নারী শিক্ষার গুরুত্ব ও প্রয়োজন উপস্থাপনের জন্যে ভাষণ রচনার একটি নমুনা তৈরি করে দেয়া হল। আগ্রহীরা এখন থেকে ধারণা নিয়ে নিজের ভাষায় নিজস্ব ভাষণ তৈরি করবেন।
নারী শিক্ষার গুরুত্ব ও প্রয়োজন উপস্থাপনের জন্যে ভাষণ রচনা
নারী শিক্ষার গুরুত্ব ও প্রয়োজন’ শীর্ষক মহতী অনুষ্ঠানের সম্মানিত সভাপতি, মাননীয় প্রধান অতিথি, মঞ্চে উপবিষ্ট সম্মানিত আলোচকবৃন্দ এবং উপস্থিত সুধীবৃন্দ — আস্সালামু আলাইকুম । আজ নবযুগের নবীন প্রভাতে দিকে দিকে নারী প্রগতির জয়ধ্বনি ঘোষিত হচ্ছে। নারী এতকাল ছিল পুরুষের ওপর নির্ভরশীল। নারীর কোনো স্বতন্ত্র সত্তা স্বীকৃত ছিল না। নারীর পরিচয় ছিল কখনো কন্যারূপে, কখনো ভগ্নীরূপে, কখনো পত্নীরূপে, কখনো মাতারূপে। সর্বত্রই ছিল তার গলগ্রহতা ও অসহায়তার প্রকট রূপ।
সুখের বিষয়, নারী আজ আর সেই বিগত শতাব্দীর অন্ধকারাচ্ছন্ন অন্তঃপুরে মৌনম্লান মুখে বসে নেই। সে সেই আলোহীন, প্রাণহীন দুর্ভেদ্য অন্তরাল থেকে বের হয়ে আজ আলোকিত জগতের উদার প্রাঙ্গণে এসে দাঁড়িয়েছে। আজ আমরা বুঝতে পেরেছি, নারী ও পুরুষ সমাজ – .. জীবনের দুটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। সমাজ গঠনে উভয়েরই সমান ভূমিকা রয়েছে। দেশ ও জাতির সার্বিক উন্নয়নের জন্যে নারী-পুরুষ উভয়কে সমান পদক্ষেপে অগ্রসর হতে হবে। তাই পুরুষের পাশাপাশি নারীরও শিক্ষার যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে।
সুধীবৃন্দ, আপনারা নিশ্চয়ই অবগত যে, আমাদের দেশের নারীসমাজ যুগ যুগ ধরে পুরুষের হাতের পুতুল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। শিক্ষাদীক্ষায়, অভিজ্ঞতায় এবং মননের উৎকর্ষে তারা অনেক পিছিয়ে রয়েছে। কিন্তু আমাদের এ বৃহত্তর নারীসমাজকে যথার্থ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে পারলে তারা আমাদের জাতীয় জীবনে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে সক্ষম হত। এর প্রমাণ আমরা পেয়েছি ‘৫২-এর ভাষা আন্দোলনে, যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে, ‘৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে এবং ‘৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে। সুধী, একজন সুশিক্ষিত মাতাই তাঁর সন্তানকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে নিজ আদর্শে গড়ে তুলতে পারেন। শিশুর জীবনে জননীর শিক্ষা ও প্রগতিশীলতার প্রভাব অনস্বীকার্য। এ জন্যই নেপোলিয়ান বলেছিলেন, “আমাকে একটি শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের একটি শিক্ষিত জাতি উপহার দেব।”
কিন্তু আমাদের নারীসমাজ শিক্ষা গ্রহণের পরিপূর্ণ সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে না। কারণ কুসংস্কার ও ধর্মীয় গোঁড়ামির বেড়াজালে আবদ্ধ এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ। আপনারা জানেন আমাদের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকই হলো নারী। এই বিপুল সংখ্যক নারীকে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের স্রোতের বাইরে রেখে দেশ ও জাতির উন্নতি কখনোই সম্ভব নয়। আমাদের বুঝতে হবে এবং স্মরণ রাখতে হবে যে, সমাজের অর্ধাংশ এই নারী জাতিকে বহির্বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে অজ্ঞানতার অন্ধকারে নিমজ্জিত রাখা কেবল সামাজিক অপরাধই নয়, আত্মহত্যার শামিল।
কেবল নারীজাতির প্রয়োজনেই নয়, পুরুষের প্রয়োজনে— সমাজের সামগ্রিক প্রয়োজনে নারীজাতির উপযুক্ত শিক্ষাদীক্ষা, মুক্ত মানসিকতা আজ অপরিহার্য হয়ে দেখা দিয়েছে। তার মধ্যে নারী শিক্ষার গুরুত্ব সর্বাদিক। সুধীবৃন্দ, আপনারা নিশ্চয়ই অবগত যে, আমাদের সুমহান সংবিধানের কয়েকটি অনুচ্ছেদে স্পষ্টভাবে নারীর অধিকারকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। ২৮ এর ১, ২ ও ৪ নং অনুচ্ছেদ বলা হয়েছে— ‘রাষ্ট্র ও জনজীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষের সমঅধিকার লাভ করবেন।
নারী বা শিশুদের অনুকূলে কিংবা নাগরিকদের যে কোনো অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য বিশেষ বিধান প্রণয়ন করতে কোনো কিছুই রাষ্ট্রকে নিবৃত করবে না। অর্থাৎ অনগ্রসরমান নারীসমাজকে উন্নতির স্বার্থে রাষ্ট্র নারীকে কোনো বিশেষ সুবিধা দিলে তা বৈষম্য বলে বিবেচিত হবে না।’
তাই নারীদের গুরুত্বের কথা বিবেচনা করেই নারীশিক্ষাকে অগ্রাধিকার দেওয়া আমাদের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব ও কর্তব্য। বাংলাদেশে কেবল মানবেতর অবস্থা থেকে নারীর মুক্তি বা নারী উন্নয়নের জন্যই নয়, সম্পদের উপর নিয়ন্ত্রণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণসহ সকল ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণকে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হচ্ছে। সুধী, স্বাবলম্বী হওয়া যে কোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের নারীসমাজ আজ স্বাবলম্বী হয়ে ঘরে বসে কিংবা বাইরে গিয়ে জামা-কাপড় সেলাই, সূচিকাজ, বাঁশ ও বেতের বিভিন্ন সামগ্রী তৈরি করে পরিবারের ভরণপোষণের ব্যবস্থা করছে।
একদিকে যেমন ব্যাপক হারে নারী কর্মজীবনে ছড়িয়ে পড়েছে অন্যদিকে তেমনি সবধরনের পেশায় নারী রাখছে তার সফলতার স্বাক্ষর। বিমানের পাইলট থেকে শুরু করে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, জজ, ম্যাজিস্ট্রেট, উকিল, দারোগা, পুলিশ, শিক্ষক, চলচ্চিত্র নির্মাণ, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী, প্রশাসক, মডেলিং, ফ্যাশন •ডিজাইনিংসহ এমন কোনো পেশা নেই যেখানে নারীরা তাদের মর্যাদাপূর্ণ উপস্থিতি ঘোষণা করে নি।
‘চোখে চোখে আজ চাহিতে পারো না / হাতে রুলি
পায়ে মল মাথার ঘুমটা ছিঁড়ে ফেলো নারী / ভেঙে ফেলো
সে শিকল যে ঘোমটা তোমায় করেছে ভীরু উড়াও সে আবরণ’-
সুধীমণ্ডলী, আমরা সবাই জানি, আমাদের দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন দুজন মহিলা। তারা উভয়েই জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে সরকার প্রধানের দায়িত্ব পালন করেছেন। ‘যে হাত দোলনা দোলায়, সেই হাতই বিশ্ব শাসন করে।’ তাই নারীর অমর্যাদা করে, তার প্রতি বৈষম্য জিইয়ে রেখে এবং তাকে শোষণের শিকার বানিয়ে পারিবারিক শান্তি, সামাজিক অগ্রগতি কিংবা জাতীয় উন্নতি কোনোটাই সম্ভব হবে না। নারীকে দেখতে হবে মানুষ হিসেবে। নারী এবং পুরুষের মাঝে প্রকৃতিপ্রদত্ত পার্থক্য যেমন স্বাভাবিক, তেমনি মানবসৃষ্ট বৈষম্য অপরিসীম। নারীমুক্তির পথ খুঁজতে হবে দেশ ও সমাজের বাস্তবতায়, জাতির মূল্যবোধ ও ঐতিহ্যের মাঝে।
সুধী, আজ আমরা উপলব্ধি করতে পারছি যে, নারীশিক্ষার প্রসার ঘটানো অত্যন্ত জরুরি। আর এ ক্ষেত্রে সফলতার জন্যে প্রয়োজন দেশে নারী শিক্ষার্থীর অনুপাতে প্রয়োজনীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, মেয়েদের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, বয়স্ক নারীদের শিক্ষার জন্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ, সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি, সরকার ও সংশ্লিষ্ট মহলের উদারনীতি ইত্যাদি। তাই একটি আদর্শ জাতি গঠনের জন্যে নারীদেরও পুরুষের মতো শিক্ষার সুযোগ-সুবিধা প্রদান করতে হবে। আমরা চাই, শিক্ষায় দীক্ষায়, কৃষ্টি ও সংস্কৃতিতে একটি সুখী সমৃদ্ধ আদর্শ পরিবার রচনায় নারীর ভূমিকা হবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
কাজেই সে-ক্ষেত্রে নারীশিক্ষা প্রসারের গুরুত্ব সন্দেহাতীত। মোট কথা, আমাদের সমাজে আমরা চাই আদর্শ জননী, চাই আদর্শ পত্নী, চাই আদর্শ কন্যা- আদর্শ জীবন ও সমাজ গঠনে চাই উপযুক্ত নারীশিক্ষা। আর এজন্য পুরুষকে অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে। একই সঙ্গে নারীকে হতে হবে সচেতন ও আত্মবিশ্বাসী। নিজের মর্যাদা ও করণীয় তাকেই উপলব্ধি করতে হবে সর্বপ্রথমে। তাই আসুন নারীকে আর অবেহেলা নয়, বরং কবি নজরুলের কণ্ঠে সবাই কণ্ঠ মিলিয়ে বলি— ‘বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর/ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।’ ধন্যবাদ। ধন্যবাদ সবাইকে।
আরও দেখুন:
- নারী শিক্ষার গুরুত্ব নিয়ে প্রতিবেদন রচনা | The importance of women’s education
- যুব সমাজের অবক্ষয়ের কারণ ও প্রতিকার সম্পর্কিত ভাষণ | ভাষণ | ভাষা ও শিক্ষা
- বাংলা বানান সংস্কার | বাংলা বানান ও বানানের নিয়ম | ভাষা ও শিক্ষা
- সাম্প্রদায়িক সহিংসতা অমার্জনীয় শীর্ষক আলোচনা সভার ভাষণ রচনা | ভাষণ | ভাষা ও শিক্ষা
- মাদকদ্রব্যের ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে ভাষণ রচনা | ভাষণ | ভাষা ও শিক্ষা
- আমনে বাম্পার ফলন হবে,খাদ্য সংকট হবে না , পেঁয়াজ রপ্তানিও করতে পারব- কৃষিমন্ত্রী