ভাষা কী ও কেন | বাংলা ভাষা | ভাষা ও শিক্ষা
ভাষা কী ও কেন | বাংলা ভাষা | ভাষা ও শিক্ষা
ভাষা কী ও কেন
ভাষা ভাবের বাহন। ভাব প্রকাশের তাগিদে ভাষার উদ্ভব। মানুষের সহজাত প্রবণতাই হল একো তার অন্যের হৃদয়ে সঞ্চারিত করে একই ভাবে ভাবিত করানো। ভাষার প্রধান কাজই হল একের ভাবনাকে অনেকের কাছে পৌঁছে দেওয়া। ভাষা জীবনানুভূতির বাহন। নিজের তার ও চিন্তার সম্পদকে অন্যের কাছে পৌঁছে দিতে চায় বলেই তার প্রয়োজন হয় উন্নততর প্রকাশমাধ্যম “ভাষা”। ভাষা যদি না থাকত তাহলে আমাদের বুদ্ধিপরিচালিত মনোভাব আমরা প্রকাশ করতে পারতাম না, একজনের সঙ্গে অন্যজনের মনোগত মিল হতো না, ফলে পরিবার, গোষ্ঠী এবং সমাজও তৈরি হতে পারত না।
ড. সুকুমার সেন বলেন,
“ভাষার মধ্য দিয়া আদিম মানুষের সামাজিক প্রবৃত্তির প্রথম অঙ্কুর প্রকাশ পাইয়াছিল। ভাষার মধ্য দিয়াই সেই সামাজিক প্রবৃত্তি নানাদিকে নানাভাবে প্রসারিত হইয়া আদিম নরকে পশুত্বের অন্যজড়তা। হইতে উদ্ধার করিয়া তাহাকে মননশীল করিয়াছে। প্রকৃতির দাসত্ব হইতে মুক্তি পাইয়া মানুষ প্রকৃতির প্রভুত্বের অধিকারী হইয়াছে। ভাষা চিন্তার শুধু বাইনই নয় চিন্তার প্রসূতিও। আমাদের চিন্তাকে আমরা প্রকাশ করি ভাষার সাহায্যে।
মননশীল মানুষ যা ভাবছে সেটা সে ভাষাতেই প্রকাশ করছে। তা শুনে মনে নতুন চিন্তা জাগছে। তাহলে ভাষা যে কেবল মানুষের চিন্তাকেই প্রকাশ করে তাই নয়, নতুন চিন্তারও জন্ম দেয়। নিউটন যা ভেবেছেন, ভাষায় প্রকাশ করেছেন। সেই ভাবনা পড়ে বা শুনে আইনস্টাইন নতুন ভাবনা উপস্থিত করেছেন। সেটাও যে প্রকাশ করেছেন- তাও ভাষায়। এই প্রবাহ যতদিন মানুষ বেঁচে থাকবে ততদিন অব্যাহত থাকবে। ভাষার মধ্যস্থতায় গড়ে ওঠে মানুষের সাহিত্য ও তার বিচিত্র সংস্কৃতি।
ভাষাতাত্ত্বিক মুহম্মদ আবদুল হাই বলেছেন,
“আমরা যেমন খাইদাই ওঠা-বসা করি ও হেঁটে বেড়াই, তেমনি সমাজ জীবন চালু রাখবার জন্যে কথা বলি, নানা বিষয়ে নানা ভাবে। মানুষের সঙ্গে মানুষের সামাজিকতা বজায় রাখতে হলে তার প্রধান উপায় কথা বলা, মুখ খোলা, আওয়াজ করা। একে অন্যের সঙ্গে সম্মন্ন যেমনই হোক না কেন— শত্রুতার কি ভালোবাসার, চেনা কি অচেনার, বন্ধুত্বের কিংবা মৌখিক আলাপ পরিচয়ের, মানুষের সঙ্গে মানুষের যে কোনো সম্মন্ধ স্থাপন করতে গেলেই মানুষ মাত্রকেই মুখ খুলতে হয়, কতকগুলো আওয়াজ করতে হয়। সে আওয়াজ বা ধ্বনিগুলোর একমাত্র শর্ত হচ্ছে সেগুলো অর্থবোধক হওয়া চাই। কতকগুলো অর্থবোধক ধ্বনির সাহায্যে এক এক সমাজের মানুষ তাদের সামাজিক জীবন চালু রাখে। এক এক সমাজের সকল অর্থবোধক ধ্বনির সমষ্টিই ভাষা।
“ভাষা হল পরপর ধ্বনি ব্যবহার করে অর্থ প্রকাশের মানবিক উপায়। ভাষার এক প্রান্তে ধ্বনি, আর-এক প্রান্তে অর্থ- এই হল মূল কথা। ভাষা ধ্বনিসমষ্টির সাহায্যে বিষয়কে মূর্তিমান করে। বিশেষ বিশেষ অর্থবান ধ্বনিসমষ্টি হল বিশেষ বিশেষ বিষয়ের প্রতীক, সেই সেই ধ্বনিসমষ্টির নয়। যেমন, ‘মানুষ’ বলতে শুধু এই ধ্বনিসমষ্টিই বোঝায় না, বোঝায় এই ধ্বনিসমষ্টির ধারা এক বিশেষ রূপ-গুণসম্পন্ন প্রাণী। এই প্রতীকদ্যোতকতাই ভাষার স্বরূপ লক্ষণ।
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘বাঘের বরর আলোচনা করবার উপলক্ষে স্বয়ং বাঘকে হাজির করা সহজ নয়, নিরাপদ নয়। বামে মানুষকে যায় এই সংবাদটাকে প্রত্যক্ষ করানোর চেষ্টা নানা কারণেই অসঙ্গত। ‘বাঘ’ বলে একটা শব্দকে মানুষ বানিয়েছে, বাঘ জঙ্গুর প্রতীক। মানুষের কানের সঙ্গে ভাবের সঙ্গে অভিব্যক্ত হয়ে চলেছে তার একটি বিরাট প্রতীকের জগৎ। এই প্রতীকের জানে জলাল আকাশ থেকে অসংখ্য সত্য যে আকর্ষণ করছে এবং সঞ্চারণ করতে পারছে দূর দেশে এবং দূর কালে ভাষা গড়ে তোলা মানুষের পক্ষে সহজ হয়েছে প্রতীক রচনার শক্তিতে, প্রকৃতির কাছ থেকে সেই দানটাই মানুষের সকল দানের সেরা।”
কোনো কোনো ভাষাতাত্ত্বিক বলেছেন ভাষা-শিক্ষার ক্ষমতা মানুষের স্বভাবগত। আর তার ফলেই এত স্বাভাবিকভাবে মানুষ তার নিজের প্রতিভাতেই গড়ে তুলেছে এই প্রতীকের লাং। বস্তু জগতের থেকে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করতে পেরেছে বলেই মানুষ ভাষা দিয়ে কলা সমানের সব খবরই দিতে পারছে, বস্তুটিকে সামনে উপস্থিত না-করেই। সে “আগুন’ শব্দটার সাহায্যে আগুনের কথা বলছে, সে ‘পানি’ শব্দটার সাহায্যে পানির কথা বলছে- আগুন এবং পানি এই বস্তুগুলোকে প্রত্যক্ষভাবে উপস্থিত করতে হচ্ছে না তাকে।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, তারা নিয়মের জাল, প্রতীকের শৃঙ্খলা। আর একটা হল ভাষা শিক্ষা সাপেক্ষ সংবাদ-বিনিময়ের মাধ্যম। স্বাভাবিক ও নিয়মমাফিক ধ্বনির সাহায্যেই মানুষ কথা বলে তার মনোভাব প্রকাশ করে, সংবাদ বিনিময় করে, আর এই কথাগুলো মানুষ তার বাগযন্ত্রের সাহায্যে উচ্চারণ করে থাকে। বাগ্যন্ত্র বলতে গলা, দাঁত, মাড়ি, জিব, ঠোঁট, নাক, তালু, মুখ্যহার ইত্যাদি বোঝায়। অর্থাৎ বাগযন্ত্রের সাহায্যে উচ্চারিত সাংকেতিক পানি সমষ্টিই প্রতিটি ভাষার আদিম রূপ। প্রসজাত রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ভাষায় কেবল এই সংকেতেরই কারবার। ধ্বনির এই সংকেত- শক্তিই হল ভাষার প্রাণ- ভাষার মূল ভিত্তি।
মানুষ যখন কথা বলে তখন গলা থেকে শব্দ বেরিয়ে মুখের নানা জায়গায় স্পর্শ করে ধ্বনি আকারে বের হয়ে আসে। এই ফানিগুলো নিলে হয় অর্থবোধক শব্দ এবং কতকগুলো অর্থবোধক শব্দ নিলে হয় বাকা। এভাবে মানুষ অর্থবোধক শব্দ ও বাক্যের মাধ্যমে মনের ভাব প্রকাশ করে থাকে। সাধারণ ও মৌল অর্থে, ভাষা বলতে আমরা মানুষের কণ্ঠোচারিত ব্যাপক জনসমাজে প্রচলিত অর্থবান ধ্বনিমালাকেই বুঝে থাকি। তার প্রকাশের জন্য ভাষার নির্দিষ্ট কতকগুলো বৈশিষ্ট্য থাকা চাই।
আরও দেখুন:
- গণমাধ্যম রচনা । Essay on Mass media । প্রতিবেদন রচনা
- সৈয়দ শামসুল হক | বাঙালি সাহিত্যিক, কবি, উপন্যাসিক, নাট্যকার, চিত্রনাট্যকার, অনুবাদক
- দীপাবলি রচনা । Essay on Diwali । প্রতিবেদন রচনা
- তথ্যপ্রযুক্তি ও বাংলাদেশ রচনা । Essay on Information and Bangladesh । প্রতিবেদন রচনা
- যখন ভাঙল মিলন মেলা , প্রেম ২৮২ | Jokhon vhanglo milon mela