বাংলা ব্যাকরণের উৎপত্তি ও বিকাশ

বাংলা ব্যাকরণের উৎপত্তি ও বিকাশ নিয়ে আজকের পাঠ। এই পাঠটি ব্যাকরণ ও ব্যাকরণ পাঠের গুরুত্বপুর্ন অংশ। বাংলা ভাষার ব্যাকরণ প্রথম রচনা করেন ইউরোপীয় পণ্ডিতরা। শুধু বাংলা ভাষার ব্যাকরণই নয়, নব্যভারতীয় প্রাদেশিক ভাষাগুলির অধিকাংশেরই ব্যাকরণ রচনার সূত্রপাত তাদের হাতে। বিদেশীরা নানা প্রয়োজনে ভারতবর্ষের আঞ্চলিক ভাষাসমূহ শিখতে ও সহগামীদের শেখাতে বাধ্য হয়েছিল। ফলে তাদের প্রয়োজনই বাংলাসহ অন্যান্য প্রাদেশিক ভাষার ব্যাকরণ রচনায় তাদেরকে উৎসাহিত করেছিল। আর এরকম প্রয়োজনের তাগিদেই পর্তুগিজ ধর্মযাজক মানোএল দা আস্‌সুম্পসাঁউ (Manoel da Assumpcam) পর্তুগিজ ভাষায় প্রথম বাংলা ব্যাকরণ রচনা করেন। চলুন বিস্তারিত জেনে নেই।

[১.৬] বাংলা ব্যাকরণের উৎপত্তি ও বিকাশ | ব্যাকরণ ও ব্যাকরণ পাঠের গুরুত্ব | অধ্যায় ১ | ভাষা ও শিক্ষা

বাংলা ব্যাকরণের উৎপত্তি ও বিকাশ:

হাজার বছরেরও বেশি সময়ের অধিক ব্যাক বাংলা ভাষা বর্ণিত ও বিশ্লেষিত হয়ে আসছে মাত্র আড়াই শ বছর ধরে। বাংলা ব্যাকরণের উৎপত্তি ও বিকাশ সম্পর্কে বলতে গেলে আমাদের আজ থেকে আড়াই হাজার আর আড়াইশ বছর পেছনে ফিরে তাকাতে হবে। বাংলা ভাষার উৎপত্তিকালে বা তারও শত শত বৎসরের মধ্যেও বাংলা ব্যাকরণ রচিত হয় নি।

বাংলা ব্যাকরণ চর্চার সূচনা হয় বাংলা ভাষার উন্মেষের আট শ বছর পর। পাণিনি থেকে বিদ্যাসাগর— সংস্কৃত ব্যাকরণের এই ধারাটি আড়াই হাজার বছরের, আর মানোএল থেকে সুনীতিকুমার বাংলা ব্যাকরণের এই যারাটি আড়াইশো বছরের। প্রথম ধারাটির কাছে দ্বিতীয় ধারাটি ঋণী, তবু তা স্বতন্ত্র খাতে বয়ে চলতে চেয়েছে নিজের প্রাণশক্তিতে।

ব্যাকরণ শব্দটির উৎস কৃষ্ণযজুর্বেদে। যেখানে দেবতারা ইন্দ্রকে বললেন, আমাদের এই ভাষাকে আপনি- ব্যাকৃত করুন, অর্থাৎ এই ভাষার ব্যাকরণ নির্দেশ করুন। এ ছাড়া ছয়টি বেনাঙ্গের মধ্যে শিক্ষা, নিরুক্ত, ব্যাকরণ ও ছন্দ- 4 চারটিই ভাষাবিজ্ঞানের অঙ্গ।

পাণিনিপন্থী বৈয়াকরণেরা বেদাঙ্গ অন্তর্ভুক্ত এই শিক্ষা দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। শিক্ষা ও বৈদিক প্রাতিশাখাকে অবলম্বন করে বিবর্তিত হয়েছিল পরবর্তী ব্যাকরণ, যার মধ্যে পাণিনির স্থান ছিল বিশিষ্ট। পাণিনি-ব্যাকরণের ধারার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ও পতঞ্জলি। কাত্যায়ন ছিলেন পাণিনির দোষদর্শী, পতঞ্জলি ছিলেন সমর্থক। পাণিনির মূল রচনা এই দুজনের সংশোধন ও সংযোজনের মধ্য দিয়ে পূর্ণতা পাত করেছিল। এই তিনজনকে বলা হয় ত্রিমুনি।

ব্যাকরণ রচনার প্রাথমিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই ভাষার সর্বজনমান্য রূপ বা standard form ঠিক করাই ছিল ব্যাকরণের প্রধান উদ্দেশ্য। সে যুগে ব্যাকরণ ছিল ‘আনুশাসনিকা। ভাষাকে শাসন করা, অর্থাৎ ভাষার নানারূপ বিশৃঙ্খলা দূর করে বহু সূত্র, বহু নিয়মের মধ্যে বেঁধে, শুদ্ধ-অশুদ্ধ নির্দেশ করে, ভাষার একটি সুদ্ধ রূপ স্থির করা ছিল প্রধান বিবেচনা। মোটামুটি খ্রিস্টপূর্ব ৮০০ অব্দ থেকে চেষ্টা শুরু হয় ভাষাশাসনের।

পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন ব্যাকরণবিদ পাণিনি খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ অব্দের দিকে তাঁর ‘অষ্টাধ্যায়ী’ নামক বিখ্যাত গ্রন্থে এলোমেলো ভাষাগুচ্ছকে সংস্কার করে সর্বভারতীয় একটা সুস্মির রূপ দান করেন। যার নাম হয় সংস্কৃত ভাষা। তবে এ-ভাষা শুধু লেখার ভাষা এবং পন্ডিতের জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার ভাষা হয়ে রইল। পরবর্তী কালে (সপ্তদশ শতকে) পাণিনি চর্চায় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য অটোজি দীক্ষিতের ‘সিদ্ধান্তকৌমুদী।

পাণিনি-ধারা ছাড়াও ঐন্দ্র, চালু, জৈনেন্দ্রীয়, শাকটায়নী, হেমচন্দ্রীয়, কাতন্ত্র, সারষত, মুগ্ধবোধ, জৌমর, সৌপদ্ম, কালাপিক ইত্যাদি বিভিন্ন ব্যাকরণের ধারা প্রচলিত ছিল। তটোজি দীক্ষিতের ‘সিদ্ধান্তকৌমুদীকে’ সহজ সংক্ষিপ্ত করে রচিত হয়েছিল ‘লঘুকৌমুদী’। এই লঘুকৌমুদীও বাংলায় প্রচলিত ছিল। সিদ্ধান্তকৌমুদী ও মুখবোধ (-মুখ অর্থাৎ মূঢ় বা অল্পজ্ঞদের বোধের নিমিত্তে রচিত ব্যাকরণ।

প্রভৃতি ব্যাকরণের সঙ্গে সামঞ্জস্য করে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ‘ব্যাকরণকৌমুদী’ (১৮৫৩) রচনা করেন। এতে বাংলা ব্যাখ্যা সংযোজিত হওয়ায় এবং শব্দরূপ ধাতুরূপাদির সহজ বিন্যাস থাকায় ব্যাকরণচর্চা সহজ হয়। বাংলা বৈয়াকরণেরাও সংস্কৃত ব্যাকরণের নিয়মগুলো ভালোভাবে জানবার সুযোগ পান। শব্দরূপ ও ক্রিয়ারূপের বিন্যাস, সখি, সমাস, ধাতুর গণবিভাগ ইত্যাদি বহু বিষয়ে বাংলা ব্যাকরণ বিলাসাগরের এই ব্যাকরণকৌমুদীর কাছে ঋণী।

 

[১.৬] বাংলা ব্যাকরণের উৎপত্তি ও বিকাশ | ব্যাকরণ ও ব্যাকরণ পাঠের গুরুত্ব | অধ্যায় ১ | ভাষা ও শিক্ষা

বাংলা ব্যাকরণ চর্চার ইতিহাস ব্যাকরণের মতো পুরাতন নয়। বহু বাঙালি ব্যাকরণবিদ সংস্কৃত ব্যাকরণ চর্চা করলেও উনিশ শতকের আগে বাংলা ব্যাকরণ বিষয়ে আগ্রহ দেখা যায় নি। আঠারো শতকের চল্লিশের দশকে মুদ্রিত হয় বাংলা ব্যাকরণের প্রধন পুস্তক মানোএল দাস Manoel da Assumpcam) এর দ্বিতাধিক শব্দকোষ ও খণ্ডিত ব্যাকরণ।

ঢাকার তাওয়ালে, ১৯৪৩ খ্রিস্টীয় অঙ্গে, তিনি রচনা করেন ভোকাবুলারিও এম ইतিওমা বেনগা, ই, পর্তুগিজ ভিনো এম নুয়ান পার্হেস’ (Vocabolario em idioma Bengalla.c Portuguez dividido em duas partes) নামে। ১১ গ্রন্থটি দুটি অংশে বিভক্ত: প্রথম অংশ ব্যাকরণের একটি সংক্ষিপ্তসার এবং দ্বিতীয় অংশ বাংলা-পর্তুগিজ ও পর্তুগিজ-বাংলা শব্দাভিধান। গ্রন্থটি পর্তুগালের রাজধানী লিসবন থেকে ১৭৪০ খ্রিস্টাব্দে রোমান হরফে মুদ্রিত হয়। এর কাঠামোগত আদর্শ গৃহীত হয়েছে লাতিন ভাষার ধাঁচে। আর এতে শুধু রূপতত্ত্ব ও বাক্যতত্ত্বই আলোচিত হয়েছে, শুনিতত্ত্ব সম্পর্কে কোনো আলোচনা নেই।

আসসুম্পসাঁওর শব্দকোষ ও ব্যাকরণ প্রকাশের তিন দশক পর, ১৭৭৮-এ তুগলি থেকে প্রকাশিত হয় নাথেনিয়েল ব্রাসি হ্যালহেডের (Nathaniel Brassey Halhed) ব্যাকরণ এ থামার অফ দি বোল ল্যাঙ্গুয়েজ’ (A Grammar of the Bengal Language) হ্যালহেডের ব্যাকরণ সম্পূর্ণ ইংরেজিতে রচিত হলেও এতেই প্রথম বাংলা হরফ মুদ্রিত হয়, এ কারণে বাংলা মুদ্রণ শিল্পের ইতিহাসে একটি মূল্যবান।

চার্লস উইলকিনসন এবং পঞ্চানন কর্মকার যৌগ প্রচেষ্টায় ছাপাখানার জন্য যে বাংলা হরফ (font) প্রবর্তন করেন, তার সাহায্যেই হ্যালহেডের গ্রন্থে বাংলা উদাহরণগুলো মুদ্রিত হয়েছে। আঠারো শতকে রচিত বাংলা ব্যাকরণের এ দুটি নমুনা ছাড়া আর কোনো নিদর্শন। পাওয়া যায় নি। উনিশ শতকে সৃষ্টি হয়, ইংরেজি ও বাংলা ভাষায়, বাংলা ব্যাকরণ পুস্তকের এক অবিরাম ধারা।

উনিশ শতকে ইংরেজিতে বাংলা ব্যাকরণ প্রণেতাদের মধ্যে আছেন কেরি (১৮০১), গঙ্গাকিশোর (১৮১৬), কিন (১৮২০), হটন (১৮২১), রামমোহন রায় (১৮২৬), শ্যামাচরণ সরকার (১৮৫০), বিশ্বস্ (১৮৭২), শ্যামাচরণ গাঙ্গুলি (১৮৭৭), যদুনাথ ভট্টাচার্য (১৮৭৯), কে পি ব্যানার্জি (১৮৯৩) প্রমুখ। বাংলায় বাংলা ব্যাকরণ প্রণেতাদের মধ্যে আছেন রামমোহন রায় (১৮:৩৩), শ্যামাচরণ সরকার (১৮৫২), ব্রজনাথ বিদ্যালঙ্কার (১৮৭৮), নিত্যানন্দ চক্রবর্তী (১৮৭৮), নীলমণি মুখোপাধ্যায় (১৮৭৮), কেদারনাথ তর্করত্ন (১৮৭৮), চিন্তামণি গঙ্গোপাধ্যায় (১৮৮১), প্রসনচন্দ্র বিদ্যারত্ন (১৮৮৪), বীরেশ্বর পাড়ে (১৮৯১), নকুলেশ্বর বিদ্যাভূষণ (১৩০৫)।

 

[১.৬] বাংলা ব্যাকরণের উৎপত্তি ও বিকাশ | ব্যাকরণ ও ব্যাকরণ পাঠের গুরুত্ব | অধ্যায় ১ | ভাষা ও শিক্ষা

 

বিশ শতকের শুরুর দশকে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী দাবি (১৩০৮) করেন যে ‘বাঙ্গালা ভাষায় কিছু কম আড়াই শত বাঞ্ছণালা ব্যাকরণ লিখিত হইয়াছে’। কিন্তু তার এক দশক পরে যোগেশচন্দ্র রায় বলেন (১৩১৯) যে, তিনি তাঁর ‘বাঙ্গালা ভাষা” নামক রচনা লেখার সময় দেখেছেন মাত্র চারটি ব্যাকরণ পুস্কর— রামমোহন রায়ের ‘গৌড়ীয় ব্যাকরণ (১৮৩৩), শ্যামাচরণ শর্মার ‘বাঙ্গালা ব্যাকরণ (১২৫৯), নকুলেশ্বর বিদ্যাভূষণের ‘ভাষাবোধ বাঙ্গালা ব্যাকরণ (১৩০৫ চতুর্দশ মুদ্রণ), গোহারাম শিবেরত্নের বাঙ্গালা ব্যাকরণ’ (সংবং ১৯৩৬)।

বাংলা ব্যাকরণ রচনার ক্ষেত্রে উনিশ শতকের তুলনায় বিশ শতক বহুমাত্রায় বৈচিত্র্যপূর্ণ। উনিশ শতকে এ বিষয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা হলেও কোনো অনুসরণীয় আদর্শ তৈরি করা সম্ভবপর হয় নি। বিশ শতকে ভাষার আদর্শের মতো ব্যাকরণ রচনারও একটি রূপ ও পদ্ধিতির অনুসন্ধানে বেশ কিছু প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসে।

সেগুলোর মধ্যে বলীয় সাহিত্য পরিষৎ’ এবং ‘কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাছাড়া গ্রিয়ারসনের Thie Languistic Survey of India-র বাংলা ভাষার রূপ ও প্রকৃতি বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা সন্নিবেশিত হওয়ায় এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল পুরস্কার পাওয়ায় (১৯১৩) বাংলা ভাষা বিদেশে পরিচিতি লাভ করে।

আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

বিশ শতকের শুরু থেকেই বাংলা ভাষা ও ব্যাকরণ চর্চার আরেকটি প্রবণতা পরিস্ফুট হতে থাকে, যার সঙ্গে আধুনিক ইউরোপীয় ভাষা চর্চার সম্পর্ক অত্যন্ত স্পষ্ট। বর্তমানে দুই বাংলার ভাষা গবেষণায় যে প্রধান ধারাগুলো দেখা যায়। সেগুলো হচ্ছে: ১. তুলনামূলক ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞান, ২. সাংগঠনিক ও রূপান্তরমূলক সৃষ্টিশীল ব্যাকরণ এবং ৩, উপভাষা তত্ত্ব।

বিশ শতকের শুরুতেই প্রকাশিত হয় শ্রীনাথ সেনের ‘ভাষাতত্ত্ব’ (১৯০১) গ্রন্থটি। নানা অসঙ্গতি ও ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকা সত্ত্বেও একেই বাংলা ভাষার ঐতিহ্যনির ব্যাকরণ রচনার প্রথম নিদর্শন বলে বিবেচনা করা হয়। সমসাময়িক কালে ঐতিহাসিক ব্যাকরণ রচনার আরেকটি নিদর্শন হচ্ছে যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধির (১৮৫৯-১৯৫৬) ‘বাঙ্গালা ভাষা” (১৯১২)। বাংলা ভাষার ঐতিহাসিক ব্যাক্যাগের অপর নিদর্শন হচ্ছে বিজ্ঞাচন্দ্র মজুমদারের (১৮৬১-১৯৪২) The History of the Bengali Language (১৯২০)। তিনিই প্রথম ঐতিহাসিকভাবে বাংলা ভাষায় বিদেশি উপাদানগুলো চিহ্নিত করার চেষ্টা করেন।

এ গ্রন্থটি প্রকাশের পর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের Journal of the Department of Letters (Vol. II, ১৯২০)- 4 Outlines of an Historical Grammar of the Bengali Languages শিরোনামে একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ রচনা করেন, যা পরবর্তীকালে ঐতিহাসিক ব্যাকরণ রচনার আদর্শ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় (১৮৯০-১৯৭৭) রচিত The Origin and Development of the Bengali Language (ODBI. ১৯২৫) নামক অদ্বিতীয় গবেষণা গ্রন্থে বিজ্ঞানসম্মতভাবে বাংলা ভাষার উপাদানগুলো চিহ্নিত ও বিশ্লেষিত হয়েছে। এ মন্ত্রের মাধ্যমে বাঙালির মাতৃভাষা চর্চার যে বৈজ্ঞানিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তার ওপরেই পাড়িয়ে আছে পরবর্তী অনেকের ভাষা চর্চার সৌধ।

BanglaGOLN.com Logo 252x68 px White বাংলা ব্যাকরণের উৎপত্তি ও বিকাশ

উল্লিখিত দুশ বছরে প্রথাগত বাংলা ব্যাকরণের যে ধারা গড়ে ওঠে তার মধ্যে মিশ্রণ ঘটে তিন রকমের ব্যাকরণের। লাতিন, ইংরেজি ও সংস্কৃতের। এ-ব্যাকরণ পুস্তকরাণি স্বায়ত্তশাসিত বাংলা ভাষার সূত্র খুঁজেছে কখনো ইংরেজি ব্যাকরণের কাঠামোতে, কখনো সংস্কৃত ব্যাকরণের রীতিতে।

বাংলা ব্যাকরণের আদি প্রণেতারা বিদেশি ও বিভাষী, তাঁরা লাতিন ও ইংরেজি ব্যাকরণের ক্যাটেগরি আবিষ্কারের চেষ্টা করেন বাংলা ভাষায়। পরে আসেন সংস্কৃত পণ্ডিতেরা, যারা বাংলাকে বিকৃত সংস্কৃত ভেবে সংস্কৃত ব্যাকরণের ক্যাটেগরিরাশি আরোপ করেন বাংলার ওপর।

বাংলা ব্যাকরণ রচনায় উদ্যোগী হয়ে সংস্কৃত পণ্ডিতেরা সংস্কৃত থেকে নিয়ে আসেন অজস্র সংস্কৃত সূত্র এবং সৃষ্টি করেন এক দুর্বল আনুশাসনিক শাস্ত্র, যা বাংলা ভাষাকে একটি মাধান- স্বায়ত্তশাসিত ভাষারূপে ব্যাখ্যা-বর্ণনা-বিশ্লেষণ করাতে ব্যর্থ হয়। এ-সব ব্যাকরণকে লক্ষ করেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মন্তব্য (১২৯২) করেছিলেন, “প্রকৃত বাংলা ব্যাকরণ একখানিও প্রকাশিত হয় নাই। সংস্কৃত ব্যাকরণের একটু ইতস্তত করিয়া তাহাকে বাংলা ব্যাকরণ নাম দেওয়া হয়।

বিশ শতকে রচিত বাংলা ব্যাকরণগুলো প্রকৃতি ও প্রণানিতে আগের শতকের বৈশিষ্ট্যই অনুসরণ করেছে, যদিও কোনো কোনোটি বেশ ব্যাপক (সুনীতিকুমার, ১৯৩৯)। ফলে প্রথাগত ব্যাকরণের ধারার বই চলে প্রথাগত খাতেই।

বাংলা ভাষার স্বাতন্ত্র্য ও স্বায়ত্তশাসন এবং বাংলা ব্যাকরণকাঠামোর স্বাধিকার প্রথম, ও অনেকটা পরোক্ষভাবে, দাবি করা হয় ‘বালক’ ও ‘সাধনা’ পত্রিকায় প্রকাশিত তরুণ রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি প্রবন্ধে বাংলা উচ্চারণ’ (১২৯২), ‘স্বরবর্ণ অ’ (১২৯৯), ও ‘টা টো (১৯৯৯)-তে। ১৩০১-এ (১৮৯৪) প্রকাশিত হয় “সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকায়, যার চতুর্থ ও পঞ্চম বর্ষের দু সংখ্যায় প্রকাশিত হয় দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘উপসর্গের অর্থবিচার’ (১৩০৪, ১৩০৫)। “উপসর্গের অর্থবিচার’ নামক দীর্ঘ এ অন্তদৃষ্টিসম্পন্ন একশটিতেই সুস্পষ্টভাবে বিকশিত হয় নবা ব্যাকরণ-দৃষ্টি যার লক্ষ্য বাংলা ভাষাকে বাংলা হিসেবেই ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা।

দ্বিজেন্দ্রনাথ যে আন্দোলনের সূচনা করেন, তাকে এগিয়ে নিয়ে যান রবীন্দ্রনাথ, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেণী, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। তাদের বিরোধীগোত্রে সক্রিয়ভাবে অবস্থান করেন। শরচ্চন্দ্র শাস্ত্রী, সতীশচন্দ্র বিদ্যাভূষণ, শ্রীনাথ সেন প্রমুখ। রবীন্দ্রনাথ যখনই প্রথাগত ব্যাকরণ সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন। তখনই তাকে সংস্কৃত ব্যাকরণের নামান্তর রূপান্তর বলে নির্দেশ করেছেন, খুঁজে বের করেছেন বাংলা ভাষার বহু একান্ত আপন বৈশিষ্ট্য এবং আবেদন জানিয়েছেন প্রকৃত বাংলা ব্যাকরণ রচনার।

পরবর্তী কালে বাংলা ব্যাকরণের বিভিন্ন বিষয়ে মূল্যবান অবদান রেখেছেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, ড. সুকুমার সেন, ড. মুহম্মদ এনামুল হক, মুহম্মদ আবদুল হাই, মুনীর চৌধুরী প্রমুখ। পশ্চিমবঙ্গের ভাষাতাত্ত্বিকগণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন ড. পবিত্র সরকার, প্রবাল দাশগুপ্ত, সুভাষ ভট্টাচার্য, উদয়নারায়ণ সিংহ, শিশিরকুমার দাস, পরেশচন্দ্র মজুমদার, ড. রামেশ্বর ‘ প্রমুখ।

বাংলাদেশে নতুন ভাষাচিন্তার গবেষকগণ হলেন : ড. হুমায়ুন আজাদ, ড. মনিরুজ্জামান, ড. রফিকুল ইসলাম, মনসুর মুসা, ড. কাজী দীন মুহম্মদ রাজিব হুমায়ূন, মহামান দানীউল হক, ড. আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ, আমিনুল ইসলাম ও আরো অনেকে।

তাদের অবদান সম্পর্কে ড. রফিকুল ইসলাম মন্তব্য করেছেন, কালানুক্রমিক, তুলনামূলক বর্ণনামূলক, রূপান্তরমূলক, সমাজ ভাষাতত্ত্ব যে কোনো পদ্ধতিতেই হোক না কেন তাঁরা এখন পর্যন্ত বাংলা ভাষার বৈশিষ্ট্য থেকে উদ্ভূত কোনো গবেষণা পদ্ধতির উদ্ভব ঘটাতে পারেন নি, এমনকী তাঁরা কেউ আধুনিক পদ্ধতিতে বাংলা ভাষার একটি ব্যাকরণও রচনা করেন নি। তাদের কৃতিত্ব ভাষাতত্ত্বের প্রায় প্রতিটি শাখায় বাংলা ভাষায় গবেষণাকর্ম পরিচালনা।

কিন্তু এখন বোধ হয় সময় হয়েছে বাংলা ভাষা বিশ্লেষণের জন্য বাংলা ভাষার ধারণা থেকে উদ্ধৃত নিজস্ব পদ্ধতির উদ্ভাবনা এবং তার মাধ্যমে বাংলা ভাষার বিশ্লেষণ। বিশেষত বাংলা ভাষায় খাঁটি বাংলা ভাষার ব্যাকরণ রচনা। প্রসঙ্গত ড. হুমায়ুন আজাদ মন্তব্য করেছেন, ‘বিশ শতকের আশির দশকেও অবাস্তবায়িত থেকে যায় নবা ব্যাকরণবিদদের স্বপ্ন, যার নাম বাংলা ভাষার ব্যাকরণ।

“বাংলা ভাষা ও ব্যাকরণ চর্চায় অবাঙালি পণ্ডিত ও গবেষকদের ভূমিকাও কম নয়। জর্জ আব্রাহাম গিয়ার্সন বাংলা উপভাষাসমূহের প্রকৃতি নিরূপণে ঐতিহাসিক অবদান রেখেছেন। বাংলা ধ্বনি ও রূপতত্ত্বের প্রকৃতি বিচারে ভূমিকা রেখেছেন চার্লস এ ফার্গুসন। ই এম বিকোভা রুশ ভাষায় নিয়েছেন বাংলা ভাষার ব্যাকরণ। সম্প্রতি হানা রুম থমসন ইংরেজিতে সমকালীন বাংলা ভাষার ব্যাকরণ লিখেছেন। এ ছাড়াও বাংলা ভাষা ও ব্যাকরণ চর্চার ক্ষেত্রে যে ডি অ্যান্ডার্সন, ওয়াল্টার সাটন পেজ, এডোয়ার্ড সি ভিমক, দুশান জাতিতে, ব্রাদার জেমস প্রমুখের নাম স্মরণীয়।

এভাবেই বাংলা ব্যাকরণ রচনার ধারায় নতুন চিন্তা-ভাবনার আগমন ঘটেছে। ১৯০১ সাল থেকে বৰ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ-এ বাংলা ভাষার ঘাঁটি ব্যাকরণ রচনার লক্ষ্যে উপযুক্ত পরাক্রমশালী লেখক- পণ্ডিত- বিজ্ঞানীরা যে-আলোচনার সূত্রপাত করেছিলেন আধুনিক ভাষাবিজ্ঞান চর্চার প্রচার ও প্রসারের ফলে তা আরো জোরালো ভিত্তি পেতে থাকে।

একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকের সূচনায় বাংলাদেশের বাংলা একাডেমির সর্বাত্মক প্রয়াস এবং পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির সহযোগিতায় দু খণ্ডে রচিত হয় ‘বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যাকরণ’ (ডিসেম্বর, ২০১১)। বাংলা ভাষা এবং সাহিত্যের ক্ষেত্রে এ এক যুগান্তকারী প্রয়াস। কাজটি বাংলা ব্যাকরণ চর্চার ইতিহাসে নিঃসন্দেহে মাইল ফলক হয়ে থাকবে।”।

BanglaGOLN.com Logo 252x68 px Dark বাংলা ব্যাকরণের উৎপত্তি ও বিকাশ

হার্ভার্ড মনোবিজ্ঞানী কিনারের দৃষ্টিতে সামাজিক অভিজ্ঞতার পথ ধরে ভাষার আবির্ভাবের ফলেই ব্যাকরণের উদ্ভব হয়েছে। বিশ্বখ্যাত ভাষাবিজ্ঞানী অধ্যাপক অ্যাবরাম নোয়াম চমস্কি  ভাষাকে শুধুমাত্র একটি মানবিক বৈশিষ্ট্য হিসেবে বিবেচনা করার দৃঢ় মতবাদ ব্যক্ত করেছেন। চমস্কি মনে করেন , সকল স্বাভাবিক মানুষের মগজে একটি  মৌলিক বিশ্বজনীন ব্যাকরণ সূত্রবদ্ধ হয়ে আছে। এই বিশ্বজনীন ব্যাকরণে সকল ভাষার জন্য অভিন্ন কিছু নিয়মাবলি নিহিত আছে।

সুনির্দিষ্ট ভাষাসমূহের ব্যাকরণ একই পরিবারের সদস্য। স্পিনার ও চমস্কির তত্ত্ব দুটি সমালোচনার উর্ধ্বে নয়। সম্ভবত দুটি তত্ত্বের মধ্যেই সত্য নিহিত আছে। একদিকে ভাষাকে আমরা দেখতে পারি বিবর্তন ও সামাজিকায়নের ধারাবাহিকতা রূপে, অন্যদিকে ভাষাকে একান্তভাবে মানবিক বৈশিষ্ট্য হিসেবেই বিবেচনা করতে হয়। বাংলাভাষা তাই আমাদের মানুষের মর্যাদা, বাংলা ভাষার জন্যই আমরা মানব সমাজে চিহ্নিত হয়েছি আলাদা পরিচয়ে ।

সূত্র : বাংলা ব্যাকরণের উৎপত্তি ও বিকাশ | ব্যাকরণ ও ব্যাকরণ পাঠের গুরুত্ব

আরও দেখুন:

Leave a Comment