শব্দালঙ্কার ছন্দ ও অলঙ্কার

শব্দালঙ্কার ছন্দ ও অলঙ্কার – বিষয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি “ভাষা ও শিক্ষা” বিষয়ের “ছন্দ ও অলঙ্কার” বিভাগের একটি পাঠ।

 

শব্দালঙ্কার ছন্দ ও অলঙ্কার

অর্থবহ ধ্বনি বা ধ্বনিসমষ্টিকে বলা হয় ‘শব্দ’। যে অলঙ্কার ধ্বনির সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে এবং য়া শ্রুতিসৌকর্যবিধায়ক তাকেই বলা হয় শব্দালঙ্কার। এই অলঙ্কারটি একান্তভাবেই শব্দের ধ্বনিসুষমার ওপর নির্ভরশীল বলেই ধ্বনির তথা শব্দের পরিবর্তনে অলঙ্কার বিনষ্ট হয়। যথা— ‘বাঘের বিক্রম সম মাঘের হিমানী’- এই বাক্যে প্রথম দুটি শব্দের আদিতে ‘ব’ ধ্বনি, প্রথমটি বাদে বাকি সব শব্দে ‘ম’ ধ্বনি এবং প্রথম পর্বের আদিতে ‘বাঘের’ সঙ্গে মিল রেখে দ্বিতীয় পর্বের আদিতেও অনুরূপ শব্দ ব্যবহৃত হবার ফলে যে শ্রুতিসুখকর প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়, এইটিই এর অলঙ্কার।

শব্দ হল মূর্তধ্বনি বা ধ্বনিসংকেত। শব্দের বহিরঙ্গের যে শব্দালঙ্কার নানা ধরনের হয়ে থাকে। তার মধ্যে প্রধান কটি অনুপ্রাস, যমক, শ্লেষ ও বক্রোক্তি।

অনুপ্রাস :

একই বর্ণ বা বর্ণগুচ্ছের বারবার বিন্যাসকে অনুপ্রাস বলে। যেমন ঐ আসে ঐ অতি ভৈরব হরষে জল সিঞ্চিত ক্ষিতি সৌরভ রভসে  ঘন গৌরবে নব যৌবনা বরষা।

একই বাক্যে অদূরবর্তী বিভিন্ন শব্দে একটি বা একাধিক বর্ণের ব্যবহারের পুনরাবৃত্তি হলে যে সৌন্দর্যের প্রকাশ ঘটে তার নাম অনুপ্রাস অলঙ্কার। যেমন :

ক. আমি অজর অমর অক্ষয় আমি অব্যয়।

খ. এ যে অজাগর গরজে সাগর ফুলিছে ।

 

শব্দালঙ্কার ছন্দ ও অলঙ্কার | ভাষা ও শিক্ষা

অনুপ্রাস নানা ধরনের হয়:

সরল অনুপ্রাস :

একটি বা দুটি বর্ণ একাধিকবার ধ্বনিত হলে সরল অনুপ্রাস হয়ে থাকে। যেমন :

ক. কাননে কুসুম কলি সকলি ফুটিল।

খ. কেতকী কেশরে কেশপাশ কর সুরভি।

 

গুচ্ছানুপ্রাস :

ব্যঞ্জনবর্ণের গুচ্ছ বা একাধিক ব্যঞ্জনবর্ণ একই ক্রমে অনেকবার ধ্বনিত হলে গুচ্ছানুপ্রাস অলঙ্কার হয়।

যেমন : ক. ভূলোক দ্যুলোক গোলক ছাড়িয়া। খ. না মানে শাসন ব্যসন অশন আসন যত।

 

অন্ত্যানুপ্রাস :

কবিতার এক চরণের শেষে যে শব্দ ধ্বনি থাকে অন্য চরণের শেষে তার পুনরাবৃত্তি হলে তাকে অন্ত্যানুপ্রাস অলঙ্কার বলে। কবিতার চরণের শেষে যে মিল তার নাম অন্ত্যানুপ্রাস। যেম যেমন : সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি, সারাদিন আমি যেন ভাল হয়ে চলি ।

 

ছেকানুপ্রাস :

দুই বা ততোদিক ব্যঞ্জনধ্বনি সংযুক্ত বা বিযুক্ত অবস্থায় ক্রমানুসারে যদি দুবার আবৃত্ত হয় তবে তাকে ছেকানুপ্রাস অলঙ্কার বলে। ‘ছেক’ শব্দের অর্থ ‘পণ্ডিত’ বা ‘বিদগ্ধ’। বিদগ্ধজনের ব্যবহারযোগ্য বলেই এই অনুপ্রাসের নাম ছেকানুপ্রাস । যেমন :

ক. ওরে বিহঙ্গ ওরে বিহঙ্গ মোর।

খ. এখনি অন্ধ বন্ধ করো না পাখা।

 

বৃত্ত্যনুপ্রাস :

যদি একটি ব্যঞ্জনধ্বনি একাধিকবার ধ্বনিত হয় কিংবা বর্ণগুচ্ছ যথার্থ ক্রমানুসারে সংযুক্ত বা (. বিযুক্তভাবে বহুবার ধ্বনিত হয় তবে তাকে বৃত্ত্যনুপ্রাস বলে। যেমন : কেতকী কেশরে কেশপাশ করো সুরভি । ক্ষীণ কটিতটে গাঁথি লয়ে পরো করবী।

 

শব্দালঙ্কার ছন্দ ও অলঙ্কার | ভাষা ও শিক্ষা

 

মালানুপ্রাস :

অনুপ্রাসের মালা অর্থাৎ একাধিক অনুপ্রাস থাকলে তাকে মালানুপ্রাস বলে। যেমন আজন্ম সাধন-বন সাধন-ধন সুন্দরী আমার / কবিতা কল্পনালতা।

 

যমক :

একই শব্দ একই স্বরধ্বনিসমেত একই ক্রমানুসারে ভিন্ন ভিন্ন অর্থে একাধিকবার ব্যবহৃত হলে তাকে যমক অলঙ্কার বলে। যমক শব্দের অর্থ যুগ্ম। এতে একই শব্দ বা প্রায় এক রকমের উচ্চার্য শব্দ দু বার বা বেশি বার উচ্চারিত হয়। শব্দের অর্থও আলাদা হতে হবে। যেমন :

ক. মাটির ভয়ে রাজ্য হবে মাটি / দিবস রাতি রহিলে আমি বন্ধ।

খ. ভারত ভারত খ্যাত আপনার গুণে।

 

শ্লেষ :

একটি শব্দ একঝর মাত্র ব্যবহৃত হয়ে বিভিন্ন অর্থ প্রকাশ করলে তাকে শ্লেষ অলঙ্কার বলে। যেমন : কে বলে ঈশ্বর গুপ্ত ব্যাপ্ত চরাচর, / যাহার প্রভায় প্রভা পায় প্রভাকর। -এখানে সমগ্র বাক্যের দুটি অর্থ। এক অর্থে ঈশ্বর চরাচরে ব্যাপ্ত, তাঁর আলোকে সূর্য আলোকিত হয়। অন্য অর্থে যাঁর প্রতিভায় ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকা উজ্জ্বলরূপে প্রকাশিত হয় সেই ঈশ্বর গুপ্তকে অখ্যাতনামা কে বলবে? তাঁর খ্যাতি চরাচরে ব্যাপ্ত।- এটা শ্লেষ অলঙ্কার। যেমন : আছিলাম একাকিনী বসিয়া কাননে। / আনিলা তোমার স্বামী বাঁধি নিজ গুণে। —এখানে ‘গুণে’ অর্থ ১. ধনুকের ছিলায়, ২. স্বভাবের উৎকর্ষে।

 

শব্দালঙ্কার ছন্দ ও অলঙ্কার | ভাষা ও শিক্ষা

 

বক্রোক্তি :

রচনার সৌন্দর্য প্রকাশের জন্য বক্রতা বা মনোহর ভঙ্গি দ্বারা উক্তি সম্পন্ন হলে তাকে বক্রোক্তি বলে। সোজাসুজি না বলে বাঁকা ভাবে কোন বক্তব্য প্রকাশ পেলে তা হয় বক্রোক্তি। যেমন গৌরী সেনের আবার টাকার অভাব কী।— এখানে টাকার অভাব নেই ভাবটি বাঁকাভাবে ব্যক্ত হয়েছে।

বক্রোক্তি দুই ধরনের— ১. শ্লেষ বক্রোক্তি ও ২. কাকু বক্রোক্তি ।

 

শ্লেষ বক্রোক্তি :

বক্তার বক্তব্যকে তার অভিপ্রেত অর্থে গ্রহণ না করে অন্য অর্থে গ্রহণ করা হলে তাকে শেষ বক্রোক্তি বলে। যেমন : সভাকবি। ওঁদের অর্থ আছে বিস্তর, কিন্তু মহারাজ অর্থের টানাটানি বড় নটরাজ। নইলে রাজদ্বারে আসব কোন দুঃখে। ‘অর্থ’ শব্দের বক্তার অভিপ্রেত অর্থ—অভিধেয়, তাৎপর্য, প্রতিবক্তার অভিপ্রেত অর্থ— টাকাকড়ি।

 

কাকু বক্রোক্তি :

যখন বক্তার কণ্ঠস্বরের বিশেষ ভঙ্গির জন্যে নেতিবাচক কথা ইতিবাচক অর্থ এবং ইতিবাচক কথা নেতিবাচক অর্থ প্রকাশ করে তখন তাকে কাকু বক্রোক্তি বলে। যেমন : রাবণ শ্বশুর মম মেঘনাদ স্বামী / আমি কি ডরাই, সখি, ভিখারী রাঘবে ?

 

আরও দেখুন:

Leave a Comment