাবে দায়মুক্ত হবে। ভেবেছিলেন সে তার কথায় প্রতিবাদ না হােক অমনি একটা কিছু করবে ! তাই খোকনের ওই উত্তরে তিনি মুষড়ে পড়লেন বৈকি।
মা ভেবে কোনো থৈ পান না, খোকন এত জরুরি কথাটা ভুলে গেল কী করে? কী করে ভুলতে পারে সে? এত আজেবাজে জিনিস কিনতে তো কই তার এতটুকু ভুলে যাবার কোনো প্রশ্ন ওঠেনি। বরঞ্চ না-চাইতেই তো ও সবকিছু নিয়ে এসেছে। নাকি খোকন খরচের ভয় করছে? হবেও বা।
হয়তো তার মন সেকেলে একটা জবুথবু দেয়ালঘড়ির পেছনে খরচ করতে সায় দেয়নি। কিন্তু রিকশা করে খোকন যে খরচ করল সেটার সার্থকতাই বা কোথায়?
মাসের তিরিশ দিন বাসে এসে একদিন রিকশা করলে কীইবা এমন লাভ? পরমুহূর্তেই ভাবেন, ক্ষতিটাই বা কী? এতগুলো টাকা ও রোজগার করে সংসারে ঢালছে, দুটো পয়সা নিজের জন্য ব্যয় করলে কীইবা এমন দোষের হয়? আনমনে চৌকির পাশে খোকনের ছোট্ট টেবিলটায় মা হাত বুলোতে থাকেন। এসময় কিসে যেন হাত ঠেকতেই তিনি চমকে ওঠেন। মসৃণ আর ঠাণ্ডা । চোখ ফেরান ।
কিছু নয়, দেখে তার বুঝতে একটুও কষ্ট হল না, এক প্যাকেট তাস। আনকোরা নতুন, কড়কড়ে । মা অজ্ঞাতসারে প্যাকেটটা হাতে তুলতেই খোকন তড়বড় করে বলে উঠল— কিছু না মা, রেখে দাও তুমি । আসবার পথে কী খেয়াল হল কিনে ফেললাম।
মা তাসের প্যাকেটটা নামিয়ে রাখেন টেবিলে, কিন্তু চোখ ফিরিয়ে আনতে পারেন না। কেমন নীল রঙ আর অদ্ভুত ছন্দ প্যাকেটটার গায়ের নকশায়। ছোট্ট, এতটুকু, কিন্তু চোখ ফেরানো যায় না ওইটুকুর জৌলুসেই। মা যেন সম্মোহিত হয়ে পড়লেন। কয়েকবার নাড়াচাড়া করে তিনি একসময় হাতে টেনে আনেন।
খোকন বলছে, মা শুনছ?
কী?
আজ রাতে ওরা আসবে বলেছিল—
মা কি একটু উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন? না, মা-র মনে এই মুহূর্তের চিন্তাধারা সহসা প্রকাশ হয়ে পড়ল? একটু সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলেন তিনি।
কারা?
খোকন একটু অপরাধজড়িত সুরেই বলে, না, ওসমানরা, মানে আমার কয়েকজন বন্ধু আসবে বলেছিল। আসে না কিনা অনেকদিন–
‘ও।
তাই কষ্ট করে একটু চায়ের জোগাড় হয়তো করতে হতে পারে। মানে—
খোকনের কথা শেষ না হতেই মা সংক্ষিপ্ত উত্তর দেন, আচ্ছা ।
কূলো হাতে করে সেই কখন মা চাল বাছতে বসেছেন এখনও শেষ হয়নি । এলোপাতাড়ি ভাবতে ভাবতে তার হাত যে কখন থেমে গেছে, নিজেই টের পাননি। সালেহা রান্নাঘর থেকে বলে, কই মা, চাল বাছা এখনও হয়নি তোমার? এদিকে তো চুলা খালি যাচ্ছে ।
তাইতো! মা যথাসম্ভব ক্ষিপ্রতার সাথে বাছা শেষ করেন।
সালেহা খকখক করে কেশে উঠল । কাশবে না? রান্নাঘরে একটা জানালা ফোটানোর জন্য কতবার মা বলেছেন খোকনকে, অভিমান হল মা-র, ধোঁয়া আটকে দম বন্ধ হয়ে মরুকগে, তার কী? তার কী এসে যাবে? চালের হাঁড়িটা চুলোর উপর ভালো করে বসিয়ে কপালের ঘাম মুছলেন। এত ঘেমেছেন কখনও তিনি?
বাইরে বসবার ঘরে পদশব্দ। খোকনের বন্ধুরা এসেছে, বুঝতে পারলেন । সালেহা মলিনমুখে প্রশ্নোৎসুক দৃষ্টিতে মা-র দিকে তাকাল। মা জানেন কারা এল, কিন্তু কোনো উত্তর করলেন না।
মা জানেন খোকন মিছেকথা বলেছে ! ওরা এসেছে তাস খেলতে। নিশ্চয়ই আপিস-ফিরতি পথে খোকন ওদের বলে এসেছে, নইলে নতুন তাস কেন ওর টেবিলে? আর ঘড়িটার কথা বেমালুম ভুলে গেল খোকন? কী করবেন তিনি, কী করতে পারেন? আক্রোশে অভিমানে মা-র মন ভরে উঠল। গলা ধরে এল ।
কেমন করে অন্ধকার ঠেকছে চারদিকে । আলো নেই, বাতাস নেই, শুধু বদ্ধ আবহাওয়া । বিমর্ষতার ভারে যেন নুয়ে পড়েছে বাসাটা। আর মা-র বুকখানা ফেটে চৌচির হয়ে যেতে চাইল। কিন্তু কাউকেও বুঝতে দিতে চান না তিনি, তাই সালেহাকে প্রায় এককোণে, নিজেই রান্নায় ব্যস্ত হয়ে উঠলেন।
এখনও মাছ চড়োন, তার ওপর ভাজা-চচ্চড়ি তো পড়েই রয়েছে। বাইরের ঘর থেকে শোনা গেল খোকন বলছে, বুলু, দ্যাখগে ঘরে টেবিলের উপর চকোলেটের বাক্সের নিচে প্যাড রয়েছে, নিয়ে আয় তো।
রান্নাঘর থেকে মা দেখতে পেলেন বুলু খেলার প্যাড দিয়ে এল ও ঘরে। ফিরতি পথে এসে মাকে বলল, মা, চা চাইছে বড়ভাই।
অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে তিনি বললেন, কয় কাপ?
কেন, চার কাপ।
বুলুই আবার চা নিয়ে এল । মা কানখাড়া করে শুনতে চেষ্টা করেন বাইরের ঘরের প্রতিটি কথা, প্রতিটি ধ্বনিতরঙ্গ!
বিস্ময়, আনন্দ, উল্লাস, বিমর্ষতা, স্তব্ধতা, সব কিছু একের-পর-এক রেখা কেটে চলেছে এই চারটি লোকের মনে।
স্তব্ধতা! আবার আবারও। মাঝে মাঝে খোকনের গলা শোনা যাচ্ছে। আরও কারা যেন! কিন্তু কোনো কথাই তাদের বুঝতে পারছেন না তিনি। একবর্ণও না। মনে হল, এ ভাষার সাথে বুঝি পরিচিত তিনি নন। অদ্ভুত এক বাক্যবিন্যাস ভঙ্গি আর বিচিত্র এর ধ্বনিতরঙ্গ । কেউ বুঝতে পারে না সে ভাষা।
খোকন একসময়ে ও-ঘর থেকে বেরিয়ে এসে রান্নাঘরে চাপা অথচ উত্তেজিত সুরে বলে, ধেত্তর ছ্যাঁকছ্যাঁকানি? বলি ভাজাপোড়ায় এত গন্ধ ওঠে কেন? বাইরে লোক বসে তোমাদের খেয়াল হয় না ! যত সব । গজ গজ করতে করতে খোকন আবার চলে যায়। মা-র যে কী হয়েছে আজ, খালি কান্না পাচ্ছে!
কিন্তু খোকন তাস কিনতে গেল কেন? খেলতে? ও ছাই খেলে কী লাভটাই বা হয়? আর যদি খেলতেই হয় তবে পুরনো তাসে দোষ করল কী? তাস পুরনো হয়ে গেছে বলেই কি ফেলে দিতে হয়?
হঠাৎ আবার ঘর থেকে দেয়ালঘড়িটা ঢং করে বিগত তিরিশ মিনিটের সংকেতধ্বনি করে চুপ হয়ে গেল। আর মা-র মন এবার একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেল। ভয়াবহভাবে গোটা গলিপথটা ঘুমিয়ে পড়েছে । রাত এখন অনেক । নিবিড় অরণ্যের মতো একটানা রাত। ছেদ নেই, যতি নেই এ তমিস্রা প্রপাতের । শুধু রাত ।
চুলে চুলে ঘষলে কেমন এক মিহি আওয়াজ বেরোয়, সূক্ষ্ম অথচ গভীর, তেমনি ছন্দময় যেন এ ছায়া রাত।
অস্বচ্ছ আকাশে গুটিকয় তারা। মা খোলা-জানালা দিয়ে দেখলেন তাকিয়ে ।
হারিকেনটা জ্বলছে ছোট হয়ে আলনার পাশে। ছোট আর বিষন্ন। খোকন ও-ঘরে বুলুকে নিয়ে শুয়ে পড়েছে। এ ঘরে মা-র পাশে টুনু । আর ও-পাশের চৌকিতে সালেহা বেবিকে বুকে জড়িয়ে ধরে ঘুমে কাতর। ঘুম আর ঘুম। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। শুধু ঘুম নেই মায়ের চোখে।
গোটা পৃথিবী যখন ঘুমে অচেতন, যখন রাত কুটিল সরীসৃপের মতো শুধু বাড়ছে, তখন মা-র মনে সারাদিনের সেই অদ্ভুত, পরস্পরবিরোধী চিন্তাগুলো এসে ভিড় করে দাঁড়াল। একে একে মনে পড়ল খোকনের কথা, নতুন তাসের প্যাকেট আর দেয়ালঘড়িটার কথা । ঘড়িটা এখনও চলছে। টিক টিক টিক। তন্ময় হয়ে শুনলেন প্রতিটি সেকেন্ডের গম্ভীর শব্দ।
সময় হয়ে যাচ্ছে—যাচ্ছে প্রতিটি মুহূর্ত। চোখ বুজে মা স্পষ্ট দেখতে পেলেন স্বামী শিয়রে দাঁড়িয়ে আছেন! চোখ খুলে তাকে হারাতে চান না। তাই তিনি চোখ বুজেই রইলেন নিঃসাড় হয়ে । একসময়ে স্বামীর মুখখানা অস্পষ্ট হয়ে এল। তারপর তিনি তাঁর সেই দগ্ধ আবেগ সামলাতে না-পেরে দু-হাতে বিছানার চাদর আঁকড়ে ধরলেন শক্ত মুঠিতে।
তারপর এলোমেলো কত কথা স্মৃতি তার মনের পটে নতুন করে ভেসে উঠল ছায়াময় অশরীরী রহস্যময় হয়ে ! একসময়ে তিনি বিছানা ছেড়ে উঠে গিয়ে জানালার পাশে দাঁড়ালেন । অনেকক্ষণ কেটে গেল।
তারপর কী ভেবে পা টিপে টিপে খোকনের ঘরে গিয়ে পা দিলেন । দুটো কামরার মাঝের দরজা সবসময়েই খোলা থাকে, তবু কত সতর্কতা প্রতিটি পদক্ষেপে। কী করবেন তিনি ও-ঘরে গিয়ে? কী করতে চান? হারিকেনের আবছা আলোয় ঘর ভরে রয়েছে। মা গিয়ে টেবিলের পাশে দাঁড়ালেন।
ভয়, দ্বিধা আর সংকোচ । তবুও দুহাতে তাসের প্যাকেটটা তুলে নিলেন। তেমনি মসৃণ আর ঠাণ্ডা । ইচ্ছে হল তাসগুলো কুটি কুটি করে ছিঁড়ে ফেলেন। চিহ্নমাত্র রাখতে চান না তিনি। সন্ধে থেকে যে-আক্রাশগুলো মনের অন্ধকার কোঠায় গুমরে মরছিল তারা যেন ছাড়া পেয়ে দলবেঁধে তাসের প্যাকেটটার ওপর নামল।
আঁচলের আড়ালে লুকিয়ে ফেললেন ওটা। তিনি ছিঁড়ে ফেলবেনই । আর দ্বিধা নয় । আর সংকোচ নয় ।
সহসা ঘুমন্ত খোকন পাশ ফিরে মায়ের দিকে মুখ করল। আর মা ভীত হয়ে তাড়াতাড়ি প্যাকেট নামিয়ে রাখলেন টেবিলের উপর। আবার ভয় এসে তাঁকে ভর করল ।
ছোটবেলা থেকে খোকনের মুখ দিয়ে লালা পড়ত, এখনও পড়ে মাঝে মাঝে ঘুমের ঘােরে। মা তাকিয়ে দেখলেন, লালায় ভরে গিয়েছে বালিশের কোনাটা আর খোকনের ডান গাল। তিনি চোরের মতো এগিয়ে এসে আঁচল দিয়ে মুছিয়ে দিলেন লালাটুকু। খোকনের মুখখানা কী সুন্দর আর কেমন মিঠে।
মা দেখেন আর দেখেন। ছোটবেলার সেই কচি আদলটুকু এখনও ওর মুখ থেকে উঠে যায়নি। তেমনি মাংসল গাল দুটো আর প্রশস্ত কপাল ! দু-একগোছা চুল এসে কপালে ছড়িয়ে পড়েছিল। তিনি আলতো করে সরিয়ে দিলেন। কপালে হাত বুলাতে মা-র ভারি ভালো লাগল। কতদিন মা খোকনকে ছোটবেলার মতো এত আপন করে পাননি।
তিনি ধীরে ধীরে হাত বুলোতে লাগলেন খোকনের কপালে, মুখে আর সারা গায়ে।
আবার সেই চিন্তাগুলো তার মনে এসে আছড়ে পড়ল উন্মাদের মতো। তিনি বড় বিব্রত হয়ে পড়লেন।
খোকনের ঘুম গাঢ় হয়ে নেমে এসেছে দুচোখে । কেমন তৃপ্তি গাঢ় ঘুম। আবছা আলোতেও তাসের নকশাগুলো চকচক করছিল। তিনি চোখ ফিরিয়ে দেখতে পেলেন ।
সহসা তাঁর সারা অন্তর মথিত করে একটা কথা ঠোট থেকে গড়িয়ে পড়ল— না, না, তিনি পারেন না, অসম্ভব। দুহাতে মুখ ঢেকে চোখ বুজে একদৌড়ে তিনি নিজের শোবার ঘরে এসে ঢুকলেন।
সালেহা তেমনি ঘুমুচ্ছে ।
ঘুমুচ্ছে বেবি আর টুনু। প্রতিটি মাংসপিণ্ড তারই দেহের রক্ত দিয়ে তৈরি ! তিনি একমুহূর্ত দাঁড়িয়ে দেখলেন। তারপর জীবনে এই প্রথম, সর্বপ্রথম, তিনি বিছানার উপর ঝড়ের মুখে ছিঁড়ে যাওয়া লতার মতো অসহায় হয়ে উবু হয়ে পড়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে ফুলে ফুলে কেঁদে উঠলেন।
মা কাঁদছেন।
![কবি সৈয়দ শামসুল হক এর কবিতা 39 সৈয়দ শামসুল হক [ Syed Shamsul Haque ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/05/সৈয়দ-শামসুল-হক-Syed-Shamsul-Haque-18-300x263.jpg)
আরও পড়ুন: