শব্দ | বাংলা ভাষার শব্দভাণ্ডার | ভাষা ও শিক্ষা

শব্দ | বাংলা ভাষার শব্দভাণ্ডার | ভাষা ও শিক্ষা , শব্দ বস্তু বা ভাবের দ্যোতক। শব্দের দ্বারা আমরা পরিচিত বস্তুকে বোঝাতে কিংবা অন্তরস্থ ভাবকে প্রকাশ করতে চাই। অর্থপূর্ণ ধ্বনি ও ধ্বনিসমষ্টিকে ‘শব্দ’ বলা হয়। যেমন অ + ল্ + অ + সৃ + অ = অলস। অলস  শব্দটি শ্রমবিমুখ, মঘর, জড়প্রকৃতিবিশিষ্ট ভাবের দ্যোতক। এভাবে এক-একটি শব্দ প্রকাশ করে একটি বা একাধিক অর্থ বা ভাব বা ধারণা। যে-ধ্বনির কোন অর্থ নেই ব্যাকরণে তাকে শব্দ বলে বিবেচনা করা হয় না।

শব্দ | বাংলা ভাষার শব্দভাণ্ডার | ভাষা ও শিক্ষা

শব্দ

বিশিষ্ট ভাষাতাত্ত্বিক ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে, “অর্থযুক্ত ধ্বনিকে বলে শব্দ (Word)। কোনও বিশেষ সমাজের নরনারীর কাছে যে-ধ্বনির স্পষ্ট অর্থ আছে, সেই অর্থযুক্ত ধ্বনি হচ্ছে, সেই সমাজের নরনারীর ভাষার শব্দ’।

অশোক মুখোপাধ্যায়-এর মতে, এক বা একাধিক ধ্বনির সমন্বয়ে তৈরি অর্থবোধক ও উচ্চারণযোগ্য একককে শব্দ বলা হয়। এ, ও, ঐ ইত্যাদি এককভাবে অর্থ প্রকাশ করতে পারে বলে এগুলো একাধারে ধ্বনি ও শব্দ।

 

শব্দ | বাংলা ভাষার শব্দভাণ্ডার | ভাষা ও শিক্ষা

 

বাংলা ভাষার শব্দভাণ্ডার

শব্দ দিয়ে তৈরি হয় বাক্য, সার্থক বাক্যরাশিতে হয় ভাষা। ভাষার প্রাণ হল শব্দভাণ্ডার। শব্দভান্ডার প্রতিটি ভাষার ঐশ্বর্য স্বরূপ। আমাদের বাংলা ভাষার খনিটিও যথেষ্ট সমৃদ্ধ। যে-রাজকোষে যত বেশি মুদ্রা, সে রাজকোষ তত বেশি ধনাঢ্য। ভাষার রাজকোষ ভরে থাকে শব্দে। সোনালি শিকির মতো শব্দ, রুপোলি আধুলির মতো শব্দ, ঝলমল করে চকচক করে। যে-ভাষার ভাণ্ডারে যত বেশি শব্দ সে-ভাষা তত বেশি ধনী।

বাংলা ভাষায় আছে অজস্র শব্দ। কত শব্দ আছে বাংলা ভাষায় তা নির্দিষ্ট করে বলা কঠিন। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে অজস্র শব্দ জমেছে বাংলা ভাষার শব্দভান্ডারে। প্রতিটি সজীব ভাষার ধর্মই হলো নদীর স্রোতের মতো বারবার সে ধারা বদল করে। পুরোনো খাত ছেড়ে নতুন পথে বয়ে চলে। যুগে যুগে ভাষার শব্দও বদলাতে থাকে। অনেক শব্দ হারিয়ে যায়, জন্মায় নতুন শব্দ, নতুনতর শব্দ। শব্দের এই ইতিহাস খুবই বিচিত্র ও চিত্তাকর্ষক, এর পেছনে লুকোনো আছে প্রাচীন সামাজিক, রাজনৈতিক ও বস্তু ব্যবহারের নানান গোপন তথ্য।

এদেশে একসময় অনার্যরা বাস করত, তাদেরও কিছু শব্দ বাংলা ভাষায় মিশে গেছে। এরপর এসেছে বিদেশিরা তাদের শব্দসম্ভার নিয়ে। যুগ যুগ ধরে আমাদের দেশে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে লোকের আগমন ঘটেছে। তারা এদেশের ভাষার ওপর প্রভাব রেখেছে। ভিন্ন প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ যেমন বলেছেন । শক হন দল পাঠান মোগল একদেহে হল লীন।’

ভীনদেশিদের অনেকে ব্যবসায়-বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে এদেশে থেকেও গিয়েছে। এছাড়া দীর্ঘকাল ধরে এ দেশটা শাসন করেছে ইংরেজ জাতি। তারও আগে এদেশে ছিল মুসলিম শাসন; তখন সারা দেশে ব্যাপকভাবে। ফারসি ভাষার প্রচলন ছিল। ধর্মীয় ব্যাপারস্যাপারে এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান-সম্প্রদায় আরবি ভাষা ব্যবহার করেছেন। ফলে এই সব ভাষার প্রচুর শব্দ বাংলা ভাষায় স্থান পেয়েছে। অনেক শব্দ এখনো টিকে আছে অতীতের স্মৃতি বহন করে। কিছু দেশি শব্দ রয়ে গেছে বাংলা ভাষায়।

কিছু শব্দ আবার হারিয়ে গেছে। কোনোটি রূপান্তরিত হয়েছে। অর্থ পালটেছে কোনো কোনো শব্দের সংযোজন হয়েছে নতুন শব্দরাশি। যেমন হারিয়ে গেছে সুগীবহ, বপন, লিচ্ছিন্ন। রয়ে গেছে পুষ্প, ফল, লতা, সুন্দরী, কল্যাণ, চন্দ্র, সূর্য। প্রস্ফুটিতকুমুচন্দ্র, বিদ্যুদ্দামস্ফুরিত, সমুদ্রহারুনিত রমাম জাতীয় দীর্ঘ পদ-শব্দ এখন আর ব্যবহৃত হয় না। কুসুমকলি, নয়নমনোহর, শান্তলয়, মৃদু তাল এখনো আমাদের আনন্দ দেয়। তিব্বতি, লিচ্ছবি, বর্মি চিহ্ন রয়ে গেছে বাংলা ভাষার শব্দ শরীরে; যেমন আছে আফগান, তুর্ক, ডাচ, দিনেমার, ফরাসি, ইংরেজ প্রভৃতির চিহ্ন।

এখন আমরা ব্যবহার করি কম্পিউটার, টিভিতে স্যাটেলাইট চ্যানেলে দেখি ভিজেদের উল্লাস, মোবাইল ফোনে ভেসে আসে প্রিয় কন্ঠস্বর, রেডিও-টিভিতে হয় টক- শো স্পেস শাটল, হ্যাকিং- সবটাই বাংলা ভাষার পরিসরে এসে গেছে। এভাবে যুগ যুগ ধরে বাংলা ভাষার শব্দসম্ভার গড়ে উঠেছে। শতাব্দের পর শতাব্দ বহমান ইতিহাসের সঙ্গে সঙ্গে শব্দভান্ডারের গ্রহণ-বর্জন-অর্থান্তরের জীবিত প্রবাহের মধ্য দিয়েই বাংলা ভাষা কল্লোলিনী।

প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষার শব্দগুলো কীভাবে পরিবর্তিত হয়ে আধুনিক বাংলায় রূপ লাভ করেছে তার কিছু উদাহরণ নিচে দেওয়া হল-

Capture400 শব্দ | বাংলা ভাষার শব্দভাণ্ডার | ভাষা ও শিক্ষা

 

শব্দের সংখ্যা যে-ভাষায় যত বেশি, সে ভাষা তত সমৃদ্ধ। শব্দের ভাণ্ডার বাড়ানোর জন্যে প্রত্যেক ভাষায় বিদেশি ভাষা থেকে শব্দ সংগ্রহ করার রীতি প্রচলিত আছে। অন্য ভাষা থেকে শব্দ গ্রহণ করার ক্ষমতা যে ভাষায় যত বেশি সে ভাষা তত উন্নত। বাংলা ভাষার শব্দসংখ্যা যেমন নিতান্ত কম নয় তেমনি এই ভাষার সব শব্দ বাঁটি বাংলাও নয়। বর্তমানে বাংলা ভাষায় যে-শব্দসম্ভার ব্যবহৃত হয় তা বহুদিন ধরে দেশি-বিদেশি অগণিত শব্দের সমাবেশে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে। “বাংলা ভাষার শব্দভান্ডার খুবই পুষ্ট সমৃদ্ধ এবং উন্নত। ” ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর মধ্যে প্রাচীন ভারতীয় আর্য শাখাটি ক্রমবিবর্তনের মাধ্যমে বাংলা ভাষায় বর্তমান রূপ লাভ করেছে; তাই এই ভাষাগোষ্ঠীর প্রচুর শব্দ বাংলায় বিদ্যমান। “নব্য ভারতীয় আর্য ভাষাগুলোর মধ্যে বাংলার স্থান সকলের ওপরে। “উত্তরাধিকার হিসেবে পাওয়া বাংলা শব্দভাণ্ডারের প্রধান উপাদান তত্ত্বব (সংস্কৃত থেকে প্রাকৃতের মধ্য দিয়ে বাংলায় আসা অন্তত দুবার পরিবর্তিত শব্দ), তৎসম (মূলত সংস্কৃত বানানে রক্ষিত কিন্তু উচ্চারণে পরিবর্তিত শব্দ ঋণ) এবং অর্ধতৎসম (বাঙালির মুখের উচ্চারণে ভেঙেচুরে নেওয়া সংস্কৃত শব্দ, যেমন নেমন্তন্ন)। এগুলোর উৎস সংস্কৃতভাষা। সেই সঙ্গে আছে কতিপয় অজ্ঞাতমূল বা দেশি শব্দ, যেগুলো হয়তো দ্রাবিড়, অস্ট্রিক বা ভোটবর্মি ভাষা থেকে প্রাচীন ঋণ। এছাড়াও আছে প্রচুর নতুন শব্দঋণ বা বিদেশি শব্দ] ফারসি, আরবি, ইংরেজি, পর্তুগিজ ও অন্যান্য ভাষা থেকে।

বাংলা ভাষায় যে সব শব্দ ব্যবহৃত হয়ে থাকে তাদের প্রধান ৫ ভাগে বিভক্ত করা যায়। ওই পাঁচটি প্রধান বিভাগেরও আবার কিছু উপবিভাগ আছে। নিচের ছকটি মনে রাখলে বাংলা শব্দের শ্রেণিবিভাগ মনে রাখতে সুবিধা হবে।

Capture401 শব্দ | বাংলা ভাষার শব্দভাণ্ডার | ভাষা ও শিক্ষা

 

বাংলা ভাষার শব্দের অনুপাত নির্ণয় করতে গিয়ে ড. মুহম্মদ এনামুল হক মন্তব্য করেছেন, বর্তমান বাংলা ভাষায় শব্দ ব্যবহারে লেখকভেদে তারতম্য ঘটে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, জসীম উদ্‌দীন প্রমুখ শ্রেষ্ঠ লেখকের ভাষা বিশ্লেষণ করলে যে শাব্দিক অনুপাত পাওয়া যায় তা নিম্নরূপ :

Capture403 শব্দ | বাংলা ভাষার শব্দভাণ্ডার | ভাষা ও শিক্ষা

 

সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের ‘বাঙ্গালা ভাষার অভিধান’-এর মোট শব্দের পরিসংখ্যান নিয়ে দেখেছিলেন, তাতে তদ্ভব ৫১.৪৫ শতাংশ, তৎসম ৪৪.০০ শতাংশ, ফারসি আরবি ৩.৩০ শতাংশ আর ইংরেজি- পর্তুগিজ ইত্যাদি ১.২৫ শতাংশ। অবশ্য এ পরিসংখ্যান সর্বৈব ঠিক নয় এবং এ থেকে বাংলা শব্দের ব্যবহারিক (মৌখিক ও লিখিত) কোন ছবি পাওয়া যায় না। তাছাড়া জ্ঞানেন্দ্রমোহনের অভিধানে প্রায় দেড়লাখ শব্দ থাকলেও সমস্ত উপভাষা মিলিয়ে ব্যবহৃত বাংলা শব্দের সংখ্যা তার চেয়েও অনেক বেশি। এভাবে বাংলা ভাষায় যে শব্দসম্ভারের সমাবেশ হয়েছে, সেগুলোকে পণ্ডিতগণ নিম্নলিখিত ৫ ভাগে ভাগ করেছেন। যেমন- ১. তদ্ভব শব্দ, ২. তৎসম শব্দ ৩. অর্ধ-তৎসম শব্দ 8. দেশি শব্দ এবং ৫. বিদেশি শব্দ

শব্দ | বাংলা ভাষার শব্দভাণ্ডার | ভাষা ও শিক্ষা

 

১. তদ্ভব শব্দ : “তদ্ভব” শব্দের অর্থ ‘তা থেকে উৎপন্ন’ (তৎ + ভব)। এখানে ‘তা’ মানে সংস্কৃত, অর্থাৎ সংস্কৃত, ভাষা থেকে উৎপন্ন হয়েছে এ রকম শব্দকে “তদ্ভব শব্দ” বলা হয়। সংস্কৃত শব্দ যখন প্রাকৃত ভাষার ভেতর দিয়ে রূপ পাল্টাতে পাল্টাতে শেষকালে বাংলায় এসে পৌঁছায়, তখন তা তদ্ভব শব্দ হিসেবে পরিগণিত হয়। সংস্কৃত শব্দ থেকে তৈরি এই সব শব্দ দেখলে অনেক সময় বোঝাই যায় না যে, প্রথমে এগুলো সংস্কৃত শব্দ ছিল। যেমন : সংস্কৃতে ‘চাঁদ’ ছিল ‘চন্দ্র’, প্রাকৃতে হয় “চন্দ, বাংলায় “চাঁদ”।

তদ্ভব শব্দের আরেক নাম ‘প্রাকৃতজ শব্দ’। প্রাকৃতজ অর্থ ‘প্রাকৃত থেকে যা জন্মেছে, প্রাকৃত ভাষার ভেতর দিয়ে পরিবর্তিত হয়ে সংস্কৃত শব্দ বাংলায় রূপান্তরিত হয়েছে বলে এই নাম। এই তদ্ভব শব্দগুলো বাংলা ভাষার মূল উপাদান। বাঙালির দৈনন্দিন জীবনে যে শব্দগুলো ব্যবহৃত হয় তার অধিকাংশই তদ্ভব শব্দ। সাহিত্যের ক্ষেত্রেও খ্যাতনামা লেখকদের রচনার শতকরা ৬০ ভাগ শব্দই তদ্ভব।

Capture404 শব্দ | বাংলা ভাষার শব্দভাণ্ডার | ভাষা ও শিক্ষা

 

এরকম আরও কিছু শব্দের উদাহরণ

Capture405 শব্দ | বাংলা ভাষার শব্দভাণ্ডার | ভাষা ও শিক্ষাCapture406 শব্দ | বাংলা ভাষার শব্দভাণ্ডার | ভাষা ও শিক্ষা

 

২. তৎসম শব্দ : সংস্কৃতের শব্দভাণ্ডার থেকে সব সময়েই প্রয়োজনীয় শব্দাবলি বাংলা ভাষায় গ্রহণ করা হয়। এ ধরনের সংস্কৃত শব্দ যদি অপরিবর্তিত রূপে হুবহু বাংলায় ব্যবহৃত হয় তাহলে সেই শব্দকে “তৎসম শব্দ’ বলা হয়। ‘তৎসম’ অর্থ তার (তৎ) সমান (সম)। “তার” অর্থ সংস্কৃতের; অর্থাৎ সংস্কৃতের সমান শব্দই তৎসম। তৎসম শব্দ খুব গুরুগম্ভীর হয়ে থাকে, কেননা সংস্কৃত ভাষাও অত্যন্ত গুরুগম্ভীর। তাই গুরুগম্ভীর বাংলা লিখতে গেলে তৎসম শব্দ ব্যবহার করা প্রয়োজ তৎসম শব্দের উদাহরণ : চন্দ্র, সূর্য, আকাশ, অল, হস্ত, পদ, মস্তক, চক্ষু, কর্ণ, নর, নারী, বৃক্ষ, লতা ইত্যাদি। মনে রাখা দরকার তৎসম শব্দ বানানের দিক দিয়েই শুধু সংস্কৃতের সমান, উচ্চারণের ক্ষেত্রে নয়।

৩. অর্ধতৎসম শব্দ : তৎসম মানে সংস্কৃত। আর অর্ধ-তৎসম মানে আধাসংস্কৃত। তৎসম শব্দ থেকে বিকৃত উচ্চারণের ফলে অর্ধ-তৎসম শব্দ উৎপন্ন হয়ে থাকে। সংস্কৃতের উচ্চারণরীতি বাংলায় অনুসরণ করা হয় না। ফলে সাধারণ লোকজন সংস্কৃত শব্দের উচ্চারণে বহু রকম ভুল করে ফেলে এবং সে-সব ক্ষেত্রে সংস্কৃত শব্দ বিকৃত হয়ে যায়। বিকৃত তৎসম শব্দকেই অর্ধ-তৎসম বা ভগ্ন-তৎসম শব্দ বলে। যেমন :

Capture407 শব্দ | বাংলা ভাষার শব্দভাণ্ডার | ভাষা ও শিক্ষা

 

৪. দেশি শব্দ : বাংলাদেশের আদিম অধিবাসীদের (যেমন : তামিল, কোল প্রভৃতি) ভাষা ও সংস্কৃতির কিছু কিছু উপাদান বাংলায় রক্ষিত হয়েছে। এসব শব্দকে দেশি শব্দও নামে অভিহিত করা হয়। অনেক সময় এসব শব্দের মূল নির্ধারণ করা যায় না; কিন্তু কোন্ ভাষা থেকে এসেছে তার হদিস মেলে। যেমন, ঝুড়ি (বিশ)- কোল ভাষা; পেট (উদর) – তামিল ভাষা: চুলা (উনুন) – মুক্তারি ভাষা। এরূপ- কুলা, গঞ্জ, চোঙ্গা, টোপর, ডাব, ডাগর, ভিত্তা, ঢেঁকি ঠ্যাঙা, বড়শি, কুড়ি, ঝাঁটা, মুড়ি, কয়লা, টাঁড়শ, লাউ, থোকা, খুকি, পোকা, কানা, বোঝা, কামড় ইত্যাদি। আরও বহু দেশি শব্দ বাংলায় ব্যবহৃত হয়।

দেশি শব্দ সম্পর্কে ড. হুমায়ুন আজাদ বলেছেন, কিছু শব্দ আছে, যেগুলোর মূল নির্ণয় করতে পারেন নি ভাষাতাত্ত্বিকেরা। তবে মনে করা হয় যে বাংলা ভাষার উদ্ভবের আগে যে-সব ভাষা ছিল আমাদের দেশে, সে-সব ভাষা থেকে এসেছে ওই শব্দগুলো। এমন শব্দকে বলা হয় ‘দেশি শব্দ’। এগুলোকে কেউ কেউ বিদেশি বা ভিন্ন ভাষার শব্দের মতোই বিচার করেন। কিন্তু এগুলোকেও গ্রহণ করা উচিত বাংলা ভাষার নিজস্ব শব্দ হিশেবেই। ডাব, ডিক্সি, ডাঙ্গা, বেল, ঝিঙ্গা, ঢেউ এমন শব্দ। এগুলোকে কী করে বিদেশি বলি?

৫. বিদেশি শব্দ : বাংলাদেশের সঙ্গে বিদেশের সংশ্রব প্রাচীন কাল থেকে ঘটে এসেছে। ব্যবসায়-বাণিজ্য, ধর্ম প্রচার ইত্যাদির জন্য বহুকাল পূর্ব থেকেই ভিন দেশের লোক এদেশে আসা-যাওয়া করেছে। পারস্পরিক ভাব বিনিময়ের ফলে সেজন্য বিদেশি বহু শব্দ বাংলা ভাষায় কখনও অবিকৃতভাবে, কখনও-বা পরিবর্তিত হয়ে পাল্টে প্রবেশ করেছে। বাংলা ‘দাম’ (‘মূল্য’ অর্থে) শব্দ যে আসলে বাংলা নয়, এ তথ্য অবিশ্বাস্য মনে হয় না কি? ‘দাম’ শব্দ এসেছে গ্রিক শব্দ ‘প্রামে’ থেকে। এমন শব্দ আরও আছে, যেমন—সুড়ঙ্গ, মুচি, কাহন ইত্যাদি।

তৎসম, তদ্ভব ও দেশি শব্দের কোনোটাই যা নয় এবং যে শব্দ বিদেশ থেকে আমদানি হয়ে বাংলা ভাষায় নিজের স্থান করে নিয়েছে সেগুলোই ‘বিদেশি শব্দ”। যত ধরনের বিদেশি শব্দ বাংলা ভাষায় রয়েছে সে-সব বিচার করে দেখা গেছে যে, তারা প্রধানত ৬ ধরনের : (১) আরবি-ফারসি, (২) তুর্কি, (৩) পর্তুগিজ, (৪) ইংরেজি, (৫) ফরাসি- ওলন্দাজ ও (৬) অন্যান্য ভাষার শব্দ। বাংলা ভাষায় তুর্কি ফারসি, আরবি শব্দের সংখ্যা প্রায় আড়াই হাজার।

মিশ্র শব্দ (সংকর শব্দ) : বাংলা ভাষায় ‘মিশ্র শব্দ’ নামে আরেক ধরনের শব্দ আছে। এই শব্দগুলো বিভিন্ন ভাষার বিদেশি শব্দ কিংবা দেশি ও বিদেশি শব্দের মিশ্রণে তৈরি হয়েছে। যেমন : পাউরুটি (‘পার্ট’ শব্দের অর্থ রুটি, শব্দটি পর্তুগিজ) পুলিশ সাহেব (‘পুলিশ’ শব্দ ইংরেজি), হেডমৌলভি (‘হেস্ত’ শব্দ ইংরেজি ‘মৌলতি’ শব্দ আরবি), পণ্ডিত স্যার (‘পণ্ডিত’ শব্দ তৎসম ‘স্যার’ শব্দটি ইংরেজি), হাফহাতা (‘হাফ’ ইংরেজি, ‘হাতা বাংলা শব্দ), মাস্টারি (‘মাস্টার’ ইংরেজি, ‘ই’ বাংলা), বেসুর ‘বে’ আরবি, সুর’ তৎসম।।

বিকৃত শব্দ : এক ভাষাভাষী গোষ্ঠীর লোকেরা অন্য ভাষা গোষ্ঠীর ভাষা সাধারণত সঠিকভাবে উচ্চারণ করতে পারে না। তারা নিজের ভাষার উচ্চারণ রীতিতে রূপান্তরিত করে নেয়। বাংলা ভাষা-ভাষীদের ক্ষেত্রেও এটা ঘটেছে। তাই বিদেশি ভাষার শব্দ তারা নিজের মতো করে উচ্চারণ করে। এগুলোকে বিকৃত শব্দ বলা যেতে পারে। তবে এ বিকৃতি কিন্তু নিন্দার্থে নয়।

এ হচ্ছে ঈষৎ পরিবর্তিত উচ্চারণ, অর্থাৎ ধ্বনি পরিবর্তন। পূর্ববর্তী অধ্যায়ে (ধ্বনির পরিবর্তন) আমরা ধ্বনির নানারকম পরিবর্তন সম্পর্কে জেনেছি। উদাহরণ : ১. ইংরেজি- ওপিয়াম (Opium) – বাংলা ‘আফিম’। ২. ইংরেজি- স্কুল (School)- বাংলা ইস্কুল’। ৩. ইংরেজি- হসপিটাল (Hospital)- বাংলা ‘হাসপাতাল’। ৪. পর্তুগিজ- আনানাস বাংলা ‘আনারস’।

ধ্বন্যাত্মক শব্দ ও শব্দদ্বৈত : উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে আমরা বাংলা শব্দসম্ভারের একটি হিসেব পেয়েছি। আরও একটি ব্যাপার বিবেচনা না করলে বাংলা শব্দ সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান সম্পূর্ণ হবে না। তা হল- বাংলা শব্দের প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য। আমরা পূর্বেই বলেছি যে, অর্থপূর্ণ ধ্বনির নামই শব্দ। বাংলা ভাষায় কিছু শব্দ আছে যা শুধু ধ্বনির জন্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ জাতীয় শব্দ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন যে, এদের ভাব প্রকাশের শক্তি অসাধারণ”। ‘ধ্বন্যাত্মক শব্দ’ ও ‘শব্দদ্বৈত এর মধ্যে পড়ে।

ধ্বন্যাত্মক শব্দ : সে রেগে টং হয়ে আছে। ঠাস করে তোকে একটা চড় মারব। চিনু ফিক্ করে হেসে ফেলল। তার মেজাজ খারাপ, কিছু বলতে গেলে এখনি ফোঁস করে উঠবে। উদাহরণে টং, ঠাস, ফিক্, ফোঁস শব্দগুলো ধ্বন্যাত্মক শব্দের পরিচয়।

শব্দদ্বৈত : ‘শব্দদ্বৈত’ মানে একই শব্দ দু বার করে ব্যবহার করা। এটিও বাংলা ভাষার বৈশিষ্ট্য। একে দ্বিরুক্ত শব্দও (অর্থাৎ দু বার উক্ত বা বলা হয়েছে এমন শব্দ বলে। যেমন হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে গেল। আজ বেশ শীত শীত ভাব। হাসি হাসি মুখ করে তোমাকে বলতে এল, আর তুমি ওকে ধমক দিয়ে? ইত্যাদি। ধ্বন্যাত্মক শব্দ ও শব্দদ্বৈত (বা দ্বিরুক্ত শব্দ) বাংলা ভাষার অন্যতম সম্পদ (এ সম্পর্কে ‘ধ্বন্যাত্মক শব্দ ও শব্দদ্বৈতঅধ্যায়ে বিস্তৃত জানতে পারবো।

পারিভাষিক শব্দ : বাংলা ভাষায় প্রচলিত বিদেশি শব্দের ভাবানুবাদমূলক প্রতিশব্দকে পারিভাষিক শব্দ বলে।  উদাহরণ : অম্লজান– oxygan উদযান— hydrogen – file, প্রশিক্ষণ training, ব্যবস্থাপক manager: বেতার– radio,  general manager সচিব- secretary – graduate: স্নাতকোত্তর— postgraduates সমাপ্তি — final, সাময়িকী — periodical, সমীকরণ equation ইত্যাদি।

শব্দ | বাংলা ভাষার শব্দভাণ্ডার | ভাষা ও শিক্ষা

 

 

দ্বিরুক্ত শব্দ বিশ্লেষণ ঃ

 

আরও দেখুন:

Leave a Comment