সারাংশ ও সারমর্ম [ পদ্যাংশ ] Sharangsho Sharmormo Bangla নিয়ে আজকের আয়োজন। সার শব্দের অর্থ মূল এবং অংশ শব্দের অর্থ ভাগ। সুতরাং সারাংশ শব্দের অর্থ ভাগ মূল বক্তব্য। কোন নির্দিষ্ট বিষয়ের বিস্তারিত বা বিবৃতিমূলক বর্ণনা থেকে ব্যাখ্যামূলক কথাগুলো বাদ দিয়ে শুধু সার বা মূল কথাগুলো সংক্ষেপে উপস্থাপন করাকে সারাংশ বলে। সারাংশকে সারমর্ম বা সংক্ষিপ্ত সারও বলা হয়ে থাকে:
Table of Contents
সারাংশ লেখার নিয়ম :
সারাংশ লেখার সময় নিম্নলিখিত নিয়মগুল্মের প্রতি লক্ষ রাখতে হবে :
- উদ্ধৃত অংশটি তিন-চার বার ভালভাবে পড়ে তার মূল কথাটা বুঝতে হবে।
- উদ্ধৃত অংশের মূল ভাবটুকু অল্প কথায় প্রকাশ করাই সারাংশ লেখার মূল উদ্দেশ্য।
- সারকথা লেখার সময় মূল অংশের বিশেষণ, উপমা, দৃষ্টান্ত প্রভৃতি বাদ দিতে হবে।
- লেখার ভিতর একটি বিষয়ের যাতে পুনরাবৃত্তি না ঘটে সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে।
- মূল বিষয়টার সাথে পরস্পর সম্পর্ক রেখে সহজ-সরল করে নিজের ভাষায় সারাংশ লেখা উচিত।
- মোটামুটি সারাংশটা মূল অংশের তিন ভাগের একভাগ হওয়া উচিত।
- পুরো লেখাটাই হবে পরোক্ষ পদ্ধতিতে।
- সারাংশ লেখার সময় উপরোক্ত নিয়মগুলো লক্ষ করে বিষয়বস্তু ধারাবাহিকভাবে সাজিয়ে লিখলে সারাংশ সহজ, সরল ও সুন্দর হয়।
সারাংশের কয়েকটি উদাহরণ [ পদ্যাংশ ]:
১। বসুমতি কেন তুমি সারমর্ম
“বসুমতি, কেন তুমি এতই কৃপণা?
কত খোঁড়াখুঁড়ি করি পাই শস্যকণা।
দিতে যদি হয় সে-মা প্রসন্ন সহাস,
কেন এ মাথার ঘাম পায়েতে বহাস?
বিনা চাষে শসা দিলে কি তাহাতে ক্ষতি?
শুনিয়া ঈষৎ হাসি কহেন বসুমতি—
“আমার গৌরব তাহে সামান্যই বাড়ে,
তোমার গৌরব তাহে একেবারে ছাড়ে।
সারমর্ম : কৃষকগণ বহু পরিশ্রমের বিনিময়ে ঘরে ফসল তোলে। কিন্তু তারা যদি জমি থেকে বিনা পরিশ্রমে ফসল লাভ করত তাহলে তাদের গৌরব বিনষ্ট হত। নিজের প্রচেষ্টায় কিছু অর্জন করার মধ্যেই যথার্থ গৌৱধ নিহিত।
২।
ছোট ছোট বালুকার কণা, বিন্দু বিন্দু ভাল,
গড়ি তোলে মহাদেশ, সাগর অতল ।
মুহূর্ত নিমেষকাল, তুচ্ছ পরিমাণ
গড়ে যুগ-যুগান্তর অনন্ত মহান।
প্রত্যেক সামান্য ত্রুটি ক্ষুদ্র অপরাধ
ক্রমে টানে পাপ পথে, ঘটায় প্রমাদ;
প্রতি করুণার নাম, স্নেহপূর্ণ বাণী,
এ ধরায় স্বর্গসুখ নিত্য দেয় আনি।
সারমর্ম : ক্ষুদ্রকে ক্ষুদ্র বলে অবজ্ঞা করা উচিত নয়। কারণ বালুকণায় মহাদেশ, জলকণায় সমুদ্র এবং মুহূর্তের সমন্বয়ে অনন্ত মহাকালের সৃষ্টি হয়। তুচ্ছ অপরাধেই জঘন্য পাপের সূচনা হয়। পক্ষান্তরে মানুষের প্রতি মানুষের সামান্য সমবেদনাই সম্মিলিতভাবে পৃথিবীতে স্বর্গের সুখ-শান্তি উপহার দিতে পারে।
৩।
নদী কভু পান নাহি করে নিজ জল,
তরুগণ নাহি খায় নিজ নিজ ফল;
গাভী কভু নাহি করে নিজ দুগ্ধ পান,
কাষ্ঠ দগ্ধ হয়ে করে পরে অন্ন দান;
স্বর্ণ করে নিজ রূপে অপরে শোভিত,
বংশী করে নিজ স্বরে অপরে মোহিত
শস্য জন্মাইয়া নাহি খায় জল ধরে,
সাধুর ঐশ্বর্য শুধু পরহিত তরে।
সারমর্ম : পরের উপকারে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার মাঝেই প্রকৃত সুখ। এ জগতে নদী, বৃদ্ধ, গাভী, কাঠ, স্বর্ণ ও জলধর কেউই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত নয়; সবাই অকাতরে নিজেকে বিলিয়ে দিচ্ছে। প্রকৃত সাধু ব্যক্তির ঐশ্বর্য অন্যের ভোগে লাগে, তাঁর নিজের ভোগে নয়।।
৪।
চিরসুখী জন ভ্রমে কি কখন
ব্যথিত বেদন বুঝিতে পারে,
কি যাতনা বিষে বুঝিবে সে কিসে
কভু আশি বিষে দংশেনি যারে?
যতদিন ভবে না হবে না হবে।
তোমার অবস্থা আমার সম
ঈষৎ হাসিবে শুনে না শুনিবে
বুঝে না বুঝিবে যাতনা মম।
সারমর্ম : জগতে সুখী ব্যক্তিরা দুঃখীর বেদনা কখনও অনুভব করতে পারে না। নিজেরা দুঃখের কবলে পতিত হলে তবেই তারা দুঃখের গভীরতা উপলব্ধি করতে পারে।
৫।
যে নদী হারায়ে স্রোত চলিতে না পারে,
সহস্র শৈবাল দাম বাঁধে আসি তারে।
যে জাতি জীবন হারা অচল অসার,
পদে পদে বাঁধে তারে জীর্ণ লোকাচার।
সর্বক্ষণ সর্বজন চলে যেই পথে,
তৃণ গুলা সেখা নাহি জন্মে কোন মতে,
যে জাতি চলে না কভু, তারি পথ ধরে
তন্ত্র-মন্ত্র সহিংসতার চরণ না পরে।
সারমর্ম : যে নদীতে স্রোত নেই তার কোন মূল্য নেই, আর সে নদীতে সহস্র শৈবাল জমা হয়ে তাকে অকেজো করে দেয়। যে পথে সবসময় লোক চলাচল করে সে পথে কোন দিন আগাছা জন্মাতে পারে না। সেরূপ যে জাতি সর্বদা কর্মে রত থাকে তার কোনদিন বিনাশ হয় না। দিন দিন তার উন্নতি হয়। কর্মহীন অলস জাতির ধ্বংস অনিবার্য।
৬।
বাবুই পাখিরে ডাকি বলিছে চড়াই
“কুড়ে ঘরে থেকে কর শিল্পের বড়াই?
আমি থাকি মহাসুখে অট্টালিকা পরে।
তুমি কত কষ্ট পাও রোদ বৃষ্টি ঝড়ে।”
হাসিয়া বাবুই কহে, “সন্দেহ কি তায়,
কষ্ট পাই তবু থাকি নিজের বাসায়।
পাকা হোক তবু ভাই পরের বাসা
নিজ হাতে গড়া মোর কাঁচা ঘর খাসা।”
সারমর্ম : পরের জিনিস নিয়ে বাহাদুরি করা উচিত নয়। নিজের জিনিস তা যতই ছোট বা কমদামি হোক না কেন। তার মধ্যে আত্মতৃপ্তি রয়েছে। চড়াই পাখি পরের দালানে থেকে বাহাদুরী দেখায় এবং ঝড়ের সময় বাবুই পাখির দুঃখ-কষ্ট দেখে টিটকারি দেয়। কিন্তু বাবুই পাখির মনে এতে কোন দুঃখ নেই। কারণ এ বাসা তার নিজের তৈরি।
৭।
কোথায় স্বর্গ কোথায় নরক? কে বলে তা বহুদূর?
মানুষেরই মাঝে স্বর্গ নরক, মানুষেতে সুরাসুর।
রিপুর তাড়নে যখনি মোদের বিবেক পায় গো লয়,
আত্মগ্লানির নরক অনলে তখনি পুড়িতে হয়।
প্রীতি ও প্রেমের পূণ্য বাঁধনে যবে মিলি পরস্পরে,
স্বর্গ আসিয়া দাঁড়ায় তখন আমাদেরি কুঁড়েঘরে।
সারমর্ম : স্বর্গ ও নরক বহু দূরে অবস্থিত এবং মানুষের নাগালের বাইরে। কিন্তু মানুষ জানে যে স্বর্গ সুখের স্থান। আর নরক কষ্টের স্থান। মানুষ একে অপরের প্রতি ভালবাসা আর সহানুভূতি দিয়ে এ পৃথিবীতেই স্বর্গ সুখ ভোগ করতে পারে। আর যদি তা না করে তারা সর্বদা দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও লোভ-লালসায় ব্যস্ত থাকে তবে এ পৃথিবীটাই নরকে পরিণত হবে।
৮।
সিন্ধু তীরে বসি শিশু খেলে বালু নিয়ে খেলা,
বাস গৃহে হাসি মুখে ফিরে সন্ধ্যা বেলা।
জননীর অংকেপিরে প্রাতে ফিরে আসি
হেরে তার গৃহখানি কোথা গেছে ভাসি।
আবার গাড়িতে বসে— সেই তার খেলা
ভাঙ্গা আর গড়া নিয়ে কাটে তার বেলা।
এ যে খেলা হায় তার আছে কিছু মানে?
যে জন খেলায় খেলা-সেই বুঝি জানে।
সারমর্ম : ভাঙ্গা আর গড়া নিয়েই মানুষের জীবন। এ পৃথিবীর সর্বত্রই ভাঙ্গা-গড়ার খেলা চলছে। এ খেলার অর্থ আপাত দৃষ্টিতে বোধগম্য নয়। তবে যে বিধাজ্ঞা এ ভাঙ্গা গড়ার পশ্চাতে রয়েছেন তিনি হয়তো তার তাৎপর্য বুঝেন।
৯।
পরের মুখে শেখা বুলি পাখির মত কেন বলিস?
পরের ভঙ্গি নকল করে নটের মত কেন চলিস?
তোর নিজস্ব সর্বাঙ্গে তোর দিলেন ধাতা আপন হাতে,
মুছে সেটুক বাজে হলি, গৌরব কি বাড়ল তাতে?
আপনারে যে ভেঙে চুরে গড়তে চায় পরের ছাঁচে,
অলীক, ফাঁকি, মেকি সে জন, নামটা তার কদিন বাঁচে?
পরের চুরি ছেড়ে দিয়ে আপন মাঝে ডুবে যা রে,
এখাঁটি ধন যে সেথায় পানি, আর কোথাও পাবি নারে।
সারমর্ম : অন্ধ অনুকরণে নয়, নিজস্বতার বিকাশেই প্রকৃত গৌরব। বিশ্ববিধাতা সকলের মধ্যে যে বৈশিষ্ট্য দান করেছেন সেগুলোকে উপেক্ষা করে পরানুকরণে বাস্ত হলে নিজের অগৌরবকেই বাড়ানো হয়। তাই পরানুকরণের মোহ ত্যাগ করে আত্মানুসন্ধান ও নিজের স্বাভাবিক গুণগুলোর বিকাশ সাধন করা উচিত।
১০।
বহুদিন ধরে বহুক্রোশ দূরে
বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে
দেখিতে গিয়াছি পর্বতমালা
দেখিতে গিয়াছি সিন্ধু।
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শিষের উপরে –
একটি শিশির বিন্দু।
সারমর্ম : সৌন্দর্যের অনুসন্ধানে দূরে যাওয়া নয়, চোখের সামনেই বিশ্ব প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য দু’চোখ ভরে উপলব্ধি করা যায়। দূরের সমুদ্র ও পর্বতের সৌন্দর্য দর্শনের জন্য দূরদেশে গিয়ে বাহুল্য ব্যয়ের কোন প্রয়োজন নেই। দেখতে জানলে কাছের প্রান্তরে ধানের শীষের উপর শিশির বিন্দুর মত তুচ্ছাতিতুচ্ছ বস্তুর মাঝেও সৌন্দর্যের সন্ধান পাওয়া সম্ভব।
১১।
পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি
এ জীবন মন সকলই দাও।
তার মত সুখ-কোথাও কি আছে?
আপনার কথা ভুলিয়া যাও।
পরের কারণে মরণেও সুখ,
সুখ সুখ করি কেঁদ না আর,
যতই কাঁদিবে ততই ভাবিবে,
ততই বাড়িবে হৃদয় ভার।
আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে
আসে নাই কেহ অবণী পরে
সকলের তরে সকলে আমরা
প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।
সারমর্ম : পরার্থে জীবন বিসর্জন করার মত সুখ আর নেই। জীবনের উদ্দেশ্য স্বার্থপরতা নয়। অন্যের দুঃখের বোঝা লাঘব করবার জন্য মানুষ এই সংসারে জন্মগ্রহণ করেছে। অতএব, পরের মঙ্গলের জন্য আত্মনিয়োগ করা উচিত। এতে মানব জীবন সার্থক হবে।
১২।
বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর সবার আমি ছাত্র
নানাভাবে নতুন জিনিস শিখছি দিবারাত্র।
এই পৃথিবীর বিরাট খাতায় পাঠ্য যে সব পাতায় পাতায়
শিখছি সে সব কৌতূহলে সন্দেহ নাই মাত্র।
সারমর্ম : বিশ্বপ্রকৃতি শিক্ষার সর্ববৃহৎ বিদ্যাপীঠ। যা কিছু দৃশ্যমান, তার প্রতি অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে কৌতূহল সহকারে লক্ষ করলে প্রচুর জ্ঞানের উপকরণ খুঁজে পাওয়া যায়।
১৩।
সার্থক জনম মোর জন্মেছি এই দেশে,
সার্থক জনম মাগো, তোমায় ভালবেসে।
জানিনে তোর ধন রতন আছে কিনা রাণীর মতন,
শুধু জানি, আমার অঙ্গ জুড়ায় তোমার ছায়ায় এসে।
কোন বনেতে জানিনে ফুল, গন্ধে এমন করে আকুল,
কোন গগনে উঠেরে চাঁদ এমন হাসি হেসে
আঁখি মেলে তোমার আলো প্রথম আমার চোখ জুড়ালো
আলোতে নয়ন রেখে মদুবো নয়ন শেষে।
সারমর্ম : বাংলাদেশ আমাদের মাতৃভূমি। এদেশকে ভালবেসে আমাদের জন্য সার্থক। ধনরত্ন না থাকলেও এদেশ আমাদের প্রিয়। এদেশের বাতাসে প্রাণ জুড়ায়। আকাশের চাঁদ, বনের ফুল মন আকুল করে। জন্মগ্রহণ করে এদেশের সুন্দর রূপ আমরা দেখেছি। আবার এদেশের সৌন্দর্য দেখে একদিন এ মাটিতেই শেষ শয্যা নেব।
১৪।
মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে
মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।
এই সূর্যকরে, এই পুষ্পিত কাননে,
জীবন্ত হৃদয় মাঝে যদি স্থান পাই।।
ধরার প্রাণে খোলা চির তরঙ্গিত
বিরহ মিলন, কত হাসি, অশ্রুময়
মানুষের সুখে দুঃখে গাথিয়া সঙ্গীতে
যদিগো রচিতে পারি অমর আলয়।
তা যদি না পারি তবে বাঁচি যতকাল
তোমাদেরই মাঝখানে লভি যেন ঠাঁই,
তোমরা ভুলিবে বলে সকাল বিকাল
নব নব সংগীতের কুসুম ফুটাই।
সারমর্ম ঃ পার্থিব জীবনের প্রতি মানুষের আকাঙ্ক্ষা চিরন্তন। পৃথিবীর সূর্যকর, পুষ্পিত কানন, জীবনের স্নেহ প্রীতি সবই মানুষকে আকর্ষণ করে তীব্রভাবে। পৃথিবীর বুক জুড়ে মানুষ বেঁচে থাকতে চায় চিরকাল। বেঁচে থাকার সেই আকাক্ষাতেই বিরহ-মিলন, সুখ-দুঃখের সঙ্গীত রচনায় মানুষ প্রার্থনা করে চির অমরতার।
আরও পড়ুন: